রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি
রসায়নের প্রকৃতি
এরিক শেরি
অনুবাদ: স ম আজাদ
খোদ রসায়নের প্রকৃতিটাই আমাদের নিকট উপস্থাপন করে একটি টেনশন। একদিকে পদার্থসমূহের বৈচিত্রময়তা ও রূপ, আর একদিকে মৌলিক ঐক্যের ( fundamental unity) নিরাপত্তা- এই দুইয়ের মধ্যকার টেনশন। এমনকি রসায়নের সাম্প্রতিক ইতিহাসও কেবলমাত্র এই টেনশন নিয়েই। ঊনিশ শতকে প্রাউটের হাইপোথেসিস নিয়ে বিতর্ক, তাহলো এই যে প্রাথমিক বস্তু (primary matter) আছে কিনা। অধিকতর সাম্প্রতিক অনুমান হলো কম্পিউটার আমাদের সামর্থ যোগায় কিনা যাতে আমরা ভার্চুয়ালি পরিক্ষণ রসায়ন (experimental chemistry) ছাড়া চলতে পারি।
বহুত্ববাদ ও ঐক্য (plurality and unity)- এই দুটি বিষয়ের মধ্যকার টেনশন এমন একটি বিষয় যার সাথে রসায়নবিদ হতে চাওয়া মানুষজন বসবাসে সক্ষম।যাদের ঐ বিষয়ের জন্য ঝোঁক থাকে না, তারা পদার্থবিজ্ঞান বা এরকম একটা কিছুর দিকে আকৃষ্ট হন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃতি অনুধাবন করতে যারা চেষ্টা করেন, সেই দর্শকদের নিকট রসায়ন উপস্থাপন করে একটি অপরিহার্য দার্শনিক প্যারাডক্স, সেটি হলো কীভাবে “অনেক এবং এক” (many and one) সহ-অবস্থান করে (co-exist)। ফরাসি দার্শনিক-রসায়নবিদ Gaston Bachelard এই অবস্থা বর্ণনা করেন তাঁর প্রথমদিকের একটি বইয়ে। এই বইয়ের শিরোনাম Le Pluralisme Coherent de la Chimie Moderne।
রসায়ন
শিক্ষকদের নিকট এই টেনশন যা আমি উল্লেখ করেছি তা কীভাবে রসায়নকে উপস্থাপন করা উচিত
সেইসব বিতর্কের কেন্দ্রে অবস্থান করে । পদার্থসমূহ ও বিক্রিয়াগুলোর নিছক বৈচিত্র
(sheer diversity) দিয়ে আমাদের শুরু করা উচিত কিনা, গুণগত রসায়নে গুরুত্বারোপ করে অথবা
আগে আমাদের সমন্বয়ক তত্ত্বসমূহ (unifying theorues) রাখা উচিত কিনা, এবং কেবলমাত্র
তারপর রাসায়নিক ঘটনাগুলো এই সাধারণ তত্ত্বগুলোতে ঝুলিয়ে দেব কিনা? এই ইস্যুগুলো নিয়ে
ঊনিশ শতকে সক্রিয়ভাবে বিতর্ক হতো যখন রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছিল। আজকের দিনে এই ইস্যুগুলোতে প্রত্যক্ষ আলোচনা সামান্যই শুনতে পাই, যদিও
সকল গভীর দার্শনিক প্রশ্নাবলীর মতই বহু ও এক-এর (many and one) প্রশ্নটিও অনেক সুনির্দিষ্ট
ইস্যুর গভীরে নিহিত যেন তারা সবগুলোই সম্পূর্ণ কেজো প্রকৃতির (practical nature) ।
সতেরো শতক থেকে ঊনিশ শতকে রসায়ন দর্শন এবং রাসায়নিক দর্শন (Philosophy of chemistry and Chemical philosophy)- পদ দু’টি থেকে থেকেই ব্যবহৃত হতো বই ও প্রবন্ধাবলীর (books and treatises) শিরোনামে, কিন্তু বর্তমান সময়ে এই পদ দু’টির খুব কমই উল্লেখ দেখা যায়। বিজ্ঞান দর্শন হলো বিজ্ঞানের প্রকৃতির একাডেমিক অধ্যয়ন। এই বিজ্ঞান দর্শনেও রসায়নের বিভিন্ন দার্শনিক দিকগুলো উপেক্ষিত বলে প্রতীয়মান । রামায়নিক বিজ্ঞান (chemical science) কর্তৃক উত্থাপিত সমস্যাবলীর প্রকরণসমূহের প্রতি নিবেদিত কোনো সাব-ডিসিপ্লিন অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সময়েও ছিল না।
কিন্তু কোনো বিজ্ঞানকেই সম্পূর্ণরূপে এর দার্শনিক ও ঐতিহাসিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, এবং এমনকি যদি অনুশীলনরত রসায়নবিদ কখনো মনে করেন যে এই দিকগুলোর পালন করার মত ভূমিকা নেই, এটি স্পষ্টতই অদূরদর্শী। যাই ঘটুক না কেন বিজ্ঞানের দার্শনিকবৃন্দের জন্য কোনো অজুহাত নেই যদি তারা রসায়নের দার্শনিক প্রকৃতিকে যদি সাদামাটাভাবে অবজ্ঞা করেন, সার্বিকভাবে বিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করতে যেয়ে। বৈচিত্র্যময়তা আক্ষরিকভাবেই প্রতীয়মান হয় ‘অবরোহিত’ (reduced) হিসেবে। ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে অবরোহের অর্থ করা যেতে পারে খোদ সিস্টেমের ছোট ছোট অংশে ভাঙ্গন (the very act of breaking up a system into smaller pieces) যাতে এর অংশগুলো পরীক্ষণ করা যায় এবং এইভাবে সিস্টেমের গভীরতর উপলব্ধি অর্জন করা যায়। এখানে অবরোহের ধারণাকে প্রায় বিশ্লেষণের সমার্থক বলে গণ্য করা যায়, এবং এটি আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের বিশুদ্ধ মননশীল দৃষ্টিভঙ্গির (purely contemplative approach) বিপরীতে। বিজ্ঞানে কাজ করেন এমন যেকেউ আদতে অবরোহ অনুশীলন করেন, অর্থাৎ সমগ্র সিস্টেম উপলব্ধির আশায় অংশসমূহের বিশ্রেষণ অনুশীলন করেন। যাহোক এই দৃষ্টিভঙ্গি (approach) সম্পূর্ণ সফল কিনা সেটি আর একটি প্রশ্ন। এবং একজনের পছন্দ অথবা ভিন্নভাবে অবরোহমূলক দৃষ্টিঙ্গির জন্য অবশ্যি একজনকে বিষয়ীগত পছন্দের জগতে (in the realm of subjective choice) চুড়ান্তভাবে থাকতে হবে। যাহোক কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে অংশগুলোর বিশ্লেষণ দ্বারা অবরোহিত করার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে সফল হতেও পারে আবার নাও পারে, কিন্তু প্রচেষ্টাগুলো সবসময় উৎপাদনশীল এই অর্থে যে এগুলো দরকারী আনুষাঙ্গিক লাভের যোগান দেয়। যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি অবরোহ বলছি তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে ক্ষুদ্রতম অংশগুলোর বিশ্লেষণ, আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে অনিঃশেষ অনুসন্ধান যদিও প্রায়ই উচ্চারিত হয় যে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছি অথবা এমনকি বিজ্ঞানের চুড়ান্ত পর্যায়ে। যদি অতিরিক্ত ব্যয় জড়িত না থাকতো তবে প্রাথমিক কণা পদার্থবিজ্ঞান (elementary particle physics) ক্রমান্বয়ে অধিকতর সুক্ষ্ম পর্যায়ে বস্তু ও শক্তি পরীক্ষণ অব্যাহত রাখতো এবং এভাবে প্রাপ্ত জ্ঞান অবশেষে ‘ঊণ মৌলিক’ (less fundamental) বিজ্ঞান যেমন কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান (solid state physics), কোয়ান্টাম রসায়ন, আণবিক জীববিজ্ঞান ইত্যাদিতে চুইয়ে পড়তো। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ সুপারিশ করে যে দুর্বল নিউক্লিয় বলে সমতা লঙ্ঘন (parity violation) দায়ী হতে পারে প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া অধিকাংশ কাইরাল যৌগে d ও l রূপের পরিমাণে অপ্রতিসমতার জন্য (for the asymmetry)।
আর একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় সাম্প্রতিক আণবিক জীববিজ্ঞানে, যেখানে বর্তমানের ঝোঁক (current obsession) মানব জিনের অন্বেষণে (search for the human genome)। এখানে চিন্তন (thinking) মনে হয় এই যে একবার জিন পুরোপুরি নির্ণয় হয়ে গেলে আমরা পৌঁছে যাবো শেষ সীমায় (at rock bottom) এবং জীববিজ্ঞান মূলত সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। অবশ্যি এই প্রকারের চিন্তন সরকারী এজেন্সিসমূহের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য অংশত প্রচারণা (partly propaganda)। একবার মানব জিনের সম্পূর্ণ ম্যাপ হয়ে গেলে, অথবা এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চালু থাকলে, এটি স্পষ্ট হবে যে গভীর পর্যায়ে সংগঠন ও তথ্যের একটি সামগ্রিক নয়া জগৎ নিহিত, যা আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে এবং অধিকতর ভালো চিকিৎসা, জীববিজ্ঞানীয় এবং সম্ভবত এমনকি সামাজিক বেনিফিটের প্রতিশ্রুতি অফার করে।
অধিপদার্থবিজ্ঞান ও অধিরসায়ন
(Metaphysics and metachemistry)
দর্শনে ঐতিহ্যিকভাবে অধ্যয়নকৃত এলাকারগুলোর একটি অধিপদার্থবিজ্ঞান, এটির উদ্দেশ্য কী অস্তিত্বমান তা আবিষ্কার করা, উদাহরণস্বরূপ ঈশ্বর অথবা অন্যকোনো পরা-অস্তিত্ব (supreme being) অস্তিত্বমান কিনা, দুনিয়াতে কি কি সত্তা অস্তিত্বমান এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রশ্নগুলো প্রয়োজনগতভাবে পরীক্ষণমূলক তদন্তের উপর (on empirical investigations) নির্ভর করে না এবং এজন্য বিজ্ঞানীগণ কর্তৃক তা অনুমোদন না দেয়ার প্রবণতা প্রদর্শিত হয়, কারণ নিজেদের পর্যবেক্ষণমূলক ডাটার (observational data) উপর তাদের দৃঢ় ভিত্তির অহং থাকে।
কিন্তু
আধুনিক বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদর্শিত এই দৃষ্টিভঙ্গি স্বয়ং তাদের পক্ষ থেকে একটি দার্শনিক
কুসংস্কার থেকে উদ্ভূত এবং এটি এখন বরং সেকেলে। বিশ শতকের প্রথম ও মধ্য ভাগে সমৃদ্ধ
লাভকৃত দর্শনের লজিক্যাল পজিটিভিস্ট স্কুল থেকে, অংশত, এটি উদ্ভূত বলে মনে করা হয় এবং অর্থহীন বলে সকল মেটাপদার্থবিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ
নির্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়। যাহোক, সকল বিজ্ঞানের জন্য একটি পর্যবেক্ষণগত ভিত্তি
(observational base) যোগানের লজিক্যাল পজিটিভিস্ট কর্মসূচী ব্যর্থ হয়েছে বিভিন্ন টেকনিক্যাল
কারণের জন্য, যা এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে না। প্রাথমিকভাবে (initially) অন্যদের
মধ্যে কুইন (Quine), পপার (Popper), কান (Kuhn), ফেইরাবেন্ড (Feyerabend) ও ল্যাকাটোস
(Lakatos) কর্তৃক লজিক্যাল পজিটিভিজম ও লজিক্যাল ইমপিরিওসিজমের সমালোচনার অনুসরণে,
দার্শনিকবৃন্দ ও বিশেষ করে বিজ্ঞান দার্শনিকবৃন্দ অধিকতর প্রবণতা প্রদর্শন করেন মেটাফিজিক্যাল
বিষয়াবলী (questions) অনুসরণ করতে।
প্রকৃতপক্ষে
সাম্প্রতিক সময়ে রাসায়নিক চিন্তায় (in recent chemical thought) কিছু এলাকা আছে, যা
প্রাথমিকভাবে মেটাফিজিক্যাল ইস্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট, যদিও এটা স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়নি।
অনুরণন (Resonance)
উদাহরণস্বরূপ, হাইজেনবার্গের প্রথম দিককার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে লিনাস পাউলিং কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল অনুরণনের ধারণা (notion) বিকশিত করেন। ১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে এই ধারণার ওপর গুরুতর বৈজ্ঞানিক বিতর্ক তৈরী হয়। পাউলিং-এর যোজ্যতা বন্ধন তত্ত্বে অনুরণন কাঠামো-এর (resonance structure) প্রস্তাব করা হয়েছে। বিতর্কটির কেন্দ্রবিন্দু- এই অনুরণন কাঠোমের অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষেই আছে কিনা। স্পষ্টত এই বিতর্কটি ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক অনুঘটক (factor) দিয়ে অনুপ্রাণিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারী পলিসি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে সমর্থন থেকে এই রাজনৈতিক অনুঘটকটির উৎপত্তি। এই দার্শনিক অবস্থান (philosophical position) মনে হয় অনুরণনিত রাসায়নিক কাঠামের জন্য (for resonating chemical structure) স্থান রাখেনি। কিছু ব্যাখ্যা অনুসারে এটির প্রকৃতপক্ষে ‘অস্তিত্ব’ নেই। এই ইস্যুটির কিছু দার্শনিক বিশ্লেষনের যোগান দেন ভ্যান মীরেন ও হারগিট্টাই (Van Meeren, 1986, Hargittai, 1995)।
অরবিটাল
কয়েক
বছর আগে ওগিলভাইয়ের একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পর রাসায়নিক শিক্ষা জার্নালে একটি
বির্তকের উদ্ভব হয় (a controversy erupted)। এই আর্টিকেলের সাবটাইটেলে তিনি দাবী করেন
যে “অরবিটাল বলে কোনকিছু নাই” (Ogilvie, 1990)। এই আর্টিকেলটি ছিল অংশত পাউলিং-এর দৃষ্টিভঙ্গির
ওপর আক্রমণ। ওলগিয়ে দাবী করেন যে রসায়ন যেভাবে পড়ানো হয় তাতে পাউলিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি
সমস্যার কারণ জারি রেখেছিল। এই আর্টিকেলটি অনেকগুলো প্রত্যুত্তর প্ররোচিত করেছিল স্বয়ং
পাউলিং-এরটি সহ যাতে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে বিরতিহীনভাবে সমর্থন করেন (Pauling,
1992, Scerri, 1992, Scott, 1992)।
সবচেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স এবং শ্রডিঙ্গারের তরঙ্গ মেকানিক্সসহ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেকগুলো ফরমুলেশন আছে- ওগিভাইয়ের অরবিটালের অনস্তিত্বের জন্য প্রধান দাবী ছিল এই ফরমুলেশনগুলোর ওপর নির্ভরতার প্রতীয়মানতা। ওগিলভাইয়ে মনে করতেন যে অরবিটালকে মৌলিক বলে গণ্য করা যায় না কারণ তারা কেবলমাত্র এই ফরমুলেশনদ্বয়ের একটি যেমন শ্রডিঞ্জারের তরঙ্গ মেকানিক্স থেকে উদ্ভব হয়েছে। যাহোক, তাঁর দীর্ঘ ও বিস্তারিত আর্টিকেলে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন যেটি অরবিটালের অস্তিত্বকে এমনকি শ্রডিঞ্জার ফরমুলেশনের মধ্যেই অনাবশ্যক হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি ঘটে কারণ বহু-ইলেকট্রন পরমাণুতে কোয়ান্টাম সংখ্যার আরোপণ কঠোরভাবে অকার্যকর। “অরবিটাল বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই”- তাঁর এই বিস্ময়কর উপশিরোনামে মনোসংযোগের পরিবর্তে ওগিলভাইয়ে অগ্রসর হন মিথেনের মত অণুতে হাইব্রিড অরবিটালের প্রকৃত অস্তিত্বের জন্য পরীক্ষণীয় প্রমাণের অভাবের দিকে।
একই জার্নালের একটি পরবর্তী ইস্যুতে ওগিলভাইয়ের প্রতি পাউলিং-্র প্রতি-উত্তরে অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রধানত একটি ad hominem প্রত্যাঘাত যাতে তিনি ওগিলভাইয়ের কোয়ান্টাম মেকানিকস উপলব্ধির ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। অরবিটাল অস্তিত্বমান নয়-ওগিলভাইয়ের এই দাবীর প্রত্যুত্তরে পাউলিং বরং আগ্রহোদ্দীপক মন্তব্য করেন। তাহলো-
“অরবিটাল হিসেবে কোন জিনিস নেই”- ওগিলভাইয়ে পেপারের এই উপশিরোনামে অন্তর্ভুক্ত আছে “জিনিস” (thing) শব্দের অর্থের একটি অপ-ধারণা (a misconception)। জিনিসের আভিধানিক সংজ্ঞাসমূহের একটি হলো এই যে “যেকোনো কিছু যা চিন্তার বিষয় বা চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পারে;” অন্যকথায়, একটি জিনিসের শরীরী হওয়ার দরকার নেই, কিন্তু এটিকে একটি প্রতীক দিয়ে উত্থাপন করা যেতে পারে . . । অরবিটালের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল এক্সপ্রেশন্স ফরমুলায়িত করেন ম্যুলিকেন এবং আমি এবং কুড়ির ওপর অন্যান্য তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী, এগুলো স্পষ্টতই চিন্তার বিষয় (object of thought), এবং সুতরাং এগুলো জিনিস (thing) (Pauling, 1992, 520)।
পাওলিংয়ের মন্তবের নির্বুদ্ধিতার তারিফ করাতে একজনের দার্শনিক হওয়ার দরকার নেই। নিশ্চিতভfবেই অবিমিশ্র ঘটনা হলো এ্ই যে যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যায় যে ইউনিকর্ন ও পরী চিন্তার বিষয় (objects of thought objects of thought) হতে পারে, কিন্তু তারমানে এটি এই বোঝায় না যে তারা বাস্তব দুনিয়াতে অস্তিত্বমান। একজন বিস্মিত হতে পারেন যে পাউনিং একটি উপ-শিরোনাম গ্রহণ করেছিলেন যেটি সরাসরি বিবৃত করে যে “অরবিটালসমূহ অস্তিত্বমান নয়”, কিন্তু এটি “বস্তু” নামক শব্দটি পরিহার করে এবং এখন পর্যন্ত ওগিলভাইয়ের অভিপ্রায়কে অনুমোদন দেয়।
এই বিশেষ বিতর্কের সমাপ্তি টানা হয়েছিলো সম্পাদকীয় আদেশ বলে। কীভাবে রসায়ন শিক্ষা দিতে হবে এবং বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিকসকে রাসায়নিক সত্যের পূর্বে স্থাপন করতে হবে কিনা- এই বিষয়গুলো কেমিক্যাল সার্কেলে আলোচনার উৎস হিসেবে অব্যাহত থাকে ((Basolo, Parry, 1980; Bent, 1984,1987; Gallup, 1988; Gillespie et al, 1996; Hudson, 1980; Pilar, 1981; Sanderson, 1986; Scaffrath, 1983; Zuckerman, 1986)। আমি পূর্বের একটি আর্টিকলে রাসায়নিক শিক্ষাবিদদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছি যে রসায়নে ব্যাপকভাবে দৃষ্ট অরবিটালের ধারণা তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিকস দ্বারা অবলিখিত হয়নি, যদিও সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে এই ধারণাটি (concept) তত্ত্বীয় পদার্খবিজ্ঞান অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেকানিকস থেকে উদ্ভূত। আমি ইঙ্গিত দিয়েছি যে পারমাণবিক গঠন ও কোয়ান্টাম মেকানিকসে গুরুত্বারোপনে ভুল করেছিলেন রাসায়নিক শিক্ষাবিদগণ, এইভাবে রসায়নের পূর্বে পদার্থবিজ্ঞানকে স্থাপন করেও। যেহেতু রসায়নবিদগণ কর্তৃক তাদের মনোযোগকৃত অরবিটাল ধারণা প্রকৃত পক্ষে ‘অস্তিত্বমান’ ছিল না (Scerri, 1991)। কিছু বিজ্ঞান দার্শনিক যেমন গুরুত্ব আরোপ করেন, তেমনি আমিও একইভাবে গুরুত্বারোপ করি যে কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে অরবিটাল পদটি নির্দেশিত হয় না। অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে মানে শ্রডিঞ্জার ও হাইজেনবা্র্গের মতে অরবিটালমূহকে বাস্তবিকভাবে গণ্য করা উচিত নয়, যদিও পুরাতন কোয়ান্টাম তত্ত্বে তখন টার্মকৃত অরবিটকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতো। কোয়ান্টাম মেকানিকস ও পারমাণবিক সংগঠনের সম্মোহনী প্রভাবের শিকার হওয়ার থেকে বরং আমি গুণগত ধারণা অনুসারে রসায়ন শিক্ষায় আংশিক প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানাই। সাম্প্রতিক সময়ে আমি এই বিষয়ে একটি নয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনীত হয়েছি,যাতে আমি মনোনিবেশ করবো। সবার আগে এটা প্রতীয়মান হয় যে রসায়নে অরবিটাল ও কনফিগারেশনের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ‘গন্ধ, ঠুংঠুং শব্দ ও রংয়ের উপর ভিত্তি করে রসায়নের নস্টাল্জিক দিনগুলোর প্রত্যাবর্তেনের সুযোগ বর্ধিতভাবে ক্ষীণ বলে প্রতীয়মান। যাহোক, একটা গভীর দার্শনিক কারণ(reason) আছে কেন একজনকে রসায়ন শিক্ষায় অরবিটালের ধারণার প্রতি অনুগত থাকতে হবে, অন্যদিকে একই সাথে কোয়ান্টাম মেকানিকসের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ভুল সংঘটিত করা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি যে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট থেকে পা্ওয়া অবস্থা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমি নিজে সর্বদা দীর্ঘস্থায়ী অবরোহী দৃষ্টিভঙ্গির শীকার হয়ে পড়ি। এই অবরোহী দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে যে পদার্থবিজ্ঞান সকল বিজ্ঞান শাসন করে, অথবা যা কখনো ‘পদার্থবিজ্ঞান সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।এ ধরনের প্রশ্নাবলী বিবেচনা করার অধিকতর আলোকিত উপায় হলো অপ্রীতিকর সিদ্ধা্ন্ত নেয়া (“bite the bullet”) এবং জোর দিয়ে দাবী করা যে পদার্থবিজ্ঞান সাম্রাজ্যবাদই দায়ী (physics imperialism is at fault)। এবং আমি উপরে যেমনটি সুপারিশ করেছি, তেমনিভাবে বলছি যে বিশেষায়িত বিজ্ঞানগুলো স্বাধীন (autonomous)এবং এইভাবে সম্পূর্ণভাবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের সর্বশেষ ঘোষণার ওপর নির্ভরশীল নয় thus not entirely dependent upon the latest pronouncements from theoretical physics (Scerri, 2000)।
গঠন (Structure)
শেষ কিন্তু ন্যুনতম নয়, একটি চলতি বিতর্ক বিদ্যমান আণবিক গঠনকে ঘিরে। আর তা হলো আণবিক গঠনের কোনো বিষয়গত অস্তিত্ব আছে কিনা নতুবা এটি নিছক একটি
উপমা কিনা।
Woolley এবং অন্যান্য লেখকবৃন্দ
সুপারিশ করেন যে আধুনিক রসায়নের কেন্দ্রীয় ধারণা আণবিক গঠন একটি উপমা ছাড়া আর কিছুইনা, এর কোনো বিষয়গত বাস্তবতা
নেই কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল লেভেলে। এই দাবীর ভিত্তি এই ঘটনায় নিহিত যে C3H4-এর
মতন অণুর appropriate Hamiltonian কেবল
মাত্র সেই টার্মগুলো ধারণ করে যেগুলো সিস্টেমে প্রোটনসমূহ ও ইলেকট্রনের সমূহের মধ্যকার
মিথস্ক্রিয়তা বর্ণনা করে। ক্যালকুলেশনে অণুর গঠন অথবা নিউক্লিয়াসগুলোর আপেক্ষিক অবস্থানসমূহ
প্রবর্তন করা হয়েছে কিছুটা কৃত্রিমভাবে, দাবী করা হয় যে এটি করা হয়েছে The
Born-Oppenheimer approximation প্রয়োগ করে। Woolley এবং অন্যান্যরা দাবী করেন যে একটি অকৃত্রিম
কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল (a purely quantum
mechanical) যেটিতে জড়িত আছে অরূপান্তরিত আণবিক হ্যামিলটোনিয়ান (the
raw molecular Hamiltonian). এজন্য
অণুতে কোনো গঠনের আরোপন দরকার নেই (the attribution of ay structure to
molecules)। অধিকন্তু, C3H4এর জানা সমাণুগুলো একই হ্যামিলটোনিয়ান (Hamiltonian) শেয়ার করে এই নিহিতার্থে যে Born-Oppenheirner approximation ছাড়া
একটি খাঁটি কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ক্যালকুলেশন তিনটি স্বতন্ত্র পৃথক গঠনের মধ্যকার
পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে না, যে তিনটি স্বতন্ত্র গঠনের অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস
করা হয়।
সম্পূর্ণ একাডেমিক (purely
academic), যেহেতু যেমনটি Woolley উল্লেখ
করেন যে অনেকগুলো ক্ষেত্র আছে যাতে Born-Oppenheimer approximation ছাড়াই ক্যালকুলেশন করা হয়, এতে যে পূর্বানুমান
(Prediction) পাওয়া যায় তা approximation ব্যবহার
করে অধিকতর প্রচলিত পদ্ধতি (conventional approach) প্রয়োগ করে পাওয়া পূর্বানুমান থেকে অধিকতর সঠিক।
গঠন একটি উপমা ছাড়া আর কিছুই না- এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস জ্ঞাপন করে অধিকসংখ্যক রসায়নবিদ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তখন তাঁরা গঠনের জন্য আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য প্রমানের দিকে ইঙ্গিত করেন যা বর্ণালিমিতিক ও অন্যান্য গাঠনিক গবেষণা (spectroscopic and other structural studies) থেকে আসে। তাঁরা আরও সুপারিশ করেন যে যদি একটি গভীর কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল বিশ্লেষণ দেখায় যে আণবিক গঠন একটি গাণিতিক আর্টিফ্যাক্ট, তখন এই ত্রুটি অবশ্যি এখনকার কোয়ান্টাম মেকানিক্সে নিহিত এবং গঠনের রাসায়নিক ধারণায় নিহিত নয়। মজার ব্যাপার হলো একজন বিজ্ঞান দার্শনিক সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহ্যিক রাসায়নিক দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষ নিয়েছেন, আণবিক গঠনের বাস্তবতা সমুন্নত রেখে। র্যামজে (Ramsey) যুক্তি দেখান যে ওওলি (Woolley) এবং অন্যান্য রাসায়নিক ভিন্নমতালম্বীদের (chemical heretics) কাজের যত্নশীল বিশ্লষণ প্রকাশ করে যে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভুল ব্যাখ্যা করছেন যার অর্থ হলো বৈজ্ঞানিক সত্তাগুলো সম্পর্কে বাস্তববাদী ধারণা পোষণ করা (Ramsey, 1997)।
এটাও উল্লেখ করা উচিত যে বাদের ও সহকর্মীবৃন্দ (Bader and co-workers) একটি গবেষণা কর্মসূচী বিকশিত করেন যাতে তাঁরা আণবিক গঠনের মত ধ্রুপদী রাসায়নিক ধারণার সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বাবলীর সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করেন। দাবী করা হয় যে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে ওওলি ও তাঁর মতন অন্যদের (Woolley and others like him) কর্তৃক উত্থাপিত সমস্যাগুলোর প্রকরণ থেকে কোনো রকম হস্থক্ষেপ ছাড়াই। রসায়ন দার্শনিকগণ কর্তৃক একটি সাবধানী বিশ্লেষণ এই উদীয়মান বিতর্কের ওপর কিছু নয়া আলোক বিচ্ছুরণ করতে পারে কিনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।
এটাও
উল্লেখ করা উচিত যে বাদের ও সহকর্মীবৃন্দ (Bader and co-workers) একটি গবেষণা কর্মসূচী বিকশিত করেন যাতে
তাঁরা আণবিক গঠনের মত ধ্রুপদী রাসায়নিক ধারণার সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বাবলীর
সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করেন (Bader, 1990)।
দাবী করা হয় যে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে ওওলি ও তাঁর মতন অন্যদের (Woolley
and others like him) কর্তৃক উত্থাপিত
সমস্যাগুলোর প্রকরণ থেকে কোনো রকম হস্থক্ষেপ ছাড়াই। রসায়ন দার্শনিকগণ কর্তৃক একটি সাবধানী
বিশ্লেষণ এই উদীয়মান বিতর্কের ওপর কিছু নয়া
আলোক বিচ্ছুরণ করতে পারে কিনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।
উপসংহার
সুতরাং
এমনকি ঠিক মেটাফিজিক্সের এলাকাতে অবস্থান করেও আমরা দেখি অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নসমূহ
যেগুলো তাঁদের নিজেদের সুপারিশ করে রসায়ন দর্শন দ্বারা অধ্যয়নের জন্য (which
suggest themselves for study by philosophy of chemistry)। যদি আমরা আমাদের মনোযোগ দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকের
প্রতি দিতে পারতাম, তাহলে আমরা দেখতে পেতাম আগ্রহোদ্দীপক বিষয়সমূহের (interesting
topics) আর একটি সিরিজ, যেমন রাসায়নিক
তত্ত্বসমূহকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে রূপান্তরণ (reduce) এবং বিজ্ঞান দার্শনিকবৃন্দ কর্তৃক বিকশিত
ব্যাখ্যার তত্ত্বসমূহের ব্যাপকতর প্রেক্ষাপটের মধ্যে রাসায়নিক ব্যাখ্যাসমূহের প্রকৃতি
(Scerri, McIntyre, 1997, Scerri, 1997a, 19978, 1997c, 1997d, Scerri,
1998a, 1998b)। কিন্তু এই জ্ঞানতাত্ত্বিক
ইস্যুগুলো অবশ্যি ভবিষ্যতের প্রবন্ধের জন্য অপেক্ষা করে যেহেতু বিবেচনার জন্য রয়েছে
অনেক উপাদান এবং এটাকে সংক্ষেপে মোকাবেলা করা যায় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন