পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

 

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

 মূল: ডান সয়াইন         অনুবাদ: স ম আজাদ

 
 

 [অনুবাদকের কথা: ডান সয়াইন গ্রেট ব্রিটেনের University of Essex থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন ২০১৫-তে। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল “Marx's Ethics of Self-emancipation”। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ “Alienation: An Introduction to Marx's Theory”। এটি ২০১২-তে প্রকাশ করে ব্রিটেনের সমাজতান্ত্রিক প্রকাশনালয় Bookmarks। তিনি একসময় লন্ডন থেকে প্রকাশিত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের কোয়াটারলি জার্নাল International Socialism-এর সম্পাদনা বোর্ডে ছিলেন। বর্তমানে প্রাগে অবস্থিত চেক ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সাইয়েন্সেস-এ অধ্যাপনা করছেন। এছাড়া চেক একাডেমি অব সাইয়েন্সেস-এ রিসার্চ ফেলো হিসেবেও গবেষণা করছেন। এই গ্রন্থের বাংলা অনুবাদের শিরোনাম দিয়েছি পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা। ডান সয়াইন গ্রন্থটি লিখেছেন এ্যাকটিভিজমের এতিহ্য থেকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের যাত্রা শুরু থেকেই বিছিন্নতা তথা পরকীকণের যাত্রা। দাস সমাজে দাসশ্রেণী সকল মনুষ্য-অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন, অর্থাৎ পরকায়িত ছিলেন। পুঁজিতন্ত্রে দাসশ্রেণী নেই, কিন্তু মেহনতি শ্রেণীর মজুরি-দাসত্ব বিদ্যমান। কাজেই শ্রমিকশ্রেণীর শ্রম প্রক্রিয়া থেকে, তাঁর উৎপন্ন দ্রব্য থেকে বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান। যাহোক, প্রগতি লেখক সংঘ, টাঙ্গাইল শাখার প্রকাশনা প্রগতি-এর পাঠকদের জন্য এই গ্রন্থটির লেখকের ভূমিকা, অধ্যায় এক ও দুই-এর বাংলা অনুবাদ ছাপা হলো। অনুবাদে কোন ত্রুটি থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে ভরসা রাখি।

 
 

 ভূমিকা

 
 পরকীকরণ দিয়ে আমি কি বুঝি আমাকে সবার আগে তার একটা সংজ্ঞা দিতে দিন। এটি মানুষের আর্ত চিৎকার যারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের অন্ধ অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের বলি বলে নিজেদের মনে করে। এটি হলো সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা বঞ্চিত সাধারণ জনগণের হতাশা। হতাশা ও আশাহীনতার অনুভূতি যেটি মানুষকে আক্রান্ত করে (pervade), যারা যুক্তিসহ (with justification) অনুভব করে যে তাদের প্রকৃতই কোনো কিছু বলার নেই তাদের নিজেদের নিয়তিসমূহকে আকার দিতে এবং নির্ণয় করতে।১

ক্লেইডসাইডের ট্রেড ইউনিয়নিস্ট জিমি রেইড গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নির্বাচিত হওয়ার পরে উপরের এই কথাগুলো বলেন। এই বক্তৃতাতে তিনি নিযুত নিযুত মানুষের যাপিত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং নিন্দা করেন, এবং দেখান যে ঠিক একটি দার্শনিক ধারণার থেকেও অধিকতর একটা কিছু হল পরকীকরণ: “অনেকে এটিকে যুক্তিসহভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, এমনকি নাও বুঝতে পারেন, এটিকে স্পষ্ট ভাষায় রূপদান নাও করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা এটি অনুভব করেন”।২

তরুণ জার্মান র‌্যাডিক্যাল কার্ল মার্কস পরকীকরণের এ অবস্থার লক্ষণ নির্ণয় করতে শুরু করেন ১৮৪০-এর প্রথমদিকে, এবং এটি তাঁর সারা জীবন মনোযোগ অধিকার করে রেখেছিল। তাঁর বিকাশকৃত পরকীকরণ তত্ত্ব বর্ণনা করে কীভাবে আমাদের মানব সক্রিয়তা (human acitvity) অভিজ্ঞতা লাভ করে আমাদের থেকে কিছু একটা বহিঃস্থ, পরক (alien) এবং শত্রুপক্ষীয় হিসেবে, এবং তা ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে আমাদের শরীর ও মনে। মার্কস পরকীকরণের এই অভিজ্ঞতাকে মানব অবস্থার অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখেন না, বরং মানব সক্রিয়তা সংগঠিত করার বিশেষ পদ্ধতিসমূহের সাথে সংযুক্ত হিসেবে দেখেন। তাঁর বর্ণনাকৃত পরকীকরণের টাইপ ছিল একটি অর্থনৈতিক সিস্টেমের ফসল, যে সিস্টেমটি তখন তার বিকাশের প্রারম্ভিক অবস্থায় ছিল, কিন্তু  এখন দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব করে: সেটি পুঁজিতন্ত্র।

এই বইটি যখন লেখা হচ্ছিল, তখন ব্রিটেন জুড়ে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। পুলিশ কর্তৃক মার্ক ডুগ্গানকে হত্যার পরে দাঙ্গা উত্তর লন্ডনে শুরু হয়ে অন্যান্য প্রধান নগরীসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গাসমূহের পেছনে অনেক কারণ নিহিত ছিল, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ছিল পুলিশী নির্যাতন ও বর্ণবাদের প্রতি ক্ষোভ, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে সেগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল ব্রিটেনের সবচেয়ে দরিদ্র ও সবচেয়ে অনগ্রসর কিছু এলাকাসমূহে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে পরকীকৃত মানুষেরা দাঙ্গাগুলোতে জড়িত ছিল, চাকুরির সাক্ষাৎকার পাওয়ার চেয়ে যে মানুষগুলোর পুলিশ কর্তৃক বাঁধা ও তল্লাশির সম্ভাবনাই ছিল বেশী। দাঙ্গাগুলোর একজন প্রত্যক্ষদর্শী লক্ষ্য করেন, “এই তরুণদের অনেকে সদাই অনুভব করবে যে তারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত, এটি এই সম্পর্কে। সেটাই প্রকৃত ট্র্যাডেজি”।৩ দাঙ্গাগুলো পরকীকরণ সম্পর্কে মার্কসের ধারণাবলীর অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতা দেখায়। যারা অনুভব করে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং ভবিষ্যৎ নেই তাদের ক্রোধের গর্জন, যারা দেখতে চায়, তাদের নিকট দৃশ্যমান হয়।

দাঙ্গা চলাকালীন সময়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় সংবাদগুলোর একটি ছিলো একজন বিবিসি সাংবাদিক কর্তৃক নেয়া দুজন মহিলার সাথে একটি সাক্ষাৎকার। বিবিসি, সাধারণতঃ, তাদের চিত্রায়িত করতে চেষ্টা করছিল অপরাধী, পাশবিক এবং অজ্ঞ হিসেবে, এবং সামান্য বিদ্রুপাত্মক ধ্বণিতে তাদের উপস্থাপিত করেছিল। যাহোক, তাদের বলা কথাসমূহ একটা গভীর সামাজিক পরকীকরণ প্রকাশ করে। যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তারা দাঙ্গায় লিপ্ত, তারা বলেছিল:

এটা সরকারের ত্রুটি . . . রক্ষণশীলদের . . .। এটা এমনকি দাঙ্গাও নয়, আমরা কেবলমাত্র পুলিশকে দেখাচ্ছি আমরা যা চাই তাই করতে পারি, এবং এখন আমাদের তা আয়ত্বাধীন . . .। এটা হল ধনী জনগন, যে জনগণের ব্যবসা আছে, এবং এই কারণেই এই সবকিছু ঘটেছে, ধণী জনগণের জন্য। এটা ধনীজনগণকে দেখানো সম্পর্কে যে আমরা যা চাই তাই করি।৪

এই নারীদের জন্য এবং তাদের মত শতশত এবং এমনকি হাজার হাজার জনের জন্য, পুলিশ ও ধনীদের চ্যালেঞ্জ জানানোর সংক্ষিপ্ত মুহুর্তগুলো, তাদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের খুব কাছাকাছি, যে জীবন সম্ভবত তারা পেতে চায়। এই কথাগুলোর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল এই যে “তারা যা চায়” তা করতে পারে না। তারা প্ররোচিত হয় বেকারত্ব, বঞ্চণা এবং দারিদ্র্য দিয়ে, এমনকি পুলিশি হয়রানি এবং বর্ণবাদ দিয়ে।

এই বইয়ের উদ্দেশ্য হলো মার্কসের পরকীকরণ সূত্রের ভূমিকা, এর উৎপত্তি এবং ধারাবাহিক প্রাসঙ্গিকতার পরিচিতি প্রদান করা। মার্কসের বিশ্লেষণ করা সমাজে আমরা যতদিন বাস করবো, ততদিন মার্কস প্রাসঙ্গিক থাকবেন। যাহোক, এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মার্কসের কাছে “পরকীকরণের তত্ত্ব-এর শরণ নেয়া কিছুটা বিভ্রান্তিকর হবে। পরকীকরণ দিয়ে তিনি যা বুঝতেন, মার্কস সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট, অদ্ব্যর্থক সংজ্ঞা দিয়ে যাননি। পরিবর্তে, আমরা মার্কসের কাজের মধ্যে একটি থিম প্রবাহমান দেখতে পাই যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থা এবং গভীর সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক রোগসমূহের মধ্যকার সম্পর্কাবলীর বর্ণনা ও রোগ নির্ণয় করা (diagnosing),যা পুঁজিতন্ত্র তৈরী করে (যদিও এমনকি এই ধারাবাহিকতার যুক্তি বিতর্কিত, যা আমি পরবর্তী অধ্যায়ে দেখাবো)। এর অন্তর্নিহিত বোধ হলো নিয়ন্ত্রণের বাইরের একটি ব্যবস্থা এবং আমাদের নিজস্ব কর্মকান্ড আমাদের নিকট অভিজ্ঞাত হয় প্রতিকূল হিসেবে (as hostile)। ব্যাপক অর্থে, এটি হলো তাই যা দিয়ে পরকীকরণ বুঝায়।

মার্কসের পরকীকরণ সম্পর্কে লেখালেখি করা কঠিন। মার্কসের জন্য পরকীকরণ ছিলো একটি জটিল প্রপঞ্চ যেটি জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে পরিব্যাপ্ত করে। এটিকে পরীক্ষা করতে হয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে। এইভাবে, যখন “শ্রম থেকে পরকীকরণ” (alienation from labour) এবং“অপরসমূহ থেকে পরকীকরণ” (alienation from others) সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব হয়, তখন এগুলোর প্রায়ই অধিক্রমণ ঘটে এবং এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বিষয়সমূহকে কেটে টুকরো টুকরো করে এটা বলা সহজ নয় যে, “এটি হলো আত্ম থেকে পরকীকরণের (alienation from self) উদাহরণ; সেটি হলো অপরসমূহ থেকে পরকীকরণের ফসল” (result of alienation from others)। সুতরাং, যখন এই বইটিকে পরকীকরণের বিভিন্ন দিকসমূহের অধ্যায়সমূহে ভাগ করা হয়, তখন আমিও চেষ্টা করেছি এই দিকসমূহের প্রত্যেকটি কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তার উপর গুরুত্বারোপ করতে।

 পরকীকরণের মার্কসের তত্ত্ব সম্পর্কে মনে রাখার মূল বিষয় হলো এই যে এটি হলো এমন একটি ধারণা (concept) যার দ্বারা তিনি নানা সামাজিক প্রপঞ্চের বৈচিত্রকে সংযুক্ত করেন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের শেকড়সমূহ দেখানোর জন্য। যেমনটি বেরটেল ওলম্যান (Bertell Ollman) বলেন, “পরকীকরণ হলো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণ যাতে মার্কস মানবসত্তাসমূহের ওপর, শারীরিক ও মানসিক অবস্থাসমূহের ওপর এবং তারা যে সামাজিক প্রক্রিয়াসমূহের  অংশ তার ওপর, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের ধ্বংসাত্মক ফলাফল দেখান”।৫ মার্কসের ধারণাবলীর লক্ষ্য হলো আমাদের দুনিয়াটাকে বুঝতে সহায়তা করা যাতে এটাকে পরিবর্তন করা যায়, এবং এই বইটি মার্কসবাদকে একটি অ্যাকটিভিস্ট ঐতিহ্য হিসেবে দেখে, কেবল একাডেমিক হিসেবে নয়। ১৮৪৪এ মার্কস লেখেন যে “র‌্যাডিক্যাল হতে হলে বিষয়গুলোকে বুঝতে হবে মূল থেকে”৬ -যথার্থভাবে র‌্যাডিক্যাল হতে হলে আমাদের দুনিয়ার দুর্বৃত্তিসমূহের কারণসমূহ অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে, যেন আমরা সেগুলো উপড়ে ফেলতে পারি এবং চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করতে পারি।



অধ্যায় ১

পরকীকরণ ও আলোকায়ন



মার্কস শূন্যে তাঁর পরকীকরণ সম্পর্কে ধারণাবলী বিকশিত করেননি। আলোকায়নের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অনেক বিতর্কে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তাদের ভিত্তি আছে। এটা এমন একটা সময় যেটি রাজাদের স্বর্গীয় শাসনকে বর্ধিত মাত্রায় চ্যালেঞ্জ করার প্রচেষ্টা দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়, এবং সমাজকে কীভাবে ভিন্নভাবে সংগঠিত করা যেতে পারে সেই প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে। পশ্চাৎপদ, অভিজাত সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহরত একটা উদীয়মান পুঁজিতান্ত্রিক শ্রেণী প্রত্যক্ষ করেছিল এই যুগ। যে সামন্ততন্ত্র তাদের অধিকারকে এবং তাদের মুনাফা তৈরীর সামর্থ্যকে সীমাবদ্ধ করেছিল।  র‌্যাডিক্যাল দার্শনিক ও চিন্তকেরা রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্ন পরীক্ষণ করতে শুরু করলেন: কখন অন্যদের ওপর কিছু লোকের শাসন বৈধ?

এটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এখন যেটাকে সামাজিক বিজ্ঞান বলা হয় তার বৃদ্ধি, যদিও এটি এখন যেভাবে অস্তিত্বমান তা থেকে অধিকতর স্থুলভাবে ছিল। বিস্তারিতভাবে, ধারণা ছিল এই যে মানব সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করতে হবে তার উপায় নির্ণয় করতে হলে তাদের মনুষ্য স্বভাবকে উপলব্ধি করতে হবে, এবং মনুষ্য আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী মৌল সূত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সম্ভব হলে, মানব সত্তার বেঁচে থাকা উচিত তাদের স্বভাব অনুসারে। যদি তাদের স্বভাব অনুসারে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়, তখন কিছু প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাজার শাসনকে নায্যতা দিতে সপ্তদশ শতকের ইংরেজ রাজনৈতিক তাত্ত্বিক রবার্ট ফিলমার এ ধরনের যুক্তি দেন যে এটা ছিল সাদাসিদাভাবে পিতৃত্বের প্রাকৃতিক কর্তৃত্বের পুনঃসৃষ্টি, এবং “আদি পিতা” আদমের উত্তরসূরী হলো রাজারা। তাঁর সমসাময়িক থমাস হবস যুক্তি দেন যে জনগণের প্রাকৃতিকভাবে শত্রুতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বীপূর্ণ স্বভাবের জন্য একজন সবল এবং চুড়ান্তভাবে সর্বশক্তিমান রাজার কর্তৃত্ব দরকার সুরক্ষার জন্য। যাহোক, আলোকায়নে অন্যদের জন্য, এই যুক্তিগুলো বর্ধিতভাবে মনোনিবেশ করে অধিকতর র‌্যাডিক্যাল উপসংহারের দিকে।

এই নয়া ধারণাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিকাশ (growth) গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও এই চিন্তকেরা আধুনিক অর্থনীতির জন্য মঞ্চ তৈরী করেছিলেন, তাঁদের উদ্বেগ (concerns) ছিল অধিকতর বিস্তৃত। সমসাময়িক অর্থনীতি সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকসমূহ (dimensions) উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখায়। অন্যদিকে এই চিন্তকেরা তাদের গুরুত্ব সহকারে নেয়,  যেমনটি অ্যাডাম স্মিথের সবথেকে বিখ্যাত শিরোনাম সুপারিশ করে, তেমনটি প্রদান করার চেষ্টা করে, “জাতিমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণের ওপর তদন্ত” (an inquiry into the nature and causes of the wealth of nations)। স্মিথ যুক্তি দেন যে মানব সত্তাসমূহের “একটি জিনিষের সাথে অপরটির লেনদেন, বার্টার ও বিনিময়ের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রয়েছে”, যেটি অনিবার্যভাবে শ্রম-বিভাজনের উৎপত্তি ঘটায়, যাতে কিছু লোক একধরনের কাজ করে অন্যরা আর একধরনের। মনুষ্য স্বভাবের এই একটি ধারনা যা আজকের দিনেও লক্ষণযোগ্যরূপে অটুট (resilient), এবং এটি হল একটি যা ব্যক্তিগত বিনিময়ের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়, এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি আধিকারের ওপরও।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ নিশ্চিতভাবে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে মানানসই। বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য, সম্পত্তির মালিকানা অর্জনের সামর্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সম্পত্তি বিক্রয়ের সামর্থ্যও গুরুত্বপূর্ণ। এটি গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয় যে এটি হলো প্রথম দিককার ধারণা (senses)-এর একটি যেটিতে “পরকীকরণ” শব্দটি দৃষ্টিগোচর হয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর লেখালেখিতে পরকীকরণ সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয় বিক্রয় বা স্থানান্তর অর্থে। এটি এমন একটি ধারণা যাতে , উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা “অপরকায়িত অধিকার”-এর কথা বলে - যে অধিকার একজনের কাছ থেকে নিয়ে অন্য কাউকে দেয়া যায় না। যাহোক, যখন সম্পত্তির কথা উঠে, তখন প্রথম দিকের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদগণ পরকীকরণকে এই অর্থে ধণাত্মক হিসেবে ব্যাপকভাবে গণ্য করেন যা আরও বিস্তৃত হওয়া দরকার। যেহেতু পুঁজিতন্ত্র পুরাতন সামন্ত ব্যবস্থা (old feudal order)-এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া শুরু করে, তাই কোন বিষয়গুলো “পরকীকৃত” করা যেতে পারে, যেমন সম্পত্তিকে বিক্রয় করা যেতে পারে, এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। সামন্তবাদ “পুঁজিতন্ত্রের উদ্দীপনা” (spirit of capitalism) রুদ্ধ করে, স্মিথ এ সম্পর্কে লেখালেখি করেন, কারণ “বুর্জোয়ারা গোষ্ঠীর  দ্রব্যসামগ্রী  পরকায়িত করতে পারেনা রাজার অনুমতি ছাড়া।৮

এ্যাডাম স্মিথের একজন গুরুত্বপূর্ণ উত্তরসূরি হলেন ডেভিড রিকার্ডো। রিকার্ডো রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রকল্পের আরো বিকাশ ঘটান, বিশেষ করে, যা মূল্যের শ্রম তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত হয় তার বিকাশ ঘটান। বিশেষ কোন পণ্যসমূহের মূল্যের উৎস সম্পর্কে বিতর্কে এটি ছিল একটি অবদান। স্মিথ পণ্যের মূল্যকে বিভিন্ন নিয়ামকের সমন্বয় হিসেবে দেখেছেন, যে নিয়ামকগুলো যেমন মেশিনারি, ভাড়া ইত্যাদি পণ্যটি উৎপাদনের সময় কাজ করে। রিকার্ডো যুক্তি দেন যে প্রকৃতপক্ষে শ্রম হলো মূল্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পণ্য-মূল্য স্থির হয় শ্রমের পরিমাণ দিয়ে যেটুকু শ্রম এটি উৎপাদনের জন্য দরকার।

এটির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি রয়েছে। প্রথমত এটি বোঝায় যে পুঁজিতন্ত্রী ও শ্রমিকদের মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক (antagonistic relationship) বিদ্যমান। পুঁজিতন্ত্রীরা মুনাফা বানাতে, শ্রমিকদের শ্রম যে মূল্য তৈরী করে, তাঁরা তার থেকে কম দেয় মজুরদের। দ্বিতীয়ত, এটা বোঝায় যে বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্যে মানব শ্রমের একটা নির্দিষ্ট  পরিমাণ “অন্তর্ভুক্ত” রয়েছে। পণ্য-দ্রব্য উৎপাদনের সময় শ্রমিকেরা বস্তুর ওপর তাঁদের শ্রম সংযোজিত করে, এবং এভাবে এটাকে মূর্ত করে (externalise), তাঁদের বাইরে এটিকে স্থাপন করে। পরকীকরণ সম্পর্কে মার্কসের যুক্তিসমূহের জন্য এই ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, যা আমি পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করবো।


এটা গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করা যায় যে রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদগণ কর্তৃক প্রবর্তিত পরকীকরণের ধারণা সরাসরি পরিব্যাপ্ত করে মার্কসের অধিকতর বিকশিত তত্ত্বকে। এই অর্থনীতিবিদদের মার্কসের ওপর বিশাল প্রভাব ছিল। তাঁর জীবনের অনেকটাই ব্যয় হয় তাঁদের ধারণাবলীর বিকাশ ঘটাতে, বিস্তৃত করতে এবং সমালোচনা করতে। পরকীকরণের এই ধারণার প্রভাব মার্কসের প্রথম দিকের কিছু লেখালেখিতে দেখা যায়, উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ১৮৪৪-এ লেখা প্রবন্ধ “ইহুদি প্রশ্নে”, এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে “বিক্রয় হলো পরকীকরণের অনুশীলন”।৯  এখানে তিনি সচেতনভাবে পরকীকরণের বিভিন্ন ধারণার ওপর খেলেন। কোনকিছু বিক্রয়ে জড়িত থাকে সরাসরি সেটিকে দূরে স্থানান্তর করা। পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ে জড়িত থাকে মানব শ্রমের অঙ্গিভূত করা এবং মূর্তরূপ দেয়া। এবং পরিশেষে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কিছু ধরন হলো পরকীকরণের মূল যাতে বিস্তৃত অর্থে দুনিয়াতে স্বগৃহে রয়েছি মনে হয় না।

আলোকায়নের আর একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাত্তি¡ক হলেন ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো। তিনি অনেকগুলো র‌্যাডিক্যাল রচনা লেখেন আঠারো শতকের প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাকে সমালোচনা করে। রাজার শাসনের অধিকারের র‌্যাডিক্যাল সমালোচনা দিয়ে, এবং তাঁর চারপাশে সংঘটিত রূপান্তরসমূহের গভীর সংশয় দিয়ে তাঁর ধারণাবলী উৎসাহিত হচ্ছিল। তিনি নগরসমূহের বৃদ্ধি আসন্ন দারিদ্র্য এবং বঞ্চনা প্রত্যক্ষ করেন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির পাশাপাশি, এবং প্রশ্ন করেন, “এটা কি সত্যি প্রগতি?”

রুশো রচনা-লিখন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে, “বিজ্ঞান ও কলার পুনঃপ্রচলন (restoration) নৈতিকতার বিশুদ্ধতায় অবদান রেখেছে কি? অন্য কথায়, বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি ও প্রযুক্তিতে সংঘটিত বৃহৎ অগ্রগতি মানুষের অবস্থার উন্নতি সাধন করেছে কি?” রুশোর র‌্যাডিক্যাল উত্তর ছিল ঠিক তা নয়, বরং এটা বিষয়সমূহের অবস্থা আরো খারাপ করেছে। সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবজাতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন যে মানব-সত্তা স্বভাবগতভাবে স্বার্থপর অথবা আগ্রাসী। বরং, “মানুষ স্বভাবগতভাবে ভালো, এবং এটা কেবলমাত্র তাদের প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মানুষ খারাপ হয়ে পড়ে।১০ এখানে দু’টি র‌্যাডিক্যাল অন্তর্দৃষ্টি বিদ্যমান। প্রথমত, প্রযুক্তিগত উন্নতি মানবজীবনে আপনাআপনি উন্নতি আনে না। বরং দুঃখ ও দুর্ভোগ নিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, সমাজে “নৈতিকতা”-র সমস্যাবলীর  বিশাল পরিসরে অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের স্বার্থপরতা এবং লোভ, এমনকি তাদের দুর্ভোগ এবং অসুখময়তা, এর সবগুলোই তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ফসল, কোনোকিছুই “স্বাভাবিক” নয়।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উচ্চ সংস্কৃতির সমালোচনা দিয়ে রুশোর কাজ শুরু হয়, কিন্তু তিনি দ্রæত জনগণের মধ্যকার অসমতার গবেষণা বিস্তৃত করেন। তিনি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকে দোষারোপ করা থেকে সরে এসে অসমতাকে দায়ী করেন সমাজের সমস্যাবলীর জন্য: অশুভের প্রথম উৎস হলো অসমতা; অসমতা থেকে ধনের উত্থান . . . । ধন থেকে বিলাসিতা ও অলসতা জন্ম নেয়; বিলাসিতা থেকে শিল্পকলার উত্থান হয়, এবং অলসতা থেকে বিজ্ঞান।”১১ রুশো  রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দেখেন “প্রাকৃতিক অবস্থা” থেকে মানব-সত্তাকে বিযুক্ত করার উপায় হিসেবে। এটা হবসের “সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ”-এর অবস্থা নয়, বরং প্রাকৃতিক  সমতার একটা শর্ত যাতে মনুষ্যজন সুখী ও পূর্ণ থাকে:


আমি কিছু প্রাণী দেখি অন্যদের থেকে কম সবল, কম ক্ষিপ্রতা সম্পন্ন, কিন্তু, সবদিক থেকে বিবেচনা করলে সবার থেকে কার্যকরভাবে সুসংগঠিত। আমি তাকে একটি ওক গাছের নিচে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে দেখি, প্রথম ঝরণা থেকে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে দেখি, যে গাছ তার খাবার সরবরাহ করে, সেই একই গাছের নিচে তার বিছানা খুঁজে পায় এবং এভাবে তা দিয়ে তার প্রয়োজনগুলো মেটে।১২


যাহোক, যেহেতু মানুষজন সমাজে সংগঠিত হয় বেঁচে থাকার জন্য, তাই তারা একধরনের গৌরব ও অহংকার বিকশিত করে (amour proper)। সমাজের মাঝে তাদের স্বীকৃতি ও অস্তিত্ব মেনে নেয়ার প্রয়োজন থেকে ক্রমাধিকারতন্ত্র (hierarchies) এবং পরিণামে বিভাজনের (divisions) উদ্ভব ঘটে।

 মানবসমাজসমুহের সহজাত অবস্থা (state of nature) এবং বিকাশ সম্পর্কে  রুশোর যুক্তিসমূহ (arguments) কতটুকু যথার্থ ঐতিহাসিক বিবরণ (historical story) হিসেবে উপলব্ধি করতে আশা করা যায়, অথবা স্রেফ মানব স্বভাব সম্পর্কে তাত্ত্বিক বিনির্মাণ (theoretical construction) হিসেবে গণ্য করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক (debate) রয়েছে। এটা এই চিন্তার চেয়ে ঊণ তাৎপর্যপূর্ণ যে আধুনিক সমাজ সম্পর্কে একটাকিছু বিদ্যমান যা ক্রমাগত মানব বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে। আধুনিক সমাজের মানুষজন প্রাকৃতিক অবস্থাসমূহ থেকে বিযুক্ত হয়ে গেছে, যে অবস্থাতে তারা সুখী ও পরিপূর্ণ হতে পারতো, এবং পরিণামে সামাজিক সমস্যা বিকশিত হয়।

যাহোক, রুশো  এটাকে দেখেন মানব সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য (general feature) হিসেবে। কারণ সমাজে বসবাসের জন্য অসমতা প্রোথিত থাকে অহংকার ও গৌরবের মাঝে, এটাকে পরিহার করা যায় না। এটা অংশত রুশোর কারণে, তিনি মনে করেন, মানবসত্তাসমূহ প্রাকৃতিকভাবে (naturally) সামাজিক প্রাণি নয় Ñ সর্বোপরি, উপরে উল্লেখিত উদ্ধৃতিতে প্রকৃতিতে তাঁর মানুষের বর্ণনা ছিলো লক্ষণযোগ্যভাবে একজন নির্জন মানুষের। এর অর্থ ছিলো এই যে  সমাজে মানুষের বসবাসের জন্য ঐকমত্য (agreements) তৈরী করা দরকার যা অসমতার প্রভাবকে সীমিত করে। এটাই রুশোর বিখ্যাত “সামাজিক চুক্তি”।

            সামাজিক চুক্তি নিজে নতুন কিছু নয়, কিন্তু রুশোর সূত্রায়ন (formulation) অন্যদের থেকে পৃথক ছিল (যেমন জন লক)। আগের সামাজিক চুক্তির সূত্রসমূহ এই যুক্তির দেয়ার প্রবণতা দেখায় যে জনগণের কেবলমাত্র কিছু ক্ষমতা রাষ্ট্রেুর নিকট দিয়ে দিতে রাজি হওয়া উচিত যা সার্বিক মঙ্গলের জন্য দরকারী। তাদের অধিকাংশ অধিকার, বিশেষ করে সম্পত্তি সংক্রান্তগুলো তাদের নিজেদের জন্য অব্যাহত রাখতে হবে। যাহোক, রুশো যুক্তি দেন যে এটা অসম্ভব। যেহেতু, প্রকৃতির অবস্থাতে (in the state of nature) কোনো অধিকার থাকে না, অধিকার কেবলমাত্র সামাজিক চুক্তিতে সামাজিক সমঝোতার মাধ্যমে আসতে পারে। সুতরাং ব্যক্তিবর্গকে সম্পূর্ণরূপে সম্প্রদায় (community) বা রাষ্ট্রের নিকট তাদের নিজেদের সমর্পণ করতে হয়। রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের মত সাধারণভাবে রুশো পরকীকরণের একই ধারণা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। রুশো বর্ণনা করেন এভাবে: প্রত্যেক এ্যাসোসিয়েটের সম্পূর্ণ পরকীকরণ, তার সকল অধিকারসহ সমগ্র কমিউনিটির নিকট”।১৩

            তখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজেদের, তাদের অধিকারসমূহ এবং তাদের ব্যক্তিগত মুক্তির থেকে পরক হয়ে। কিছু অর্থনীতিবিদ কর্তৃক প্রবর্তিত “সার্বজনীন বিক্রয়যোগ্যতা” (universal saleability)-এর  ধারণার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটাকে দেখা যেতে পারে। রুশো যুক্তি দেন যে মুক্তির কিছু প্রকারভেদ পরক করে ফেলা ন্যায় সঙ্গত নয় রাষ্ট্র ব্যতিত:


পরক করা (to alienate) হলো দিয়ে দেয়া (to give) অথবা বিক্রয় করা (to sell) . . . . কিন্তু কিসের জন্য একজন মানুষ নিজেকে বিক্রয় করতো? . . . যদিও প্রত্যেক মানুষ নিজেকে পরক করতে পারে, কিন্তু সে তার ছেলেমেয়েদের পরক করতে পারে না। তারা জন্মগতভাবে মুক্ত মানুষ; তাদের মুক্তি তাদের মালিকানায়, এবং অন্য কারো নয়, কেবলমাত্র তাদের অধিকার আছে এটি নিষ্পত্তি করার।১৪


এভাবে, উদাহরণস্বরূপ, আপনি আপনার নিজেকে দাসত্বে সমর্পণ করতে রাজি হতে পারেন না। যাহোক, যৌথ পরকীকরণ (collective alienation) হলো সমাধান, যেখানে প্রত্যেকে সবকিছু কমিউনিটিকে প্রদান করে।

যাহোক, রুশো ব্যক্তিগত সম্পত্তি অথবা প্রাতিস্বিক মুক্তির বিপক্ষে  যুক্তি দেননি। তিনি ভেবেছিলেন যে পরকীকরণের এই কাজের দরকার ছিলো সম্যকভাবে  ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে রক্ষা করতে, এর ধারণাকে অর্থবহ করতে। তিনি লিখেন যে  ব্যক্তিগত সম্পত্তির নীতি হলো “নাগরিকত্বের  সকল  অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র (sacred) এবং কোন কোন ক্ষেত্রে স্বয়ং মুক্তির থেকেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ”।১৫  সম্পত্তি এবং মুক্তির অর্থ নবডঙ্কা যদি সেগুলো একটি সমাজে বিদ্যমান না থাকে যেটি তাদের স্বীকৃতি এবং বৈধতা দেয়।

রুশোর অধিকাংশ কাজকে নিঃসন্দেহে দেখা যেতে পারে পুঁজিতন্ত্রের অবস্থা, শ্রমজীবি জনগণের  ওপর এর অবমাননাকর প্রভাব, এবং এর কুৎসিত অসমতাগুলোর প্রতি প্রথম দিকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যাহোক, খোদ পুঁজিতন্ত্রের কাঠামোর বাইরে দেখার অক্ষমতার জন্য এবং মানুষজনের সামাজিকভাবে সহ-অবস্থানের সক্ষমতা সম্পর্কে হতাশাজনক মানব স্বভাবের বর্ণনার জন্য তাঁর সমালোচনার র‌্যাডিক্যালিজম ভোঁতা হয়ে যায়।






অধ্যায় দুই

হেগেল, ফয়েরবাখ, মার্কস



এ সময় মার্কস ছাত্র ছিলেন। আলোকায়নের চিন্তকবৃন্দ পাশ্চাত্য দর্শনের আর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব জি ডাবøুও এফ হেগেলকে পথ ছেড়ে দেন। হেগেলের ধারণাবলী ও সিস্টেম দার্শনিক দৃশপটে আধিপত্য করে, এবং অধিকাংশ মানুষ তাদের যুক্তি (arguments) প্রনয়ন করে হেগেলের রচনাবলী (works)-তে  সৃজনকৃত পরিভাষার মধ্যে। মোটাদাগে,  এদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এদের এক দল ডানপন্থী হেগেলীয়, এরা হেগেলের অধিকতর রক্ষণশীল দিকগুলোতে গুরুত্বারোপ করে, এবং বাম হেগেলেীয়, এরা তাঁর সিস্টেমের অধিকতর র‌্যাডিক্যাল সম্ভাবনাসমূহের ওপর গুরুত্বারোপ করে। ফ্রেইড্রিখ এঙ্গেলস যিনি তাঁর একজন জীবনব্যাপী সহযোদ্ধা হয়েছিলেন, তিনিসহ মার্কস নিজেকে বাম হেগেলীয়দের মধ্যে দেখতে পান। এই তরুণ র‌্যাডিক্যালেরা দমনমূলক প্রুশীয় রাজতন্ত্রকে আক্রমণ করেন।

            হেগেলের দর্শনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসের দর্শন বিকাশে তাঁর প্রচেষ্টা। এটা উপলব্ধি করা সহজ কেন তিনি এটা করেছিলেন। তিনি যে যুগে বাস করেছিলেন, তার শুরু ফরাসি বিপ্লবে, শেষ নেপোলিয়োনীয় যুদ্ধে। ইউরোপ ব্যাপক গোলযোগ ও রূপান্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করে, এবং এটা উপলব্ধি করা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে রূপান্তর হলো একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ। সর্বাগ্রে হেগেল ইতিহাসকে দেখেন মানব স্বাধীনতার (freedom) ইতিহাস হিসেবে। হেগেলের তত্তে¡র একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে এটি একটি উপায় যা বর্ণনা করে কীভাবে মানব ইতিহাসের কিছু পর্যায় অপসারিত হয় অন্যগুলো দিয়ে। হেগেল মানবতার ইতিহাসে পর্যায়সমূহকে অস্থায়ী হিসেবে দেখেন। এ পর্যায়গুলোর ধারণকৃত প্রবণতা হলো প্রত্যেকটি পর্যায় পরাভূত হয় এবং প্রতিস্থাপিত হয় একটি নয়া, উচ্চতর, এবং অধিকতর ভালো পর্যায় দিয়ে। রুশোর তত্ত¡গুলোর ওপর এটা ছিল একটি বড় অগ্রগতি। রুশোর প্রবণতা ছিল  “সভ্যতা” এবং  একটি “প্রকৃতির অবস্থা”-এর মধ্যকার সরল বিভাগ,  এতে ধারণা ছিল না যে সংঘাতকে (conflict) পরাভূত করে পেছন দিকে না ফিরে একটা নয়া ধরণের সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

            হেগেলের মতে, মানব আত্মা ছিল মুক্ত, কিন্তু এটি সবসময় নিজেকে এভাবে স্বীকৃতি দিতো না। ইতিহাসের প্রক্রিয়া ছিলো মনুষ্যজনদের নিজেদের এগিয়ে এসে মুুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রক্রিয়া। বিভিন্ন সামাজিক গঠন এই ধরণের স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন সম্ভাবনার প্রস্তাব দেয়, এবং প্রত্যেক আনুক্রমিক ঐতিহাসিক পর্যায় এই উপলব্ধির সন্নিকতবর্তী হয়েছিল। হেগেলের মতে, ফরাসি বিপ্লবের চেতনা (spirit) নেপোলিয়ান আত্মীকৃত করেছিলেন এবং এভাবে এই মুক্তির মানব অন্তর্ভুক্তি ইউরোপ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

            হেগেলের ছিল স্বাধীনতার একটি খুব বিশেষ ধারণা (a very particular conception), যাহোক,  যার ভিত্তি ছিল স্ব-উপলব্ধি (self-realisation) হিসেবে স্বাধীনতার একটি বোঝাপোড়া (understanding)। স্বাধীনতা কেবলমাত্র আমাদের মুক্তির দিকে প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা সম্পর্কে নয়, বরং দুনিয়াতে আমাদের নিজেদের স্বীকৃতি দিতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা সম্পর্কে। সাম্প্রতিক কালের দার্শনিক চার্লস টেইলর স্বাধীনতা সম্পর্কে চিন্তনের (thinking) এই পথকে 'অভিব্যক্তিবাদ' (expressivism) বলেন:


মানুষ নিজেকে জানতে পায় সে কি তা প্রকাশ ও ব্যাখ্যা করে, এবং এই অভিব্যক্তিতে নিজেকে স্বীকৃতি দিয়ে । মানব জীবনের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো অভিব্যক্তির মাধ্যমে স্ব-সচেতনতা (self-awareness)-এর শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানো।১৬


এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দুনিয়াতে সৃজনশীলভাবে তাদের নিজেদের প্রকাশের মাধ্যমে মানব সত্তাসমূহ নিজেদের অধিকতর ভালভাবে উপলব্ধি করে, এবং এভাবে অধিকতর পরিতৃপ্তিকর জীবন-যাপন করে।

যাহোক, হেগেলের জন্য, এই স্বাধীনতা অভিব্যক্ত হতো “আত্মা”(spirit)  সংক্রান্ত পদাবলী দিয়ে, অংশতঃ উপলব্ধ হতো ধর্মীয় পদাবলী দিয়ে। মানব ইতিহাস হলো মনুষ্যজনের গল্প (story) যাতে বোঝা যায় যে আত্মার দুনিয়া ও ভৌত দুনিয়া^ আসলে একটি ও একই। প্রাথমিকভাবে আধ্যাত্মিক দুনিয়া ও ভৌত দুনিয়া একটি “দরকারী ঐক্যে” (essential unity) একীভূত। তখন বহিঃস্থ, বস্তু জগতের স্বীকৃতি মনুষ্যজনকে পৃথক করে আত্মা থেকে। পরকীকরণের এই অবস্থা, যেখানে মানব সত্তাসমূহ নিজেদের দেখতে পায় আত্মা থেকে অপর (other) কোনোকিছু হিসেবে (এটা থেকে পরক), তারা জ্ঞানের কিছু পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত সংশোধিত হয়। মনুষ্যজন নিজেদের দুনিয়াতে মুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে, এই আদি ঐক্যকে উচ্চতর স্তরে পুনঃস্থাপিত করে। এই ক্রমাগত সংঘটিত প্রক্রিয়ার  প্রত্যেকটি পর্যায় হলো পরকীকরণের এক-একটি পর্যায়, কিন্তু এগুলো সত্যি জ্ঞানের নিকটবর্তী হয়।

এই পর্যায়গুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো বহিঃস্থকরণের (externalisation) বর্ণনা। আমরা বহিঃস্থ দুনিয়ার ওপর ক্রিয়া করি, এটাকে রূপায়িত করি নির্দিষ্ট উপায়সমূহ দিয়ে, এবং এই প্রক্রিয়াতে আমরা আমাদের নিজেদের উপাদানসমূহ (elements) বাইরের দুনিয়াতে প্রক্ষিপ্ত করি, তাদের “বহিঃস্থকৃত” (externalised) করি। এ হলো কীভাবে আমরা আমাদের নিজেদের এই দুনিয়াতে স্বীকৃতি দিতে পারি, দুনিয়াকে আমাদের একটি অংশ বানাতে পারি, এবং আমাদের নিজেদের দুনিয়ার একটি অংশ বানাতে পারি। আধুনিক রাষ্ট্র এটার একটা উদাহরণ, নির্দিষ্ট মানবিক ক্ষমতাসমূহের কোনকিছুতে বহিঃস্থকরণের ফল এই রাষ্ট্র, অধিকন্তু যেটি অস্তিত্বমান সাধারণ জনগণের ওপরে।

যাহোক, হেগেলের বর্ণনা, কারণ এটি নির্ভর করে আত্মা সম্পর্কে এই ধারণাবলীর ওপর, চূড়ান্তভাবে কেবলমাত্র চিন্তনের জগতে এই প্রশ্নাবলীর সমাধান করে। মানব সমাজের এই বিভিন্ন অপর্যাপ্ত রূপের সমাধান ছিল স্রেফ নিজেদেরকে “আমাদের অপর-সত্তার বাড়িতে অন্বেষণে" যেমন-  প্রয়োজনগতভাবে  সমাজের ভেতরে আমাদের অবস্থানের একটি গ্রহণযোগ্যতা আসা। অধিকন্তু, মানব ইতিহাস যে উপায়ে পরিবর্তিত হয়, তাতে তাঁর গুরুত্ব আরোপন সত্তে¡ও, প্রুশিয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রকে সমাজের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য রূপ হিসেবে তিনি শেষ করেন (ended up)। পরিবর্তন ও রূপান্তরের ওপর ভিত্তি করে একটি দার্শনিক সিস্টেম বিকশিত করা সত্ত্বেও, হেগেলের ইতিহাস ঊনিশ শতকে এসে থেমে যায়।

হেগেল ছিলেন ভাববাদী। তিনি বিশ^াস করতেন যে চুড়ান্তরূপে সবকিছু অস্তিত্বমান থাকে ভাব হিসেবে ঈশ^রের মনে। তাসত্তে¡ও, বস্তুবাদের ওপর ভিত্তি করে তাঁর সিস্টেম দৃশ্যপট স্থাপন করে র‌্যাডিক্যাল সমালোচনার জন্য। জার্মান বাম হেগেলিয়ান দার্শনিক লুদভিগ ফয়েরবাখ এটি (অনুবাদক: র‌্যাডিক্যাল সমালোচনা) প্রথম করেন। ফয়েরবাখ হেগেলের তত্ত্বকে সমালোচনা করেন নাস্তিকতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি হেগেলের সিস্টেমকে উল্টিয়ে দেন (turn upside-down)। আমাদের নিজেদের আত্মা হিসেবে দেখা, অথবা  ঈশ্বরকে জানতে চাওয়া, পরকীকরণের সমাধান নয়, বরং পরকীকরণের ফল।

 তাঁর ১৮৪১-এর পুস্তক The Essence of Christianity-তে ফয়েরবাখ যুক্তি দেন যে মানব জীবনের স্রেফ “পরকীকৃত” অথবা “বহিঃস্থকৃত বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় ধারণাবলী। মানব সত্তাসমূহ ঈশ^রের প্রতিকৃতি সৃজন করেন, মানবিক ক্ষমতাগুলোসহ একটি সত্তা হিসেবে। তারা মানব ক্ষমতাসমূহ, চিন্তন, বাকশক্তি (speech), সৃজনশীলতা ইত্যাদি একটি কাল্পনিক স্বর্গীয় সত্তায় আরোপ করে। এইভাবে তারা তাদের নিজেদের সামর্থ্যসমূহ পরকীকৃত করে, এবং তাদের মূল্য হ্রাস করে এ প্রক্রিয়াতে। ঈশ্বরকে উচ্চ মর্যদায় আসীন করা হয় সর্বক্ষমতাময় এবং চমকপ্রদ হিসেবে, অন্যদিকে মানবসত্তাকে দেখা হয় ক্ষমতাহীন, অতাৎপর্যপূর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে।

ফয়েরবাখের ধারণাসমূহ বিপুলভাবে তাৎপর্যময় ছিল মার্কস ও সমসাময়িকদের জন্য। ফয়েরবাখ এই ঘটনা পুনঃব্যক্ত করেন যে দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারণাসমূহের পুর্বেই মানব সক্রিয়তা এসেছে। মানুষ কীভাবে জীবন-যাপন করে প্রকৃতপক্ষে তাই নির্ধারণ করে তাদের ধারণাসমূহকে, ধারণাবলীর মহত্তম আন্দোলন (grand movement) নির্ধারণ করে না কীভাবে তারা জীবন-যাপন করবে। এঙ্গেলস বর্ণনা করেন কীভাবে (how):


এক ফুঁয়ে, এটি  (হেগেলীয় পদ্ধতির) দ্বন্দ্বসমূহকে গুড়িয়ে দেয়, কোনরকম ঘুরিয়ে কথা বলা ছাড়াই এটি বস্তুবাদকে আবার সিংহাসনে স্থাপন করে। প্রকৃতি অস্তিÍত্বমান থাকে সকল দর্শন থেকে স্বাধীনভাবে। এটি হলো ভিত্তি যার ওপর আমরা মানব সত্তাসমূহ, নিজেরা প্রকৃতির উৎপাদ হিসেবে বেড়ে উঠেছি। প্রকৃতি ও মানুষের বাইরে কোনকিছুর অস্তিÍত্ব নাই এবং আমাদের ধর্মীয় ফ্যান্টাসি সৃষ্টি করেছে উচ্চতর সত্তাসমূহ, যেগুলো কেবলমাত্র আমাদের নিজেদের সারসত্তার (essence) চমৎকার প্রতিফলন।১৮


এটা ছিল কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি যা মার্কসের নিজের বর্ণনাকৃত পরকীকরণ সম্পর্কে অবহিত করে। যে বস্তুগত শর্তাবলীতে আমরা বসবাস করি তারই ফলাফল হলো আমাদের অস্তিত্বের ধারণাসমূহ।

যাহোক, ফয়েরবাখের যুক্তিসমূহে কিছুটা সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। রূপান্তরের যেকোনো ধারণাতে তাঁর ঘাটতি আছে, যা এই শর্তসমূহকে (conditions) অপসারণ করতে পারে, যে শর্তগুলো ধারণার উৎপত্তি সংঘটিত করে। সমাধান হিসেবে তিনি যেসব প্রস্তাব করেন তা হলো শিক্ষার কর্মসূচী। ঠিক যেমন হেগেল বিশ্বাস করতেন যে মানুষজনকে তাদের প্রকৃতিকে জানতে হবে আধ্যাত্মিক সত্তা (spiritual being) হিসেবে। ফয়েরবাখ যুক্তি দেন যে তাদের নিজেদেরকে জানতে হবে বস্তুগত সত্তা (material being) হিসেবে। আমাদের প্রকৃত রূপ (true nature) উপলব্ধির সাথে সাথে ধর্মের ক্ষতিকর ধারণাবলী অন্তর্হিত হয়ে যাবে। তারা পরিচালিত হয় উচ্চতর ক্ষমতা দিয়ে, এই বিশ^াস পরিত্যাগ করে মানুষ তখন পরিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারবে। তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে তারা ঈশ্বরে যে ক্ষমতাগুলো আরোপ করে, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজেদের, এবং তারা মহৎ জিনিষসমূহ করতে সক্ষম।

হেগেল ও ফয়েরবাখের সমালোচনাতে মার্কস বিকশিত করেন পরকীকরণ সম্পর্কে তাঁর নিজের বর্ণনা। ফয়েরবাখের প্রভাবে মার্কস প্রথমে হেগেলের তত্তে¡র সমালোচনা করেন, তারপরে স্বয়ং ফয়েরবাখের সমালোচনা করেন। ফয়েরবাখের বস্তুবাদের সাথে একমত হয়ে, মার্কস হেগেলের সমালোচনা করেন চুড়ান্তভাবে তাঁর সিস্টেমের ভাববাদে অধঃপতিত হওয়ার জন্য। যখন হেগেল সঠিক ছিলেন পদ্ধতির গুরুত্ব পর্যবেক্ষণে, যে পদ্ধতিতে মানুষ দুনিয়াতে তাদের নিজেদের উপলব্ধি করতে পারে, তখন তিনি এই উপলব্ধি অর্জনের বস্তুগত প্রতিবন্ধকতাকে অবমূল্যায়ন করেন। তিনি নিছক “আপাত সমালোচনার” জন্য দোষী ছিলেন।১৯ এর কারণ হলো তিনি প্রধানতঃ চিন্তনের ওপর, চেতনার ওপর  মনোযোগ নিবদ্ধ করেন, যে পথে মানুষ দুনিয়াতে নিজেদের উপলব্ধি করতে পারেন।

মার্কস যুক্তি দেন যে দুনিয়াতে আমাদের নিজেদের বুঝতে চিন্তন গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতন উৎপাদনশীল কর্মকান্ডÑ শ্রম। যখন হেগেল মানব কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা করেন, তখন এটি নিছক জ্ঞানের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকাশ মাত্র। এটি তাঁকে এই কর্মকান্ডের  প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করে। হেগেলের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার গ্রহণযোগ্যতার বিপরীতে, মার্কস তাঁর চারপাশে দেখতে পান গুরুতর ভোগান্তি, নির্যাতন ও অশান্তি, এবং এজন্য তাদের কর্মকান্ডে তাদের নিজেদের উপলব্ধিতে মানুষজন কীভাবে ব্যর্থ হয়- সেটির ব্যাখ্যাতে তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ  থাকে:


জীবন্ত ও সক্রিয় মানব সত্তাসমূহসহ তাদের মেটাবলিজমের প্রাকৃতিক, অজৈব অবস্থাসমূহের সঙ্গে প্রকৃতির ঐক্য এবং এমনকি তাদের প্রকৃতির আত্মসাতের ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি এমনকি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল নয়। আমাদের অবশ্যি যা ব্যখ্যা করতে হবে তা হলো এই সক্রিয় অস্তিত্ব থেকে মানব অস্তিত্বের অজৈব অবস্থাসমূহের পৃথকীকরণ। এই পৃথিকীকরণ কেবলমাত্র সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হবে মজুরী-শ্রম ও পুঁজি মধ্যকার সম্পর্কে।২০


কারণ, হেগেলের প্রাধিকারপ্রাপ্ত ধারণাবলী ছিল কেজো মানব সক্রিয়তার ওপরে। যেভাবে আমরা দুনিয়াতে আমাদের নিজেদের বহিঃস্থকৃত করি সেটির ঋণাত্মক দিক পর্যবেক্ষণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।

মার্কসের হেগেল সম্পর্কিত অধিকাংশ সমালোচনা আসে তাঁর ফয়েরবাখ পাঠের মাধ্যমে। যাহোক, পাশাপাশি মার্কস ও এঙ্গেলস দ্রুত ফয়েরবাখের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পরকীকরণের সমস্যার সামাধানকল্পে শিক্ষায় ফয়েরবাখের মনোযোগকে তাঁরা সমালোচনা করেন। ফয়েরবাখ সম্পূর্ণ সঠিকভাবে শনাক্ত করেন যে আমাদের মস্তিষ্কস্থিত ধারণাবলী হলো আমাদের বস্তুগত অস্তিত্বের একটি প্রতিফলন। পরে তা মার্কস ও এঙ্গেলস এভাবে বলেন, “মানব মস্তিষ্কে তৈরী হওয়া  ভূতগুলো (phantoms), প্রয়োজনগতভাবে, তাদের বস্তুগত জীবন প্রক্রিয়ার সাবলিমেটস (sublimates)”।২১ যাহোক, তাঁর প্রস্তাবকৃত সমাধান সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে জনগণের ধারণাবলীর (ideas) পরিবর্তনের পর্যায়ে, ভিন্নভাবে জীবন-যাপনে তাদের শিক্ষা দেওয়াতে। মার্কস এটিকে দেখেন খুব অপর্যাপ্ত হিসেবে।

ফয়েরবাখের সমস্যার একটি অংশ ছিলো তাঁর মানব প্রকৃতির স্থির ধারণা (static conception), যা পরিবর্তন করা যায় না। তিনি মানুষজনকে দেখেন প্রাকৃতিকভাবে সামাজিক সত্তা হিসেবে যারা নির্দিষ্ট সমাজসমূহে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে (way) বাস করেন। যা কিছু দরকার তা হলো জনগণকে সঠিক উপায়ে শিক্ষিত করা যাতে তারা বাস করতে পারে এই সত্য প্রকৃতি অনুসারে। আলোকায়নের মানব প্রকৃতির ব্যক্তিতান্ত্রিক অভিমত অপেক্ষা এই ধারণা (conception) একটি তাৎপর্যময় অগ্রগতি, তারপরেও এটি প্রগাঢ়ভাবে সীমাবদ্ধ ছিল। হেগেলের সিস্টেমের ভাববাদকে অস্বীকার করতে যেয়ে তিনি এটির গতিশীলতা (dynamism) ও র‌্যাডিক্যালিজম অস্বীকার করেন-এই ধারণা যে মানব সমাজসমূহ পরিবর্তনের বিষয় (subject) এবং নয়া একটি দিয়ে এর নিরাকরণ (supersede) হতে পারে।

মার্কস ফয়েরবাখের মানব স্বভাবের স্থিতির ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মানব স্বভাব সম্পর্কে বলেন যে “এর বাস্তবতায় এটা হলো সামাজিক সম্পর্কগুলোর জালিকা (ensemble)।”২২ এটি দ্বারা তিনি বুঝাতে চান যে এটা পরিবর্তিত হয় নানা পদ্ধতি অনুসারে যাতে সমাজ সংগঠিত ছিল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো নানা পদ্ধতি যাতে শ্রম সংগঠিত ছিল। প্রত্যেকটি ব্যক্তি সত্তার সহজাত মানব স্বভাব থেকে মার্কস তাঁর মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে নিবদ্ধ করেন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্কের ওপর - যে পদ্ধতিতে জনগণ সক্রিয়ভাবে বহিঃস্থ দুনিয়ার ওপর কাজ করে এবং এর মাঝে নিজেদের উপলব্ধি করে।

যদি শ্রম কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তখন দু’টি বিষয় সর্বোচ্চ (paramount) গুরুত্ব পায়: (১) নানা উপায় যাতে জনগণ তাদের শ্রম সম্পন্ন করে (হাতিয়ার, মেশিনারি, ইত্যাদি); এবং (২) নানা পদ্ধতি যাতে শ্রম সংগঠিত হয়। হেগেল সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন পদ্ধতির ইতিহাসকে দেখেন আত্মার (spirit) নানা রূপ (different forms) হিসেবে, যেটি নিজেকে নিজেই বুঝতে পারে (realising itself)। মার্কসের জন্য বিপরীতটি সত্য। সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন রূপ এবং উৎপাদনের বিভিন্ন উপায় ইতিহাসকে সামনে ধাবিত করে এবং সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণার জন্ম দেয়। এটি মানব আত্মার নয়া পর্যায় নয় যেটি পুঁজিতন্ত্র তৈরী করেছে, বরং পুঁজিতন্ত্র যার অধীনে মানুষজাতি বসবাস করাতে তাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা তৈরী হয়েছে। বিভিন্ন হাতিয়ার এবং শ্রম সংগঠনের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুমোদন দেয় কাজের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের প্রকাশ করতে (অথবা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়াতে)।

 এর অর্থ হলো এই যে পরকীকরণকে জয় করা সম্ভব কেবলমাত্র জনগণ যে পদ্ধতিতে তাদের শ্রম সংগঠিত করে, সেই পদ্ধতির রূপান্তর করে। যে অবস্থায় তারা বসবাস করে একইসাথে তার রূপান্তর ছাড়া, জনগণের ধারণাবলীকে পরিবর্তন করতে শিক্ষায় উদ্যোগ নিলে তা অন্তঃসারশূন্য হবে। তাঁর ১৮৪৫এর “ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমহ”-এ মার্কস লেখেন:


পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ও পরিপালন (upbringing) সংক্রান্ত বস্তুতান্ত্রিক মতবাদ ভুলে যায় যে মানুষই পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে পরিবর্তন করে এবং স্বয়ং শিক্ষককে শিক্ষাদান করা দরকার। পারিপার্শ্বিক অবস্থাসমূহের পরিবর্তন এবং মানব সক্রিয়তা বা আত্ম-পরিবর্তনের (self-changing) মধ্যে মিলটাকে ধারণ করা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে  বোঝা সম্ভব কেবলমাত্র বৈপ্লবিক অনুশীলন (revolutionary practice) হিসেবে।২৩


জনগণের মাথার ভূত দূর করতে দরকার যে পারিপাশির্^ক অবস্থাসমূহে তারা বাস করে এবং কাজ করে, সেগুলোর রূপান্তর। এবং এজন্য দরকার বৈপ্লবিক অনুশীলন। শ্রমের কেন্দ্রীকতা এবং বৈপ্লবিক রূপান্তরের গুরুত্ব -  এই দু’টি পয়েন্ট হলো মার্কসের সকল কাজ, বিশেষ করে পরকীকরণের ওপর তাঁর ধারণাসমূহ বোঝার চাবিকাঠি, এবং আমি তাদের নিকট ফিরে আসবো পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে। মার্কসের জন্য কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ছিল কীভাবে দুনিয়াকে আমরা সক্রিয়ভাবে পরিবর্তন করি। সুতরাং মার্কসের জগদ্বিখ্যাত দাবী ছিল এই যে “দার্শনিকেরা কেবলমাত্র নানভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো সেটাকে পরিবর্তিত করা।”২৪ এটি হাতিয়ারসমূহের আহŸানের চেয়ে বেশী কিছু; এটিকে গণ্য করা হয় দার্শনিক বিপ্লব হিসেবে।






অধ্যায় তিন

একটি সার্বজনীন শ্রেণী

রুশো, হেগেল ও ফয়েরবাখের জন্য পরকীকরণ এমন একটাকিছু যা হলো একটি সার্বজনীন মানব অবস্থা (a general human condition)। একটি নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসকারী  প্রত্যেককে এটি বিস্তৃতভাবে একই মাত্রায় প্রভাবিত করে। যাহোক, মার্কস পর্যবেক্ষণ করেন যে কিছু অন্যদের থেকে অধিকতর পরকায়িত। সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত, এবং এই শ্রেণীগুলো পরকীকরণের অভিজ্ঞতা লাভ করে বিভিন্ন উপায়ে:

            সম্পত্তিবান শ্রেণী এবং প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী একই মানব স্ব-বিচ্ছেদের (self-estrangement) অভিজ্ঞতা লাভ করে। কিন্তু প্রথম উল্লেখিত শ্রেণীটি এই স্ব-বিচ্ছেদে নিশ্চিন্ত বোধ করে এবং শক্তিশালী মনে করে, এটি বিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দেয় এর নিজের ক্ষমতা হিসেবে এবং এর মধ্যে বিদ্যমান আছে মানব অস্তিত্বের আভাস।


            পুঁজিতন্ত্রের অধীনে প্রোলেতারিয়েত, শ্রমিক শ্রেণী তাদের নিয়োগ-কর্তাদের থেকে অধিকতর তীব্রভাবে পরকীকরণের অভিজ্ঞতা লাভ করে।

            প্রোলেতারিয়েতের বৃদ্ধি গঠন করে মার্কসের বিশ্লেষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনে দরকার হয় দু’টি শ্রেণীতে সমাজের বিভাজন। প্রথম শ্রেণী উৎপাদন উপায়ের মালিক, যেমন, মেশিনারি, টুলস এবং আর্থিক সংস্থান (finance) যেগুলো জিনিসপত্র উৎপাদনে দরকারী। দ্বিতীয় শ্রেণীর শ্রম দক্ষতা ছাড়া বিক্রয়ের কিছু নেই। পরবর্তীতে মার্কস শ্রমিককে মুক্ত হিসেবে বর্ণনা করেন “দ্বৈত অর্থে”। যেহেতু “একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে (as a free individual)  তার নিজের পণ্য হিসেবে তিনি তাঁর শ্রম ক্ষমতা বিক্রয় করতে পারেন, এবং অন্যদিকে তাঁর বিক্রয়ের জন্য অন্য কোনো পণ্য নেই, অর্থাৎ তিনি সেগুলোকে থেকে মুক্ত (rid of them), তাঁর শ্রম ক্ষমতা বাস্তবায়নের জন্য দরকারী সকল জিনিসপত্র থেকে তিনি মুক্ত”। অন্যকথায় এই মানুষেরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁদের শ্রম সামর্থ্য (শ্রম ক্ষমতা) বিক্রয় করার জন্য স্বাধীন - তাঁরা দাস নন - কিন্তু একই সময়ে এটা করা ছাড়া তাঁদের কোনো বিকল্প নেই, কারণ তাঁদের বিক্রয়  করার জন্য আর কিছু নেই।

                দু’টি প্রক্রিয়াতে এই শ্রেণী অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। একদিকে, শিল্প বিপ্লব নতুন ধরনের মেশিনারি তৈরী করেছে যাতে দরকার হয় বাড়ি থেকে কাজ করার পরিবর্তে বরং শ্রমিকেরা যেন একটা নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত হয়। ব্যক্তি শ্রমিক এই যন্ত্রপাতির মালিক নয়, বরং পুঁজিপতি এর মালিক। অন্যদিকে, ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য মানুষের বিশাল গ্রুপ তৈরী করতে গণ বাজেয়াপ্তকরণের (mass expropriation) দরকার, মার্কস যেটিকে বলেন “আদিম সঞ্চয়ন” (primative accumulation)।  এতে জড়িত থাকে কৃষকদের তাঁদের ভূমি থেকে উৎখাত - “যে মুহুর্তগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ হঠাৎ জোরপূর্বক তাদের জীবিকার উপায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এবং মুক্ত ও অসংযুক্ত (free and unattached) প্রোলেতারিয়েত হিসেবে শ্রম-বাজারে নিক্ষিপ্ত হয়”। মার্কস বর্ণনা করেন কীভাবে এটি সংঘটিত হয় “নিষ্ঠুর সন্ত্রাসবাদীতার পরিবেশে”, যেখানে সম্প্রদায়, গির্জা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার ভূমিসমূহ দখল করে নেয় ব্যক্তি পুঁজিতন্ত্রীরা। এটির সবচেয়ে গুরুতর উদাহরণ ছিলো স্কটল্যান্ডে হাইল্যান্ড ক্লিয়ারেন্স, যাতে হাজার হাজার পরিবার তাদের জমি থেকে বিতাড়িত হয়। যে জমিতে একদা তাদের বাড়ি ছিল পরবর্তীতে তাদের অনেকেই সেখানে কাজ করতে পুনর্নিয়োগ পায়।

            মার্কসের জন্য, প্রোলেতারিয়েত ছিল বিপুল রাজনৈতিক ও তাত্তি¡ক গুরুত্বের। এই জন্য একটি কারণ ছিলো তাদের দুর্ভোগ। ঐ সময়ে ইউরোপে বৃহত্তম শ্রমিক শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায় ইংল্যান্ডে, যেখানে পূর্বেই পুঁজিতন্ত্র শেকড় প্রোথিত করেছিল। এই পরিবর্তনগুলো মেহনতীদের ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত নগরগুলোতে কেন্দ্রীভূত করেছিল, ভগ্ন-স্বাস্থ্য ও দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায়। ১৮৪৫-এ এঙ্গেলস ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর ওপর একটি গবেষণা লেখেন যেখানে তিনি এই দুর্ভোগ বর্ণনা করেন নিবিড়ভাবে। একটি টিপিক্যাল প্যাসেজে তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে:

         

            তাদের সরবরাহ করা হয় খারাপ, ছিন্ন, অথবা পল্কা বস্ত্র, ভেজাল ও অপাচ্য খাদ্য। তারা উম্মোচিত থাকে মানসিক অবস্থার সবচেয়ে উত্তেজনাকর পরিবর্তনসমূহে, আশা ও ভয়ের মধ্যে ভয়াবহ স্পন্দনে; তাদের দৌড়ানো হয় খেলার মতো, মনের শান্তি এবং জীবনের শান্ত আনন্দ অর্জনের অনুমোদন নেই। ইন্দ্রিয় সেবা (sexual indulgence) ও মাতলামি ছাড়া সকল আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের প্রতিদিন কাজ করতে হয় তাদের মানসিক ও শারীরিক শক্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হওয়া পর্যন্ত। এবং, এইভাবে তাদের আয়ত্বে থাকা কেবলমাত্র দুটি আনন্দ দিয়ে তারা প্রতিনিয়ত তাড়িত হয় পাগলামির চুড়ান্ত মাত্রায়।


            তাদের জমির নিরাপত্তা থেকে অপসারণ করা, তাদের শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য করা এবং উপড়ে পড়া জনবহুল নগরগুলোতে তাদের কেন্দ্রীভূত করা, এই অবস্থাগুলো হলো পুঁজিতান্ত্রিক সিস্টেমের সরাসরি ফসল।

            যাহোক, শ্রমিক শ্রেণীর দুর্ভোগে গুরুত্বারোপ থেকে মার্কস দ্রুত সরে আসেন তাদের র‌্যাডিক্যাল সম্ভাবনা (radical potential) উপলব্ধির দিকে। সমাজের প্রকৃত জনগণ থেকে সংযোগবিহীন এক ধরনের অকার্যকর সমালোচনায় মার্কস ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তি দেন যে সমালোচনাকে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাশালী হতে হলে এটার “জনগণকে আকর্ষণ”-এর সামর্থ্য থাকতে হবে। কিছু ধরনের সামাজিক শক্তির সমর্থন (back up) ছাড়া সমালোচনা একাকী ক্ষমতাবিহীন। অধিকন্তু, তাঁর বাসকৃত উদারনীতিক, বৃদ্ধিবৃত্তিক বুর্জোড়া সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি হতাশ ছিলেন, তিনি বিশ^াস হারিয়েছিলেন যে তারা কখনো র‌্যাডিক্যাল শক্তি হতে পারবে (তাদের “বিপ্লবী সাহসিকতার অভাব ছিল, যেটি  নিক্ষেপ করে অভিঘাতী স্পর্ধিত বাণীর মুখোমুখি : আমি কিছুই না, আমার সবকিছু হওয়া উচিত”)। পরিবর্তে, মার্কস বরং উঠতি প্রোলেতারিয়েতের দিকে তাকান সমাজ পরিবর্তনে র‌্যাডিক্যাল শক্তি হিসেবে।


পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে তাদের অনন্য অবস্থানে প্রোলেতারিয়েতের তাৎপর্য নিহিত। ইতিহাসে যেকোনো পূর্ববর্তী শ্রেণী থেকে তারা পৃথক। তারা সার্বজনীনভাবে এবং প্রয়োজন দ্বারা দখলচ্যুত। কেবলমাত্র সংজ্ঞার্থ অনুসারে, সম্পদ উৎপাদনের উপায় থেকে প্রোলেতারিয়েতকে পৃথক করা হয়। সুতরাং সিস্টেমে তাদের কোনো কায়েমী স্বার্থ নেই, রক্ষা করতে কোনো সম্পত্তি নেই। যখন বুর্জোয়ারা পুরাতন সামন্ত সমাজ উৎখাত করে, তখন ফল হয় একটি নয়া ধরনের শ্রেণী শাসন, সম্পত্তির নয়া ধরন সহ, পুঁজিতন্ত্র। বিপরীতে প্রোলেতারিয়েতের নেতৃত্বে একটি বিপ্লব শ্রেণী বিভাজন উৎখাতের দিকে ধাবিত করে। মার্কস প্রোলেতারিয়েতকে বর্ণনা করেন একটি শ্রেণী হিসেবে যার একটি সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য আছে, এর সার্বজনীন দুর্ভোগের জন্য। এটা কোনো নির্দিষ্ট সত্য দাবী করে না কারণ এটির দুর্ভোগ কৃত ভুল একটি নির্দিষ্ট ভুল নয়, বরং সার্বিকভাবে ভুল।


যাহোক, পুঁজিতন্ত্রকে ভাঙ্গতে, এবং পুঁজিতন্ত্রের অভ্যন্তরে তাদের রক্ষা করতে শ্রমিকদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে। কেবল একটি ধর্মঘট অথবা শিল্প-কারখানায় অন্য এ্যাকশন কার্যকর হতে পারে না যদি কিছু মানুষ কাজ অব্যাহত রাখে। একটি যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং যৌথ এ্যাকশন নিতে হবে। মার্কস মনে করতেন যে এটিই প্রোলেতারিয়েতকে পৃথক করে অন্য শ্রেণীগুলো থেকে, যে শ্রেণীগুলো একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ততটুকু যতটুকু তারা তাদের বসেদের সাথেও লিপ্ত। যেহেতু তাদের সংগ্রামগুলোতে তাদের যৌথভাবে কাজ করতে হয়. মার্কস তাই বিশ্বাস করেন যে প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী বিভাজনকে পুরোপুরি উৎখাত করতে সমর্থ হবে, এবং যৌথ সহযোগিতা প্রতিযোগিতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। এ কারণে মার্কস যুক্তি দেন যে , “শিল্প-কারখানায় একটি বিদ্রোহ যতই সীমিত হোক না কেন, এটি এর ভেতরে লালন করে একটি সার্বজনীন আত্মা” (a universal soul)।

এটা জোর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ যে প্রোলেতারিয়েত সম্পর্কে মার্কসের ধারণা বিকশিত হয় অনেক বছর ধরে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনসমূহের নিবিড় অধ্যয়ন ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তাঁর হেগেলের সমালোচনাতে প্রোলেতারিয়েতের তাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে লেখা-লেখির কয়েক মাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী সংঘটিত হয় যা তাঁর বিশ্লেষণকে সমর্থন করে। ১৮৪৪-এ সাইলেশিয়াতে (তখনকার প্রাশিয়াতে, এখনকার পোল্যান্ডে) তাঁতীরা উচ্চতর মজুরির দাবীতে বিক্ষোভে জেগে ওঠে। এটি দ্রুত তীব্র হয়ে প্রুশিয় রাষ্ট্রের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যুত্থান, প্রুশিয়াতে অনেকের ওপর এর প্রভাব ছিল। এটা ছিল সন্ধি মুহুর্তের একটা কিছু, যাতে মার্কসের অনেক আপাত র‌্যাডিক্যাল সমসাময়িকেরা ব্যর্থ হয় একটি পরীক্ষায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কসের প্রাক্তন সহযোদ্ধা (colleague) আর্নল্ড রুজ (Arnold Ruge) বিদ্রোহের গুরুত্বকে সমালোচনা করেন এবং অবমূল্যায়ন করেন।

রুজের সমালোচনা হিসেবে লেখা তাঁর এই সময়কার লেখালেখিতে, মার্কস পর্যবেক্ষণ করেন কীভাবে তাঁতীদের বিদ্রোহ দ্রুত অর্থনৈতিক থেকে সামাজিক দাবীতে সরে আসে, তিনি তাদের অকুতোভয় সিংহনাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেন যা এমনকি চুল্লী, কারখানা, বা অঞ্চলের কথা উল্লেখ করে না বরং যাতে প্রোলেতারিয়েত তৎক্ষণাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির সমাজকে বিরোধীতা করার ঘোষণা করে সবচেয়ে সিদ্ধান্তিক, আক্রমণাত্মক, নির্মম ও তেজস্বী উপায়ে। অনুমানকৃত পশ্চাৎপদ, অশিক্ষিত তাঁতীরা সমাজের একটি সমালোচনা বিকশিত করেন যা মার্কসের উদারনীতিক বুদ্ধিজীবি বন্ধুদের সমালোচনাকে অতিক্রম করে।

মার্কসের জীবন ব্যাপী এটি ছিল শ্রমিক শ্রেণীর ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য (persistant feature)। এই প্রক্রিয়াতে ১৮৪৪-এর বিদ্রোহগুলো ছিলো প্রাথমিক পর্যায়ের যা ধাবিত হয় ১৮৪৮-এর ব্যাপক বিপ্লব ও অভ্যুত্থানে। মার্কস ও এঙ্গেলস নিজেদের এই বিদ্রোহগুলোতে প্রক্ষেপ করেন, যে সমস্ত গণতান্ত্রিক দাবীতে তারা জড়িত ছিলেন সেগুলোকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করতেন, কিন্তু এই যুক্তিও দিতেন যে কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণী চুড়ান্তভাবে  একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে। মার্কস ও এঙ্গেলসের শ্রমিক শ্রেণীর ওপর আস্থা যথেষ্ট স্পষ্ট কমিউনিস্ট ইশতেহারে। এই বিপ্লবগুলোর প্রাক্কালে তাঁরা কমিউনিস্ট ইশতেহার লেখেন, যেখানে তাঁরা যুক্তি দেন, “কমিউনিস্টদের তাত্ত্বিক উপসংহারগুলো কোনভাবেই এই অথবা সেই হবু সংস্কারকের আবিস্কৃত ধারণাবলী বা নীতিমালার ওপর নির্ভর করে না। তাঁরা নিছক প্রকাশ করে, সাধারণ ভাষায়, বিদ্যমান শ্রেণী সংগ্রাম থেকে উদ্ভূত প্রকৃত সম্পর্কাবলী, ঠিক আমাদের চোখের সামনে চলমান ঐতিহাসিক আন্দোলন থেকে”।

এটি লক্ষণীয় যে কেবলমাত্র মার্কস ও এঙ্গেলস এই আন্দোলন প্রত্যক্ষকারী মানুষ নন। বুর্জোয়া শ্রেণীর অনেক তাত্ত্বিক নিজেরা ঠিক এই সম্ভাবনাগুলো দেখেছিলো। ১৮৪৮-এ ব্যারিকেডগুলোর অপর পাশর্^ থেকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এ্যালেক্সিস ডি টোকভিল (Alexis de Toqeville) লিখছিলেন, তিনি এটি যথেষ্ট স্পষ্টভাবে  দেখেন:


অনিবার্যভাবে আগে বা পরে তারা আবিষ্কার করতে বাধ্য যে তাদের অবস্থানে যা তাদের ধরে রাখে তা সরকারের সংবিধান নয়, বরং  অপরিবর্তনীয় আইনসমূহ যেগুলো স্বয়ং সমাজকে  গঠন করে (constitute); এবং এটা তাদের জিজ্ঞাসা করা খুব স্বাভাবিক যে তাদের এগুলো পরিবর্তনের ক্ষমতা ও অধিকার আছে কিনা, যেভাবে তারা অন্যগুলো (others) পরিবর্তন করেছিলো।


অবশ্যি ডি টোকভিল থেকে মার্কসকে যা পৃথক করে তাহলো তিনি বিশ^াস করেন না যে সমাজের নিয়মগুলো

“অপরিবর্তনীয়” এবং তিনি শ্রমিকদের স্বাগত জানান সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য।

            যখন মার্কস প্রোলেতারিয়েতকে বর্ণনা করেন সমাজের একটি নয়া ও বর্ধিষ্ণু গোষ্ঠী হিসেবে। তখন এটি ছিলো একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু, এমনকি পশ্চিম ইউরোপেও, এবং বাদবাকী দুনিয়াতেও এটি কোনোমতে অস্তিত্বমান ছিল। যাহোক মার্কস পূর্বানুমান করেন যে পুঁজিতন্ত্রের সম্প্রসারণ নির্ভর করে দ্বৈত অর্থে আরো বেশী করে শ্রমিকদের মুক্ত করে। শ্রমিকেরা হবে জনসংখ্যার অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং এটি গঠন করবে তাদের বিপ্লবী সম্ভাবনার একটি অংশ:


সকল পূর্বতন আন্দেলন ছিলো সংখ্যালঘিষ্ঠের আন্দোলন অথবা সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থে পরিচালিত আন্দোলন। প্রোলেতারিয় আন্দোলন হলো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্ম-সচেতন (self-concious), স্বাধীন আন্দোলন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে।


            এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। এখন দুনিয়া ব্যাপী বিস্তৃত একটি বিশাল, বৈশ্বিক শ্রমিক শ্রেণী বিদ্যমান। দক্ষিণ বিশ্বের (global south) উন্নয়ন প্রক্রিয়া তৈরী করেছে এবং তৈরী করে যাচ্ছে জনগণের বিশাল গোষ্ঠীসমূহ, প্রধানত নগরগুলোতে, যারা বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করে অন্যকারো জন্য কাজ করে। উন্নত বিশে^ও শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা বিপুল। তারা প্রায়ই বস্তুগতভাবে তৃতীয় বিশ্বের মেহনতীদের থেকে অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিসম্পন্ন, কিন্তু তারা এখনো বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল চাকুরীর ওপর।

            প্রোলেতারিয়েতের মার্কসের বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই কীভাবে তিনি পরকীকরণকে একটি দু-ধারী তলোয়ার হিসেবে প্রত্যক্ষ করেন। যখন পুঁজিতন্ত্র সার্বজনীন পরকীকরণ, দুর্ভোগ, দখলচ্যূতকরণ সংঘটিত করে, তখন এটি র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তৈরী করে, যার অস্তিত্ব পূর্বে কখনোই ছিল না। বহুবিস্তৃত পরকীকরণ শর্তাবলী তৈরী করে, এবং এর নিজের উৎসাদন ও নিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। সম্পত্তি থেকে তাদের সার্বজনীন পরকীকরণের কারণে মার্কস প্রোলেতারিয়েতকে দেখেন সম্পূর্ণরূপে শ্রেণীবিভাগ বিলোপ করতে সক্ষম হিসেবে। একটি সার্বজনীন শ্রেণী হিসেবে, এটি মানবতার সবকিছুর প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। “যখন প্রোলেতারিয়েত ব্যক্তিগত সম্পত্তির নেতিকরণের দাবী করে, এটি কেবলমাত্র সমাজের জন্য একটি নীতিতে উন্নীত করে যেটিকে সমাজ ইতোমধ্যে প্রোলেতারিয়েতের জন্য একটি নীতিতে প্রণীত করেছে”।

           

অধ্যায় ৪

শ্রম প্রক্রিয়া থেকে পরকীকরণ




পরকীকরণের মার্কসের বর্ণনাতে মানব শ্রমকে এর কেন্দ্রে রাখা হয়। এটি হেগেল কর্তৃক উপলব্ধ কেবলমাত্র বিমূর্ত অর্থে “মানবিক কর্মকান্ড” নয়, বরং মূর্ত (concrete3), স্বাতন্ত্রিক (specific) উপায়সমূহ দিয়ে মানব সত্তাসমূহ তাদের চারপাশের দুনিয়াতে কাজ করে। মার্কস বলেন, “প্রাকৃতিক শক্তি সহ (with natural powers) মানুষ একটি দেহধারী, জীবন্ত, বাস্তব (real), ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (sensuous), বিষয়ী সত্তা (objective being), এটা বলার অর্থ হলো এই যে তার সত্তার এবং প্রাণবন্ত অভিব্যক্তির বিষয় হিসেবে তার রয়েছে প্রকৃত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহ (objects), অথবা সে কেবলমাত্র প্রকাশ করতে পারে তার জীবনকে বাস্তব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোতে”। এটা বলে তিনি যুক্তি দিচ্ছিলেন যে মানবসত্তাগুলো নিজেদের যে অবস্থাসমুহে দেখতে পায় তা যদি আমরা বুঝতে চাই তাহলে আমাদের নির্দিষ্ট উপায়গুলো দেখতে হবে যাতে ব্যবহারিক কর্মকান্ড সংগঠিত করা হয়। এটা হলো নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের পরিবর্তে বরং উৎপাদনশীল কর্মকান্ড যেটি সচেতনভাবে আমাদের পরিবেশকে রূপ দেয় সৃজনশীল উপায়ে, দুনিয়াতে আমাদের নিজেদের উপলব্ধি করতে তাই হলো চাবিকাঠি।
    মার্কস নানাভাবে শ্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। প্রথমত, মানব সত্তার শ্রম কীভাবে প্রাণীদের থেকে পৃথকায়িত হয়:

    একটি মাকড়সার পরিচালনকৃত কাজ তাঁতীর কাজের অনুরূপ, এবং একটি মৌমাছি তার মৌচাক প্রকোষ্ঠসমূহের নির্মাণ দ্বারা অনেক স্থপতিকে লজ্জায় নিপতিত করতে পারে। কিন্তু যেটি সবচেয়ে খারাপ স্থপতিকে পৃথকায়িত করে মৌমাছিদের সবথেকে সেরাটি থেকে তাহলো এই যে মোমে নির্মাণের পুর্বেই স্থপতি প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করে তার মনে। প্রত্যেক শ্রম প্রক্রিয়ার শেষে, একটি ফলাফল পাওয়া যায় যা শুরুতেই শ্রমিক কর্তৃক কল্পনাকৃত, সুতরাং ইতিমধ্যে ভাবগতভাবে (ideally) অস্তিত্বমান।

    মানব শ্রম বৈশ্যিষ্টায়িত হয় যৌথ, সচেতন, সৃজনশীল অস্তিত্ব দিয়ে এবং রূপান্তরিত হয় প্রাকৃতিক জগতের সাথে সংযোগে। যখন মাকড়সা ও মৌমাছি তাদের প্রয়োজন মেটাতে পরিবেশকে রূপান্তরিত করে, এবং মৌমাছিরা এটা করে যৌথভাবে, তারা কেবলমাত্র ক্রিয়া করে সজ্ঞা অনুসারে। অন্য দিকে, মানুষেরা তাদের শ্রম পরিকল্পনা করে আগামভাবে, এবং অধিকন্তু তারা নয়া ও পৃথক জিনিষসমূহ উৎপন্ন করতে পারে।  
  মার্কসের জন্য, পুঁজিতন্ত্রের অধীনে যা সংকীর্ণভাবে বিবেচনা করা হয় শ্রমের তাৎপর্য্য তার থেকে অধিক। প্রায়ই “কাজ”-কে উপলব্ধি করা হয় মানব কর্মকান্ডের কেবলমাত্র কিছু প্রকারভেদের বর্ণনা হিসেবে যেগুলো “দরকারী” (useful) এবং “উৎপাদনশীল” (productive)। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে এটি হলো সাধারণত মজুরির জন্য শ্রমিক কর্তৃক সম্পাদিত শ্রম। যাহোক, মার্কসের জন্য, শ্রমের অর্থ হলো যেকোনো মানবিক কর্মকান্ড যাতে জড়িত থাকে প্রাকৃতিক জগতের যৌথ, সৃজনশীল রূপান্তর।
এর অর্থ হলো এই যে মার্কস শ্রমকে বোঝা হিসেবে, অথবা দরকারী কিন্তু অনভিপ্রেত হিসেবে বলা কথাগুলোর ঐতিহ্য থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ছেদ ঘটান। মার্কসের পড়া অর্থনীতিবিদদের অনেকেই যখন মূল্যের জন্য শ্রমের গুরুত্বকে স্বীকার করছেন, তখনো এটিকে দেখছিলেন একটা-কিছু হিসেবে যেটি মূলগতভাবে ভারবাহী। বিপরীতক্রমে, মার্কস শ্রমকে দেখেন মানব কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে যা হতে পারতো সত্যিকার পরিপূর্ণতা ও অভিব্যক্তির উৎস। প্রকৃতপক্ষে, তিনি এই ধারণাবলীকে আক্রমণ করেন স্বয়ং পরকীকরণের ফলাফল হিসেবে। ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে আমরা কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করি নিছক বোঝা (burdensome) হিসেবে এবং এর বাইরে আমরা আনন্দিত বোধ করি, এর থেকে আমাদের পরকীকরণের কারণে: “ফল হলো এই যে মানুষ (শ্রমিক) অনুভব করে যে সে মুক্তভাবে কাজ করছে কেবলমাত্র তার প্রাণি প্রবৃত্তিতে- আহার, পান (drinking),  সন্তান জন্মদান (procreating), অথবা  বড় জোর তার বসবাস ও সাজসজ্জায়”।
এটির একটি উদাহরণ হলো অবসর ও কাজের মধ্যকার পার্থক্য যা আধুনিক সমাজে খুবই প্রচলিত (common)। জনগণ সব ধরণের সৃজনশীল কর্মকান্ড সম্পাদন করে তাদের তথাকথিত “অবসর সময়ে”  - তারা সঙ্গীত রচনা করে, মডেল তৈরী করে, খেলাধুলা করে সাহিত্য পড়ে এবং লেখে, এবং অন্যান্য কর্মকান্ডের  একটি বিশাল পরিসর সম্পাদন করে। এখন পর্যন্ত এটাকে দেখা হয় নিছক অনুৎপাদনশীল অবসর কর্মকান্ড হিসেবে, অথবা “শখ”, যা করা হয় দরকারী কাজের মাঝখানে, আগমন-প্রস্থানের মাঝখানের সময়ে (time between clocking off and clocking on) আমাদের ব্যস্ত রাখতে। পালাক্রমে, “অবসর শিল্প” (leisure industry) লাভজনক ব্যবসা (lucrative bussiness) গড়ে তোলে এর বৈশিষ্ট্যের ওপর দাড়িয়ে। এটি সব ধরনের উপায় অন্বেষণ করে অবসরকে পন্যায়িত ও নিয়ন্ত্রণ করতে যাতে এটি থেকে মুনাফা বানানো যায়। মানুষের খুবই বৈচিত্রময় আগ্রহ ও প্রকল্পকে দেখা হয় তাদের গুরুত্বের নিছক একটি পাশর্^-প্রদশর্নী হিসেবে যেমন, একদিকে মজুরি শ্রমিক, এবং অন্যদিকে, একজন নিষ্ক্রিয় ভোক্তা হিসেবে।
অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপিতে (Economic and Philosophical Manuscripts) মার্কস প্রজাতি-সত্তার নিরিখে শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন। এটি একটি কুট ধারণা (tricky concept) যেটি কিছু বিতর্কের কারণ হয়েছে, কিন্তু এটাকে বিস্তৃতভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে মানব প্রকৃতির (human nature) ধারণা হিসেবে। যাহোক, রুশো বা হবস কর্তৃক প্রচারিত মানব প্রকৃতির রূপকল্প (vision of human nature) এটি নয়, অথবা সে বিষয়ের জন্য উধরষু গধরষ কলাম লেখক যা বলেন উদাহরণ হিসেবে, আমরা সবাই “প্রকৃতিগতভাবে” লোভী এবং নারীরা “প্রকৃিতগতভাবে” গৃহিনী, তাও নয়। ফয়েরবাখ কর্তৃক প্রবর্তিত প্রজাতি-সত্তার অনড়, স্থির ধারণাও (fixed, static conception)  নয়। মার্কস ব্যক্তির মাঝে নিহিত কিছু-একটা সহজাত থেকে মনোযোগ সরিয়ে মানুষের মধ্যকার সম্পর্কগুলোর মধ্যে নিবদ্ধ করেন। ্এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে শ্রম ছিলো সবচেয়ে মৌলিক। মার্কস শ্রমের গুরুত্ব বর্ণনা করেন “মানব অস্তিত্বের প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত চিরস্থায়ী অবস্থা” হিসেবে।  মানুষ সম্পর্কে ইতিহাস জুড়ে একটি ধ্রুব সত্য হচ্ছে এই যে তারা দুনিয়ার ওপর শ্রম সম্পাদন করে যৌথ, সচেতন ও সৃজনশীল উপায়ে, প্রথমত তাৎক্ষণিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে এবং তারপর ঐ প্রয়োজনগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে: “সচেতন জীবন কর্মকান্ড মানুষকে তৎক্ষণাৎ পৃথক করে প্রাণি জীবন কর্মকান্ড থেকে”। প্রজাতি-সত্তা একটি বিতর্কিত ধারণা হিসেবে থেকে যায়, এবং ঐ বির্তকগুলোর কতগুলোতে আলোকপাত করা হবে অধ্যায় দশে।
   
শ্রম হলো প্রথম ও সর্বাগ্রে একটি যৌথ কর্ম। একজন মানুষ তার নিজ থেকে যতটুকু অর্জন করতে পারে তা খুব সামান্য। কেবলমাত্র সবথেকে মৌল প্রয়োজনগুলো মিটতে পারে, এবং এমনকি প্রায়ই সেগুলোও না। বিপরীতে, সহযোগিতার মাধ্যমে অবিশ্বাস্য বিষয়সমূহ (things) অর্জন করা যেতে পারে। ডানপন্থী অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদদের পুরাকথা (mythologies) সত্ত্বেও, সমাজগুলোতে মনুষ্যজন সবসময় অস্তিত্বমান থেকেছে, যাতে শ্রম সংগঠিত হয়েছে সমবায়ীভাবে (cooperatively)। মূল প্রশ্ন সবসময় ছিলো সেই সহযোগিতার শর্তাবলী কি হবে। এর অর্থ হলো এই যে মার্কসের মতে , শ্রম একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে সামাজিক সম্পর্কাবলীর গঠনে।
মার্কসের মতে, পরকীকরণ ছিলো আমাদের শ্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি সম্পর্কে। পরকীকরণের উৎস খুঁজে পেতে হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণের ঘাটতিতে। যখন এটাই প্রকৃত ঘটনা (case) সকল সমাজে, যেখানে একটি শ্রেণী অপরটির ওপর আধিপত্য করে। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে এটি একটি বিশেষ রূপ (particular form) নেয়। কারণ শ্রমিকদের উৎপাদন উপায়ের ওপর মালিকানা নেই, বেঁচে থাকার জন্য তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে হয় পুঁজিতন্ত্রীদের নিকট। এইভাবে শ্রমশক্তি নিজেই একটি পণ্য হয়ে যায় - বাজারে ক্রয়-বিক্রয় হয় এমন একটাকিছু। এই পণ্য বিক্রয় করে শ্রমিকেরা প্রতিদিন তাদের সময়ের একটা অংশ পুঁজিতন্ত্রীর জন্য নতুন মূল্য তৈরী করতে ব্যয় করেন।
এটি হলো মার্কসের বিশ্লেষণকৃত প্রক্রিয়া, মানব শ্রমের পণ্যে রূপান্তর, যেটি পরকীকরণের বিভিন্ন মাত্রা দেয়। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে এটি হলো পরকীকরণের সবচেয়ে মৌলিক রূপ (মার্কস পরকীকরণের অন্যান্য দিক বর্ণনা করেন শ্রম প্রক্রিয়া থেকে পরকীকরণের “ সার-সংক্ষেপায়ন” হিসেবে)। পুঁজিতন্ত্রীদের নিকট তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ে শ্রমিকেরা কেবল কিছু মুক্ত সময় (free time) হারায় না, যাতে তারা যা করতে চায় তাই করতে পারতো ভিন্নভাবে – তারা তাদের জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর সকল নিয়ন্ত্রণ হারায়: “মজুরের কর্মকান্ড (activity) তার স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকান্ড নয়। এটি অন্যের সত্তাধীন, এটি হলো তার সত্তার (self) ক্ষতি (loss)। তাদের সৃজনশীল ক্ষমতাসমূহ কেবল তাদের নিজেদের উদ্যোগগুলোতে প্রবাহিত হয় না, বরং বসদের প্রয়োজনগুলোতে প্রবাহিত হয়।

এখানে নিয়ন্ত্রণ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। যারা তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করে অনতিরঞ্জিতভাবে (litterally) এটিকে পরকায়িত করে দূরে সরিয়ে দেয়, এটার ওপর সকল নিয়স্ত্রণ হারায়। শ্রম প্রক্রিয়া হয়ে উঠে অন্য কারো নিয়ন্ত্রণের অধীনে একটা-কিছু এবং চুড়ান্তভাবে যেকোনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিতন্ত্রের প্রয়োজনের অর্থ হলো এই যে কাজের মাধ্যমে জনগণের অভিব্যক্তিকে (expression) অস্বীকার করা। প্রথমত, পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদন সংগঠিত করা হয় কর্তৃত্ব ও আদেশের কঠোর কাঠামো অনুসারে: এক জেনারেলের যুদ্ধের ময়দানে যেভাবে কমান্ড করা উচিত সেভাবে এখন একজন পুঁজিতন্ত্রীকে উৎপাদন ক্ষেত্রে কমান্ড করা উচিত”। পুঁজিতন্ত্র দাবী করে যে তাদের কাজের (job) সাথে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত-গ্রহণে (decision-making) মেহনতিরা জড়িত থাকবে না। চাকুরিদাতার নিকট তাদের সময় বিক্রয় করাতে, চাকুরিদাতা তাদেরকে কম-বেশী বলতে পারে কীভাবে কাজ করতে হবে এবং কোথায়।
অধিকন্তু, একজন পুঁজিতন্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রম এমন একটা-কিছু যাকে সুষম করতে হবে (has to be made uniform)। এটা বলা এই নয় যে প্রত্যেকটি কাজকে একই হতে হবে, বরং এটাকে পরিমাপ করতে হবে বিমূর্ত  পদসমূহ দিয়ে। শ্রমের অন্যান্য এককের সাথে এটাকে অবশ্যি গণনাযোগ্য, পরিমাপযোগ্য, ও তুলনীয় হতে হবে – এটাকে সংখ্যায় ব্যক্তকরণযোগ্য (quantifiable) হতে হবে। সুষমকরণের (homogenesation) এই প্রক্রিয়া নাটকীয় উপায়ে কাজের রূপান্তরকে পরিহার করতে পারেনা। মার্কস বর্ণনা করেন কীভাবে মেহনতীদের দেখতে হবে, এবং তাদের নিজেদের দেখতে শুরু করে নিছক “বিমূর্ত কর্মকান্ড এবং একটি উদর” হিসেবে।
স্বয়ং পুঁজিতন্ত্রের প্রয়োজন থেকেই পরিমাপকরণের এই প্রয়োজন আসে। মার্কসের মতানুসারে, মানব কর্মকান্ডকে বিমূর্ত শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়, এর ওপর পুঁজিতন্ত্র নির্ভর করে। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে সকল পণ্যের ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য থাকে। ব্যবহার মূল্য  হিসেবে পণ্যসমূহ হলো মূর্ত মানব শ্রমের উৎপাদ (product), এটির মানুষের নিকট ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যেটি সামাজিক সম্পর্কসমূহ দিয়ে “সক্রিয়কৃত” (activated) হয়, কিন্তু তাদের থেকে স্বাধীনভাবে। যাহোক, পণ্য-দ্রব্যাদি বাজারে বিনিময়কৃত হয় তাদের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী, এবং এটি অর্জনে তাদেরকে অবশ্যি দেখতে হবে “সুুষম মানব শ্রমের নিছক জমাট বাঁধা পরিমাপ হিসেবে, অর্থাৎ  এর ব্যয়ের (expenditure) রূপ নির্বিশেষে ব্যয়কৃত (expended) মানব শ্রমশক্তি হিসেবে”। পুঁজিতন্ত্রকে কেজো রাখতে, নির্দিষ্ট মান অনুসারে পণ্য-দ্রব্যাদি বিনিময় পুঁজিতন্ত্রের জন্য সম্ভব রাখতে মানব শ্রমকে দেখা হয় এই বিমূর্ত পদসমূহ দিয়ে। ফলে, কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির শ্রমের বিশেষ, মানব বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত শ্রমের অধীনস্থ হয়, যা সুষম ও পরিমাপযোগ্য (homogenized and measurable)।
যারা উচ্চ শিক্ষায় গত কয়েক দশক কাজ করেছেন, তারা পরিচিত হয়ে থাকবেন শ্রম ও শ্রম সময়কে সংখ্যায় পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণের (quantify and regulate) দাবীর সাথে। নিগূঢ়, বিভ্রান্তিকর এবং খুবই ঘৃণিত Research Assessment Exercise হলো এর একটি উদাহরণ। যেমনটি এ্যালেক্স ক্যালিনিকোস (Allex Callinicos) বর্ণনা করেন:

একাডেমিকদের নিয়োগ দেয়া হয় গবেষণা করতে ও পড়াতে (ধারণাগতভাবে বেতনের পাঁচ-দ্বিতীয়াংশ দেয়া হয় গবেষণা করতে)।
তখন তাদের উৎপাদনশীলতাকে কীভাবে পরিমাপ করা হয়? শিল্পকারখানার সাথে তুলনাতে দরকার হলো কিছু ভৌত উৎপাদ (physical output) খুঁজে পাওয়া যা পরিমাপ করা যায়।

এইভাবে পুঁজিতন্ত্রের দাবীতে প্রয়োজন হয় যে গবেষণা ও শিক্ষণের কাজ অবশ্যি পরিমাপযোগ্য ও সংখ্যায় ব্যক্তকরণযোগ্য হতে হবে অন্য যেকোনো প্রকারের কাজের মত। প্রভাষকের কাজের তুলনা করা সম্ভব হতে হবে অন্য যে কোনো শ্রমিকের কাজের সাথে বিমূর্ত উপায়ে। অনুরূপভাবে,  যা শেখানো হবে তা পরিমাপকৃত হতে হবে। “স্থানান্তরযোগ্য” দক্ষতাসমূহের ওপর খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়, ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট প্রত্যাশা করা হয় এই দক্ষতাগুলো তারা আত্মস্থ করবে তাদেও অন্যান্য অধ্যয়নের পাশাপাশি।  একটি চাকুরি পরামর্শদানকারী ওয়েবসাইট এগুলো বর্ণনা কওে “যোগ্যতাসমূহ যেগুলো একটা কর্মকান্ড থেকে অপরটিতে স্থানান্তরযোগ্য” হিসেবে। এটি এবং বিমূর্ত শ্রমের মধ্যে  সংযোগ পর্যবেক্ষণ করা কোনো কঠিন কাজ নয়, যেটিকে মার্কস বর্ণনা করেন, যেটিকে মার্কস বর্ণনা করেন এমন একটি শ্রম হিসেবে যা এর বিশেষ সুনির্দিষ্টতার প্রতি নিষ্পৃহ, কিন্তু সকল সুনির্দিষ্টতায় সক্ষম”।৪৭

পুঁজিতন্ত্রের অধীনে  পরকীকরণ হলো পুরোপুরি নিকৃষ্ট। কারণ, পুঁজিতন্ত্র জনগণের জন্য অবারিত করেছে অভূতপূর্ব সম্ভাবনাসমূহ তার চারপাশের জগৎকে আকর দিতে (to shape the world around them)। সামাজিক উৎপাদনের পূর্বতন রূপগুলোর (previous forms) সীমাবদ্ধতা ছিল তাদেও সৃজনশীল ক্ষমতায়। বিপরীতে পুঁজিতন্ত্র হলো  একটি ব্যবস্থা “যার সার্বজনীনতা (universality) ব্যক্তির তার নিজেকে এবং অন্যদেও থেকেই পরকীকরণ তৈরী কওে না, সাথে সাথে তার সম্পর্কাবলী এবং সামর্থ্যসমূহও তৈরী করে”। সামন্ত প্রভুর নিজেকে এবং দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ভালভাবে পরিপালনের বাইরে উৎপাদন বিকাশে (in developing production) কোনো আগ্রহ থাকে না, কিন্তু পুঁজিতন্ত্রীগণকে নিরন্তর একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এইভাবে তারা সবসময় বাধ্য হয় জিনিসপত্রাদি উৎপাদনের নয়া, অধিকতর দক্ষ উপায়সমূহের উদ্ভাবনের জন্য যাতে এই উৎপাদন দ্রুততর, সহজতর ও অধিকতর সস্তা হয়। মানুষজনের ব্যাপকভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধি করাতে এর প্রভাব রয়েছে যাতে তারা চারপাশের জগৎকে আকর দিতে পারে, “তাদের নিজেদের উপলব্ধি করতে পারে” ।

যাহোক, পুঁজিতন্ত্রে অধীনে এই আত্ম-উপলব্ধি সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য সহজলভ্য নয়। পুঁজিতন্ত্র যে সৃজনশীল ক্ষমতাসমূহ উম্মোচিত করে, তার পাশাপাশি এটি  ঐ ক্ষমতাসমূহের প্রতি আরো বৃহত্তর অস্বীকৃতি নিয়ে আসে, যেহেতু এই উৎপাদিকা ক্ষমতাসমূহ অধিকতরভাবে একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, এবং বেশী বেশী করে মানব কর্মকান্ড বিমূর্ত, সুষমকৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিল্প পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ এর সাথে নিয়ে এসেছিল কাজের সময় ও নিয়ন্ত্রণের ওপর সম্পূর্ণরূপে নতুন মনোভাবসমূহ। মজুরি শ্রম বিকাশের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে ঘড়ির ব্যাপক মালিকানা , এমনকি ঘড়িতে মিনিটের কাঁটার অন্তর্ভূক্তি। সময়কে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা হয়ে দাড়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। নৈমিত্তিক, প্রকৃতির ছন্দ সাপেক্ষ এবং নির্দিষ্ট কর্মভারের (particular task) দরকারসমূহ হওয়া থেকে কাজের স্থানান্তর ঘটে নিয়মিত, পরিমাপকৃত, বাঁশি বাজানো পর্যন্ত কর্মরত থাকা, যে পর্যন্ত না একটি কর্মভার (task) সম্পন্ন  হয় তার পরিবর্তে। ইংল্যান্ডে পুঁজিতন্ত্রীরা অনেকগুলো ঐতিহ্যবাহী ছুটি ও উৎসব বাতিল করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, এতে অন্তর্ভূক্ত ছিল উইকেন্ডের পরে সোমবারের বন্ধ তুলে দিয়ে সন্ত সোমবারের প্রথার ওপর আঘাত (cracking dowing) - যাতে আরো কর্ম ঘন্টা বের করে আনা যায় (squeezed out)।৪৯  কাজটা যতটুকু  হতে পারতো তার থেকে কম পরিতৃপ্ত করতে এই সবকিছু অবদান রাখে।

 আধুনিক কল সেন্টারগুলো প্রদান করে এই তাড়নার একটি স্পষ্ট উদাহরণ যাতে কর্মচারীদের নিকট থেকে প্রতিটি কার্য মিনিট নিংড়ে নেয়া হয়। কম্পিউটারকৃত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে টয়লেট ব্রেক ও  মধ্যাহ্নভোজের সময়,  যখন কঠোর গাইডলাইন হুবহু নির্দেশ দেয় কীভাবে ফোনে আপনার সময় সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করবেন। সবকিছু কার্যকর করা হয় যাতে শ্রমিকদের কাছ থেকে শ্রমের প্রত্যেকটি সম্ভাব্য মিনিট নিংড়ে নেয়া যায়; একজন শ্রমিকের তার পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি। কিছু কল সেন্টারে শ্রমিকদের গ্রাহকদের সাথে লেনদেনের জন্য প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়ার (question and responses) একটি ফ্লো-চার্ট রিপোর্ট দেয়া হয়, কারণ নিয়োগকর্তারা একটি যান্ত্রিক মডেলের সাথে এই মিথষ্ক্রিয়াটি ন্যুনতম করতে খুবই আগ্রহী।

স্কটল্যান্ডে কল সেন্টারগুলোর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে “নয়া তথ্য প্রযুক্তির বিন্যাসের প্রবর্তনে শিফট প্যাটার্নের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব প্রায়ই বেড়ে যায় (exacerbated) যা প্রত্যেক কর্মচারীকে (employee) শিফট বিন্যাসে ন্যুনতম পছন্দ বা সুবিবেচনা (choice or discretiom) দেয়”৫০, যেহেতু “রুটিনকৃত, তীব্র ও অনিশ্চিত কাজের সীমাবদ্ধতাগুলো একটি অধিকতর পরিপূর্ণ জীবন অর্জনে একটি বড় বাধা উত্থাপন করে” অধিকাংশ শ্রমিকের জন্য।৫১ এটা কোনো বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি নয় যখন সিভিল সার্ভিস ইউনিয়ন নেতা Mark Serwotka কল সেন্টারগুলোকে অভিহিত করেন “নয়া অন্ধকরের শয়তানের মিল” হিসেবে।

পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদনে শ্রমিকদের বর্ধিতভাবে মনে হয় একটি অতিকায় মেশিনের (a grand machine) নিছক একটি অংশ। হাঙ্গেরিয় দার্শনিক গিয়র্গ লুকাস এই প্রক্রিয়াটি ভালভাবে বর্ণনা করেন:

 কর্ম-প্রক্রিয়ার যৌক্তিকিকরণের ফলে শ্রমিকের মানবিক গুণাবলী ও মানসিক গড়ন বর্ধিতভাবে প্রতীয়মান হয় নিছক ভ্রান্তির ‍উৎস হিসেবে যখন বিপরীতে এই বিমূর্ত বিশেষ আইনগুলো কাজ করে যৌক্তিক ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে। বিষয়গতভাবে (objectively) অথবা তার কাজের সাথে তার সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে কোনভাবেই মানুষ এই প্রক্রিয়ার প্রকৃত প্রভু হিসেবে আভির্ভূত হয় না; বিপরীতে তিনি একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থাতে আত্মীকৃত একটি যান্ত্রিক অংশ। তিনি দেখতে পান এটি ইতোমধ্যে পূর্ব-অস্তিত্বমান (pre-existing) ও স্বয়ং-সম্পূর্ণ(self-sufficient), এটি তাঁর নিকট থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং তাঁকে এর আইনসমূহের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়ে তিনি এটি পছন্দ করুন আর নাই করুন।৫২

 শ্রমিকের বিশেষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা (particular individuality) শ্রম প্রক্রিয়াতে একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। 
স্বতন্ত্র মানব বৈশিষ্ট্য এমন একটা কিছু যাকে  উদযাপন বা সদ্ব্যবহারের চেয়ে, বরং ইস্ত্রি করে দূর করে হ্রাস করতে হবে। 

কাজ বিভাজিত হয়ে (break down) সরল একঘেয়ে কর্মসমূহে (simple monotonous tasks) রূপান্তরিত হয়। একজন ব্রিটিশ কার শ্রমিক প্রোডাকশন লাইনের কাজের বর্ণনা দেন:

এটা বাস্তবিকই দক্ষতা নয়  যেমন . . আমি মনে করি হা, তুমি পাও নানা ধরণের অনেক জিনিষ করার জন্য, তাদের নিজের থেকে বিবেচনা করলে তারা চমৎকার সাদাসিদা কাজ। এটা দক্ষতা নয়। দেখে মনে হবে আপনি সত্যি একজন রোবট . . .  আমি সুইচ অফ করতে পারি এবং আমি বারবাডোসে সৈকতে বসতে পারি।৫৩

এই কাজ থেকে সকল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা ও সৃজনশীলতা নিংড়ে নেয়া হয়: এটা নিষ্ঠুরভাবে বিরক্তিকর”।৫৪

মার্কসের মতে, এই প্রবণতাগুলো পুঁজিতন্ত্রের অনিবার্য পরিণতি। পুঁজিতন্ত্র নির্ভর করে যে শ্রমের ওপর তা স্বয়ং একটি পণ্যে রূপান্তরিত,  এমন একটাকিছু যা স্থানান্তরিত হয়েছে অন্যদের নিয়ন্ত্রণে। এই প্রাথমিক পরকীকরণ হচ্ছে ভিত্তি যাতে কাজের মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশকে অস্বীকার করা হয়, এবং এইভাবে মানবতার জন্য রয়েছে ভীষণ পরিণতি।


অধ্যায় পাঁচ

উৎপাদ থেকে পরকীকরণ 

 মার্কস আরও বর্ণনা করেন যে পুঁজিতন্ত্রের অধীনে শ্রমিকেরা যে দ্রব্যসমূহ উৎপন্ন করেন সেগুলো থেকে কীভাবে তাঁরা পরকায়িত হন। আবার, এর রয়েছে একটি আক্ষরিক দিক -  শ্রমিকেরা তাদের উৎপাদের মালিক নয়, বরং এটির মালিক তাদের নিয়োগকর্তা। অনেক মানুষ কাজ করে যে জিনিসগুলো উৎপন্ন করে সেগুলোর মালিক তাঁরা নয় - যেমন কার তৈরী করা বা বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি উৎপন্ন করা যেগুলো ক্রয়ের সামর্থ্য তাঁদের কখনও হয় না, অথবা যে রেস্টুরেন্টসমূহে তাঁরা খাবার পরিবেশন করে সেগুলোতে কখনও তাঁদের খাওয়ার সামর্থ্য হয় না। যে জিনিসগুলো আমরা  ‍উৎপন্ন করি সেগুলো অন্য কারও সম্পত্তি হিসেবে শেষ হয়; সেগুলো সত্যিকার অর্থে কখনও আমাদের হয় না।

আধুনিক জীবনের এটি সেই পরিমাণে একটি বৈশিষ্ট্য, যতটুকু মার্কসের সময়ে ছিল। দিনে ১ ডলারের কম টাকায় ১ বিলিয়নের বেশী মানুষ বেঁচে থাকে এবং দিনে ২ ডলারে জীবনযাপন করে ২ বিলিয়নের অধিক মানুষ। চীনে এ্যাপোলের আইফোন প্রস্তুতকারী শ্রমিকেরা মাসে খুব বেশী হলে ১৭২ ডলার আয় করেন- দৈনিক ভিত্তিতে তাঁরা যে হাজার হাজার সৌখিন দ্রব্যাদি (fancy gadgets) উৎপন্ন করেন তার কোন একটি ক্রয়ের ধারেকাছে কোথাও থাকেন না। এটি নিছক উন্নয়নশীল বিশ্বের বৈশিষ্ট্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল মোটর্সের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নটি  দেখায় যে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রমিকেরা যে কারগুলো  উৎপন্ন করে সেগুলো কেনা তাঁদের জন্য খুবই কষ্টকর। আমেরিকাতে অভিবাসী শ্রমিকদের বিক্ষোভগুলোর একটি উৎস এই বোধ থেকে যে তাঁদের শাক-সবজি কেনার সামর্থ্য নেই যেগুলো তাঁরা উত্তোলন করে, তাছাড়া অনেক তরুণ শ্রমিকেরা নিজেদের  দেখতে পায় ন্যূনতম মজুরি বা তারচেয়ে কমে রেস্টুরেন্টগুলোতে কাজ করতে, যেগুলো একবার খাবারের জন্য  এক সপ্তাহের মজুরির সমান টাকা দাম ধরে।

 শ্রমিকেরা যে দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন করে সেগুলো অন্য কারও নিকট বিক্রয় করা হয়, অন্য কারও দ্বারা, অন্য কারও জন্য মুনাফা তৈরী করতে। আমরা সেগুলো দেখতে পারি আমাদের সৃজনশীল সক্ষমতাসমূহের উৎপন্নসমূহ হিসেবে - এই ধারণা সম্পূর্ণ অর্থহীন। মার্কস যেমনটি বলেন, “শ্রমের এই উসুল (realisation) প্রতীয়মান হয় শ্রমিকদের জন্য বাস্তবতার একটি ক্ষতি হিসেবে, বিষয়ের ক্ষতি ও এর প্রতি বন্ধন হিসেবে বিষয়করণ (objectification as loss of and bondage to the object), এবং  বিচ্ছেদ হিসেবে, পরকীকরণ হিসেবে আত্মসাৎ”।৫৫ যেভাবে আমরা আমাদের উৎপাদিত দ্রবসামগ্রীর সাথে মিথষ্ক্রিয়া করি তা সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে যায়।
 এর অর্থ এই যে এই উৎপন্ন দ্রব্যগুলো, পাশাপাশি অন্য কারও জিনিসপত্রাদি প্রতীয়মান হয় আমাদের বিরোধী একটাকিছু হিসেবে। “শ্রমিক যে জীবন দ্রব্যটির (the object) ওপর অর্পন করে, সেটি তাঁর মুখোমু্খি হয় শত্রুতাপূর্ণ ও পরক (hostile and alien) এমন একটাকিছু হিসেবে"।৫৬ শ্রমিক এই দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন করতে যত বেশী শক্তি ব্যয় করেন, ঠিক ততটুকু কম পরিমাণে এটি তাঁর নিজের: “শ্রমিক নিজেকে যত বেশী ব্যয় করেন, তত বেশী ক্ষমতাশালী হয় দ্রব্যসামগ্রীর পরকায়িত জগৎ যেটি তিনি সৃজন করেন নিজের বিরুদ্ধে ও বিপক্ষে, তিনি নিজে আরও দরিদ্রতর হন- তাঁর অন্তরতর জগৎ তাঁর নিজের হিসেবে তাঁর নিকট আরও কম অন্তর্গত হয়”।৫৭

এই ধরণের পরকীকরণের সাথে মোকাবেলা করতে, মানুষকে বিশ্বাস করাতে, তাঁরা যা উৎপন্ন করে তার সাথে একাত্মতাবোধ করাতে, ব্যবস্থাপনাবর্গের (management) প্রচেষ্টাসমূহ ‍প্রায়ই হাস্যকর (hilarious) হয়। মিশিগানে জেনারেল মটরসের একটি ট্রাক ফ্যাক্টরিতে তাঁর কাজের বয়ানে বেন হ্যাম্পার (Ben Hamper) ব্যবস্থাপনাবর্গের আরোপিত বিভিন্ন কৌশলের (techniques) বর্ণনা দেন। প্রথমটি ছিল একটি “কোয়ালিটি মাসকোট”, হাওয়ে মেকাম (a quality mascot, Howe Makem), “একটি প্রকান্ডকায় বেড়াল, যার মাথায় কোয়ালিটির জন্য Q অক্ষর শোভিত একটা লম্বা লাল টুপি ছিল” যেটি কারখানাতে (plant) ঘুরে বেড়াত মনোবল বাড়াতে। দ্বিতীয়টি ছিল কারখানার চারপাশে স্থাপিত নিয়ন সাইনসমূহের একটি সিরিজ যাতে উদ্দীপনামূলক বার্তাসমূহ থাকত:

যে বার্তাসমূহ তারা প্রদীপ্ত (flash) করত সেগুলোর পরিসর ছিল মামুলি প্রচারণা (corny propaganda) (সবুজ নিয়ন বাতি হ’ল হাওয়ে মেকামের প্রতিকৃতি যেটি উচ্চারণ করছে জঞ্জাল বাক্যাবলী যেমন উৎকর্ষ হচ্ছে ভাল কারিগরি দক্ষতার মেরুদন্ড ), উদ্দেশ্যমূলক তীব্র চিৎকার (motivated pep squawk) (একজন  বিজয়ী কখনও প্রস্থান করে না, একজন প্রস্থানকারী কখনও বিজয়ী হয় না ) থেকে মস্তিষ্ক ঝাঁকুনি দেয়া জাবরকাটাসমূহ (নিরাপত্তা হ’ল নিরাপদ) . . .আমি বার্তা বোর্ড চালুর প্রথম দিনের কথা মনে করতে পারি। পুরো সিফট ব্যাপী এটি একটি একক বার্তা প্রদীপ্ত হচ্ছিল . . . ধাতব পিনগুলো মুচরানো কৌতুককর (Squeezing rivets is fun)।৫৯

অনাশ্চর্যজনকভাবে, এগুলোর কোন কিছুই মনে হয় না কোনও লক্ষণযোগ্য পার্থক্য তৈরী করে শ্রমিকদের তৈরীকৃত ট্রাকগুলোর সাথে তাঁদের সামর্থ্যকে অভিন্নরূপে গণ্য করতে।

অধ্যায় এক-এ আমি উল্লেখ করেছিলাম ডেভিড রিকার্ডোর যুক্তি (argument)। এই যুক্তিতে তিনি বলেছিলেন যে মূল্যের (value) উৎস হ’ল শ্রম (labour)। এর অর্থ হ’ল এই যে মানব শ্রমের উৎপাদগুলো (products) ঐ শ্রমের মূর্তরূপ (embodiments), যাতে অন্তর্ভৃক্ত থাকে শ্রমিকদের নিজেদেরই একটি দিক। মানুষজন যে যন্ত্রপাতিতে কাজ করে তা তাঁরা যে দ্রব্যাদি উৎপন্ন করে সেগুলোর মতই শ্রমের উৎপাদ (product of labour)। এইভাবে শ্রমিকেরা পরিবেষ্টিত থাকে এবং প্রভাবাধীন থাকে তাঁদের নিজেদের অতীত শ্রমের মূর্তরূপসমূহ (embodiments) দিয়ে। অধিকন্তু, পুঁজি দ্বারা এইভাবে মূতায়িত (embodied) শ্রমকে মার্কস বর্ণনা করেন মৃত (dead) শ্রম হিসেবে। শ্রমিকদের “জীবন্ত” (living) শ্রমের মত নয়, এই মৃত শ্রম (dead labour) যেমন যন্ত্রপাতি, কারখানা ইত্যাদি আর কোন মূল্য তৈরীতে অক্ষম।

আরও বেশী বেশী সঞ্চয়নে পুঁজিতন্ত্রের অবিরাম তাড়না মৃত শ্রমের এই দুনিয়াকে আরো বেশী করে বর্ধিত করার দিকে ধাবিত হয়। শ্রমিক যত বেশী কাজ করে, ততই তিনি তাঁর জীবন্ত শ্রমকে আরও বেশী করে ঢেলে দেন মৃত শ্রমের এই দুনিয়াতে। যদিও এই দুনিয়া অন্য কারও অধিকারে, এবং এইভাবে র‌্যাডিক্যালগতভাবে পরকীকৃত বলে প্রতীয়মান হয়। একটি বিখ্যাত প্যাসেজে মার্কস পুঁজিকে একটি পিশাচের (vampire) সাথে তুলনা করেন, যেটি “কেবলমাত্র বেঁচে থাকে জীবন্ত শ্রম পান করে (lives by sucking living labour), এবং যতই বেশী বেঁচে তাকে, ততই বেশী এটি শ্রম পান করে”।৬০ কাজের বর্ণনাসমূহে প্রায়ই কর্মক্ষেত্রকে স্বাধীন, প্রতিদ্বন্দ্বী জীবন্ত সত্তা  (independent, hostile living being) হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ফ্রান্সে কয়লা খনিশ্রমিকদের ধর্মঘট সম্পর্কে ইমিল জোলার ঊনিশ শতকের উপন্যাস Jerminal, এতে তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে খনি “এর গর্তের তলায়, একটি শয়তানি জন্তু হিসেবে এর ভাবভঙ্গি সহ, কড়মড় করে চিবানো অব্যাহত রাখে, ভারী ও ধীরগতির দম দিয়ে শ্বসন ক্রিয়া, মানুষের মাংসের বেদনাদায়ক হজমক্রিয়া দিয়ে যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়।

যখন মৃত সামগ্রীর এই দুনিয়া আরও বড় হয়, তখন শ্রমিকেরা যে শ্রম সম্পাদন করে তা প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পায় না। যখন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ শ্রমিকদের জীবন সহজতর করতে পারত, তখন এটি কেবল নয়া ও স্বতন্ত্র ধরনের খাটুনি বোঝায়। পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ থেকে এটি হ’ল সাধারণ চিত্র (general story)। ১৮৬৭ সালে প্যারিসে একটি বিশাল বাণিজ্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা সারা দুনিয়া থেকে আসা প্রযুক্তি প্রদর্শন করে। Live Working অথবা  Die Fighting-এ পল ম্যাসন (Paul Mason) বর্ণনা করেন কীভাবে শ্রমিক সংগঠনসমূহ থেকে ডেলিগেটরা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনিতে (expo) অংশগ্রহণ করেন এবং নিজেদের প্রতিবেদনসমূহ উত্থাপন করেন। তাদের প্রতিক্রিয়া কর্তৃপক্ষকে ধাক্কা দেয়: “প্রতিবেদনসমূহ পড়লে, যান্ত্রিকীকরণের প্রশংসার কবিতার পরিবর্তে মধ্য-ঊনিশ শতকের সামাজিক বিন্যাসের একটি টেকসই সমালোচনা বলে মনে হয়।৬২ শ্রমিকদের ডেলিগেটগণ যন্ত্রপাতি বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু এর মধ্যে দেখতে পেলেন তাঁদের নিজেদের অবস্থানের অস্বীকৃতি। এই নয়া যন্ত্রপাতি প্রতীয়মান হ’ল তাঁদের নিজেদের মূল্যহীনতার প্রতীক হিসেবে। 
   
    পুঁজিতন্ত্রের অধীনে পরকীকরণের আর একটি বৈশিষ্ট্যকে এটি নির্দেশ করে। মেশিনারি এমন একটাকিছু যা তাঁর ভার লাঘব করতে পারে, এভাবে দেখার পরিবর্তে মার্কস যেভাবে দেখেন, “যেহেতু শ্রমিক একটি মেশিনে রূপান্তরিত, মেশিন তাঁকে মোকাবেলা করতে পারে একটি প্র্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে”।৬৮ এটির সবথেকে চরম উদাহরণ দেখা যায় ঊনিশ শতকের প্রথম দিককার লুডাইট আন্দোলনে (Luddite movement), যখন শ্রমিকেরা সক্রিয়ভাবে মেশিনারি ধ্বংস করে যেগুলোকে তাঁরা দেখেছিলেন তাঁদের জীবনের পথে হুমকি হিসেবে। আজ পর্যন্ত সমস্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপ ধারণ করে। ফ্যাক্টরি বা অফিসে নয়া প্রযুক্তির প্রবর্তন কাজের পরিবেশের উন্নতির একটি ইঙ্গিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এটি ঠিক একইসাথে কাজ হারানোরও সংকেত হয়ে থাকতে পারে। প্রযুক্তিতে উন্নতি শ্রমিকদের জন্য যতটুকু পরিত্রাণের কারণ হতে পারে ততটুকু ন্যায়ত ভয়েরও কারণ হতে পারে।

 

অধ্যায় ছয়

পণ্য-কাম

 
 তাঁর পরবর্তী কালের অধিকতর বিকশিত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিশ্লষণের জন্য, মার্কসের পরকীকরণের প্রথম দিককার বিশ্লেষণ ভিত্তি স্থাপন করেছিল। পরকীকরণকে উপলব্ধি করা হত শ্রম প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব হিসেবে, এটি নানা আঙ্গিকে অস্তিত্বমান ছিল। যাহোক, মার্কস যুক্তি দেন, পুঁজিতন্ত্রের অধীনে, এটি একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিক নেয় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্যবস্থাটি শক্তিশালী করতে এবং পুনঃ-সৃষ্টিতে। এই আঙ্গিকটিকে তিনি পণ্য পূঁজা বলেন। পুঁজিতন্ত্রের পূর্বে সামন্ততন্ত্র ও সমাজের অন্যান্য রূপের অধীনে, সামাজিক উৎপাদন সংগঠিত হত তাৎক্ষণিক উপায়ে। যে সার্ফরা ভূমিতে কাজ করত তাঁরা তাঁদের সামন্ত প্রভুদের সরাসরি খাজনা (tribute) দিত। এই সম্পর্ক কার্যকর হত (was enforced) প্রধানত সরাসরি বলপ্রয়োগ ও নির্যাতনের (coercion) মাধ্যমে। এটা ছিল প্রভুর (lord) সামরিক শক্তি যা তাকে অনুমোদন দিত এই মূল্য নিষ্কাশন করতে। এর অর্থ এই নয় যে তাঁদের শ্রম ও তাঁদের জীবনের ওপর সার্ফদের নিয়ন্ত্রণ ছিল, বরং তা থেকে অনেক দূরে। তাঁরা যা করত তা সামন্ত প্রভু নিয়ন্ত্রণ করত (dictate), উৎপাদন পরিচালিত হত প্রধানত তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। পুঁজিতন্ত্র ভিন্ন। এক শ্রেণী থেকে আর একটিতে সম্পদের সরাসরি আত্মসাতের (direct appropriation) ওপর এটি নির্ভর করে না। বরং এটি নির্ভর করে বাজারে বিনিময় সম্পর্কের ওপর। মার্কস ও এঙ্গেলস এই রূপান্তরটিকে বর্ণনা করেন এভাবে: বুর্জোয়ারা যেখানেই আধিপত্য লাভ করে, সেখানেই সকল সামন্ত, পিতৃতান্ত্রিক ও সরল সম্পর্কসমূহের অবসান ঘটায়। এটি নির্দয়ভাবে প্রবল ঘূর্ণীতে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে বহুবৈচিত্রময় সামন্ত বন্ধনগুলোকে (ties) যা মানুষকে তাঁর “প্রাকৃতিক ঊর্ধ্বতন”-এর সাথে বেঁধে রাখে, এবং নগ্ন আত্ম-স্বার্থ ছাড়া, নির্মম “নগদ নারায়ন” (cash payment) ছাড়া মানুষে মানুষে আর কোনও সম্পর্ক অবশিষ্ট রাখে না। এটি নিমজ্জিত করেছে ধর্মীয় উদ্দীপনার সবচেয়ে স্বর্গীয় ভাবাবেশসমূহকে, সাহসী উদ্দমকে, সংকীর্ণমনা ভাবপ্রবণতাকে আত্মম্ভরি হিসাবের (egotistical calculation) বরফতুল্য পানিতে। এটি রূপান্তরিত করেছে ব্যক্তিগত নৈতিক গুণকে (personal worth) বিনিময় মূল্যে, এবং অসংখ্য অখন্ডনীয় চার্টারকৃত স্বাধীনতাসমূহের পরিবর্তে, এটি স্থাপিত করেছে সেই একক, অবিবেকী স্বাধীনতা – মুক্ত বানিজ্য।৬৪ বাজারে প্রত্যেকে হাজির হন একজন স্বাধীন, সার্বভৌম এজেন্ট হিসেবে যার মালিকানায় রয়েছে বিনিময়ের জন্য একটাকিছু, এবং বিনিময়ের এই প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে পুঁজিতন্ত্র নিজেকে সংগঠিত করে। এখনও এটিতে জড়িত আছে জি শোষণ সম্পর্ক, কিন্তু এটি হ’ল একটি যা সংঘটিত হয় বাজার-স্থানে পণ্যসমূহের দৃশ্যত মুক্ত ক্রয় ও বিক্রয়ের মাধ্যমে। শ্রমিকেরা হাজির হন একটি পণ্যের মালিক হিসেবে- সেটি হ’ল একটি বিমূর্ত রূপে তাদের নিজেদের শ্রম, যেটি ক্রয় করেন একজন পুজিতন্ত্রী, যিনি পুজির মালিক। মার্কস যেমনটি বলেন, পুজিতন্ত্রী “শ্রম শোষণের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করতে পারে একমাত্র এই কারণে যে, শ্রম শক্তির শর্তাবলীর মালিক হিসেবে, কেবলমাত্র শ্রম শক্তির মালিক হিসেবে শ্রমিকদের তিনি মোকবিলা করে ”। ৬৫ তখন মানুষেরা একে অপরকে সরাসরি সম্পর্কিত না করে, পণ্যসমূহের মাধ্যমে করে। এর অর্থ হ’ল এই যে মানব সত্তাসমহের মধ্যকার সম্পর্কাবলী দেখতে মনে হয় দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যকার সম্পর্কাবলী হিসেবে। এটি হ’ল তাই যা দিয়ে মার্কস পূঁজা (fetishism) বুঝতেন: এটি হ’ল মানুষদের মধ্যকার সুনির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক, যেটি তাদের চোখে দেয় দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যকার সম্পর্কের একটি চমৎকার রূপ হিসেবে”।৬৬ এটি সময়ের সাথে বিকশিত হয়, যখন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা অধিকতর প্রতিষ্ঠিত হয়।যতই বিনিময়ের প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়, ততই বেশী করে এটিকে মনে হয় জীবনের একটি অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য।পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনে জড়িত সামাজিক সম্পর্কাবলী বস্তুসামগ্রীতে স্ফটিকায়িত বা জমাট বাঁধতে শুরু করে।শ্রমের উৎপাদসমূহ হাজির হয় বিমূর্ত শ্রমের জমাট বাঁধা পরিমাণ হিসেবে।মার্কস বর্ণনা করেন কীভাবে পণ্যে “মনুষ্যজনের শ্রমের সামাজিক বৈশিষ্ট্য তাদের নিকট হাজির হয় বিষয়গত বৈশিষ্ট্য (objective character)হিসেবে ঐ শ্রমের উৎপাদের ওপর ছাপ মারা থাকে (stumped upon); কারণ তাঁদের নিজেদের শ্রমের সাথে উৎপাদকদের সম্পর্ক তাঁদের নিকট উপস্থাপিত হয় একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে, যা অস্তিত্বমান নয় নিজেদের মধ্যে, বরং তাঁদের শ্রমের উৎপাদসমূহের মধ্যে”।৬৭ মার্কস এই পণ্যকামকে তুলনা করেন এক প্রকারের পরকীকরণের সাথে যেটি ফয়েরবাখ চিহ্নিত করেন ধর্মীয় চিন্তায়:

 

সুতরাং, একটি সাদৃশ্য খুঁজে পেতে আমাদের অবশ্যি আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে ধর্মীয় জগতের কুয়াশাচ্ছন্ন (mist-enveloped)অঞ্চলগুলোতে।ঐ জগতে মানব মস্তিষ্কের উৎপাদনসমূহ হাজির  হয় সহজাত জীবনাধিকারী স্বাধীন সত্তা হিসেবে, এবং একে অপরের সাথে এবং মানবজাতির সাথে সম্পর্কে প্রবেশ করে।সুতরাং একইভাবে এটা পণ্যসমূহের জগতের সাথে মানুষের হাতের তৈরী উৎপন্নসমূহের।৬৮

 

ঠিক যেমনভাবে ঈশ্বরসমূহ আসে বহিস্থ সত্তাসমূহে মানবিক ক্ষমতাসমূহ প্রক্ষিপ্ত করে, যেগুলো তখন আমাদের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে, আমাদের বার্তাসমূহ প্রেরণ করে, ইত্যাদি, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদেনেও তেমনি পণ্যসমূহ হাজির হয় স্বাধীন সত্তাবলী (independent entities)হিসেবে।

এই ধরনের পুজার প্রায়শ উদ্ধৃত উদাহরণ হ’ল এই ধারণা যে “টাকায় টাকা বানায়”।এটি হ’ল গতানুগতিকভাবে প্রত্যক্ষীভূত ধারণা, এবং পুঁজিতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পয়েন্ট থেকে, এটি সত্য হিসেবে হাজির হয়।একটি ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত ছোট্ট ঝুঁকি (stake)অনেক বড় মুনাফা তৈরী করতে পারে।স্বল্প মেয়াদে টাকা “বর্ধিত” (grown) হতে পারে সরাসরি এটি বিনিয়োগ না করেই, শেয়ার বাজার ফাটকাবাজি ইত্যাকার মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত বাস্তবে এটি হল নিছক টাকাতে প্রাকৃতিক জগতের একটি বৈশিষ্ট্য প্রক্ষিপ্ত করা।আক্ষরিকভাবে গাছ যেভাবে বর্ধিত হয় টাকা সেভাবে বর্ধিত হয় না।টাকা স্বয়ং অধিকতর সম্পদ উৎপাদন করতে পারে না।এটি হ’ল নিয়োগকৃত জনগণ যারা চুড়ান্তভাবে বিনিয়োগকারীর জন্য মুনাফা উৎপাদন করে।পুঁজা এই বাস্তবতা আড়াল করে, এবং সুপারিশ করে যে টাকার নিজের এক ধরণের প্রায় রহস্যময় সম্প্রাসারণীয় ক্ষমতা আছে।

পণ্যসমূহ আমাদের জীবনে আধিপত্য করে- এটি ক্রমবর্ধিষ্ণুরূপে একটি পরিচিত অনুভূতি।ক্যানাডিয় একটিভিস্টি নাওমি ক্লেইন-এর ২০০০ সনের গ্রন্থ নো লোগো (No logo)।এতে তিনি এই প্রপঞ্চগুলোর অনেক কটি বর্ণনা করেন, এবং কীভাবে বিজ্ঞাপনদাতাগণ সেগুলোকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে দক্ষ হন।উদাহরণস্বরূপ, তিনি একজন জুতার দোকানের মালিককে উদ্ধৃত করেন, যিনি বর্ণনা করেন কীভাবে কিছু উৎপন্ন বস্তু হয়ে ওঠে “অবশ্যি দরকারী” (must have), এবং স্বাস্থ্য অথবা খাদ্যের থেকে অধিকতর মূল্যবান হয়ে ওঠে:

 

আমি খুবই ক্লান্তিগ্রস্ত হই এবং এসব থেকে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ি।আমি সবসময় এই সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য হই যে আমি টাকা বানাই দরিদ্র জনগণের নিকট থেকে।তাদের অনেকেই কল্যাণ ভাতার ওপর জীবন চলে।কখনও একজন মা এখানে আসেন একজন শিশুসহ, এবং শিশুটি নোংরা এবং খারাপ পোষাক পরিহিত।কিন্তু শিশুটি ১২০ বাক মূল্যের এক জোড়া জুতো চায় এবং নির্বোধ মা তার জন্য তা কিনে দেয়।আমি ঐ শিশুর অন্তরতর প্রয়োজন অনুভব করতে পারি- এই জিনিষগুলোর মালিক হওয়ার এই ইচ্ছা এবং সেগুলোর সাথে যে অনুভূতিসমূহ থাকে- কিন্তু এটি আমাকে কষ্ট দেয় যে এই বিষয়ের জন্য এটিই হ’ল পথ।৬৯

 

ক্লেইন বর্ণনা করেন কীভাবে তারা যে প্রকৃত সামগ্রীগুলো বিক্রয় করেন তাদের উপযোগিতাকে অতিক্রম করে এই ব্র্যান্ডগুলো একটি তাৎপর্যময় উপায় নিতে আসে।

মার্কসের তর্ক করতে নাইকি, স্টারবাকস বা অ্যাপলের মত ব্র্যান্ড না থাকতে পারে, কিন্তু তিনি আধুনিক জীবনের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর খানিকটা চিনতে সক্ষম হয়েছিলেন।তিনি একটি টেবিলের অধিকতর মামুলি উদাহরণ দেন:

উদারহণস্বরূপ, কাঠের একটি ধরণ পরিবর্তন করা হয়, এটি থেকে টেবিল তৈরী করে। সে সব সত্তেও, টেবিলটি অস্তিত্বমান থাকে সাধারণ, নিত্যকার বস্তু কাঠ হিসেবেই।কিন্তু, যেইমাত্র এটি একটি পণ্য হিসেবে পদক্ষেপ দেয়, এটি পরিবর্তন হয় কিছু একটা তুরীয়তে (transcendent)। এটি কেবলমাত্র এর পায়ার সাহায্যে মাটিতে দাঁড়িয়েই থাকে না, বরং অন্য সব পণ্যগুলোর সুবাদে, এটি এর মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, এবং এর কাঠের মস্তিষ্কস্থিত কৌতুককর ধারণাবলী বাইরে বিকশিত হয়েছে, যা “টেবিলে রূপান্তরের (table-turning) চেয়ে অনেক অনেক বেশী বিস্ময়কর।৭০

মানবিক কর্মকান্ডের সাধারণ উৎপাদ একটি সম্পূর্ণ নয়া তাৎপর্য নেয়, তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অতিক্রম করে।

যখন পণ্যকামের ওপর মার্কসের বিশ্লেষণ বুঝতে সহায়তা করে ক্লেইন বর্ণিত বিকাশের ধরণগুলো, তখন তাঁর বিশ্লেষণ এবং তথাকথিত “কনজুমার সংস্কৃতি”র ওপর অধিক জনপ্রিয় মন্তব্যের মধ্যকার পার্থক্যে জোর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মার্কসের মতে পণ্যসমূহের নিজেদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর পণ্যকামের কিছুই করার নেই। কিন্ডলে বিদ্যমান আছে কিন্তু একটি বইয়ে নেই, অথবা একটি অর্কেস্ট্রার চেয়ে বরং আইপড দিয়ে তৈরীকৃত সঙ্গীতে আছে এরকম কিছু যাদুকরী বা বিকৃত গুণাবলী – এগুলো সম্পর্কে নয়। প্রায়ই, ভোগবাদের ওপর ব্যাখ্যান সুপারিশ করে যে উৎপন্ন দ্রব্যাদিতে সহজাতভাবে ভ্রান্তিকর একটা-কিছু আছে যাতে আমরা কিনতে উৎসাহী হই।উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন উদারনীতিক হেনরি ডেভিড থোরিয়াউই (Henry David Threau)-এর কথা বলা যায় যিনি এখনও জনপ্রিয় র‌্যাডিক্যাল সার্কেলে।তিনি যুক্তি দেন যে অন্য যেকোনও কিছুর থেকে, “এটি হ’ল সম্পত্তি দিয়ে মোহাবিষ্টতা যা আমাদের বাঁধা দেয় মুক্ত ও মহৎ জীবন-যাপনে”।

এখানে ধারণা এই যে খুব বেশী দ্রব্যাদি থাকা কোনওভাবে সমস্যার মূল কারণ।মার্কসের মতে, যাহোক, জিনিষপত্রগুলো নিজেরা সমস্যা নয় বরং যে সামাজিক সম্পর্কাবলীতে আমরা উৎপাদন করি, মালিক হই এবং ঐ জিনিষগুলো বিনিময় করি, সেটিই সমস্যা।উৎপন্ন দ্রব্যাদিতে আদৌ ভ্রান্তি নেই যেগুলো মানব জীবনকে অধিকতর সহনীয় করে, অথবা অধিকতর কৌতুকময় করে, এমনকি যে দরিদ্র ও বেপরোয়া জনগণ ঐ উৎপন্ন দ্রব্যাদি পেতে চায়, তাতেও কোনও ভ্রান্তি নেই।

মার্কসের বয়ানে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ’ল- এটি এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে যে এই কাম্যবস্তুগুলোকে (fetishes)উপলব্ধি করা উচিত নয় ‍নিছক মোহ (merely illusion) হিসেবে। ভোগবাদ-বিরোধী প্রচারণাগুলোতে প্রায়ই গুরুত্বারোপ করা হয় যাতে মানুষ সাদাসিদাভাবে কম ভোগ করে, তাদের মোহ ও আকাঙ্খা পরিত্যাগ করে।এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি “কোনওকিছু না কেনা দিবস”-এর মত প্রকল্পসমূহ হাতে নেয় যেগুলোতে মানুষজনকে উৎসাহ দেয়া হয় তারা যে জিনিষগুলো চায় বা তাদের যে জিনিষগুলো দরকার সেগুলো কেনা থামাতে।এখানে ধারণাটা এই যে পণ্যদ্রব্যাদির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি মোহ যেটি আমাদের সেভাবেই দেখা উচিত এবং পরিত্যাগ করা উচিত।

যাহোক, মার্কসের বয়ানে কেন্দ্রীয় বিষয় হল পণ্যকাম নিছক একটি মোহ নয়। বরং সেগুলো তাদের নিজেদের জীবন ধারণ করে, পণ্যসমুহের এই উপলব্ধি (perception) হ’ল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রতিফলন, এর থেকে দরকারী স্বাভাবিক বিকাশ (necessary outgrowth)।পুঁজির খন্ড ১-এ, মার্কস ইতালিয় অর্থনীতিবিদ গ্যালিয়ানিকে সংশোধন করেন এই পয়েন্টে মনোযোগ আকর্ষণ করে যে  যখন তিনি বলেন “মুল্য হ’ল ব্যক্তিগণের মধ্যকার সম্পর্ক” তিনি যোগ করতে পারতেন, “একটি বস্তুগত খোলের (material shell) ভেতরে লুকায়িত একটি সম্পর্ক”।৭১ মার্কস পর্যবেক্ষণ করছিলেন যে মানুষজনের মধ্যকার প্রকৃত সম্পর্কাবলীতে এই “মোহসমূহ”-এর শেকড় নিহিত।তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তাঁর নিজের দ্বারা ও অন্যান্য রাজনীতিক অর্থনীতিবিদগণ কর্তৃক নেয়া বিশ্লেষণ “মানবজাতির বিকাশের ইতিহাসে একটি যুগ (epoch) চিহ্নিত করে, কিন্তু কোনওভাবেই শ্রমের সামাজিক বৈশিষ্ট্য কর্তৃক ধারণকৃত বিষয়গততাকে (objectivity)উৎখাত করে না।

সুতরাং, এই বস্তুকামকে (fetishism)পরাজিত করা নিছক একটি বিষয়ের ইঙ্গিতবাহী নয় যে এটি অস্তিত্বমান (যদিও এটি সহায়তা করে)। স্বয়ং সামাজিক সম্পর্কসমূহের রূপান্তর দরকার। সেগুলোর নিজেদের জীবন আছে, নিয়ন্তণকৃত হওয়ার বদলে নিয়ন্ত্রণ করছে, পণ্যসমূহের এই অভিজ্ঞতা হ’ল একটি ব্যবস্থার প্রতিফলন যেখানে উৎপন্ন দ্রব্যাদি হ’ল সংখ্যাগরিষ্ঠের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

পণ্যকাম গঠন করে তাঁর সময়কার প্রধান ধারার অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর মার্কসের সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।তিনি যুক্তি দেন যে প্রধান ধারার অর্থনীতি কেবলমাত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহের কামনা-উদ্রেককারী রূপের (fetishised form) ওপর। অর্থনীতি যে ধারণাবলী ও গণসমূহের প্রকারভেদ (The kinds of concepts and categories) ব্যবহার করে সেগুলো হ’ল নিছক বাস্তবিক সামাজিক সম্পর্কাবলীর কামনা-উদ্রেককারী রূপ। মার্কস যুক্তি দেন যে,“পণ্যসমূহে সহজাতভাবে বিদ্যমান বস্তুকাম (fetishism)দ্বারা কিছু অর্থনীতিবিদ কতটা বিভ্রান্ত . . তা দেখানো হয় বিনিময়-মূল্য গঠনে প্রকৃতি কর্তৃক ভূমিকা পালনের ওপর নিস্তেজ ও ক্লান্তিকর অসদ্ভাবের দ্বারা”।৭৩ “মূল্য”-এর মত ধারণা ভিত্তিকৃত হয় একটি সামাজিক সম্পর্ক (social relationship)দ্বারা; আপনি একটি পণ্যের মূল্য আবিষ্কার করতে পারবেন না এটিকে পর্যবেক্ষণ করে, এটা কোনও বিষয় না আপনি কতটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন: এ পর্যন্ত কোনও রসায়নবিদ মুক্তা অথবা হীরকে বিনিময় মূল্য আবিষ্কার করতে পারেননি”।৭৪

যাহোক, প্রধান ধারার অর্থনীতি এটিকে গণ্য করেন (treats this) স্বয়ং বিষয়ের (object)বৈশিষ্ট্য হিসেবে, সামাজিক সম্পর্কগুলোর থেকে বরং ভৌত প্রকৃতির সাথে এটির কিছু্-একটা করার আছে।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পণ্যকাম যে ভূমিকা পালন করে এটি তারই ইঙ্গিত দেয়। পুঁজিতেন্ত্রের জন্য বিশেষ নিয়মসমূহকে দেখা হয় মানবসমাজের সার্বজনীন, অপরিবর্তনীয় নিয়মাবলী হিসেবে। 
    

এই নিয়মগুলো “যা বহন করে এর ওপর অভ্রান্ত অক্ষরের ছাপ তাহ’ল এই যে সেগুলো সমাজের একটা অবস্থার অন্তর্ভুক্ত, যাতে মানুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রনের পরিবর্তে, মানুষের ওপর উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধিপত্য থাকে, …. স্বয়ং উৎপাদনশীল শ্রমের মতই প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটি স্বতঃস্বিদ্ধ অপরিহার্যতা (self-evident necessity) হিসেবে বুর্জোয়া বোধশক্তির নিকট হাজির হয়”।৭৫ যখন দুনিয়াতে পুঁজিতন্ত্রের নেয়া রূপকে (form) দেখা হয় বিষয়সমূহের (objects) মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে,  তখন এটিকে চ্যালেঞ্জ করা অধিকতর দুরূহ হয়ে পড়ে।

যে পদ্ধতিতে আমারা্ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত সেটির ওপরও পণ্যকাম প্রভাব বিস্তার করে।কারণ আমরা পণ্যসমূহের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত, এই পণ্যসমূহ যে রূপ ধারণ করে তার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার প্রবণতা দেখাই।এইভাবে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী পণ্যায়িত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট মূল্য রূপ নেয়।এটির পুরোপুরি উদাহরণ সম্ভবত যৌণতার পণ্যায়ন।যৌণ শিল্পের পরিসর বিশাল।বছরে এর রাজস্ব মূল্য ৫৭ বিলিয়ন ডলার, এতে অন্তর্ভুক্ত আছে বছরে ২০ বিলিয়ন এ্যাডাল্ট ভিডিও এবং এসকর্ট সার্ভিস থেকে বছরে ১১ বিলিয়ন ডলার।৭৬ এতে জড়িত আছে আমাদের মানবতার অনস্বীকার্য দিক, আমাদের যৌণতা, যা প্যাকেজ করে আমাদের নিকট বিক্রয় করা হয়।যৌণতা নিজেই একটি পণ্য হয়ে যায়। পালাক্রমে, যৌণায়িত চিত্রকল্প (sexualized imagery), মাত্রারিতিক্তভাবে নারীদের, সংস্কৃতির দিকসমূহের সকল প্রকারের প্রকরণে আধিপত্য করতে আসে।উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের বিশাল পরিসরকে বিজ্ঞাপিত করতে সেক্স ব্যবহার করা হয়, এবং এ্যালকোহল থেকে ভালব ক্যাপসহ যেকোনও কিছুর প্রতীক হয় নারী দেহ।এই পরিসীমার ব্যাপ্তি দেখতে আপনার চিন্তা করা প্রয়োজন জুয়েলারি, টি-সার্ট এবং এমনকি পেন্সিল কেইজের ওপর চিত্রিত করা প্লেবয় খরগোসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে।

     যে যৌণ সম্পর্কগুলো সরাসরি পণ্যায়িত হয়নি, সেগুলো্কে এটি প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়নি।সকল সেক্স ক্রয়-বিক্রয় হয় না,

কিন্তু যে সমাজে আমরা একে অপরের সাথে পণ্যগুলোর মধ্য দিয়ে সম্পর্কিত, সেটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নেয়া আরম্ভ করে। যেমনটি শিলা ম্যাকগ্রেগর বলে, যৌণ শিল্প “জোরদার করে নারীর লিঙ্গ বিভাগকে যৌণ বিষয় হিসেবে এবং পুরুষকে ক্রেতা হিসেবে| এই বিভাগ নারীকে তাদের যৌণ প্রয়োজনের অস্বীকৃতির ফাঁদে ফেলে এবং পুরুষকে এই বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে দেয় যে নারী নিছক শরীর যা কটাক্ষ করা যায় এবং কেনা যায়”।৭৭ মূল্য ও পণ্য-রূপের মাধ্যমে স্বয়ং যৌণতাকে উপলব্ধি করা হয়।

     এইভাবে পুঁজিতন্ত্রের মার্কসের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও তাঁর এটির র‌্যাডিক্যাল সমালোচনার মধ্যকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ গঠন করে পণ্যকাম। পুঁজিতন্ত্রের অর্থনীতি উপলব্ধিতে পণ্য-রূপ খু্বই গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে আমাদের সামাজিক জীবনের প্রত্যেকটি দিককেও এই পণ্য-রূপ পরিব্যাপ্ত করে, এবং আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনও দিককে অস্পর্শিত রাখে না। 

 

 

অধ্যায় সাত

অপর থেকে পরকীকরণ

 

মানুষজন যেভাবে একে অপরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে সেটি গঠনে মার্কস শ্রমকে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা হিসেবে দেখেন, এর যৌথ চরিত্রের কারণে। এই শ্রম পরকীকৃত হ’লে এটি ব্যাপক পরিণতি নিয়ে আসে আমাদের সামাজিক জীবনের জন্য এবং অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্কাবলীর জন্যও। মার্কস লেখেন:

 

তাঁর শ্রমের উৎপাদ, তাঁর জীবনের কর্ম-তৎপরতা, তাঁর প্রজাতি-সত্তা (species-being) থেকে মানুষের বিচ্ছেদের আশু পরিণাম হ’ল মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছেদ। যখন মানুষ নিজেকে মোকাবেলা করে, তখন সে অপর মানুষদেরও মোকাবেলা করে। তাঁর শ্রমের সাথে, তাঁর শ্রমের উৎপাদের সাথে এবং তাঁর স্বয়ং নিজের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা সত্যি, অপর মানুষের সাথে, অপর মানুষের শ্রম ও শ্রমের বস্তুর (labour and object of labour) সাথে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা সত্যি।৭৮

 

পরকীকরণে নিছক শ্রমিকবৃন্দ ও তাঁদের শ্রমের মধ্যকার সম্পর্কই জড়িত থাকে না; এটি সমাজে প্রত্যেকের মধ্যকার সম্পর্কাবলী গঠন করে ও অতিরঞ্জিতও করে।মানুষ বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে পড়ে; সহযোগী অংশীদার হিসেবে দেখার পরিবর্তে তারা বরং তাদের প্রতিবেশীদের দেখে বৈরী প্রতিযোগী হিসেবে।

মানুষজনের মধ্যকার সম্পর্কাবলীর শর্তসমূহ অতিরঞ্জিত হয়ে পড়ে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার যুক্তি  দিয়ে। অপর মানবিক সত্তাসমূহ আমাদের সামনে হাজির হয় অর্থনৈতিক বর্গসমূহের (economic categories) মধ্য দিয়ে। আমরা তাদের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নই, বরং গ্রাহক, নিয়োগদাতা, ব্যবস্থাপক, প্রতিযোগী হিসেবে তাদের সাথে সম্পর্কিত। হাঙ্গেরীয় দার্শনিক আইস্তভান মেসজারোস (Istvan Meszaros) এটিকে বর্ণনা করেন “দ্বিতীয়-মাত্রার মধ্যস্থতা”-এর একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। মানব শ্রম সরাসরি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে মানব সত্তা ও দুনিয়ার মধ্যে; এটি একটি উপায় যার সাহায্যে আমরা বহিস্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি।

মেসজারোস যুক্তি দেন যে “উৎপাদনশীল কর্মকান্ড (productive activity)হয়ে যায় পরকীকৃত কর্মকান্ড যখন এটি প্রস্থান করে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার বিষয়ী-বিষয় সম্পর্কে (in the subject-object relationship) এটির মনুষ্যোচিত মধ্যস্থতার যথাযথ কাজ থেকে”।৭৯ অন্য কথায়, পুঁজিতন্ত্র সরাসরি মধ্যস্থতার পরিবর্তে বিপুল সংখ্যক “দ্বিতীয় মাত্রার” মধ্যস্থতা স্থাপন করে, যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কাবলী দ্বারা: “মানুষের উৎপাদনশীল কর্মকান্ড তাকে পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারে না কারণ প্রতিষ্ঠানকৃত দ্বিতীয় মাত্রার মধ্যস্থতাসমূহ হস্থক্ষেপ করে মানুষ এবং তাঁর কর্মকান্ডের মধ্যে, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে, এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যে”।৮০

সবচেয়ে স্পষ্টভাবে, এই বিভাজন প্রতীয়মান হয় শ্রমিক ও বসদের মধ্যকার সম্পর্কে:

 

যদি শ্রমের উৎপাদের মালিক শ্রমিক না হয়, যদি এটি তাঁকে মোকাবেলা করে পরক ক্ষমতা (alien power) হিসেবে। এটি খুবই সম্ভব কারণ এটির মালিক শ্রমিক ব্যতিত অপর কোনও ব্যক্তি . . .। যদি তিনি নিজের কর্মকান্ডকে সম্পর্কিত করেন পরাধীন কর্মকান্ড (unfree activity) হিসেবে, তখন তিনি এটিকে সম্পর্কিত করেন চাকুরিতে কর্মকান্ড হিসেবে, অপর মানুষের শাসন, জুলুম ও জোয়ালের অধীনে।৮১

 

    বিরোধী স্বার্থসহ শ্রেণীতে সমাজের বিভাজনের অর্থ হ’ল এই যে জনগণ একে অপরের বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যে পর্যন্ত এক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নির্ভর করে অন্যের ওপর শোষণ ও অধিপত্যে, সে পর্যন্ত এই ধরনের বিভাজন বিদ্যমান থাকবে। 

      এই পরকীকরণের ভৌত ও ব্যবহারিক পরিণতির ওপর মার্কস গুরুত্বারোপ করেন। আবাসনের ওপর তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে তিনি প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা করেন শ্রমিক জনগণ ও পুঁজিতন্ত্রীদের মধ্যে সংস্থাপিত প্রতিবন্ধকসমূহ ও বিভাজনসমূহকে:

 

দরিদ্র মানুষের ভূগর্ভস্থ আবাস হ’ল একটি বৈরী উপাদান …. একটি আবাস যাকে তিনি তাঁর নিজের রসই ঘর হিসেবে গণ্য করতে পারেন না- যেখানে তিনি অবশেষে চিৎকার করে বলতে পারতেন: “এখানে আমি বাড়ীতে”- কিন্তু যেখানে তাঁর পরিবর্তে তিনি নিজেকে দেখতে পান অন্য কারও বাড়ীতে, একজন অপরিচিতের বাড়ীতে যিনি সবসময় তাঁকে নজরদারীতে রাখেন এবং তাঁকে বাইরে নিক্ষেপ করেন  যদি তিনি তাঁর ভাড়া পরিশোধ না করেন।৮২

 
    

শ্রমিকেরা যে বাড়ীতে বাস করতে বাধ্য হয় এবং ধণীক শ্রেণীর সম্পদ- এই দুইয়ের মধ্যে যখন তাঁরা বৈষম্য দেখে, তখন এই পরকীকরণ আরও জোরদার হয়। শ্রমিক “তাঁর আবাস ও অপর দুনিয়াতে, সম্পদের স্বর্গে অবস্থিত একটি মানব আবাসের মধ্যে গুণগতভবে বৈষম্য সম্পর্কেও সচেতন”।৮৩

শ্রমিক শ্রেণী ও পুঁজিতন্ত্রীদের মধ্যকার পরকীকরণ অপর মূর্ত রূপসমূহও (other concrete forms) নেয়। যখন নিম্ন বেতনের চাকুরীর জন্য আমেরিকা জুড়ে বারবারা ইহরেনরেইখ (Barbara Ehrenreich) দরখাস্ত করছিলেন, তখন তিনি বর্ণনা করেন কী পদ্ধতিতে তিনি বাধ্য হন বিভিন্ন ধরনের টেস্ট ও লিখিত প্রশ্নাবলীতে (questionnaire) অংশগ্রহণ করতে। সম্ভবত এই টেস্টগুলো বিতরণ করা হয় বসদের সবসময় তাঁদের শ্রমিকদের স্বশরীরে স্বাক্ষাতকার নেবার প্রয়োজনীয়তা থেকে:

 

দ্যা মেইডস (The Maids) হ’ল একটি আবাসন পরিস্কারকরণ পরিসেবা (housecleaning service), এটিতে আমাকে কিছু-একটিা দেয়া হয় যাকে বলা হয় “Accurate personality tests”, এতে আমাকে শুরুতেই সতর্ক করে দেয়া হয় যে “এ্যাককুট্র্যাকের (Accutrac) রয়েছে বহুবিধ মাপকাঠি (multiple measures) যা লিখিত প্রশ্নাবলীকে বিকৃতকরণেরর অথবা সঠিকভাবে অনুমানকরণের প্রেচেষ্টাকে সনাক্ত করে”। “নিজের প্রতি সমবেদনার মানসিক অবস্থাকে থামাতে” স্বভাবতই আমার “কখনও” কঠিন মনে হয়নি, অথবা আমি কল্পনাও করি না যে অন্যরা পেছন দিক থেকে আমার সম্পর্কে কথা বলছে অথবা বিশ্বাস করি না যে “ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীরা সর্বদা সংঘাতে থাকবে কারণ তাঁদের লক্ষ্যের বিভিন্ন সেট আছে”। আমি মনে করি, এই টেস্টগুলোর প্রকৃত কাজ, চাকুরিদাতর কাছে তথ্য জ্ঞাপন করা নয়, বরং সম্ভাব্য কর্মচারীদের নিকট জানানো এবং জ্ঞাপনকৃত তথ্য সর্বদা এই: আমাদের নিকট আপনাদের গোপন কোন রহস্য থাকবে না। আমরা আপনার পেশীগুলো চাই না, সেগুলোর সাথে সরাসরি সংযুক্ত মস্তিষ্কের সেই অংশও চাই না, আমরা আপনার অন্তর্নিহিত আত্মা (innermost self) চাই।৮৪

 

পুঁজিতন্ত্রী শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর পৃথকীকরণ, এবং একটি শ্রেণীর অপর শ্রেণীর ওপর আধিপত্য, এই উভয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করতে এই সবকিছু সেবা করে।

যাহোক, শ্রেণীসমূহের মধ্যে কেবল পরকীকরণ থাকে না; পুঁজিতন্ত্র শ্রেণীসমূহের ভেতরেও বিভাজন ও পরকীকরণ (division and alienation) উৎসাহিত করে। ব্যবস্থাটি নির্ভর করে পুঁজিতন্ত্রীদের ওপর, যারা তাদের নিজেদের মধ্যে আক্রমণাত্মকভাবে প্রতিযোগীতা করে “যুদ্ধরত ভাইদের দল” হিসেবে কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। পুঁজিতন্ত্র নির্ভর করে কিছু পুঁজিপতিদের সফলতা ও অন্যদের ব্যর্থতার ওপর, বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের একত্রীকরণ (merger), শত্রুতামূলক কর্তৃত্বগ্রহণ (hostile takeover) ও মূল্য যুদ্ধের (price war) ওপর। এগুলো স্বাতন্ত্রিক পুঁজিতন্ত্রীদের একে অপরের বিরুদ্ধে স্থাপন করে একটি নির্মম যুদ্ধে যাতে ব্যবস্থাটি থেকে যতবেশী সম্ভব মুনাফা বের করে আনা যায়।

এটি শ্রমিক শ্রেণীকেও প্রভাবিত করে। শ্রমজীবি মানুষকে উৎসাহ দেয়া হয় তাঁদের নিজেদের স্বতন্ত্র হিসেবে দেখতে যারা প্রতিযোগীতা করে তাঁদের কাজের সহকর্মী, প্রতিবেশী এবং এমনকি বন্ধুদের সাথে। এটি আরম্ভ হয় কাজের জন্য তাঁদের নিজেদের প্রতিযোগীতায়, যেমন মানুষজনকে উৎসাহিত করা হয়, প্রায়ই সম্পূর্ণ অপমানজনকভাবে, চাকুরীদাতাদের মনোযোগের জন্য প্রতিযোগীতা করতে।

যে কেউ যাকে কাজের জন্য অন্বেষণ করতে হয় তাকে শুনতে হয় চাকরি সন্ধানদাতা সংস্থা (employment agency)এবং সরকারের নিকট থেকে অসংখ্য উপদেশ, তারা আপনাকে প্ররোচিত করে “আগ বাড়িয়ে পেতে” (get ahead), আপনার নিজেকে অন্য শ্রমিকদের থেকে ‍পৃথক করতে এবং আপনার নিজেকে অধিকতর ভাল প্রমাণ করতে।একবার কাজে যোগ দিলে, এই প্রক্রিয়া তীব্র হয়।মানুষজনকে উৎসাহিত করা হয় “মাসের কর্মী” (employee of the month) হতে, অথবা কৃতিত্ব সম্পর্কিত বোনাসের (performance related bonus) জন্য প্রতিযোগিতাতে। মারসিসাইডে ইলিসমোর পোর্টে অবস্থিত ভক্সহল কার কারখানার ইউনিয়ন কর্মকর্তা বর্ণনা করেন কীভাবে বিভিন্ন টিমে বিভক্ত করে টিম লিডারগণ “টিমের সবথেকে দুর্বল সদস্যকে চাপ দেন টিম মেটদের সাথে তাল রেখে চলতে। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরী করে কারণ মানুষেরা পাল্লা দেয় টিম লিডার হতে এবং আরও বেতনের জন্য”।৮৫

কাজের বাইরেও এটির রয়েছে অনিবার্য পরিণাম, যা আমাদের প্রতিবেশী, বন্ধু ও পরিবারের সাথের সম্পর্কাবলীকেও প্রভাবান্বিত করে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে পণ্যকামের যে ধরণের বর্ণনা আমি দিয়েছি সেটি অবদান রাখে বন্ধুবর্গ ও প্রতিবেশীদের মধ্যকার অর্থহীন ঠাটবাটের প্রকরণের (meaningless status item) জন্য প্রতিয়োগিতা। যেই মাত্র মানুষজন অন্বেষণ করে পণ্য খরিদে কিছু ধরণের নিশ্চয়করণের জন্য, তখন তাদের উৎসাহিত করা হয় অপরদের বিপরীতে নিজেদের পরিমাপ করতে ঠিক ঐ মানদন্ড দিয়ে।

এই প্রতিযোগিতা ও বিভাজন (competition and division) তৈরী করে ধারণার জন্য উর্বর ভিত্তি যা শ্রমিক শ্রেণীকে বিভক্ত করে। মানুষজন একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাদের সহকর্মীদের ও বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়, এবং এ পরিবেশে বর্ণবাদ, যৌণবাদ, হোমোফোবিয়া সহজেই শেকড় প্রোথিত করতে পারে। এটি হয় কেবলমাত্র এমন অবস্থায় যেখানে শ্রমিকেরা বাধ্য হয় অল্প সংখ্যক কাজের জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতে, এতে জাতীয়তাবাদী শ্লোগানগুলো যেমন “ব্রিটিশ কাজ ব্রিটিশ শ্রমিকের জন্য” অর্থবহ অথবা আকর্ষণীয় হয়। এই ধরণের ধারণাগুলো নির্ভর করে অপর থেকে পরকীরণের ওপর যেগুলো পুঁজিতন্ত্রের অধীনে খুবই বিস্তৃত।

এটা আরও বোঝায় যে মানুষেরা ব্যবস্থাটিকে চ্যালেঞ্জ করতে কম ইচ্ছুক। কারণ মানুষেরা পরকায়িত এবং একে অপরকে থেকে বিভাজিত, তাদের সমস্যাগুলোর যৌথ সমাধান অন্বেষণে তারা ঊণ ইচ্ছুক। পরিবর্তে তারা ব্যবস্থাটির যুক্তি গ্রহণ করবে, এবং পুঁজিতন্ত্রের মধ্যেই এগিয়ে যেতে প্রতিযোগিতা করবে। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, তাঁদের সহকর্মীদের সাথে তাঁদের অবস্থার উন্নতির প্রচেষ্টাতে যৌথ ক্রিয়াতে জড়িত থাকার পরিবর্তে মাথা নিচু করে কঠোর পরিশ্রম করতে চাপ অনুভব করে, এই আশায় যে তাঁরা বর্ধিত বেতন অথবা অতিরিক্ত বোনাস পেতে পারে। মানুষ্যজনের অধিকতর বিশ্বাস করার সম্ভাবনা এই যে অন্যদের খরচার বিনিময়ে তারা এগিয়ে যেতে পারেন, যাতে “আমরা সবাই এর ভেতরে আমাদের নিজেদের জন্য”। ভূমিকাতে আমি যে বক্তৃতাটি ‍উদ্ধৃত করেছি তাতে  জিমি রেইড পর্যবেক্ষণ করেন ‘ইদুর দৌড়’-এর ধারণা ও পদের অন্তর্নিহিত গ্রহণযোগ্যতা। এটি যে ছবিটি স্ফটিকায়িত করে তাহ’ল এই যে আমরা চারপাশে দ্রুতবেগে ছুটছি, ঠেলাঠেলি করে একত্র হচ্ছি পদের জন্য, অন্যদের পদদলিত করছি, ছুরিকাঘাত করছি, সবই ব্যক্তিগত সফলতার সাধনায়”।৮৬

        পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণিত যৌণতার উদাহরণ দেখায়, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কসমূহের কোনই দিকই পরকীকরণের প্রভাব মুক্ত নয়। পারিবারিক জীবন বাইরের দুনিয়া থেকে কিছুটা রেহাই পেলেও, তাও এটি দিয়ে প্রভাবিত হয়। এতে জড়িত থাকতে পারে পরকীকরণের সবচেয়ে বেদনাদায়ক কিছু উদাহরণ। ঠিক একটা উদাহরণ দেয়া যাক, মার্চ ২০১০-এ কোরিয়াতে একটি শিশু অনাহারে মৃত্যু বরণ করে যখন তার পিতা-মাতা একটি ইন্টারনেট কাফেতে ১২ ঘন্টা ব্যয় করেছিল একটি গেম খেলতে, যে গেমে জড়িত ছিল একটি ভারচুয়াল শিশুর লালন-পালন (raising a virtual child)।৮৭ এটি হ’ল মধ্যবর্তী সামাজিক সম্পর্কসমূহের সবচেয়ে চরম প্রান্তে, যেখানে  পিতা-মাতা ও শিশুর মধ্যকার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক একটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম সম্পর্কের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।

        মার্কসও রাজনীতিকে দেখেন এই সামাজিক পরকীকরণের একটি বিশেষ উদাহরণ হিসেবে। সাধারণ জনগণের জীবন থেকে পৃথক একটা-কিছু এবং অপর জনগণ দ্বারা কৃত একটা-কিছু হ’ল রাজনীতি, অপর থেকে কৃত্রিমভাবে আমাদের জীবনের কিছু দিকের পৃথক করার ফসল হ’ল এই ধারণা। রাজনীতি রূপান্তরিত হয় সংকীর্ণ ও নির্দিষ্ট একটা-কিছুতে, যেটি কৃত হয় জনগণের একটি বিশেষ শ্রেণী দিয়ে। ফলে এই পৃথকীকরণ উৎসাহিত করে এই ধারণা যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও  রাজনৈতিক প্রশ্নাবলী কোনভাবে একে অপর থেকে  সংবাদপত্রের কথা চিন্তা করুন, এই ক্ষেত্রগুলোর প্রত্যেকটার জন্য পৃথক সেকশন সেখানে বিদ্যমান, যেন অর্থনৈতিক প্রশ্নাবলীর রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই, এবং বিপরীত দিকে রাজনৈতিক প্রশ্নাবলীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই। এটা খুবই সাধারণভাবে শোনা যায় মানুষজন দাবী করে যে কিছু বিষয় এমনকি দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ “একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়”। এমনকি রাজনীতির কর্মকান্ড হয়ে ওঠে একটি বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা – খুব বেশী হলে বছরে একবার গোপন বাক্সে আপনার ভোট প্রদান, যা ‍যৌথ বিতর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি রাজনৈতিক প্রশ্নাবলী থেকেও অনানুগত্য উৎসাহিত করে, মানুষজন বলতে থাকে যে তারা “রাজনীতি করে না”, এমনকি যখন তারা প্রতিদিন উৎপীড়ক বসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে অভিযোগ করে।

        এই পরকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল রাষ্ট্র। মার্কসের মতে সমাজ থেকে আলাদা ও পৃথক করে রাখে রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, এটি হ’ল শ্রেণীতে বিভাজনের একটি অনিবার্য পরিণতি। এটি হ’ল রুশো ও হেগেল উভয়েরেই বিশ্লেষণের স্মৃতিবাহী, যেটি রাষ্ট্রকে দেখে সামাজিক পরকীকরণের ফসল হিসেবে, সামাজিক জীবনের কিছু কাজের স্থানান্তর করা হয় কিছু নির্দিষ্ট সংগঠনে যেমন কোর্টে, পুলিশে, বিচারক ইত্যাদির নিকট। যাহোক এই উভয় চিন্তকের জন্য এই পরকীকরণ ছিল অনিবার্য, এবং প্রধানত ইতিবাচক বিষয়, সমাজের মধ্যে পরিপূর্ণ জীবন-যাপনে জনগণের জন্য দরকার।

        রুশো ও হেগেল রাষ্ট্রকে দেখেন একটি নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে, অন্যদিকে মার্কস যুক্তি দেন যে এটি ছিল অনিবার্যত শ্রেণী বিভাজনের একটি বৈশিষ্ট্য, একটির ওপর অপর শ্রেণীর শাসণ জোরদার করতে এটি অস্তিত্বমান ছিল:

 

        যে গতিতে আধুনিক শিল্পের উন্নতি বিকশিত হয়, বিস্তৃত হয়, পুজি ও শ্রমের মধ্যকার শ্রেণী বিরোধ (class antagonism) তীব্রতর হয়, সেই গতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা শ্রমের ওপর পুঁজির একটি জাতীয়  ক্ষমতার চরিত্র বেশী বেশী করে ধারণ করে, এটি হয়ে ওঠে সামাজিক দাসত্বের জন্য একটি সংগঠিত জনশক্তি, শ্রেণী স্বৈরতন্ত্রের এটি ইঞ্জিন।৮৮

            রাষ্ট্র দাবী করে এটি ক্রিয়াশীল থাকে সম্প্রদায়ের স্বার্থে, অর্থাৎ প্রত্যেকের স্বার্থে। যাহোক, মার্কস যুক্তি দেন যে পুঁজিতন্ত্র সুনির্দিষ্টায়িত হয় শ্রেণী বিভাজন দিয়ে যা নিষ্পত্তি করা যায় না। এভাবে, রাষ্ট্র যখন “সাধারণ স্বার্থ” রক্ষার্থে হস্তক্ষেপ করে, তখন প্রকৃতপক্ষে এটা স্থিতাবস্থা রক্ষার্থে, এবং এভাবে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে হস্তক্ষেপ করে। পুঁজিতন্ত্রের টিকে থাকতে সহায়তা করার জন্য যা করা হয় তা অবশ্যি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের জন্য নয়। এভাবে রাষ্ট্র হ’ল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের একটি বৈশিষ্ট্য।

          যেভাবে পণ্যকাম এই প্রতীতি (impression) সৃজন করে যে বস্তু-সামগ্রীর নিছক একটি স্বাধীন অস্তিত্ব আছে, ঠিক একইভাবে সামাজিক পরকীকরণ রাষ্ট্রের প্রতীতি সৃজন করে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে, যে জনগণ এটি তৈরী করে তার বাইরে। এবং ঠিক পণ্যাকামের মতই, এটি হয়ে উঠে নিছক বিভ্রমের থেকেও বেশী কিছু (mere than illusion)। যে জনগণ জাতি রাষ্ট্রে বাস করে তাদের অতিক্রম করে রাষ্ট্র একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদ্ধতি হয়ে ওঠে, এবং  এটি এর নিজের একটি স্থায়ী জীবন ধারণ করে। জনসাধারণের “তাদের দেশের জন্য” অথবা এমনকি “পতাকার” জন্য মৃত্যুবরণের ইচ্ছা হ’ল এটির একটি টেস্টামেন্ট। জনসমাজ (community) বস্তু-সামগ্রী ও প্রতীকসমূহে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, যেগুলোকে কোনও-না-কোনওভাবে দেখা হয় স্বয়ং জনসমাজের চেয়ে বেশী কিছু হিসেবে।

        যাহোক, রাষ্ট্রের থেকে আরও বিস্তৃতভাবে এই সামাজিক পরকীকরণ এই বোধের জন্ম দেয় যে মানব জীবনের অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণরূপে মানব কমকান্ডের ফসল হওয়া সত্ত্বেও, এটি অনুভূত হয় একটি বিমূর্তায়িত ও পরক (disembodied and alien) ক্ষমতা হিসেবে। মার্কস যেমনটি বলেন, মানব ইতিহাস জুড়ে মানব সত্ত্বাসমূহ “বেশী বেশী করে গোলাম হয়ে ওঠে একটি তাদের থেকে পরক একটি ক্ষমতার অধীনে . . .

একটি ক্ষমতা যা আরও অতিকায় হয়ে একটি বিশ্ব বাজারে পরিণত হয়৮৯ এই ধরণের চিন্তন কীভাবে  শক্ত ভিত পেতে শুরু করে তা দেখতে হলে আপনাদের কেবলমাত্র টিভি সংবাদ দেখলেই চলবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের মত করে শেয়ার বাজারের সঞ্চালনের (stock market movements) রিপোর্ট করা হয়, যেন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলাফলের মতই শেয়ারের দাম উঠা-নামা করে। ব্রিটেনে ২০১০-এর নির্বাচনে বলা হয়ে থাকে যে “বাজারের দাবী ছিল ঝুলন্ত পার্লামেন্টের দ্রুত নিষ্পত্তি, আরও ভয়ংকরভাবে বলা হয়েছিল সেটিই পছন্দসই ফলাফল।

        পরকীকরণের এই বৈশিষ্ট্য প্রত্যেককে প্রভাবিক করে, এমনকি এই ব্যবস্থাটির শীর্ষে যারা অবস্থান করে তাদেরও। মার্কস যেমনটি বলেন, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদেনের অন্তর্নিহিত আইন ব্যক্তিক পুঁজিতন্ত্রীকে মোকাবেলা করে তার থেকে বহিস্থ একটি দমনমূলক শক্তি হিসেবে”।৯০ তারা বাজারের চাপের দাস, এবং সম্পূর্ণরূপে এর খেয়ালের বিষয়। যাহোক, পুঁজিতন্ত্রীরা পরকীকরণের অভিজ্ঞতা লাভ করে ভিন্ন পদ্ধতিতে। এর কতকগুলো সবচেয়ে খারাপ প্রভাবসমূহ থেকে তাদের সম্পদ তাদের উপাধানের সামর্থ যোগায়, এবং ব্যবস্থাটি যতটুকু তাদের স্বার্থের জন্য সংগঠিত, তাতে পরকীকরণের প্রভাব খুব তীব্র নয়। তা সত্ত্বেও, পুঁজিতন্ত্রীরা তাদের কাজে পরিপূর্ণতা অন্বেষণে অসমর্থ, ঠিক যেমন শ্রমিকেরাও। প্রায়ই পুঁজিতন্ত্রীরা নিছক নিষ্ক্রিয় শোষক যারা ধণী হয়ে বেড়ে উঠে অন্যদের কাজের পিঠে। যখন তারা “কাজ” করে, এটা করে সাধারণত ঐ শ্রমিকদের নিকট থেকে অধিকতর মুনাফা নিংড়ে নেয়ার নয়া ও জটিল পদ্ধতি অন্বেষণে। যেমনটি বেরটেল ওলম্যান বলেন, “প্রোলেতারিয়েতদের ওপর পুঁজিতন্ত্রীদের সুবিধা পরম হওয়ার চেয়ে বরং আপেক্ষিক; তারা উৎসাহী একটি পরিমাপকের ওপর ভিত্তি করে একটি উচ্চতর স্কোর নিবন্ধনে, যেটির নিজেরই নিন্দা হওয়া অবশ্যিক”।৯১

 

 

 

 

অধ্যায় আট

আত্ম থেকে পরকীকরণ

 

মার্কস যুক্তি দেন, পুঁজিতন্ত্র কেবলমাত্র সামাজিকভাবেই আমাদের জন্য মন্দ তাই নয়, সাথে সাথে এটি আমাদের জন্য ব্যক্তিভাবেও মন্দ। মার্কস লেখেন যে

শ্রমিক “তাঁর কাজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না, নিজেকে অস্বীকৃত করেন (denies himself), দুর্দশাগ্রস্ত অনুভব করেন, সুখী মনে করেন না, তাঁর মুক্ত মানসিক ও দৈহিক শক্তিকে বিকশিত করতে পারেন না, বরং নিজের মানবদেহকে বিকল করেন এবং তাঁর মনকে ধ্বংস করেন”।৯২

            মার্কসের সমালোচনার এই দিকটি (this aspect) প্ররোচিত হয় ব্যাপকভাবে তাঁর সময়কার প্রোলেতারিয়েত সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতা দ্বারা। ফ্যাক্টরির অবস্থা দ্বারা শ্রমিকদের ওপর কৃত দৈহিক ও মানসিক ক্ষতি (damage) তিনি এখানে পর্যবেক্ষণ করেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য (feature) স্বয়ং ফ্যাক্টরি কাজটি ছিল না, বরং যে পদ্ধতিতে এটি সংগঠিত হতো সেটি, যাতে শ্রমিকের প্রয়োজনের আগে উৎপাদন ও মুনাফার প্রয়োজন জারি রাখা যায়। মার্কস তাঁর অর্থনৈতিক কাজে বিশদ করেন ফ্যাক্টরি উৎপাদনের বৈচিত্রময় প্রকরণের অনেকগুলোর ওপর এবং কীভাবে সেগুলো শ্রমিকদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। কেবল একটি উদাহরণ নেয়া যাক, ছাপাখানার মেশিন দ্বারা কৃত ছাপাখানার শ্রমিকদের পরিবর্তন তিনি বর্ণনা করেন:

    ইংরেজ ছাপাখানার ব্যবসায়ে পূর্বে একটি সিস্টেমের অস্তিত্ব ছিল, যা পুরাতন মানুফ্যাক্চার ও হস্তশিল্পের অনুরূপ, এতে শিক্ষানবীসদের অগ্রবর্তী করানো হতো সহজ থেকে আরও অধিক কঠিন কাজের দিকে তাঁরা প্রশিক্ষণের একটি কোর্সের মধ্য দিয়ে যেতো একটি সম্পূর্ণ মুদ্রক হওয়া অবধি তাদের ব্যবসায়ের একটা আবশ্যিক শর্ত ছিল তাঁদের প্রত্যেককে লিখতে ও পড়তে সামর্থ্যবান হতে হবে এই সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যায় ছাপাখানার মেশিন দ্বারা এটি নিয়োগ দেয় দুই প্রকারের শ্রমিক, এক প্রকারের হল প্রাপ্ত বয়স্ক ভাড়া খাটা (renter); আর অপর প্রকার হল ১১ থেকে  ১৭ বছরের কিশোর বালকগণ, এদের সমগ্র কাজ (bussiness) : হয় কাগজের তাওগুলো (sheets of paper) মেশিনের নীচে রাখা, অথবা ছাপানো পাতাগুলো মেশিন থেকে নিয়ে নেওয়া বিশেষ করে লন্ডনে তাঁরা এই একঘেঁয়ে কাজ করতো সপ্তাহে কয়েকদিন একটানা ১৪, ১৫ ও ১৬ ঘন্টার জন্য, এবং প্রায়ই ৩৬ ঘন্টার জন্য, খাবার ও ঘুমানোর জন্য ২ ঘন্টা বিরতিসহ তাঁদের একটা বিশাল অংশ পড়তে পারতো না, এবং তাঁরা সচরাচর অমার্জিত ও খুবই ব্যতিক্রমী  মানুষ (extraordinarty creature) ছিল

এই নয়া প্রক্রিয়াগুলোর অনেকগুলোই স্বাস্থ্য ও সুস্থতার (health and fitness) ক্ষতির সাথে জড়িত ছিল, যদিও এগুলো প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকদের কাজ সম্পন্ন করতে সহজ করে দিয়েছিল এর একটি উদাহরণ হল শ্রমিকদের দেহাবয়বের স্থায়ী পরিবর্তন (permanent changes to the shape of workers’ bones), যেটি ঘটেছে কিছু মেশিনারির ব্যবহার থেকেযে বৈশিষ্ট্যগুলো এক জন কারিগরের জন্য সমস্যা হতো, যাকে এক কর্ম দিবসে অনেকগুলো নানা প্রকারের কাজ করতে হয়, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে তার জন্য উপকারী যখন তাঁকে এক দিনে আট-দশ ঘন্টার জন্য কেবলমাত্র একটি কাজ (only one action) সম্পাদন করতে হয়। এভাবে শ্রমিকেরা রূপান্তরিত হয় “মেশিনের একটি জীবন্ত অনুষঙ্গে”, এবং উৎপাদনের প্রয়োজনের অধীনস্ত হয় তাঁদের নিজেদের স্বাস্হ্য ও জীবন। তাঁদের কাজ তাঁদের সঠিক পরিচয়কে গঠন করে এবং নির্দিষ্টায়িত করে, আক্ষরিক অর্থে কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের ত্বকের নীচে। উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের একটি শহর সেন্ট হেলেনস, এখানে কাঁচ উৎপাদনের আধিপত্য আছে, এখানে মন্তব্য করা হয়ে থাকে যে, “আপনি ফাইবার-গ্লাস শ্রমিককে চিনতে পারবেন এই ঘটনা থেকে যে তিনি সর্বদা আঁচড় কাটতে থাকেন”।৯৩

    এটা অতীব গুরুত্বারোপের বিষয় যে কর্ম পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত এই ধরণের স্বাস্হ্য সমস্যাগুলো খুব কমই দূর হয়েছে। আইপ্যাডের জন্য যন্ত্রাংশ উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠান ফক্সকন ফ্যাক্টরিতে ২০১০-এ সংঘটিত আত্মহত্যাসমূহ গণ ফ্যাক্টরিতে বিরাজমান অবস্থাসমূহ মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। শ্রমিকেরা রিপোর্ট করে যে “তাঁদের হাত অনবরত কাঁপতে থাকে রাতে, অথবা যখন তারা রাজপথে হেঁটে যায় তখন তাদের ভঙ্গি অনুকরণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না”।৯৪
 
 ফক্সকন ফ্যাক্টরির চারপাশে জাল স্থাপন করে যাতে লাফদানকারী মানুষকে ধরা যায়। কল সেন্টারগুলোর সমীক্ষাতে দেখা যায় যে কাজের চাপ ও প্রক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে কর্মচারীদের কল্যাণে (for the employee wellbeing)। “শ্রমিকেরা ক্লান্তিকর অনুভূতির শিকার হয় এবং কাজের পরেও তা দূর হয় না (not being able to switch off) এবং, আরও বিপজ্জনকভাবে মানসিক চাপ এবং মাঝে মাঝে এমনকি বিরূপ স্বাস্হ্য প্রতিক্রিয়ারও শিকার হয়”।৯৫
 
    

একজন শ্রমিক একটি ব্রিটিশ কার প্ল্যান্টে তাঁর প্রথম সপ্তাহের কাজের ওপর রিপোর্ট করেন:

যখনই পারছে প্রত্যেকে আড্ডা দিচ্ছে (chatting away), তখন কেউ একজন টম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, যিনি একটা আঘাত থেকে পিঠে ব্যথা নিয়ে কয়েক সপ্তাহের জন্য ছুটিতে। এই আঘাতটি তিনি পেয়েছিলেন যখন তিনি একটি জিগের ওপর থেকে একটি হুড উঠাচ্ছিলেন ঠিক সেইসময় স্বয়ংক্রিয় ফিডারটি ভেঙ্গে পড়ে। এটা অনেকটা প্রেসার কুকারের ওপর থেকে ঢাকনা উত্তোলনের মত ব্যাপার। নানা ধরণের শারীরিক আঘাত সম্পর্কে কেউ কেউ কথা থামাতে পারছেনা। যে বিষয়গুলো তাঁদের “ঠিক বয়ে বেড়াতে হবে”। কিন্তু এটা কেবলমাত্র শারীরিক ব্যথাই নয় যা মানুষজন “যে পর্যন্ত পারে একে সাথে নিয়ে এর সাথে খাপ খাইয়ে চলে”, যা কেউ একজন আমাকে বলে, সাথে সাথে ভুল না করার মানসিক চাপও, এবং মানসিক বিচ্ছিন্নতা সহ (with mental isolation) এটা আরও খারাপ।৯৬

 

          মুনাফার প্রয়োজনের জন্য এবং শ্রমশক্তিকে (workforce) নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিকল্পিত কাজের জায়গাসমূহ এবং আমাদের স্বাস্হ্যের জন্য সেরা কাজের জায়গাগুলোর প্রকরণের মধ্যেও বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান, এমনকি গণ ফ্যাক্টরি অবস্থার (mass factory conditions) অনুপস্থিতিতেও। গ্লাসগোতে করণিক ও অফিসের কাজের জায়গাগুলোর ওপর একটা সমীক্ষা যুক্তি দেয়, “আমাদের উত্তরদাতাদের মন্তব্যগুলো নিশ্চিত করে যে স্বাস্হ্যপ্রদ ও উপযোগী কাজের পরিবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হ’ল সেই  মাত্রা (degree) যাতে শ্রমিকেরা এর ওপর নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে পারে”।৯৭ কিন্তু যেভাবে এই ভবনগুলোর নকসা করা হয়েছে তা এর ঠিক বিপরীত প্রবণতাই দেখায়। যার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় তা হ’ল ব্যয়ভার হ্রাস করা এবং শ্রম শক্তি নিয়ন্ত্রণ: “বর্তমান অনুশীলন হ’ল অপ্রতিরোধ্যভাবে প্রযুক্তি-কেন্দ্রীক, আপাদোমোস্তক কর্মকান্ড (top-down operation) যাতে পরিবেশগত ব্যবস্থাটি স্থাপন করা হয়েছে এবং তারপর প্রত্যাশা করা হয় মানুষেরা এর সাথে খাপ খাইয়ে নেবে”।৯৮ 

    

আরও বিস্তৃতভাবে, আমাদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক সম্পর্কাবলীর প্রভাবের ব্যাপারে মার্কস উদ্বিগ্ন ছিলেন। এটা ঠিক কাজের ধরণ নয় যেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বরং সেগুলোর মধ্যকার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের সম্পর্কাবলীই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং, শ্রেণীই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা। শ্রমিক শ্রেণীর সদস্যগণ তাঁদের কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রেণের অভাবের অভিজ্ঞতা লাভ করে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাঁদের ভগ্ন-স্বাস্থ্যের ব্যাখ্যাতে।

        স্বাস্থ্য ও অসুস্থতার ওপর গবেষণাতে কিছু সাম্প্রতিক অনুসন্ধান মার্কসের যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অনেক গবেষণা দেখিয়েছে যে সামাজিক মর্যদা ও স্বাস্হ সমস্যার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। সাধারণভাবে আপনি যত দরিদ্র হবেন, তত সমাজে আপনার কম থাকবে, আপনার স্বাস্হ সমস্যা বৃদ্ধির ঝুঁকিও বেশী হবে। শ্রেণী ও শ্রেণী বিভাজন জনগণের প্রথমদিকের জীবন, তাঁদের বন্ধুত্ব, সামাজিক সম্পর্ক, অবসর সময় (leisure time) এবং কাজের পরিবেশ (working coditions) গঠন করে।

        এটার প্রধান সূচক (key indicator) হ’ল সামাজিক অসমতা (social inequality)। সমাজগুলোতে অসমতা কীভাবে কতটুকু প্রভাব ফেলে, রিচার্ড উইলকিনসন ও কেইট পিকেট তাঁদের জনপ্রিয় বই The Spirit Level-এ দেখান। সমাজে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরীবের মধ্যে ব্যবধান যত বেশী হবে, জনগণের অবস্থা তত বেশী খারাপ হতে পারে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এটা কেবলমাত্র বস্তুগত বঞ্চনার (material deprivation) বিষয় না। বরং এটা সমাজের ভেতরকার অসমতার একটি সরাসরি বৈশিষ্ট্য, যেখানে ধণী আরও আরও আরও ধণী হয়। এমনকি যে সমস্ত দেশে দরিদ্ররা অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ভালো আছে, সে সমস্ত দেশেও ক্রমাধিকারতন্ত্র ও অসমতার অস্তিত্ব সরাসরি দুর্বল শারিরীক ও মানসিক স্বাস্হ্যে অবদান রাখে। প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক গবেষণা সুপারিশ করে যে বিষয়গুলোর সমগ্র পরিসর সরাসরি প্রভাবিত হয় অসমতা দিয়ে, যেমন কিশোরী গর্ভাবস্থা, অপরাধ, মানসিক স্বাস্থ্য, জীবন আয়ু (life expectancy) ইত্যাদি।

        একই শারিরীক স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রভাব ফেলে ভিন্নভাবে এবং তা নির্ভর করে সমাজের ভেতরে আপনার অবস্থানের (position) ওপর। সিভিল সার্ভেন্টদের ওপর একটি সমীক্ষাতে দেখা গেছে যে তাদের পদমর্যদা, তাদের কাজের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ, এবং তাদের স্বাস্হ্যের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে: “নিম্নতর পদবীর একজন সিভিল সার্ভেন্ট যে দিনে ২০টি সিগারেট পান করে, তার চেয়ে একই পরিমাণ সিগারেট পানকারী একজন প্রশাসকের ফুসফুস ক্যান্সার থেকে মৃত্যু ঝুঁকি কম”।৯৯ উপসংহার ছিল এই যে “ব্রিটেনে একই সরকারী অফিসে কর্মরত উচ্চ পদস্থ সিভিল সার্ভেন্টবৃন্দ ও নিম্ন পদস্থ সিভিল সার্ভেন্টবৃন্দের মধ্যকার মৃত্যুহারে পার্থক্য তিন গুণ, কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল সবচেয়ে সফল একক নিয়ামক যা এই মৃত্যুহারের পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করতে পারে”।১০০ একই ধরণের রিপোর্ট সিন্ধান্তে উপনীত হয় যে “কর্মচারীদের কাজে (task) অধিকতর বৈচিত্র প্রদান করলে এবং কাজ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে জোড়ালো মতামত দেবার সুযোগ দিলে করোনারি হৃদ রোগের ঝুঁকি কমে যেতে পারে”।১০১

    এই সমস্ত কিছু সুপারিশ করে যে এটা কেবলমাত্র সম্পদের বন্টনের অসমতা বা সামাজিক মর্যদাই নয়, বরং সাথে সাথে পরকীকরণও এই সমস্যাগুলোর কারণ। এই সমস্যাগুলোর শেকড় অনুসন্ধান করতে হবে পদ্ধতিটিরর মধ্যে যে পদ্ধতিতে আমাদের সামাজিক ও কর্ম জীবন সংগঠিত, যেটি প্রথমে এবং সর্বাগ্রে নির্দিষ্টায়িত হয় নিয়ন্ত্রণের অভাব দিয়ে। এটা নিছক সবচেয়ে ধণী ও সবচেয়ে গরীবের মধ্যে বিস্তর পার্থক্যই নয়, বরং বস ও কর্মীর মধ্যকার বিভাজন (divisions) যা আমাদের স্বাস্হ্য ও সমৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলে। অসমতা (inequality) সম্ভবত শ্রেণী অবস্থান ও পরকীকরণের সূচক। যাদের নিজেদের কাজের ওপর সবচেয়ে কম নিয়ন্ত্রণ আছে তারা সম্ভবত সবচেয়ে কম বেতন পান অথবা এর বিপরীতটা (vice versa)। কিন্তু এটি মূল কারণ (root cause) নয়।

    

কারণ, পরিপূর্ণতা, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগের অভাব বিদ্যমান, আমাদের নিজেদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে আমরা অন্য উপায় অন্বেষণ করি। এর অর্থ এই যে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে দেখা হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (individuality) প্রকাশে একমাত্র উপায় হিসেবে। কাজের জায়গায় আমরা মুখাবয়বহীন (faceless), ক্ষমতাহীন ও বদলিযোগ্য (interchangeable); বাড়িতে আমরা যে খাদ্য খাই, আমরা যে কাপড় পরিধান করি, আমরা যে সঙ্গীত শুনি, আমরা যে কার চালাই, আমরা যে সম্পর্ক  তৈরী করি, সেগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার চেষ্টা করি।

        অধিকাংশ জনমানুষের জন্য যদিও এটা মোটামুটি সীমাবদ্ধ। গণভাবে উৎপন্ন একই ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর চেয়ে বেশী কিছু কেনার সংগতি তাঁদের নেই, এবং কাজের চাহিদা প্রতিনিয়ত (constantly) এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি, অংশত, সেলিব্রেটি সংস্কৃতির প্রতি বদ্ধসংস্কারের ব্যাখ্যা করে যা আধুনিক পুঁজিতন্ত্রের অধীনে বহুবিস্তৃত। এই মানুষগুলোর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়, এবং সাধারণভাবে, এটি অর্জনের উপায় থাকে। যেমনটি কলিন স্পার্কস (Colin Sparks) বলেন:

সেলিব্রিটির জগৎ হ’ল বৈধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জগৎ। সেলিব্রিটিদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর (key characteristics) একটি হ’ল এই যে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন ও কার্যকলাপকে আগ্রহোদ্দীপক হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং সর্বজনের সম্পত্তি (public property) হিসেবে গণ্য করা হয়। এটিকে প্রায়শই গণ্য করা হয় অসহনীয় অনধিকার প্রবেশ হিসেবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা হ’ল পুঁজিতন্ত্রের অধীনে প্রদানকৃত সর্বোচ্চ পুরস্কার। ব্যাপক জনসংখ্যার বিপরীতে, সেলিব্রিটি হ’ল এমন একজন যাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্বসহকার নেয়া হয়।১০২

         

          সেলিব্রিটি সংস্কৃতির প্রতি ঘোর (obseeeion) তৈরী হয় একটি ইচ্ছা (desire) থেকে । এই ইচ্ছাটা হ’ল যে কোনও একটা উপায়ে আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে যাতে গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়, যা পুঁজিতন্ত্র বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য অস্বীকার করে। অবশ্যি, এটি পরকীকরণের প্রতি প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না যেটি এর উত্থান সংঘটিত করে। এটি জনমানুষকে অস্থায়ী বিরাম দিতে পারে, কিন্তু এটা তাঁদের পরকীকরণকে পরাজিত করতে পারে না।

          প্রায়ই দেখা যায় জনমানুষ তাঁদের জীবনের ওপর পুনঃনিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে আরও অধিক নাটকীয় উপায় অন্বেষণ করে (look to)। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৬-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে, “আনুমানিক [জাপানে] ১.২ মিলিয়ন তরুণ জনগণ বহির্জগতের সকল সংযোগ থেকে পশ্চাদপসারণ করে তাদের নিজেদের কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে, এরা আধুনিক সন্নাসী বা হিকিকোমোরি”। ১০৩ এই তরুণেরা বাস্তবিকই আক্ষরিকভাবে (quite litterally) পরকায়িত (alienated), এবং দুনিয়া ও অন্যান্যদের থেকে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

          নিয়ন্ত্রণ না থাকার অনুভব একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে অনেকগুলো খাদ্য রোগে (eating disorder), বিশেষত anorexia nervosa রোগে। anorexia রোগীদের সমীক্ষা ধারণা দেয় যে নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা পালন করে রোগের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। পরবর্তী সব উদ্ধৃতি এসেছে ১৩ ও ২১ বছর বয়সীদের মধ্যকার ১০টি নারী anorexia রোগী এবং তাঁদের পিতা-মাতার নিকট থেকে। রোগটিকে দেখা হয় নিয়ন্ত্রণ আরোপনের উপায় হিসেবে (as a means of asserting control)। “যদি আমি মোটা হতাম তখন আমি অনাকর্ষণীয়া এবং সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতাম, এবং  কি আমি করবো এবং কি আমি খাবো তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ থাকতো না”; “তিনি এটির ওপর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন, একমাত্র যে বস্তুটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তা হ’ল তাঁর দেহ (body),” নিয়ন্ত্রণ চিকিৎসার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি মূর্ত করে:

    

    যেইমাত্র আমি যে জায়গায় থাকতাম যেখানে আমার নিয়ন্ত্রণ ও পছন্দ থাকতো এবং তখন আমি     ঠিক চাইতাম সবকিছু যেন স্বাস্থ্যপ্রদ থাকে এবং সংখ্যাটা (figures) এতটা প্রfসাঙ্গিক ছিল না,       এটা ছিল কীভাবে আমি অনুভব করতাম এবং সম্পূর্ণ পূর্ণ করতাম (It was how I felt and stuff)। আমি প্রকৃতই (really) মনে করি যে আমি যদি একটা জায়গায় থাকতাম যেটি বাস্তবিকই অনমনীয়, তাহ’লে আমি এ সবকিছুই আবার হারাতাম . . .কিন্তু যদি একটা জায়গায় আসতাম যেখানে সবকিছুই আমার পছন্দের এবং আমার নিয়ন্ত্রণে তখন আমি বাস্তবিকই যা চাইতাম তাই করতাম এবং সেভাবে এটি আমার জন্য খুব ভালভাবে কাজ করতো।

          রিপোর্টটি উল্লেখ করে যে কিছু মানুষজন ধারণা করে যে রোগটি “বিশেষ করে কঠিন সময়ে তাঁদের সহায়তা করে তাঁরা নিরাপদে আছে এবং নিয়ন্ত্রণে আছে এ রকম বোধ করতে ”। যে ‍দুনিয়াতে এতকিছু অধিকাংশ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেখানে মানুষজন  যেকোনও উপায়ে যেভাবে পারে নিয়ন্ত্রণ জাহির করে দেখাতে চায়, প্রায়শই করুণ পরিণতি সহ।

    

পুঁজিতন্ত্রের অধীনে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক। ঠিক ব্রিটেনকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক, এটা অনুমান করা হয় যে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রতি ছয় জনে একজন হতাশা অথবা দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ রোগে ভুগছে (প্রায় ছয় মিলিয়ন মানুষ), এর অর্থ এই যে প্রতি তিনটি পরিবারে একটি এটি দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। প্রতিবন্ধীত্বের শতকরা চল্লিশ ভাগই শারীরিক অসুস্থ্যতার চেয়ে বরং মানসিক অসুস্থ্যতার জন্যই দেখা দেয়। একটি রিপোর্ট উপসংহারে উল্লেখ করে যে “আজকের দিনে ব্রিটেনে বিকলকৃত হতাশা (crippling depression) ও দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ (chronic anxiety) হ’ল দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ”।১০৫

    

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার গভীরতার ওপর ব্যাপক ঐকমত্য (widespread agreement) সত্ত্বেও, ব্যাপকতর সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অগ্রাহ্য করার একটা লক্ষণীয় প্রবণতা বিদ্যমান, সামগ্রিকভাবে  সমাজের চেয়ে বরং ব্যক্তির জন্য এই সমস্যাগুলোকে গণ্য করা হয়, এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসা বা ঔষধে সমাধান অন্বেষণ করা হয়। একই রিপোর্ট যেটি ব্রিটেনে হতাশার ব্যাপকতাকে চিহ্নিত করে, সেটিও এর প্রস্তাবকৃত সমাধান সীমাবদ্ধ করে কগনিটিভ বিহ্যাভিরিয়াল থেরাপির ওপর যাতে এটি সাধারণ জনগণের নিকট অধিকতর প্রাপণীয় হয়। “কীভাবে আমরা সমাজকে সংগঠিত করতে পারি যাতে এটি বন্ধ করা যায়?” এভাবে প্রশ্নটা উত্থাপন করা হয়নি, বরং উত্থাপন করা হয়েছে এভাবে, “কীভাবে আমরা অধিকতর জনগণকে ঔষধ ও চিকিৎসার (medication and therapy) আওতায় পেতে পারি?” এটি প্রায়ই সৎ-অভিপ্রায়ের সাথে অশুভের সংযোগ সংঘটিত করে- যেমন জব সেন্টারে চিকিৎসা (therapy in job centre), এতে অর্ধেক মন নিবেদিত থাকে মানুষকে সহায়তা করতে, কিন্তু অন্য অর্ধেকটা নিবেদিত থাকে যাতে তারা যত দ্রুত সম্ভব কাজে ফিরতে পারে।

          অন্য কথায়, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিতে অবদান রাখার সাথে সাথে পরকীকরণ এটিকে পরাজিত করতে বাধা প্রদান করে। প্রথমত, মুনাফা তৈরীতে মানুষ যাতে কাজে ফিরে, সেই প্রয়োজন থেকে প্রস্তাবিত সমাধান প্রণোদিত হয়। এভাবে, সত্যিকার সমস্যাকে আদৌ এ্যাড্রেস করা হয় না। দ্বিতীয়ত,  এই সমস্যাবলীর শেকড় সামাজিক সম্পর্কাবলীর ভেতরে-এভাবে এ্যাড্রেস করতে ব্যর্থতায় পরকীকরণ অবদান রাখে। ঠিক অর্থনীতিবিদের মত যিনি একটি পণ্যের মূল্য (value) অন্বেষণ করতে গিয়ে অবজ্ঞা করেন যে মূল্য সামাজিকভাবে গঠিত হয় (socially constituted), একইভাবে চিকিৎসা পেশাজীবি মানুষকে ব্যক্তি হিসেবে (as individual) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রবণতা দেখান, তাঁদের সমস্যার অভ্যন্তরীণ কারণগুলো অন্বেষণে এবং স্পষ্টতই সমাজিক কারণগুলোকে অবজ্ঞা করেন।

আরও বিস্তৃতভাবে, যেটিকে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করি সেটিও পরকীকরণ আকার দেয়। উপরে উল্লেখিত রিপোর্টে, উচ্ছসিত ফোকাস করা হয় কিছু অবস্থার ওপর যেগুলো জনগণের কাজের জীবনে হস্তক্ষেপ করে, তাদেরকে অধিকতর কম উৎপাদনশীল ব্যক্তিতে পরিণত করা হয় শ্রম প্রক্রিয়াতে। হতাশা ইউকের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি (damage) করে সেই অর্থে এটির অধিকাংশকে স্থাপন করা হয়। এটিকে সম্পূর্ণরূপে আকার দেয়া হয় পুঁজিতন্ত্রের প্রয়োজনের অর্থে, ব্যক্তির প্রয়োজনের অর্থে নয়। যেমনটি পিটার সেজউইক (Peter Sedgwick) যুক্তি দেন, অসুস্থ্যতা ও ফিটনেসের সংজ্ঞা নির্ভর করে সমাজ যে লক্ষ্য ধার্য করে তার ওপর। ১০৬

            মজুরি-শ্রমের ওপর ভিত্তি করে সংগঠিত সমাজে যাকিছু এটির সাথে হস্তক্ষেপ করে তাকেই অসুস্থ্যতা বলে গণ্য করা হয়, যা সামলানো ও নিরাময় করা যাবে। ভিন্ন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংগঠিত একটি সমাজ অসুস্থ্যতার একটি পৃথক উপলব্ধি দিতে পারে, এবং যারা ভুক্তভোগী তাদের সহায়তা করতে বিকল্প উপায় প্রদান করতে পারে।

 

 

অধ্যায় আট

প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ

 

পরকীকরণের একটি দিক যা অত্যাধিকভাবে আধুনিক দুনিয়ার সাথে প্রাসঙ্গিক তাহ’ল প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ। জলবায়ু পরিবর্তন সংঘটনে মানব কর্মকান্ডের একটি ভূমিকা আছে যা বিপর্যকর হতে পারে, এই মর্মে একটা ব্যাপক ঐকমত্য আছে। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ধ্বংসের বিপদ দেখা যাচ্ছে নজিববিহীন মাত্রায়। উদাহরণস্বরূপ:

 

          ১.৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ৪০০ মিলিয়ন মানুষ জল চাপের (water stress) সম্মুখীন হবে এবং আরও ৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধায় নিপতিত হবে। ভারত মহাসাগরের প্রবাল রিফগুলো নিশ্চিহ্ন হবে। দুনিয়ার ১৮% উদ্ভিদ ও প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে।১০৭

          টা কেবল জলবায়ু পরিবর্তনই নয় যেখানে মানব কর্মকান্ড প্রাকৃতিক জগতে প্রভাব ফেলে। বর্জ্য, দূষণ ও পরিবেশ ধ্বংসও বিদ্যমান।

 

          এই ব্যাপক ঐকমত্য, এবং কীভাবে এটি বন্ধ করা যাবে সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, এ ব্যাপারে খুব কমই করা হয়েছে। ২০০৯-এর গ্রীস্মে আইল অফ ওয়াইটের (Isle of Wight) থেকে এতটা স্পষ্টতর আর কোথাও হয়নি, যেখানে ভেস্টাস (Vestas) কোম্পানির মালিকানায় ব্রিটেনের একমাত্র wind turbine manufacturer-টি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখনকার এনার্জি সেক্রেটারি এ্যাড মিলিব্যান্ডের (Ed Milband) জলবায়ু পরিবর্তনে দায়বদ্ধ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, এটিকে বন্ধ করতে অনুমোদন দেন। চুড়ান্তভাবে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি  যেকোনও প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাজারের শক্তিসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধন্যবাদ ভেস্টাসের শ্রমিকদের, তাঁদের অন্য ধারণা ছিল, তাঁরা অবস্থান কর্মসূচী  সংগঠিত করে যা অনেক মাস ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিলো। 

একটা মিথ আছে যে মার্কস ও এঙ্গেলস এবং সুতরাং মার্কসবাদীদের পরিবেশবাদ সম্পর্কে কিছু বলার নেই অথবা তাঁরা এমনকি পরিবেশবাদের প্রতি বিরোধী ভাবাপন্ন হতে পারেন। নিশ্চয়ই কিছু মানুষ যারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে তাদের এই বিষয়ে খারাপ ট্র্যাক রেকর্ড আছে। নির্দিষ্টভাবে, পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞাসহ কারও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যয় দেয়া হয় স্তালিনীয় রাষ্ট্রসমূহের দ্রুত শিল্পায়নের সাথে সহযোগী পরিবেশগত সমস্যাসমূহ দিয়ে। যাহোক, মার্কস, এঙ্গেলস ও পরিবর্তী সময়ের মার্কসবাদীদের পরিবেশগত প্রশ্নাবলীতে সমৃদ্ধ অবদানকে এটি উপেক্ষা করে। লক্ষণীয়ভাবে জন বেলামি ফস্টারের (John Bellamy Foster) মত মার্কসবাদী বাস্তুবিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণা দেখায় কীভাবে প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ সম্পর্কে মার্কসের অন্তর্দৃষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যে সামাজিক প্রক্রিয়াবলী আমাদের পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রান্তে নিয়ে যায়, এবং আমাদের সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধা দেয় বলে মনে হয়, সেই সামাজিক প্রক্রিয়াবলী অনুধাবনে।

    

মার্কস ও এঙ্গেলস এমন এক সময়ে লিখছিলেন যখন পরিবেশের ওপর মানব কর্মকান্ডের প্রভাব সম্পর্কে খুব কম জ্ঞানই ছিল, এবং এর সাথে জড়িত বিজ্ঞানের বোধ আরও কম ছিল। যাহোক, আলোকায়নের (enlightment) যুগে বিভিন্ন চিন্তক বিশ্লেষণ বিকশিত করা শুরু করেন, যা ফোকাস করে মানব সমাজ এবং দৃশ্যত “প্রাকৃতিক” ঘটনাবলীর মধ্যে সংযোগের ওপর। একটি উদাহরণ হ’ল ১৭৫৫ সনে লিসবন ভূমিকম্পের ওপর প্রতিক্রিয়া। দার্শনিকবৃন্দ ও সমাজ তাত্ত্বিকদের ওপর জোরালো প্রভাব ফেলেছিল এই দুর্ঘটনা। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার এটিকে ব্যবহার করেন এবং প্রাকৃতিক জগতের হৃদয়হীনতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে এই ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দেন, ধারণাটি হ’ল এই যে সকল সম্ভাব্য দুনিয়ার মধ্যে আমরা সেরাটিতে বাস করছি। অন্যদিকে, রুশো যুক্তি দেন যে দুর্ঘটনা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক কারণও এতে নিহিত আছে, তাহ’ল বিপদজনক এলাকাগুলোতে ভঙ্গুর, উচু ভবনসমূহ নির্মাণ। এটা হ’ল  অপ্রাকৃতিক পদ্ধতিতে  বসবাসের ফল, যা ব্যর্থ হয় পরিবেশগত প্রতিবেশকে (environmental surroundings) মান্য করতে।

    

 পুঁজিতন্ত্র মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্কে যে ক্ষতি করে সে সম্পর্কে মার্কস কিছু খুবই সাধারণ মন্তব্য করেন অর্থনৈতিক দার্শনিক পান্ডুলিপিতে তিনি লেখেন যে তাঁদের শ্রমের উৎপাদ থেকে পরকায়িত হয়ে শ্রমিকএকই সময়েসংবেদনশীল বহিস্থ দুনিয়া, প্রকৃতির বিষয়সমূহের (objects of nature) সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় পরক দুনিয়া (alien world) হিসেবে যা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁর বিরোধী এর কারণ:

মানুষ প্রকৃতিতে বাস করেযার সাথে তাঁকে অবশ্যি অবিরাম বিনিময়ে থাকতে হয়ে যদি তাঁকে মরতে না হয় মানুষের শারিরীক ও আধ্যত্মিক জীবন প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত, এর সাদাসিদা অর্থ এই যে প্রকৃতি নিজেই নিজের সাথে সংযুক্ত,  কারণ মানুষ হল প্রকৃতির একটি অংশ১০৮

এইভাবে শ্রমের উৎপাদ ও প্রক্রিয়া (products and process of labour) থেকে আমাদের পরকীকরণের অর্থ হ’ল এই যে আমরা যে প্রাকৃতিক জগতে বাস করি এবং কাজ করি তা থেকেও পরকায়িত হই। ঠিক যেভাবে পরক (alien) হিসেবে এবং  নিয়ন্ত্রণের বাইরে, প্রাকৃতিক জগতের মতই কাজ আমাদের মোকাবেলা করে (confronts us)।

মার্কস ও এঙ্গেলস এই গোড়ার দিকের ধারণাগুলো (these early ideas) বিকশিত করেন অর্থনীতিতে ভূমির ভূমিকার বিশ্লেষণের অংশ হিসেবে। তাঁরা সজাগ ছিলেন (concerned) যখন মালথুসের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর মোকাবিলা করছিলেন (were addressing), যার সংস্করণসমূহ (versions) আজ পর্যন্ত সাধারণ বোধ (common sense) গঠন করে। মালথুস অনুসারে, দুর্ভিক্ষ পর্যায়ক্রমিকভাবে অনিবার্য (periodically inevitable) কারণ মানুষের খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতার চেয়ে তাঁর জনসংখ্যা অবধারিতভাবে দ্রুততর বৃদ্ধি পায়। এইভাবে মনুষ্য জনসংখ্যা সংকট বিন্দুতে (point of crisis) পৌঁছায় যেখানে পুরোপুরিভাবে (simply) যথেষ্ট খাদ্য থাকে না প্রত্যেককে খাওয়াতে। মার্কস ম্যালথুসের ধারণাবলীকে দেখেন “পুঁজির নিষ্ঠুর দৃষ্টিভঙ্গির নিষ্ঠুর প্রকাশ” হিসেবে। ম্যালথুসের ভুল ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃ্দ্ধির একটা স্থির সীমা (fixed limit) ধরে নেয়া যা বিভিন্ন পদ্ধতির অনধীন যে পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন সংগঠিত হয়। তিনি, কোনও ভাল কারণ ছাড়াই, “সকল ধরণের সমাজে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘটনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন”।

কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা ছিল একটি আপেক্ষিক বিষয়, এবং খাদ্য উৎপাদন অধিক সীমাবদ্ধ হয় এর উৎপাদনের যেকোনওপ্রাকৃতিকনিয়মসমূহের থেকে বরং বহিঃস্থ প্রতিবন্ধকতা দিয়ে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সার উৎপাদন ব্যবহারের দ্রুত বৃদ্ধির কালে এই ধরণের ধারণাবলীর সীমা বর্ধিতভাবে স্পষ্ট (increasingly clear) হয় আগে যতটুকু সম্ভব ভাবা হতো তার থেকে দ্রুত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হয় যাহোক, এই কৃষি উৎপাদন সাথে নয়া সমস্যাবলী নিয়ে আসে এটি তাড়িত হয় পুঁজিতান্ত্রিক সম্প্রসারণের প্রয়োজন দ্বারা, বিশেষত নগরগুলোতে শ্রমিকদের  বিপুল নয়া জনগণকে খাওয়ানোর প্রয়োজন থেকে পুঁজিতন্ত্র প্রোলেতারিয়েত তৈরী করেছিল এবং কাজের বিশেষ জায়গাগুলোতে তাঁদের কেন্দ্রীভূত করেছিল, তাঁদের নিজেদের খাওয়ার জন্য কোনও জমি বা উপায় ছাড়াই এখন তাঁদের খাওয়ানো দরকার ছিল

এই সমস্ত নয়া সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল মৃত্তিকা ক্ষয়করণ এটা বর্ধিতভাবে স্পষ্ট হচ্ছিল যে শিল্পায়ন মাটি থেকে পুষ্টিউপাদানসমূহ নিষ্কাশন করে এটিকে ক্ষয় করছিল, যেগুলো কখনও প্রতিস্থাপিত হয়নি, বরং বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয় জন নগরগুলোর বৃদ্ধি, এবং এগুলোর সাথে জড়িত উৎপাদন পরিবহনের বৃদ্ধি এমন একটা অবস্থার দিকে ধাবিত করে যেখানে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনের জন্য মাটি যথেষ্ট উর্বর নয় পুঁজি গ্রন্থে মার্কস লিখেন:

পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন বড় বড় কেন্দ্রগুলোতে জনগণকে একত্রিত করে এবং সদা ক্রমবর্ধমান সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ ঘটায় এটির দুটি ফলাফল রয়েছে একদিকে এটি সমাজের ঐতিহাসিক প্রেরণাদায়ক শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে; অন্যদিকে মানুষ পৃথিবীর মধ্যকার মেটাবোলিক মিথষ্ক্রিয়াকে এটি বাধাগ্রস্থ করে, অর্থাৎ খাদ্য বস্ত্র রূপে মানুষ কর্তৃক ভোগকৃত মৃত্তিকার উপাদান মৌলসমূহ (constituent elements) মৃত্তিকাতে প্রত্যাবর্তনে এটি বাধা প্রদান করে; সুতরাং মৃত্তিকার টেকসই উর্বরতার (lasting fertility) জন্য এটি শাশ্বত প্রাকৃতিক অবস্থার কাজে বাধা প্রদান করে পুঁজিতান্ত্রিক কৃষিতে সকল উন্নতি (a progress in the art), কেবলমাত্র শ্রমিকদের লুণ্ঠনে শিল্পের (art) একটি উন্নতি নয়, বরং মৃত্তিকার লুন্ঠনেও১০৯

 

জনসংখ্যার কেন্দ্রীভবনের কারণে মার্কস এখানে প্রকৃতি মানব সত্তার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ভাঙ্গন শনাক্ত করেন এঙ্গেলস পর্যবেক্ষণ করেন যে সমগ্র সাক্সনি রাজ্যের থেকে লন্ডনে এককভাবে বিপুল পরিমাণে সার উৎপাদন হয় এবং বিশাল অর্থ ব্যয়ে প্রতিদিন এই সার সমুদ্রে ঢেলে ফেলা হয় (is poured away into the sea)”১১০ সুতরাং, একটিঅন্তরঙ্গ সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার শিল্প-কারখানা কৃষির মধ্য”, একই সাথে সারা দেশে যতটা সম্ভব জনসংখ্যার সুষম বন্টনকরা১১১

এই বয়ানের কেন্দ্রে ছিল মেটাবোলিজমের ধারণা (জার্মান ভাষায় ‍Stoffwechsel, সোজাসুজি “material exchange”, অর্থাৎ বস্তুগত বিনিময়)। মানব সত্তা ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা করতে মার্কস পরবর্তী লেখাগুলোতে বর্ধিতভাবে মেটাবোলিজমের ধারণা ব্যবহার করেন। তিনি শ্রমকে বর্ণনা করেন এইভাবে: “মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি প্রক্রিয়া , যে প্রক্রিয়াতে মানুষ, তাঁর নিজের কর্মকান্ড দ্বারা তাঁর নিজের ও প্রকৃতির মধ্যকার মেটাবোলিজমকে মধ্যস্থতা করে, নিয়মাধীন (regulate) ও নিয়ন্ত্রণ করে।১১২ মৃত্তিকা ক্ষয়ের উদাহরণ হ’ল সোজাসুজি “বস্তুগত বিনিময়”-এর ব্যর্থতা, যেখানে শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়াতে মৃত্তিকা থেকে নেয়া পুষ্টি-উপাদান যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়নি। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াসমূহের এই ভাঙ্গন ছিল নগরসমূহে কেন্দ্রীভূত শ্রমশক্তির জন্য পুঁজিতন্ত্রের চাহিদার ফল।

ভাঙ্গনের এই ধরণ হ’ল শ্রম প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফসল। যদি মানব সত্তা ও প্রকৃতির মধ্যে মধ্যস্থতা করতে শ্রম একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তখন ঐ মধ্যস্থতাকারী সম্পর্ক হারানোর রয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রতিফল (disastrous consequences)। মানব সত্তা ও প্রকৃতির মধ্যকার মেটাবোলিজম ভেঙ্গে অনিয়মিত ও অসম হয়ে পড়ে। “মেটাবোলিক রিফট”-এর ধারণার ওপর ভিত্তি করে, জন বেলামি ফস্টার প্রকৃতি থেকে পরকীকরণের একটি বয়ান বিকশিত করেন । ফস্টার যেমনটি লক্ষ্য করেন, “জার্মান শব্দ ‍stiffwechsel সরাসরি ‘বস্তুগত বিনিময়’-এর ধারণায় এর মৌল উপাদান প্রদর্শন করে, যেটি ভিত্তিস্বরূপ হয় জৈবনিক বৃদ্ধি ও ক্ষয়ের (biological growth and decay) কাঠামোকৃত প্রক্রিয়াবলীর ধারণার, যা মেটাবোলিজম এপরিশব্দে করায়ত্ত হয়”। ফস্টার যুক্তি দেন, “মেটাবোলিজমের ধারণা মার্কসকে যোগান দেয় প্রকৃতির পরকীকরণের ধারণা প্রকাশে একটি মূর্ত উপায়. . . তাঁর একেবারে প্রথম দিকের লেখাগুলো থেকেই তা ছিল তাঁর ক্রিটিকের কেন্দ্রীয় বিষয়”।১১৩ অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপিতে দেওয়া মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্কের ওপর যুক্তিতে এটি বৈজ্ঞানিক অবয়ব (scientific flesh) দেয়। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার মেটাবোলিজমের এই ধারণা আজকের দিনে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। মৃত্তিকা থেকে নিষ্কাশনকৃত পুষ্টিউপাদান প্রতিস্থাপনের ব্যর্থতা (এই সমস্যাটির সমাধান এখনও হয়নি) হ’ল বায়ুমন্ডলে নিঃসরিত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনের ব্যর্থতার সমতুল্য।

এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে রুশোর প্রকৃতি থেকে পরকীকরণের বয়ান থেকে মার্কসের বয়ান পৃথক। রুশোর বয়ান এক ধরণের আদর্শ প্রাকৃতিক অবস্থার প্রসঙ্গে ফিরে আসে (hark back)। মার্কসের ক্ষেত্রে এটা দরকার নয় যে জীবন-যাপনের  প্রাক-আধুনিক  অবস্থায় আমরা প্রত্যাবর্তন করবো, যার অস্তিত্ব এখন আর নেই। প্রকৃতি থেকে পরকায়িত হওয়া এডেনের বাগান থেকে পৃথক হওয়া নয় যাতে আমাদের অবশ্যি প্রত্যাবর্তন করতে হবে। বরং, প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ এবং মেটাবোলিক রিফ্ট-এর ধারণা বর্ণনা করে প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণের অভাব, যা পুঁজিতন্ত্র দাবী করে এবং উৎসাহিত করে।

শহর ও গ্রামের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর এঙ্গেলসের কিছু লেখাতে এটি স্পষ্ট:

শহর ও গ্রামের মধ্যকার বিরোধের (antithesis) উচ্ছেদ কেবল সম্ভবই না। এটা স্বয়ং শিল্প উৎপাদনের একটি সরাসরি বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক যেমন এটা কৃষি উৎপাদনের একটি বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং, অধিকন্তু জনস্বাস্থ্যের। বায়ু, পানি ও ভূমির বর্তমান বিষক্রিয়া শেষ করা যেতে পারে কেবলমাত্র শহর ও গ্রামের সমন্বয়ে (by the fusion of town and country)। কেবলমাত্র এ ধরণের সমন্বয় জনগণের অবস্থার পরিবর্তন করবে, যারা এখন শহরগুলোতে ঝিমুচ্ছে (languishing in the towns), এবং রোগ উৎপাদনের পরিবর্তে  গাছপালা উৎপাদনে তাঁদের বিষ্ঠা ব্যবহারে সমর্থ হবে।১১৪

 

এটা হারানো গ্রামীণ জীবনে প্রত্যাবর্তনের ধারণা নয়, বরং শহর ও গ্রামের মধ্যকার প্রভেদ উচ্ছেদের ধারণা। অধিকন্তু, প্রকৃতির প্রতি এক প্রকারের অতিন্দ্রীয়বাদী উদ্বেগ (mystical concern) থেকে এটি অনুপ্রাণিত নয়, বরং মানব স্বাস্থ্যের ও মানব প্রয়োজন মেটাতে অধিকতর উপযোগী উৎপাদনের একটি রূপের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন থেকে।

 

এটির অর্থ আরও এই যে অনেক পরিবেশবাদীদের মধ্যে যারা কেতাদুরস্ত তাঁদের থেকে মার্কস খুবই পৃথক সামাধান প্রস্তাব করতেন এগুলো প্রায়ই দৃষ্টিপাত করে ব্যক্তিগত আচরণ পরিবর্তন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেকে তাঁদেরকার্বন ফুটপ্রিন্ট” (carbon footprint) হ্রাস করবে-এগুলোরওপর অনেকে এমনকি এই যুক্তি দেন যে একই বাজারের শক্তিসমূহ যে এই বিষয়ক অবস্থার (state of affairs) সৃষ্টি করেছে, তাঁদের এটি সমাধানে ডাকা যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানে প্রস্তাবকৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় সমাধানগুলোর একটি হকার্বন ব্যবসায়করণ”, যদ্দ্বারা কোম্পানিগুলো দুনিয়ার এক প্রান্তে দূষণ অব্যাহত রাখতে পারবে অপর প্রান্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অথবা বৃক্ষরোপণে বিনিয়োগের বিনিময়ে এটি পণ্যকামীতার পরিণতির একটি স্পষ্টতরউদাহরণ হতে পারে না, যেখানে এমনকি CO2 অণুসমূহকে উপলদ্ধি করা হয় পণ্য হিসেবে যেগুলো একে অপরের সাথে ভারসাম্য করতে পারে (can be traded off) এটি তখনও পুঁজিতন্ত্রীদের জন্য অধিকতর জটিল উপায়সমূহ তৈরী করে তাঁদের পকেট ভারী করতে (to line their pockets), কিন্তু সমস্যা সমাধানে অল্পই করে

          মার্কসের মতে, প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ, অন্য সকল পরকীকরণের মতই পরাজিত করা যেতে পারে যৌথভাবে, সমাজের সর্বাত্মক পুনঃসংগঠনের মাধ্যমে এতে দরকার হয় এই সম্পর্কের ওপর সচেতন, যৌথ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগ, যাতে জনগণ “যৌক্তিক উপায়ে প্রকৃতির সাথে মানব মেটাবোলিজম পরিচালনা করে (govern), একটি অন্ধ ক্ষমতা হিসেবে এটি দ্বারা নিয়নন্ত্রিত হওয়ার পরিবর্তে (instead of dominated by it) এটিকে তাঁদের যৌথ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে”।১১৫ এতে জড়িত থাকে মনুষ্যজন ও প্রকৃতির মধ্যকার একটি সুক্ষ্ম মেটাবোলিজমের সচেতনতা, এবং পদ্ধতিসমূহ যাতে এটিকে অবশ্যি নিয়মাধীন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় (regulate and control) ব্যক্তিগত ও যৌথ পর্যায়ে। ‍মানব জীবন সংগঠিত করতে যে কোনও একটি নির্দিষ্ট মডেল এটি জড়িত করে না, কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে একটিকে বাতিল করে দেয়, যেটি বর্তমানে আমাদের আছে।

          মার্কস ও এঙ্গেলসের জন্য, প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ সবচেয়ে জরুরী উদ্বেগ ছিল ন। যাহোক, বর্তমান প্রজন্মের জন্য এর তাৎপর্যকে অগ্রাহ্য করা যায় না। মানব প্রজাতির জন্য প্রকৃতি থেকে পরকীকরণ সবধরণের পরকীকরণের থেকে দ্রুত সবচেয়ে বিপদজনক রূপ লাভ করছে। 

 

অধ্যায় দশ

কাজ কি পরিবর্তিত হয়েছে?

 

মার্কসের বর্ণনার পেছনে চালিকা শক্তি ছিল বৃহদায়তনের ফ্যাক্টরি উৎপাদনের মডেল, যাতে শ্রমিকেরা ভারী মেশিনারির আনুষঙ্গিক বস্তু হয়ে পড়ে, যেটি দরকার মেশিনের কার্যক্রমের জন্য (for the machine’s operation), তার ছন্দ ও চাহিদা সাপেক্ষেও। আজকের দিনে অনেক মানুষজনের জ্ন্য এই ব্যবস্থাটি জীবন্ত ও ভালো। ফক্সকন ফ্যাক্টরি (Foxconn Factory) একাই নিয়োগ দেয় ৩০০-৪০০,০০০ শ্রমিক, যারা  ফ্যাক্টরি সাইটে বাস করে এবং সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করে। ফ্যাক্টরি গেটের চারপাশে পশ্চিম গেট থেকে দক্ষিণ গেট অবধি ৩০ মিনিটের পথ। দুনিয়া ব্যাপী নিযুত নিযুত মানুষের জন্য এই ধরণের কাজ স্বাভাবিক। ফক্সকন ফ্যাক্টরি ২০১১-আইপ্যাড-এর দরকারী গ্যাজেট (must-have gadget of 2011-the ipad) উৎপাদন করে, এই ঘটনা কেবল জোরদার করে কীভাবে এই ধরণের উৎপাদন উন্নত বিশ্বের সাথে সংযুক্ত হয়।

          যাহোক, মার্কস যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন তা থেকে কিছু রূপে ও কিছু জায়গায় কাজ পরিবর্তন হয়েছে (work has changed)। মার্কস স্বীকার করেছিলেন (acknowledged) পুঁজিতন্ত্র যে পদ্ধতিতে দ্রুত সমাজের আমূল পরিবর্তন করে (rapidly revolutionizes society) সেটি যাকিছু কঠিন তা বাতাসে বুদবুদ হয়ে যায় (making ‍all that is solid melt into air)। পুঁজিতন্ত্র কাজের নয়া ধরণগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, বিশেষত উন্নত দুনিয়ায়, যা মার্কস আলোচনা করেননি। এটার অর্থ কি এই বুঝায় যে মার্কসের ধারণাবলী আজকের দিনে প্রয়োগ করা যায় না? পুঁজিতন্ত্রের সমর্থক ও সমালোচক উভয়ই ধরণের অনেক মন্তব্যকারীদের মতে, মার্কসের ধারণাবলী সেকেলে (outdated), এবং আধুনিক দুনিয়াতে প্রয়োগ করা যায় না।

    এই সত্যের ওপর এটা তৈরী করা হয় যে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যানুফ্যাক্চারিং খাতে কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়েছে, যখন সেবা ও অর্থ (service and financial) খাতের বৃদ্ধি হয়েছে। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৮ হতে ব্রিটেনের শ্রমশক্তির শতকরা হার ২৮.৫ হতে কমে ঠিক ১০% হয়েছে।১১৬ একই সময়ে সেখানে সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য অনুপাতে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থ ও ব্যবসায় খাতে তাঁদের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া সমেত, এবং শ্রমিকদের ২৮.১% কাজ করে জন প্রশাসন (public administration), শিক্ষা অথবা স্বাস্থ্য খাতে।১১৭ তাঁদের কাজকে (job) প্রায়ই দেখা হয় স্বতন্ত্র শ্রমিককে অধিকতর স্বাধীনতা (more freedom) প্রদানকারী হিসেবে। মার্কসের পর্যবেক্ষণকৃত ফ্যাক্টরি কাজের ধরণের মত এই কাজগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক অথবা অবজ্ঞাপূর্ণ (repetitive or degrading) নয়, এবং একই ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও জড়িত নেই।

          ম্যানেজfরগণ কাজ সম্পর্কে যে পদ্ধতিতে কথা বলে, এমনকি “অধিকতর পুরাতন” ধরণের কাজগুলো সম্পর্কেও, তাতে একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। তাঁদের বসদের নেতৃত্ব এবং “কর্মচারী স্বায়ত্তশাসন” সম্পর্কে বলা ছাইভস্ম সম্পর্কে এখন তাঁরা সুপরিচিত। যাহোক, এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতাকে অভিহিত মূল্য (face value) হিসেবে নেয়া উচিত নয়। সামাজিক সম্পর্কসমূহ ও কাজের অনুশীলনকে মার্কস পরকায়িত হিসেবে বুঝতেন, সেগুলো এখনও জীবন্ত ‍ও স্পষ্ট (live and well)।  

 

          মার্কসের জন্য পরকীকরণ প্রোথিত ছিল সামাজিক সম্পর্কাবলীর ভেতরে যেটি পুঁজিতন্ত্র গঠন করে- সমাজের বিভাজন সংঘটিত করে একটি শ্রেণীতে যেটি উৎপাদনের উপায়ের মালিক হয় এবং আর একটি শ্রেণীতে যে শ্রেণীকে এর নিজের শ্রম বিক্রয় করতে হয়, এবং শ্রমের রূপান্তর ঘটে পণ্যে। শ্রমের বিশেষ ধরণ, এবং কাজের জায়গার বিশেষ ধরণ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক নয়। পরকীকরণের প্রধাণ উৎস নয় ভারী মেশিনারি। ভারি মেশিনারি যেভাবে কর্ম জীবনের ওপর আধিপত্য করে সে ব্যাপারে মার্কস নিশ্চয়ই ‍সজাগ ছিলেন (was concerned); যাহোক, নতুন মেশিনারি যে সামাজিক সম্পর্কাবলী এবং কাজের অবস্থাবলী তৈরী করে সে বিষয়গুলোতে তিনি অধিকতর সজাগ ছিলেন। ফ্যাক্টরি মেঝের ওপর (on the factory floor) কঠোর আদেশের সম্পর্কাবলীর পাশাপাশি, শিল্প-কারখানার বিকাশে (The of development of industry ) দরকার হয় শ্রমিক শ্রেণীর দ্বিগুণ স্বাধীনতা (double freedom)। এই অবস্থাসমূহ চলমান থাকতে পারে এবং অবশ্যি চলমান থাকে এমনকি যখন ভারী মেশিনারি অনুপস্থিত থাকে। আপনি প্রোডাকশন লাইনে কাজ করেন এটি অনুভব করতে আক্ষরিক অর্থে আপনার কনভেয়ার বেল্ট দরকার নেই। কী ধরণের কাজ করা হয় সেটা মুখ্য প্রশ্ন নয়, বরং এর সাথে জড়িত  আদেশ ও নিয়ন্ত্রণের (command and control) সম্পর্কাবলী হ’ল মুখ্য।

সবচেয়ে বিখ্যাত যুক্তিগুলোর (arguments) একটি হ’ল এই যে মার্কসের বিশ্লেষণ আর পুরোপুরি প্রয়োগ করা যায় না, এটি আসে মাইকেল হার্ডট (Michael Hardt) ও টনি নেগ্রির (Toni Negri) কাজ থেকে। হার্ডট ও নেগ্রি পুঁজিতন্ত্রের জন্য পক্ষ সমর্থনকারী (apologists) নন । প্রকৃতপক্ষে তাঁরা তীব্র সমালোচনাকারী, যারা পুঁজিতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ও প্রভাবশালী (active and influencial)। বিশেষ করে নেগ্রির ইতালিতে র‌্যাডিক্যাল কর্মকান্ডের (radical acitivity) একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যাহোক, তাঁরা যুক্তি দেন যে কাজের নয়া রূপগুলো (new forms) বিষয়সমূহকে (things) পরিবর্তন করেছে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে। তাঁরা দাবী করেন যে মৌলিক অর্থনৈতিক রূপান্তর সংঘটিত হয়েছে একটা “প্যারাডাইমে (paradigm) যাতে সেবা প্রদান (providing services) এবং তথ্যকে সুনিপুণভাবে পরিচালন (manipulating information) অর্থনৈতিক উৎপাদনের অন্তঃপ্রকৃতিতে বিদ্যমান”।১১৮ তাঁরা যুক্তি দেন যে “তথ্যগত অর্থনীতির দিকে ধাবিত পথে প্রয়োজনগতভাবে জড়িত থাকে  শ্রমের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিতে পরিবর্ত ”।১১৯ এই রূপান্তরের অর্থ হ’ল এই যে শ্রমের একটা নয়া রূপ এখন কর্তৃত্বশালী (dominant), তাঁরা এই নয়া রূপটিকে বলেন “অবস্তুগত শ্রম” (immaterial labour)। এই শ্রমে জড়িত থাকে প্রতীক, টেক্সট,আবেগ (emotion) অথবা অনুভূতি (feelings)।

যখন হার্ডট ও নেগ্রি মনে করেন না যে এই কাজ অবশ্যাম্ভাবীরূপে অধিকতর ভালো, তবে তাঁরা অবশ্যি মনে করেন এটি শ্রমিকদের জন্য নয়া সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। এর জন্য কারণসমূহের একটি হ’ল এই যে এই ধরণের কাজের জন্য যা দরকার তা হ’ল, দৃশ্যত, আমাদের মস্তিষ্ক: মস্তিষ্ক ও শরীরের এখনও অন্যকিছু দরকার মূল্য উৎপাদন করতে, কিন্তু তাদের উৎপাদন সুসমন্বিত করতে অন্য যা কিছু দরকার আবশ্যাম্ভাবীভাবে সেগুলো পুঁজি ও এর ক্ষমতা দ্বারা প্রদানকৃত হয় না”।১২০ কার্যকরভাবে এর অর্থ হ’ল এই যে মার্কস বর্ণীত দ্বৈত অর্থে শ্রমিকেরা আর স্বাধীন (free) নয়। শ্রমিকদের বেচে থাকতে পুঁজিতন্ত্রীর নিকট আর শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে হয়  না। নেগ্রি স্পষ্টভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরেন নিউ স্টেটসম্যান  পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে: “অতীতে ফ্যাক্টরি এবং উৎপাদনের সমস্ত হাতিয়ার সরবরাহের জন শ্রম নির্ভরশীল ছিল পুঁজির ওপর। আজ আমাদের কাজ করার  দরকারী সব হাতিয়ার আছে আমাদের মস্তিষ্কে”।১২১

যখন হার্ডট ও নেগ্রি এই দাবীগুলো করেন র‌্যাডিক্যাল প্রেক্ষাপট থেকে, তখন তাঁরা খুবই পৃথক খুবই ভিন্ন রাজনৈতিক পটভূমির ব্যাবস্থাপনা ও তাত্ত্বিকদের (management and theorists) পেশ কৃত দাবীসমূহের প্রকরণগুলো থেকে খুব একটা ভিন্ন নন। এবং এই যুক্তিগুলো অযৌক্তিকভাবে অতিরঞ্জিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটা সাদাসিদাভাবে (simply) সুপারিশ করা ভুল, উপরের সাক্ষাৎকারে যেভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে সেভাবে, যে এই “নয়া” ধরণের কাজে দরকার যা কেবলমাত্র আমাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান। একদল নার্স কি দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারেন হাসপাতাল ছাড়া? কল সেন্টার ব্যতিত কল সেন্টারের কর্মীবৃন্দ কি কাজ করতে পারেন? এয়ারক্রাফট ছাড়া কেবিন ক্রুবৃন্দ কি পানীয় পরিবেশন করতে পারেন? এটা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট কেন তাঁদের নিজেদের মস্তিষ্ক ব্যবহারকারী শ্রমিকবৃন্দ পৃথক হবেন একজন কয়লা খনি শ্রমিক থেকে যিনি তাঁর নিজের হাত ব্যবহার করেন অথবা একজন ট্রাক চালক থেকে যিনি তাঁর নিজের পা ব্যবহার করেন। তাঁদের এখনও দরকার একটা কাজের জায়গা (a work place), যন্ত্রপাতি (equipment), ইত্যাদি, এবং এই সবগুলোই পুঁজিন্ত্রীদের মালিকানায়।

এই কাজের প্রকৃতি সম্পর্কে নেগ্রির অধিকতর অতিরঞ্জিত দাবীসমূহ বাদ দেবার পরও দেখা যায়, হার্ডট ও নেগ্রিও ভুল করেছিলেন এই যুক্তি দিয়ে যে শ্রমের অন্যান্য রূপের ওপর “অবস্তুগত শ্রম” এখন আধিপত্যশীল । মার্কসের সময় থেকে এখন কাজ ও শ্রমিকদের দেখতে পৃথক মনে হতে পারে, কিন্তু ঠিক অনুরূপ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে ভাসা-ভাসা (superficial) পার্থক্যগুলো উপেক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মার্কসের সময়ে, যথেষ্ট পরিমাণে সেবা ও আর্থিক খাত ছিল, কিন্তু মার্কস তাদেরকে বুঝতেন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সেবা প্রদানকারী হিসবে, অন্য কোনও ভাবে নয়। এটি এখনও সত্য। শুধু এই কারণে, কমপক্ষে উন্নত বিশ্বে, তথাকথিত তথ্যমূলক অর্থনীতি (informational economy) বৃহত্তম সংখ্যায় জনগণকে নিয়োগ দেয়, এর অর্থ এই না যে এটি অর্থনীতির “আধিপত্যশীল” (dominant) অংশ। বরং এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে অর্থনীতির ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেবা ও তথ্য খাতের সাধারণভাবে অস্তিত্ব বিদ্যমান, এর কারণে

যুক্ত রাজ্যে ভোডাফোনের শ্রমিকেরা হতে পারেন অফিস, দোকান বা কল সেন্টারের শ্রমিক, কিন্তু তাঁরা অস্তিত্বমান ফোন বিক্রয় করতে, যেগুলো ম্যানুফ্যাকচারকৃত, এবং নেটওয়ার্কের ব্যবহার, এটি যদিও “তারবিহীন” (wireless), তারপরেও এর জন্য দরকার হয় বিপুল প্রেরণ সরঞ্জাম (transmitting equipment)। যদিও আইফোনের ম্যানুফ্যাকচারগণের থেকে নক্সাকারবৃন্দ (designers), পরিবেশকবৃন্দ (distributors), সহায়তাকারকবৃন্দ (promoters) এবং গ্রাহক সেবা প্রদানকারীগণ (customer service providers) অধিকতর ভালো বেতন পান এবং সংখ্যায় অনেক, এটা তাদেরকে প্রক্রিয়াটির অপরিহার্য অংশে পরিণত করে না। এটা উল্লেখযোগ্য যে সাম্পতিক সময়ে এ্যাপল মাইক্রোসফটকে অতিক্রম করে গেছে বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে, কিন্তু সফটওয়ারের ভিত্তিতে নয়, বরং ইলেকট্রনিক গ্যাজেটগুলোর ওপর ভিত্তি করে, প্রকৃত উৎপন্ন দ্রব্য যা মানুষের হাতে ধরা থাকে।

ম্যানেজমেন্ট ও বামেদের কিছু অংশ - এই উভয়ের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, কাজের প্রকৃতিতে যেকোনও প্রকৃত পরিবর্তনের প্রমাণ খুব সীমিত। কাজের নতুন ধরণসমূহ সম্পর্কে অতি সাধারণীকরণ করার একটা তীব্র প্রবণতা বিদ্যমান। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ কেবিন ক্রুর একজন সদস্য এবং ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার্ক এন্ড পেনশনস কল সেন্টারের একজন কর্মী- উভয়েই হয়তো খুবই পৃথক হতে পারেন জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার-এর প্রোডাকশন লাইনের একজন কর্মী থেকে, কিন্তু তারপর তাঁরাও একে অপর থেকে খুবই পৃথক। এই কাজগুলোর (jobs) দৃশ্যতঃ (apparant) সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ (common feature) থেকে তাত্ত্বিক বিমূর্তায়ন টানার পরিবর্তে, তাঁরা যে মূর্ত ওয়ার্ক-প্লেস সম্পর্কাবলীতে জড়িত সেটি বিবেচনা করা অধিকতর কেজো (more useful) মনে হয়।

তারপরেও কাজের নয়া ধরণের জন্য যুক্তিসমূহ (arguments) উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল বলে প্রতিভাত হয়, যখন প্রকৃত কাজের জায়গার বিশ্লেষণ (analyisis of the actual workplace) দেয়া হয়। যেমনটি একটি স্টাডি যুক্তি দেয়, এই বিতর্কটি প্রবণতা দেখায় “পরিবর্তনশীল কর্ম-অনুশীলনসমূহকে (changing work practices) প্রায়োগিক পরীক্ষণের (empirically examine) থেকে বরং, স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেয়ার (assume), বিশ্বাসের একটি উল্লম্ফনের মাধ্যমে জ্ঞান কর্মীদের বর্ধিত শ্রেণী অবস্থান এবং তাঁরা যে ব্যবস্থাপনাগত ভঙ্গি উপস্থাপন করে, সেগুলোর আলোচনা গিয়ে নেয়া”।১২২ হার্ডট ও নেগ্রির যুক্তিগুলো জাহির করে যে কাজের এই ধরণগুলো তাদের সাথে নিয়ে আসতে পারে অথবা পারবে শ্রমিকদের একটা নয়া প্রকরণ, এটা প্রদর্শন করতে উল্লম্ফন দেয় যে তাঁরা আছে বা আছে:

আদতে, এর বিপরীতে অনেক প্রমাণ বিদ্যমান। জ্ঞান শ্রমিকদের (knowledge workers) উত্থানের সাথে সাথে একটি বিপ্লবের উত্থান ঘটেছে- এটি অনুমান করা ও জোর দেয়ার থেকে বরং, মূল প্রশ্ন এখন মনে হচ্ছে: বিপ্লব কেন সংঘটিত হয়নি?১২৩

কাজের পরিবর্তন হয়েছে- এটা মনে করার একটা কারণ এই যে মার্কস কর্তৃক বর্ণিত প্রোডাকশন লাইন কাজের ধরণের তুলনায় কিছু কাজ অধিকতর জটিল বলে প্রতীয়মান হয়। মার্কস বর্ণনা করেন কাজ বিভাজিত করা হয় অনবরত ক্ষুদ্রতর, সরল টাস্কে, যা প্রয়োজনগতভাবে শ্রমিকদের সৃজনশীলতা ব্যাহত করে। যাহোক, কিছু ক্ষেত্রে এটি সংঘটিত হয় না। এটা ভাবা যেতে পারে যে কাজগুলো (jobs) অধিকতর জটিল হলে তাদের প্রয়োজনগতভাবে দরকার হয় অধিকতর কর্মী নিয়ন্ত্রণ, যা পরকীকরণের সবথেকে খারাপ দিকসমূহ (worst aspects of alienation) দূর করতে পারে।

যাহোক, ১৯৮৬ ও ২০০১-এ ব্রিটেনের দক্ষতা লেভেল জরিপের ফলাফলের তুলনা সুপারিশ করে যে এটা সত্য নয় (this not the case), বরং আদতে সুক্ষভাবে (precisely) বিপরীত প্রবণতাই দৃশ্যমান। যখন তুলনাসমূহ সুপারিশ করে যে ব্রিটেনে কাজসমূহের জটিলতা ও দক্ষতা লেভেলের ক্ষুদ্র কিন্তু ধীর লয়ের বৃদ্ধি (steady increases), তখন কার্য বিচক্ষণতা”-এর (job discretion) পরিমাণে সম্পর্কিত বৃদ্ধি ছিল নাঅর্থাৎ তাঁদের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে আদতে, “কার্য বিচক্ষণতায় একটা উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে১২৫ তাঁরা যে পদ্ধতিতে কাজ করে তার ওপর প্রভূত পরিমাণেতাঁদের পছন্দ বজায় আছে- এ ধরণের রিপোর্টের অনুপাত ১৯৮৬-এর ৫১.% থেকে কমে ২০০১-এ দাঁড়ায় ৩৮.৬৮% তখন কতটা কঠোর পরিশ্রম করা যায় তাঁর ওপর তাঁদের প্রভূত পরিমাণে প্রভাব বিদ্যমান আছে- এ ধরণের রিপোর্টের অনুপাত ১৯৯২-এর ৭০.৭৮% থেকে কমে ২০০১-এ দাঁড়ায় ৫০.৬৮%১২৬  

এটি যা সুপারিশ করে তাহল এই যে নয়া শিল্প-কারখানা (industries) যাই পরিবর্তন নিয়ে আসুক না কেন, সেগুলো কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিতে জড়িত নয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে গ্লাসগোতে তিনটি করণিক কাজের জায়গাতে (clerical workplaces) একটি গবেষণা (study) চালানো হয়, এই তিনটির দু’টি ছিল সর্বজনের সেকটরে (public sector) আর একটি ছিল ব্যক্তিগত সেকটরের (private sector)এই গবেষণার উপসংহার ছিল এই যে কাজের বিন্যাস (configuration), পরিবেশ (atmosphere), নজরদারীর পর্যায় (level of surveillance) অফিসের কাজের (office work) প্রচলিত চিত্রের থেকে বরং হালকা ম্যানুফ্যাকচারিং এসেম্বলি প্ল্যান্টের অধিকতর সদৃশ১২৭

গবেষণা যুক্তি দেয় যে আমাদের কেইস স্টাডিগুলো ও অপারেটিভদের সাথে সাক্ষাৎকারগুলো থেকে সামান্যই দেখানোর আছে যে কল সেন্টারগুলোতে প্রচলিত কাজের নয়া রূপগুলো মানানসই হয় নয়া স্টাইলগুলো দ্বারা অথবা ম্যানেজমেন্টের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা”, এবং এই উপসংহারে আসে যে কর্মীদের কাজের জীবনের উন্নতি এবং সকলের জন্য সুযোগের সম্প্রসারণ ঘটিত নয়াকাজের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, আমরা বাস্তবতাকে দেখতে সম্পূর্ণ খুবই পৃথক হিসেবে১২৮

এমনকি ম্যানেজমেন্ট যে পদ্ধতিতে তাঁদের ম্যানুফ্যাকচারিং সম্পর্কে কথা বলে তাতে একটা স্থানান্তর (shift) দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, হার্ডট ও নেগ্রি ব্যাপক মাত্রায় রূপান্তর সংঘটিত করেন কীভাবে কার ফ্যাক্টরিগুলো সংগঠিত করা যায় ফোর্ডবাদ (Fordism) থেকে টয়োটাবাদে (Toyotism) যখন ফোর্ডবাদ গুরুত্বারোপ করে সরলীকৃত রুটিন কাজে (routine tasks), তখন টয়োটাবাদ গুরত্বারোপ করে টিম ওয়ার্কে এবং কর্মী স্বাধীনতায়। কিন্তু আর একবার ম্যানেজমেন্টের এই নয়া রূপগুলোর বাস্তবতা প্রত্যাশা অবধি পৌঁছায়নি (live up to the promised) সাউথ ওয়েলসে জাপানী ফার্মসমূহের ওপর একটি জরিপ অর্থপূর্ণ সন্দেহ প্রকাশ করে যে এই নয়া পদ্ধতিগুলো কীভাবে বাস্তবিকই পৃথক।জাপানীজ মডেলঅনুমিতভাবে (supposedly) জড়িত থাকে টিম ওয়ার্কিংয়ে, যা সংহত করে (mobilises) মালিকানার একটি বোধ, স্বশাসন (autonomy) এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি (business orientation)” এটা সরাসরি উৎপাদন শ্রমিকদের জন্য কাজের পরিকল্পনায় (job design) অংশগ্রহণ করতে কিছুটা জায়গা প্রদান করেবলে ধারণা করা হয়।১২৯

তারপরেও বাস্তবে এটি সহজভাবে ঘটে না। সৃজনশীল স্বাধীনতা দেয়া থেকে অনেক দূরে, “কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই প্রোডাকশন অপারেটরদের নিয়োগ দেয়া হতো স্বল্প দক্ষ, একঘেয়ে এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলোতে (repetitive tasks)” ১৩০ যখন মালিকানাসম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন মাৎশুশিতা ইলেকট্রিকের একজন ট্রেড ইউনিয়ন স্টুয়ার্ড প্রত্যুত্তর দেন:

কাজের মালিকানা? এই পরিভাষা আপনাকে শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এটার অর্থ কী বলে প্রতীয়মান হয়? আপনি কেবলমাত্র দুই সেকেন্ডের জন্য এই রক্তাক্ত ইউনিটকে আপনার সামনে পাচ্ছেন। সুতরাং তাহলে আপনি কীভাবে মনে করবেন যে আপনি এটির মালিক?১৩১

আসলে গবেষণাটি জাপানী মডেলের কেবলমাত্র বিশেষভাবে স্বাতন্ত্রসূচক যে বৈশিষ্ট্যটি  (study) শনাক্ত করে তাহল এই যে কর্মীদের কাজের সময়ে নিয়ন্ত্রণের চরম মাত্রায় জোর দেয়, বিশেষ করে ঘন্টা ও সাইরেনের নির্ভুল কাজে। “শ্রম নিয়ন্ত্রণের প্রতি এর সাধারণভাবে নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গির (meticulous approach) জন্য জাপানী ম্যানেজমেন্ট অনুশীলন হ’ল সুস্পষ্ট (conspicuous), যা পালাক্রমে, লক্ষ্য স্থির করে অতিরিক্ত প্রচেষ্টায় বর্ধিত লব্ধ সুবিধা অর্জন এবং কর্মচ্যুতিতে সম্মতি দেয়া শ্রমিক”।১৩২

মার্কসের দুনিয়া এবং আমাদের নিজেদের দুনিয়ার মধ্যকার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ’ল রাষ্ট্রীয় খাতের বিপুল বিস্তৃতি (vast expansion)। ঊনিশ শতকের থেকে আরও বেশী মানুষ সর্বজনের সেবা খাতে (public services) নিয়োগকৃত হয়। রাষ্ট্র একটি বিশাল নিয়োগকর্তা, এবং এটাকে বিস্তৃত পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। রক্ষণশীল বাগাড়ম্বর দাবী করে যে রাষ্ট্র হ’ল অর্থনীতির ওপর একটি নর্দমা (drain)। তারা দাবী করে যে এটি কোনও মূল্য তৈরী করে না এবং প্রাইভেট ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ রুদ্ধ করে, এবং এটি তাদের উদ্দেশ্যের সাথে মানানসই হয় যখন এটি বেনিফিট ও কাজের ওপর আঘাত হানে (cut back)। কিন্তু পুঁজিতেন্ত্রে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কসের মতে শ্রম                      শক্তি (labour power) একটি পণ্য এবং পুঁজিতন্ত্রকে সক্রিয়া রাখার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ পণ্য। রাষ্ট্রীয় খাতকে বুঝতে হবে এই শ্রম শক্তির পুরুৎপাদনে (reproduction) একটি ভূমিকা পালনকারী হিসেবে, অর্থাৎ স্বাস্থ্যপ্রদ ও সামর্থ্যবান কর্মশক্তি তৈরী করতে ও বজায় রাখতে ‍ভূমিকা পালনকারী হিসেবে। স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও শিক্ষা এ সবকিছুই দরকার কর্মজীবি মানুষ তৈরী করতে যারা শ্রম প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্তভাবে দক্ষ ও উপযুক্ত।  

এটার অর্থ এই যে সর্বজনের সেবা (public service) অথবা প্রশাসনের ২৮.১% মানুষকে সাদামাটাভাবে দেখা উচিত নয় উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরে। বরং, তারা কর্মশক্তি পুরুৎপাদনের একটি অপরিহার্য অংশ। অধিকন্তু, যখন ব্যক্তিগত খাতের সাথে তুলনা করা হয়, তখন এই চাকুরীতে কাজ করা কোনমতেই এক ধরণের কর্মী স্বায়ত্বশাসনের স্বর্গে কাজ করা নয়। লক্ষ্য পূরণ এবং একটি পরিমাণযোগ্য পরিষেবা সরবরাহ করতে সর্বজনের খাতের শ্রমিকদের প্রচন্ড আমলাতান্ত্রিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাইকেল লাভালেট (Micheael Lavalette) ও আয়ান ফারগুসন (Iain Ferguson) সামাজিক কাজের (social work) মধ্যে বর্ধিত ব্যবস্থাপনীয় ও আমলাতান্ত্রিক কর্ম পরিবেশ এবং এর চরম নেতিবাচক প্রভাবগুলো বর্ণনা করেন: “পরিণতি এই যে সামাজিক কর্মীবৃন্দ দেখেন  গ্রাহকদের সাথে তাঁদের চুক্তি ও কাজের ওপর তাঁদের ঊণ স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে; তারা আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রবিধান বৃদ্ধির বিষয়। তাঁদের কাজের সক্রিয়তাসমূহ বর্ধিতভাবে তাদের ও তাঁদের গ্রাহকদের মোকাবেলা করে (confront) `পরক’ অনুশীলনসমূহের একটা সেট হিসেবে”।১৩৩         

সামাজিক কর্মীদের দু’টি ভূমিকা: একটি হ’ল সামাজিকভাবে সচেতন যত্নকারী (carer) হিসেবে তাঁদের গ্রাহকদের যত্নে আগ্রহী থাকা, এবং অপরটি হ’ল শ্রম শক্তির পুনরুৎপাদক (reproducer) হিসেবে, যাতে মানুষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে ফিরে আসতে পারে চাপের অধীনে। এই দু’টি ভূমিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এটি এবং মার্কসের বিমূর্ত শ্রমের আলোচনা- এই দু’য়ের মধ্যকার সংযোগে জোর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। সর্বজনের খাতের শ্রমিকদের কাজ পরিমাপকৃত, সীমাবদ্ধ এবং সংখ্যায় ব্যক্ত (measured, restricted and quantified)। সকল সর্বজন খাতের শ্রমিকদের সামনে কাগজ-পত্রের (paperwork) গাদা, টার্গেট, টেস্ট, মূল্যায়ন (assessment) স্তুপীকৃত থাকে। যেমনটি অধ্যায় চারের উচ্চ শিক্ষা হতে ধারণা পাওয়া যায়, এর লক্ষ্য হ’ল তাঁরা যে শ্রম দেয় এবং যে শ্রম তারা পুনরুৎপাদিত করে, এই উভয়েরই সংখ্যায় ব্যক্ত করা। এখানে পুনরুপাদিত করে অর্থাৎ অপরদের  কতটুকু কাজ করাতে সক্ষম করে। এটি আমলাতান্ত্রিকীকরণের দিকে ধাবিত করে এবং সম্পাদিত কাজকে সংখ্যায় ব্যক্ত করতে চেষ্টা করে, এ ধরণের কাজে পরিপূর্ণতার বোধ থেকে তীব্রভাবে বাইরে টেনে আনে।

এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে যা বিস্মায়ক তাহল জনগণের কর্ম-জীবনের বাস্তবতা এবং কাজের একটি র‌্যাডিক্যাল নয়া ধরণের বাগাড়ম্বরের মধ্যকার ফাঁক (gap)কল সেন্টার ও জাপানী ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্ম- এই উভয়ক্ষেত্রে চালানো জরিপে দেখা যায় যে ম্যানেজমেন্ট ও কিছু সংখ্যক সামাজিক তাত্ত্বিক উভয়ের বাগাড়ম্বর বাস্তবতা থেকে খু্বই পৃথক। যেমনটি কেভিন ডুগান (Kevin Doogan) লক্ষ্য করেছেন, কীভাবে কাজের পরিবর্তন ঘটেছে- এ সম্পর্কে অনুমান (assumptions) এবং এর বাস্তবতার মধ্যকার ফাঁক সুপারিশ করে যে এই বিতর্কগুলোতে প্রায়ই একটি মাত্রাতিরিক্ত রাজনীতিকৃত (politicised) ডাইমেনশন থাকে।১৩৪ প্রায়শ যেভাবে কাজ পরিবর্তিত হয়েছে সে সম্পর্কে যারা অতিরঞ্জিত করে তাদের একটি লুকানো এজেন্ডা থাকে (যদিও প্রায়ই কদাচিৎ ভালভাবে লুকানো থাকে ) কাজের নয়া যুগের অতিরঞ্জিত বাগাড়ম্বর আড়াল করে মার্কস কর্তৃক বর্ণনাকৃত ‍দুনিয়া ঠিক কতটুকু অনমনীয়ভাবে একই রকম আছে।

বাস্তবতা ও বাগাড়ম্বরের মধ্যকার ফাঁক নিজেই অবদান রাখতে পারে পরকীকরণে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হঅতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি তাদের কাজের জন্য। কল সেন্টারগুলোর জরিপে দেখা গেছে কর্মীদের এক-চতুরাংশের অধিকেরই ডিগ্রী-লেভেলের অথবা উচচতর যোগ্যতা আছে। যখন পরিপূর্ণ, সৃজনশীল ও দক্ষতাসম্পন্ন (fulfilling, creative and qulified) কাজের একটা নয়া রূপের প্রত্যাশা পার্থিব, রুটিনকৃত ও অপরিপূর্ণ (mundane, routinised and unfulfilling) বাস্তবতার সম্মুখীন হয়, তখন এটি পরকীকরণ ও ক্ষমতাহীনতার বোধে (a sense of alienation and powrlessness) অবদান রাখতে পারে। মার্টিন স্মিথ (Martin Smith) সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে পাসপোর্ট অফিসে তাঁর প্রথম দিন বর্ণনা করেন:

আমি দুনিয়াতে উর্ধ্বগামী হচ্ছিলাম- চিন্তার এই ভয়াবহ ভুলটি আমি করেছিলাম। আমি সবচেয়ে ভাল সুট পরিধান করে কাজে পৌঁছেছিলাম . . . আমার জীবনের ধাক্কাটি আমি খেলাম: প্রত্যেকেই জিনস পরিধান করেছিলো। আমাকে একটা বিশাল অফিসে নিয়োজিত করা হয়েছিলো, যেখানে মানুষজনের অর্ধেক সারাদিন চিঠি খুলছিলো এবং বাকী অর্ধেক এনভেলাপগুলো ভরছিলো . . . আমি ছিলাম একটা করণিক প্রোডাকশন লাইনের অংশ।১৩৫

পরকীকরণের অবসানের অতিরঞ্জিত দাবী এভাবে আসলে পরকীকরণকে উৎসাহ প্রদানে সেবা করতে পারে। অপরকায়িত কাজের একটি নয়া যুগের সূচনা থেকে অনেক দূরে, কাজ ও ম্যানেজমেন্টের নয়া রূপসমূহ তাদের সাথে করে নিয়ে আসে পরকীকরণের নয়া ডাইমেনশনসমূহ এবং পুরাতন রূপগুলোর উৎখাতে সামান্যই করে।

 

 

 

 

 

 

 

অধ্যায় ১১

প্রজাতি-সত্তা এবং ব্যাখ্যার বিতর্কসমূহ

 

এই অধ্যায়ে পরকীকরণের মার্কসের তত্ত্বের ব্যাখ্যাকে ঘিরে কিছু মতভেদের ওপর আমি মন্তব্য উত্থাপন করতে চাই। মার্কসের কাজের ব্যাখ্যাতে কিছু বিতর্ক (controversies) বিকশিত হয়েছে, বিশেষ করে তাঁর জীবনকালে তাঁর ধারণাবলীর পরিবর্তনের মাত্রার প্রশ্নে।

     মার্কস ৩৫ বছরের ওপর লিখেন, যে সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন অভ্যুত্থান, বিপ্লব এবং গণ শ্রমিক আন্দোলনের বৃদ্ধি। এ সময়টাতে যুগপৎ সংঘটিত হয় মহান বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশ, সাথে সাথে দর্শন ও সামাজিক তত্ত্বে পরিবর্তন সাধিত হয় (shifts in philosophy) এই প্রেক্ষাপটে এটা অদ্ভূত হবে যদি মার্কসের ধারণাবলী কোনভাবে পরিবর্তিত না হয়। যাহোক, তাঁর ধারণাবলী কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান। মোটামুটি, কিছু আছেন যারা মার্কসের কাজে কিছু ধরণের প্রয়োজনগত ঐক্যদেখেন, এবং  আর কিছু আছেন যারা বিশ্বাস করেন তাঁর কাজকে বিভিন্ন যুগে (different periods) ভাগ করতে হবে. যেখানে তিনি ডিল করেন বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যাবলী (different subjects and problems) নিয়ে।

          যারা একটি প্রয়োজনগত ঐক্য সুপারিশ করেন তাঁদের মতে, মার্কস  জীবন অতিবাহিত করেন ধারণাবলী (concepts) বিকশিত করে, যেগুলো ঘটেছিলো প্রথম দিকের হেগেলের সমালোচনায়। তাঁর কিছু পরিভাষা পরিবর্তন হলেও, দরকারী ধারণাগুলো একই থেকে যায়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, মেসজেরোস (Meszaros) যুক্তি দেন যে১৮৪৪-এ মার্কস কর্তৃক অনুধাবন কৃত পরকীকরণের ধারণা সামগ্রিকভাবে মার্কসীয় সিস্টেমের অত্যাবশ্যকরূপে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ”।১৩৬ অন্যদিকে, অন্যেরা যুক্তি দেন যে কিছু পয়েন্টে মার্কসের ঝোঁকের (emphasis) স্থানান্তর (shift) ঘটেছে। সবচেয়ে সাধারণভাবে, এতে জড়িত আছে “তরুণ মার্কস” ও “পরিণত মার্কস”-এর মধ্যকার কিছু ধরণের বিভাগ (some sort of division)তরুণ মার্কসকে দেখা হয় একজন র‌্যাডিক্যাল  হেগিলিয় (Radical Hegelian) হিসেবে, যিনি  তখনও চিন্তা করছিলেন হেগেলিয় সমস্যাবলী অর্থাৎ দার্শনিক সমস্যাবলী নিয়ে। পরিণত মার্কস অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রশ্নাবলীতে মনোযোগ স্থানান্তরিত করেন। এটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবক্তা ছিলেন
ফরাসি মার্কসবাদী লুই আলথুসার (Louis Althusser), যিনি যুক্তি দেন যে মধ্য-১৮৪০-এর দশকের পরে মার্কসের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি র‌্যাডিক্যাল স্থানান্তর (shift) ঘটেছিলো।

      পরকীকরণের বিবেচনাবলীর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। পরকীকরণের ধারণাটি (concept) সবেচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় মার্কসের প্রথম দিককার রচনাসমূহে (in Marx’s early work), এবং ১৮৪৪-এ তাঁর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপি-তে সবচেয়ে বিশদায়িত হয়। মার্কসের পরের দিকের কাজে পরকীকরণ শব্দটি ম্রিয়মাণ হওয়ার প্রবণতা দেখায়। এটি নিশ্চিতভাবে স্পষ্টতই কম উল্লেখিত হয় তাঁর অধিকতর পরিণত অর্থনৈতিক কাজে, এবং তাঁর মাস্টারপিস, পুঁজি গ্রন্থে। অনুরূপভাবে, মার্কস দার্শনিক প্রশ্নাবলীর ওপর ফোকাস দেয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে তিনি ধাবিত হন যাকে তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি (scientific approach) বলেন তার দিকে। দর্শন বর্ধিতভাবে প্রতীয়মান হয় এমন একটা কিছু হিসেবে যা বর্জন করতে হবে (something to be rejected) এটি সমালোচকদের (commentators) এই যুক্তির দিকে ধাবিত করে যে পরকীকরণ দ্বারা উত্থাপিত দার্শনিক  প্রশ্নাবলীর প্রকারভেদ পরবর্তী মার্কসের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়, এবং এটা বর্জন করা উচিত।

       কিন্তু এটা প্রমাণ থেকে দূরে (far from evident) কোন স্পষ্ট প্রমাণ নেই যে পরকীকরণের ওপর তাঁর ধারণাবলী মার্কস পরিত্যাগ করেছিলেন। অধিকন্তু, যখন পুঁজিতে পরকীকরণ চোখে পড়েনি, তখন এটি Grundrisse-তে বার বার সমুল্লেখিত। Grundrisse পুঁজির পুর্বে লেখা অর্থনৈতিক পান্ডুলিপির একটি সংকলন, যা ডিল করে একই থিমের অনেকগুলো নিয়ে। প্রত্যেক টুকরো টেক্সটের জন্য যা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে (অনু: মার্কসের শেষদিকের কাজে পরকীকরণ অনুপস্থিত) সমর্থন করে থাকতে পারে, বরং এমনকিছু আছে যা বিপরীতটাকেই সুপারিশ করে। অধিকন্তু, আমি যে ধারণাবলী উত্থাপন করেছি, যেমন মেটাবোলিজম, মধ্যস্থতা ও পণ্যকামীতা (metabolism, mediation and commodity fetishism), পরকীকরণ তত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত এই ধারণাগুলো প্রকৃতপক্ষে  পরবর্তী সময়কার মার্কসে  অধিকতর (more) দেখা যায়। পণ্যকামীতার ধারণা পুঁজির প্রারম্ভিক অধ্যায়সমূহের কেন্দ্রীয় বিষয়। এই ব্যাখ্যার অধিকাংশ নিহিত থাকে আপনি পণ্যকামীতাকে কীভাবে দেখবেন: উৎপাদ থেকে পরকীকরণের ধারণার বিকাশ হিসেবে নাকি এটার জন্য একটা প্রতিস্থাপন হিসেবে। অধ্যায় ছয়ে আমি যুক্তি দিয়েছি যে এটি একটি বিকাশ।

     কাজের প্রতি মার্কসের যে দৃষ্টিভঙ্গী তা থেকে একটি অনুরূপ বিতর্ক (similar controversy) উঠতে পারে। আমি এভাবে এটি উপস্থাপন করেছি।        মার্কস শ্রমকে দেখেন উপায় হিসেবে যাতে মানুষ দুনিয়াতে পরিপূর্ণতা অন্বেষণ করতে পারে। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে, কাজ হ’ল পরিপূরক ছাড়া যেকোনও কিছু, কিন্তু ভিন্ন অবস্থায় আমরা যেভাবে মেহনত করতে পারবো (the way we labour) তা হয়ে উঠতে পারে যথার্থই অর্থবহ (genuinely meaningful)। এই ধরণের ভিসনের ওপর, কাজ, যথার্থই পরিপূরক কাজ হিসেবে একটাকিছু যা উৎসাহিত করতে হবে এবং বৃদ্ধি করতে হবে। যাহোক, অন্যত্র, বিশেষ করে তাঁর পরবর্তী সময়ের লেখাগুলোতে মার্কস কাজ কমানোর ওপর কথা বলার প্রবণতা দেখান (tends to minimizing work)। তিনি যুক্তি দেন যে পুঁজিতন্ত্রের বিশাল উৎপাদনশীল সম্ভাবনাসমূহের অর্থ হ’ল এই যে কাজকে বিপুলভাবে কমিয়ে আনা যাবে, যাতে মানুষ অবিলম্বে বেশী সময় পায় বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের জন্য।

        মার্কসের মধ্যে স্ববিরোধ (contradiction) বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়, একদিকে মানব সত্তার জন্য কাজের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া এবং অন্যদিকে কাজের সময় একটা ন্যুনতম পর্যায়ে হ্রাস করার জন্য সমর্থন করা। কাজকে যদি পরিপূরক (fulfilling) হিসেবে তৈরী করা যায়, তবে কেন এটাকে হ্রাস করা উচিত? যাহোক, প্রয়োজনগতভাবে কোন বিরোধ (contradiction) নেই। এটা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব উভয়ত: দরকারী শ্রম হ্রাস করাতে সমর্থন দেয়া, একইসাথে দরকারী কাজের বাইরে আরও বেশী কাজে উৎসাহ যোগানো অব্যাহত রাখা। মার্কস স্পষ্টই বিশ্বাস করতেন যে দরকারী কাজের পরিমাণ হ্রাসকরণ ধাবিত হবে না জনগণ কর্তৃক সম্পাদিত শ্রমের পরিমাণে। বরং, এটি অধিকতর স্পেইচ তৈরী করবে সৃজনশীল, মুক্ত ও পরিপূরক শ্রমের জন্য। অধিকন্তু, মার্কস আরও বিশ্বাস করতেন যে সকল কাজ, এমনকি যা দরকার তাৎক্ষণিক (immediate) প্রয়োজন মেটাতে, তা হতে পারে আরও অধিক পরিপূরক, এবং রূপান্তরিত হতে পারে ভারগ্রস্ত (burden) থেকে সৃজনশীল কর্মকান্ডে। 

       কিছু মানুষ যুক্তি দেন যে মার্কস সক্রিয়ভাবে পরকীকরণের তত্ত্বকে  প্রত্যাখ্যান করেন বা না করেন,  কিন্তু তাঁর করা উচিত ছিল। এর কারণ হ’ল পরকীকরণের তত্ত্ব মনে হয়  নির্ভর করে মানব প্রকৃতির তত্ত্বের (a theory of human nature) ওপর, যেমনটি উপরে আমি বর্ণনা করেছি, ফয়েরবাখের যুক্তিসমূহ (arguments) প্রত্যাখ্যান করে মার্কস তাঁর ফোকাসকে যেকোনও ব্যক্তির মাঝে সহজাত মানব প্রকৃতি থেকে স্থানান্তর করেন সামাজিক সম্পর্কাবলীতে, বিশেষ করে উৎপাদনশীল সম্পর্কবলীর ওপর। যাহোক, কমপক্ষে আমি যে উপায়ে এটি উপস্থাপন করেছি, তাতে প্রজাতি-সত্তার ধারণা বিদ্যমান যার মাধ্যমে উৎপাদন সংগঠনের কিছু পদ্ধতি অনুমোদন দেয় অন্যদের চেয়ে অধিকতর আত্ম-উপলদ্ধির (self-realisation)। কীভাবে মনুষ্যজনের সমাজকে সংগঠিত করা উচিত “ভালো জীবনের” জন্য, এ সম্পর্কে যখন এটি প্রয়োজনগতভাবে কোনও সুনির্দিষ্ট মডেল দেয় না, তখন এটি স্পষ্টভাবে শনাক্ত করে সামাজিক জীবন সংগঠনের কিছু পদ্ধতিকে যা অপরিহার্যভাবে মন্দ (necessarily worse)।

     যাহোক, যদি মার্কস সামঞ্জস্যপূর্ণ (consistent) হতেন, কিছু মানুষ যুক্তি দেন, তিনি এমনকি এই ধারণাও প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। এর কারণ হ’ল এই যে তাঁরা দেখেন মানব প্রকৃতির  যেকোনও ধারণা, যেটি এমনকি  পরকীকরণের তত্ত্ব যেভাবে ইঙ্গিত দেয় সেভাবে বিস্তৃত হিসেবে, অকল্পনীয় হিসেবে- পরামর্শ দেয় মানব সমাজের একটি আদর্শকৃত (idealised) ভিশনের, যার বাস্তবে কোন ভিত্তি নেই (no grounding in reality)। একটি কারণে, তাঁরা যুক্তি দেন, আমরা জানতে পারি না কীভাবে মানব সত্তাগণ পৃথক (different) হতে পারে যদি তাঁরা কাজ সংগঠিত করে বিভিন্ন উপায়ে। অন্যের জন্য, এটি মানব প্রকৃতি পরিববর্তনযোগ্য (changeable) সংক্রান্ত মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির (vision) বিরুদ্ধে যেতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। পুঁজিতে মার্কস পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া (autonomous process) হিসেবে গুরুত্বারোপে উৎসাহী ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্যাসেজগুলোতে (in these passages) এটা মনে হয় যেন মানুষেরা সম্পূর্ণ পরিবর্তনযোগ্য, তবে একটি কাঠামোতে (in a structure) তাদের যে অবস্থান দ্বারা অনুমোদিত বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত তা থেকে দূরে নয়।
   

স্বয়ং (itself) মার্কসের পরকীকরণ তত্ত্বের শক্তিমত্তা (strength) হ’ল এই ধারণাবলীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি (argument)। উপরের অধ্যায়গুলোতে আমি যুক্তি দিতে চেষ্টা করেছি যে পরকীকরণ হ’ল একটি ধারণা (concept) যা প্রকৃতই সহায়তা করতে পারে মানব সত্তা কর্তৃক মুখোমুখি সমস্যাসমূহের অনেকগুলোকে বুঝতে। সামাজিক ও মানসিক অভিজ্ঞতাসমূহের একটি পরিসরকে (a range) দেখা যেতে পারে এভাবে যে তাদের শেকড়গুলো উৎপাদন সংগঠনের (organizing production) কিছু পদ্ধতিতে বিদ্যমান । পুঁজিতন্ত্র একটি ব্যবস্থা হিসেবে এই মন্দগুলো  জন্ম দেয় (breeds these ills), যেগুলোকে নিছক চরম দারিদ্র্য অথবা বস্তুগত সম্পদের প্রশ্নাবলী হিসেবে পর্যবসিত করা যায় না। পরকীকরণের তত্ত্ব  প্রদান করে উপলদ্ধির একটি পদ্ধতি কীভাবে এই বিষয়গুলো (things) সংযুক্ত (connected), এবং কীভাবে তারা পৃথক (different) হতে পারে। পরিণামে এই তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে যাবে অথবা পতিত হবে, এই সংযোগ প্রদর্শনে এর সামর্থ্য অনুসারে, এবং আমি যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলো হ’ল দেখানোর প্রচেষ্টা যে এটি এই পরীক্ষাটিতে (this test) বরং ভালভাবে উত্তীর্ণ হয়। যদি তার মানে মানব প্রকৃতির একটি তত্ত্ব যেটি, কমপক্ষে অংশত, অনুমানমূলক (speculative), তখন তার জন্য একটি ছোট্ট মূল্য দিতে হবে।

 

 

 

 

 

অধ্যায় ১২

যৌথ নিয়ন্ত্রণ

 

 

অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে যেটি দিয়ে মার্কসকে পৃথক করা যায় তাঁর পূর্বসূরীদের অনেকের মধ্য থেকে তাহলো তাঁর এই বিশ্বাস যে পরকীকরণ বিষয়ের একটি অবস্থা (a state of affairs) যা অতিক্রম করা যেতে পারে। অধিকন্তু, এটা কেবলমাত্র সমাজের একটা র‌্যাডিক্যাল পুনর্গঠনের মাধ্যমে অতিক্রম করা যেতে পারে। এর অর্থ হলো যে উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি র‌্যাডিক্যাল পুনঃনির্ধারণ। যেহেতু পরকীকরণ শেকড়কৃত থাকে সমাজগুলোতে নানা পদ্ধতিতে সংগঠিত সামাজিক উৎপাদনে, কাজেই সমাধান নিহিত ঐ উৎপাদনের পুনঃসংগঠনে।

    প্রাথমিকভাবে, এর অর্থ হ’ল যে ব্যবস্থাতে শ্রম বিক্রয় হয় পণ্য হিসেবে সেটির উচ্ছেদ। এতে দরকার সমাজের বিভাজনের উচ্ছেদ, যে বিভাজনে উদ্ভব হয় একটি শ্রেণীর যাকে এর শ্রম বিক্রয় হয় এবং আর একটি শ্রেণীর যে এটি ক্রয় করে। অধিকন্তু, এটি কেবলমাত্র অর্জন করা যেতে পারে কাজের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের একটি র‌্যাডিক্যাল সম্প্রসারণ দ্বারা। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সম্পর্কে অনেক বাগাড়ম্বর হয়, তবে কাজের জায়গাতে (in the workplace) গণতন্ত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। পরকীকরণ অতিক্রমণ করতে একটা উপায়ে উৎপাদন সংগঠিত করতে হয়, যেটিকে বিবেচনা করা যায় অকৃত্রিমভাবে (genuinely) পরিপূরক ও অর্থবহ (fulfilling and meaningful) হিসেবে, এতে অবশ্যি শ্রমিকদের জন্য সম্ভব হবে তাঁদের শ্রমের ওপর অধিকতর সরাসরি কিছু বলা।

       এটিতে দরকার হয় কাজের অবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত-তৈরী করা যেটি থাকবে যারা কাজ করে তাঁদের হাতে, তাঁদের হাতে থাকবে না যারা কাজের জায়গার মালিক, অথবা নিয়োগকৃত ম্যানেজারদের একটি ক্ষুদ্র লঘুর হাতে। এতে দরকার হয় কাজের জায়গার মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামোসমূহ তৈরী করা, যে কাঠামোগুলো এই সিদ্ধান্তাবলী তৈরী করতে সক্ষম। এতে দরকার হয় চিন্তা ও ভূমিকা সম্পর্কে চিন্তন যা মানুষকে ক্ষমতায়ন করে এটি করতে, এবং যেগুলো বাধাগ্রস্ত করে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতে।

        পুঁজিতন্ত্রের সবচেয়ে বিকৃত মিথগুলোর একটি হ’ল এই যে ব্যবস্থাপকগণ ও পুঁজিতন্ত্রীরা সবচেয়ে সেরা মানুষ যারা সবচেয়ে ভালো জানে কীভাবে কাজ সংগঠিত করা উচিত। আমাদেরকে বলা হয় যে শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর যেকোনও নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা নৈরাজ্য ও অদক্ষতার দিকে ধাবিত হয়। তাদের যা দরকার তা হ’ল একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন (visionary) বসের যিনি তাদের লাইনমত রাখতে পারবেন। পুঁজিতান্ত্রিক টার্মে, এটি সত্য। পুঁজিতন্ত্রের মধ্যে শ্রমিকবৃন্দ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি কোম্পানি অথবা শিল্প-কারখানার প্রতিযোগিতা করা কঠিন বলে মনে হয় একজন বস ছাড়া। কারণ বস তাদের লাইনে রাখতে পারেন এবং তাদের শ্রমিকদের মূল্যের প্রতিটি শেষ বিন্দু নিংড়ে নেয়ার নয়া পদ্ধতিসমূহ অনুসন্ধান করতে পারেন। এটা অংশত, কারণ শ্রমিকেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাঁদের মানবিক প্রয়োজনসমূহের ওপর ভিত্তি করে- কাজকে আরও সহনীয় করতে, মুনাফার প্রয়োজন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নির্দেশিত হওয়ার থেকে।

       কিন্তু অধিক বিস্তৃতভাবে, এটা আদৌ সত্য নয় যে পুঁজিতন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশী জানে। এটা জনগণ যারা প্রকৃতপক্ষে কাজটা করে যারা জানে এটি কীভাবে সবচেয়ে ভালভাবে করা যায়। যদি শ্রমিকেরা কাজের ওপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, তাঁরা এটিকে নানা উপায়ে সংগঠিত করতে পারে, যেগুলো তাঁদের নিজেদের ও বিস্তৃত সমাজ উভয়ের জন্য উপকারী। ইতিহাস এরকম উদাহরণ দিয়ে ঠাসা।

আলজেরিয়াতে, ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ উৎখাতের পর, শ্রমিকগণ পরিত্যক্ত ফার্ম ও ফ্যাক্টরিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করে। অলিভ ওয়েল ফ্যাক্টরি থেকে নেয়া একটি উদাহরণ এর মাত্রা দেখায়:

 

শতাধিক ফ্যাক্টরি শ্রমিক একটি কমিটি সংগঠিত করেন, আবর্জনা পরিষ্কার করেন, মেশিন মেরামত করেন, এবং সেটলার কোম্পানি থেকে স্থানান্তরিত টনকে টন কাঁচা-মাল দিয়ে উৎপাদন শুরু করেনএকদিন একটি সারা-রাতের সভায় তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রথম বার্ষিক মুনাফা সমানভাবে শেয়ার করা হবে চারটি উদ্দেশ্যের জন্য: কর, মেরামতি এবং মেশিনারি ক্রয়, স্থানীয় কৃষি কমিটিকে ঋণ, এবং অবশিষ্টাংশ বোনাস হিসেবে তাদের জন্য। তাঁরা সংহতি ঘোষনা করে তাঁদের “ফার্মগুলোর শ্রমিক ভাইদের” সাথে এবং অফ-সিজনের সময় অন্যান্য শস্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মৌসুমী বেকারদের জন্য নয়া চাকুরি প্রদান করা।১৩৭

 

 

কাজের পুনঃসংগঠনের থেকে এমনকি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হল এতে জড়িত এটির পুনর্দাবীকরণ (reclaiming)এতে জড়িত থাকে কাজকে অন্য কারও মালিকানাধীন প্রতিকূল কিছু একটা  না ভেবে বরং অর্থপূর্ণভাবে নিজের মনে করা উচিতএটা একটা-কিছু যাতে তাঁদের কিছু বলার আছে, একটা-কিছু যা তাঁরা করে নিজেদের জন্য, এবং সমাজের জন্য, বুলিং বস অথব দূরবর্তী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নয়

       তাঁর সমসাময়িক অনেকের থেকে এবং প্রকৃতপক্ষে আজকের দিনের কিছু ভাষ্যকার থেকে মার্কসের ভিন্নমত ছিল, তিনি অস্বীকার করতেন যে পেছনের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। কিছু মানুষ অনুভব করেন যে পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক আনীত পরকীকরণকে অতিক্রম করতে হলে সামন্ততন্ত্রের সাথে যু্ক্ত উৎপাদনের রূপ যেমন হস্থ-শিল্প ও ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে প্রত্যাবর্তন করা দরকার। সম্ভবত এই উপায়ে জনগণ অধিকতর সৃজনশীলভাবে তাঁদের কাজে নিয়োজিত ও পুরিপূরিত থাকতে পারে। যে পদ্ধতিতে এই চিন্তকেরা এটিকে দেখেন, কীভাবে বিশাল কাজের জায়গাগুলোতে গণ ফ্যাক্টরি-স্টাইল উৎপাদন পরকীকৃত (alienating) ছাড়া আর কীইবা হতে পারে?

         অবশ্যি মার্কস ও মার্কসবাদীগণ পরকায়িত উৎপাদনের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোর কিছু বিলোপের পক্ষে উকালতি করতেন। আপনি আশা করতে পারেন যে পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে ফক্সকনে বর্ণিত অবস্থাগুলোর ধরনসমূহ যেকোনও সমাজতান্ত্রিক সমাজে অসহনীয়। যাহোক, এর অর্থ এই নয় যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনে জড়িত বিশাল উৎপাদিকা শক্তিকে বর্জন করতে হবে। মার্কস বিশ্বাস করতেন ব্যাপক উৎপাদন (mass production) এমনভাবে পুনঃসংগঠিত করা সম্ভব যে তা প্রকৃতপক্ষে অপরকায়িত (unalienated) আদতে, পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক নিয়ে আসা কাজের জায়গাসমূহ ও প্রক্রিয়াবলীর নয়া ধরনসমূহ তৈরী করে নয়া সম্ভাবনাসমূহ অপরকায়িত শ্রমের জন্য  যার কোনও পূর্ব অস্তিত্ব ছিলনা।

       কারণ পুঁজিতন্ত্র শ্রমিকদের একত্রে কেন্দ্রীভূত করে কোন নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে, এবং এতে জড়িত থাকে সহযোগিতার অধিকতর জটিল রূপসমূহ (more complicated forms of cooperation), এটি সংহতি এবং যৌথ সংগঠনের জন্য সৃজন করে নয়া সম্ভাবনাসমূহ। কাজের পুরাতন ধরনসমূহ অধিকতর বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিতান্ত্রিক (more isolating and individualistic), কিন্তু পুঁজিতন্ত্র কাজের যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করেছে এমনটি অধিকতর স্পষ্টভাবে।

    এর অর্থ এই যে শ্রম প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার কাজে (task) গণতন্ত্র ও সংগঠনের র‌্যাডিক্যালি নয়া ও উচ্চতর রূপসমূহ দরকার, উৎপাদনের ব্যক্তিতান্ত্রিক রূপসমূহে প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে। শ্রমিকেরা শ্রম প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণভার নিতে পারে কেবলমাত্র যৌথভাবে। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন এতটাই সমন্বিত ও কেন্দ্রীকৃত হয়েছে যে এটিকে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে নিতে অপরিহার্যরূপে দরকার হয় যৌথ রূপসমূহের। আপনি শ্রমিকদের মধ্যে ফ্যাক্টরি ভাগ করে দিতে পারবেন না- যেমন আপনি নিলেন বিশাল চাকার দাঁতগুলো, আমি নিলাম ছোটগুলো, কেউ একজন পেল লিভারগুলো। আপনারা যদি ঐ উৎপাদন থেকে অব্যাহতভাবে কল্যাণ পেতে চান, এই উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আপনাদের অন্বেষণ করতে হবে গণতান্ত্রিক রূপসমূহ।

        এঙ্গেলস এটিকে সামাজীকৃত উৎপাদন”-এর পদ দিয়ে বর্ণনা করেন। পুঁজিতন্ত্র উৎপাদনকে সামাজিক করেছিলো, যখন এটি বজায় রাখে বিনিময়ের ব্যক্তিতান্ত্রিক পদ্ধতি। বস্তু-সামগ্রী (things) যেভাবে উৎপাদিত হয়, আদতে, তা যৌথ ও সমবায়িক (collective and cooperative) (যদিও কোনও যৌথ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ), কিন্তু জনগণের মধ্যে যে উপায়ে বস্তুসামগ্রী বিতরণকৃত হয় তা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিতান্ত্রিক। পুঁজিতন্ত্রের মধ্যে এই বিরোধ (contradiction) হ’ল  সংকটের উৎসগুলোর একটি। এঙ্গেলস যুক্তি দেন:

                                 

সামাধান নিহিত থাকে উৎপাদনের আধুনিক শক্তিসমূহের সামাজিক প্রকৃতির ব্যবহারিক স্বীকৃতিতে, এবং কাজেই উৎপাদন সাধিত্রের (means of production) সামাজিকায়িত বৈশিষ্ট্যের সাথে সমন্বয়কৃত হয়ে। উৎপাদিকা শক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এটি কেবলমাত্র সংঘটিত হতে পারে খোলাখুলি ও সরাসরি সমাজ দ্বারা, যে উৎপাদিকা শক্তিসমূহ সকল নিয়ন্ত্রণকে অতিক্রম করেছে, সামগ্রিকভাবে একটি সমাজ ব্যতিত।১৩৮

 

        পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক অর্গলমুক্ত উৎপাদিকা শক্তিসমূহকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র যৌথভাবে।

        ঐতিহাসিকভাবে এই দাবীগুলো মূর্ত রূপ ধারণ করেছে, এবং সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত হ’ল অক্টোবর ১৯১৭-এর বিপ্লব। জারতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র ও তাদের পুঁজিতন্ত্রী বস উভয়ের বিরুদ্ধে রুশ শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামগুলোতে, রাজনৈতিক সংগঠনের নয়া রূপসমূহ বিকশিত হয়েছিলো। এগুলো ছিল “সোভিয়েতসমূহ”, ফ্যাক্টরি কমিটিসমূহ যেগুলো সংগঠিত হয়েছিলো শ্রমিকদের স্বার্থে। ১৯১৭-তে লেনিন ও বলশেভিকগণ “সকল ক্ষমতা সোভিয়েতসমূহে” এই স্লোগান গ্রহণ করেছিলেন। এটি ছিলো তাঁদের বিপ্লবী কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে এটি আরও ধারণ করেছিলো কাজের জায়গাতে শ্রমিকদের নিকট রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনঃস্থানান্তরের একটি দাবী, পূর্বে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না এমন জায়গাগুলোতে গণতন্ত্রের র‌্যাডিক্যাল সম্প্রসারণের জন্য।

        এর প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে, রুশ বিপ্লবে জড়িত ছিলো কাজের জীবনের (working life) একটি বিস্ময়কর গণতন্ত্রায়ণ। একটি মস্কো মেটাল ওয়ার্কসে তাঁর সমীক্ষায় কেভিন মার্ফি লেখেন অবিলম্বে বিপ্লবের পরবর্তী সময়কালে কীভাবে শ্রমিকগণ লড়াই করেন কাজের জায়গায় গণতন্ত্রের ব্যবহারিক প্রশ্নের সাথে:

ফ্যাক্টরি কমিটির প্রস্তাবগুলো (resolutions) ছিলো ফ্যাক্টরি-ব্যাপী সভাগুলোর অধীনস্থ, এই সভাগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতো ৫০০ হতে ৮০০ শ্রমিক, এই সভাগুলো সিদ্ধান্ত নিতো শ্রমিকদের ও ম্যানেজারদের বরখাস্তকরণ, মৃত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে সহায়তাকরণ, ছুটির সিডিউল, ও অবদানের মত বিষয়গুলো নিয়ে।১৩৯

 

        গৃহযুদ্ধের ধ্বংস এর মূল্য (toll) নিতে শুরু করবার পূর্বে, “মস্কো মেটাল ওয়ার্কসের শ্রমিকেরা একটি ঐক্যবদ্ধ, অদম্য (irrepressible) সামাজিক শক্তির মার্কসবাদী আদর্শের সন্নিকটবর্তী হতে থাকে”,১৪০ এবং  কাজের জায়গার গণতন্ত্র (workplace democracy) দোকান পর্যায় (shop level) পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়, যেহেতু বার বার শ্রমিকেরা  তাঁদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করার অধিকার এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানায়”।১৪১

       দুঃখজনকভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তী ইতিহাস আরও প্রদান করে পরকীকরণের বিশ্লেষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, যদিও একট ভিন্ন পদ্ধতিতে (albeit in a different way)। যেহেতু গৃহযুদ্ধ এর মূল্য নেয়, প্রাণহানী ও শিল্প ধ্বংস এই উভয় দিক হতে, বিপ্লবী প্রক্রিয়া স্থবির হতে শুরু করেছিলো। এটি রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রকে অনুমোদন দেয় বর্ধিতভাবে সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবী করতে, একটি নয়া আধিপত্যকারী শ্রেণীর গঠনে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ যর্থার্থ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের স্থান দখল করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, এবং পুঁজিতন্ত্রের গঠনসমূহ (structures) পুনঃ তৈরী করা হয়, যদিও রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে।

      কিছু মানুষজন যুক্তি দেন যে ব্যাপারটা হচ্ছে ব্যক্তি পুঁজিতন্ত্রীগণ কর্তৃক মালিকানার পরিবর্তে বরং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শিল্পের অর্থ হ’ল এই যে সোভিয়েত ইউনিয়নে পরকীকরণ একটা ইস্যু ছিল না। এইভাবে পরকীকরণের নানা রূপ সম্পর্কে আমি ওপরে যেভাবে বর্ণনা করেছি তার ওপর ভিত্তি না করে, বরং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা “জনগণ”-এর হাতে ছিল। যাহোক, এটার ভিত্তি ছিল যৌথ নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একটি (সাধারণত সুচিন্তিত) বিভ্রান্তি (confusion)। জনগণের সংখ্যাধিক্যের ওপর  একটি বডি হিসেবে যতক্ষণ রাষ্ট্র স্বয়ং অধিষ্ঠিত থাকে, যার ওপর তাঁদের সামান্য নিয়ন্ত্রণ থাকে, পরকীকরণ ততক্ষণ বজায় থাকে। তাঁদের কর্ম দিবস কীভাবে সংগঠিত হবে, সে ব্যাপারে জনগণের কোনও কথা

ছিল না।

        সোভিয়েত ইউনিয়নে পরকীকরণের অস্তিত্ব (the persistence of alienation) অনেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা স্তালিনবাদের একটি সমালোচনা বিকশিত করতে প্রচেষ্টা নেন। ১৯৫৬ সনে হাঙ্গেরীতে এবং ১৯৬৮ সনে চেকোস্লাভাকিয়াতে সোভিয়েত ট্যাংকবহর দিয়ে অভ্যুত্থানগুলো দমনে পশ্চিমের অনেকের এই রেজিমগুলোর সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটে। তাঁরা মার্কসবাদের একটি স্বাধীন ধারা পুনরূজ্জীবিত করতে শুরু করেন, যা ব্যাপকভাবে প্রায়ই মার্কসের প্রথম সময়ের লেখাগুলোতে বিদ্যমান পরকীকরণের ধারণা (notion)-এর নিকটবর্তী, যা নিজেকে “প্রকৃত অস্তিত্বমান সমাজতন্ত্র” হিসেবে বর্ণনা করে তার প্রতি এই ধারণাবলী একটি স্পষ্ট ভৎর্সনার প্রতিনিধিত্ব করে। এর অর্থ আরও এই যে আমি অধ্যায় ১০-এ ব্যাখ্যা (interpretation) সম্পর্কে যে বিতর্ক বর্ণনা করেছি যা প্রায়ই রাজনৈতিকভাবে অভিযুক্ত বৈশিষ্ট্য (politically charged character) ধারণ করে। এটি কিছু মানুষের উপযোগী হয়  যাতে তাঁরা এই মর্মে যুক্তি দিতে সমর্থ হয় যে পরকীকরণের ধারণা ছিল একটি তারুণ্যদীপ্ত (youthful) ভাববাদের অংশ যা মার্কস পরিত্যাগ করেন।

        স্তালিনবাদী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের দাবী এবং এইরকমভাবে পুঁজিতন্ত্রের রক্ষকদের দাবী সত্ত্বেও, মার্কস ও এঙ্গেলস কখনও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সাথে যৌথ নিয়ন্ত্রণকে গুলিয়ে ফেলেননি। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে আমি বর্ণনা করেছি কীভবে মার্কস রাষ্ট্রকে দেখতেন পরকীকরণের একটি রূপ হিসেবে। এঙ্গেলসের নিচের এই অনুচ্ছেদটি ইস্যুটির সারসংক্ষেপ করে:

 

আধুনিক রাষ্ট্র, এটার রূপ কি তা কোনও ব্যাপার নয়, মূলত একটি পুঁজিতান্ত্রিক যন্ত্র (capitalist machine)- পুঁজিতন্ত্রীদের রাষ্ট্র, সমগ্র জাতীয় পুঁজির ভাবগত ব্যক্তিকরণ (ideal personification)। উৎপাদিকা শক্তিসমূহের অধিগ্রহণের দিকে এটি যত অগ্রসর হয়, ততই এটি প্রকৃতপক্ষে  জাতীয় পুঁজিপতি হয়, ততই এটা অধিকতর নাগরিকদের শোষণ করে। শ্রমিকেরা  মজুরি-শ্রমিক অর্থাৎ প্রোলেতারিয়ানই থেকে যায়। এটার সাথে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না।১৪২

 

এঙ্গেলস যুক্তি দেন যে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের ইস্যুটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ “মাথায় আনতে পারে” (bring to a head), এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি নয়া প্রশ্নাবলী হাজির করে। যাহোক, এটি নিজ থেকে পুঁজিতন্ত্রের অপরিহার্য সম্পর্কাবলী দূর করে না।    

    কারণ, মার্কসের মতে, স্বয়ং রাষ্ট্র নিজেই পরকীকরণের একটি রূপ, এটি পরকীকরণ অতিক্রমের জন্য একটি চালিকা শক্তি হতে পারে না। বরং, পরকীকরণকে অতিক্রম করতে হবে “নিচ থেকে”। এটি প্রতিফলিত করে মার্কস কর্তৃক শিক্ষার মাধ্যমে পরকীকরণ অতিক্রমণ সংক্রান্ত ফয়েরবাখের দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যাখ্যান। এই বিভাজন প্রত্যাখ্যান করে মার্কস যেকোনও মডেল প্রত্যাখ্যান করেন যা সামাজিক রূপান্তরকে দেখে সংখ্যাগুরুর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু ক্রিয়ার ফল হিসেবে, নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ তাহ’ল সংখ্যাগুরুর সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়া

        এটি নির্দেশ করে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে বরং পরকীকরণ অতিক্রমণের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব। রাজনৈতিক রূপান্তর ছাড়া, বিপ্লব ছাড়া উৎপাদনের পুনর্গঠন সংঘটিত হয় না। এটি চুড়ান্ত অধ্যায়ের বিষয়।

 

 

 

অধ্যায় ১৩

বিপ্লব

 

 

সমাজ গঠনের একটি পৃথক উপায় সম্পর্কে মার্কসের পরকীকরণের বিশ্লেষণ কিছু ইঙ্গিত প্রদান করে, তবে তিনি চমৎকারভাবে একটি ভবিষ্যতের দুনিয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিচিত্র (blueprint) প্রদান করা পরিহার করেন। মার্কসকে প্রায়ই সমালোচনা করা হয় একটি মূর্ত ভিশন প্রদান করার এই ব্যর্থতার জন্য, কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর কারণ হ’ল তিনি বিশ্বাস করতেন যে  ভবিষ্যতের সমাজ যে উপায়ে গঠিত হবে তা কেবলমাত্র সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে তাদের দ্বারা যারা নয়া সমাজ গঠন করবেন। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি (emancipation) হতে হবে স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব কাজ, এবং  “ভবিষ্যতের রান্নার দোকানগুলোর উপাদানসমূহ লেখা”, তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়।১৪৩

        মার্কস বিশ্বাস করতেন যে সমাজ অভ্যন্তরে আমাদের বিদ্যমান পরকায়িত অবস্থান থেকে আমাদের জন্য কষ্টকর কোনও বিকল্পের গড়ন কল্পনা করা। পুঁজিতন্ত্র যেভাবে আমাদের পরকায়িত করে একে অপর থেকে এবং আমাদের নিজেদের থেকে, তাতে শাসক শ্রেণীর জন্য অধিকতর সুবিধা হয় জনগণকে বিভক্ত করার ধারণাবলী ছড়িয়ে দিতে।

দিতে।লোভ ভাল”, জনগণের শুধু তাঁদের আত্ম-স্বার্থ অনুসরণ করা উচিত, এই ধারণা পরকায়িত সমাজে উর্বর ভিত্তির সন্ধান পায়। দ্বিতীয়ত, সমাজের সামাজিক সম্পর্কাবলী সীমিত করে আমরা সম্ভাব্য ভবিষ্যত কতটুকু কল্পনা করি। মার্কস যুক্তি দেন যে মানুষের মস্তিষ্কে তৈরীকৃত ভূতগুলো (phantoms) আবশ্যিকভাবে তাঁদের বস্তুগত জীবন-প্রক্রিয়ার আদর্শ-রূপ (sublimate)”১৪৪ এখানে,পুঁজিতন্ত্রের মধ্যে আমাদের কল্পনাকৃত বিষয়সমূহের প্রকরণ সীমিত, প্রায়ই এমনভাবে যে আমরা বুঝতে পারি না।

        প্রভাবের এই ধরনসমূহ, যেগুলোকে প্রায়ই আদর্শিক হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেগুলো সাহিত্যে দেখা যায়। কল্প বিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি উপন্যাসগুলো প্রযুক্তি, চমৎকার ম্যাজিক ও প্রাণীর (creatures) নয়া রূপগুলো সম্পূর্ণরূপে কল্পনা করতে সক্ষম, কিন্তু নয়া সামাজিক সম্পর্কাবলীর কল্পনায় প্রায়ই উল্লেখযোগ্যরূপে সেগুলো বাজে। লর্ড অফ দ্যা রিঙ্গস-এর মত ফ্যান্টাসি উপন্যাসগুলোর শেষ হয় এমনসব সমাজের বর্ণনায় যেখানকার সামাজিক কাঠামোতে বসত করে elves, dwarves and hobbitsএই কাঠামোগুলো অনেকটাই সামন্তান্ত্রিক ইউরোপের অনুরূপ।

        আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতি অতিক্রম করতে পারি? প্রভাবশালী পুঁজিতন্ত্র বিরোধী চিন্তক জন হলওয়ে একটি সুপারিশ প্রদান করেন, তিনি শ্রমের বিপরীতে করণ” (doing against labour) এর একটি বিদ্রোহের প্রয়োজনের জন্য লেখেন, যাতে তিনি বলেন আমরাপুঁজিতন্ত্র তৈরী করা বন্ধ করিতিনি যুক্তি দেন যে দৈনন্দিন জীবনে অপরকায়িত শ্রমের উদাহরণগুলোর প্রতি আমাদের নজর দেয়া উচিত। হলওয়ের যুক্তির একটি বৈশ্যিষ্টসূচক উদাহরণ হল নিম্নোক্ত প্যাসেজ:

 

        আমি একজন শিক্ষক এবং আমি শ্রম শক্তি উৎপাদন করি বাজারে বিক্রয়ের জন্য, কিন্তু একই সময়ে আমি আমার শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করি সমাজ সম্পর্কে ক্রিটিক্যালি চিন্তা করতে। আমি ব্যক্তিগত মালিকানার হাসপাতালে একজন নার্স এবং আমার নিয়োগদাতার জন্য মুনাফা উৎপাদন করি, কিন্তু একই সময়ে আমি আমার রোগীদের সহায়তা করতে চেষ্টা করি তাঁদের জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর মুহুর্তগুলোর কিছুতে। আমি একটি কার ফ্যাক্টরিতে এসেমব্লি লাইনে কাজ করি এবং প্রত্যেকবার মুক্ত কিছু সেকেন্ডে আমার আঙ্গুলগুলো ব্যস্ত থাকে গিটারের তারগুলোতে অনুশীলনে যা আজ রাতে আমার গিটারে পরিবেশন করবো ব্যান্ডে . . । এই সকল ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক শ্রমের বাইরে একটা অবস্থান (standing), বিমূর্ত শ্রমের মধ্যে আমার ফাঁদের (entrapment) বিরুদ্ধে ও বাইরে একটি অভিক্ষেপ বজায় থাকে।১৪৫

যাহোক, হলওয়ের বর্ণনার সমস্যা হ’ল এই যে এই অভিজ্ঞতাগুলো পরকীকরণের এক রূপ বা অন্য রূপ থেকে মুক্ত নয়। পরকীকরণ এমনকি আমাদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কাবলীতেও প্রভাব ফেলে, এটা হ’ল মার্কসের তত্ত্বের দাবীগুলোর একটা অংশ। উদাহরণ হিসেবে, এটা অসম্ভব মনে হয় যে তাঁর অন্য ব্যান্ড মেম্বারদের সাথে কার শ্রমিকের সম্পর্ক বৈশিষ্ট্যকৃত হবে না পরকীকরেণের কিছু মাত্রা দ্বারা।

মার্কসের যুক্তির (argument) ওপর ভিত্তি করে হলওয়ের বিশ্লেষণ গঠিত, তাহ’ল এই যে শ্রমকে উপলদ্ধি করা যেতে পারে মূর্ত ও বিমূর্ত এই উভয় প্রকারের শ্রম রূপে। হলওয়ে মূর্ত শ্রমকে অপরকায়িত শ্রমের সাথে এবং বিমূর্ত শ্রমকে পরকায়িত শ্রমের সাথে অভিন্ন রূপে গণ্য করেন, তাই তিনি যুক্তি দেন যে সকল মানব শ্রমের একট অপরকায়িত প্রেক্ষাপট আছে (হলওয়ের জন্য “মূর্ত শ্রম” হ’ল সহজভাবে অপরকায়িত সৃজনশীল কর্মকান্ডের জন্য পরিণত মার্কসের দেয়া নাম)।

এটি একটি ভুল-উপলদ্ধি- মূর্ত শ্রম অপরকায়িত শ্রমের মত একই বিষয় নয়। মার্কসের মতে, পুঁজিতন্ত্রের অধীনে শ্রম পণ্য উৎপাদন করে, যাতে ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য এই উভয়ই বিদ্যমান; মূ্র্ত শ্রমকে উপলব্ধি করা হয় সেই শ্রম হিসেবে যে ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করে, বিমূর্ত শ্রমকে উপলদ্ধি করা হয় বিনিময়-মূল্য উৎপাদক হিসেবে। পুঁজিতন্ত্রের দরকার উভয় প্রকার শ্রমের। বিমূর্ত শ্রম পুঁজিবাদের কোনও দরকারে আসবে না, যদি এটাকে ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনকারী শ্রম থেকে পৃথক করা না হয় (not abstracted)। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে বোমা ও বোটোক্সের ব্যবহার-মূল্য আছে, এগুলো তৈরী হবে না, যদি উৎপাদিত হতে না দেয়া হয়, তবে তাদের উৎপাদন ও ব্যবহার  অপরকায়িত সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হবে না। মূর্ত শ্রম সবসময়  বিমূর্ত শ্রমের সাথে থাকতে পারে, কিন্তু অপরকায়িত শ্রম অনুরূপভাবে পরকায়িত শ্রমের সাথে থাকতে পারে না।

এই সমস্যার প্রতি মার্কসের সমাধান নিহিত বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তায়। মার্কসের জন্য বিপ্লবের দরকার ছিল দু’টি কারণে: 

বিপুল মাত্রায় কমিউনিস্ট চেতনার উৎপাদন, এবং স্বয়ং এই কারণের সফলতা- এই উভয়ের জন্য, বিপুল মাত্রায় মানুষের পরিবর্তন দরকার, একটি পরিবর্তন যা কেবলমাত্র সংঘটিত হতে পারে একটি ব্যবহারিক আন্দোলনে, একটি বিপ্লবে; সুতরাং বিপ্লব দরকার, কেবলমাত্র এই কারণে নয় যে শাসক শ্রেণীকে অন্য কোনও উপায়ে উৎখাত করা যায় না, বরং এই কারণেও যে বিপ্লবে একটি শ্রেণীকে উৎখাত করেই যুগের সকল আবর্জনা থেকে স্বয়ং এটি নিজে মুক্ত হতে সফল হয় এবং নতুন করে সমাজ অন্বেষণের উপযোগী হয়ে ওঠে।১৪৬

 

বিপ্লবের রূপান্তরকারী দিকের ওপর এখানে গুরুত্বারোপ করা হয়। সক্রিয়ভাবে সমাজকে রূপান্তর করার মাধ্যমে জনগণ তাঁদের নিজেদের এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও রূপান্তরিত করে। মার্কসের জন্য বিপ্লব হ’ল পরকীকরণ অতিক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যৌথভাবে সমাজকে রূপান্তর করার পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জনগণ যে সম্ভাবনাগুলো দেখতে শুরু করে, পরকীকরণ সেই সম্ভাবনাগুলোকে অগ্রাহ্য করেছিল। এটা তাঁদের জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সংগ্রামের মাধ্যমে মানব শ্রম সংগঠিত করার ভিন্ন উপায় তৈরী করে। এটি প্রতিফলিত করে সাধারণ জনগণের তাঁদের জীবনকে রূপান্তর করার ক্ষমতায় একটি মহান আস্থা (a great confidence), তবে এটি নিছক বিশ্বাসের একটি ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম যে নয়া সম্ভাবনাসমূহের দুয়ার খুলে দেয় তার মাত্রা মার্কস সময় সময় দেখেছিলেন। অধ্যায় তিনে উল্লেখিত সিলেসিয়ান তাঁতীগণ ছিল প্রথম দিককার উদাহরণ, কিন্তু এমনকি মার্কসের নিকট আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৮৭১-এর প্যারিস কমিউন।

১৮৭১-এ, ফ্রাংকো-প্রুসিয় যুদ্ধে পরাজয়ের পরিণামে, প্যারিসের মেহনতি জনগণ বিদ্রোহে জেগে ওঠে। তাঁরা একটি স্বাধীন কমিউন ঘোষণা করে, এবং সম্পূর্ণভাবে সমাজ পুনর্গঠন শুরু করে। মার্কসের জন্য কমিউনের তাৎপর্য ছিলো এই যে এটা ছিলো “অবশেষে আবিষ্কৃত রাজনৈতিক রূপ যেটির অধীনে শ্রমের অর্থনৈতিক মুক্তি কার্যকর করা যায়”।১৪৭ কমিউনের অধীনে, “মুক্ত শ্রমসহ, প্রত্যেক মানুষ একটি শ্রমজীবি মানুষ হয়ে ওঠে, এবং উৎপাদনশীল শ্রম একটি শ্রেণী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়”।১৪৮ মার্কসের জন্য, কমিউন তাঁর উভয় দাবীর নিশ্চয়তা দেয়  বিপ্লবের গুরুত্বের জন্য। প্রথমত, এটি এর রূপান্তর সম্ভাবনা দেখায়:

 

শ্রমিক শ্রেণী কমিউন থেকে অলৌকিক ঘটনা প্রত্যাশা করে না। প্রবর্তনের জন্য তাঁদের তৈরী ইউটোপিয়া (ready-made utopias) নেই। তাঁরা জানেন যে তাঁদের মুক্তির জন্য কাজ করতে, এবং এটি সহ ঐ উচ্চতর রূপ যার দিকে বর্তমান সমাজ অদম্যভাবে ধাবিত হচ্ছে এর নিজের অর্থনৈতিক এজেন্সিগুলো দ্বারা, এ জন্য তাঁদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, এক সারি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, পরিস্থিতি ও মানুষকে রূপান্তর করে।১৪৯

 

দ্বিতীয়ত, কমিউন দেখায় যে শাসকশ্রেণীগুলো সংগ্রাম ছাড়া জায়গা ছেড়ে দেবে না। দুঃখজনকভাবে, ফরাসি রাষ্ট্র কমিউনকে ধ্বংস করতে ফিরে আসে, এবং সবচেয়ে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে এর মধ্যে যারা ছিলেন তাঁদের সকলের প্রত্যাশাগুলোকে ঢাক্কা দেয়।

ইতিহাস এই ধরনের ‍দৃষ্টান্ত দিয়ে ঠাঁসা যাতে বিপ্লবী কর্মকান্ডের এই ধরনে জড়িত থাকে যৌথভাবে পরকীকরণকে চ্যালেঞ্জ করা ও অতিক্রম করা। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন সলিডারিটির নেতৃত্বে ধর্মঘট ও কাজের জায়গা দখলের ঢেউ পোল্যান্ডে নিবর্তনমূলক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করে। এ ধরনের একটি ধর্মঘটের ঢেউয়ের সময়ে, কমিউনিস্ট পার্টির একটি পত্রিকা হাসপাতালের চিকিৎসকের নিকট থেকে একটি রিপোর্ট ছাপে। তাঁর শ্রমিক শ্রেণীর সকল রোগী তাঁদের নিজেদের হাতপাতাল থেকে প্রত্যাহার করে নেয় যাতে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করতে পারে। যৌথভাবে তাঁদের পরকীকরণকে চ্যালেঞ্জ করা সংগঠিত করতে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে অধিকতর ভালো বোধ করতো।১৫০

বিপ্লব যেভাবে জনগণের দিগন্তকে রূপান্তরিত করে, তা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাতে সংঘটিত সাম্প্রতিককালের অভ্যুত্থানে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। যা শুরু হয়েছিলো দমনমূলক রেজিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে তাই রূপান্তরিত হয় সমাজের ব্যাপকতর রূপান্তরে, বিশেষ করে মিশরে। সামেহ নাগেব (Sameh Nguib) বর্ণনা করেন কীভাবে তাহরির স্কোয়ারে পুরাতন কুসংস্কার ও বিভাজন (old prejudices and divisions) ক্ষীণ হতে শুরু করে:

 

তাহরির স্কোয়ারের স্পেইচ সাদামাটাভাবে শারীরকভাবে দখলীকৃত ছিল না, বরং আধ্যাত্মিকভাবে ছিল। নারীর প্রতি হয়রানি অন্তর্হিত হয়েছিলো, কপ্টস ও মুসলিমদের মধ্যকার টানাপোড়েন (tensions) বিলু্প্ত হয়েছিলো। জনগণ খাদ্য, পানি, সিগারেট শেয়ার করেছিলো। গান, সঙ্গীত, কবিতা ও ভক্তিগীতিতে বাতাস পূর্ণ হয়েছিলো। একটি নয়া মিশর তৈরী হচ্ছিলো।১৫১

 

একটি গণ বিক্ষোভের ওপর এটি নিছক অস্থায়ী উচ্ছাস (elation) ছিল না, বরং একটা প্রক্রিয়ার শুরু, যেমনটি মার্কস বলেন, যেটি পরিস্থিতি ও মানুষকে (circumstances and men) রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রের দাবী ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক রূপান্তরের দাবীর সাথে একীভূত হয়, এবং পালাক্রমে এই অর্থনৈতিক দাবীগুলো উপস্থাপন করে সমাজ কীভাবে সংগঠিত হবে সেই নয়া রাজনৈতিক প্রশ্ন। নাগেব বলেন:

শ্রমিকদের জন্য স্বাধীনতার (freedom) অর্থ কেবলমাত্র ভোটের স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা (freedom to expression) নয়, এটার অর্থ আরও এই যে ক্ষুধা, নিরাপত্তাহীনতা এবং বেকারত্বের লাগাতার হুমকি থেকে মুক্তি . . . মর্যদা হ’ল একটা অর্থহীন ধারণা যদি না এটার অর্থ হয় দারিদ্র্য ও প্রয়োজনের অবসান।১৫২

 

মিশরে সংঘটিত বিপ্লবের ন্যায় বিপ্লবগুলো পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর সাথে নিয়ে আসা পরকীকরণ- এই উভয়ের অবসানের সম্ভাবনার জন্য আত্যন্তিক প্রত্যাশা দেয়। মিশরে সংঘটিত বিপ্লব হতে পারে হিমশৈলের চূড়া, যেখানে জনগণের নিজেদের ও তাঁদের চারপাশের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে পারেন যাতে আরও অধিকতর র‌্যাডিক্যাল রূপান্তর সংঘটিত হয়। অথবা এটি নাও সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু এটি একটি বাতিঘরকে আলোকিত করে, যেটি অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য সম্ভাবনাগুলোকে নির্দেশ করে। এই সম্ভাবনাগুলো হ’ল: তাঁদের জীবনের, তাঁদের কাজের এবং তাঁদের ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়া, এবং এগুলো করে একটা অধিকতর ভালো (better) দুনিয়া তৈরী করা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

     

 

 

 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

 

 

 

         

 

         

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

         

         

         

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি