বিচ্ছিন্নতা

বিচ্ছিন্নতা
মূল: ইজটভান মেসজারেস             অনুবাদ: স ম আজাদ



দর্শন, রাজনীতি, মনোবিদ্যা ও সমাজবিদ্যা সংক্রান্ত লেখালেখিতে এবং সৃজনশীল সাহিত্যে সবচেয়ে বেশী নিয়মিতভাবে দেখতে পাওয়া ধারণা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। এমনকি প্রায় দৈনিক ভিত্তিতে জনপ্রিয় মিডিয়াতে এর উপস্থিতি ভাস্বর। এটি বিস্মায়ক নয়। ব্যবহারিক বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে কোন না কোন ধরণের বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা বিদ্যমান।

  বোধগম্যভাবেই, এই অভিজ্ঞতার ঋণাত্মক দ্যোতনা বিদ্যমান, যা প্রায়ই এর নিন্দিত প্রভাব দূর করতে কিছু করতে নির্দেশ করে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বৃথা বলে প্রতীয়মান। এটি কেন? 'বিচ্ছিন্নতা'-এর দৃশ্যতঃ সার্বিক পরিক্রিয়া যা ইতিহাসের সুদীর্ঘকালে সমগ্র মানবজাতির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, সেটি কি? অতীতে এটি কীভাবে কাজ করতো?

সহজভাবে পদটির মৌলিক ধারণায় মানবজাতির বিচ্ছিন্নতার অর্থ নিয়ন্ত্রণ হানি: বিজাতীয় শক্তিতে এর  মূর্ত প্রকাশ যা ব্যক্তি মানুষের সম্মুখীন হয় বৈরী ও সম্ভাব্যরূপে ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা হসেবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে খারিজ করে এবং তাদেরকে অধীনস্ত করে এর নিজের দৃঢ় সংকল্পে।

 তাঁর ১৮৪৪-এর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপিতে মার্কস বিচ্ছিন্নতাকে বিশ্লেষণ করেন। তিনি এর চারটি প্রধান দিক নির্দেশ করেন: (১) প্রকৃতি থেকে মানবজাতির বিচ্ছিন্নতা; (২) তাদের নিজেদের উৎপাদনশীল কর্মকান্ড থেকে মানবজাতির বিচ্ছিন্নতা; (৩) মানবজাতির সদস্য হিসেবে তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী থেকে মানবজাতির বিচ্ছিন্নতা; এবং (৪) তাদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্নতা। তিনি জোরেশোরে গুরুত্বারোপ করেন যে এই সবগুলো আদৌ "প্রকৃতির কিছু বিপর্যের" ফল নয়, যেহেতু বাস্তবতঃ তাদেরকে তাদের জায়গায় রাখার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো দ্বন্দ্বসমূহকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিতভাবে অযথার্থরূপে উপস্থাপন করেন। এটি বরং সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিকাশের সীমাবদ্ধ ধরণের রহস্যময় ফলাফল থেকে দূরে। এটিকে ধণাত্মকরূপে পরিবর্তন করা যেতে পারে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে সচেতন হস্তক্ষেপ দিয়ে।

এটি সবথেকে ব্যবহারিক গুরুত্বের সমস্যা। এটিকে এর যথাযথ প্রেক্ষাপটে স্থাপন  করতে হলে অবশ্যি জোর দিতে হবে যে আজকের দিনে মানবজাতি কর্তৃক আরোপিত বিচ্ছিন্নতার কল্পনাযোগ্য সবচেয়ে চরম ধরণ সামরিক প্রেক্ষাপট এবং  প্রকৃতির ধ্বংস - এই উভয়রূপেই মানবজাতির খোদ অস্তিত্বই হুমকিগ্রস্ত -  এদের থেকে কোনক্রমেই ঊণ নয়। কল্পনাযোগ্যভাবেই এটি মানবজাতি কর্তৃক তাদের নিজেদের ওপর আরোপিত বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে চরম রূপ।

পর্যন্ত গভীর বিকাশনমূহ মানব সভ্যতার সম্ভাব্য ইতির পূর্বাভাস দেয়, দৃশ্যতঃ অপ্রতিদ্বন্দীরূপে তার উম্মোচন ঘটছে, যেন রহস্যময় ও অজেয় গোষ্ঠী (agency) তাদের পেছনে অবস্থান করে ধ্বংসে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখছে। বিচ্ছিন্নতার ক্ষমতার অধিকতর লাক্ষ্যণিক প্রদর্শন বিদ্যমান আছে কি, যার অধিকতর ধণাত্মক মনোভাবসম্পন্ন মানবগোষ্ঠীর প্রয়াসসমূহকে দমন করার সামর্থ্য আছে।

মৌলিক বস্তুগত উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে শিল্পকলার সৃজন পর্যন্ত, মানবিক কর্মকান্ডের সকল ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্নতা প্রভাব ফেলে। বিচ্ছিন্নতার ওপর গুরুত্বারোপনে মার্কস কোনভাবেই প্রথম চিন্তক ছিলেন না। এর গভীরে প্রোথিত সামাজিক নির্ণায়কসমূহ চিহ্নিত করে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে র‍্যাডিকালি ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন এবং এভাবে এটিকে পরাজিত করার সম্ভাব্য উপায় তিনি বাতলে দেন।

মার্কসের পূর্বসূরীদের মধ্যে হেগেলই বিচ্ছিন্নতার ধারণার ওপর সবথেকে গুরুত্বারোপ করেন। যেহেতু তাঁর দূরদৃষ্টিতে কর্তৃত্বময় ভাববাদী অনুমানমূলক সংশ্লেষণ ‍বহির্মূখীনতা (externalization) ও বিষয়মূখীনতা (objectification) যুগপৎ প্রয়োজনীয়ভাবে বিচ্ছিন্নতাও গঠন করে। ফলে হেগেল বিচ্ছিন্নতাকে পরাভূত করতে কাল্পনিক ধারণাকৃত চিত্রায়নই করতে পারেন। এতে তিনি বহির্মূখীনতা-বিচ্ছিন্নতার সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক প্রকাশ- যেমন সামাজিক শ্রেণীনসমূহের মধ্যে গভীর অসমতা রেখে যান, হেগেল যেমনটি উপলদ্ধি করেছিলেন- সুনির্দিষ্টভাবে তারা যেন যথার্থতায়, তাদের অনুমানকৃত পরাভূতকরণ আপোষরফা সত্ত্বেও।
 
(illustrative)  উদাহরণ হল নিঃস্বের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা। তিনি হেগেল কর্তৃক বর্ণনাকৃত হন এমন একজনরূপে যিনি তার সত্যিকার দুঃখময় অস্তিত্বকে পেছনে ফেলে আসেন যখন তিনি ক্যাথিড্রালে প্রবেশ করেন। এইভাবে, কাল্পনিকভাবে “নিজেকে তাঁর বিচ্ছিন্ন সামাজিক অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে” তিনি “প্রিন্সের সমান” হন। এটি বজায় থাকে তাঁর ক্যাথেড্রাল ত্যাগ করে জীর্ণ কুটিরে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত, যেখানে তাঁর সত্যিকার অস্তিত্বের ধরণ অপেক্ষা করে।

শ্রমের বিচ্ছিন্নতাকে মার্কস সকল ধরণের বিচ্ছিন্নতার মূল হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটিকে সামাজিক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিকার করা উচিত এবং করা যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য করেন জীবনের বহির্মূখিনতা বা প্রকাশ এবং জীবনের কার্যক্রমের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে। মানব সত্তা কর্তৃক সৃষ্ট বস্তু (object) হল মানবিক উৎপাদনশীল কর্মকান্ডের বিষয়মূখীতা ও  বহির্মূখীনতা, এটি ব্যক্তির জীবনের প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত। অন্যদিকে মানব শ্রম কর্তৃক উৎপাদিত বস্তুসমূহের পুঁজিতান্ত্রিক দখলচ্যুতকরণ (expropriation) ও পণ্যায়ন (commodification) এবং ঐ প্রক্রিয়াতে শ্রমিকের সক্রিয় সম্পৃক্তকরণ হল জীবন-কর্মকান্ডের পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের গতিপথে সার্বজনীন বিক্রয়যোগ্যতা (Saleability) বিদ্যমান থাকতে হয়। এমনকি শিল্প ও সাহিত্যের সুন্দরতম সৃষ্টিসমূহসহ মানব শ্রমে উৎপাদিত সকল বস্তুকেই বিক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত হতে হয়।  একই সময়ে জীবন্ত শ্রমের নিজেকেও বস্তু হতে হয় একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে- ঠিক যেমন শ্রম বাজারে যে কাউকেই বিক্রয়কৃত হতে হয়, সেভাবে সকল মানবিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। সেই অনুসারে “পণ্য-পুঁজা” অপরিবর্তনীয় “স্বাভাবিক ব্যবস্থার” ধারণা তৈরী করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এর আধিপত্য ঘোষণা করতে পারে।

এই ব্যবহারিক বিদ্রোহ ও মানবিক সম্পর্কগুলোর “পণ্যায়নের” মাধ্যমেও সামাজিক জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকদর্শী ধারণাবলী পরাভূত করা যেতে পারে একই মানসিক শক্তিতে। এই প্রক্রিয়াটি সামাজিক উৎপাদনের চরম (absolute) ও আপেক্ষিক (relative) অবস্থাসমূহের বিপরীতায়নের রূপ পরিগ্রহ করে। মানুষজনের মধ্যকার মধ্যস্থতাকারী উৎপাদনশীল কর্মকান্ড হ’ল সাধারণভাবে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট অংশ, এটি মানবজাতির অস্তিত্বের চরম অবস্থা, এটি আরও বেশী লঙ্ঘিত এবং বিপদগ্রস্থ হচ্ছে প্রকৃতির ওপর পুঁজির অবিরাম বিচ্ছিন্নতাকারী হস্তক্ষেপে।

একই সময়ে ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট ( এবং অবশ্যি ঐতিহাসিকভাবে অতিক্রমযোগ্য) পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বিতীয় ক্রমের মধ্যস্থতা করার সহযোগী স্তম্ভগুলো হ’ল: পুঁজিতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বাজার-নিয়ন্ত্রিত বিনিময়, কাঠামোগতভাবে আরোপিত শ্রমের অগ্রাধিকার ক্রমের সামাজিক বিভাগ (উদ্দেশ্যমূলকভাবে শাসক ভাবাদর্শ কর্তৃক শ্রমের কারিগরি/প্রযুক্তিগত বিভাগের সাথে গুলিয়ে ফেলা), এবং আধুনিক রাষ্ট্র- এগুলো নিরুঙ্কুশকৃত ও “চিরন্তনকৃত” করা হয় প্রকৃত সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিকাশের জন্য বিপদজনক পরিণতিসহ।

ব্যবহারিক বিচ্ছিন্নতার এই প্রক্রিয়া পুঁজি সম্প্রসারণ করে সামাজিক পুনরুৎপাদনের সার্বিক-গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি হিসেবে, যাতে সবকিছুই অধীনস্থ করে ফেলা হয়, ফলাফল যতই ধ্বংসাত্মক হোক না কেন তাতে কিছুই আসে যায় না। এভাবে মানব প্রয়োজনকে দুর্বল করে ফেলা হয়, পুঁজির সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার নিকট এর উদ্দশ্যপ্রণোদিত অধীনস্থকরণ দিয়ে, ধণাত্মকভাবে প্রশংসনীয় “বৃদ্ধির” সাথে একীভূত করে যেমন, এর সাথে নিয়ে আসা হয় লাভজনক কৃত্রিম “আকাঙ্খাসমূহ”-এর উৎপাদন, যা একই সাথে স্থুলভাবে মানবজাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এমনকি প্রাথমিক প্রয়োজনসমূহের পরিপূরণকে অস্বীকার করে।

একই সাথে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অন্তর্ভূক্তকৃত ক্রমাধিকারতান্ত্রিক কাঠামোগত আধিপত্য আধুনিক রাষ্ট্র কর্তৃক জোরপূর্বক সংরক্ষিত হয়: এটি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বগ্রাহী রাজনৈতিক কর্তৃকমূলক কাঠামো। যেহেতু বিচ্ছিন্নতা হ’ল একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, কাজেই কেবল সত্যিকার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর হিসেবে একটি র‍্যাডিক্যাল অনুশীলনমূলক বিকল্পই দিতে পারে এর বিমানবিকায়ন প্রভাবের সম্ভাব্য প্রতিকার।

আমরা সবাই জানি যে নিরন্তর-বৃদ্ধিমান অসমতার একটি সমাজে “প্রগতিশীল কর আরোপ” করে “অধিক ন্যায় সঙ্গত বিতরণ”-এর মাধ্যমে সামাজিক অসমতা ও বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধে সংস্কারবাদী প্রচেষ্টা কীভাবে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। আমরা আরও জানি যে এরূপে সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ হতে হয়, কারণ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে বিতরণের সবচেয়ে মৌল দিক হ’ল ক্ষুদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃক উৎপাদন উপায়ের আত্মসাৎকরণ, এবং এভাবে বিরোধী সামাজিক শ্রেণীসমূহে ব্যক্তির কাঠামোগত নিরাপদ ও সংরক্ষিত বিতরণও ব্যর্থ হয়।

উদ্দেশ্যের দিক থেকে মহত্তর আরেক ধরণের ব্যর্থতা ছিল “পুঁজিতান্ত্রিক যৌক্তিকতার” ক্ষমতার  বিরুদ্ধে ইউটোপিয় সমর্থন নন্দনতাত্ত্বিক শিক্ষার মাধ্যমে। এর চেষ্টাকৃত প্রকারভেদসমূহ ক্ষমতাহীনতায় পর্যবেশিত হয় কারণ, মার্কসের কথায়, “দায়িত্বভারে ন্যুজ দরিদ্র ব্যক্তির সুন্দরতম  নাটকের জন্য কোন বোধ নেই; “খনিজদ্রব্যের ডিলার কেবলমাত্র এর বাজার-মূল্যই দেখে, কিন্তু খনিজের সৌন্দর্য্য ও চমৎকার বৈশিষ্ট্য দেখে না। তাঁর কোন নন্দনতাত্ত্বিক বোধ নেই”।

স্পষ্টতঃই কেবলমাত্র নন্দনতাত্ত্বিক শিক্ষারই নয়, শিক্ষার রয়েছে সিদ্ধান্তিক ভূমিকা বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে। যাহোক, দরকারী র‍্যাডিক্যাল সামাজিক পরিবর্তনের বিকল্প হিসেবে নয়, বরং এর নিবিড় সংযোগে। যেহেতু কেবলমাত্র সবথেকে র‍্যাডিক্যাল সামাজিক রূপান্তর মানবজাতিকে মুক্ত করতে পারে বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবস্থা থেকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি