মার্কস ও ধর্ম
মার্কস ও ধর্ম
মূল:অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অনুবাদ: স ম আজাদ
কার্ল মার্কসের ধর্ম সম্পর্কে সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি কোনটি? অনেক মানুষই জানেন যে মার্কস ধর্মকে “জনগণের আফিম” হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু অনেক কম মানুষই জানে সম্পূর্ণ উক্তিটি: “ধর্মীয় দুর্ভোগ একই সঙ্গে বাস্তব দুভোর্গের প্রকাশ এবং বাস্তব দুর্ভোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নির্যাতিত সৃষ্টির দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়, এবং আত্মাবিহীন অবস্থার আত্মা হচ্ছে ধর্ম।
এটি জনগণের আফিম।”
এই বিষয়ে মার্কসের লেখালেখির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে যখন তিনি শুধুমাত্র নিশ্চিতভাবেই ধর্মের সমালোচনা করেন, তখন তিনি সমানভাবে কঠোর ছিলেন উদারনীতিকদের প্রতি, যারা অন্যান্য সকল রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর ধর্মের সমালোচনাকে বর্ধিত করেন।
মার্কসের অধিকাংশ কাজের মত তাঁর ধর্মের বিশ্লেষণকে বুঝতে হলে তাঁর সমগ্র জীবনে তিনি যে সমস্ত রাজনৈতিক সংগ্রামে জড়িত ছিলেন সেগুলোতে পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টি দিতে হবে।
১৮১৮তে এখনকার জার্মানীর অংশ প্রুশিয়াতে মার্কসের জম্ম। মার্কসের প্রথম দিককার জীবনায়নে একটি নির্ধারক সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে আর্বতিত হয়।
প্রশিয়াতে ইহুদীরা সাংশ্রায়িক বৈষম্য (systematic
discrimination)-এর সম্মুখীন হয়। কোথায় তারা বাস করতে পারবে এবং কোন পেশা তারা গ্রহন করতে পারবে তা আইন দিয়ে নির্ধারিত হতো। ১৮৪০-এর দশকে ইহুদী মুক্তির ব্যাপারে প্রচন্ড বিতর্ক ছিল, এটি আজকের দিনে ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে কিছু যুক্তির সমান্তরাল।
সেই সময়ে উদারনীতিক প্রকাশনাবলীর উপর র্যাডিক্যাল সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে মার্কস নিজের জন্য খ্যাতি বয়ে আনেন।
তরুণ হেগেলপন্থী হিসেবে পরিচিত উদারনীতিক লেখক ও চিন্তাবিদদের চক্রের সঙ্গে বিতর্কে তাঁর শক্তির অনেকটাই ব্যয় হয়।
এদের মধ্যে উলেখযোগ্য ছিলেন ব্রæনো বাউয়ের, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কসের শিক্ষকদের একজন ছিলেন।
বাউয়ের ডানপন্থী হিসেবে তাঁর একাডেমিক পেশা শুরু করেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বামপন্থার দিকে ঝুঁকেন, বর্ধিতভাবে খ্রীস্টান ধর্মের সমালোচকে পরিণত হন। ১৮৪২-এ তিনি বার্লিনে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ থেকে বহিস্কৃত হন তাঁর র্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য।
বাউয়ের ও তরুণ হেগেলপন্থীরা খ্রীস্টধর্ম এবং সাধারণভাবে ধর্মকে কেন সমালোচনা করেন- তার যথেষ্ট কারণ আছে। সামন্তযুগ থেকে পাওয়া নিয়ন্ত্রণমূলক আইনসহ গীর্জার দমনমূলক ভাবাদর্শ দিয়ে ঠেক দেয়া প্রুশিয়া তখন পর্যন্ত ছিল স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র।
১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের অনুবর্তী যে ধরণের সংস্কার আসে, তার জন্য আগ্রহান্বিত হন প্রæশিয়াতে উদারনীতিকরা। যাহোক, তারা প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব সংগঠনের ঝামেলাপূর্ণ কাজে বিবেচনাযোগ্যভাবে স্বল্প আগ্রহী ছিলেন। ফলে তাঁরা সংকটাপন্ন প্রæশিয় সরকারের নিকট সংস্কারের দাবীতে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন- বিশেষ করে পার্লামেন্ট নির্বাচনে এবং গীর্জা ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণে।
মুক্তির জন্য ইহুদীয় দাবী এই ব্যাপক সংগ্রামের অংশ ছিল। মার্কসের ইহুদী পিতা নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা নেন। মার্কস ইহুদীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করার অভিযান সমর্থন করেন।
উদারনীতিক নাস্তিক
কিন্তু সকল উদারনীতিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি। মার্কসের ঠিক বিপরীতে বাউয়ের ইহুদী মুক্তির বিরুদ্ধে আবির্ভূত হন, তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনে আপাতদৃষ্টিতে বামপন্থী যুক্তি সমবেত করেন।
ইসলামবিদ্বেষীতা (Islamophobia)-কে গুরুত্বহীন, অগ্রাহ্য করা অথবা এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক সহযোগীতার জন্য কিছু লোকজনের দেয়া যুক্তিসমূহ বাউয়ের এর ব্যবস্থাবলীর অনেকগুলিরই প্রতিরূপ।
বাউয়ের যুক্তি দেন যে ধর্ম প্রধান শত্রæ এবং অতএব ইহুদীদের ইহুদী হিসেবে মুক্তির দাবীর প্রতি সমর্থন ধর্মের প্রতি আত্মসমর্পণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিশেষ পক্ষ সমর্থনের সামিল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রথমে তাদের ধর্মকে নিন্দা করতে হবে, এবং কেবল তখনি তারা উদারনীতিক নাস্তিকদের সমর্থনের উপযোগী হবে।
এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাউয়ের লেখেন, “যতদিন তিনি ইহুদী, নিয়ন্ত্রণপ্রবণ স্বভাব, যা তাকে ইহুদী করে, এবং তাকে অইহুদীদের নিকট থেকে পৃথক করে তা মানব স্বভাবের ওপর জয়যুক্ত হতে বাধ্য, এটির (মানব স্বভাবের- অনু) তাঁকে একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত করা উচিত ছিল।”
সাময়িকভাবে এই যুক্তি ভাসাভাসাভাবে সকল ধর্মকে “সমানভাবে খারাপ” হিসেবে গণ্য করে বলে মনে হয়, এটি দ্রæত মদদ যোগায় অন্যটি দিয়ে যা ব্যাখ্যা করে বাস্তবিকই কি সংকটাপন্ন। দ্বিতীয় নিবন্ধে ইহুদী মুক্তি আন্দোলনকে আক্রমণ করে বাউয়ের যুক্তি দেন যে যখন সকল ধর্ম সমানভাবে খারাপ, তখন কিছু অন্যগুলো থেকে অধিকতর সমান।
বিশেষ করে বাউয়ের এখন দাবী করেন যে ইহুদীবাদ থেকে খ্রীস্টধর্ম বাস্তবত অধিকতর শ্রেষ্ঠ্য: সর্বাংশে ধর্মকে ত্যাগ করতে খ্রীস্টানদের কেবলমাত্র একটি ধাপ অর্থাৎ তার ধর্মকে কাটিয়ে উঠতে হবে। অন্যদিকে ইহুদীদের কেবলমাত্র তার ইহুদী স্বভাবের সঙ্গে ছেদ ঘটাতে হবে তাই নয়, তার ধর্মকে নিখুঁতকরণের লক্ষ্যে উন্নয়নের সঙ্গেও ছেদ ঘটাতে হবে।
এই উন্নয়ন তার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন।
আজকের দিনে এখানে ইসলাম সম্পর্কে অনুরূপ যুক্তিসমূহ বিস্মায়ক। উদারনীতিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রায়ই জোর দেন যে তারা সকল ধর্মের বিরোধী, এবং ইসলামের সঙ্গে কোন সুনির্দিষ্ট ইস্যু নেই।
কিন্তু যে ধর্মটি তাদের সবথেকে কর্মতৎপর করে, যে একটি ধর্ম সামাজিক পাপ থেকে সন্ত্রাসবাদ হয়ে homophobia পর্যন্ত সবকিছুর জন্য প্রধানতঃ দায়ী বলে তারা ধারণা করে, অধিকার্যরূপে তা ইসলামের উপর বর্তায়।
মার্কস ইতোমধ্যে তরুণ হেগেলপন্থীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পুণঃমুল্যায়ন করছিলেন, ১৮৪৪-এ প্রকাশিত প্রত্যুত্তরমূলক নিবন্ধ “ইহুদী প্রশ্নে” তিনি প্রত্যয়মূলকভাবে
তাঁর ভূতপূর্ব শিক্ষক বাউয়ের-এর জবাব দেন। “ইহুদী
পশ্চাদপদতা”-এর ওপর আক্রমণ, অথবা “সহিষ্ণুতা”-এর জন্য অগভীর আবেদনের ইস্যুতে যোগদানের পরিবর্তে বরং তিনি তাঁর বন্দুক তাঁক করেন বাউয়ের-এর উদারনীতিক রাজনীতির ব্যর্থতার ওপর।
মার্কস প্রথম লক্ষ্য করেন যে বাউয়ের কর্তৃক আহŸানকৃত সীমিত “রাজনৈতিক মুক্তি”, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবী কোনভাবেই যথেষ্ট-এর নিকটবর্তী ছিলনা। বাস্তবতঃ এটি ধর্মকে মুক্তি দিতে পারতো না, যা সম্ভবতঃ বাউয়ের এর প্রধান লক্ষ্য ছিল। মার্কস লক্ষ্য করেন যে মার্কিন সংবিধান স্পষ্টতই ধর্মনিরপেক্ষ, তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট প্রধানতঃ “ধার্মিকতার দেশ”, সকল ধরণের ফেরকা ও প্রথা দিয়ে ঠাসা তাদের পণ্যসামগ্রী ফেরি করছে।
সামাজিক সংগ্রাম
অধিকতর মৌলভাবে মার্কস যুক্তি দেন যে, ধর্ম বিশ্বাস সার্বিক নির্যাতনের কারণের থেকে বরং প্রাথমিক পরিণতি। ধর্ম প্রসঙ্গে মনোযোগ এই বিশাল চিত্রকে অস্পষ্ট করে, বাস্তব সামাজিক সংগ্রাম থেকে শক্তি বন্ধ্যা ধর্মতাত্তি¡ক বির্তকের দিকে সরিয়ে দেয়।
মার্কস আরো লক্ষ্য করেন যে উদারনীতিকগণ মানব সমাজকে জন “রাজনৈতিক জীবন” এবং ব্যক্তিগত সুশীল সমাজের মধ্যে অনমনীয়ভাবে বিভক্ত দেখেন।
মার্কস এই কৃত্রিম বিভাজনকে ছিঁড়ে ফেলতে এগিয়ে আসেন।
তিনি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে অনুমানমূলকভাবে তরুণ হেগেলপন্থী বাস্তব নাস্তিক্য দাবীসমূহ তাদের নিজেদের ছদ্ম-ধার্মিক প্রস্তাবনাসমূহ দিয়ে ঢেকে রাখে।
সুনির্দিষ্টভাবে তারা বিশ্বাস করেন মানব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে যা পরমাণুকৃত ব্যক্তি সত্ত¡া দিয়ে গঠিত যা সম্পদের মালিকানা বজায় রাখে, আত্মস্বার্থ দিয়ে চালিত হয়, এটি এর যুগের পূর্বেই একই প্রকারের থেচারবাদ, যা কিভাবে মানব সমাজ প্রকৃতপক্ষে কাজ করে তা ধারণ করে না:
“মানুষের তথাকথিত অধিকার আসলে সুশীল সমাজের সদস্যদের অধিকার, আত্মবাদী (egoistic) মানুষের অধিকার, অপর মানুষ ও সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের অধিকার ছাড়া আর কিছু নয়।”
মার্কস এখানে যে পরিহাসটি লক্ষ্য করেন তা হলো এই যে “বাউয়ের ইহুদীদের অভিযুক্ত করেন সুনিদির্ষ্টভাবে আত্মবাদ (egoism)-এর জন্য, সমাজ থেকে ভীষণভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য, টাকা বানানো ও ব্যবসার ধান্দা দ্বারা সুচিন্তিতভাবে আচছন্ন থাকার জন্য। ইহুদীদের যে পাপের জন্য তিনি অভিযুক্ত করেন বাউয়ের নিজেই সেই পাপে পাপী এবং তাঁর নিজের রাজনৈতিক ব্যর্থতার জন্য ইহুদীবাদ কাজ করে যুতসই বলির পাঁঠা হিসেবে।
উদারনীতিকদের বিপরীতে, মার্কস আহবান জানান “রাজনৈতিক মুক্তি”-কে “মানব মুক্তি”-তে আমুল সাধারণীকরণের জন্য Ñ যা অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সমগ্র সমাজকে বিপ্লবায়িত করে, যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের চরিত্র খুটখাট করার বিপরীত। এবং এই সমাজতান্ত্রিক প্রকল্পটির ভিত্তি হবে দুনিয়ার সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদী বোঝাপড়ার ওপর, কেবলমাত্র নাস্তিক্যবাদের ওপর নয়।
তরুণ হেগেলপন্থীদের
রাজনৈতিক ভিরুতার সমুচিত জবাব দিয়ে নিষ্পত্তি করেন তিনি এক সারি লেখা দিয়ে, মার্কসের রচনা “ইহুদী প্রশ্নে” তারই একটি। মার্কস শীঘ্র শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী সমর্থকে রূপান্তরিত হন, এ জন্য তিনি আজও স্মরণীয়।
অন্যদিকে বাউয়ের দ্রæত দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং জার্মানীতে ১৮৭০-এর দশকে উদ্ভূত জঘন্য এন্টি-সেমিটিজম-এর উৎসাহী নেতায় পরিণত হয়- যে ভাবাদর্শ পরিণামে নাৎসী গ্যাস চেম্বারের দিকে ধাবিত হয়।
আজকে আমাদের বামপন্থীদের মার্কসের অন্তর্দৃষ্টিকে পুনার্বিষ্কার করা দরকার। যুদ্ধবাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ উদারনীতিকদের দাবীর বিপরীতে,মার্কস মুক্ত বাজারে বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুঁজাকে কোনভাবেই ধর্মীয় চিন্তার থেকে শ্রেয় বিবেচনা করতেন না।
অনেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বলীর পাঁঠা হিসেবে ব্যবহারের অজুহাত হিসেবে ধর্মের বিরোধীতাকে ব্যবহার করে, একই সঙ্গে দারিদ্র্য, বর্ণবাদ, ও যুদ্ধের দিকে ধাবিতকারী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রশংসার জয়গান গায়, তাদের জন্য মার্কসের নিশ্চিতভাবেই কোন সময় ছিল না।
[Socialist
Worker Online থেকে অনুবাদ কৃত।]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন