বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি মূল: ইসমে কুনারা অনুবাদ স ম আজাদ





বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি

মূল: ইসমে কুনারা  অনুবাদ স ম আজাদ




 বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি

ইসমে কুনারা

অনুবাদ: সম আজাদ

প্রথম প্রকাশ

ফেব্রুয়ারি ২০০৯

প্রকাশক

সেলিনা আজাদ

সাবালিয়া বটতলা

টাঙ্গাইল

 

 

 

 

 

উৎসর্গ: শোয়েব, শশী ও সাম্যকে




অনুবাদকের কথা




লিওন ত্রৎস্কি যেকোনো বিবেচনাতেই বিস্ময়কর জীবন-যাপন করতেন। তিনি ছিলেন মেধাবী বাগ্মী ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, এবং ১৯১৭-এর অক্টোবর বিপ্লবের প্রধান সংগঠকদের একজন। বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধে তিনি ছিলেন লাল বাহিনীর বিজয়ের স্থপতি। পরে তাত্ত্বিক প্রশ্নে স্তালিনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিস্কৃত হন। ১৯৪০ সনে মেক্সিকোতে তিনি র‍্যামন মারকাদার (Raman Mercader) কর্তৃক নিহত হন।


ত্রৎস্কির ধারণাবলী থেকে আজকের দিনের সমাজ পরিবর্তনের অভিযাত্রীদের অনেক কিছু শেখার আছে। তাঁর স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব দক্ষিণ বিশ্বের স্বল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর বিপ্লবী প্রক্রিয়াসমূহের ক্ষেত্র এখনও প্রাসঙ্গিক। তাই বাংলাভাষী পাঠকদের নিকট তাঁকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সাংবাদিক ইসমে কুনারা কর্তৃক লিখিত A Rebel's Guide to Trotosky-এর ভাষান্তর করা হলো।এর বাংলা অনুবাদের শিরোনাম দেয়া হলো বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি। ইসমে কুনারা লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক Socilaist Worker পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি গ্রেট ব্রিটেনের Socialist Workers Party (www.swp.org.uk)-এর সদস্য।


A Rebel's Guide to Trotosky বইটি ২০০৭ সনে প্রকাশ করে  ব্রিটেনের সমাজতান্ত্রিক প্রকাশনালয় Bookmrks Publications (www.bookmarks.uk.com)। এই প্রকাশনালয়ের জনাব Mark L Thomas বাংলা অনুবাদের সত্ত্ব রয়ালটি ছাড়া প্রদান করায় আমি বাংলাদেশের মেহনতি শ্রেণীর পক্ষ থেকে তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা জানাই।


বাংলা অনুবাদের পান্ডুলিপি সংক্ষিপ্ত সময়ে সম্পাদনা করে দিয়েছেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক ড. এ টি এম আতিকুর রহমান। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বর্তমানে ব্রিটেন অধ্যয়নরত আমার ছাত্র আবু নাসির মিয়া লন্ডন থেকে মূল বইটি পাঠিয়ে দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। অনুবাদটি প্রকাশ করতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন বন্ধুবর সদরুল আলম হারুন। স্বল্প সময়ে বইটি ছেপে দিয়েছেন লোক-কথা প্রেসের স্বত্বাধিকারী জনাব হুমায়ুন চৌধুরী। এদের নিকট আমি কৃতজ্ঞতাপাশে আ্ববদ্ধ। এছাড়া আরো অনেকে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু সহযোগিতা করেছেন সর্বতোভাবে, তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।


অনুবাদটি বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন-সংগ্রামে সামান্য উপকারে এলে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করবো।


স ম আজাদ


সম্পাদকীয় নোট

বর্তমান গ্রন্থের অনুবাদক  স ম আজাদ একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ছাত্রজীবনের সহযোদ্ধা। তিনি ব্রিটিশ সাংবাদিক ইসমে কুনারা লিখিত A Rebel’s Guide to Trotsky  গ্রন্থটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন। নাম দিয়েছেন বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি। প্রথমেই বিষয় নির্বাচনের জন্য অনুবাদককে ধন্যবাদ জানাই। বিগত শতকে, এমনকি বর্তমানেও সাম্যবাদী দুনিয়ায় ত্রৎস্কি আলোচিত-সমালোচিত। আমাদের দেশে বিরুদ্ধবাদীদের গালাগাল দেয়ার জন্যও অনেকে ত্রৎস্কি নামটি ব্যবহার করেন। অথচ তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে, তাঁর সংগ্রাম, সংগ্রামের ধরন সম্পর্কে, এমন কী কমিউনিজমের উম্মেষ ও বিস্তৃতিতে তাঁর অবদান কতটুকু- আমরা খুব কমই জানি। এ ক্ষেত্রে বিদ্রোহের পাঠ: ত্রৎস্কি আমাদের সামনে নতুন দিগন্ত উম্মোচন ঘটাবে বলে আমার ধারণা। গ্রন্থটি সম্পাদনা ও ভূমিকা লেখার জন্য স ম আজাদ এবং অন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু সদরুল আলম হারুন আমাকে অনুরোধ করলে না করতে পারিনি। তবে বলা প্রয়োজন অল্প সময় বরাদ্দ দেয়ায় সম্পাদনার কাজ ভালভাবে করা সম্ভব হয়নি। যাহোক, আমার কাছে মনে হয়েছে ভাষান্তরের কাজটি অনুবাদক ভালভাবেই করেছেন। কিছুক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা দ্রুত পাঠকের কাছে ত্রৎস্কিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগ্রহ থেকেই হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আশা করা যায়  পরের সংস্করণে তা দূর  হবে। গ্রন্থটি  অনেক আগ্রহী পাঠকের প্রয়োজন মেটাবে বলে আমার বিশ্বাস।

ড. এ টি এম আতিকুর রহমান
প্রফেসর
ইতিহাস বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়







এক. একুশ শতকে ত্রৎস্কি


একুশ বছর বয়সী লিয়ন ত্রৎস্কি সাইবেরিয়াতে তাঁর প্রথম নির্বাসনকালে লেখেন, “যতক্ষণ আমি বেঁচে থাকবো, আমি লড়াই করবো ভবিষ্যতের জন্য”।  গত শতকে সংঘটিত কিছু অসাধারণ ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে লড়াই করেন।

যে কোনো বিচারেই ত্রৎস্কি বিস্ময়কর জীবন-যাপন করতেন। ১৯১৭ সনে রাশিয়াতে সংঘটিত অক্টোবর অভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন প্রধান সংগঠক। এবং বিপ্লবের পরে তিনি ডজনাধিক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লালবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের কতগুলোতে, যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যা এবং হিটলারের উত্থানের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন।

তাঁর চারপাশের জগতকে নিরন্তর গড়ে তোলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ত্রৎস্কি মতবাদিক সংগ্রাম পরিচালনা করেন এবং তাঁর ধারণাবলীর বিকাশ ঘটান, অবশেষে তিনি লেখেন। ত্রৎস্কি যে সময়ে  তাঁর সংগ্রাম পরিচালনা করেন, সে সময় থেকে আজকের দুনিয়া নানা দিক থেকে পৃথক, কিন্তু আজকের দিনে যুদ্ধ ও নয়া উদারতাবাদ বিরোধী বৈশ্বিক আন্দোলনের সম্মুখীন বহুবিধ প্রশ্নাবলী ও ইস্যুতে তিনি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন: যেদেশে অধিকাংশ জনগণ শিল্পশ্রমিক নয়, সেখানে আপনি কীভাবে পুঁজিবাদকে মোকাবেলা করবেন? রাজনৈতিক সংস্কারের সংগ্রাম ও সত্যিকার অর্থনৈতিক সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক কী? আমাদের আন্দোলনের জন্য আন্তর্জাতিকতাবাদের তাৎপর্য কী? নীতিনিষ্ঠ হয়ে কীভাবে জনগণের বৃহৎ পরিসরে আপনি কাজ করবেন যাতে তখন পর্যন্ত বিপ্লবী ভাবাদর্শের প্রভাবকে সম্প্রসারিত করার প্রচেষ্টা চালানো যায়।

আজকের দিনে অনেকেই যারা পুঁজিবাদ থেকে ভালকিছু চান, তাঁরা স্তালিনবাদের বিভিষিকা দ্বারা তাড়িত। কিন্তু তিনি ছিলেন স্তালিনের উত্থানের বিরুদ্ধে সমৃদ্ধ প্রতিপক্ষ, এবং তিনিই প্রথম স্তালিনবাদের সমালোচনার বিকাশ ঘটান। স্তাালিনের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেন, এতে তিনি চুড়ান্ত মূল্য দেন জীবনের বিনিময়ে। এতে প্রতিভাত হয় যে সমাজতন্ত্রের একটি ভিন্ন ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্যের ভিত্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং এই ভাবাদর্শ দিয়ে মেহনতি জনগণকে তাঁদের নিজেদের জন্য দুনিয়া পরিবর্তন করতে হবে।

ত্রৎস্কি সারা জীবন যুদ্ধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৩৮ সনে কবি আঁদ্রে ব্রেতোঁকে তিনি অভিযোগ করেন, “আমাদের গ্রহ নোংরা ও পাপগন্ধী সাম্রাজ্যবাদী ব্যারাকে পরিণত হচ্ছে।” আজ যখন পুঁজিবাদ কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধ  ও ধ্বংস বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ত্রৎস্কি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারেন যারা এই প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে চেষ্টা করছেন।




দুই. ত্রৎস্কি বিপ্লবী হলেন



সাইবেরিয়া থেকে পালানোর সময় ত্রৎস্কি তাঁর নামটি ধার করেন এক কারারক্ষীর নিকট থেকে। তিনি ১৮৭৯ সনে ইউক্রেনের একটি গ্রামে জন্মেছিলেন, তাঁর সত্যিকার নাম ছিল লেভ দাভিদোভিচ ব্রনস্টেইন।

ত্রৎস্কি যে রাশিয়াতে জন্মেছিলেন, সেটি ছিল জার ও অর্থোডক্স চার্চ শাসিত নিবর্তনমূলক সমাজ। বিশ বছরের কম সময় পূর্বে ভূমিদাস প্রথা (serfdom) উচ্ছেদ করা হয়। রাশিয়ার ব্যাপক অংশই ছিল গ্রামীণ এবং ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ, যদিও শহরে বর্ধিষ্ণু ক্ষুদ্র শিল্প ছিল।  জার্মানিতে এডলফ হিটলারের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সম্ভবত যে কোন দেশের তুলনায় রাশিয়া গভীরতম এন্টিসেমিটিজমের পৌরহিত্য করতো। প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্র কর্তৃক এন্টিসেমিটিজম উৎসাহিত হতো, যা ইহুদিদের বিরুদ্ধে দলগত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জাল বুনত, ইহুদিদের রাশিয়ায় অনেক অংশেই অভিবাসিত অথবা ভূমি অধিকারী হওয়ায় বাধা ছিল। এজন্য ত্রৎস্কির পরিবার শেষতক ইউক্রেনে বসত গড়ে।

এই সময় জারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রধানত আন্দোলনের রূপ নেয়, এটিকে নারোদনিক বা ‘জনগণের বন্ধু’ বলা হতো। পশ্চিম ইউরোপে দেখা পুঁজিবাদী বিভিষিকা পরিহার করার পথ হিসেবে তাঁরা গ্রাম-চাষীর ঐতিহ্য পর্যবেক্ষণ করতো। কিন্তু কৃষকদের মধ্যে বাস করা এবং তাঁদের বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং নারোদনিকগণ বর্ধিতভাবে ষড়যন্ত্রমূলক ও সন্ত্রাসমূলক পদ্ধতির দিকে ধাবিত হয়। ১৮৮১ সনে তাঁরা জারকে হত্যার ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়। তাঁরা আশা করেছিলেন যে এতে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে প্রতিরোধ ঢেউয়ের স্ফুলিঙ্গ তৈরী হবে। কিন্তু কেবলমাত্র রাষ্ট্রের আরো জুলুম নেমে এলো।

এই নির্যাতন সত্ত্বেও মধ্য  ১৮৯০-এর দশকে বর্ধিতভাবে প্রতিরোধ দেখা দেয়। ১৮৯৬ সনে শত শত ছাত্র নতুন জারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে ৩০,০০০ শ্রমিক ধর্মঘট করেন। রাশিয়াতে এটি ছিল প্রথম ধর্মঘট এবং রাশিয়াতে নতুন শক্তি নগর শ্রমিকশ্রেণীর জন্মের আগমনী ঘোষনা।

একই বছরে তখন সতেরো বছর বয়সী ছাত্র ত্রৎস্কি ফ্রাঞ্জ সভিগরস্কির কুটিরকে ঘিরে গড়ে উঠা একটি বিপ্লবী চক্রে যোগ দেন। ত্রৎস্কির পিতা খুবই উদ্বিগ্ন হলেন, তাঁর পুত্রের জন্য মনে যা পরিকল্পনা ছিল, এটি সেই পথ নয়। জেদী তরুণ কর্মী ত্রৎস্কি তাঁর পরিবার থেকে অর্থ না নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং  ফ্রাঞ্জ সভিগরস্কির “বিপ্লবী কুটির”-এ চলে গেলেন। তিনি যে সমস্ত শ্রমিক ও ছাত্রের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের অধিকাংশের মত নিজেকে তিনি প্রথমে নারোদনিক হিসেবে অভিহিত করতেন। নারোদনিকদের সাহসিকতা ও অঙ্গীকারকে জনগণ প্রশংসা করতেন। এই কুটিরে  যারা একত্রিত হতেন তাঁদের চক্রে ত্রৎস্কি তাঁর প্রথম স্ত্রী আলেকজান্দ্রা সকোলোভস্কায়ার দেখা পেলেন। তিনি ইতোমধ্যেই নিজেকে মার্কসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। কয়েক মাস পওে ত্রৎস্কিও নিজেকে মার্কসবাদী বলে অভিহিত করেন।

মার্কস যুক্তি দেন যে পুঁজিবাদের উত্থানে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে যার ক্ষমতা রয়েছে এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার। এবং এর রয়েছে সত্যিকার অর্থে বৈপ্লবিক ধরনের সমাজের প্রতি যৌথ আগ্রহ। তিনি তাঁদের পুঁজিবাদের কবর খনক বলতেন। তাঁর বিখ্যাত যুক্তি ছিল যে  শোষিতদের পক্ষে মুক্তি সংঘটিত করা যাবে না। ‘মেহনতি শ্রেণীর মুক্তি মেহনতি শ্রেণীর কাজ’ – এই নীতিটি ত্রৎস্কি তাঁর সমগ্র জীবন অব্যাহত রাখেন।

ত্রৎস্কির গ্রুপ শ্রমিকদের মাঝে আন্দোলন সংগঠিত করা শুরু করেন, বিপ্লবী সাহিত্য বিতরণ করেন এবং তাঁদের আলোচনাতে অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিকদের সংগ্রহ করেন। তাঁদের সফলতা ছিল অভিভূত হওয়ার মতো। শীঘ্রই তাঁদের সদস্য সংখ্যা ২০০-এর অধিক ছাড়িয়ে গেল।

এই ছোট্ট গ্রুপের আকস্মিক বিকাশে পুলিশ ভীষণ মর্মাহত হয়। ১৮৯৮ সনে অন্যান্যদের সহ ত্রৎস্কিকে তারা গ্রেপ্তার করেন। ত্রৎস্কি দু’বছরের জন্য বন্দী ছিলেন। এই সময়টিতে তিনি ব্যাপকভাবে পড়াশোনা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন, এবং ‘মুক্ত রাজমিস্ত্রির কাজের ইতিহাস’ লেখেন, তিনি এটিকে তাঁর প্রথম মার্কসবাদী  কাজ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি তাঁর সাথী বন্দীদের আন্দোলিত করেন, এতে এক পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল অকার্যকর কিন্তু নাটকীয় টুপি পড়ে প্রতিবাদ। এতে তিনি আবার একটা সময়ের জন্য  কারাবাস লাভ করেন।

জেলে থাকতে ত্রৎস্কি আলেকসান্দ্রাকে বিয়ে করেন এবং তাঁরা সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হন। এখানে তিনি সংবাদ নিবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং চলতি ঘটনা ও সাহিত্যের ওপর বক্তৃতা দেন। এই সময়ে তিনি সর্বোপরি একজন একনিষ্ঠ বিপ্লবী এবং দৃঢ়-প্রত্যয়ী মার্কসবাদী ছিলেন। এবং নির্বাসনে তিনি ক্রমাগত ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্থ হচ্ছিলেন।


তিন. কী ধরণের পার্টি


১৯০২ সনে ত্রৎস্কি সাইবেরিয়া থেকে খড়ের লরিতে পালান। ইউরোপ জুড়ে অন্যান্য কর্মীদের সাহায্য সহায়তায় তিনি লন্ডনে পৌঁছান। কিঙ্গস ক্রশের নিকটবর্তী বাড়ীতে তিনি লেনিন ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় রুশ বিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন, এরা বিপ্লবী পত্রিকা ‘ইস্ক্রা’ (অর্থ স্ফুলিঙ্গ)-তে কাজ করতেন। ইস্ক্রা নিয়মিতভাবে রাশিয়াতে অবস্থিত কর্মীদের নিকট গোপন পথে চলে যেত।

ইস্ক্রাতে কর্মরত গ্রুপটি রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (RSDLP)-এর অংশ ছিল। ১৮৯৮ সনে এক মিটিংয়ে নয় জন ডেলিগেটের উপস্থিতিতে এই সোস্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও ১৯০২ সন নাগাদ এটি আকার ও প্রভাবের দিক থেকে বিবেচনার যোগ্য হয়ে বেড়ে ওঠে।

পরের বছরে এর কংগ্রেসে RSDLP ভেঙ্গে যায়। অতি তুচ্ছ সাংগাঠনিক মতবিরোধের পরিণতিতে পার্টি ভেঙ্গে যাওয়ায় এর সাথে জড়িতরা বিস্মিত হন। লেনিন এক পক্ষের যুক্তিতে  নেতৃত্ব দিলেন, অন্যদিকে ত্রৎস্কি অন্য ভগ্নাংশের অনুসরণ করেন।

বিতর্ক শুরু হয়েছিল পার্টির সদস্য হিসেবে কাকে বিবেচনা করা হবে- এই প্রশ্নে: কি ধরনের পার্টি প্রয়োজন- এই বিষয়ে গভীর মতনৈক্য প্রতিফলিত হয়। এই সময়ে লেনিন গুরুত্ব আরোপ করেন বিপ্লবীদের দৃঢ় ঠাসবুনন বিশিষ্ট কেন্দ্রীভূত সংগঠনের ওপর। ত্রৎস্কি ভাবলেন যে লেনিনের  মডেলের পরিসমাপ্তি ঘটবে প্রতিস্থাপনবাদে- এতে কেন্দ্রীয় পার্টি বা পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক  শ্রমিক শ্রেণীর  স্ব-কর্মকান্ডের প্রতিস্থাপন ঘটবে। তিনি বৃহত্তর গণ সংগঠন (mass party) সমর্থন করেন। পশ্চিম ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানিতে সমাজতন্ত্রীরা কিছু বৃহৎ পার্টি সংগঠিত করে এই পার্টির মডেলে।

লেনিনের পার্টির ধারণা তখন পর্যন্ত বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং অংশত গড়ে উঠে জার পুলিশের নির্যাতনের মুখে অবৈধ অবস্থায় সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা থেকে। আরো সাধারণভাবে তাঁর প্রত্যয়ের ভিত্তি ছিল এই ধারণাতে যে যখন শ্রমিকদের মুক্ত করতে হবে, তখন তাঁদের সবার একই রকম ধারণা থাকে না। কিছু প্রগতিশীল ধারণা পোষণ করেন, কিছু প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা পোষণ করেন এবং অধিকাংশই মাঝামাঝি  কোন এক জায়গায় অবস্থান করেন। পার্টির উচিত বিপ্লবীদের একত্রে দলবদ্ধ করা যেন তাঁরা  অন্যদের নিকট পৌঁছতে পারে এবং প্রভাবিত করতে পারে।

লেনিনের গ্রুপ ডেলিগেটদের  অধিকাংশের সমর্থন লাভ করেন, সুতরাং  এটি বলশেভিক নাম ধারণ করে। ত্রৎস্কি সংখ্যালঘু মেনশেভিকদেস সাথে যান; কিন্তু এক বছর পর তাঁদের পরিত্যাগ করেন। তিনি পরবর্তী দশকে দু’টি গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টায় অতিবাহিত করেন।

অধিকাংশ জনগণ তাঁদের ঐক্যবদ্ধ দেখতে প্রত্যাশা করেন, এবং ১৯১২ সনের পুর্ব পর্যন্ত চুড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গন সম্পন্ন হয়নি এবং কিছু এলাকাতে ১৯১৭ সনের বিপ্লব পর্ব পর্যন্তও আনুশীলনিকভাবে ভাঙ্গন সম্পন্ন হয়নি।

১৯০৩ সনে কেউই ভাবেনি যে মৌলিকভাবে পৃথক দু’টি পথে বলশেভিক ও মেনশেভিকগণ ধাবিত হচ্ছে। ১৯০৩ ও  ১৯১৭ সনের মধ্যে বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব ও যুদ্ধে জোয়ার-ভাটার সময়ে এটি এই পার্থক্য টেনেছিল এবং সংহত করেছিল।

ঐ বছরগুলোতে ত্রৎস্কির বিকাশ ঘটে মেধাবী বাগ্মি, লেখক ও মৌলিক চিন্তাবিদ হিসেবে। কিন্তু ১৯১৭ সনের পুর্ব পর্যন্ত এই অবদানগুলোকে বিপ্লব অর্জনের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর কৌশলের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর জন্য তাঁর কোন সংগঠন ছিল না। ১৯১৭ সনে ত্রৎস্কি লেনিনের বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি বলেন যে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অধিকতর দ্রুত যোগ না দেয়া।



চার. ১৯০৫: প্রথম ওয়ার্কার্স কাউন্সিল


জনগণ কখনো ভাবে যে বিপ্লবীদের একটি ক্ষুদ্র দল কর্তৃক বিপ্লব অনুষ্ঠিত করতে সংগঠিত করা হয়। বাস্তবে, অপ্রত্যাশিত জনগণ বা ঘটনাবলী বছরের পর বছর ক্ষোভ ও তিক্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং গণআন্দোলন অথবা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়।

১৯০৫ সনের জানুয়ারিতে রাশিয়াতে জার এবং জাপানের সাথে বিপর্যয়কর যুদ্ধের প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি  পাচ্ছিল। ফাদার গ্যাপনের অসম্ভাবনীয় বিপ্লবী ব্যক্তিত্বে পরিচালিত একটি বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গই ক্ষোভকে প্রজ্জ্বলিত করে। এই সন্ত ও পুলিশের চর সংস্কারের দাবি জানাতে জারের বিরুদ্ধে জনগণকে পরিচালিত করে। জার তাঁর সৈন্যদের বিক্ষোভকারীদের প্রতি গুলি করতে আদেশ দেন ম্যাসাকার করতে, এটি রক্তাক্ত রোববার হিসেবে পরিচিতি পায়।

এটি রাশিয়াতে বৎসরব্যাপী ব্যাপক অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত করে। পরবর্তী দু’মাসে রাশিয়া জুড়ে ধর্মঘটে ১২৮টি শহরের এক মিলিয়নের ওপর শ্রমিক জড়িত থাকে। গত দশ বছরের চেয়ে ১৯০৫ সনের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আরো শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দেয়। গণ ধর্মঘট গ্রামাঞ্চলে কৃষক অসন্তোষ, সেনাবাহিনীতে এবং নৌবাহিনীতে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের সূত্রপাত ঘটায়, এতে যুদ্ধজাহাজ ব্যাটলশিপ পোতেমকিন অন্তর্ভুক্ত  ছিল  সের্গেই আইজেনস্তাইনের একই শিরোনামের চলচিত্রে যা প্রোজ্জ্বলভাবে ক্যামেরাবন্দী হয়েছ)।

অক্টোবরের প্রথম দিকে রেল শ্রমিকদের আহুত ধর্মঘট সমগ্র রুশ সাম্রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হয়। সংবাদটি ত্রৎস্কির নিকট পৌঁছলে তিনি দ্রুত রাশিয়া ফিরে আসেন। রাশিয়ার ইতিহাসে গঠিত প্রথম সোভিয়েত ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ সোভিয়েত, এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন শ্রমিক ডেপুটিবৃন্দ। এটি গঠনের ঠিক একদিন পর ১৪ অক্টোবর তিনি রাজধানীতে পৌঁছেন।

সোভিয়েত ছিল শ্রমিকদের কাউন্সিল, এটি ছিল নতুন ধরণের সংগঠন। এটি ছিল রাশিয়াতে এ পর্যন্ত দেখা প্রথম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এটিতে শ্রমিকেরা ডেলিগেট নির্বাচন করতেন বিতর্কের জন্য এবং সিদ্ধান্তগুলোতে ভোট  দেয়ার জন্য। ধর্মঘট সংগঠিত করার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন থেকে এটি তৈরী হয় এবং এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে ১৪৭টি ফ্যাক্টরি থেকে ৫৬২ জন ডেলিগেট অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ধর্মঘট কার্যক্রমের সমন্বয় করা থেকে এর কার্যক্রম দ্রুত খাদ্য বিতরণ ও দক্ষিণপন্থী গুন্ডাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সশস্ত্রকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া পর্যন্ত উন্নীত হয়।

সোভিয়েত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়া একীভূত করে শ্লোগান উৎসাহিত করে যাতে উভয় কর্মসূচীই অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমনটি ত্রৎস্কি লিখেছিলেন, অতএব যুদ্ধকালীন আহ্বান ‘আট ঘন্টা এবং একটি বন্দুক’ প্রত্যেকটি পিটার্সবার্গ শ্রমিকের অন্তরে অবশ্যি জীবন্ত থাকবে” (টনি ক্লিফের উদ্ধৃতি, ত্রৎস্কি ১৮৭৯-১৯১৭: অক্টোবর বিপ্লবের দিকে, লন্ডন, ১৯৮৯, পৃ ১০৫)। জারতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপরীতে সোভিয়েত ক্ষমতার নয়া তৃণমূল কেন্দ্র গড়ে তুলতে শুরু করে। ত্রৎস্কি এটিকে “শ্রমিকদের সরকারের ভ্রুণ” বলে অভিহিত করেন। তিন মাসের মধ্যে রাশিয়া জুড়ে ৪০ থেকে ৫০টির মধ্যে সোভিয়েত গড়ে ওঠে, যদিও কোনটিই সেন্ট পিটার্সবার্গ  সোভিয়েতের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে স্পর্শ করতে পারেনি।

রাশিয়া ১৯০৫ সনের বিপ্লবে গণ ধর্মঘট জড়িত করে এবং প্রথম শ্রমিক কাউন্সিল প্রত্যক্ষ করে। তখন থেকে সকল গণ বিপ্লবে শ্রমিকেরা  প্রায়োজনিকভাবে একইভাবে নিজেদের সংগঠিত করে, গণতান্ত্রিক ফোরাম গঠন করে যাতে জনগণ বির্তক করতে পারে এবং সংগঠিত হতে পারে। রাশিয়াতে তাদের বলা হতো সোভিয়েত , ১৯৭৮-৭৯ সনের ইরান বিপ্লবে তাদের বলা হতো সূরা  এবং চিলিতে ১৯৭২-৭৩ সনে তাদের বলা হতো করদনেস (cordones)।

তাঁর সময়কার অন্য যেকোন বিপ্লবী নেতার থেকে ত্রৎস্কি সোভিয়েতের গুরুত্ব অধিক অনুধাবন করেন এবং এর কার্যক্রমে উৎসাহভরে নিয়োজিত রাখেন। অন্যদিকে অনেক বলশেভিক প্রাথমিকভাবে এই সংগঠনের প্রতি সংশয়াবিষ্ট ছিলেন। ২৬ বছর বয়সে এন্টিসেমেটিজম বিরাজিত দেশে ত্রৎস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গ সোভিয়েতের নেতা নির্বাচিত হন এবং সংবাদপত্রের (newsletter) গুরুত্বপূর্ণ মুখপত্র ও সম্পাদক হন।

সোভিয়েত ৫০ দিন স্থায়ী হয়েছিল। সেই সময়ে ত্রৎস্কি শ্রমিকদের কখনও অগ্রসর হওয়ার, কখনও পিছু হটার যুক্তি দেন। তিনি জারের হাস্যকর (phoney) প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস না করার জন্য সাবধান করেন। তিনি সোভিয়েতের অনেক বিবৃতির খসড়া করেন, এর মধ্যে একটি ছিল জারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দিতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান। রাষ্ট্র কর্তৃক উৎসাহিত কর্মসূচীর বিরুদ্ধে তিনি শ্রমিকদের সশস্ত্র করতে জড়িত ছিলেন।

এই  ঘটনাবলীর মাঝে থাকার  উত্তেজনা সম্পর্কে পরে তিনি লেখেন: “বিপ্লব কেবলমাত্র তাঁদের নিকট পাগলামি হিসেবে প্রতীয়মান হয় যাদের এটি সরিয়ে দেয় (sweep aside) এবং উৎখাত করে। আমাদের নিকট এটি ভিন্ন। আমরা আমাদের বৈশিষ্ট্যসূচক উপাদানসহ ছিলাম, যদিও এটি ছিল ঝড়ো ‍উপাদান” (Leon Trotsky, MY Life, London, 2004, p 191)।

সোভিয়েতে অন্তর্ভুক্তি ত্রৎস্কিকে রূপান্তরিত করে- তিনি বিশ্বাস ও সামর্থের মধ্যে বেড়ে উঠেন, বিদ্রোহী তরুণ থেকে প্রায়োগিক ও আদর্শিক নেতা হিসেবে।

সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে দমনের মধ্য দিয়ে ১৯০৫ সনের ডিসেম্বরে বিপ্লব শেষ হয়। ত্রৎস্কিকে বন্দীশালায় নিক্ষিপ্ত করা হয়। সাময়িকভাবে জারতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিপ্লবের স্রোতকে বাঁধা দিকে সমর্থ হয়, রাশিয়া আর কখনও একই ছিল না। শ্রমিকেরা তাঁদের ক্ষীণ আশা দেখান, তাঁদের শক্তি প্রদর্শন করেন। রুশ শ্রমিক শ্রেণী ইতিহাসে নাটকীয়ভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন।

 পাঁচ. স্থায়ী বিপ্লব

১৯০৫ সনের বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ত্রৎস্কি স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্বের বিকাশ ঘটান। এটি মার্কসীয় ধারণাতে সবথেকে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বর্তমানে দক্ষিণ বিশ্বের বিপ্লব ও মুক্তির প্রশ্নে এর সরাসরি প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

১৯০৫ সনের বিপ্লব রাশিয়াতে ও আন্তর্জাতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। ১৯০৫ সন পর্যন্ত অসংখ্য কর্মী বিতর্ক করেন কোত্থেকে বিপ্লব শুরু হতে পারে এবং এটি কেমন হতে পারে। কেউও রাশিয়াতে এটি প্রত্যাশা করেনি।

পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় রাশিয়া ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। এর তখনও জারতন্ত্রী স্বৈরতন্ত্র ছিল এবং অধিকাংশ জনগণ তখন পর্যন্ত ছিলেন কৃষক।

ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ঐকমত্য ছিল যে পশ্চিম ইউরোপের দোরগোড়াতে (footstep) অবস্থিত রাশিয়াকে অনুসরণ করতে হবে এবং সম্পন্ন করতে হবে ১৭৮৯ সনের ফরাসি বিপ্লবের মত বুর্জোয়া (পুঁজিতন্ত্রী) বিপ্লব - যা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশা করবার পূর্বে পুঁজিন্ত্রী শক্তি তৈরী করতে পারে।

প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল মার্কসবাদী একমত হন যেকোন আসন্ন বিপ্লব জারকে উৎখাত করবে এবং পুঁজিতন্ত্রী উন্নয়নের পথকে বাধামুক্ত করবে। বিতর্ক ছিল কোন শক্তি এ ধরনের বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে। উদারনীতিকগণ  ছিলেন পুঁজিতন্ত্রী শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি।  মেনশেভিকগণ শ্রমিক ও উদারনীতিকদের মধ্যে জোটের জন্য যুক্তি দেন। উদারনীতিকদের রাজনৈতিক ভীরুতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে লেনিন  ও বলশেভিকগণ এ ধরনের জোটের বিরোধিতা করেন এবং শ্রমিকদের পুঁজিতন্ত্রী শ্রেণী থেকে স্বাধীন থাকা দরকার বলে যুক্তি দেন। বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে শ্রমিকদের সংগ্রাম করা উচিত কৃষকদের সাথে জোটের জন্য।

ত্রৎস্কি নতুন ও মৌলিক অবস্থান নেন। ১৯০৫ সনের বিপ্লবের অভিজ্ঞতার আলোকে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে রাশিয়াতে শ্রমিকদের নেতৃত্বে সংগঠিত বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে।

১৯৪৮ সনে ইউরোপ জুড়ে সংঘটিত বিপ্লবগুলোর সার-সংকলন করে মার্কস বলেন যে পুঁজিপতি শ্রেণী আর কোন বিপ্লবী শ্রেণী নয়। এই অন্তর্দৃষ্টির উপর ভিত্তি করে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে শ্রমিক শ্রেণীর উপর চুড়ান্ত বিপ্লবী শক্তির হওয়ার দায়ভার পড়েছে।

রুশ পুঁজিতন্ত্রী উদারনীতিকদের প্রতি লেনিনের ঘৃণা ত্রৎস্কি শেয়ার করতেন - এরা সংস্কারের আবশ্যকতার প্রতি আন্তরিকতাহীন সমর্থন যোগাতো, কিন্তু ১৯০৫ সনে প্রমাণ হয় যে তাঁদের জারের প্রতি ঘৃণা অপেক্ষা শ্রমিকদের প্রতি ভীতি অধিকতর। যাহোক ত্রৎস্কি বিশ্বাস করতেন না যে পশ্চিম ইউরোপের মতো অনুরূপ পর্যায়সমূহ দিয়ে রুশ বিপ্লবকে যেতে হবে অথবা এটি পার্লামেন্টিয় পুঁজিতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার বিকাশকে পর্যবেক্ষণ ছিল তাঁর প্রারম্ভিক কাজ। ক্ষুদ্র পরিসরের কারিগরি শিল্প, তারপর ওয়ার্কশপ, তারপর বৃহৎ পরিসরের ফ্যাক্টরির মধ্য দিয়ে ফ্রান্স বা ব্রিটেন বিকশিত হয়েছিল, রাশিয়া সে রকম বিকাশের মধ্য দিয়ে যায়নি। আন্তর্জাতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা দিয়ে তাড়িত হয়ে রাশিয়া বিশ্বের সবথেকে অগ্রসর শিল্পের দিকে উল্লফন দিয়েছিল।

ত্রৎস্কি পরবর্তীতে এই প্যাটার্নটিকে অসম ও যৌথ বিকাশ বলে অভিহিত করেন। অসম কারণ বিভিন্ন অঞ্চল পুঁজিবাদী দিকে বিভিন্ন মাত্রায় অগ্রসর হয়। এবং  যৌথ কারণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় মিশ্রিত হয় অথবা সহাবস্থান করে। আপনারা আজকের দিনে বিকাশের এই প্যাটার্ন অধিক মাত্রায় দক্ষিণ বিশ্বে দেখতে পাবেন। গ্রামীণ কৃষকেরা যারা কোন রকমে প্রাণ ধারণের জন্য কৃষিকাজ করে, অথবা শহরের বস্তিবাসীদের পাশাপাশি অবস্থান করে সবচেয়ে অগ্রসর ফ্যাক্টরিসমূহ ও প্রযুক্তি। দুঃখজনক, অবিস্মরণীয় এবং অসমভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্ব পুঁজিবাদ দ্বারা রূপান্তরিত হওয়াতে ত্রৎস্কির পরিজ্ঞানসমূহের (insights) প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে যদিও অনেক কৃষক পরিবর্তনের জন্য  সংগ্রামকে সমর্থন দেন (১৯০৫ সনের বিপ্লবে তিনি মোটের উপর তাঁদের নিকট পৌঁছার প্রচেষ্টার অংশীদার হন), তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন এবং ব্যক্তিক উৎপাদনে জড়িত থাকেন। এগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কেন্দ্রে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়।

রাশিয়াতে বিকাশমান পুঁজিবাদী পথ খুবই ক্ষমতাশালী শ্রমিকদের ঘনীভবন সৃষ্টি করে, এই মানুষেরা  ১৯০৫ সনের বিপ্লবের কেন্দ্রে ছিলেন। জারদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য কেবলমাত্র শ্রমিকেরাই বিজয়দৃপ্ত সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারতেন, কিন্তু তাঁরা আরও লক্ষ্য করলেন যে  পুঁজিপতিদের হাতে অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে কেবলমাত্র পুঁজিবাদের সীমানার ভেতরে  গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্যই নয়, তাঁরা শ্রমিকদের ক্ষমতার জন্য, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যও সংগ্রামে লিপ্ত।

ত্রৎস্কি অবশ্য জানতেন যে তখনও রাশিয়াতে শ্রমিকেরা সংখ্যালঘু। যে কোন বিপ্লবের সফল বিজয়ে এবং  সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বৈশ্বিক পরিস্থিতি- যেমন অধিকতর উন্নত পুঁজিবাদী দেশকগুলোতে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ার উপর নির্ভর করতো। আমরা দেখতে পাই ত্রৎস্কি তাঁর জীবন এই আন্তর্জাতিকতবাদের উপর দাঁড়ান। সাম্রাজ্যবাদের বাস্তবতায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রক্রিয়াকে এখন আমরা বিশ্বায়ন বলি। এর উপর তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ দাঁড়িয়ে আছে।

বর্তমানে দুনিয়ার প্রত্যেকটি দেশে পুঁজিবাদ কর্তৃক করে, যদিও এমন অঞ্চল আছে যেখানে শিল্প শ্রমিকেরা  সংখ্যালঘু। স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব নির্দেশ করে যে  কেন ঐ সমস্ত দেশে শ্রমিকেরা পরিবর্তনের মূল শক্তি। পুঁজিবাদকে থামিয়ে দিতে শ্রমিকদের রয়েছে যৌথ শক্তি। নির্যাতিত গ্রুপ ও অসংগঠিত, গ্রামীণ ও ঠিকা শ্রমিকদের সম্ভাবনাময় বিস্ফোরণোম্মুখ প্রতিরোধে তাঁদের সংগ্রাম প্রভাব ফেলতে পারে এবং সংগঠন দিতে পারে। কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য কার্যকর সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের জন্য  সর্বব্যাপী সংগ্রামে মোড় নেয়- সেই ব্যাপারে ত্রৎস্কির তত্ত্ব নির্দেশনা দেয়।

তিনি কখনও দাবী করেননি যে এটি অনিবার্য। স্থায়ী বিপ্লব হল বিকল্পে তত্ত্ব।  গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে একীভূত করার সম্ভাবনা বিদ্যমান, কিন্তু যারা কেবলমাত্র বুর্জোয়া রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তারাও সংগ্রামটিকে দখল করতে পারে (বিস্তারিতভাবে দেখুন, Tonny Cliff's1963 pamphlet Deflected Permanent Revolution available at www.marxists.org)।

পুঁজিবাদী পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের স্তরের ভেতর দিয়ে যাওয়া ব্যতিরেকেই রাশিয়াতে গণতন্ত্র এসেছিল ওয়ার্কার্স কাউন্সিল রূপে। পশ্চিম ইউরোপের যে প্রান্তে পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছিল সেখানে যে সমস্ত পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিকে যেতে হয়েছিল সেগুলো ব্যতিতই রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব ছিল বলে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন। এটি কেবলমাত্র প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারতো- একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে, যদি বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। সদর্থক ও নঞঅর্থক উভয় অর্থেই ত্রৎস্কির তত্ত্বকে ১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লব সমর্থন করে।

ছয়. যুদ্ধের পরীক্ষা

অষ্ট্রিয়ার আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকান্ডের কারণে ১৯১৪ সনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বাস্তবে এটি ছিল পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীতা ও সম্প্রসারণের যুদ্ধ, যা বিশ্ব ইতিহাসের দেখা সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধ। এতে ১.৭ মিলিয়ন রুশ ও ১.৮ মিলিয়ন জার্মানসহ কমপক্ষে মোট ১০ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়। এটি ছিল প্রথম যুদ্ধ যাতে সমগ্র অর্থনীতি ও সমগ্র সমাজ আকৃতি পেয়েছিল যুদ্ধ তাড়নায়।
জাতীয়তাবাদের ঢেউ সৃষ্টি করে প্রত্যেক জাতির শাসকগোষ্ঠী তাদের যুদ্ধ লক্ষ্যের সমর্থন নিশ্চয়তাকরণে সবকিছুই করেছিল। ইউরোপ খুনোখুনিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে আওয়াজ ধ্বণিত করে তাকে ত্রৎস্কি অভিহিত করেন “পুঁজিবাদী শেয়ালের দেশপ্রেমমূলক চিৎকার হিসেবে”।
যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রাক্কালে সকল প্রধান সমাজতান্ত্রিক সংগঠনসমূহ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে শপথ নেয়। এই সংগঠনগুলো দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছিল (প্রথম আন্তর্জাতিক ছিল মার্কসের সময়ে)। যাহোক, যুদ্ধ শুরু হলে, এই একই সমাজতন্ত্রী দলগুলোর অধিকাংশ যুদ্ধের সমর্থনে তাদের নিজেদের সরকারের পক্ষে দাঁড়ায়। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল রুশ সমাজতন্ত্রীরা, বিশেষ করে বলশেভিকরা, সার্বিয়ান সমাজতন্ত্রীরা এবং বাদবাকী ইউরোপের স্বল্প সংখ্যক মিলিট্যান্টরা।
দ্বিতীয়বারের মত সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে যুদ্ধের প্রারম্ভে ত্রৎস্কি ভিয়েনাতে বাস করতেন। অষ্টিয়ার সরকারে থেকে থেকেই তাঁকে হুমকি দিলে তিনি সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান। তিনি এখানে যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক শিরোনামে সংক্ষিপ্ত পাম্ফলেট লিখেন। এটি ছিল রুশ বিপ্লবী কর্তৃক লিখিত প্রথম যুদ্ধ-বিরোধী বিবৃতি।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ ছিল জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (SDP)। পাম্ফলেটটি ছিল প্রধানত এর বিশ্বাসঘাতকারা বিরুদ্ধে আক্রমণ। যুদ্ধে SDP-এর সমর্থনে ত্রৎস্কি ও লেনিন মর্মাহত হন।
অসংখ্য সদস্যসহ SDP-এর ছিল বিশাল নির্বাচনী যন্ত্র (electoral machine)। এটি অভিযোজিত হতে শুরু করেছিল পুঁজিতন্ত্রী ঘেরের মধ্যে কাজ করতে।
কিছু SDP সদস্য যুক্তি দেন যে তাঁরা যুদ্ধে জার্মানিকে সমর্থন দিচ্ছিলেন, কারণ জার্মানি ছিল জার রাশিয়া থেকে অধিক প্রগতিশীল। ত্রৎস্কি এতে ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি দেখান যে অন্য আর একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপে সহায়তার পরিবর্তে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে রাশিয়াতে জারের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম।
ত্রৎস্কি যুদ্ধের বিরোধিতার থেকেও অধিক কিছু করতে চাইলেন। তিনি যুদ্ধে তাড়না সৃষ্টিকারী শক্তিটিকে আরও বুঝতে চাইলেন। তিনি যুক্তি দেন যে জাতি রাষ্ট্রের কাঠামোকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শক্তি অতিক্রম করে গেছে। যেহেতু অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্রসমূহ আরও অধিকতর সমন্বিত বিশ্ব বাজারে ক্ষমতার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে, তাই যুদ্ধ হচ্ছে পুঁজিবাদের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। নির্যাতিত জাতিসমূহ এবং জনগণের অভ্যুত্থানের জন্য আত্ম-স্থিরীকরণের (self-determination) ভিত্তিতে তিনি শান্তির জন্য আহ্বান জানান।
যুদ্ধ অনেক পুরাতন আনুগত্যকে (allegiance) নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দেয়। জার্মান SDP যাকে তিনি দেখেছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে সবথেকে ‍গুরুত্বপূর্ণ পার্টি হিসেবে সেই পার্টির সাথে সম্পর্ক ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে ত্রৎস্কি তাঁর পুরাতন কমরেড ও বন্ধুর সাথেও সম্পর্কছেদ করেন। তিনি এমনকি তাঁর পুরাতন বন্ধুদের মধ্য থেকে এক প্রাণবন্ত বন্ধুর জন্য শোক গাঁথা লেখেন যিনি যুদ্ধ সমর্থকে পরিণত হন। একই সময়ে তিনি ইউরোপে যে ব্যক্তিবর্গ যুদ্ধের বিরোধিতা করেন তাঁদের থেকে নতুন বন্ধু তৈরী এবং স্থায়ী রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
যুদ্ধের সময়ে বলশেভিকদের দৃঢ় সাংকল্পিক যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং মেনশেভিকদের জাতীয়তাবাদের প্রতি ছাড় (concession) ও দোদুল্যমানতার মধ্যে পার্থক্য বৃদ্ধিপাচ্ছিল। প্রথমবারের মত ত্রৎস্কি মেনশেভিকদের সাথে তার পূর্ব মতবিরোধ প্রকাশ করেন, যদিও তখন পর্যন্ত তিনি বলশেভিকদের সাথে যোগ দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
১৯১৫ সনের সেপ্টম্বরে সুইজারল্যান্ডের জিমারভ্যাল্ড সম্মেলনে ত্রৎস্কি সহায়তা করেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরোধী কর্মীদের একত্রে কাজ করতে। এগারোটি দেশ থেকে আটত্রিশ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। সম্মেলনটি ক্ষুদ্র হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি পরস্পর যুদ্ধরত দেশগুলোর সমাজতন্ত্রীদের ও নিরপেক্ষ দেশসমূহের সমাজতন্ত্রীদের একত্রিত করে। ত্রৎস্কি ও লেনিন উভয়েই একমত হন যে আন্তর্জাতিক লাইন ত্যাগ করেছে এবং এটিকে সংস্কার করা সম্ভব নয়। জিমারভ্যাল্ড সম্মেলন থেকেনতুন আন্তর্জাতিকের যাত্রা শুরু হয়।
এই সময়ে ত্রৎস্কি প্যারিসে বসবাস করছিলেন। এখানে তিনি যুদ্ধের ‍উপর রিপোর্ট করছিলেন এবং একটি সমাজতন্ত্রী পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন। ১৯১৬ সনের অক্টোবলে তিনি স্পেনে নির্বাসিত হয়। তারপর তিনমাস পর তিনি পুনরায় নিউইয়র্কে নির্বাসিত হন। তিনি লেখেন “আমি রক্তে নিমজ্জিত ইউরোপ রেখে গেলাম কিন্তু আমি আসন্ন বিপ্লবে গভীর বিশ্বাস রেখে গেলাম” (Leon Trotsky, My Life, p-260)।


সাত. ১৯১৭: রাশিয়াতে বিপ্লব 

১৯১৭ সনের ফেব্রুয়ারিতে সেন্ট পিটার্সবার্গে নারীদের বিক্ষোভ ও ধর্মঘট বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত করে, যুদ্ধের সময়ে সেন্ট পিটার্সবার্গের নতুন নামকরণ করা হয় পেত্রোগ্রাদ। এতে জার উৎখাত হন এবং নতুন সাময়িক সরকার ক্ষমতায় আসে, এই সরকারে উদারনীতিক পুঁজিবাদীদের প্রাধান্য ছিল। লেনিন পরের মাসে রাশিয়াতে ফিরে আসেন, একে তিনি তাঁর দেখা সমাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মুক্ত সমাজ বলে বর্ণনা করেন, যাতে শ্রমিকেরা ও সৈনিকেরা বির্তক ও আলোচনায় রত এবং সংগঠিত।

নতুন সাময়িক সরকার খুবই অস্থিতিশীল ছিল। বিপ্লব জার থেকে মুক্ত করেছিল, কিন্তু রাশিয়ার সাধারণ জনগণের সামনের সমস্যাগুলো ছিল চলতি যুদ্ধ যার  প্রতি সাময়িক সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, দারিদ্র্য, ভূমিস্বামীদের শাসন, জাতীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন এবং পুঁজিপতি শ্রেণী কর্তৃক শ্রমিকদের শোষণ, এগুলোর সমাধান করতে পারছিল না।

১৯০৫ সনের বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিকেরা সংগঠন ও বিতর্কের কেন্দ্র হিসেবে সোভিয়েতসমূহ পুনঃসৃষ্টি করেন। রাশিয়াতে পরস্পর বিরোধী দু’টি ক্ষমতা কেন্দ্র, যেমন সাময়িক  সরকার সোভিয়েতের “দ্বৈত ক্ষমতা”-এর অস্তিত্ব ছিল। এই দু’টি কেন্দ্র একই ভবন থেকে পরিচালিত হতো।

মে মাসে ত্রৎস্কি রাশিয়া পৌঁছে দেখতে পেলেন যে তাঁদের পূর্ব মতনৈক্য সত্ত্বেও তিনি এবং লেনিন বিপ্লবের সামনের মূল প্রশ্নগুলোতে এখন একমত। যখন লেনিন রাশিয়াতে ফিরেন, তখন কার্যত ত্রৎস্কির মত একই অবস্থানের যুক্তি দিয়ে তিনি প্রত্যেইককে হতাশ করলেন, তা হল বিপ্লবকে সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করতে হবে। এখন তাঁর পক্ষে ত্রৎস্কি বিপ্লবে বলশেভিক পার্টির গুরুত্ব দেখতে পেলেন। ত্রৎস্কি ও তাঁর অনুসারীরা লেনিনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে  কাজ করলেন এবং ১৯১৭ সনের জুলাই মাসে বলশেভিকদের সাথ যোগ দিলেন। যেকোনও প্রার্থীর চেয়ে বেশী ভোট পেয়ে ত্রৎস্কি বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রায় তৎক্ষণাৎ নির্বাচিত হলেন।

১৯০৫ সনের মতই সোভিয়েত ছিল বহুদলীয়, গণতান্ত্রিক সংগঠন যেখানে শ্রমিকেরা ও সৈনিকেরা বিতর্ক করত ও সংগঠিত হত। যখন ত্রৎস্কি রাশিয়াতে ফিরে আসেন, তখন সোভিয়েতে মেনশেভিকরা ও অন্যান্য মধ্যপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। তারা কেবলমাত্র সাময়িক সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সরকার হিসেব করে দেখেছিল যে পদক্ষেপটি নিজেদের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং বিপ্লবের দাবীকে সীমিত করতে সহজ করবে। তাঁর ফেরার পরের দিনই ত্রৎস্কি সোভিয়েতে গেলেন এবং এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে স্পষ্ট বললেন যে বিপ্লবের সামনের জরুরী সমস্যাসমূহ এটি সমাধান করতে পারবে না।

বলশেভিক পার্টির  অভ্যন্তরে লেনিন যুক্তি দিলেন যে  তাঁদের শ্রমিকদের নিকট “ধৈর্য্য সহকারে ব্যাখ্যা” করা দরকার, তাঁদের জয় করে বুঝাতে হবে যে বিপ্লবকে কেন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে পেত্রোগ্রাদের শ্রমিকেরা ও সৈনিকেরা যুদ্ধ ও লাগাতার শোষণে অতিষ্ট হয়ে ইতোমধ্যে ‍উপসংহারে এসেছিল যে বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ধাবিত করা দরকার, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠরা তখনও সাময়িক সরকারের প্রতি তাঁদের প্রত্যাশা স্থাপন করেছিল। জুলাইয়ে লেনিন ও ত্রৎস্কি পেত্রোগ্রাদে অসময়োচিত ক্ষমতা দখলকে বন্ধ করতে চেষ্টা করেন, তাঁরা যুক্তি দেন যে তাঁরা রাজধানীতে ক্ষমতা দখল করতে পারেন, কিন্তু বাদবাকী দেশ অনেক পশ্চাৎপদ ছিল।

এই অধ্যায়টি “জুলাই দিবস” হিসেবে পরিচিত ছিল যার অনুগামী হয়েছিল বলশেভিকদের নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা। তাঁদের অনেককেই বন্দীশালায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল, এবং লেনিন  ও অন্য দু্ই নেতৃস্থানীয় বলশেভিকদের জন্য গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। লেনিন আত্মগোপন করলেন। তিনি লেনিনের সাথে একমত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পরোয়ানা জারি করা হল না- এই মর্মে ত্রৎস্কস্পর্ধাভরে চিঠি বিতরণ করে দাবী জানালেন। কয়েক সপ্তাহ পরে তাঁকে যথারীতি গ্রেফতার করা হল। সমায়িক সরকার দৃশ্যত (supposedly) বিপ্লবের সরকার হলেও, তারা তাঁকে একই বন্দীশালায় নিক্ষেপ করেছিল যাতে ১৯০৫ সনের বিপ্লবের পতনের পরে জার তাঁকে বন্দী করে রেখেছিল।

প্রশাসনে অস্থিতি বিরাজ করছিল- অনেক শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকেরা নয়া প্রশাসনের প্রতি অতিষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু একইভাবে দক্ষিণপন্থীরাও। আগস্টে জেনারেল করনিলভ ক্যু সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন। যে সরকার তাঁদের জেলে নিক্ষেপ করেছিল ক্যু-এর সম্মুখীন হয়ে বলশেভিকরা সেই একই সরকারের পক্ষাবলম্বন করলেন।

সাময়িক সরকার বাধ্য হয় বলশেভিকদের জেল থেকে মুক্তি দিতে যাতে তাঁরা বিপ্লব রক্ষায় সহায়তা করতে পারে। ক্যু পরাজিত করতে যে সুস্পষ্ট ভূমিকা তাঁরা পালন করেন, তাতে জনগণের নিকটত প্রমাণিত হয় যে তাঁরা সবথেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিপ্লবের অর্জনকে রক্ষা করতে সমর্থ। একটা গুলি খরচ না করেও করনিলভকে পরাজিত করা হয়। ত্রৎস্কি তখন সোভিয়েতে যান এবং মেনশেভিক নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহনের উদ্যোগ নেন। তাঁকে আশ্চর্য করে দিয়ে এটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠায় পাশ হয়। সোভিয়েতে বলশেভিকরা  সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং ত্রৎস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে ধাক্কা দেয়া অথবা সাময়িক সরকারের প্রতি থিতু হওয়া- এই দু’টির মধ্যে বাছাইয়ের সময় ছিল না। প্রশাসনের দুর্বলতার অর্থই হচ্ছে  যে হয়  বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে হবে অথবা এটি প্রতিবিপ্লবের সম্মুখীন হবে। ক্যু এটিই প্রমাণ করে।

এই সময়কালে জনগণের মধ্যে  সোভিয়েতের তৃণমূলে কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। নির্দেশনার জন্য ফ্যাক্টরিসমূহ ও সশস্ত্র এককসমূহ সোভিয়েতকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে। রাশিয়াতে সোভিয়েত ধীরে ধীরে  প্রকৃত সিদ্ধানকারী সংস্থা হয়ে উঠে। ১৯১৭ সনের অক্টোবরে ত্রৎস্কি অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে সহায়তা করেন যাতে চুড়ান্তভাবে দেখা যায় যে বলশেভিকরা সোভিয়েতকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ক্ষমতা গ্রহণে। যেহেতু কর্তৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং জনগণের আস্থা ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছিল, তাই রাজধানীতে বিপ্লব ছিল প্রায় রক্তপাতহীন।

লেনিন চেয়েছিলেন যে  সোভিয়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলশেভিক পার্টি অভ্যুত্থানের ডাক দিক কিন্তু ত্রৎস্কি তাঁকে বুঝান যে পার্টি খুবই সংকীর্ণ একটি সংগঠন, এবং এটির ডাক দেয়া উচিত এবং সংগঠিত করা উচিত সোভিয়েতসমূহের। ত্রৎস্কির নেতৃত্বে সামরিক কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে অন্যান্য বামপন্থী সমাজতন্ত্রীএবং নৈরাজ্যবাদী যারা জড়িত ছিলেন- তাঁদের সহ প্রধানত বলশেভিকরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্র-ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো দখলের সময় এবং বিস্তারিত প্রস্তুতি গ্রহণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।

কার্ল মার্কস বলেছিলেন যে অভ্যুত্থান একটি শিল্পকলা। অন্যকথায়, এতে কিছু সহজাত ক্ষমতা ও কল্পনা শক্তি, সাথে সাথে দৃঢ় সংগঠনের দরকার হয়। ১৯১৭ সনে ত্রৎস্কি এই সহজাত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। অক্টোবর বিপ্লবে তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিক ও সৈনিক, এবং গুরুত্বপূ্র্ণভাবে বলশেভিক পার্টির অনেক সদস্য- যাদের কর্মক্ষেত্রে, সম্প্রদায়ে ও সৈন্যবাহিনীতে শেকড় ছিল এবং বিপ্লবের জন্য লড়াইয়ে যাদের রাজনীতি ও সংগঠন ছিল দীর্ঘ বছর ব্যাপী সাধারণ জনগণের মাঝে সংগ্রামে, তাঁদের ছাড়া বিপ্লব সম্ভব হত না।


আট. নতুন সমাজের যাত্রা 

সোভিয়েতের উপর ভিত্তি করে অক্টোবর বিপ্লব নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল, যেটি ছিল রাশিয়াতে দেখা সবথেকে গণতান্ত্রিক সংগঠন। ত্রৎস্কিকে নতুন রাষ্ট্রের পৌরহিত্য করতে বলা হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন, সুতরাং লেনিন সোভিয়েত রাশিয়ার নেতা হন।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক দারিদ্র্য এবং নতুন সমাজের ঠিক অস্তিত্বটিই হুমকীর সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও  বিপ্লব সূচনা করে পৃথিবীর যেকোন জায়গায় এ পর্যন্ত দেখা  সবথেকে স্বাধীন (libertarian) এবং গণতান্ত্রিক পদক্ষেপসমূহ।

শ্রমিকেরা ফ্যাক্টরি নিয়ন্ত্রণ করত এবং ভূস্বামীর নিকট হতে জমি ছিনিয়ে নিল তাঁরাই যারা এতে কাজ করত।

জার্মানির সাথে শান্তি চুক্তির জন্য আলেচনা করতে ত্রৎস্কিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যা অনেক বিতর্ক ও নাটকের পর রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে বের করে আনে। রুশ সাম্রাজ্য কর্তৃক নির্যাতিত জাতিসমূহকে স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়।

ত্রৎস্কি প্রায়ই বলতেন যে নারীর প্রতি এর যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা দিয়েই কোন মানব সমাজকে শ্রেষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করা যায় (Leon Trotsky, Women and the family, New york, 1973, p-42)। রাশিয়া ছিল এমন একটি সমাজ যেখানে নারীর প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন গভীরভাবে প্রেথিত ছিল। অনেকেই নারীকে দেখত পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে।

বিপ্লবী প্রশাসন (regime) এই অবস্থার রূপান্তর করেন। নারীদের ভোটাধিকার, পূর্ণ নাগরিকত্ব, সমান মজুরি, কাজের অধিকার দেয়া হয়। পৃথিবীতে গর্ভপাতের আইনি বৈধতা দেয়া প্রথম দেশ ছিল বিপ্লবী রাশিয়া। সমকামীতাকেও বৈধতা দেয়া হয়।


অবৈধ সন্তানের ধারণাকে উচ্ছেদ করা হয়। বিবাহে যেকোনও সঙ্গী অন্য সঙ্গীর নাম  নিতে পারত। ত্রৎস্কি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নাতালিয়া সেদোভার নাম নেন সরকারী দলিলগুলোতে, তাঁদের ছেলেমেয়েরাও তাই করেন।  যেকোন সঙ্গীর অনুরোধে বিবাহ বিচ্ছেদ লভ্য ছিল। ‍

ত্রৎস্কি বুঝেছিলেন যে আইনি সাম্য কেবলমাত্র শুরু হয়েছে। সোভিয়েত রাষ্ট্র নারী নির্যাতনের বস্তুগত অবস্থা দূরী করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল সামষ্টিক (communal) শিশু-যত্ন, রান্না ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির ব্যবস্থা করে।

সাম্যের প্রতি দায়বদ্ধতা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, গৃহ যুদ্ধে অর্থনীতি ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও  বিপ্লবের চার বছর পরে শিশু মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছিল। ,
 
বিপ্লব শিক্ষাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্র রূপান্তরিত করেছিল। স্কুলের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছিল এবং রাশিয়াতে নিরক্ষরতার উচ্চ মাত্রা সামাল দেয়া শুরু করতে  নতুন রাষ্ট্র প্রচারাভিযান সংগঠিত করেছিল।  বিশ্ববিদ্যালয় ফি রদ করা হয়েছিল। গ্রন্তাগারসমূহের সম্প্রসারণে লেনিন ও ত্রৎস্কি উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী ছিলেন। যেহেতু শিখনের জন্য প্রেষণাতে পরিবর্তন এসেছিল, তাই স্বয়ং শিখনের প্রকৃতিতেও একই ঘটনা ঘটেছিল, যেমন পরীক্ষা প্রথার বিলুপ্তি।

তাঁর সারা জীবনে ত্রৎস্কি সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের প্রশ্নে উৎসাহী ছিলেন। সেখানে মানবিক অস্তিত্ব ও অভিব্যক্তির সকল প্রশ্নে ব্যাপক গণ-আগ্রহও জাগরিত হয়েছিল, যেহেতু বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ তাঁদের অর্থনৈতিক বিশ্বকে রূপান্তরিত করতে প্রচেষ্টিত ছিল। বিপ্লব শিল্প, কবিতা ও চলচিত্রে নিরীক্ষার ঢেউকে উৎসাহিত করেছিল।

ভিকতর সার্জ একজন নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। তিনি গৃহ যুদ্ধের সময় বলশেভিকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। বিপ্লবের পরে এমনকি গৃহ যুদ্ধের সময়ে তিনি শিল্পের প্রতি অঙ্গীকার দেখে আলোড়িত হয়েছিলেন। ১৯১৯-এর জুনে যখন পেত্রোগ্রাদ অবরুদ্ধ ছিল, তখন  তিনি লেখেন, “গৃহ যুদ্ধের প্রতিটি ঘন্টায় সৌন্দর্য্, বৈরাগ্যতা (stoicism), সামর্থ ও বিশ্বাসের জন্য দুর্দমনীয় অভিযাত্রায় আমি আবিষ্কারে সহায়তা করতে পারছি না। নিঃসন্দেহে লাল নগর দুর্যোগে ভুগছে ও যুদ্ধ করছে যেন একদিন অবকাশ ও শিল্প সকলে সম্পত্তি হয়”। (Victor Serge, Revolution in Danger: Writtings from Russia 1919-21, London, 1997, p 13) ।
 
আগ্রাসন ও গৃহ যুদ্ধ রাশিয়ার অর্থনীতিতে রাষ্ট্র কি করতে সমর্থ ছিল তা ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ করেছিল। এসব সত্ত্বেও  সংক্ষেপে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল তখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে সাম্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ।


নয়. বিপ্লবের সশস্ত্রায়ন

 

অক্টোবর বিপ্লবের পর পরই নতুন প্রশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিসমূহ সংগঠিত হতে শুরু করে। অভ্যুত্থানের ঠিক এক মাস পরেই পুরাতন জারতন্ত্রী প্রশাসনের অনুগতরা হামলা শুরু করে। একই সাথে কিছু কসাক ও ধনী কৃষকও বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে শুরু করে।

নতুন শ্রমিক রাষ্ট্র কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ বিরোধীতার সম্মুখীন হয়নি, এটি আগ্রাসন, অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ ও শত্রুতার সম্মুখীন হয়েছিল সকল প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিকট হতে। ১৯১৮ সনের প্রথমা্র্ধে ডজনাধিক পুঁজিবাদী সেনাবাহিনী সোভিয়েত রাষ্ট্রকে আক্রমণ করেছিল। এদের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরি্কা ও জাপান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে বিপ্লবী প্রশাসনের অস্তিত্বই বিপদগ্রস্থ ছিল।

১৯১৮ সনের জানুয়ারিতে লেনিন সরকারীভাবে  শ্রমিক ও কৃষক লাল বাহিনী গঠন করেন। দুই মাস পরে ত্রৎস্কি যুদ্ধ বিষয়ক কমিশার নিযুক্ত হন এবং যুদ্ধ কাউন্সিলের সভাপতি হন। ত্রৎস্কির কোন সামরিক প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছিল না, যদিও তিনি সামরিক লেখালেখিসমূহ অধ্যয়ন করেছিলেন এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন বলকান যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ সম্পর্কে রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব পালন করে।
 
ত্রৎস্কি বিপুল কাজের সম্মুখীন হন। তাঁকে পাঁচ হাজার মাইল সীমান্ত অধ্যুষিত এলাকার নিরাপত্তা বিধান করতে হত এমন একটি সেনাবাহিনী দিয়ে, যাকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থা থেকে গড়তে হয়েছিল।

ত্রৎস্কি যদিও পুরাতন জারতন্ত্রী সেনাবাহিনী  ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি পারেননি, এটি কার্যকরভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। প্রায় ৯ মিলিয়ন সেনাবাহিনীর মধ্যে  কেবলমাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার মাত্র ১৯১৭ সনের বিপ্লবের পক্ষাবলম্বন করেন। সৈন্যদের আর যুদ্ধ করার আকাঙ্খা ছি ল না, কিছু পুরাতন বিপ্লবের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিলেন, এবং সেনাবাহিনীর কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল।
 
জনগণ যুদ্ধ-ক্লান্ত ছিলেন। বলশেভিকদের সফলতা ও জনপ্রিয়তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি  ছিল এই যে শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকাংশ কর্তৃক অনুভূত যুদ্ধ-বিরোধী  ভাবনা ও অনুভূতিকে তাঁর স্পষ্ট ভাষায় রূপদানে সক্ষম হন। তখন ত্রৎস্কি সনাক্ত করেছিলেন যে যদি সেনাবাহিনীকে সফল হতে হয়, তবে এর কেন্দ্রে (core) থাকতে হবে বিপ্লবে বিশ্বাসী জনগণ, যারা সংগ্রাম করেছিলেন এমন একটা কিছু রক্ষা করতে যার প্রতি গভীরভাবে আগ্রহান্বিত ছিলেন।

যখন তিনি লাল বাহিনী গড়তে শুরু করেন, তখন তিনি ভলান্টিয়ারের জন্য সর্নিবন্ধ আবেদন জানান।  তিনি সেই সমস্ত শ্রমিকদের দিয়ে  সেনাবাহিনীর শাঁস গঠন করেন, যাদের মধ্যে প্রত্যয় জন্মেছিল যে বিপ্লবকে রক্ষা করা উচিত। ১৯১৮ সনের এপ্রিল নাগাদ প্রায় ২০০,০০ জন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসেন।

যাহোক, রাশিয়াকে আক্রমণ করেছিল উচ্চমাত্রায় অস্ত্রে সজ্জিত বিশাল সেনাবাহিনী, তাকে পরাজিত করার জন্য ভলান্টিয়ারের সংখ্যা ছিল ‍খুবই স্বল্প। ত্রৎস্কি সেনাবাহিনী গড়তে বাধ্যতামূলক সেন্য নিয়োগে বাধ্য হলেন।  এতে সেনাবাহিনীতে বিপুল  সংখ্যক কৃষক এসেছিল এবং এটিকে রাজনৈতিকভাবে ও সাংগঠনিকভাবে  অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। অনেক কৃষকেরই বলশেভিকদের প্রতি পরস্পরবিরোধী মনোভঙ্গি ছিল। পুরাতন ভূ-স্বামীদের  নিকট থেকে জমি অধিগ্রহণ কর তাদের দেয়া হয়েছিল বলে তারা খুশী ছিল, কিন্তু নগরগুলোর খাদ্য ঘাটতি মেটাতে বলশেভিত প্রশাসনের জন্য শস্য রিকুইজেশন তারা বিরোধিতা করেছিল।

এ রকম কঠোর অবস্থার মধ্যে  সেনাবাহিনী  গঠনের অর্থ ছিল এই যে ত্রৎস্কিকে বর্ধিতভাবে  কঠোর শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হচ্ছিল। যখন এটি  প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন পুরাতন জারতন্ত্রী  সেনাবাহিনীর নিবর্তনমূলক ক্রমাধিকারতন্ত্রের (hierাািনarchy) সাথে স্পষ্ট ছেদ ঘটিয়ে লাল বাহিনীতে সৈনিকেরা তাঁদের অফিসারদের নির্বাচিত করতে পারতো। সেনাবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে  এবং কিছু  ফ্রন্টে অপারেশন  কেন্দ্রীভূত করতে অধিকতর আনুষ্ঠানিক শৃঙ্খলার দরকার হয়ে পড়ে বলে এটি বিলোপ করা হয়। তারপরেও ত্রৎস্কি সাধারণ (rank and file) সৈনিকদের জন্য শ্রদ্ধার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।  জেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অন্যায় ব্যবহারের  প্রচন্ড বিরোধিতা করতেন, তা শারিরীক ও মানসিক এই উভয় প্রকারের অভ্যাঘাতই।

কারণ প্রশিক্ষণ ও কৌশল বিকাশের জন্য লাল বাহিনীর কোন শান্তিপূর্ণ সময় ছিল না, এর কৌশলগত দক্ষতা ও সামাজিক অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। বিতর্কিতভাবে, তিনি জারতন্ত্রী সেনাবাহিনীর অফিসার নিয়োগ করেছিলেন সামরিক বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালনের জন্য, তবে ভারসাম্য রক্ষার জন্য  রাজনৈতিক কমিশারদের  সেনাবাহিনীতে প্রেরণ করা হয়েছিল বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা পর্যবেক্ষণের জন্য। ত্রৎস্কি কমিউনিস্টদের (যেহেতু বলশেভিকদের তখন তাই বলা হতো) সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য  আহ্বান জানিয়েছিলেন সৈন্যদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করতে অনানুষ্টানিক ভূমিকা পালনের জন্য।

গৃহযুদ্ধের সময় ত্রৎস্কি মূর্ত ভূ্মিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি লিখেছিলেন যে তিনি ব্যাপক সময় যাত্রীবাহী ট্রেনে থাকতেন, ফ্রন্টলাইনে যেতেন, সেনাবাহিনীর অবস্থা তদারকি করতেন, সৈনিকদের সাথে কথা বলতেন, কৌশল-উন্নয়নের জন্য কাজ করতেন।

গৃহযুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিপ্লব অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল। বিপ্লব রাষ্ট্রের বিরোধী “শ্বেত” বাহিনীর রুশরা রাজধানী পেত্রোগ্রাদ থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরের একটি শহর দখল করে নিয়েছিল। নগরের উপকন্ঠসমূহে শত্রুর ট্যাংকগুলো  দেখা দিয়েছিল। লেনিন নগর থেকে পশ্চাদাপসারণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ত্রৎস্কি জোর দেন যে তাঁরা অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনমত গেরিলা যুদ্ধকৌশলের সাহায্যে পেত্রোগ্রাদ রক্ষা করবেন। ত্রৎস্কি এমনকি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পশ্চাদ্ধাবনরত সৈন্যদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উৎসাহ দেন যুদ্ধ চালু রাখতে এবং ফলশ্রুতিতে চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন।

সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, ১৯২০ সনে লাল বাহিনীর জন্য যুদ্ধ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ত্রৎস্কির নেতৃত্বে এটি ছিল বিশাল অর্জন, কিন্তু দশ সহস্রাধিক জনতা যারা সংগ্রাম করেছিলেন এবং  অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম করতে তাঁদের দৃঢ়সংকল্প ত্যাগ ও সাহসে এটি অর্জিত হয়েছিল।

কিন্তু বিজয় এসেছিল বিশাল মূল্য দিয়ে। গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে নিবেদিত কর্মীবৃন্দ, সেরা কমিউনিস্টদের হাজারে হাজারে মারা যান। শিল্পকারখানা এং অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

দশ. বিপ্লবের সঞ্চারণ

 

ত্রৎস্কি অভিমত পোষণ করতেন যে পৃথিবীকে বুঝতে হবে সমন্বিত ব্যবস্থা হিসেবে। তিনি  ও লেনিন উভয়েই সবসময় সমর্থন করতেন যে রাশিয়াতে বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে বিপ্লবের সঞ্চারণে।

রুশ বিপ্লবের প্রেরণা যুক্ত হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অভ্যুৎপাত ১৯১৮ থেকে ১৯২০-এ দুনিয়াব্যাপী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হয়।  ১৯১৮-এর নভেম্বরে জার্মান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে এবং “জনগণের কমিশার” কর্তৃক নয়া সরকার গঠিত হয়। হাঙ্গেরী  ও বাভারিয়াতে বিদ্রোহ স্বল্পস্থায়ী সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র নিয়ে আসে।  ইতালিতে ১৯১৯-২০-এর “লাল বছর” শ্রমিক জনগণের সংগ্রাম ও কারখানা দখল প্রত্যক্ষ করে। ১৯১৮-এ জঙ্গীত্বের ঢেউ স্পেনকে ভাসিয়ে দেয়।  ভ্যালেন্সিয়াতে ধর্মঘটীরা এমনকি কিছু সড়কের পুনঃনামকরণ করেন “লেনিন” এবং “অক্টোবর বিপ্লব”।

ব্রিটেনে ধর্মঘটের ঢেউ এবং অস্থিরতা দেখা দেয় দেশব্যাপী, ফরাসি ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। উপনিবেশসমূহে যেমন ভারত ও বিশেষভাবে মিশরে গণআন্দোলনের, এবং আয়ারল্যান্ডে গেরিলা যুদ্ধের সম্মুখীন হয় ব্রিটেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, অস্ট্রেলিয়াতে এবং কানাডাতেও ধর্মঘটের ঢেউ দেখা দেয়।

এটি ছিল সেই প্রেক্ষাপট যাতে বলশেভিকরা নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠিন প্রতিষ্ঠিত করেন, এটি পরিচিত পেয়েছিল তৃতীয় আন্তর্জাতিক  বা ‘কমিনটার্ন নামে। একই সময়ে লাল বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করে এবং যে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো  নয়া বিপ্লবী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল,তাদের থেকে একে রক্ষা করে বলশেভিকরা বিপ্লবের আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে আক্রমণে  গিয়েছিলেন।

সেই সময়ে লাল বাহিনীর নেতৃত্বে ব্যস্ত থাক সত্ত্বেও ত্রৎস্কি শুরু থেকে নয়া আন্তর্জাতিকে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রথম কংগ্রেসের দাওয়াতপত্র তিনি খসড়া করেন, এটি ১৯১৯-এ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পাঁচ বছরে সভা ও বিতর্কসমূহের দলিলায়নসহ তিনি আন্তর্জাতিকের অনেক ইশতেহার ও সিদ্ধান্ত লেখেন।

কমিনটার্নের ভিত্তি ছিল দু’টি মৌল নীতি- আন্তর্জাতিকতাবাদ, এবং সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যকার বিকাশমান প্রভেদ।

১৯১৪ সনে এই বিভাজন সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত হয়, যখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অনেক পার্টিই যুদ্ধে তাদের নিজেদের সরকারকে সমর্থন দিয়ে অধঃপতিত হয়। এই সময়ে লেনিন ও ত্রৎস্কি দৃঢ়ভাবে  বিপ্লব ও যথার্থ আন্তর্জাতিকতাবদের ওপর ভিত্তি করে একটি নয়া আন্তর্জাতিকের জন্য যুক্তি দেন।

বিদ্রোহের বিকাশমান ঢেউ যাতে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়, তাতে অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে ঐ স্পষ্টতা প্রয়োজন ছিল। অনেক সংগঠন যারা এখন নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেন, তারা সংস্কারবাদী ছিলেন।  পুঁজিতন্ত্রের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই কাজ করে তাঁরা পরিবর্তনের পথ দেখেন। 

অন্যদিকে নীচ থেকে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর কমিনটার্ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- এটিতে প্রয়োজন ছিল শ্রমিকের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়নে পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আপনারা ব্যবহার করতে পারেন- এই ধারণার প্রত্যাখ্যান।

১৯১৯-এ প্রথম কংগ্রেস একবারে ছোট ও অপ্রতিনিধিত্বশীল ছিল।  যা’হোক দুনিয়াব্যাপী বর্ধনশীল  অস্থিতিশীলতার অর্থ ছিল এই যে অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি অধিকতর র‌্যাডিক্যাল হন, এবং বর্ধিত সংখ্যক গ্রুপ কমিনটার্নে যোগ দেন। ১৯২০-এর গ্রীস্মে দ্বিতীয় কংগ্রেস নাগাদ তৃতীয় আন্তর্জাতিক গণ সংগঠনে পরিণত হয়।

ত্রৎস্কি ও লেনিন বিশ্বাস করতেন যে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পুঁজিতন্ত্রের মূল কেন্দ্রসমূহের একটি যেমন পাশ্চাত্যে  বিপ্লব দরকার। কিন্ত তাঁরা উভয়ে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক নির্যাতিতদের বিদ্রোহের গুরুত্বও অনুধাবন করেন।
ঞ্জাব
লাল বাহিনীর কাজে ফ্রন্টলাইনে থাক অবস্থায় ত্রৎস্কি যেমনটি লিখেছিলেন, “আফগানিস্তান, পাঞ্জাব ও বাংলার শহরগুলোর মধ্য দিয়ে প্যারিস ও লন্ডনের পথ বিদ্যমান” (Issac Deutscher কর্তৃক উদ্ধৃত, The Prophet Armed: Trotsky 1879-1921, London, 1954, pp 456-457 )।
 
উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেন, তাঁদের অনেকেই বলশেভিকদের নিকট থেকে, তাঁদের সফল বিপ্লব থেকে এবং নির্যাতিত জাতিসত্তাসমূহের প্রতি তাঁদের প্রগতিশীল পলিসিসমূহ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন।

দুনিয়াব্যাপী  নির্যাতিতদের নিকট পৌঁছতে বলশেভিকগণ বিশেষ পদক্ষেপ নেন। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২০-এ বলশেভিকগণ প্রাচ্য জনগণের কংগ্রেস সংগঠিত করেন আজারবাইজানের বাকুতে। প্রাচ্যে কীভাবে বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়া যায়  সেই ব্যাপারে এশিয়ার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে ২,০০০ প্রতিনিধি উপস্থিত হন।
 

এগার. যুক্তফ্রন্ট

কৌশল ও ‍উপায় (strategy and tactics)  সম্পর্কে মতবাদিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে কমিনটার্ন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত  থেকে বিপ্লবীদের একত্রিত করে। ত্রৎস্কি ও লেনিনের জন্য  এটি ছিল বিপ্লব সঞ্চারণের সমর্থনে মূল রণক্ষেত্র। ১৯২১-এর জুন-জুলাইয়ে তৃতীয় কংগ্রেস নাগাদ এটি স্পষ্ট দেখা যায় যে যুদ্ধের পরে বিপ্লবী সংগ্রামসমূহের প্রথম ঢেউ হতে পুঁজিতন্ত্র রক্ষা পেল।  এই প্রেক্ষাপটে কমিনটার্নের গ্রুপসমূহ যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তা হ’ল- যে অবস্থাতে যেখানে আসন্ন বিপ্লব স্থগিত সেখানে কীভাবে সংগঠিত হওয়া যায়। ত্রৎস্কি এই কংগ্রেসকে বললেন “বিপ্লবী কৌশলের সর্বোচ্চ স্কুল”।
 
এই কংগ্রেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে, যা আজকের দিনের কর্মীদের অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। এই বিতর্কে  এবং এর ঠিক পরের লেখাতে ত্রৎস্কি স্পষ্ট ও সহজ করে তাঁর ধারণা বললেন, যারা বিপ্লবী নয়, তাঁদের সঙ্গে কীভাবে বিপ্লবীদের কাজ করা উচিত নিয়মনিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধভাবে।

পুঁজিতন্ত্রের আক্রমণ ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে  ঐক্যের জন্য শ্রমিকদের যথার্থ প্রয়োজনানুভব থেকে প্রথমত যুক্তফ্রন্টের কৌশল  উদ্ভূত হয়। ত্রৎস্কি বলেন, “শ্রমিক জনগণ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কর্মে, তীব্র আক্রমণ প্রতিরোধে অথবা এর বিরুদ্ধে আক্রমেণ”। (Leon Trotsky, First Five years of the Communist International, Vol 2.London, 1974, p92)।
 
দ্বিতীয়ত, বিপ্লবী সংগ্রামের সর্বোচ্চ বিন্দুর বাইরে, কেবলমাত্র শ্রমিকদের ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশই বিপ্লবী ধারণাবলী ধারণ করেন। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে অধিকাংশ সময় অধিকাংশ জনগণ  অনুভব করেন যে  পুঁজিতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে তাঁদের জীবনের বিকাশের পথ বিদ্যমান, তাঁরা সংস্কারবাদী ধারণাবলী  গ্রহণ করেন। বিপ্লবীদের নিজেদের এই জনগণ হতে সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিত নয়।

ত্রৎস্কি আন্দোলনে চরমপত্র (ultimatums) উপস্থাপনের বিরুদ্ধে যুক্তি দেন। তিনি দৃঢ়তা সহকারে বলেন যে তাঁদের সাথে কাজ করবার পূর্বে  আপনারা যা বলবেন লোকজন তাতেই রাজি হয়ে যাবেন, এটি ঐক্য গড়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা নয়।
    এতে এটি বলা যায় না যে ত্রৎস্কি জনগণকে বিপ্লবী রাজনীতির সপক্ষে নিয়ে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর অভিমত ছিল যে ধারণাবলী সংগ্রামে পরিবর্তিত হয়, এবং সাধারণ লক্ষ্যের জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রক্রিয়াতে, বিপ্লবীদের সম্ভাবনা থাকে বিপ্লব কেন সম্মুখে ধাবমান, তা সংগ্রামের কষ্টিপাথরের মধ্য দিয়ে দেখতে।
    যখন তাঁরা প্রমাণ করেন যে কর্নিলভ কর্তৃক সংঘটিত ক্যু-এর বিরুদ্ধে  তাঁরা সেরা যোদ্ধা ছিলেন,  সেভাবেই ১৯১৭ সনে বলশেভিকগণ  বিপ্লবে জনগণকে জয় করেন। যেহেতু ছোট বা বড় জয় জনগণকে আত্মবিশ্বাস যোগাতে পারে, তাই যারা সংস্কারের জয়কে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেন তাঁদের বিরুদ্ধে ত্রৎস্কি যু্ক্তি দেন।
    সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ দেশে  বিপ্লবী গ্রুপগুলো  সংস্কারবাদীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন  করেছিলেন।  ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে  তাঁদের আলাদা হওয়ার অধিকার আছে এবং স্বাধীন  সংগঠন গড়ার অধিকার আছে, এবং এই স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত। তাঁদের অন্যদের সাথে এমনভাবে কাজ করা দরকার যে তা যেন এই পার্থক্যগুলোকে স্বীকার করে, কিন্তু তাঁদেরকে যেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে। 
    সংস্কারবাদী নেতাদের অবজ্ঞার বিরুদ্ধে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন। ঐকান্তিক  সংগ্রাম পরিচালনা করতে এই নেতৃত্ব যে অনাগ্রহী তা অনাবৃত করা হচ্ছে বিপ্লবীদের অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি। কিন্তু তাঁদেরকে পরিহার করে বা কেবলমাত্র নিন্দা করে তা করা যাবে না। তাঁদেরকে উম্মোচিত করতে হবে সংগ্রামের প্রক্রিয়াতে।
    আজকে ট্রেড ইউনিয়নবাদী ও প্রচারাভিযানকারীদের জন্য এর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। ত্রৎস্কি লেখেন যে যুক্তফ্রন্টের নির্ধারক মূলনীতি হওয়া উচিত, “জনগণের সাথে সর্বদা’ দোদুল্যমান নেতৃবৃন্দের সাথে কখনও কখনও, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তাঁরা জনগণের সামনে থাকে, কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও এই নেতৃবৃন্দের সমালোচনা পরিত্যাগ করা যাবে না। এবং যথাযথ সময়ে  তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা দরকার যখন তাঁদের দোদুল্যমান অবস্থা শত্রুতামূলক কর্ম ও বিশ্বাসঘাতকার দিকে ধাবিত হয়” (Leon Trotsky, Writings on Britain, Vol 2, London, 1974, p141)    
    যুক্তফ্রন্টের ধারণাতে ত্রৎস্কি বার বার ফিরে আসেন। ১৯৩০-এর দশকে মধ্যভাগে জার্মানী, ফ্রান্স ও স্পেনে ফ্যাসিবাদের উত্থান সম্পর্কে তাঁর লেখায় প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করেন- যেখানে ত্রৎস্কি স্তালিনের পপুলার ফ্রন্টের কৌশলের বিরোধীতা করেন, যখন শ্রমিকদের স্বার্থকে “উদারনৈতিক” পুঁজিতন্ত্রীদের স্বার্থের অধীনস্থ করা হয়।
    আজকের দিনে বিপ্লবীদের জন্য যুক্তফ্রন্ট একটি মূল কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে বিদ্যমান। ঐকান্তিক কার্যকর ঐক্যবদ্ধ প্রচারাভিযান গড়ে তোলা, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেন স্টপ দ্য ওয়ার কোয়ালিশন হ’ল এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এবং সংস্কারবাদী ধারণাবলীর রশি আলগা করতে যারা সংগ্রামে লিপ্ত তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ করা-এই উভয় বিষয়ে একটি পদ্ধতি দেয়।

বার. আমলাতন্ত্রের উত্থান


বলশেভিকদের গৃহযুদ্ধে বিজয়ীরূপে উত্থান ঘটে, কিন্তু রাশিয়া বিধ্বস্থ হয়। ১৯১৩ সনের তুলনায় ১৯২১ সনে মোট দেশজ উৎপাদন (Gross industrial production) মাত্র ৩১% হয়েছিল। বৃহদায়তন শিল্পের জন্য এটি আরও কম ছিল। ১৯১৩ সনের উৎপাদনের তুলনায় ইস্পাত উৎপাদন ৪%-এ নেমে আসে। পরিবহন স্থবির হয়ে পড়ে। জ্বালানী ঘাটতি,দুর্ভিক্ষ ও রোগব্যধি বিদ্যমান থাকে।
    শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লব করেছিলে, তাঁরাও ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক শ্রমিক গণ-বেকারত্বের সম্ভাবনার সম্মুখবর্তী হন এবং খাদ্যান্বেষণে গ্রামাঞ্চলে ফেরত আসেন।
    যে শ্রেণীটির অস্তিত্ব কদাচ বিদ্যমান, তাঁদের পক্ষে বলশেভিকদের এমন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়ভার অর্পিত হয়েছিল, যেটি দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত ছিল।
    লেনিন ও ত্রৎস্কির নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের সরকার অবকাঠামো ও অর্থনীতি পুনর্গঠনে নানাভাবে চেষ্টা করছিলেন। কীভাবে এটি করা হবে এই ব্যাপারে অনেক যুক্তি ছিল এবং কেউই এমনকি লেনিন ও ত্রৎস্কিও প্রত্যেক ইস্যুতে নিজেদের পথ পাচ্ছিলেন না।
    গৃহযুদ্ধের সময়ে অর্থনীতি নির্ভর ছিল কৃষকদের নিকট থেকে বাধ্যতামূলক খাদ্য সংগ্রহের উপর, এটি করা হচ্ছিল সেনাবাহিনী ও নগরাঞ্চলে শ্রমিকদের খাদ্য  সরবরাহের লক্ষ্যে। গ্রামাঞ্চলের বিদ্রোহগুলো হতে ক্রমবর্ধমান চাপের অধীনে বলশেভিকগণ সীমিত বাজার সংস্কারের প্রবর্তন করেন কৃষকদের উৎসাহ দেবার জন্য। এটি পরিচিত ছিল নয়া অর্থনৈতিক কর্মসূচী (NEP) হিসেবে।
    ত্রৎস্কি ও লেনিন এটিকে দেখেন অস্থায়ী সমাধান হিসেবে। রাশিয়ার বেপরোয়া অবস্থার উন্নতির জন্য তাঁরা যে কোনও স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নেন না কেন, সত্যিকার সমাধান নিহিত বিপ্লব বিস্তারণের সম্ভাবনায়, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে। এটিই ছিল একমাত্র উপায় যাতে ‍রুশ অর্থনীতির উপর চাপ কমানো যায় এবং শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ও সংখ্যাগত শক্তি পুনঃনির্ধারণ করা যায়।
    গৃহযুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়াতে নৈরাজ্য ও ধ্বংসের মধ্যে আকারে ও গুরুত্বে একটি গোষ্ঠী বেড়ে উঠতে শুরু করে, সেটি রাষ্ট্রীয় আমলতন্ত্র, এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রশাসকবৃন্দ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ যারা দেশের দৈনন্দিন কার্যাবলী বর্ধিতভাবে পরিচালনা করছিলেন। ধীরে ধীরে এই লোকজন তাঁদের স্বার্থসমূহের নিজস্ব সেটের প্রতিনিধিত্ব করতে এগিয়ে আসে এবং বাদবাকী সমাজের উর্ধ্বে একটি সুবিধাভোগী স্তরে পরিণত হয়। এটি ছিল সেই বর্ধিষ্ণু আমলাতন্ত্র  যা স্তালিনকে গড়ে তোলে। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সারির বলশেভিক নেতা, যিনি সমাজের এই স্তরের স্বার্থবালীর বাস্তবরূপদানের জন্য এগিয়ে আসেন।   
    লেনিন ও ত্রৎস্কি বিকাশমান আমলাতন্ত্র  সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। ১৯২১ সনের জানুয়ারিতেই  লেনিন “আমলাতান্ত্রিক বিকৃতি” সম্পর্কে সতর্ক করেন। ১৯২৯ সনে ত্রৎস্কি আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনা দেন। “জনগণের ওপরে বিকাশ লাভকৃত এই আমলাবর্গের অধিকাংশ গভীরভাবে রক্ষণশীল.। এই রক্ষণশীল স্তরই স্তালিনের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থকমন্ডলী গঠন কর” (Leon Trotsky, Writings 1929, New York, 1975, p47)।
    লেনিন বিকাশমান আমলাতন্ত্রের তীব্র সমালোচক হন। তিনি ১৯২৪ সনে মৃত্যুবরণ করেন,  ঠিক তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনি যা লিখেন সেটি পরবর্তীতে তাঁর “টেস্টামেন্ট” নামে পরিচিত হয়, এতে তিনি পার্টির  নেতৃত্ব থেকে স্তালিনের অপসারণের জন্য আহ্বান জানান। বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই টেস্টামেন্টটি জনসম্মুখে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন।  ত্রৎস্কি পার্টির প্রকাশ্য ভাঙ্গনের জন্য সতর্ক ছিলেন। তাই লেনিনের সমালোচনার অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তের প্রতি অটল ছিলেন। 
    ইতোমধ্যে স্তালিন আমলাতন্ত্রে গভীরভাবে প্রোথিত ছিলেন এবং ১৯২৪ সন নাগাদ অনেক রাষ্ট্রীয় কমিটিতে জড়িত ছিলেন। তাঁর অবস্থান সংহত করতে তিনি লেনিনের মৃত্যুর সুযোগ নিলেন।  লেনিনের বিধবা স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার হতাশাকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে লেনিনের সত্যিকার উত্তরাধিকাররূপে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন এবং লেনিনের শেষকৃত্য পরিচালনা করেন। এখান হতেই ত্রৎস্কি এবং তাঁর রাজনীতির উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পায়।
 
 

তের. এক দেশে সমাজতন্ত্র

ত্রৎস্কি আমলাতন্ত্রের বৃদ্ধিতে বিপদ দেখেন এবং  এর উত্থান প্রতিহত করতে উপায় অন্বেষণ করেন। তিনি বাম প্রতিরোধ শক্তি (Left opposition) গঠন করেন, এটি শ্রমিক শ্রেণীর আকার ও সামাজিক ওজন বৃদ্ধিতে, এর জীবনযাত্রার মান বাড়াতে এবং শ্রমিক-গণতন্ত্র প্রসারণের জন্য পরিকল্পিত শিল্পায়নের প্রস্তাব করে।
    স্তালিন ও তাঁর সমর্থকেরা এই পদক্ষেপসমূহের বিরোধিতা করেন। পরিবর্তে তাঁরা ধীর ও সার্তকিক ভারসাম্য বজায় রাখে শিল্প ও কৃষির মধ্যে, এবং  উৎপাদনে বর্খিত বাজার উদ্দীপনা প্রদান করে, যা পুঁজিতন্ত্রের উত্থানের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।
    তাৎপর্যপূর্ণভাবে অবশ্যি, ত্রৎস্কি রাশিয়ার দারিদ্র্য দূর করতে এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্রের চাপ থেকে নিষ্কৃত পেতে বিপ্লবের বিস্তারণের উপর নির্ভর করেন। যাহোক, ১৯২৩ সনে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক আন্দোলন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। সুযোগ বা সংখ্যার অভাবে জার্মান বিপ্লবীরা পরাজয় বরণ করেননি, পরাজয়ের কারণ হ’ল তাঁদের পার্টি ছিল অনভিজ্ঞ, দুর্বল ও বিভক্ত।   
    জার্মানিতে পরাজয়ের পর ত্রৎস্কি অক্টোবরের শিক্ষা লিখেন। এখানে জার্মানিতে যা ঘটেছিল তার বিপরীতে, তিনি অনিবার্য দোদুল্যমানতা জয় করতে সক্ষম, আত্মবিশ্বাসী বিপ্লবী পার্টির নিয়ামক ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করেন রুশ বিপ্লবের সফলতা নিশ্চিত করতে। 
    অক্টোবরের শিক্ষা প্রকাশনে ত্রৎস্কির ওপর নতুন আক্রমণের ঢেউ শুরু হয়। এই সময়ে স্তালিন ও তাঁর সমর্থকেরা “ত্রৎস্কিবাদ” তৈরী করেন, এটি ত্রৎস্কি যার প্রতিনিধিত্ব করতেন সেই সম্পর্কে একসারি মিথ্যা এবং পার্টিতে ত্রৎস্কির প্রভাবে বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাঁরা আহবান জানান। ত্রৎস্কি কেবলমাত্র ১৯১৭ সনে বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেন, এই তথ্যটিকে অতিরঞ্জিত করেন, এবং ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবেরে তত্ত্বকে আক্রমণ করেন।
    জার্মানীতে পরাজয়  রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে হতাশার বোধ ও নিষ্ক্রিয়তা যোগায়। তাঁরা বছরের পর বছর দুর্ভোগ ও যুদ্ধে ইতোমধ্যে ক্লান্ত ছিলেন।
    ১৯২৪ সনের  পরে স্তালিন প্রথম একটি নিবন্ধে ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্বকে আক্রমণ করে “একদেশে সমাজতন্ত্র”-এর ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। রাশিয়া পুঁজিবাদ পরিবেষ্টিত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হতে পারে- এই ধারণাটি বিপ্লব বিস্তারণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি থেকে বড় ধরণের পশ্চাদাপসারণ। মার্কসবাদের মর্মমূলে আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে এটি ছিল বিশাল ধা্ক্কা। ত্রৎস্কি গুরুত্ব আরোপ করেন যে, হয় বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে হবে অথবা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের চাপ বিপ্লবকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করবে। স্তালিনের রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কথা কেবলমাত্র সাদামাটাভাবে এই উভয় সংকটকে পরিহার করে।
    ১৯২৮ সনে বাস্তবতা আমলাতন্ত্রকে জড়িয়ে ধরে। ব্রিটেনের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের হুমকিতে এবং গ্রামাঞ্চলে সংকটের মুখোমুখি হয়ে স্তালিন গ্রামাঞ্চলে জবরদস্তিমূলক যৌথকরণের দিকে আতঙ্কিতভাবে ঝুঁকে পড়েন, জোরপূর্বকভাবে কৃষকদের জমিজমা নিয়ন্ত্রণে এনে, এবং শহরাঞ্চলে  নিষ্ঠুর দ্রুত শিল্পায়ন করে।  এটি ছিল একেবারে ত্রৎস্কির শিল্পায়েনের কর্মসূচীর বিপরীত। এটি ছিল শ্রমিক গণতন্ত্র বৃদ্ধি থেকে অনেক দূরে, এতে জড়িত ছিল শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরাট আক্রমণ।
    রাশিয়া চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছিল উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক দেশসমূহের নাগাল ধরতে- এটি ছিল “একদেশে সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার অনিবার্য কারণ।  ১৯৩১ সনে স্তালিন যেমনটি ম্যানেজারদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাতে ব্যাখ্যা করেন, “আমরা উন্নত দেশসমূহ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর  পিছিয়ে আছি। আমরা অবশ্যি  এই পিছিয়ে পড়া অবস্থা ১০ বছরে পূরণ করবো। হয় আমরা এটা করবো অথবা তাঁরা আমাদের ধ্বংস করবে (Issac Deutscher কর্তৃক উদ্ধৃত, Stalin, London 1988, p328)।
    পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে প্রতিযোগিতার প্রভাব পড়েছিল রাশিয়াতে প্রশাসনের নিজের ওপরই।  পাঁচশালা পরিকল্পনাগুলোর একটি ১৯২৯ সনে শুরু হয়, এর পরিণতি হয়েছিল জীবনযাত্রার মানের নাটকীয় অবনমনে ও গণদুর্ভিক্ষে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩০-এ শ্রমশিবিরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২০ গুণের অধিক। এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে স্তালিন  বর্ধিতভাবে  নিবর্তনমূলক প্রশাসন এবং সকল রাজনৈতিক বিরোধীদের উচ্ছেদকরণের ওপর নির্ভর করেন। গণতন্ত্রের সকল অবশিষ্ট চিহ্ন ধ্বংস করে দেয়া হয়।
    আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে “এক দেশে সমাজতন্ত্র”-এর ধ্বংসকারী প্রভাবও ছিল। কৌশল ও উপায়ের (strategy and means) আন্তর্জাতিক স্কুল থেকে কমিনটার্ন ক্রমাগত স্তালিনের বৈদেশিক নীতি প্রয়োজন দিয়ে বর্ধিতভাবে আকারপ্রাপ্ত একটি সংস্থায় পরিণত হয়। যেহেতু স্তালিনের  আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনের  নিকট শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থকে বারবার বলি দেয়া হচ্ছিল, তাই এর অর্থ ছিল কৌশলে  কিছু আকস্মিক বাকাচোরা পথ, যার ভয়াবহ ফলাফল ছিল।
     ১৯২৬ সনে ত্রৎস্কি যোগ দিলেন স্তালিনের পূর্বতন মিত্র জিরোভিয়েভ ও কামেনেভের সঙ্গে, ঐক্যবদ্ধ  বিরোধী অবস্থান অণ্বেষণে। ত্রৎস্কি এবং জিনোভিয়েভ-কামেনেভের মধ্যকার বিদ্বেষের ইতিহাস এটি কষ্টকর করে তুলল তাঁদের সমর্থকদের জন্য একে অপরের  প্রতি বিশ্বাসে। এই ঐক্য ধরে রাখতে উভয় পক্ষ অনেক আপোষ করে- এমনকি সেই বিষয়ে যাতে ত্রৎস্কি সাময়িকভাবে  তাঁর স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব পরিত্যাগ করেন।
    যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ থেকে শ্রমিক ও কৃষক জনগণ দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে, স্তালিন ও আমলাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতেবিরোধীদের খুবই সীমিত ভিত্তি ছিল। বিরোধীরা নিশ্চিহ্ন হয়। ১৯২৭ সনে বিপ্লবের দশম বার্ষিকীতে বিরোধীদের জন্য সমাবেশ সমর্থনের প্রচেষ্টাকে ব্যবহার করা হয়, ত্রৎস্কিকে  কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিস্কারের কৈফিয়ত হিসেবে। ১৯১৭-এর অভ্যুত্থান সংগঠিত করার মাত্র দশ বছর পরে, এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনীর মধ্যকার কয়েকটিকে পরাজিত করতে সহায়তা করার মাত্র ছয় বছর পরে, ত্রৎস্কি তাঁর পার্টি থেকে বহিস্কৃত হন এবং তারপর নির্বাসনে যান।
 
 

চৌদ্দ. ভিসা-বিহীন গ্রহ

 

স্তালিনের নির্দেশে জানুয়ারী  ১৯২৮-এ ত্রৎস্কি রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে আলমা আতায় নির্বাসিত হন। এক বছর পর পুনরায় তিনি আলমা আতা থেকে তুরস্কে বহিস্কৃত হন, যেখানে তিনি প্রিনকিপো দ্বীপে বসত গেড়েন।
    তিনি তুরস্কে চার বছরের বেশী সময় অতিবাহিত করেন, কিন্তু পছন্দের মধ্যে নয়। ত্রৎস্কি এই সময়টাকে বর্ণনা করেন “The Planet without a visa" হিসেবে। কোন দেশই তাঁকে তাদের মাটিতে দেখতে চায় না। তাঁকে দেখা হয় অত্যন্ত পরিধ্বংসী হিসেবে, এবং ইউরোপের সকল স্বঘোষিত দেশসমূহে তাঁর প্রবেশ অগ্রাহ্য করা হয়।
    অবশেষে তাঁর সমর্থকেরা ফ্রান্সে ও তারপর নরওয়েতে তাঁর সংক্ষিপ্ত ও বেদনাদায়ক অভিবাসনে বিজয় লাভ করেন, কিন্তু তাঁর ওপর স্তালিনের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য  সংগঠিত হওয়ার উপর যখন নরওয়ে সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, তখন পুনরায় তিনি আর একটি আবাসের জন্য অন্বেষণ করেন।
    ১৯৩৬ সনের শেষদিকে মহান শিল্পী  দিয়োগো রিভেরা ত্রৎস্কিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে মেক্সিকো সরকারকে রাজী করান। ১৯৪০ সনে স্তালিনের গুপ্ত পুলিশের এজেন্টের নিকট মৃত্যুবরণ  করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মেক্সিকোতে বসবাস করেন।
    তাঁর সারা নির্বাসনকালে ত্রৎস্কি বিস্তৃতভাবে লিখেন। স্তালিন কর্তৃক ত্রৎস্কির অনেক অপপ্রচার জড়িত ছিল রুশ বিপ্লবে ত্রৎস্কির ভূমিকা এবং লেনিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে জড়িত করে পুনর্লিখনসমূহে। ত্রৎস্কি একসারি বই লিখেন তথ্যকে সঠিক অবস্থানে রাখতে, এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর নিজের আত্মজীবনী আমার জীবন এবং তাঁর রুশ বিপ্লবের ইতিহাস- এটি ঐতিহাসিক লেখণীসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সেরা উদাহরণসমূহের একটি এবং ত্রৎস্কির সেরা অর্জনসমূহের একটি।
    তাঁর বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও ত্রৎস্কি দুনিয়া জুড়ে রাজনীতির ঢেউ পর্যবেক্ষণ করেন এবং অনেক দেশের আন্দোলনের সম্মুখবর্তী কৌশল ও উপায় সম্পর্কে বিস্তৃত লিখেন।
    মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের মত ত্রৎস্কি বিশ্বাস করতেন তত্ত্ব ও অনুশীলনের ঐক্যে। এমনকি নির্বাসনে বা অন্তরীণে, সর্বদা স্তালিনের তুলনায় ছোট্ট শক্তি নিয়ে, তাঁর সমর্থকদের আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত করতে যা করা সম্ভব তাঁর সবকিছুই করেন। স্তালিনের নেতৃত্বে কমিনটার্নের ধ্বংসাত্মক ভূমিকার বিরুদ্ধে  ত্রৎস্কি সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন এবং এটি যে ভুল করে তাঁর বিরুদ্ধে সমাবেশ করেন। কমিনটার্নের অভিভাবকত্বে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক পালিত ভূমিকাসমূহের মধ্যে গভীরতম ভুল ছিল- হিটলারকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া। 
     
 

পনের. ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম 

জার্মানীতে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে ত্রৎস্কি “শ্রমিক শ্রেণীর ইতিহাসে বৃহত্তম পরাজয়” হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯৩৩-এর জানুয়ারীতে হিটলার ক্ষমতায় আসীন হন। তিন বছর পূর্বে ত্রৎস্কি বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন, তিনি যুক্তি দেন  যে ফ্যাসিবাদের বিজয় কেবলমাত্র জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর পরাজয় নয়, ইউরোপ জুড়ে সকল প্রগতিশীল শক্তির পরাজয়।
    তিনি বলেন যে ফ্যাসিবাদকে থামিয়ে দেয়া যেতো। এই সময়ে শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠনগুলো যেকোন জায়গার তুলনায় বৃহৎ ছিল। ১৯৩২ সনে সংস্কারবাদী সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির (SDP) এক মিলিয়ন সদস্য ছিল এবং জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির (KPD) সদস্য ছিল প্রায় ৩০০,০০০ এবং উভয় গ্রুপের যুব সংগঠনের প্রত্যেকটিতে ৫০,০০০-এর উপরে সদস্য ছিল।
    ১৯৩৩ সনের সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে SDP ও KPD যৌথভাবে  নাৎসীদের দ্বিগুণের অধিক আসন জেতে। এমনকি ১৯৩৩ সনের মার্চে হিটলারের ক্ষমতারোহণের পর KPD নিষিদ্ধ হয় এবং বামদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস শুরু হয়, SDP ও KPD ১২ মিলিয়ন ভোট অর্জন করে। কিন্তু ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে ভোটের অধিক যা ছিল তা হল জার্মান অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ফ্যাক্টরীসমূহে যৌথ সংগঠনের শক্তি।  
    ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে কমিউনিস্ট ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যকার যুক্তফ্রন্টই ছিল একমাত্র পথ যাতে হিটলার ও নাৎসীদের ঠেকানো যেতো। এটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির পলিসির সরাসরি প্রত্যাখ্যান, যারা কঠোরভাবে  স্তালিনের কমিনটার্ন থেকে পাওয়া  ‍দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল সমর্থন করতো। 
    ১৯২৮ সনে কমিনটার্ন স্পষ্ট মোড় নেয়, এটিকে বলা যায় তৃতীয় পর্যায়। ১৯১৭ থেকে ১৯২৩-এর বিপ্লবী উচ্ছাস ছিল প্রথম পর্যায়। ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ হ’ল দ্বিতীয় পর্যায়, এটিকে পুঁজিবাদী সুস্থিতি হিসেবে দেখা হয়। ত্রৎস্কি ব্যাখ্যা দেন যে এই পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল ভয়াবহ ভ্রান্তিসমূহ- একটি চীনে জাতীয়তাবাদীদের ওপর নির্ভরতা এবং ব্রিটেনে ট্রেড ইউনিয়নে আমলাদের ওপর নির্ভরতা।
    স্তালিন ও কমিনটার্নের মতে তৃতীয় পর্যায় বৈশিষ্ট্যায়িত হয় পুঁজিতন্ত্রের চুড়ান্ত সংকট  দিয়ে। এটি ছিল “স্বীকৃতভাবে বিপ্লবী আক্রমণ”-এর দিকে স্পষ্ট মোড় নেয়া। এত জড়িত ছিল- পৃথক “লাল” (কার্যকারভাবে কেবলমাত্র কমিউনিস্টরা) ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট ত্যাগ করা এবং সোস্যাল ডেমোক্রাটদের প্রধান শত্রু হিসেবে দেখা যাদেরকে তখন “সামাজিক ফ্যাসিবাদী” হিসেবে বর্ণনা করা হত।
    বিপরীতে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে কোন প্রমাণ নেই যে অর্থনৈতিক সংকট বিপ্লবী গণ-আমুলবাদ (mass radicalism) তৈরি করে। তিনি বারবার কমিউনিস্টদের আহ্বান জানান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে  যুক্তফ্রন্টে প্রবেশে সোস্যাল ডেমোক্রাটদের চাপ দিতে। তিনি তাঁর কৌশলের ভিত্তি স্থাপন করেন ফ্যাসিবাদের শক্তিশালী বিশ্লেষণের ওপর। তিনি যুক্তি দেন ফ্যাসিবাদ হ’ল মধ্যশ্রেণী ভিত্তিক হতাশার প্রতিবিপ্লবী আন্দোলন। ১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে অর্থনৈতিক সংকট জার্মানীকে আঘাত করে, এটি মধ্যশ্রেণীকে তাড়িত করে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার উম্মত্ততায়। ত্রৎস্কি লিখলেন যে হিটলারকে এই প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত- এই বিকারগ্রস্থ মধ্যশ্রেণীর  জীবন্ত প্রতিমূর্তিরূপে।
    মধ্যশ্রেণী ফ্যাসিবাদের গণভিত্তি গঠন করে থাকতে পারে, কিন্তু ত্রৎস্কি যুক্তি দিলেন যে পুঁজপতিশ্রেণীর কোন অংশের সমর্থন ছাড়া হিটলার ক্ষমতায় আসতে পারতো না। পুঁজিপতিরা সাধারণত বুর্জোয়া গণতন্ত্র পছন্দ করে, তারা যখন তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয় তখনি কেবলমাত্র তারা ফ্যাসিবাদের দিকে মোড় নেয়। ত্রৎস্কি এটিকে তুলনা করেন এমন কারো সঙ্গে যিনি দন্তচিকিৎসককে ভয় পান, কিন্তু যেতে বাধ্য হন যখন তার দাঁত-ব্যথা খুবই তীব্র হয়।  ১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে জার্মান পুঁজিপতি  শ্রেণী  হিটলারের মধ্যে সমস্ত শ্রমিকশ্রণীর সংগঠনগুলোর ধ্বংসের সুযোগ দেখতে পান, তাদের মুনাফা পুনর্গঠনের সুযোগ করে দিয়ে।
 ত্রৎস্কি যুক্তি দিলেন যে যেহেতু এটি ফ্যাসিবাদের প্রধান কাজ, এটি সকল ধরনের শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠনকে, এমনকি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। এটি জার্মানীর ক্ষেত্রে প্রমাণিত অবস্থা যেখানে সকল ধরনের স্ব-সংগঠন এমনকি বয়স্কাউটও নিষিদ্ধ হয়। এ কারণেই স্যোসাল ডেমোক্র্যটিক পার্টির সাংবিধানিক বিরোধিতার কৌশল কাজে লাগে নি। নাৎসীদের সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি কোনও শ্রদ্ধা ছিল না এবং যখনই সমর্থ হয় তখনই গণতন্ত্রের সকল উপাদান ধ্বংস করে।
    ত্রৎস্কি বর্ণবাদের (racism) ব্যবহারকে “বর্ণের আবিষ্কার” (invention of race) বলেও বর্ণনা দেন, যেহেতু তিনি বলেন এটি নাৎসি কর্তৃক ব্যবহৃত হয় প্রশাসনের জন্য সমর্থন গ্রন্থিত করতে।
    ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে কমিউনিস্টরা নিজ থেকে অতটা শক্তিশালী ছিল না। তারপরেও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রধান শত্রু হিসেবে দেখার আত্মঘাতী পলিসি অব্যাহত রাখে এবং কমিউনিস্ট পার্টির তৃণমূল সদস্যবৃন্দ এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাঁদের পথে যেতে থাকে।
    ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে একটি বিষয় ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করতে পারতো, তাহলো সেই সময়ে জার্মানীতে ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক পার্টিগুলোতে সংগঠিত নিযুত নিযুত শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ কর্মকান্ড। তিনি আরও যুক্তি দেন যে এ ধরনের যুক্তফ্রন্ট হতে পারে একটি উপায় যাতে প্রতিরোধমূলক সংগঠন থেকে আক্রমণে যাওয়া যেতে পারে। তাঁর আহ্বান বারবার অরণ্যে রোদন হয়। 
     জার্মানীতে এটি কখনও সহজ যুক্তি ছিল না। সোস্যাল ডেমোক্র্যটিক নেতারা এমন অবস্থা তৈরী  করেছিল যাতে কমিউনিস্ট নেতা রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবক্নেখট ঠিক এক দশক পূর্বে নিহত হন। কিন্তু ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কিছু খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদাহরণ দেখাতে সমর্থ হন যেখানে ঐক্য তৈরী হয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণভাবে ঐ সমস্ত জায়গাতে যেখানে তাঁর সমর্থকবৃন্দ ছিল তার ভিত্তিতে।
    ত্রৎস্কির মেধা সত্ত্বেও কেউ তাঁর দিকে মনোযোগ দেননি। জার্মানীতে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি ছিল, এই সংখ্যা পাঁচশত সমর্থকের উপরে ছিল না। কিছু দিনের জন্য তাঁর সমর্থকেরা পাক্ষিক পত্রিকা বিতরণ করেন এবং তারপর একট অনুলিপিকৃত তথ্য শিট বিতরণ করেন। তাঁর বইপত্র ও লেখালেখির অনেকগুলোই পাওয়া যেতো; এগুলোর কোন বাস্তব প্রভাব ছিল না।
    ফ্যাসিবাদ কি অর্থ প্রকাশ করে সে সম্পর্কে বর্ধিষ্ণুভাবে সচেতন থাকা সত্ত্বেও তিনি এটি প্রতিরোধে অক্ষম ছিলেন, ত্রৎস্কি শ্রমিকদের সাবধান করে দেন, “ফ্যাসিবাদকে কি ক্ষমতায় আসতে দেয়া উচিত, একট ভয়াবহ ট্যাংকের মত এটি আপনাদের খুলি ও মেরুদন্ডের উপর দিয়ে যাবে” (“ফ্যাসিবাদ বিরোধী শ্রমিকদের যুক্তফ্রন্ট”, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩১; পাওয়া যাবে www.marxists.org.uk)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি সঠিক ছিলেন।
 

 ষোল. বিপ্লব বিসর্জন


১৯৩৩ অবধি ত্রৎস্কি বিশ্বাস করতেন যে  কমিনটার্ন ও রুশ কমিউনিস্ট পার্টিকে সংস্কার করা যাবে। রাশিয়ার পরামর্শে জার্মানীতে কমিউনিস্ট পার্টি কোন রকম সংগ্রাম ছাড়াই হিটলারকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার পর তিনি আর বিশ্বাস করতেন না যে এটি আর সম্ভব। তিনি তখন ভাবলেন যে রাশিয়াতে একটি রাজনৈতিক বিপ্লব এবং একটি নয়া আন্তর্জাতিক দরকার।
    আরও পাঁচ বছর পরে ১৯৩৮ সনে ১১টি দেশের ২১ জন প্রতিনিধি ফ্রান্সে একটি বাড়ীতে মিলিত হন এবং তাঁদের নিজেদেরকে চতুর্থ আন্তর্জাতিক হিসেবে ঘোষণা দেন। মার্কিন প্রতিনিধিদের সীমিত ব্যতিক্রম ছাড়া , তাঁরা ক্ষুদ্র শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতো। তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিকাশমান গণআন্দোলনের সময় যাত্রা শুরু করেছিল এবং শীঘ্রই তাঁদের ব্যানারে অনেক গ্রুপকেই আকৃষ্ট করেছিল, তা থেকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে চতুর্থ আন্তর্জাতিক যাত্রা করেছিল পরাজয়, ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবছা আবির্ভাবের কালে। এর অর্থ  এটি কখনও এর বিচ্ছিন্নতা কাটাতে পারেনি।
    ১৯৩৬ সনে ত্রৎস্কি The Revolution Betrayed  লিখেন, এতে তিনি স্তালিনবাদী রাশিয়ার বাস্তবতা বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে একটি ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রের সত্যিকার অর্থ পুনরুদ্ধারে এটি ছিল কিছু মাত্রায় একটি সংগ্রাম। স্তালিন কেবলমাত্র ঘোষণা দিয়েছেন যে রাশিয়া সমাজতন্ত্র অর্জন করেছে। ক্রমবর্ধমান অসমতাকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে ত্রৎস্কি যুক্তি দিলেন যে স্তালিনের রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক নয়। সমাজে নারীর প্রশ্নে আর একবার আলোকপাত করে তিনি লিখলেন, “সমাজে পতিতাবৃত্তির উপস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের  বিজয়ের কথা বলা ক্ষমার অযোগ্য” (Leon Trotosky, The Revolution Betrayed, New York, 1989, p149)।
    বর্তমানে স্তালিনের অপরাধসমূহ সারা দুনিয়া জুড়ে পরিচিত। ১৯৩০-এর দশকে তা ছিল না। ত্রৎস্কি ছিলেন প্রথম সমাজতন্ত্রী যিনি স্তালিনবাদী রাশিয়ার বিস্তারিত মার্কসবাদী বিশ্লেষণের  চেষ্টা করেন। তাঁর সমালোচনা ছিল অগ্রবর্তী এবং রাজনৈতিকভাবে বিস্তারণীয়। ত্রৎস্কি দেখান যে স্তালিন অক্টোবর বিপ্লবের অর্জনসমূহ উল্টে দেন। ‍উদাহরণস্বরূপ, স্তালিন গর্ভপাতের পুনঃঅপরাধায়ন করেন, বিচ্ছেদকে তাদের জন্য বিশেষাধিকার করেন যারা এর জন্য টাকা দিতে পারেন, এবং নারীর জন্য এর সংকীর্ণ  এবং নিবর্তনমূলক ভূমিকাসহ পুরাতন ধরনের  পরিবারে প্রত্যাবর্তনে উৎসাহ যোগানো হয়। যথার্থ জাতীয় মুক্তির অঙ্গীকার প্রতিস্থাপিত হয় রুশ জাতিদম্ভবাদ (chauvinism) এবং জাতীয়াধিকারের ধ্বংস দিয়ে।
    আমলাতন্ত্র ও স্তালিনের উত্থান ছিল একটি নতুন ঘটনা। যদিও ত্রৎস্কি স্তালিনের সমালোচনায় নির্মম ছিলেন, তারপরও স্তালিনের অধীনে প্রতি-বিপ্লব কত গভীরে গিয়েছিল  তা তিনি ঊণজ্ঞান করেছিলেন। তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে রাশিয়া তখন পর্যন্ত কোনো না কোনো ভাবে শ্রমিকদের রাষ্ট্র। International Socialists যেটি পরে সোস্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি হয়, তার প্রতিষ্ঠাতা টনি ক্লিফের মত সমাজতন্ত্রীরা ত্রৎস্কির বিশ্লেষনৈর উপর ভিত্তি করে যুক্তি দেন যে স্তালিনের অধীনে রাশিয়া ছিল একটি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, এটি পরিচালিত হচ্ছিল ব্যক্তিগত ফার্মের পরিবর্তে রাষ্ট্র দিয়ে।
    শ্রমিক ও কৃষকের জীবন-যাত্রার মানের উপর ব্যাপক আঘাত বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে স্তালিন যেকোনও ধরনের মতদ্বৈধ বা বিরোধিতা দীর্ঘস্থায়ীভাবে দমন করতেন। “ত্রৎস্কিবাদ”-এর হুমকি সম্পর্কে অতিকথা সৃষ্টি করে স্তালিন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়াতেন। তিনি ত্রৎস্কি ও প্রশাসনের অন্যান্য ইহুদীয় বিরোধীদের বিরোধিতা উসকে দেয়ার জন্য এমনকি এন্টি-সেমিটিজমের অবলম্বন নেন। স্বয়ং স্তালিনবাদী প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ দরকারমত ভিন্ন খাতে পরিচালিত করে এই ভীতিসমূহ।
    পার্টি হতে বিরোধীদের ব্যাপক সংখ্যায় বহিস্কার করা হয়। বিশেষ করে পুরাতন বলশেভিকদের উচ্ছেদ করা হয়, এতে স্তালিনের প্রাক্তন সমর্থকবৃন্দও ছিলেন যারা ১৯১৭ বিপ্লবের অংশীদার ছিলেন। অনেককে ক্যাম্পে বন্দী করা হয় অথবা মিথ্যা বিচার করা হয়। 
    স্তালিন এই সমস্ত লোকজনকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেন এই দাবী করে যে  তারা প্রকাশ্যে  নিজেদের অধঃপতিত ও অবমানিত করেন, মিথ্যাকৃতভাবে  অন্যদের ফ্যাসিবাদের এজেন্ট হিসেবে অথবা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘটিত করার ষড়যন্ত্রে অভিযোগ এনে। অনেকে অস্বীকার করলে সংক্ষিপ্ত বিচার শেষে তাদের হত্যা করা হয়। নির্যাতনে ভেঙ্গে পড়ে অথবা হতাশ হয়ে অন্যেরা রাজি হন কিছুটা দন্ড মওকুফের প্রত্যাশায়। তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয় এই যুক্তিতে যে স্তালিনকে সমর্থনে ব্যর্থ হওয়া হিটলারকে সমর্থনের সামিল।     
     পুরাতন বলশেভিকদের বর্ণনার থেকে কেউই স্তালিনের প্রতি-বিপ্লবের নৈরাশ্য  ও আতংকের কথা বেশী বলে না। এরা জারের অধীনে নির্যাতন, বন্দী-দশা ও দুর্ভোগ প্রতিরোধ করেছিলেন, স্তালিনের আদেশে ভেঙ্গে পড়েন এবং আত্ম-মর্যাদাহীন হয়ে পড়েন।    
    নেতৃস্থানীয় বলশেভিকদের জড়িত করে ১৯৩৫ হতে ১৯৩৭-এ স্তালিন লোক দেখানো বিচারের মঞ্চায়ন করেন। এতে জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের বিচার অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাঁরা  ১৯১৭ সনে বলশেভিকদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন, তারপর স্তালিনের মিত্র ছিলেন এবং তারপর ত্রৎস্কির সঙ্গে সম্মিলিত বিরোধীদের অংশ ছিলেন। আত্ম-নীচতার হৃদয় বিদারক প্রকাশ্য দৃশ্যাবলীতে তাঁদের নিজেদের নিন্দা করেন এবং ত্রৎস্কিকে ফ্যাসিবাদের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতে তাঁরা বাধ্য হন তাঁদেরকে অবমানিত করতে। এটিও তাঁদেরকে মৃত্যুদন্ড হতে রক্ষা করতে পারেনি।
    বাস্তবত নির্বাসনকৃত ত্রৎস্কি এবং আলেকসান্দ্রা কলনতাই যিনি তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এঁরা ছাড়া ১৯১৭ সনের কেন্দ্রীয় কমিটির সকল অবশিষ্ট সদস্যদের স্তালিন কর্তৃক মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। স্তালিন নিজেকে লেনিনের সত্যিকার উত্তরধিকাররূপে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন। এমনকি বর্তমানেও অনেক মানুষই স্তালিনের অপরাধের সঙ্গে লেনিনকে সম্পৃক্ত করেন। এখন পর্যন্ত কোনকিছুই পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না অক্টোবর ১৯১৭-এর সত্যিকার উত্তরাধিকারকে আক্ষরিকভাবে মুছে ফেলার প্রয়োজনের চেয়ে লেনিন ও ত্রৎস্কির নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব এবং স্তালিনের ভয়ংকর প্রশাসনের মধ্যকারছেদকে।  ত্রৎস্কি ১৯৩৬ সনে যেমনটি বলেন, “বর্তমান শুদ্ধিকরণ বলশেভিকবাদ ও স্তালিনবাদের মধ্যে কেবলমাত্র রক্তাক্ত রেখাই টানে না, একটি সমগ্র রক্তের নদী টেনে আনে” (টনি ক্লিফ কর্তৃক উদ্ধৃত, Trotsky 1927-1940: The Darker the Night the Brighter the Star, London, 1993, p-359)।
    ১৯৪০ সনে স্তালিনের একজন এজেন্ট মেক্সিকোতে তাঁর বাড়ীতে ত্রৎস্কিকে হত্যা করে। স্তালিন কেবলমাত্র ত্রৎস্কিকেই হত্যা করেননি, তিনি তাঁর সমগ্র পরিবার ধ্বংস করেন। ত্রৎস্কির কন্যাদের একজনকে কমিউনিস্ট পার্টি হতে বহিস্কার করা হয় এবং কাজ হতে নিষিদ্ধ করার পর তিনি যক্ষা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অন্য কন্যা জিনাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। তাঁদের স্বামীদের সাইবেরিয়াতে শ্রম-শিবিরে পাঠানো হয়। ত্রৎস্কির জেষ্ঠ পুত্র লিওন সেদভ পরিচিত ছিলেন লাইয়াভো নামে, তাঁর সঙ্গে ত্রৎস্কি নির্বাসিত অবস্থায়  ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ১৯৩৮ সনে তাঁকে স্তালিনের গুপ্ত পুলিশ বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে। ত্রৎস্কির কনিষ্ঠতম পুত্র বিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি সুচিন্তিতভাবে  রাজনীতি পরিহার করতেন, তাঁকেও বন্দী করা হয় ১৯৩৪ সনে এবং  স্তালিনের শিবিরে পাঠানো হয়। ১৯৩৬ সনে অনশন ধর্মঘটে থাকাবস্থায়  সর্বশেষ তাঁর কথা শোনা যায়। ত্রৎস্কির প্রথম স্ত্রী আলেকসান্দ্রা নিজেই বিরোধীদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৩৬ সনে তাঁকে লেলিনগ্রাদ হতে বহিস্কার করা হয় এবং অবশেষে  ১৯৩৮ সনে গুলি করে হত্যা করা হয়।
    এটি ঠিক কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির রূপকথা নয়। স্তালিন কতদূর যেতে পারতেন তাঁর বিরোধীদের ধ্বংস করতে এবং অক্টোবর বিপ্লবের উত্তরাধিকারকে ধ্বংস করতে, যেমন ত্রৎস্কির পুত্র লাইয়েভা বলেন, স্তালিন “অক্টোবর বিপ্লবের ধারণাবলী ও ঐতিহ্যাবলীর জীবন্ত মূর্ত প্রকাশরূপে ত্রৎস্কিকে ঘৃণা করতেন” (Leon Sedov, The Red Book: On the Moscow Trials, London, 1980)। 
 
 
 

সতের. ত্রৎস্কি স্তালিনকে পরাস্ত করতে পারতেন কী? 

 

অনেক ইতিহাসবেত্তা  ত্রৎস্কি ও স্তালিনের মধ্যকার সংগ্রামকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন ক্ষমতার জন্য দু’টি স্বৈরতান্ত্রিক সবল ইচ্ছাদ্বয়ের সংগ্রাম হিসেবে। যাহোক, ব্যক্তি হিসেবে নিলে ত্রৎস্কি স্তালিনের দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যান। ত্রৎস্কির বিপরীতে স্তালিন সামান্য ভূমিকা পালন করেন ১৯১৭ সনে। সুখানভ যিনি বিপ্লবকে লিপিবদ্ধ করেন, তিনি স্মরণ করেন যে ”স্তালিন . . . তৈরী করেন ধূসর অস্পষ্ট ছাপ এবং কেবল আমার ওপরই নয়” (টনি ক্লিফ কর্তৃক উদ্ধৃত, Trotsky 1923-1927: Fighting the Rising Stalinist Bureaucracy, London, 1991, p 11)। বিপরীতক্রমে, তাঁর বাগ্মিতা ও সাহিত্যিক দক্ষতার জন্য ত্রৎস্কি বিখ্যাত ছিলেন বন্ধুদের মধ্যে এবং সমানভাবে শত্রুদের মধ্যেও এবং ১৯১৭ সনের অভ্যুত্থান এবং বিজয়ী লাল বাহিনীর সংগঠক হিসেবে।

কিন্তু ত্রৎস্কি ও স্তালিনের মধ্যে সংগ্রাম ব্যক্তিগত সংগ্রাম ছিল না। তাঁরা রাশিয়াতে দু’টি ভিন্ন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতেন। ত্রৎস্কির রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল শ্রমিক শ্রেণী, যারা অক্টোবর বিপ্লব করেছিলেন। স্তালিনের ভিত্তি ছিল উদীয়মান আমলাতন্ত্রের মধ্যে।

গৃহযুদ্ধ শেষে আমলাতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীকে সংখ্যায় অতিক্রম করে। ১৯২১ সনে কেবলমাত্র ১.২৫ মিলিয়ন উৎপাদনশীল শ্রমিকের তুলনায় প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। যেহেতু গৃহযুদ্ধের পরে শিল্প-কারখানা পুনঃনির্মাণ করা হয়, শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তখন তাঁরা পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে ও সংখ্যাগতভাবে খুবই দুর্বল ছিলেন এবং মনোবলও খুব দুর্বল ছিল স্তালিনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য।
 
এই কারণে বিপ্লব এবং তারপর লালবাহিনীর নেতা হিসেবে বিপুল সম্মানের দাবীদার হলেও, যখন তাঁকে নির্যাতন করা হয় এবং নির্বসানে দেয়া হয়, তখন তাঁকে সমর্থনের জন্য কোন গণ-বিদ্রোহ হয়নি।

তাঁর ধারণাবলীকে যারা সমর্থন করতেন তাঁরাসহ অনেকেই ত্রৎস্কিকে সমালোচনা করেন কৌশলগতভাবে ভুল করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের শেষ ইচ্ছা (last testament) অনুসারে স্তালিনকে তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধ না করার জন্য। এটি সত্য যে কখনও কখনও ত্রৎস্কি নিরব থাকতেন, যখন তিনি কথা বলতে পারতেন। কখনও কখনও তিনি আপোষ করেন, যা হয়তো তাঁর করা উচিত ছিল না।

বিপ্লব বিস্তারণের ওপর সোভিয়েত রাশিয়ার ভাগ্য ঝুলে ছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজিপতি শ্রেণী রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা নিশ্চিত করে এবং এতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতেই স্তালিন ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

স্তালিনের নিহিত ভিত্তি ছিল: আমলাতন্ত্রের শক্তির ওপর, শ্রমিকশ্রেণী ও বিপ্লবীদের দুর্বলতার ওপর এবং মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার ওপর। আন্তর্জাতিকভাবে বিপ্লবের প্রত্যেকটি ব্যর্থতা শ্রমিকদের আত্মবিশ্বাসকে আরও ক্ষয়িষ্ণু করে এবং তাঁদের উৎসাহিত করে উপর থেকে পরিবর্তনের ওপর আশা রাখতে। এবং স্তালিনের অবস্থান যত শক্তিশালী হয়, তত তিনি বিদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে রুশ বৈদেশিক নীতির এজেন্টে পরিণত করেন, যা পরিণামে সংবর্ধিত করে কিছু কৌশলকে যেগুলো আরও আন্তর্জাতিক পরাজয় বরণে সহায়তা করে।


যদিও ত্রৎস্কি পরাজিত হন, তাঁর নৈতিক বিরোধিতা প্রমাণ করে যে স্তালিন থেকে ভিন্নতর ঐতিহ্য বিদ্যমান। অক্টোবর বিপ্লবের গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাবের (spirit) প্রতি ত্রৎস্কি বিশ্বস্ত থাকেন। মার্কসের বিপ্লবী তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা হচ্ছে যে শ্রমিক-জনতাকে দুনিয়াটাকে বদলাতে হবে তাঁদের নিজেদের জন্যই। এই ঐতিহ্যের ওপর ত্রৎস্কি দাঁড়িয়েছিলেন, যদি তিনি সংগ্রাম না করতেন, সকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, এটি এমন একটি ঐতিহ্য হত, যা চিরদিনের জন্য ধ্বংস হত স্তালিনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে

আঠার. ত্রৎস্কির উত্তরাধিকার 

ত্রৎস্কির জীবন লেখালেখি থেকে দুটি প্রদর্শক নীতি (guiding principle) বেরিয়ে আসে, আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং নীচ থেকে সমাজতন্ত্রের প্রতি সুগভীর অঙ্গীকার। বর্তমানে যুদ্ধ এবং নয়া-উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে দুনিয়া ব্যাপী গণ-আন্দোলন সহ আন্তর্জাতিক সংগ্রামের বর্ধিত সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। ত্রৎস্কি দুনিয়া ব্যাপী শোষিত ও নির্যাযিত সমর্থন করেন, কিন্তু তিনি যুক্তি দেন যে আন্তর্জাতিকতাবাদের অর্থ হওয়া উচিত সংহতির থেকেও অধিকতর কিছু- এর অর্থ প্রত্যেকটি সংগ্রামকে বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেখা।‘বিশ্বায়ন’-এর আধুনিক তাত্ত্বিকদের অনেক বছর পূর্বে লিখে ত্রৎস্কি যুক্তি দেন যে দুনিয়াটা বুঝতে হবে একটি বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং একটি বৈশ্বিক সংগ্রামের সমন্বয় হিসেবে। তিনি লিখেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ বিমূর্ত নীতি নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতি, উৎপাদিকা শক্তির বৈশ্বিক বিকাশ, এবং শ্রেণী সংগ্রামের বৈশ্বিক মাত্রায় চরিত্রের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রতিফলন” (Leon Trotosky, The Permanent Revolution, London, 2004, p49)।

 বিশ্বকে সমন্বিত সমগ্র হিসেবে পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু হয়ে তাঁর সকল কর্মকান্ড গড়ে উঠে- তাঁর স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্বের বিকাশ, সাম্রজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা, বিপ্লব বিস্তারণে তাঁর অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনে তাঁর সংশ্লিষ্টতা।

 এই প্রেক্ষাপট এবং সমন্বিত ও বন্ধুর বিকাশে ত্রৎস্কির উপলব্ধি আমাদের কিছু কৌশলগত উপসংহার দেখায় আজকের জন্য। ত্রৎস্কি যখন লিখেছিলেন তখনকার চেয়ে কৃষকের সংখ্যা এখন অনেক কম। এখন ভূমিতে কাজ করা অধিকাংশ মানুষেরা কৃষি মজুর, তাঁদের জীবন ও কাজ পুঁজিতন্ত্র ও বৃহদায়তন ব্যবসা দিয়ে গড়ে ওঠে্।

অর্থনীতির প্রান্তে বসবাসকারী শত শত স্থানচ্যুত অসংগঠিত দরিদ্রদের দ্বারা বৈশিষ্টায়িত হচ্ছে দক্ষিণ বিশ্বের নতুন ছড়িয়ে পড়া বস্তি-নগরী। অনেক নগরীতে, বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকার ঐ অংশগুলোতে দরিদ্রতমরা হচ্ছেন আদিবাসী জনগণ, এরা শোষণ ও দারিদ্র্যের ওপরে দশক দশক ব্যাপী বর্ণবাদের সম্মুখীন। দক্ষিণ বিশ্বের আধুনিক নগরগুলোতে আদিবাসী ও ”অনানুষ্ঠানিক” (informal) শ্রমিকেরা অস্থায়ী ও বিস্ফোরণোম্মুখ উপাদান তৈরী করে। তাঁরা বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণীয় বিদ্রোহের সূত্রপাত করতে পারে। চুড়ান্তভাবে এই সংগ্রামগুলোকে সংগঠিত শ্রমিকদের শক্তির সাথে সংযোগ করা দরকার, যাঁরা পুঁজিতান্ত্রিক অর্খনীতির কেন্দ্রে কৌশলগতভাবে অবস্থান করেন। সংগ্রামগুলোর এই ধরনের সংযোগে বিপ্লবের জন্য দিতে পারে সম্ভাবনা

স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব কর্মপদ্ধতিসমূহ উপস্থাপন করে যাতে গণতান্ত্রিক অধিকার সংস্কারসমূহের জন্য সংগ্রাম অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রামে একীভূত হতে পারে- শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে এবং কেন এই প্রশ্নাবলী স্বাতন্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে সমাধান সম্ভব নয়।

আজকের দরিদ্রতম দেশগুলোর জন্য জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কোনও সমাধান নেই। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনিদের জন্য সমাধান মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শ্রমিকদের ব্যাপক সংগ্রামসমূহের মধ্যে নিহিত- বিশেষ করে মিশরের ওপর। যতই ধনী হোক, সমাজতন্ত্র একদেশে অসম্ভব। সাব-সাহারান অফ্রিকার মত অঞ্চলগুলোর জন্য এটি শতগুণের অধিক সত্য।

বিপ্লবের প্রতি ত্রৎস্কির অঙ্গীকার কেবলমাত্র ঠিক অভ্যুত্থানের উচ্চ মাত্রা সম্পর্কে নয়। মার্কসের মত তাঁর অভিমত হ’ল মুক্তিকে হতে হবে শ্রমজীবি জনগণের নিজেদের কাজ। স্পষ্ট প্রতীয়মান সমস্যাবলীর একটি হচ্ছে যে অধিকাংশ সময়ের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রয়োজন দেখে না অথবা তাঁদের নিজেদের সামর্থবলীতে আস্থা থাকে না যে বিপ্লব সম্ভব। এ থেকে ত্রৎস্কির কৌশল ও উপায় (strategy and tactics)সম্পর্কযুক্ত হয়ে আসে গণ আন্দোলন গড়ার জন্য এবং বিপ্লবী মতবাদের দিকে ধাবিত করার জন্য।

আজ আমরা দুনিয়াব্যাপী নয়া প্রজন্মের গণ আন্দোলন দেখতে পাই এর সাথে সহগামী হিসেবে এই বিশ্বাসে বিকাশমান ভাঙ্গন দেখা যায় যে ঐতিহ্যবাহী সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিসমূহ যেমন ব্রিটেনের নিউ লেবার শ্রমিক-জনতাকে যে কোনও কিছু দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বৃহৎ ও নৈতিক প্রচারাভিযান গড়ে তোলার উপায় খুঁজে পেতে ত্রৎস্কির যুক্তফ্রন্টের কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ছোট বা বড় প্রত্যেকটি সংগ্রামে সংস্কারবাদের কৌশলের উপায় এবং বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা থাকে। সংস্কারবাদে পরিবর্তন উপর থেকে এবং রাষ্ট্রীয় পরিসীমার মধ্যে ঘটে। বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে সমস্ত পদ্ধতি গড়ে উঠে তা হ’ল: স্ব-কর্মকান্ড, নীচ থেকে গণ-সম্পৃক্ত সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সদিচ্ছা। এই সমস্ত সংগ্রামে ধারণাবলীর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

ত্রৎস্কির প্রতি বিশাল শ্রদ্ধা এই জন্য যে যখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিস্কৃত হন এবং রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হন, তখনও তিনি সংগঠিত থাকেন এবং কখনও স্তালিনের নিকট বা হতাশার নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। এটি সেই সংগ্রাম সুকঠোর অবস্থাবলীর প্রেক্ষাপটে যেটি জাগিয়ে রাখে যথার্থ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী ঐতিহ্য আজকের জন্য। এই ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে যথার্থ সাম্য,মুক্তি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের উপর।

ত্রৎস্কির ধারণাবলী তাঁর পূর্বসূরী মার্কসের মতই অন্ধ মতবাদ নয়।তিনি সবসময় সঠিক ছিলেন না। তাঁকে হত্যার ঠিক পূর্বে তিনি অনুমান করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পশ্চিমা পুঁজিতন্ত্র এবং স্তালিনবাদ গভীর সংকটে নিপতিত হবে। উভয় বিবেচনায় তিনি চুড়ান্তভাবে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হন, যুদ্ধের পরে তাঁর অনেক অনুসারী ভ্রান্তিতে নিপতিত হন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ন্যস্ত হয় তাঁর ধারণাবলীকে গড়তে ও বিকাশ করতে। কিন্তু যদি কিছু মানুষ অধিক দেখতে সমর্থ হন, এটি কেবলমাত্র এই কারণে যে তাঁরা দাঁড়ান জায়ান্টের কাঁধে। যুদ্ধ ও পুঁজিতন্ত্র প্রতিরোধে নিয়োজিত নতুন প্রজন্মের জন্য ত্রৎস্কির ধারণাবলী ও প্রক্রিয়াবলী শিক্ষায় পরিপূর্ণ।তাঁর জন্য যেমন আমাদের জন্য তেমনি, সেগুলো দুনিয়াকে পরিবর্তন করার এবং ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামের হাতিয়ার।

 

 

 

 

 

 

 


 
 
 
 
 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি