রসায়নের দর্শন ও অ্যারিস্তোতল স ম আজাদ
আমাদের দেশে বিজ্ঞান দর্শনের চর্চা এমনিতেই কম। আর উদীয়মান ডিসিপ্লিন হিসেবে রসায়ন দর্শনের যাত্রার ঘটনাও পাশ্চাত্যেই শুরু কয়েক দশক আগে। আর আমাদের দেশেতো চর্চা আরও কম। আমার প্রত্যাশা রসায়ন দর্শনের ওপর এই ক্ষীণকায় নিবন্ধটি রসায়ন দর্শন চর্চা উসকে দেবে।
রসায়নের দর্শন ও অ্যারিস্তোতল
স ম আজাদ
প্রকৃতি জগৎকে জানা-বোঝা ও একে মানব কল্যাণে ব্যবহারের চেষ্টা থেকে প্রকৃতি দর্শন তথা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ। বিজ্ঞান-দর্শনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রসায়ন-দর্শন অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক জ্ঞান-তাত্ত্বিক ঘটনা।
রসায়ন-দর্শনের দুটি শাখা। প্রথমটিতে রসায়ন বিজ্ঞানে ধারণাসংক্রান্ত ইস্যুগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লে ষণ
সমন্বয় ইত্যকার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। ধারণা সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীতে
রয়েছে পদার্থের প্রকৃতি, পরমাণুবাদ, রাসায়নিক বন্ধন, সংশ্লেষণ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় শাখায় বিজ্ঞান-দর্শনের
ঐতিহ্যিক বিষয়সমূহ যেমন বাস্তববাদ (realism), অবরোহ (reduction),
ব্যাখ্যা, নিশ্চায়ন (confirmation) ও মডেলকরণ (modeling), এগুলোকে রসায়নের
প্রেক্ষাপটের মধ্যে আত্মীকৃত করা হয়।
পদার্থ, মৌলসমূহ, এবং রাসায়নিক সংযোগ
রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে আমাদের সাম্প্রতিক বোঝাপড়া হচ্ছে মৌলিক ও পারমাণবিক । সকল পদার্থই মৌলিক পদার্থসমূহের পরমাণু দিয়ে গঠিত। যৌগিক পদার্থের আণুবিক্ষণিক গঠনেনর বিল্ডিং বক হচ্ছে এই পরমাণুসমূহ। তাই পরমাণু হচ্ছে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মৌলিক একক। কিন্ত বিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত রাসায়নিক পরমাণুর অস্তিত্বের বাস্তবতা (reality) ছিল বিতর্কিত। আর “মৌলিক বিল্ডিং ব্লক” প্রবাদটি সবসময়ই অস্পষ্ট। সকল পদার্থ মৌল দ্বারা গঠিত, এই দাবীটি মৌলের অস্তিত্বের স্বরূপ দার্শনিকীয় মর্যাদা (ontological status of element) এবং মৌলসমূহকে কীভাবে বৈশিষ্টমন্ডিত করা হবে- এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত দিক নির্দেশনা দেয় না।
“কোনকিছুকে মৌল হতে হলে কি হতে হবে? ”অর্থাৎ মৌলের সংজ্ঞা কি, ঐতিহাসিকভাবে রসায়নবিদগণ এই প্রশ্নের দুটি উত্তর দেন:
ক. বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অস্তিত্বমান পদার্থ যাকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে মৌল বলে। এটি হলো বিশ্লেষণের অবসান (end of analysis)থিসিস।
খ. কম্পোজিট পদার্থের উপাদানকে মৌল বলে। এটি হলো প্রকৃত উপাদান (actual component) থিসিস।
এই দুটি থিসিস মৌলসমূহকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করে। প্রথম থিসিসটি প্রক্রিয়াগত (procedural), এতে মৌলসমূহকে বাহ্যিকভাবে (explicitly) শনাক্ত করা হয় একটি প্রক্রিয়া দ্বারা (by a procedure)। সোজাসুজিভাবে একটি মিশ্রণের উপাদান হলো মৌলসমূহ, এই উপাদানসমূহকে আর পৃথক করা যায় না। দ্বিতীয় থিসিসটি অধিকতর তত্ত্বীয়, এতে মৌলসমূহকে কম্পোজিট পদার্থের উপাদানরূপে গণ্য করা হয়। প্রাক-আধুনিক অ্যারিস্তোতলিয় সিস্টেমে বিশ্লেষণের অবসান থিসিসটি পছন্দের অপসন ছিলো। অ্যারিস্তাতল বিশ্বাস করতেন যে রাসায়নিক পদার্থের বিল্ডিং ব্লক হলো মৌলসমূহ, এগুলো সম্ভাবনীয়রূপে (potentially) পদার্থসমূহে উপস্থিত থাকে। কিন্তু আধুনিক ধারণায় মৌলগুলো প্রকৃত উপাদান। রসায়নের ধারণাগত বিবর্তনের পটভূমিতে অ্যারিস্তোতলের অবদান সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
অ্যারিস্তোতলীয় রসায়ন
অ্যারিস্তোতলীয় ঐতিহ্যে বস্তু ও এর রূপান্তরের প্রথমদিককার ধারণাগত বিশ্লেষণসমূহ দেখা গেছে। আধুনিক রসায়নের মত অ্যারিস্তোতলের তত্ত্বসমূহের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল পদার্থসমূহের প্রকৃতি এবং তাদের রূপান্তরের ওপর। তিনি প্রথম রাসায়নিক তত্ত্বের প্রণালীবদ্ধ ট্রেটাইজগুলো দেন: যেমন On Generation and Corruption, Meteorology, and parts of Physics and On the Heavens।
অ্যারিস্তোতলের মতে অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী অনেকগুলো পদার্থ দিয়ে গঠিত। তবে তাদের মধ্যে কিছু পদার্থ একক, খাঁটি পদার্থ দিয়ে গঠিত হতে পারে। খাঁটি পদার্থসমূহকে স্বাতন্ত্রীকৃত করতে তিনি খাঁটিত্বের বৈশিষ্ট্যের ধারণা দেন। তিনি বলেন খাঁটি পদার্থ হলো হোমিয়োমেরাস (homoeomerous)।
অর্থাৎ, সেগুলো প্রত্যেকেটি পর্যায়ে একই ধরনের অংশ দ্বারা গঠিত। যেমন
পানির যেকোনো অংশ পানি, স্বর্ণের যেকোনো অংশ স্বর্ণ। যদি আমরা বলি পানিতে
তেল অথবা শিলাতে সঞ্চিত হীরক, তাহলে অ্যারিস্তোতলীয় রসায়ন মতে এগুলোতে
একাধিক পদার্থ উপস্থিত।
তাঁর পূর্বসুরীদের মত অ্যারিস্তোতল মনে করতেন যে আগুন, পানি, বাতাস ও মাটি হলো চারটি মৌল, এগুলো সকল পদার্থের বিল্ডিং বক। কিন্তু তিনি তাঁর পূর্বসুরীদের থেকে পৃথকভাবে এই ধারণায় উপনীত হন। তিনি এই মৌলগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেন মৌলিক নীতিসমূহ (fundamental principles) ) থেকে। তিনি যুক্তি দেন যে একই দ্রব্য একই সাথে গরম (hot) ও ঠান্ডা (cold) হতে পারেনা অথবা আর্দ্র (moist) ও শুষ্ক (dry) হতে পারেনা। আগুন হলো গরম ও শুষ্ক, বাতাস হলো গরম ও আর্দ্র, পানি হলো ঠান্ডা ও আর্দ্র , আর মাটি হলো ঠান্ডা ও শুষ্ক। এইভাবে, অ্যারিস্তোতল মৌলসমূহকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেন তাপ ও আর্দ্রতা (heat and humidity) এর সর্বোচ্চ মাত্রার টার্ম দিয়ে। অমৌলিক দ্রব্যসমূহকে বৈশিষ্টায়িত করেন গরমত্ব ও আর্দ্রতার (warmth and humidity) মধ্যম পর্যায়ের মাত্রার টার্ম দিয়ে।
পদার্থের বিল্ডিং ব্লক ছাড়াও রসায়ন বিজ্ঞান পদার্থের রূপান্তরের উপর গুরুত্ব দেয়। অ্যারিস্তোতল এ ক্ষেত্রেও অবদান রাখেন। তিনি ট্রান্সমিউটেশন ও প্রোপার মিক্সিংএর পার্থক্য করেন। ট্রান্সমিউট্রেশ নে
একটি পদার্থ অন্যটিকে আচ্ছন্ন করে এবং অপসারিত করে, এটি বর্তমান সময়ের
দশার পরিবর্তনের কাছাকাছি। প্রোপার মিক্সিং হলো এখনকার রাসায়নিক সংযোগ।
অ্যারিস্তোতলের মতে তুলনীয় পরিমাণ পদার্থসমূহকে একত্রে মেশানো হলে অন্য পদার্থসমূহ উৎপন্ন হয়। এই উৎপন্ন অন্য পদার্থগুলো হলো যৌগ। সব যৌগই কতগুলো উপকরণ থেকে তৈরী করা যায়।
সংক্ষেপে এটা বলা যায় যে মৌলসমূহ, খাঁটি পদার্থসমূহ এবং রাসায়নিক সংযোগ সম্পর্কে পরবর্তী কালের সকল আলোচনার দার্শনিক পটভূমি অ্যারিস্তোতলই তৈরী করেন।
স ম আজাদ
প্রকৃতি জগৎকে জানা-বোঝা ও একে মানব কল্যাণে ব্যবহারের চেষ্টা থেকে প্রকৃতি দর্শন তথা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-দর্শনের
রসায়ন-দর্শনের দুটি শাখা। প্রথমটিতে রসায়ন বিজ্ঞানে ধারণাসংক্রান্ত ইস্যুগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লে
পদার্থ, মৌলসমূহ, এবং রাসায়নিক সংযোগ
রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে আমাদের সাম্প্রতিক বোঝাপড়া হচ্ছে মৌলিক ও পারমাণবিক । সকল পদার্থই মৌলিক পদার্থসমূহের পরমাণু দিয়ে গঠিত। যৌগিক পদার্থের আণুবিক্ষণিক গঠনেনর বিল্ডিং বক হচ্ছে এই পরমাণুসমূহ। তাই পরমাণু হচ্ছে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মৌলিক একক। কিন্ত বিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত রাসায়নিক পরমাণুর অস্তিত্বের বাস্তবতা (reality) ছিল বিতর্কিত। আর “মৌলিক বিল্ডিং ব্লক” প্রবাদটি সবসময়ই অস্পষ্ট। সকল পদার্থ মৌল দ্বারা গঠিত, এই দাবীটি মৌলের অস্তিত্বের স্বরূপ দার্শনিকীয় মর্যাদা (ontological status of element) এবং মৌলসমূহকে কীভাবে বৈশিষ্টমন্ডিত করা হবে- এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত দিক নির্দেশনা দেয় না।
“কোনকিছুকে মৌল হতে হলে কি হতে হবে? ”অর্থাৎ মৌলের সংজ্ঞা কি, ঐতিহাসিকভাবে রসায়নবিদগণ এই প্রশ্নের দুটি উত্তর দেন:
ক. বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অস্তিত্বমান পদার্থ যাকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে মৌল বলে। এটি হলো বিশ্লেষণের অবসান (end of analysis)থিসিস।
খ. কম্পোজিট পদার্থের উপাদানকে মৌল বলে। এটি হলো প্রকৃত উপাদান (actual component) থিসিস।
এই দুটি থিসিস মৌলসমূহকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করে। প্রথম থিসিসটি প্রক্রিয়াগত (procedural), এতে মৌলসমূহকে বাহ্যিকভাবে (explicitly) শনাক্ত করা হয় একটি প্রক্রিয়া দ্বারা (by a procedure)। সোজাসুজিভাবে একটি মিশ্রণের উপাদান হলো মৌলসমূহ, এই উপাদানসমূহকে আর পৃথক করা যায় না। দ্বিতীয় থিসিসটি অধিকতর তত্ত্বীয়, এতে মৌলসমূহকে কম্পোজিট পদার্থের উপাদানরূপে গণ্য করা হয়। প্রাক-আধুনিক অ্যারিস্তোতলিয় সিস্টেমে বিশ্লেষণের অবসান থিসিসটি পছন্দের অপসন ছিলো। অ্যারিস্তাতল বিশ্বাস করতেন যে রাসায়নিক পদার্থের বিল্ডিং ব্লক হলো মৌলসমূহ, এগুলো সম্ভাবনীয়রূপে (potentially) পদার্থসমূহে উপস্থিত থাকে। কিন্তু আধুনিক ধারণায় মৌলগুলো প্রকৃত উপাদান। রসায়নের ধারণাগত বিবর্তনের পটভূমিতে অ্যারিস্তোতলের অবদান সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
অ্যারিস্তোতলীয় রসায়ন
অ্যারিস্তোতলীয় ঐতিহ্যে বস্তু ও এর রূপান্তরের প্রথমদিককার ধারণাগত বিশ্লেষণসমূহ দেখা গেছে। আধুনিক রসায়নের মত অ্যারিস্তোতলের তত্ত্বসমূহের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল পদার্থসমূহের প্রকৃতি এবং তাদের রূপান্তরের ওপর। তিনি প্রথম রাসায়নিক তত্ত্বের প্রণালীবদ্ধ ট্রেটাইজগুলো দেন: যেমন On Generation and Corruption, Meteorology, and parts of Physics and On the Heavens।
অ্যারিস্তোতলের মতে অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী অনেকগুলো পদার্থ দিয়ে গঠিত। তবে তাদের মধ্যে কিছু পদার্থ একক, খাঁটি পদার্থ দিয়ে গঠিত হতে পারে। খাঁটি পদার্থসমূহকে স্বাতন্ত্রীকৃত করতে তিনি খাঁটিত্বের বৈশিষ্ট্যের ধারণা দেন। তিনি বলেন খাঁটি পদার্থ হলো হোমিয়োমেরাস (homoeomerous)।
তাঁর পূর্বসুরীদের মত অ্যারিস্তোতল মনে করতেন যে আগুন, পানি, বাতাস ও মাটি হলো চারটি মৌল, এগুলো সকল পদার্থের বিল্ডিং বক। কিন্তু তিনি তাঁর পূর্বসুরীদের থেকে পৃথকভাবে এই ধারণায় উপনীত হন। তিনি এই মৌলগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেন মৌলিক নীতিসমূহ (fundamental principles) ) থেকে। তিনি যুক্তি দেন যে একই দ্রব্য একই সাথে গরম (hot) ও ঠান্ডা (cold) হতে পারেনা অথবা আর্দ্র (moist) ও শুষ্ক (dry) হতে পারেনা। আগুন হলো গরম ও শুষ্ক, বাতাস হলো গরম ও আর্দ্র, পানি হলো ঠান্ডা ও আর্দ্র , আর মাটি হলো ঠান্ডা ও শুষ্ক। এইভাবে, অ্যারিস্তোতল মৌলসমূহকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেন তাপ ও আর্দ্রতা (heat and humidity) এর সর্বোচ্চ মাত্রার টার্ম দিয়ে। অমৌলিক দ্রব্যসমূহকে বৈশিষ্টায়িত করেন গরমত্ব ও আর্দ্রতার (warmth and humidity) মধ্যম পর্যায়ের মাত্রার টার্ম দিয়ে।
পদার্থের বিল্ডিং ব্লক ছাড়াও রসায়ন বিজ্ঞান পদার্থের রূপান্তরের উপর গুরুত্ব দেয়। অ্যারিস্তোতল এ ক্ষেত্রেও অবদান রাখেন। তিনি ট্রান্সমিউটেশন ও প্রোপার মিক্সিংএর পার্থক্য করেন। ট্রান্সমিউট্রেশ
অ্যারিস্তোতলের মতে তুলনীয় পরিমাণ পদার্থসমূহকে একত্রে মেশানো হলে অন্য পদার্থসমূহ উৎপন্ন হয়। এই উৎপন্ন অন্য পদার্থগুলো হলো যৌগ। সব যৌগই কতগুলো উপকরণ থেকে তৈরী করা যায়।
সংক্ষেপে এটা বলা যায় যে মৌলসমূহ, খাঁটি পদার্থসমূহ এবং রাসায়নিক সংযোগ সম্পর্কে পরবর্তী কালের সকল আলোচনার দার্শনিক পটভূমি অ্যারিস্তোতলই তৈরী করেন।
নূতন চিন্তার সম্প্রসারণ। চলুক লেখা চাবুকের মত।
উত্তরমুছুন