ত্রৎস্কি উত্তর ত্রৎস্কিবাদ, মূল: টনি ক্লিফ অনুবাদ: স ম আজাদ

Tony Cliff: revolutionary theory and practice - Counterfire
 
ত্রৎস্কি উত্তর ত্রৎস্কিবাদ

 টনি ক্লিফ

অনুবাদ: স ম আজাদ

উৎসর্গ: সন্তোষ স্যারকে


অধ্যায় এক

 সমস্যার স্বীকৃতায়ন

                                                     

 কমিউনিস্ট ইশতেহারে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেন যে শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে কমিউনিস্টরা সাধারণীকরণ করে। এই অভিজ্ঞতা সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং বিকাশমান। সুতরাং মার্কসবাদ সবসময় পরিবর্তিত হয়। মার্কসবাদের পরিবর্তন থেমে গেলে এটি মৃত মতবাদে পরিণত হয়। কখনো ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে ধীর গতিতে এবং প্রায় অব্যক্তভাবে। কিন্তু কখনো কখনো পরিবর্তন র‌্যাডিক্যাল হয়। ফলে মার্কসবাদের ইতিহাসে আকস্মিক ক্রান্তিকাল দেখা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, ১৮৪৮এর আসন্ন বিপ্ল­বের পশ্চাৎ-প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না এনে একজনের পক্ষে কমিউনিস্ট ইশতেহার এর সাফল্য বোঝা সম্ভব নয়।

আর একটি ক্রান্তিকাল ছিল ১৮৭১এর প্যারিস কমিউন। এটি মার্কসকে ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ লিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ‘শ্রমিকশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে সমাজতন্ত্র গড়তে এটিকে ব্যবহার করতে পারে না’।১ তিনি বলেন যে শ্রমিকশ্রেণীকে অবশ্যি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে এবং নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র গড়তে হবে যাতে কোন পুলিশ বাহিনী , স্থায়ী সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্র থাকবে না। এই রাষ্ট্রে সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত এবং যে কোনো সময়ে প্রত্যাহারযোগ্য হবে। যে মজুরদের তারা প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের সমান মজুরি পাওয়া উচিত। কমিউনিস্ট ইশতেহার-এ এগুলোর কোন উল্লেখ নেই। এখন মার্কস শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যাবলী চিহ্নিত করলেন। তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গভীর অধ্যয়ন করে এই উপসংহারে আসেননি। তাঁর উপলব্ধি এসেছিল প্যারিসের শ্রমিকদের কর্মকান্ড থেকে। এরা ক্ষমতা দখল করে টিকেছিল চুয়াত্তর দিন। এরা দেখিয়েছিল শ্রমিকশ্রেণী কী ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

পুনরায়, ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব ছিল ১৯০৫এর বিপ্লবের  সহ-উৎপাদ। এই তত্ত্ব যুক্তি দেয় যে পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত দেশগুলোতে বুর্জোয়া শ্রেণী দেরীতে আগত হিসেবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কর্মসূচী, যেমন জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও কৃষি সংস্কার সম্পন্ন করতে খুবই ভীতু ও রক্ষণশীল। কৃষক শ্রেণীর পুরোভাগে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এই কর্মসূচী সম্পন্ন হতে পারে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এই ইস্যুগুলো সমাধানের প্রক্রিয়াতে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব বুর্জোয়া সম্পত্তির নিয়মাবলীর সীমানা অতিক্রম করে এবং শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে চালিত করে।

বুর্জোয়া শ্রেণী প্রতিবিপ্লবী এবং শ্রমিক শ্রেণী কৃষক শ্রেণীকে নেতৃত্ব দেবে- এই ধারণাবলী কোন অন্তর্দৃষ্টি নয়- যা ত্রৎস্কির প্রতিভাবান মন থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদ্ভূত। এগুলো ১৯০৫এর বিপ্লবের বাস্তবতায় আবিষ্কৃত। আনুশীলনীকভাবে এটি দেখায় যে কিভাবে বুর্জোয়ারা নয়, শ্রমিক শ্রেণী সংগ্রাম করে জারতন্ত্র উৎখাত করে সমাজের ওপর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণভারের অনুশীলন করে। পেত্রোগ্রাদ, বিপ্ল­বের কেন্দ্রে এমন কী শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের সংগঠন শ্রমিক কাউন্সিল বা সোভিয়েত বিকশিত করে। লেনিন ও লুক্সেমবার্গের মতন ব্যক্তিত্বের দ্বারা মার্কসবাদের আরো বিকাশায়ন ঘটে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে। ১৯০৫এ রাশিয়া ও পোল্যান্ডে সংঘটিত সংগ্রামের উপজাত ছিল লুক্সেমবার্গের গণ-ধর্মঘট সম্পর্কিত প্রতিভামন্ডিত বইটি।

স্তালিন বলশেভিক বিপ্ল­বের ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেন, তখন একটি নতুন সন্ধিকাল শুরু হয়। এর সুরক্ষাকে বজায় রাখার দায়িত্ব ত্রৎস্কির ওপর ন্যস্ত হয়। ১৯৪০এ তাঁর হত্যার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বুদ্ধিদীপ্তভাবে এই দায়িত্ব পালন করেন। যাহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক নতুন ও সিদ্ধান্তিক (decisive) চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, এটি ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক কল্পনাকৃত অবস্থা থেকে র‌্যাডিক্যালগতভাবে ভিন্ন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এটি বিশেষ অসুবিধাসমূহের সৃষ্টি করে, আন্দোলনটি অসামান্য প্রতিভাধর জায়ান্টের এযাবৎ পর্যন্ত দেয়া নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।


ত্রৎস্কির পূর্বাভাস (Trotosky’s prognosis)


তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ত্রৎস্কি একসারি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এর মধ্যে চারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিকাশের বাস্তবতা দিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।


(১) তিনি অনুমান করেন যে রাশিয়াতে স্তালিনবাদী রেজিম টিকে থাকতে পারবে না। ১৯৩৫এর ১ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর ‘The Workers’ State, Thermidor and Bonapartism’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি যুক্তি দেন যে বোনাপার্টপন্থার একটি ধরন হিসেবে স্তালিনবাদ নিজেকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। পিরামিডের চূড়ায় ভারসাম্যাবস্থায় রাখা একটি গোলক অনিবার্যরূপে  গড়িয়ে পড়বে হয় এপাশ দিয়ে অথবা অপর কোন পাশ দিয়ে। সুতরাং, ‘স্তালিনবাদী  রেজিম অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগুবে’।২

এর একটি ফলাফল হতে পারে পুঁজিবাদী পুনর্গঠন। ১৯৩৪এর ১০ জুন ‘যুদ্ধ ও চতুর্থ আন্তর্জাতিক’ শিরোনামের অভিসন্দর্ভে ত্রৎস্কি লেখেন যে ‘প্রলম্বিত যুদ্ধের সাথে বিশ্ব প্রলেতায়িতের নিষ্ক্রিয়তা যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে, সোভিয়েত ইউনিয়নে অভ্যন্তরীণ সামাজিক দ্বন্দ্ব বুর্জোয়া বোনাপার্টিয় প্রতিবিপ্ল­বের দিকে হতে পারে, হতে হবে’।৩

১৯৩৬এর ৮ জুলাই তিনি একটি বিকল্প ভবিষ্যতের রূপরেখা তুলে ধরেন:


সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ থেকে অপরাজিতভাবে উঠে আসতে সমর্থ হবে কেবলমাত্র একটি শর্তের অধীনে, এবং তা হলো এটি যদি পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের বিপ্ল­ব দিয়ে সমর্থিত হয়। কিন্তু একই সময়ে আন্তর্জাতিক বিপ্লব সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র সুরক্ষা হলেও, এটি আবার সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের জন্য মৃত্যু ঘন্টা।4


যে প্রেক্ষাপটই আমরা বিবেচনা করি না কেন, এটা স্পষ্ট যে স্তালিনপন্থী রেজিমের অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে ত্রৎস্কির দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল। তাই ১৯৩৯এর ২৫ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধে ইউএসএসআর প্রবন্ধে তিনি লেখেন যে রুশ রেজিমকে স্থিতিশীল শ্রেণী ব্যবস্থা হিসেবে দেখার অর্থ হল ‘আমাদের নিজেদের হাস্যকর অবস্থায় নিপতিত করা’। কারণ ঐ সময়ে ‘এটি ছিল এর অগৌরবময় পতনের ঠিক কয়েক বছর বা কয়েক মাস পূর্বকার সময়’।5

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রকৃত বাস্তবতা ছিল খুবই পৃথক। স্তালিনপন্থী রেজিমের পতন ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৫এর পরে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে এটির শক্তি বৃদ্ধি ঘটে।


(২) ত্রৎস্কি ভেবেছিলেন যে পুঁজিবাদ চুড়ান্ত সংকটগ্রস্থ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে কোন ঐকান্তিক সামাজিক সংস্কার বা জনগণের জীবনযাত্রার মানের কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৩৮এ The Death Agony of Capitalism and the Tasks of the Fourth International প্রবন্ধে ত্রৎস্কি লেখেন যে পাশ্চাত্য বিশ্ব:


. . . ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের যুগে: যখন সাধারণভাবে প্রণালীবদ্ধ সামাজিক সংস্কার এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের কোন আলোচনাই চলে না........প্রলেতারিয়েতের প্রতিটি ঐকান্তিক দাবী এবং এমনকী পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী অনিবার্যরূপে বুর্জোয়া সম্পত্তি সম্পর্ক এবং বুজোর্য়া রাষ্ট্রের সীমাকে অতিক্রম করে।6


যাহোক যুদ্ধোত্তর বিশ্ব পুঁজিবাদ সাধারণ মন্দা (stagantion) ও পরিক্ষয় (decay) এর ফাঁদে আটকা পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিমা পুঁজিবাদ ব্যাপক সম্প্রসারণ উপভোগ করে এবং সাথে সাথে সংস্কারবাদও বিকশিত হয়। মাইক কিড্রন যেমনটি বলেন, ‘যুদ্ধ পরবর্তীকালে দীর্ঘসময়ের জন্য পদ্ধতিটি সামগ্রিকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পায় - ১৯৫০-১৯৬৪তে ১৯১৩-১৯৫০এর দ্বিগুণ, এবং  ঐ প্রজন্মের পূর্বে প্রায় অর্ধেক দ্রুত বৃদ্ধি পায়’।7

ফলে সামাজিক গণতন্ত্রী এবং কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভাঙ্গন দূরের কথা, যুদ্ধোত্তরকালে সংখ্যায় ও সমর্থনে পূর্বের তুলনায় তারা অধিকতর শক্তিশালী হয়। জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ণের ভিত্তিতে সংস্কারবাদের বিকাশ ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনে অ্যাটলি সরকার সংস্কারবাদের শীর্ষত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৪৫এ গঠিত এটি কেবলমাত্র প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ লেবার সরকারই ছিলনা, এটি লেবার পার্টির ইতিহাসে  চুড়ান্ত উচ্চতার (high-point) প্রতিনিধিত্ব করতো। ১৯৪৫-৫১এর লেবার সরকার সম্পর্কে মিথ যাই থাকুক না কেন, নিঃসন্দেহে এটি ছিল তাদের মধ্যে সবথেকে কার্যকর সংস্কারবাদী সরকার।

অ্যাটলির অধীনে শ্রমিকেরা এবং তাদের পরিবারবর্গ যুদ্ধপূর্ব সময় থেকে অধিকতর অগ্রসর হয়। সরকার সামাজিক সেবা খাতে উচ্চ ব্যয় বজায় রাখে। ১৯৪৯এর এপ্রিল নাগাদ খাদ্য ভর্তুকি ৪৬৫ মিলিয়ন পাউন্ডে উন্নীত হয়, এটি তখন পর্যন্ত ব্যাপক ব্যয়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং শ্রমিক জনগণের ব্যয় হ্রাসে ভূমিকা রাখে। এবং অবশ্যি, পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং মৃদু আপেক্ষিক মূল্যস্ফীতি শ্রমিকদের জন্য ছিল অপরিমেয় আর্শিবাদ।

সরকারের জন্য যে বিষয়টি  গণসমর্থন নিশ্চিত করেছিল তা হল পূর্ণ কর্মসংস্থান। লেবার পার্টির ক্ষমতাসীন সময়ে বেকারত্ব ছিল খুবই কম (কেবলমাত্র ১৯৪৭এর শীতের জ্বালানি সংকটের সময়টুকু বাদ দিয়ে, সে সময় এটি ৩%এ উন্নীত হয়েছিল)। ছয় বছর পূর্বের তুলনায় ১৯৫১এর জুনে ৩.৫ মিলিয়নের অধিক শ্রমিকের কর্ম-সংস্থান হয়েছিল।8 আর একটি নিয়ামক ছিল কল্যাণ রাষ্ট্র যার পতাকাবাহী প্রতীক ছিল ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস।

শ্রমিকদের মাঝে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল খ্বুই উচ্চ। ১৯৪৩এর উপনির্বাচনে এটি মাত্র আসন হারিয়েছিল! অধিকন্তু ১৯৫১এর অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনে তারা ভোট পেয়েছিল ১,৩৯,৪৮,৬০৫টি, সর্বমোট গৃহিত ভোটের ৪৯.৪% ছিল এটি। কেবলমাত্র নির্বাচনী ব্যবস্থা (electoral system)-এর অদ্ভুত কর্মকান্ড পার্লামেন্টে টোরিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। দেশে কৃচ্ছতাসাধন ও রেশনিং এবং বিদেশে যুদ্ধরত সত্ত্বেও, লেবার পার্টি তার সমর্থন ধরে রেখেছিল।9

এবং ব্রিটেনই ব্যতিক্রম ছিলনা। ইউরোপ জুড়ে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছিল। সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান বা প্রায় সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান বিরাজমান ছিল। পদ্ধতিগত সংস্কার অর্জিত হয় এবং গণ সংস্কারবাদী পার্টিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়নি।  জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং অন্যান্য দেশগুলোতে সামাজিক গণতন্ত্রী পার্টিগুলো দীর্ঘ দিনের জন্য শাসন করে।


(৩) তাঁর স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্ব ব্যবহার করে ত্রৎস্কি বলেন যে পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত দেশগুলোতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রী কর্মসূচীগুলো যেমন জাতীয় মুক্তি এবং কৃষি সংস্কার সম্পন্ন করতে পারে অথবা এগিয়ে নিতে পারে শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতা।

এটিও প্রকৃত ঘটনাবলীর দ্বারা প্রত্যাখাত হয়। দুনিয়ার সবথেকে জনবহুল দেশ চীনে, দেশের ঐক্যবদ্ধকরণ, সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আনয়ন এবং ভূমি সংস্কারকরণে মাও একটি স্তালিনপন্থী পার্টির নেতৃত্ব দেন সম্পূর্ণরূপে শ্রমিকশ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। একই ধরণের প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় অন্যান্য দেশে, যেমন কিউবা ও ভিয়েতনামে।


 (৪) সবশেষে, যদি উল্লেখিত পূর্বাভাস তিনটি সঠিক হতো, তবে স্তালিনবাদ অথবা সংস্কারবাদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকতো না এবং ভবিষ্যৎ উম্মুক্ত থাকতো চতুর্থ আন্তর্জাতিকের দ্রুত অগ্রসরায়নে। এই প্রেক্ষাপটে, ত্রৎস্কি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, আসন্ন অল্প কয়েক বছরেই এর বিশাল ভবিষ্যৎ রয়েছে।

১৯৩৮এর ১০ অক্টোবরে তিনি লেখেন:


২৫ বছর পূর্বের তুলনায় মানবজাতি অধিকতর দরিদ্র হয়ে পড়েছে, যখন ধ্বংসের উপায়গুলো অসীমভাবে ক্ষমতাবান হয়েছে। সুতরাং যুদ্ধের প্রথম মাসগুলোতেই শ্রমিক জনগণের মাঝে দম্ভবাদ (পযধাঁরহরংস)এর ধুঁয়ার বিরুদ্ধে ঝড়ো প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এই প্রতিক্রিয়ার প্রথম শিকার হবে ফ্যাসিবাদসহ দ্বিতীয় ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলো। নিশ্চিত বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য তাদের ধ্বংস হচ্ছে অপরিহার্য শর্ত, যা তার স্ফটিকায়নের জন্য চতুর্থ আন্তর্জাতিক ছাড়া আর কোনো অক্ষ অন্বেষণ করবে না। এর উজ্জীবিত ক্যাডারবৃন্দ নির্যাতিত জনতাকে নেতৃত্ব দিয়ে আক্রমণের পুরোভাগে নিয়ে আসবে।10


ত্রৎস্কি ইতেমধ্যে বিবৃত করেন যে:


যখন কমিউনিস্ট ইশতেহার এর শতবর্ষ (অর্থাৎ ১৯৪৮) উদযাপন হবে, তখন চতুর্থ আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তিক বিপ্লবী শক্তি হবে আমাদের গ্রহে।11


১৮ অক্টোবর ১৯৩৮এ ‘চতুর্থ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক একটি বক্তৃতাতে ত্রৎস্কি নিম্নোক্ত বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করেন:


দশ বছর! মাত্র দশ বছর! আমাকে একটি ভবিষ্যৎঅনুমান শেষ করতে অনুমতি দিন: পরবর্তী দশ বছর সময়ে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের কর্মসূচীসমূহ হবে নিযুত নিযুত জনতার পথ প্রদর্শক এবং এই বিপ্লবী নিযুত নিযুত জনতা জানবে কীভাবে স্বর্গ-মর্তকে কাঁপিয়ে দিতে হবে।12


একই থিমে পুনরাবৃত্তিক মন্তব্যসমূহ এই সত্য প্রতিষ্ঠা করে যে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের দ্রুত বিজয়ের ওপর বিবৃতিসমূহ ফেলে দেয়ার মত ছিল না, বরং তাঁর মৃত্যু অবধি এটি ছিল একটি ধ্রুব যোগসূত্র।

হায়, এই ভবিষ্যৎ-অনুমানও ছিল ভিত্তিহীন, কারণ ১৯৪৫ পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রকৃত বাস্তবতা রাশিয়া, পশ্চিমা পুঁজিবাদ, ও তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে তাঁর পুর্বাভাসকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে। চতুর্থ আন্তর্জাতিকের জন্য খুব সামান্য জায়গা বিদ্যমান থাকে-শ্রমিক শ্রেণীর ওপর সামান্য প্রভাবসহ ত্রৎস্কিপন্থী সংগঠনসমূহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যায়।


মার্কসবাদে ত্রৎস্কির অবস্থান


ত্রৎস্কিকে আমাদের ত্রৎস্কিপন্থীদের কী পদ্ধতিতে দেখা উচিত - এ ব্যাপারে প্রাথমিক মন্তব্য জরুরী। তিনি আমাদের মাঝে রাজনৈতিক জায়ান্ট ছিলেন। তিনি অক্টোবর বিপ্ল­বের সংগঠক, লালবাহিনীর নেতা, লেনিনের সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নেতা ছিলেন।

১৯২৬এ ব্রিটেন, বা ১৯২৫-২৭এ চীন বিপ্লব, বা নাৎসিবাদের উত্থানের সময়কার জার্মানী, ১৯৩৬এর ফ্রান্স এবং ১৯৩১-৩৮এর স্পেনের পরিস্থিতি - এগুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে যেয়ে ত্রৎস্কি চমৎকার সামর্থ্য  প্রদর্শন করেন জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণে, ভবিষ্যৎ বিকাশাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণীতে, প্রয়োজনীয় কৌশল  সুপারিশে।

ত্রৎস্কির বাণী প্রায়ই ভবিষ্যৎসূচক (prophetic) ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর বিশ্লে­ষণসমূহ প্রতিভাদীপ্তভাবে সময়ের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হয়েছিল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতি ব্যবহারে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ামকসমূহ সংশ্লেষণে, নিযুত জনগণের গণ-মনস্তত্ত্বের সঙ্গে তাদের আন্তঃসম্পর্ক পর্যবেক্ষণে, এবং বিষয়ী নিয়ামক (subjective factor) এর তাৎপর্য অনুধাবনে, মহান ঘটনাবলীতে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের ভূমিকা - এই সমস্ত বিষয়ে কোন মার্কসবাদী চিন্তানায়কই তাঁকে অতিক্রম করতে পারেননি।13 ত্রৎস্কির রুশ বিপ্ল­বের ইতিহাস অন্য যে কোন ইতিহাস বিষয়ক মার্কসবাদী লেখালেখিকে অতিক্রম করে গেছে। এটি হল অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের বিশ্লেষণীয় ও শৈল্পিক কীর্তি।14

ত্রৎস্কির ১৯২৮-৪০এর লেখালেখিগুলো, যেমন জার্মানী, ফ্রান্স ও স্পেনের বিকাশাবলীর উপর নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও বইসমূহ হল সবচেয়ে মেধাবী মার্কসবাদী লেখাগুলোর অন্যতম। সেগুলোকে কার্ল মার্কসের সবচেয়ে সেরা ঐতিহাসিক লেখাগুলো যেমন, লুই বোনাপার্টের আঠারো ব্রুমেয়ার ও ফ্রান্সে শ্রেণী সংগ্রাম­ - এগুলোর সঙ্গে এক সারিতে স্থান দেয়া যায়। ত্রৎস্কি নিজেকে কেবলমাত্র পরিস্থিতি বিশ্লে­ষণেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের জন্য কর্মের স্পষ্ট দিক নির্দেশনা (clear line of action) দেন। কৌশল ও পদ্ধতির (strategy and tactics) বিবেচনায় তাঁর লেখালেখিগুলো খুবই মূল্যবান বিপ্লবী ম্যানুয়াল। এগুলো লেনিনের সেরা লেখাগুলোর সঙ্গে তুলনীয়।

            হিটলারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পুর্ববর্তী বছরগুলোতে জার্মানীর ওপর তাঁর লেখাগুলো হল ত্রৎস্কির কাজগুলোর মধ্যে মূল্যবান রত্নের একটি উদাহরণ। ঐ সময়ে দুনিয়াতে জার্মানী ছিল এমন একটি দেশ যেটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন বিদ্যমান ছিল। এটি গভীর মন্দা ও সামাজিক সংকটে প্রবেশ করছিল, যা নাৎসি আন্দোলনের দ্রুত বৃদ্ধির পশ্চাৎপট ছিল। এর মুখোমুখি হয়ে ত্রৎস্কি তাঁর সকল শক্তি ও জ্ঞান নিয়োজিত করেন। এই সময়ে তিনি জার্মানীর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ব্যাপক সংখ্যক পুস্তিকা, পাম্ফলেট ও নিবন্ধসমূহ লেখেন। তাঁর সবচেয়ে প্রতিভাদীপ্ত লেখালেখির মধ্যে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত। কোনো ঘটনাবলীর গতিধারায় এমন পূর্বজ্ঞান (prescience) আর কোথাও দেখা যায় না। নাৎসীদের উত্থানের ভয়াবহ বিপর্যয় যা জার্মানদেরসহ আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীকে হুমকিগ্রস্থ করছিল সে সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাদের থামানোর জন্য কর্মোদ্যোগ, শ্রমিক আন্দোলনের সবগুলো সংগঠনের যুক্তফ্রন্টের জন্য তাঁর আহবান আরো বেশী জরুরী হয়ে পড়ে। দুঃখজনকভাবে তাঁর ভবিষ্যৎসূচক হুশিয়ারিসমূহ এবং জরুরী আহবানসমূহে কর্ণপাত করা হয়নি। তাঁর কণ্ঠস্বর অরণ্যে রোদন হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি (KPD) অথবা সমাজ গণতন্ত্রী পার্টি (SDP) কোন মনোযোগ দেয়নি। যদি কর্মোদ্যোগের জন্য ত্রৎস্কির বিশ্লে­ষণ ও প্রস্তাবনাসমূহ গৃহিত হতো, তাহলে শতাব্দীর পরবর্তী ইতিহাসমূহ সম্পূর্ণ পৃথক হতে পারতো। জার্মান ঘটনাবলীর ওপর ত্রৎস্কির বিশ্লে­ষণ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষভাবে হৃদয়গ্রাহী যে, লেখক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট থেকে বিবেচনার যোগ্য দূরত্বে অবস্থান করছিলেন। তারপরও তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রতিদিনকার ঘটনাবলী অনুসরণ করতে ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। ১৯৩০-৩৩এর ত্রৎস্কির লেখালেখির অধ্যয়ন, এগুলোর মুর্ততা স্পষ্ট ধারণা দেয় যে লেখক অবশ্যি জার্মানীতে বসবাস করছিলেন, তুরস্কের প্রিনকিপো দ্বীপের মত কোন দুরবর্তী স্থানে নয়।15

১৯৩০ এর দশকের ভয়াবহ অন্ধকার দিনগুলোতে ত্রৎস্কি আমাদের জন্য উদ্ভাসিত হন একজন প্রতিভাদীপ্ত পরিচালন তারকা (guiding star) হিসেবে। নাৎসীদের ভীতিপ্রদ উত্থানে, এবং মস্কোর সাজানো বিচারেÑযাতে অক্টোবর বিপ্লব, বলশেভিক পার্টি ও কমিনটার্নের নেতাদের নাৎসি এজেন্ট হিসেবে দোষী গণ্য করা হয়, আমাদের নির্ভরশীলতা আদর্শিক ও আবেগিকভাবে গভীর ও বোধগম্য ছিল । তাঁর সামগ্রিক অবস্থার বিশ্লেষণের এবং এটাকে মোকাবেলাকরণে তাঁর দ্বারা বিকাশকৃত দরকারী কৌশল ও পদ্ধতির (strategy and tactics) প্রতিভাদীপ্ত সৃজনশীল ক্ষমতার ওপর আমাদের সম্পূর্ণরূপে ও সঠিকভাবে প্রত্যয় তৈরী হয়েছিল।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা ত্রৎস্কিপন্থীগণ কীভাবে মেনে নিয়েছিলেন?


যুদ্ধের পরে স্তালিনপন্থী রেজিমের ভবিষ্যৎ, পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বসহ পশ্চাৎপদ ও উন্নয়নশীল প্রাচ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ সত্য হয়নি - এই বাস্তবতার মোকাবেলা ছিল বাস্তবিকই যন্ত্রণাদায়কভাবে বেদনাকর। বাস্তব অবস্থার মোকাবেলা পরিহার করে ত্রৎস্কির বাণীসমূহ আক্ষরিকভাবে বারবার উদ্ধৃত করে ত্রৎস্কিকে খুবই সম্মান দেয়া হলেও, তা খুবই অপমানেরও বটে। এটা হলো তাঁকে পরা-ঐতিহাসিক (supra-historical) ব্যক্তি বলে গণ্যকরণ; যা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ভারাক্রান্ত মনে আমাদের স্মরণ করতে হয় একটি প্রবাদের যা আরিস্তোতলের বলে গণ্য করা হয়: ‘প্লাতো আমার প্রিয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত সত্য আমার নিকট অধিকতর প্রিয়।’

বোধগম্যভাবে, কিন্তু ভ্রান্তভাবে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের নেতৃত্ব সামগ্রিকভাবে এই সত্যকে মোকাবেলা করতে অস্বীকৃতি জানায় যে মৌল ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ঘটনাবলী দিয়ে অমূলক বলে প্রতিপন্ন। এই সত্যটির সম্মুখীন হওয়া  ছিল এই প্রশ্নটির উত্তরের জন্য পূর্বশর্ত: কেন সেগুলো সত্য হয়নি? উত্তর অন্বেষণের শতকরা নব্বই ভাগ হলো সত্য প্রশ্নটি জিজ্ঞাসাকরা। আইজাক নিউটনের অনেক অনেক পূর্ব থেকেই গাছ থেকে আপেলের পতন ঘটত। তাঁর ‘কেন?’ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসাকরণই অভিকর্ষ সূত্রের দিকে ধাবিত হয়।

বিশ্ব ত্রৎস্কিপন্থার সংকট অতিক্রমণে, একজনকে ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ ও বাস্তবতার মধ্যকার বিশাল ব্যবধানকে মোকাবেলা করতে হয়। এটি প্রয়োজনিকভাবে ঘটেনি।

ত্রৎস্কির প্রথম অনুমানটি নেয়া যাক। উপরের উদ্ধৃতি অনুসারে, তিনি ভেবেছিলেন যে স্তালিনবাদী রেজিম যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না। তারপর যখন রাশিয়াতে স্তালিনের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রৎস্কিপন্থীদের নেতা জেমস পি ক্যাননের উপসংহার ছিল যে অতএব যুদ্ধ শেষ হয়নি!


ত্রৎস্কি পূর্বানুমান করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্য নির্ধারিত হবে যুদ্ধে, যা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস জুড়ে অবস্থান করে। আমরা কেবলমাত্র কিছু লোকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি যারা তাচ্ছিল্য সহকারে মনে করে যে যুদ্ধ শেষ। যুদ্ধ কেবলমাত্র একটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে এবং এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য  পুনঃগোষ্ঠীকরণ ও পুনঃসংঠনের প্রক্রিয়াতে রয়েছে। যুদ্ধ শেষ হয়নি, এবং আমরা বলি ইউরোপে যুদ্ধ থেকে পাওয়া ইস্যু হল বিপ্ল­ব যা এজেন্ডা থেকে বাদ দেয়া হয়নি। এটিকে কেবলমাত্র বিলম্বিত করা হয়েছে এবং স্থগিত করা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট মাত্রায় শক্তিশালী বিপ্লবী পার্টির অভাবের জন্য।16


এটি ছিল Scholasticism-এর চরম দৃষ্টান্ত। মধ্যযুগে scholastic পন্ডিতগণ বিতর্ক করতেন যে শীতে তেল জমে কিনা, কিন্তু বরফে তেলের পাত্র রেখে পর্যবেক্ষণের ছোট্ট পরীক্ষাটি করতেন না, এর পরিবর্তে  এই বিষয়ে আরিস্তোতল থেকে উদ্ধৃতির খোঁজ করতেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার এগারো মাস পরে এমনকি সবচেয়ে গোঁড়া ত্রৎস্কিপন্থীদের নিকট স্পষ্ট হয় যে স্তালিনপন্থী রেজিম  যুদ্ধে টিকে গেছে। কিন্তু তারপরও তাঁরা দৃঢ়ভাবে প্রচার করে যে রেজিম খুবই নড়বড়ে অবস্থায় আছে। এইভাবে এপ্রিল ১৯৪৬এ চতুর্থ আন্তর্জাতিক ঘোষণা করে যে:


কোন রকম অতিরঞ্জনের ভীতি ছাড়াই একজন বলতে পারে যে ক্রেমলিন দেশে-বিদেশে এরকম অধিকতর সংকটজনক অবস্থার সম্মুখীন আর কখনো হয়নি যা আজকে হয়েছে।17


এই জোরালো দাবীর সমর্থনে নিম্নোক্ত কথানক (anecdote) উল্লেখ করা যায়:


. . . কালিনিন একটি জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন যাতে একটি ঘটনা সংঘটিত হয়। একজন নারী উঠে দাঁড়িয়ে দাবী করলেন যে কেন তিনি এমন চকচকে পালিশ করা বুট পরেছেন, যখন জনগণকে খালি পায়ে বা বাকলের জুতা পরিধান করে হাটতে হয়। এটি বাস্তবিকই দুঃসাহসিক! এটি আমলাতন্ত্রের সুযোগ-সুবিধাগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে গড়ে উঠা ঘৃণার মাত্রা নির্দেশ করে।18


যাহোক, যুদ্ধোত্তর রাশিয়ার দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার বর্ণনা থেকে অনেক দূরে এটি, যেমনটি আমি চতুর্থ আন্তর্জাতিকের নেতৃস্থানীয় সদস্য আরনেস্ট মেন্ডেলকে বলেছিলাম, যখন আমি তাঁর সাথে প্যারিসে সেপ্টেম্বর ১৯৪৬এ দেখা করেছিলাম, এই কাহিনীটি তার অনেক বছর পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। বাস্তবিকই, এটি যে ঘটনাটির শরণ নেয় সেটি ঘটেছিল সিকি শতাব্দীর অধিকতর পূর্বে!

তারপরও এপ্রিল ১৯৪৬এ চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সম্মেলন দাবী অব্যাহত রাখে যে:


যে ক্ষমতাটি পূর্বে কখনও অর্জিত হয়নি তার আবির্ভাবের পেছনে, এই বাস্তবতাটি ওৎ পেতে আছে যে ইউএসএসআর ও সোভিয়েত আমলাতন্ত্র তাদের অস্তিত্বের ক্রান্তি পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।19


স্তালিনিয় পতন সম্পর্কে ত্রৎস্কির অনুমান ছিল রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্রের ওপর তাঁর বিশ্লেষণের অপরিহারযোগ্য পরিণতি। যদি অনুমানটি ভুল হয়, তখন তাঁর মৌলিক বিশ্লেষণ প্রায়োজনিকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যদি এমনটি হয় তবে স্তালিনপন্থী আমলাতন্ত্রের একটি নতুন ব্যাখ্যা অপরিহার্য। এই কাজটি করার নিকটবর্তী হওয়ার একটি পথ ছিল এটি জিজ্ঞাসা করা যে স্তালিন কর্তৃক জয় করে নেয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর শ্রেণী চরিত্র কী ছিল, যে দেশগুলো শীঘ্রই স্বয়ং রাশিয়ার প্রায় যথার্থ রেপ্লিকা হিসেবে পুনর্মডেলায়িত হয়।

চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্পূর্ণরূপে ত্রৎস্কির দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে যে রাশিয়া ছিল একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র,‘বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র’, শাসক আমলাতন্ত্র কর্তৃক বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র। তারপরও যদি পোল্যান্ড, চেকোস্লাভাকিয়া, হাঙ্গেরি ইত্যাদির প্রকৃতি রাশিয়ার মতই হয়, তখন কী এটাই প্রতীয়মান হয় না যে স্তালিন পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। তাহলে তিনি প্রতিবিপ্লবীর তুলনায় বরং বিপ্লবীই নন কি? কিন্তু তা হওয়ার নয়। প্রথমে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের নেতৃবৃন্দ অসঙ্গতি নিরসন করেন খুবই সাদামাটাভাবে: তাদের মধ্যে সাদৃশ্য সত্ত‌্বেও পূর্ব ব্লকের দেশগুলো তখন পর্যন্ত পুঁজিবাদী, অন্যদিকে রাশিয়া একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র।

সেপ্টেম্বর ১৯৪৬এ মেন্ডেল বিবৃত করেন যে যুগোস্লাভিয়াসহ ‘সকল জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো’ পুঁজিবাদী দেশ। স্তালিনপন্থীগণ পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব সংঘটিত করেননি, বরং প্রতি-বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন।  যুগোস্লাভিয়া ও আলবেনিয়া সম্পর্কে তিনি কী লিখেছিলেন কেবলমাত্র তা উদ্ধৃত করা যাক: এই দুটি দেশে সোভিয়েত আমলাতন্ত্রের কোন লাগাতার প্রতিবিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনের দরকার ছিল না; স্থানীয় স্তালিনপন্থীগণই তা নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছিল।’ উভয়ই দেশে স্তালিনপন্থীগণ ‘একটি নতুন বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র স্থাপন করেছিল’।20

আরো দুবছর চতুর্থ আন্তর্জাতিক পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে একই লাইন বজায় রাখে। এপ্রিল ১৯৪৮এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসে ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ’ (যুগোস্লাভিয়া সহ) এর শ্রেণী চরিত্র সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয় যে ‘এই দেশগুলো মূলগতভাবে তাদের পুঁজিবাদী গঠন বজায় রেখেছে . . .। এইভাবে বুর্জোয়া কার্যাবলী ও গঠন বজায় রেখে, এই “বাফার” দেশগুলোর রাষ্ট্রসমূহ একই সময়ে বোনাপার্টপন্থার সবচেয়ে চরম রূপের প্রতিনিধিত্ব করে।’ এটি অনুবৃত্তি করে, “বোনাপার্টপন্থার চরম ধরনসমূহ” এবং “পুলিশি একনায়কতন্ত্র” ইত্যাদিসহ “জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ” হল পুঁজিতান্ত্রিক দেশ। সুতরাং, কেবলমাত্র “জনগণের বিপ্লবী কর্মকান্ড”-এর মাধ্যমে পুঁজিতন্ত্রের ধ্বংস সম্পন্ন করা যেতে পারে, কিন্তু তখন পর্যন্ত সেটি প্রকৃত বাস্তবতা ছিল না, কারণ বিপ্লব দাবী করে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের তীব্র ধ্বংস।’ এইভাবে আপনি এই অবস্থাসমূহের কোনটিই রক্ষা করতে পারতেন না, বরং আপনাদের পর্যবেক্ষণ করতে হতো ‘কঠোরতম বিপ্লবী পরাজয়বাদ’।21

দুই মাস পরে যখন টিটো স্তালিনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন, তখন চতুর্থ আন্তর্জাতিক ডিগবাজী দেয়: পুলিশি বোনাপার্টিয় একনায়কতন্ত্রের অধীনে যুগোস্লাভিয়া আর পুঁজিবাদী দেশ নয়, বরং একটি প্রকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র। ১৯৪৮এর ১লা জুলাইতে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের আন্তর্জাতিক সেক্রেটারিয়েট ‘যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি খোলা চিঠি’ ইস্যু করে: ‘যদি আপনি কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে মনোযোগ সহকারে কাজ করেন, তবে আপনি আপনার হাতে একটি ক্ষমতাশালী শক্তিকে ধরতে পারেন’, এবং উপসংহারে লেখে, ‘একটি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কর্তৃক ক্রেমলিন মেশিনের বিরুদ্ধে বিজয়দৃপ্ত প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি . . . . যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’।22 প্রথম অবস্থাতেই এটি ছিল একটি অগভীর বিশ্লেষণ এবং এটি ১৯৪৮এ যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসে টিটোর দম্ভোক্তিকে উপেক্ষা করে যাতে তিনি বলেন যে তিনি এবং তাঁর বন্ধুগণ জানেন কিভাবে ‘ত্রৎস্কিপন্থী-ফ্যাসিবাদী’-দের পিপলস কোর্টের সামনে হাজির করে মোকাবেলা করা যায় এবং সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা যায়।  ১৯৪৮এর ৪ জুলাইতে বুরবা  লেখে:


কতিপয় ত্রৎস্কিপন্থী তাদের সত্যিকার পরিচয়টি তুলে ধরেছেন হানাদারদের দালাল ও এজেন্ট হিসেবে। তারা লজ্জাস্করভাবে পিপলস কোর্টের সামনে পরিণতির সম্মুখীন হন।23


           সোজাসুজি এই ধরনের ডিগবাজী (flip-flops) দিয়ে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সাধারণ সম্পাদক মাইকেল পাবলো নতুন লাইন গ্রহণ করেন, এবং তাহ’ল, রাশিয়ার প্রাচ্য ব্লক হল শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের চরম রূপ। তিনি ১৯৪৯এ বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রসমূহের শতাব্দীর ধারণার প্রবর্তন করেন।24 এপ্রিল ১৯৪৫এ পাবলো লেখেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী হুমকি ও বিশ্ববিপ্লবের মধ্যে আটকা পড়ে সোভিয়েত আমলাতন্ত্র বিশ্ববিপ্লবের পক্ষে অবস্থান নেয়’।25 অধিকন্তু সোভিয়েত আমলাতন্ত্র রেজিমের বিআমলাতন্ত্রায়ন এবং ‘সামগ্রিক ও প্রকৃত উদারীকরণ করছিলেন এবং অব্যাহতভাবে তা জারি রেখেছিলেন’।26 পাবলো স্তালিনবাদের আত্মসমর্থনকারীতে পরিণত হন। যদি বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রসমূহের শতাব্দী জারি থাকে, তবে ত্রৎস্কিবাদ অথবা শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের কী ভূমিকা সেখানে থাকে? স্তালিনবাদকে প্রগতিশীল বলে হাজির করা হলে ত্রৎস্কিবাদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

বিভিন্ন দেশকে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাপটিজাইশনে পাবলো থেকেও অধিকতর এগিয়ে যান জুলিয়ান পোসাদাস। তিনি আর্জেন্টিনিয় ত্রৎস্কিপন্থী  এবং চতুর্থ আন্তর্জাতিকের একটি লাইনের নেতা। পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ, কিউবা, চীন, উত্তর ভিয়েতনাম এবং বহিঃমঙ্গোলিয়া ছাড়াও পোসাদাস আবিষ্কার করেন যে অন্যান্য দেশসমূহের একটি সামগ্রিক সংখ্যাও শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র। পোসাদাস ঘোষণা করেন:


. . . আফ্রিকা [ও] এশিয়ার একসারি দেশ যেমন, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, মালি, গিনি, কঙ্গো, ব্রাজাভিল ইত্যাদির শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে বিবর্তন অবশ্যি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে হবে আন্তর্জাতিককে, যাতে কখন তারা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় তা নির্ণয় করা যায়।27


            অযৌক্তিকভাবে পোসাদাস বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে উৎসাহভরে প্রতীক্ষা করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আহবান জানান পারমাণবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার জন্য। ১৯৬২তে একটি ‘অসাধারণ সম্মেলন’ এ তাঁর চতুর্থ আন্তর্জাতিক ঘোষণা করে:


. . . . পারমাণবিক যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী। এটি সম্ভবত মানবজাতির অর্ধেককে ধ্বংস করবে; এটি বিপুল মানবিক সম্পদ ধ্বংস করতে যাচ্ছে। এটি খুবই সম্ভব। পারমাণবিক যুদ্ধ দুনিয়াতে একটি সত্যিকার দোযখের উস্কানি দিতে যাচ্ছে। কিন্তু সাম্যবাদকে বাঁধাগ্রস্থ করতে পারবে না। উৎপন্ন বস্তুগত দ্রব্যাদির জন্য নয়, বরং মানব সত্তার সজ্ঞার কারণে, সাম্যবাদ একটি অর্জিত প্রয়োজন। মানবজাতি সাম্যবাদী ধরণে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং কাজ করে, এখন যেমন কাজ করছে, কোনো পারমাণবিক বোমার সাধ্য নেই মানব সজ্ঞা যা অর্জন করেছে এবং যা শিখেছে, তা থেকে তাকে পিছনে ফেরানোর . . . . ।

ইতিহাস এর তীব্র, অনিয়মিত (spasmodic) ধরন দেখাচ্ছে যে পুঁজিবাদের জন্য  খুবই অল্প সময় বিদ্যমান। খুবই অল্প সময়। আমরা সম্পূর্ণ সচেতন ও নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে যদি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রসমূহ ঔপনিবেশিক বিপ্লবসমূহকে সহায়তাকরণে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে, তাহলে পুঁজিবাদের আয়ু দশ বছরও নেই। এটি একটি সাহসী ঘোষণা, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক। পুঁজিবাদের দশ বছর আয়ু নেই। যদি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রসমূহ তাদের সকল শক্তি দিয়ে ঔপনিবেশিক বিপ্লবকে সমর্থন দেয়, তখন পুঁজিবাদের আয়ু পাঁচ বছরও থাকবে না, এবং পারমাণবিক যুদ্ধ খুবই সংক্ষিপ্ত সময় বিদ্যমান থাকবে।28


            অর্ধেক মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হবে! কিন্তু তা কোনো ব্যাপার নয়। সাম্যবাদের বিজয় নিশ্চিত!


আমরা আমাদের নিজেদের এমন একটা পর্যায়ের জন্য প্রস্তুত করছি যাতে পারমাণবিক যুদ্ধের পূর্বে আমরা ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করবো, পারমাণবিক যুদ্ধের সময়ে আমরা ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করবো এবং আমরা ক্ষমতায় থাকবো, এবং পারমাণবিক যুদ্ধের ঠিক পরপরই আমরা ক্ষমতায় থাকবো। পারমাণবিক যুদ্ধের কোনো শুরু নেই, শেষ আছে, কারণ পারমাণবিক যুদ্ধ একই সঙ্গে সারা দুনিয়াতে বিপ্লব; চেইন বিক্রিয়া হিসেবে নয়, যুগপৎ। যুগপৎতার অর্থ একই দিন এবং একই ঘন্টা নয়। মহান ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ঘন্টা অথবা দিন দিয়ে পরিমাপ করা উচিত নয়, বরং যুগ দিয়ে পরিমাপ করা উচিত . . .। শ্রমিক শ্রেণী কেবলমাত্র একাকী নিজেদের ব্যবস্থাপনা বজায় রাখবে, তাৎক্ষণিকভাবে এর সংহতি ও কেন্দ্রীকরণ অন্বেষণ করবে . . .

            ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর পরে, সকল দেশে জনগণ জেগে উঠতে শুরু করবে - খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে, কয়েক ঘন্টায়। নিজেকে গুহায় না ঢুকিয়ে এবং এটি যা পারে তার সবই ধ্বংস করার চেষ্টা করা ব্যতিত, পুঁজিবাদ নিজেকে পারমাণবিক যুদ্ধে রক্ষা করতে পারবে না।  বিপরীতক্রমে, জনগণ জেগে উঠতে যাচ্ছে, জেগে উঠতে হবে, কারণ শত্রুকে পরাজিতকরণ হলো একমাত্র বেঁচে থাকার উপায় . . .। পুঁজিতন্ত্রের যন্ত্র পুলিশ, সেনাবাহিনী প্রতিরোধে সক্ষম হবে না . . .। তাৎক্ষণিকভাবে শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতাকে সংগঠিত করার দরকার হবে . . . ।29


            এই যুক্তি অনুসারে, যদি একটি হাইড্রোজেন বোমা লন্ডনে পড়ে, তবে ভয় ও অক্ষমতায় বিহ্বল শ্রমিক শ্রেণীর অবশিষ্টাংশ ক্ষমতা দখল করবে! এইভাবে মার্কসবাদ মূলসূত্র থেকে তাবিজে পরিণত হয়! শ্রমিকদের পারমাণবিক ধ্বংসের ফলে শ্রমিকদের রাষ্ট্র যাতে শ্রমিকদের ক্ষমতা নেই, বাক স্বাধীনতা নেই, সেটি শ্রমিকদের বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়! কী আদর্শিক অবনতি। ঊনিশ শতকে ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অর্থাৎ মার্কসবাদ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু এখন মার্কসবাদ প্রতিস্থাপিত হচ্ছে ‘অলৌকিক’ সমাজতন্ত্র দিয়ে!

            মেন্ডেল, পাবলো ও পোসাদাস একই সুস্থিত গোঁড়ামীপূর্ণ ত্রৎস্কিবাদ থেকে এসেছিলেন। এটি ত্রৎস্কির বাণীসমূহে অটল থেকে সেগুলোর স্পিরিটকে বিসর্জন দিয়েছিল।

            বিশ্ব পুঁজিবাদের পরিণতি সংক্রান্ত দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীর কী হয়েছিল? পুঁজিবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ উন্নয়নশীল তেজীভাবের সম্মুখীন হয়ে, ১৯৪৬এর এপ্রিলে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সম্মেলন ঘোষণা করে যে:


. . . .এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে পুঁজিতান্ত্রিক সুস্থিতিকরণ ও উন্নয়ণের একটা নয়া যুগের আমরা সম্মুখীন হচ্ছি . . .।  যুদ্ধ পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিসংগঠনায়ন (disorganisation)-এর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে, এটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবলীতে একটি অপেক্ষাকৃত সুস্থিত সাম্যাবস্থার শেষ সম্ভাবনাসমূহকে ধ্বংস করেছে।30


            অধিকন্তু:


যুদ্ধ পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পুনরুজ্জীবনকে দুর্বল করে দেয়, এবং বিশেষ করে মহাদেশীয় ইউরোপীয় দেশগুলো বৈশিষ্ট্যায়িত হবে একটি বিশেষ ধীর গতিমাত্রা দিয়ে যা তাদের অর্থনীতিকে মন্দা ও পরিক্ষয়ের সীমান্ত পর্যায়ে রাখবে।31


            এটা স্বীকার করা হয় যে ‘আমেরিকার অর্থনীতি একটি আপেক্ষিক তেজীভাবের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবে শীঘ্রই . . . ’ কিন্তু এই তেজীভাব ক্ষণস্থায়ী হবে: ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারপর একটি  নয়া অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত হবে, বিশ্ব অর্থনীতিতে আরো ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়াসহ এটি ১৯২৯-৩৩এর সংকট থেকেও অধিকতর গভীরাভিমুখী ও ব্যাপক হবে ।’ ব্রিটিশ পুঁজিতন্ত্রের সম্ভাবনাগুলো ছিল ‘গভীর অর্থনৈতিক অসুবিধাসমূহ (difficulties), প্রবল আলোড়ন, এবং আংশিক ও সাধারণ সংকটসমূহের একটি দীর্ঘ পর্যায়’। দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা কী হতে পারে? ‘যুদ্ধের পূর্বে যে অবস্থাসমূহ বিদ্যমান ছিল তার থেকেও অধিকতর খারাপ জীবনযাপনের মানের অধীনে প্রলেতারিয়েত শ্রম দিতে থাকবে’।32

             এই অবস্থাসমূহের প্রেক্ষাপটে একটি উদীয়মান বিপ্লবী তরঙ্গের ঢেউ অনিবার্য। এর কারণ:


. . . প্রলেতারিয়েতের প্রতিরোধ এবং তাদের জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নতির দাবীর কারণে, যে উন্নতি পুঁজিবাদের উত্থানের সম্ভাবনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

            ইউরোপে যুদ্ধ যদি আমাদের প্রত্যাশিত বিপ্লবী উচ্ছাসের সুযোগ ও মেজাজ তৈরী না করে, তারপরও এটা অস্বীকার করা যায় না যে এটি বিশ্বমাত্রায় পুঁজিতান্ত্রিক সাম্যাবস্থার ধ্বংসসাধন করে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবের দারোদ্ঘাটন করবে . . .।33


            বিশ্ব পুঁজিবাদের মন্দা এবং গণবেকারত্ব একটি সার্বিক বিপ্লবী পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারবে:


অতীতের জানা যে কোনো সংকট ছাপিয়ে আমরা এখন বিশ্বব্যাপী সংকটের সম্মুখীন। বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী উচ্ছাস বিকশিত হচ্ছে দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অসম মেজাজে, কিন্তু অবিরামভাবে এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে বিপরীতমুখী প্রভাবে অনুুশীলনকৃত হচ্ছে, এবং এইভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবী প্রেক্ষাপট নির্ণীত হচ্ছে।34

 

            ১৯৪৬এ চতুর্থ আন্তর্জাতিক ভবিষ্যদ্বাণী করে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চেয়েও বিপ্লবী তরঙ্গ অধিকতর বিস্তৃত এবং উচ্চতর হবে:


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে বিপ্লবী সংগ্রামের গ্রাফ প্রথম থেকেই বৈশিষ্ট্যায়িত হয় একটি সংক্ষিপ্ত ও ত্বরিত উত্থান দিয়ে, এটি ১৯১৯-এর বসন্ত নাগাদ এর সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে, তারপর তীক্ষ্ম ও ধারাবাহিক অবনমনের সম্মুখীন হয় এবং এই অবনতিতে ছেদ ঘটে ১৯২৩ এ একটি নতুন ও খুবই সংক্ষিপ্ত উত্থান দিয়ে।

            এই সময়ে বিপ্লবী সংগ্রামের গ্রাফ শুরু হয় একটি ধীর ও দ্বিধান্বিত উত্থান দিয়ে, যা মাঝে মাঝে বাধাগ্রস্থ হয় অনেকগুলো দোলায়মান বা আংশিক পশ্চাৎগতি দিয়ে, কিন্তু এর সাধারণ প্রবণতা ছিল উর্ধ্বমূখী। এই ঘটনার গুরুত্ব অনিবার্য (obvious)। যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্দোলন প্রাথমিক পরাজয়সমূহ, বিশেষ করে জার্মানীর পরাজয় দিয়ে ভারাক্রান্ত, তখন অন্যদিকে বর্তমান আন্দোলন এই ঘটনা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে কোন সময়েই প্রলেতারিতের পূর্ণ শক্তি সংগ্রামে নিয়োজিত হয়নি। সুতরাং পরাজয়গুলো সাময়িক এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আপেক্ষিক। এগুলো ঘটনাবলীর উত্তরকালীন বিকাশাবলীকে পর্যুদস্ত করে না।  এই পরাজয়গুলোকে প্রশমিত করা যেতে পারে সংগ্রামের পথকে অধিকতর অগ্রসর পর্যায়ে উন্নীত করে।35


            একমাত্র ভিন্ন প্রতিকল্প ছিল এই যে, যদি বিপ্লবী তরঙ্গ প্রলেতারিয়েতের বিজয়ের দিকে ধাবিত না হয়, তবে খুব স্বল্প সময়ে নয়া ফ্যাসিবাদী রেজিমসমূহ দিয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হবে:


এর নিজের নিবর্তনমূলক যন্ত্র অর্জন এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থাবলী দিয়ে এর ব্যবস্থার অস্তিত্ব হুমকিগ্রস্থ হওয়ার মুহুর্ত থেকে, বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণী প্রলেতারিয়েত জনগণের প্রত্যেকটি ক্রিয়ার জবাব দেবে নব্য-ফ্যাসিবাদী ‘নেতাদের’ আরো বেশী করে আর্থিক সহায়তা (contribution) দিয়ে। এখানে তাদের একমাত্র অসুবিধা হবে কোনো একটি বাছাইয়ের। যদি আমরা মনোযোগ সহকারে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশসমূহের রাজনৈতিক অবস্থা অধ্যয়ন করি, ইতোমধ্যে আমরা দেখি রাজনৈতিক দৃশ্যপটে, কেবলমাত্র একটি নয়, বরং একাধিক চরিত্র, যারা আগামীদিনের সম্ভাব্য Doriots, Mussolinis Degrelles  হবে। এই অর্থে ফ্যাসিবাদী বিপদ সমগ্র মহাদেশ জুড়েই বিদ্যমান।36


            ১৯৪৭এ মেন্ডেল একটি নিবন্ধ লেখেন যাতে তিনি নিম্নোক্ত উপসংহার টানেন:


. . . . .পুঁজিবাদী অবক্ষয়ের অধীনে উৎপাদন চক্রের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী দেখা যায়:


(ক) সংকটগুলো অধিকতর দীর্ঘস্থায়ী ও অধিকতর ভয়াবহ হয়, এবং উত্থান ও উন্নতির কালের থেকে অধিকতর দীর্ঘস্থায়ী মন্দা বহন করে। আরোহী (ascending) পুঁজিবাদ দৃশ্যমান হয় একটি দীর্ঘ উন্নতি দিয়ে, এটি বাধাগ্রস্থ হয় সংকটের সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে। অবক্ষয়ী (decadent) পুঁজিবাদ দৃশ্যমান হয় একটি  দীর্ঘস্থায়ী সংকট হিসেবে, যেটি বাধাপ্রাপ্ত হয় পুনরুভ্যুদয়সমূহ দিয়ে, যেগুলো আরো অস্থায়ী ও সংক্ষিপ্ত।


(খ) বিশ্ববাজারের ভূময় সম্প্রসারণ থেমে গেছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে আর কোন তেজীভাব নেই। বিশ্ববাজারের ভাঙ্গন (splitting up) অথবা কেবলমাত্র একটি প্রতিযোগীর ভয়াবহ ধ্বংসায়ন, কিছু পুঁজিবাদী দেশের অনুকুল তেজীভাবের বিকাশের সুযোগ করে দেয়।


(গ) জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদিকা শক্তিসমূহের সর্বাত্মক বিকাশ আর নেই। এমনকি ‘উন্নতি’-এর সময়েও কিছু শাখার বিকাশ ঘটে অন্যান্য শাখার বিনিময়ে। প্রাযুক্তিক অগ্রগতি আর নেই অথবা উৎপাদনে তা খুবই সংক্ষিপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।


(ঘ) একটি পুনরুভ্যুদয় থেকে আরেকটিতে শিল্পশ্রমিকদের জীবনমানের আর কোন সার্বিক উন্নতি নেই। এটি স্বভাবতই সংকট ও পুনরুভ্যুদয়  মধ্যেকার আপেক্ষিক ‘উন্নতি’ অথবা ‘ পুনরুভ্যুদয়’এর সময়ে বেকার বা কৃষিজীবিদের শিল্পশ্রমিকে রূপান্তরণের সময় তাদের অবস্থানের আপেক্ষিক উন্নতিকে বাদ দেয় না।37


কী কাল্পনিক জগৎ!

           ম্যান্ডেল, পাবলো, পোসাদাস ও চতুর্থ আন্তর্জাতিকের উপরের বিবৃতি আজকে যে কেউ পাঠ করলে অবশ্যি আঘাত পাবেন যে যৌক্তিক মানব সত্তা এই ধরণের ভ্রান্তিসমূহ ধারণ করতে পারে। তার মতন এমন অন্ধ আর নেই যে দেখতে পায় না। ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সদস্যবর্গ বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ পরিহার করতে প্রচন্ড চেষ্টা করেছিলেন। অতীত ঘটনাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে একজন আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। নেতৃস্থানীয় ত্রৎস্কিপন্থীদের বাস্তবতার মুখোমুখী হওয়ার প্রত্যাখ্যানকে বুঝতে হলে একজনকে অবশ্যি বুঝতে হবে যে এই বাস্তবতা তাদের কি পরিমাণ বেদনা দেয়, যে বাস্তবতাটি তাদের বিশাল আশাকে বিধ্বস্থ করেছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের খ্রীস্টিয়  ফেরকাসমূহের (sects) মতন ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলন কাজ করেছিল, যারা মধ্যযুগের পুরাতন ধারণাসমূহে আটকে ছিল, যখন ঐ দুনিয়াটা ভেঙ্গে পড়ছিল এবং নয়া পুঁজিবাদী দুনিয়া তখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। তাদের ডাকিনীদের অগ্নিদগ্ধকরণ ছিল একটি অযৌক্তিক কাজ, কিন্তু এটিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে  যৌক্তিকভাবে।

      যাহোক, ম্যান্ডেল, পাবলো ও পোসাদাসদের পেছনের অভিপ্রায়সমূহ উপলব্ধি করলে একজন বুঝে যে সেগুলোর নায্যতা প্রতিপাদন করা যায় না। মার্কসবাদীদের জন্য পয়লা নিয়ম হল, যদি আপনি বাস্তবতা পরিবর্তন করতে চান, আপনাকে অবশ্যি এটাকে বুঝতে হবে। যে বাস্তবতায়  শ্রমিক শ্রেণী  নিজেদের দেখতে পায়, সেই বাস্তবতাকে বুঝতে না পারার অনিবার্য পরিণতি ছিল ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বের বিশৃঙ্খলা, চড়াই-উৎরাই, ভাঙ্গন ।  তারা যে মানচিত্রের সাহায্যে একটি গতিপথ প্রণয়ন করতে চেষ্টা করেছিলেন, সেটি ছিল হতাশাব্যঞ্জকভাবে সেকেলে। এইভাবে বিশ্ব ত্রৎস্কিবাদ কানাগলিতে প্রবেশ করেছিল। আন্দোলনের সাধারণ সংকট মানবতার প্রেক্ষাপটের র‌্যাডিক্যাল পুনর্মূল্যায়নের দাবী জানায়।


ত্রৎস্কির সাহিত্যের আক্ষরিক অনুসরণ থেকে বিচ্যুতি এবং ত্রৎস্কিবাদের সারবস্তুর সংরক্ষণ


International Socialist Tendency শুরু করা স্বল্প সংখ্যক কমরেড মার্কসবাদ দিয়ে বাস্তবতার প্রতিস্থাপনে প্রস্তুত ছিলেন না, বরং অন্যদিকে এই বাস্তবতার উপর প্রভুত্বকরণে সহায়তার একটি হাতিয়ার হিসেবে তারা মার্কসবাদকে ব্যবহারের ইচ্ছা করেছিলেন। ১৯৪৬-৪৮ এর বছরগুলোতে আমাদের খুবই কঠিন প্রশ্নাবলীর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। আমাদেরকে স্পষ্টায়ন করতে হচ্ছিল যে আমরা একটি ঐতিহ্যকে বহাল রাখছি, আর তা হলো আমরা মার্কস, লেনিন ও ত্রৎস্কির অনুসারী। কিন্তু আমাদেরকে একটি নয়া অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এটি একই সঙ্গে ছিল ধারবাহিকতা ও নয়া সূচনা উভয়ই। বৌদ্ধিক দৃঢ়তার (intellectual toughness) অর্থ মতান্ধবাদীতা নয়। পরিবর্তনশীল বাস্তবতার আত্মীকরণ অর্থ অস্পষ্টতা নয়। গোঁড়া ত্রৎস্কিবাদের প্রতি আমাদের সমালোচনাকে বুঝতে হবে ধ্রুপদী মার্কসবাদে প্রত্যাবর্তন হিসেবে।

            পরবর্তী বিষয়গুলোর আলোচনা ইস্যুগুলোর দিকে পশ্চাৎ-দৃষ্টির (hindsight) ওপর ভিত্তি করে এগোবে না। পশ্চাৎ-দৃষ্টি সবসময় পূর্ণাঙ্গ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কীভাবে তিনটি তত্ত্বের উত্থান ঘটেছে সেভাবেই আমাদের দেখতে হবে। এই তত্ত্বে তিনটি হল: রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্ত্ব, স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্ত্ব এবং বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লবের (deflected permanent revolution) তত্ত্ব। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশসমূহ ও তৃতীয় বিশ্ব যাতে সারা দুনিয়াই অন্তর্ভূক্ত, এই এলাকাগুলোতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।

এখানে প্রত্যেকটি  প্রশ্ন আলাদা আলাদা বিবেচিত হবে। কেবলমাত্র তারপরেই তাদের মধ্যকার  আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে এবং এইভাবে বিকাশের সামগ্রিক প্যাটার্ন ব্যাখ্যাকরণ সম্ভব হবে। কেবলমাত্র পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এবং নীচে অবলোকন করে একজন দেখতে পায় কীভাবে বিভিন্ন পথগুলো সমবিন্দু অভিমুখী হয়।


    

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                               

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                 

অধ্যায় দুই


রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ



কেন স্তালিনপন্থী রেজিম টিকেছিল? পূর্ব ইউরোপের “জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো”এর প্রকৃতিই বা কেমন ছিল? স্তালিনপন্থী রেজিমের প্রতিষ্ঠা এর প্রকৃতি সম্পর্কে কী দেখায়? এই প্রশ্নাবলীর উত্তর অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা থেকেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। এই উত্তরসমূহ স্তালিনবাদী রাশিয়াকে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।

বর্তমান লেখক কর্তৃক প্রথম যে দলিলে রাশিয়াকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেটি ছিল ১৪২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ডুপলিকেটকৃত দলিল। এটি ১৯৪৮ সনে লেখা হয়েছিল এবং এর শিরোনাম ছিল ‘স্তালিনপন্থী রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’। যাহোক, এই তত্ত্বের উৎপত্তি বুঝতে হলে ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহকে’ বিবেচনা করাটা দরকারী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রুশ সেনাবাহিনী এই দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়েছিল। নেপোলিয়ান বলেছিলেন,’’Une armee dehors c’est le’tat qui voyage’ (‘বিদেশের মাটিতে সেনাবাহিনী থাকার অর্থ রাষ্ট্রটি সচল’), এবং এই প্রবাদ সমানভাবে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরীর মত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এই দেশগুলোর সরকারসমূহ রুশ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সুতরাং এই রাষ্ট্রগুলোর অধ্যয়ন ‘মাতৃরাষ্ট্র’-এর রেজিম সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

যদিও ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ’-এর প্রিজমের মাধ্যমে একজন স্পষ্টভাবে স্তালিনপন্থী রাশিয়ার গড়ন (shape) দেখতে পায়। কিন্তু কেবলমাত্র ‘স্তালিনপন্থী রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’ লেখার পরেই যুক্তিটি তত্ত্বায়িত হয়েছিল। ১৯৫০এ ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের শ্রেণী চরিত্র’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এটির প্রারম্ভিক বিষয় ছিল যে  যদি পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ সত্যিকারের শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হতো, তবে সেখানে একটি সামাজিক বিপ্ল­ব সংঘটিত হতে হতো। বিপরীতক্রমে, যদি কোন সামাজিক বিপ্লব না হয়ে থাকে তবে পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের চরিত্রের পূণর্মূল্যায়ন করতে হবে।

মার্কস ও লেনিনের রাষ্ট্রতত্ত্বকে ঘিরে আলোচনা সংঘটিত হচ্ছিল। মার্কস প্রায়ই বলতেন যে এর অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব একটি পূর্ব শর্ত। শ্রমিক শ্রেণী উৎপাদন সাধিত্রের যৌথভাবে মালিক হতে পারে না, যদি না যে রাষ্ট্র উৎপাদন সাধিত্রের মালিক এবং নিয়ন্ত্রক, সেই রাষ্ট্র তাঁদের না থাকে; অন্যকথায়, প্রলেতারিয়েতের রাজনৈতিক ক্ষমতা যদি না থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রলেতারিয়েত মৌলিকভাবে  বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে পৃথক। শেষোক্ত শ্রেণীর সম্পদের উপর সরাসরি মালিকানা বজায় থাকে; কাজেই সরকারের রূপ যাই হোক না, যতক্ষণ বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করা না হয়, এটি ততক্ষণ পর্যন্ত শাসক শ্রেণী হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয় না। একজন পুঁজিপতি তাঁর সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে সামন্ত রাজতন্ত্রে, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রে, ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্রে, সামরিক শাসনের অধীনে, রবেস্পিয়ের, হিটলার, চার্চিল অথবা অ্যাটলি-এর অধীনে। এর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীকে উৎপাদন সাধিত্র থেকে পৃথক করে ফেলা হয় এবং এই সত্যটিই তাঁদেরকে মজুরি-দাসে পরিণত করে। যদি এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যেখানে রাষ্ট্র উৎপাদন সাধিত্রের মালিক, কিন্তু এটি সম্পূর্ণরূপে শ্রমিক শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন, তবে তাঁরা শাসক শ্রেণী হতে পারেন না।38

মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়কদের কয়েকটি উদ্ধৃতি এই বিষয়গুলো তুলে ধরে। কমিউনিস্ট ইশতেহার ঘোষণা করে:


. . .শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্ল­বে প্রথম ধাপ হল প্রলেতারিয়েতকে শাসক শ্রেণীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ, গণতন্ত্রের সংগ্রামে জেতা।

বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেয়ার জন্য, রাষ্ট্রের হাতে উৎপাদনের সমস্ত সাধিত্র কেন্দ্রীভূতকরণের জন্য, এবং উৎপাদিকা শক্তির সমষ্টিটাকে যথাসম্ভব দ্রুত বাড়িয়ে  তোলার জন্য প্রলেতারিয়েত তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে, অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত শাসক শ্রেণী হিসেবে সংগঠিত হবে . . . ।39


প্রলেতারিয় বিপ্লব হল ‘গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম’এর বিজয়। শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হল ‘শাসক হিসেবে সংগঠিত’ প্রলেতারিয়েত। লালবাহিনীর ট্যাংক দিয়ে বাইরে থেকে আরোপকৃত স্তালিনপন্থী ‘সামাজিক বিপ্লব’ কীভাবে বিপ্ল­বে প্রলেতারিয় শ্রেণী চেতনার ভূমিকার মার্কসবাদী ধারণার সঙ্গে খাপ খেতে পারতো?

মার্কস বার বার বলেন যে প্রলেতারিয় বিপ্লব হলো স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণীর সচেতন কর্মকান্ড। সুতরাং, যদি আমরা ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ’-কে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেই, তা’হলে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে যে ‘ইতিহাস স্বয়ং সচেতন’ (history conscious of itself) বলেছিলেন তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এঙ্গেলসের বিবৃতি সম্পর্কে একই কথা সত্য:


কেবলমাত্র এই বিষয় [সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব] থেকেই মানুষ সম্পূর্ণ সচেতনভাবে নিজেদের ইতিহাসকে গড়ে তোলে; কেবলমাত্র এই বিষয় থেকেই মানুষ কর্তৃক গতিপ্রাপ্ত সামাজিক কারণসমূহ, প্রধাণত ও অবিরতভাবে বর্ধিত পদক্ষেপে ফলাফলসমূহও মানুষের ইচ্ছাÑশক্তি প্রয়োগে নিয়ন্ত্রিত হয়, এটি মানবজাতির প্রয়োজনের জগৎ থেকে মুক্তির জগতে উল­ম্ফন।40


একটি বিপ্লবে প্রলেতারিয় সচেতনার অবস্থান সম্পর্কে মার্কসবাদী শিক্ষকবৃন্দের লেখালেখিগুলোর সার-সংক্ষেপকরণে রোজা লুক্সেমবার্গও ভ্রান্তিতে নিপতিত হন:


অতীতের সকল শ্রেণী সংগ্রাম সংখ্যালঘুর স্বার্থে পরিচালিত হয়, এবং যাতে মার্কসের কথানুসারে ‘সকল বিকাশ সংঘটিত হয় জনসাধারণের সংখ্যা-গরিষ্ঠের বিপরীতে।’ কর্মের (action) দরকারী শর্তসমূহের একটি ছিল সংগ্রামের প্রকৃত লক্ষ্যাবলী, এর বস্তুগত আধেয় (content) এবং এর সীমাবদ্ধতাসমূহ সম্পর্কে এই জনগণের অজ্ঞতা। প্রকৃতপক্ষে এই ঘাটতি ছিল ‘আলোকিত’ বুর্জোয়া শ্রেণীর ‘নেতৃত্বকারী ভূমিকা’ এর সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ভিত্তি, যা বাধ্য অনুসারী (docile followers) হিসেবে জনগণের ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু ১৮৪৫ সনে মার্কস লিখেছিলেন যে ঐতিহাসিক কর্ম গভীরতা পেলে, এর সঙ্গে জড়িত জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আমাদের সময় পর্যন্ত সকল ঐতিহাসিক কর্মের মধ্যে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রামই সবথেকে গভীর। এটি জনগণের নিম্নতর স্তরসমূহের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে, এবং সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়ার মুহুর্ত থেকে এটি প্রথম আন্দোলন যেটি জনগণের প্রকৃত স্বার্থানুসারে চালিত। এই কারণে তাঁদের কর্ম ও পদ্ধতি (task and method) সাপেক্ষে সমাজতান্ত্রিক কর্মের জন্য জনগণের আলোকায়ন হল একটি অনিবার্য ঐতিহাসিক শর্ত (condition), যেমন পূর্ববর্তী কালগুলোতে অধিপতি শ্রেণীসমূহের কর্মের জন্য জনগণের অজ্ঞতা ছিল একটি শর্ত।41


কাইজারের চ্যাঞ্চেলরের রাজনৈতিক শাসন এবং পুরাতন ভূস্বামী গোষ্ঠী জাংকারদের অধীনে যেভাবে জার্মান পুঁজিবাদ বেড়ে উঠে তার সঙ্গে তুলনা করে প্রলেতারিয় বিপ্ল­বের ‘বিকাশের বিসমার্কিয় পন্থা’ সম্পর্কে আলোচনা করে পাবলো ও ম্যান্ডেল এই সমস্যার চারপাশে পথ অন্বেষণ করেন। এই ত্রৎস্কিপন্থীগণ প্রমাণ করতে আশা করেন যে স্বয়ং প্রলেতারিয়েত কর্তৃক বিপ্লবী কর্ম ছাড়াই প্রলেতারিয় সামাজিক বিপ্ল­বকে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে ‘‘এর নিজস্ব ভরবেগে”। যদি চিন্তা করা যায় তাহলে এই ধারণা সব থেকে দুঃখজনক উপসংহারের দিকে ধাবিত করে। এটি সত্য যে বুর্জোয়া শ্রেণী অনেক ও নানাপথে ক্ষমতা দখল করে। ফলে কেবলমাত্র একটি খাঁটি দৃষ্টান্ত (case) দেখা যায় যাতে তারা সামন্ততন্ত্রের বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী সংগ্রাম চালনা করেন - এটি ছিল ফ্রান্সে ১৭৮৯এর পরে । ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে তারা সামতান্ত্রিক ভূ-স্বামীদের সাথে আপোষ করেন। জার্মানী, ইতালি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, চীন ও দক্ষিণ আমেরিকাতে তারা ক্ষমতায় আসে বিপ্লবী সংগ্রাম ছাড়াই। আমেরিকাতে সামন্ত অবশেষের প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি বুর্জোয়া শ্রেণীকে সামর্থ জোগায় সামন্ত-বিরোধী বিপ্লবী সংগ্রাম পরিহার করতে।

‘বিসমার্কিয়’ পদ্ধতি বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য কোন ব্যতিক্রম ব্যাপার নয়, প্রায় ক্ষেত্রে এটি একটি নিয়ম। ফ্রান্স ব্যতিক্রম ছিল। যদি স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণীর কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রলেতারিয় বিপ্ল­ব প্রয়োজনগতভাবে অর্জিত না হয়ে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র কর্তৃক অর্জিত হয়, তখন রুশ বিপ্ল­ব অনিবার্যভাবেই ব্যতিক্রম, বিসমার্কিয় পথই নিয়ম। উপসংহার এই হতো যে (ত্রৎস্কিপন্থী কর্তৃক) কোন স্বাধীন নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই।

sanse-culattes -এর ক্ষেত্রেই হোক আর বিসমার্কের সৈন্যদল দিয়েই হোক, যদি একটি প্রলেতারিয় বিপ্লব এইভাবে সম্পন্ন করা যায়, তাহলে ক্ষুদ্রতর প্রতিরোধের নিয়মের অর্থ দাঁড়ায় এই যে বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রতারিত করে ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ কর্তৃক বিপ্লব সংঘটনের পথকে ইতিহাস কর্তৃক বেছে নেয়া।42

‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর শ্রেণী চরিত্র’ দলিলটি শেষ হয় এটি দেখিয়ে যে যদিও চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সদস্যবৃন্দ মৌল মার্কসবাদী ধারণাবলী বারংবার উল্লেখ করেন -  শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি অর্জনের কাজ কেবলমাত্র স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক সম্পন্ন করা যেতে পারে, বুর্জোয়া শ্রেণীর রাষ্ট্র যন্ত্র দখল করেই কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণী স্থির থাকতে পারে না, তাকে এটি অবশ্যি ধ্বংস করতে হবে এবং প্রলেতারিয় গণতন্ত্র যেমন সোভিয়েত ইত্যাদিকে ভিত্তি করে একটি নয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপরেও তাঁরা ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ’কে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িতকরণ অব্যাহত রাখেন। 

এর জন্য কারণ হলো রাশিয়াকে বিকৃত (degenerate) শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে অধিগম্যকরণ। যদিও শ্রমিক শ্রেণী উৎপাদন সাধিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ভূমিকা নেই, এবং সবথেকে ভয়াবহ আমলাতান্ত্রিক এবং সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীন, এই অবস্থাতেও যদি রাশিয়া শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হয়, শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীন, শ্রেণী সচেতন কর্মকান্ড ছাড়া, অস্তিত্বমান আমলাতান্ত্রিক ও সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংসকরণ ছাড়া, নয়া শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়নে কেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব পরিচালনা করা উচিত নয়- তার কোন কারণ নেই। পুঁজিতন্ত্র থেকে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে রূপান্তর (transition) সম্পন্ন করতে আমলাতন্ত্রের এটাই যথেষ্ট হতো শ্রমিক শ্রেণীকে ‘তাদের অবস্থানে রেখে’ বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদকরণ।

যদি জনগণতাান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহকে কোনো না কোনো ধরণের শ্রমিক শ্র্রেণীর রাষ্ট্র বলে গণ্য করে বিপ্লবের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বকে উল্টে দেয়া হয়, তাহলে স্বয়ং শ্রমিক শ্র্রেণীর রাষ্ট্রে প্রকৃতিই বা কেমন হবে?43

এই ইস্যুটিও বিশ্লেষণের জন্য প্রারম্ভ বিন্দু হল রাশিয়াকে বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে ত্রৎস্কি সংজ্ঞার সমালোচনামূলক পরীক্ষা, শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি রাষ্ট্র কী শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হতে পারে?

ত্রৎস্কির লেখালেখিতে আমরা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের দুটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক সংজ্ঞা দেখি। একটি সংজ্ঞানুসারে, একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের মানদন্ড হলো এই যে প্রলেতারিয়েতের রাষ্ট্র ক্ষমতার ওপর সরাসরি বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ জারি আছে কিনা, এটা কোন ব্যাপার নয় যে এটি কতটুকু সীমিত পরিসরে বিদ্যমান আছে। এর অর্থ হল কোনো বিপ্লব ছাড়াই প্রলেতারিয়েত আমলাতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তি পেতে পারে কিনা, কেবলমাত্র সংস্কারের মাধ্যমে। ১৯৩১এ ত্রৎস্কি লেখেন:


বর্তমান সোভিয়েত রাষ্ট্রকে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি কেবলমাত্র এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করে যে বুর্জোয়া শ্রেণীই কেবলমাত্র সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল করতে পারে তা নয়, ইউএসএসআর-এর প্রলেতারিয়েতও একটি নয়া বিপ্লব ছাড়াই সংস্কারের পদ্ধতিতে ও পথে আমলাতন্ত্রকে এর  নিকট সমর্পণে, অথবা পুনরায় পার্টিকে পুনরুজ্জীবিতকরণে এবং একনায়কতান্ত্রিক রেজিমের সংশোধনের সম্ভাবনাকে বাদ দিতে পারে না।44


সম্ভবত ১৯২৮এর শেষের দিকে লিখিত একটি চিঠিতে ত্রৎস্কি এই ধারণাকে অধিকতর স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। ‘সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতার বিকৃতি একটি সত্য ঘটনা কী?’ - এই প্রশ্নের জবাবে ঐ চিঠিতে তিনি লেখেন:


এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকৃতি পার্টি যন্ত্র অপেক্ষা
অধিকতর অগ্রগামী। তবুও পার্টিই সিদ্ধান্তদাতা। বর্তমানে এর অর্থ হলো পার্টি যন্ত্র। এইভাবে প্রশ্নটি একই বিষয়ে নেমে আসে: রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা পার্টি যন্ত্রের স্বৈরতন্ত্রের ওপর শ্রমিক শ্রেণীর সহযোগীতায় পার্টির প্রলেতারিয় শাঁস জয়ী হতে পারে কিনা? কেইবা আগাম উত্তর দিতে পারে যে এটি এইভাবে নতুন ভিত্তিতে নতুন পার্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেই কেবল অসমর্থ নয়, সঙ্গে সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ও নয়া প্রলেতারিয় বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেও অসমর্থ।45


ত্রৎস্কি একই চিঠিতে পরের দিকে বলেন যে:


যদি পার্টি মৃত হয়, তবে একটি নতুন অবস্থানে একটি নতুন পার্টি অবশ্যি গড়তে হবে, এবং শ্রমিক শ্রেণীকে এটি সম্পর্কে খোলাখুলি অবশ্যি বলতে হবে। যদি থারমিডর [মহান ফরাসি বিপ্লবের সময়কার একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন যেটি বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয় এবং বিপরীত দিকে চালনা করে] সম্পূর্ণ হয়, এবং যদি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব নিশ্চি‎হ্ন হয়, তবে দ্বিতীয় প্রলেতারিয় বিপ্লবের ব্যানার অবশ্যি উম্মোচিত করতে হবে। তবে আমাদের সেইভাবে কাজ করতে হবে, যদি সংস্কারের পথ, যার পক্ষে আমরা দাঁড়াই সেটি যদি নিরাশ বলে প্রমাণিত হয়, ।46


ত্রৎস্কির দ্বিতীয় সংজ্ঞাতে মূলগতভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। এটা কোন বিষয় নয় যে রাষ্ট্রযন্ত্র গণমানুষ থেকে কতটুকু স্বাধীন, এবং এমন কি যদি আমলাতন্ত্র থেকে মুক্ত হতে একমাত্র পথ হয় বিপ্লব দ্বারা, তারপরেও যতক্ষণ উৎপাদন সাধিত্রের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে থাকে, ততক্ষণ রাষ্ট্রটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রই থাকে, যাতে প্রলেতারিয়েত হলো শাসক শ্রেণী।

এটি থেকে তিনটি উপসংহার টানা  যায়:


(ক) ত্রৎস্কির শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি প্রথমটিকে বাতিল করে।


(খ) যদি দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি সঠিক হয়, কমিউনিস্ট ইশতেহারের এই কথাটি সঠিক নয় যে ‘শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক বিপ্লবের প্রথম ধাপ হল প্রলেতারিয়েতের শাসক শ্রেণীতে উন্নতীকরণ’। অধিকন্তু, এই ক্ষেত্রে, প্যারিস কমিউন অথবা বলশেভিক একনায়কত্ব কোনটিই শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র নয়, যেহেতু প্রথমটি আদৌ উৎপাদন সাধিত্রের রাষ্ট্রীয়করণ করেনি, এবং পরেরটি এটি করেনি কিছু সময়ের জন্য।


(গ) রাষ্ট্র যদি উৎপাদন সাধিত্রের মালিক হয় এবং শ্রমিক শ্রেণীর যদি এর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তারা যদি উৎপাদন সাধিত্রের মালিক না হয়, তবে তার অর্থ তারা শাসক শ্রেণী নয়। প্রথম সংজ্ঞাটি এটি স্বীকার করে, দ্বিতীয়টি এটিকে এড়িয়ে চলে কিন্তু এটিকে অগ্রাহ্য করে না।


শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার সংজ্ঞা এবং রাষ্ট্রের মার্কসবাদী তত্ত্ব


রাশিয়া একটি বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র - এই অনুমানটি অনিবার্যভাবে যে উপসংহারসমূহে উপনীত হয়, সেগুলো রাষ্ট্রের মার্কসবাদী তত্ত্বের ধারণার সংঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ত্রৎস্কি যেটিকে রাজনৈতিক বিপ্লব এবং সামাজিক প্রতি-বিপ্লবের ভূমিকা বলতেন, সেটির বিশ্লেষণ এটিকে প্রমাণিত করে।

বুর্জোয়া রাজনৈতিক বিপ্লবসমূহের কালে যেমন ১৮৩০ এবং ১৮৪৮-এর ফরাসি বিপ্লবসমূহে সরকারের প্রকৃতি কম-বেশী মাত্রায় পরিবর্তিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রকৃতি একইরকম থাকে - তা হ’ল ‘সশস্ত্র ব্যক্তিসমূহ ও কারাগারসমূহের বিশেষ সংস্থা’, যেগুলো জনগণ থেকে স্বাধীন এবং পুঁজিপতি শ্রেণীকে সেবা করে।

যাহোক, অন্য যে কোন রাষ্ট্র থেকে একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে প্রয়োজনগতভাবেই আধার (content) ও রূপ (form)এর মধ্যে অধিকতর কাছাকাছি সংযোগ (connection) বিদ্যমান থাকে।  সুতরাং, এমন কী আমরা যদি মনে করি যে একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিপ্লবসমূহ সংঘটিত হতে পারে, তারপরও একটি বিষয় পরিষ্কার - পূর্বের মতই প্রলেতারিয় রাজনৈতিক বিপ্লবের পরও একই শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্র অবশ্যি অস্তিত্বমান থাকে। যদি রাশিয়া প্রকৃতই একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হয়, তখন যদি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি রাজনৈতিক বিপ্লবে বড় মাত্রায় শুদ্ধিকরণ চালু করে, তখন এটি অস্তিত্বমান রাষ্ট্রযন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে, যদি প্রাক্তন বুর্জোয়া শ্রেণীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে হয়, তারা চালু রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না, বরং এটিকে তারা ধ্বংস করতে বাধ্য হয় এবং এর ধ্বংসের ওপর অন্য একটি রাষ্ট্র গঠনে বাধ্য হয়।

রাশিয়াতে এই অবস্থাসমূহ জারি আছে কী? প্রশ্নটি সঠিকভাবে উত্থাপিত হলে এর উত্তরের অর্ধেক পথে অগ্রসর হওয়া যায়। যদি বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতায় আসে, এটি নিশ্চিতভাবেই KGB, নিয়মিত সেনাবাহিনী ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারে। এটি নিশ্চিতভাবেই প্রতীয়মান যে বিপ্লবী পার্টি KGB, বা আমলাতন্ত্র বা উপস্থিত (standing) সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে না। বিপ্লবী পার্টিকে বিদ্যমান রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে হয় এবং এটিকে প্রতিস্থাপিত করতে হয় সোভিয়েত, জনগণের মিলিশিয়া ইত্যাদি দিয়ে।

ত্রৎস্কি রাষ্ট্রের মার্কসবাদী তত্ত্বের শিক্ষার প্রয়োগ আংশিক পরিহার করেন এই বলে যে বিপ্লবী পার্টি যাত্রা শুরু করবে ট্রেড ইউনিয়ন ও সোভিয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে।47 কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াতে কোন ট্রেড ইউনিয়ন বা সোভিয়েত ছিল না, যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতো। একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রকে পুনপ্রতিষ্ঠা করা যেতো না স্তালিনিয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংশোধন করে, বরং এটিকে ধ্বংস করে একটি নয়া রাষ্ট্র গড়া যেতো।                                                                                                                                                                     

যদি প্রলেতারিয়েতকে ক্ষমতায় আসতে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হয়, অন্যদিকে বুর্জোয়া শ্রেণীকে এটি ব্যবহার করতে হয়, তবে বলা যায় যে রাশিয়া একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র নয়। এমন কি যদি আমরা ধরে নেই যে ‘প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া উভয় শ্রেণীরই রাষ্ট্রযন্ত্রের শুদ্ধিকরণের দরকার পড়ে’ (প্রয়োজনিকভাবেই এ ধরনের গভীর পরিবর্তন জড়িত, এটিকে গুণগতভাবে রূপান্তরণের জন্য), তাহলে আমাদের অবশ্যি উপসংহার টানতে হয় যে রাশিয়া শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র নয়।

প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণী একই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে, এটি বিশ্বাস করা হচ্ছে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্বয়ং ত্রৎস্কি কর্তৃক ব্যক্ত রাষ্ট্র তত্ত্বের বিপ্লবী আধারকে প্রত্যাখ্যান করার সামিল।


উৎপাদন সম্পর্ক থেকে স্বতন্ত্রভাবে সম্পত্তির রূপকে বিবেচনা একটি অধিবিদ্যক বিমূর্তায়ন


রাশিয়ার যে বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ত্রৎস্কি এটিকে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র (যদিও এমনকি বিকৃত) বলেন তা হলো ব্যাপক মাত্রায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি এবং রাষ্ট্রিয় সম্পত্তির প্রাধান্য। যাহোক, এটি মার্কসবাদের স্বতঃসিদ্ধ যুক্তি যে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে বিবেচনাকরণ হলো একটি পরা-ঐতিহাসিক বিমূর্তায়ন (suprahistorical abstraction)।

মানব ইতিহাস অবগত যে দাস-ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্রের ব্যক্তিগত সম্পত্তিসমূহ - এদের সবগুলোই মূলগতভাবেই একে অপর থেকে পৃথক। উৎপাদন সম্পর্ক থেকে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সংজ্ঞায়নের প্রুধোঁর প্রচেষ্টাকে মার্কস সমালোচনা করেন:


প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক যুগে, সম্পত্তির বিকাশ ঘটে ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ পৃথক সামাজিক সম্পর্কাবলীর একটি সেটের অধীনে। এইভাবে, বুর্জোয়া সম্পত্তির সংজ্ঞায়ন বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কের সকল সামাজিক সম্পর্কাবলীর উম্মোচনের কম কিছু নয়। স্বাধীন সম্পর্ক হিসেবে সম্পত্তির সংজ্ঞা দেয়ার  চেষ্টা যেন- একটি দূরবর্তী স্বয়ংসম্পূর্ণ  প্রকরণ (category) রীতি - একটি বিমূর্ত চিরন্তন ধারণা - এটি অধিবিদ্যা বা আইনবিজ্ঞানের একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।48


            ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ হ’ল উৎপাদন সম্পর্কসমূহের সমষ্টি। উৎপাদনের পুঁজিতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে জনগণের মধ্যেকার সম্পর্কসমূহ প্রকাশ করে এমন সব প্রকরণ যেমন মূল্য, দাম, মজুরি ইত্যাদি এটির অপরিহার্য অংশ গঠন করে। এটি ছিল পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার গতির সূত্রাবলী যা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৈশিষ্ট্যকে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সংজ্ঞায়িত করে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্যান্য রূপভেদ এটিকে পার্থক্যায়িত করে। প্রুধোঁ, উৎপাদনের সম্পর্কাবলী থেকে সম্পত্তির রূপকে বিমূর্তায়ন করে ‘এই সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পর্কাবলীকে [উৎপাদনের পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কাবলী] “সম্পত্তি”র সাধারণ বিচারিক ধারণাতে গুলিয়ে ফেলেন।’ সুতরাং, ‘Brissot ১৭৮৯ এর পূর্বেই লিখেছিলেন যে “সম্পত্তি চুরিকৃত হয়ে গেছে” (property is theft) - এর বাইরে প্রুধোঁ যেতে পারেননি।’49

ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটি রূপের পৃথক ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে অন্যটি থেকে, এটি অন্যটি থেকে একটি পৃথক শ্রেণীর দুর্গ হতে পারে, এই বিষয়টি মার্কস সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু একই বিষয় রাষ্ট্রায়িত সম্পত্তিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে - এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান নয়। এর কারণ ইতিহাস প্রধাণত শ্রেণী সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তির বাইরে শ্রেণীর পৃথকায়ন (differentiation)এর দৃষ্টান্ত খুব একটা বেশী নয়, এবং সামগ্রিকভাবে খুব ভালভাবে জানাও যায় নি। তা সত্ত্বেও, তাদের অস্তিত্ব ছিল।

উদাহরণ হিসেবে, ইউরোপের ইতিহাস থেকে একটি অধ্যায় নেয়া যাক, যেমন মধ্য যুগের ক্যাথলিক গির্জা। গির্জার ছিল বিশাল ভূ-সম্পত্তি যাতে হাজার হাজার কৃষক শ্রম দিতো। গির্জা ও কৃষকদের মধ্যেকার সম্পর্কাবলী ছিল সামন্ত ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যে যে সামন্ত সম্পর্কাবলীর অস্তিত্ব ছিল তার অনুরূপ। সত্যিকার অর্থে গির্জা ছিল সামন্তীয়। একই সময়ে বিশপ, কার্ডিনাল ইত্যদি কারোই সামন্ত সম্পত্তিতে স্বাতন্ত্রিক অধিকার ছিল না। এটি ছিল উৎপাদন সম্পর্ক যা গির্জার সম্পত্তির সামন্ত শ্রেণী চরিত্রকে সুনির্দিষ্টায়িত করেছিল, যদিও এটি ব্যক্তিগত ছিল না।


রাশিয়ার আমলাতন্ত্র - একটি gendarme যেটির বিতরণ প্রক্রিয়াতে উদ্ভব ঘটেছিল?


রাশিয়াকে একটি বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করতে ত্রৎস্কির তত্ত্বের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে স্তালিনপন্থী রেজিম একটি নয়া শাসক শ্রেণী গঠন করেনি। পরিবর্তে বরং ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মতন এটি আমলাতন্ত্রের ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি ঘটেছিল কারণ রাশিয়াকে ভোগ্যদ্রব্যাদির অভাব ক্রেতাদের বাধ্য করেছিল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে এবং আমলাতন্ত্রের কাজ ছিল একটি মবহফধৎসব এর মতন যারা সারিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো।

এটিই কী ব্যাপার ছিল? আমলাতন্ত্রের কর্মকান্ড কী বিতরণ প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল, অথবা সামগ্রিকভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে এটি কী দৃশ্যমান হয়েছিল, যাতে প্রথমটি অধীনস্থ অংশ ব্যতিত আর কিছুই ছিল না? এই ইস্যুটির ব্যাপক তাত্তি¡ক গুরুত্ব বিদ্যমান।

এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার প্রচেষ্টার পূর্বে আমরা বরং বিশ্লেষণ করে দেখবো উৎপাদন ও বন্টনের সম্পর্কাবলী স¤পর্কে মার্কস কী ভেবেছিলেন। মার্কস লিখেছিলেন:


স্বাতন্ত্রিক ব্যক্তির নিকট বন্টন স্বভাবতই দৃশ্যমান হয় একটি নিয়ম হিসেবে যা সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, এটি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার অবস্থানকে নির্দিষ্টায়িত করে, যার ভেতর তিনি উৎপাদন করেন এবং এইভাবে এটি উৎপাদনের পূর্বগামী হয়। প্রারম্ভে ব্যক্তির কোন পুঁজি থাকে না, কোন ভূসম্পত্তি থাকে না। তার জন্ম থেকে বন্টনের সামাজিক শক্তিসমূহ কর্তৃক তাকে বরাদ্দ দেয়া হয় মজুরি শ্রম। কিন্তু মজুরি শ্রম বরাদ্দকৃত হওয়ার এই অবস্থাটি হলো উৎপাদনের স্বাধীন এজেন্ট হিসেবে পুঁজি ও ভূসম্পত্তির অস্তিত্বের ফলাফল।

সামগ্রিকভাবে সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি প্রাগÑঅর্থনৈতিক ঘটনা হিসেবে বন্টনকে উৎপাদনের পূর্ববর্তী মনে হয় বলতে গেলে উৎপাদনকে নির্দিষ্টায়িত করতে। বিজয়ী জনগণ বিজয়ীদের মধ্যে জমি ভাগ করে দেয়, এইভাবে ভূসম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট বিভাগ ও রূপ (division and form) প্রতিষ্ঠিত করে এবং উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যকে নির্ণয় করে। অথবা, এটি বিজিত জনগণকে দাসে পরিণত করে এবং এইভাবে দাস শ্রমকে উৎপাদনের ভিত্তিতে পরিণত করে। অথবা, একটি জাতি বিপ্লব দ্বারা বৃহৎ ভূসম্পত্তিকে ভেঙ্গে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে এবং এই নতুন বন্টন দিয়ে উৎপাদনে একটি নতুন বৈশিষ্ট্য আরোপ করে। অথবা, প্রণীত আইন বড় পরিবারে জমির মালিকানা স্থায়ী করে অথবা শ্রম বন্টন করে একটি বংশানুক্রমিক সুবিধা হিসেবে এবং এইভাবে এটিকে বর্ণসমূহে (castes) নির্দিষ্ট করে। এই সকল ক্ষেত্রে, এবং তারা সকলে ঐতিহাসিক, এটি বন্টন নয় যেটি উৎপাদন দ্বারা সংগঠিত ও নির্দিষ্টায়িত হয়, বরং বিপরীতক্রমে বন্টন দ্বারা উৎপাদন।

বন্টনের সবথেকে অগভীর ধারণাতে বন্টন দৃশ্যমান হয় উৎপন্ন দ্রব্যাদির বন্টন হিসেবে এবং সেই পর্যায় পর্যন্ত উৎপাদন থেকে অধিকতর দূরে এবং দৃশ্যত স্বাধীনভাবে। কিন্তু বন্টনের অর্থ উৎপন্ন দ্রব্যাদির বন্টন, এই ধারণার পূর্বে এটি প্রথমত উৎপাদন সাধিত্রের বন্টন, এবং দ্বিতীয়ত এটি একই ঘটনার বাস্তবত আর একটি অর্থ হল এই যে উৎপাদনের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে সমাজের সদস্যদের বন্টন (উৎপাদনের কতিপয় অবস্থাবলীতে ব্যক্তির অধীনস্থায়ন)। উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের বন্টন স্পষ্টভাবে এই বন্টনের ফসল, যেটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরেরটি খোদ সংগঠনটিকেই নির্ণয় করে দেয়।50


এটি মার্কস থেকে উদ্ধৃতি, এটির সারবস্তু তাঁর রচনাবলীতে বার বার পুনরাবৃত্ত হয়, এটি অর্থনীতিতে স্তালিনপন্থী আমলাতন্ত্রের অবস্থান বিশ্লেষণের জন্য প্রারম্ভ বিন্দু হিসেবে যথেষ্ট।

আমলাতন্ত্র জনগণের মধ্যে কেবলমাত্র ভোগের উপায়গুলোর বন্টন পরিচালনা করেছিল কী, অথবা উৎপাদন প্রক্রিয়াতে জনগণের বন্টনও পরিচালনা করেছিল কী? আমলাতন্ত্র কেবলমাত্র বন্টনের নিয়ন্ত্রণের ওপর একচেটিয়া অনুশীলন করেছিল কী, অথবা উৎপাদন সাধিত্রের ওপরও সঙ্গে সঙ্গে? এটি কী কেবলমাত্র ভোগের উপায়ের উপর বরাদ্দ (ration) দিত, অথবা সমাজের সমগ্র শ্রমসময়ও কী এটি বন্টন করে দিত সঞ্চয়ন ও ভোগের মধ্যে, উৎপাদন সাধিত্র ও ভোগের উপায়ের উৎপাদনের মধ্যে? রাশিয়াতে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কাবলী বন্টনের সম্পর্কাবলীকে নির্ধারণ করে দিত কিনা, যাতে তাদের একটি অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল? ঐতিহাসিক তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ করে এই প্রশ্নসমূহের জবাব দেয়া হবে।


স্তালিনপন্থী রাশিয়া রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী হল


মার্কসের পুঁজিবাদের বিশ্লেষণে শোষক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্কসমূহ এবং শোাষক শ্রেণীর নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কসমূহের তত্ত¡ জড়িত। উৎপাদনের পুঁজিবাদী ধরনের দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল: উৎপাদন সাধিত্রসমূহ থেকে শ্রমিক শ্রেণীর পৃথকীকরণ এবং শ্রম শক্তির পণ্যে রূপান্তর যা শ্রমিক শ্রেণীকে অবশ্যি বিক্রয় করতে হয় বেঁচে-বর্তে থাকতে, এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের পুনর্বিনিয়োগ - অর্থাৎ পুঁজির সঞ্চয়ন, যা স্বাতন্ত্রিক পুঁজিপতিদের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে আরোপিত হয় তাদের একের সঙ্গে অপরের প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রাম দিয়ে। ১৯২৮-৩২এ প্রথম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে এই উভয় বৈশিষ্ট্যই সোভিয়েত ইউনিয়নকে চরিত্রায়িত করে। এই বছরগুলোতে কৃষিতে যৌথীকরণ ছিল ইংরেজ কৃষক শ্রেণীর উচ্ছেদায়নের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ। মার্কস এই বিষয়টি তাঁর পুঁজি গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেন ‘পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন’ অধ্যায়ে। উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদক সরাসরি ভূমি থেকে বঞ্চিত হয় এবং  তাদের শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু পুঁজি সঞ্চয়নে রাশিয়ার অর্থনীতি কী চাপে ছিল? এই বিষয়ে আমি লিখেছিলাম:


ফ্যাক্টরি মালিক হিসেবে রাশিয়ার সমাজের সমগ্র শ্রম সময়ের সাপেক্ষে এবং তার কর্মচারীদের শ্রমের সাপেক্ষে স্তালিনপন্থী রাষ্ট্র একই অবস্থানে বিদ্যমান। অন্য কথায়, শ্রম বিভাগ পরিকল্পিত। কিন্তু সেটি কী যা রাশিয়ার সমাজের সমগ্র শ্রম সময়ের প্রকৃত বিভাগকে নির্ধারণ করে? যদি রাশিয়াকে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করতে হতো, তবে এই বিভাগ হতো সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত (ধৎনরঃৎধৎু)। কিন্তু যেহেতু, স্তালিনের সিদ্ধান্তসমূহের ভিত্তির নিয়ামকসমূহ যেমন বিশ্ব অর্থনীতি, বিশ্ব প্রতিযোগিতা ইত্যাদি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরের ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রুশ রাষ্ট্র একটি একক পুঁজিতান্ত্রিক এন্টারপ্রাইজের মালিকসমূহের মতন একই অবস্থানে যারা অন্যান্য এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।

শোষণের হার, অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত মূল্য ও মজুরীর মধ্যেকার অনুপাত (ং/া) স্তালিনীয় সরকারের স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না, বরং এটি নির্দেশিত হয় বিশ্ব পুঁজিবাদ দিয়ে। একই বিষয় খাটে প্রযুক্তিতে উৎকর্ষের ব্যাপারে, অথবা, এটি ব্যবহার করা যায় মার্কসবাদী পারিভাষিক শব্দাবলীতে প্রায়োগিকভাবে সমতুল্য বাগধারাতে, স্থির (পড়হংঃধহঃ) পুঁজি ও চল (াধৎরধনষব) পুঁজির মধ্যেকার সম্পর্কে, অর্থাৎ,  একদিকে মেশিনারি ও নির্মাণ দ্রব্যাদি এবং অন্যদিকে মজুরির মধ্যেকার সম্পর্কে (প/া)।  একই বিষয় খাটে উৎপাদন সাধিত্রের উৎপাদন ও ভোগ্যদ্রব্যাদির উৎপাদনের মধ্যে রাশিয়ার সমাজের সমগ্র শ্রম সময়ের বিভাগের ক্ষেত্রে। সুতরাং, যখন রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ভেতরে পর্যবেক্ষণ করা হয়. তখন পুঁজিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্যাবলী উপলব্ধি করা যায়: ‘শ্রমের সামাজিক বিভাগে নৈরাজ্য এবং ওয়ার্কসপগুলোতে স্বৈরতন্ত্র (ফবংঢ়ড়ঃরংস) হলো একটির সঙ্গে আর একটির পারস্পরিক অবস্থাবলী’।৫১


প্রথম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে ইউএসএসআর পুঁজিতন্ত্রের দিকে বাঁক নেয়। এখন, প্রথম বারের মত প্রলেতারিয়েত সৃষ্টিতে এবং দ্রæত পুঁজির সঞ্চয়ণে আমলাতন্ত্র প্রয়াস নেয়। অন্য কথায়, এটি যত দ্রæত সম্ভব বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক মিশন সম্পন্নকরণের প্রয়াস নেয়। উৎপাদনের নিচু মাত্রায় এবং মাথা পিছু ক্ষুদ্র জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে পুঁজির দ্রæত সঞ্চয়ণ জনগণের ভোগে এবং তাদের জীবনযাত্রার মানে খুবই চাপ তৈরী করে। এই অবস্থাধীনে, আমলাতন্ত্র রূপান্তরিত হয় পুঁজির ব্যক্তিকায়নে (ঢ়বৎংড়হরভরপধঃরড়হ), যাদের জন্য পুঁজির সঞ্চয়ণই প্রথমত ও শেষত সবকিছু (নব ধষষ ধহফ বহফ ধষষ), তাই এটিকে শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণের সকল অবশিষ্টাংশও উচ্ছেদ করতে হয়। শ্রমিক শ্রেণীকে এককায়িত (ধঃড়সরংব) করতে, এবং সকল সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনকে একটি সর্বাত্মকবাদী ছাঁচে ফেলতে বাধ্যকরণে, এটি শ্রম প্রক্রিয়াতে উৎসাহ (পড়হারপঃরড়হ)-কে প্রতিস্থাপিত করে দমন-পীড়ন (পড়বৎপরড়হ) দিয়ে ।

এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান যে পুঁজির সঞ্চয়ণ প্রক্রিয়াতে ও শ্রমিকদের নির্যাতনে, আমলাতন্ত্র উৎপাদন সম্পর্কে এর সামাজিক শ্রেষ্ঠত্বকে ব্যবহার করতে দেরী করে না বন্টন সম্পর্কাবলীতে এর নিজেদের সুবিধাবলী অর্জনে। এইভাবে অবরোধের অবস্থাধীনে একটি পশ্চাৎপদ দেশে কৃষিতে শিল্পায়ন ও প্রাযুক্তিক বিপ্লব (‘যৌথকরণ’) আমলাতন্ত্রকে রূপান্তরিত করে প্রলেতারিয়েতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ ও নিয়ন্ত্রণাধীন  একটি স্তর থেকে একটি শাসক শ্রেণীর স্তরে।

দ্ব›দ্ব (পড়হঃৎধফরপঃরড়হং) ও বিস্ময়ে (ংঁৎঢ়ৎরংবং) ভরা দ্বা›িদ্বক ঐতিহাসিক বিকাশ এটি দেখায় যে ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ তরান্বিতকরণের বিষয়ীগত (ংঁনলবপঃরাব) অভিপ্রায়ে আমলাতন্ত্রের নেয়া প্রথম পদক্ষেপ রাষ্ট্্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হয়।৫২

প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনাদ্বয়ের সময়ে ভোগ (পড়হংঁসঢ়ঃরড়হ) সম্পূর্ণরূপে সঞ্চয়ণ (ধপপঁসঁষধঃরড়হ) এর অধীনস্থ হয়। এইভাবে সামগ্রিক উৎপাদনে ভোগ্যপণ্যের শেয়ার ১৯২৭-২৮ এর ৬৭.২% থেকে নেমে ১৯৪০এ ৩৯.০% হয়। একই সময় কালে উৎপাদক সামগ্রী (ঢ়ৎড়ফঁপবৎ মড়ড়ফং) এর শেয়ার ৩২.৮% থেকে বেড়ে ৬১.০% হয়। এটি ১৯২১-২৮ এর সময়ের বিপরীত যখন আমলাতান্ত্রিক বিকৃতি সত্তে¡ও, ভোগ সঞ্চয়ণের অধীনস্থ হয়নি, বরং উৎপাদন, ভোগ ও সঞ্চয়ণের একটি মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি সংঘটিত হয়।

আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ হিসেবে রাশিয়ার এই বিশ্লেষণটি ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡কে অনুসরণ করে যাতে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে ভৎধসব ড়ভ ৎবভবৎবহপব হিসেবে নেয়া হয়েছে। যদি এটি ঞযব জবাড়ষঁঃরড়হ ইবঃৎধুবফ ও অন্যত্র দেয়া স্তালিনপন্থী রেজিম সম্পর্কে ত্রৎস্কির বিশ্লেষণ থেকে এক ধাপ অগ্রগতি হয়ে থাকে, তবে তা এই জন্য যে এটি সোভিয়েট ইউনিয়নে বিদ্যমান উৎপাদনের ধরন (সড়ফব ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ) ও উৎপাদন সম্পর্কাবলীর উপর বিশ্বপুঁজিতন্ত্রের চাপকে বিবেচনার মধ্যে আনে। ত্রৎস্কির ব্যাখ্যা সিস্টেমের গতিশীলতাকে ধরতে পারে না। উৎপাদন সম্পর্কাবলীর পরিবর্তে এটি নিজেকে নিয়োজিত রাখে সম্পত্তির রূপসমূহের মাঝে। এটি সিস্টেমের রাজনৈতিক অর্থনীতি দেয় না। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্ত¡ উভয়টি করার চেষ্টা করে।

কিন্তু আমাদের স্পষ্ট হওয়া দরকার যে তাঁর স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡, ‘এক দেশে সমাজতন্ত্রের মতবাদ (ফড়পৎরহব)’এর বিরোধীতা, এবং স্তালিনপন্থী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসিক সংগ্রাম ইত্যাদিসহ লিওন ত্রৎস্কির মতন একজন জায়ান্টের কাঁধে ভর করে যে কেউ স্তালিনীয় ধারা (ড়ৎফবৎ) সম্পর্কে উপলব্ধির ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।                   

ত্রৎস্কির প্রয়াণের অনেক বছর পরে স্তালিনপন্থী রেজিমের পর্যবেক্ষণের সুযোগই আমালাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্তে¡র বিকাশ সম্ভবপর করে তোলে। পুর্ব ইউরোপের স্তালিনের স্যাটেলাইটে রূপান্তরণ আমাকে একটি প্রশ্ন করতে বাধ্য করে যে বিকৃত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হিসেবে ত্রৎস্কির বর্ণনা পর্যাপ্ত ছিল কিনা।


রাশিয়া একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র Ñ এই তত্ত¡টি অস্বীকারকরণে ত্রৎস্কিকে কী বাধা দিয়েছিল?


অতীতের আলোকে ভবিষ্যৎকে দেখা হল একটি প্রবণতা। অনেক বছর ধরেই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকদের অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ ধারণ করেছে। সুতরাং যখন লেনিন, ত্রৎস্কি ও অন্যান্য বলশেভিক নেতারা বলেন যে যদি রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন থাকে, তবে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে, তাঁরা কল্পনা করেছিলেন যে ধ্বংস একটি নির্দিষ্ট ধরনে অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুনপ্রতিষ্ঠায়। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে দেখা হয়েছিল মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ফসল হিসেবে। এখান থেকেই এটি ছিল ত্রৎস্কির উপসংহারের দিকে কেবলমাত্র একটি  পদক্ষেপ। রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অস্তিত্বের কারণ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আমলাতন্ত্রের ভয়। এর অর্থ হল আমলাতন্ত্র একটি প্রতিবিপ্লব সংঘটিতকরণে বাধামুক্ত ছিল না, যে বিপ্লব পুঁজিবাদ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতো।

বিজয়দৃপ্ত প্রতিক্রিয়া (ৎবধপঃরড়হ)এর অনিবার্য  অর্থ এই নয় যে প্রস্থানের মূল বিন্দুতে প্রত্যাবর্তন। এই ঘটনা অনুধাবনে অতীত অভিজ্ঞতা ছিল ত্রৎস্কির প্রধান প্রতিবন্ধকতা। মন্দা থেকে পুঁজিবাদ আসতে পারে পেচানো পথে, যাতে বিপ্লব পূর্ব সময়ের উপাদানসমূহ এবং বিপ্লবী অতীতের উপাদানসমূহ সংযুক্ত হয়। পুরাতন পুঁজিবাদী শ্রেণী আধারের তখন উত্থান ঘটতে পারে নয়া ‘সমাজতান্ত্রিক’ পোষাকের আলখাল্লায়, এইভাবে সংযুক্ত বিকাশের তত্ত¡ (ষধি ড়ভ পড়সনরহবফ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ) অধিকতর নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। এই তত্ত¡টি বিকাশে ত্রৎস্কি নিজেই অনেক কিছু করেন।

সারার্থে এটি বলা যায় যে যখন স্তালিনপন্থী রেজিমের বোঝাপোড়ায় (ঁহফবৎংঃধহফরহম) ত্রৎস্কি তুলনাবিহীনভাবে অন্য যে কোন মার্কসবাদীর চেয়ে অধিকতর অবদান রাখেন, তখন তাঁর বিশ্লেষণটি ব্যাহত হয় একটি মারাত্মক সীমাবদ্ধতা দিয়ে, এটি হল আনুষ্ঠানিকতাবাদ (ভড়ৎসধষরংস) এর প্রতি রক্ষণশীল সংযুক্তি (ধঃঃধপযসবহঃ)। এটি স্বভাবগতভাবে মার্কসবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক (পড়হঃৎধফরপঃড়ৎু), যা রূপ (ভড়ৎস)কে আধার (পড়হঃবহঃ) এর অধীন করে।


স্তালিনপন্থী রেজিমের স্বরূপ উম্মোচন


স্তালিনীয় রেজিম সহজাতভাবে পুঁজিবাদ থেকে শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ এটি পুঁজিবাদ থেকে অধিকতর প্রগতিশীল, এই পুর্ব ধারণাটি ত্রৎস্কির যে জোরালো দাবীতে সারাংশায়িত হয়েছে তা হল এই যে ‘প্রায় সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার স্থবিরতা ও মন্দার বিপরীতে রাশিয়াতে উৎপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশ হয়েছে খুবই গতিশীলভাবে’।৫৩ অবশ্য, মার্কসবাদীদের জন্য, এক রেজিমের তুলনায় আর একটি রেজিমের আপেক্ষিক প্রগতি সর্বোপরি প্রকাশ করা হয় এর উৎপাদিকা শক্তির অধিকতর বিকাশের সক্ষমতার ওপর।

ত্রৎস্কি বলেন যে সোভিয়েত রেজিম পুঁজিবাদের অর্জনের সীমাকে ছাড়িয়ে দ্রæত গতিতে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সক্ষমতা প্রদর্শন করে। এর সাথে তাল মিলিয়ে ১৯৫৬ সনে মেন্ডেল লিখেন:


সোভিয়ত ইউনিয়ন মোটামুটিভাবে অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধির ছন্দ বজায় রাখে পরিকল্পনার পর পরিকল্পনাতে, দশকের পর দশকে, অতীতের কোন প্রগতির ভর ছাড়াই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার. . . . । পুঁজিবাদী অর্থনীতির যে সকল উন্নয়নের নিয়মাবলী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে সেগুলো দূর করা হয়।৫৪


১৯৫৬ এর একই বছরে আইজাক দয়েৎশার (ওংধধপ উবঁঃপযবৎ) ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে দশ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জীবন যাত্রার মান পশ্চিম ইউরোপের জীবন যাত্রার মানকে অতিক্রম করবে!

রুশ রেজিমের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী বিশ্লেষণ ঠিক বিপরীত দিকটি নির্দেশ করে: উৎপাদিকা শক্তির উন্নয়ণে আমলাতন্ত্র প্রতিবন্ধক ছিল, এবং আরো বেশী করে প্রতিবন্ধক হবে। ১৯৪৮ এ প্রকাশিত ‘স্তালিনীয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’ দলিলটিতে বলা হয় যে যদিও আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ছিল শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে রাশিয়াকে শিল্পায়িত করা, কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে এটি তীক্ষè দ্ব›েদ্ব (পড়হঃৎধফরপঃরড়হ) প্রবেশ করে:


আমলাতন্ত্রের ঐতিহাসিক কর্তব্য ছিল শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ। এটি করতে যেয়ে আমলাতন্ত্র গভীর দ্ব›েদ্ব জাড়িয়ে পড়ে। একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের উপরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণের জীবনযাত্রার মানকে অবশ্যি বৃদ্ধি করতে হবে, কারণ অপুষ্টি, জীর্ণ আবাসন ও অশিক্ষার শিকার শ্রমিকশ্রেণী আধুনিক উৎপাদনে সক্ষম নয়।৫৫


দমন-পীড়নের মাধ্যমে একটি পর্যায় পর্যন্ত আমলাতন্ত্র শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সক্ষম, কিন্তু এটি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলতে পারে না। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ব্যর্থতা ইতোমধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে মন্দা এবং ‘উৎপাদনে অমসৃণ উন্নয়ণ’ এর  দিকে ধাবিত করে থাকতে পারে।৫৬

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ওপর রাশিয়া: একটি মার্কসীয় বিশ্লেষণ শিরোনামের একটি বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪তে। এই সংস্করণের ১০০ পৃষ্ঠার  আপডেটে বলা হয় যে স্তালিন থেকে উত্তরাধিকার রূপে পাওয়া সোভিয়েত অর্থনীতি অধিকতর অচল হচ্ছে সংকটের উপাদানসমূহ দিয়ে। এবং উৎপাদন বিকাশের ওপর এই অর্থনীতি বেশী বেশী জগদ্দল পাথরে পরিণত হচ্ছে:


প্রতিটি নতুন ব্যর্থতা অথবা অসুবিধার (ফরভভভরপঁষঃু) প্রতি স্তালিনের দৃষ্টিভঙ্গির পদ্ধতি ছিল চাপ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধিকরণ। কিন্তু এই কঠোর পদ্ধতি কেবলমাত্র অধিকতর অমানবিকই হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর অনুপযোগীও। চাবুকের প্রতিটি নয়া তীক্ষè আওয়াজ জনগণের সংকল্পবদ্ধ কিন্তু নিরব প্রতিরোধ বৃদ্ধি করে। . . . . সকল আধুনিক শিল্প প্রগতির ওপর অনমনীয় স্তালিনীয় নির্যাতন বাধা হয়ে দাঁড়ায়।  


অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে স্তালিনপন্থী রেজিম কিভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়, তার একটি চুলচেরা বিশ্লেষণ রয়েছে বইটিতে। কৃষিতে সংকটের ওপর এটিতে বলা হয়:


গ্রামাঞ্চলে স্তালিন যে উত্তরাধিকার রেখে যান তা হল সিকি শতাব্দীর অধিক স্থায়ী মন্দার জলাভূমির পঙ্কে নিমজ্জিত কৃষি। ১৯৪৯-৫৩ এ শস্য উৎপাদন ১৯১০-১৪ এর চেয়ে মাত্র ১২.৮ শতাংশ বেশী ছিল, কিন্তু একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছিল ৩০ শতাংশ। সোভিয়েত কৃষিতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র এক-পঞ্চমাংশে পৌঁছেছিল।

অনেকগুলো কারণের জন্য মন্দা রেজিমের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমত, গ্রামাঞ্চলে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ব্যাপকমাত্রায় দূরীকরণের পর, কৃষিতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ ছাড়া শিল্পে শ্রমের যোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, কৃষি থেকে পুঁজির উৎসমূহ শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তাকরণে যোগান দেয়া একটা পর্যায়ের পর অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্তালিনের ‘পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন’ এর পদ্ধতি অনুঘটক থেকে মন্দায়কে পরিণত হয়ে সমগ্র অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়।৫৮


শিল্পে কী ঘটেছিল? যদিও সাড়ে তিন দশকের অধিক সময় ধরে শিল্প ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হয়েছিল, তারপর এটিরও প্রবৃদ্ধির হার অধোগামী হচ্ছিল। ১৯৩০ এর দশকে পাশ্চাত্যের থেকে অধিকতর দ্রæত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এটি বর্তমানে রাশিয়ার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে বিবেচনার যোগ্য নিচু মাত্রায় আটকে গেছে:


১৯৫৭এর শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সোভিয়েট ইউনিয়নে শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা বারো শতাংশ বেশী ছিল . . . তাসত্তে¡ও, এমনকি সোভিয়েত হিসেব অনুসারেও, সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৫৬তে বার্ষিক শিল্প উৎপাদন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অর্ধেক।৫৯


কৃষিতে সংকটের কারণে, শিল্পে নিচু মাত্রার উৎপাদনশীলতার ক্ষতিপূরণ করা যাচ্ছিল না শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি করে। সুতরাং রুশ আমলাতন্ত্রকে রাশিয়ার অর্থনীতির অভ্যন্তরে অপচয়ী ও নিম্নমানের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে বর্ধিতভাবে নজর দিতে হচ্ছিল।

বইটিতে অপচয়ের কতিপয় উৎসের খুটিনাটি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল: প্রকোষ্ঠায়ন (পড়সঢ়ধৎঃসবহঃধষরংস) এন্টারপ্রাইজগুলোকে ধাবিত করেছিল অভ্যন্তরীণভাবে দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে যেগুলো অন্য কোথাও অধিকতর সস্তায় উৎপাদন করা যেতো;৬০ ব্যবস্থাপক ও শ্রমিক কর্তৃক যোগানের মজুদকরণ;৬১ প্রাযুক্তিক আবিষ্কারকে ব্যবস্থাপকগণ কর্তৃক প্রতিরোধকরণ;৬২ গুণগত মানের বিপরীতে সংখ্যাগত মানের উপর গুরুত্বারোপ;৬৩ রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি অবহেলা;৬৪ ‘কাগুজে কাজ ও বিশৃঙ্খলা’র বৃদ্ধি;৬৫ ব্যাবস্থাপকদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরির আপেক্ষিক দক্ষতা নিরুপণে কার্যকর ও যৌক্তিক মূল্য ব্যবস্থা (বভভরপরবহঃ ধহফ ৎধঃরড়হধষ ঢ়ৎরপব সবপযধহরংস) এর দরকার হয়, সেটি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা।৬৬ উপসংহারটি ছিল নিম্নরূপ:


যদি আমরা ‘পরিকল্পিত অর্থনীতি’ বলতে এমন একটি অর্থনীতি বুঝি যাতে সকল উপাদান মৌলসমূহ অভিযোজিত ও ব্যবস্থিত করা হয় একটি একক ছন্দে, এতে সংঘর্ষাবলী নূনতম থাকে, এবং সর্বোপরি, এতে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তাবলী নিতে ভবিষ্যৎদর্শিতা বজায় থাকে, তাহলে রুশ অর্থনীতি পরিকল্পিত ছাড়া অন্য যে কোন কিছু। প্রকৃত পরিকল্পনার পরিবর্তে, অর্থনীতিতে তৈরীকৃত শূন্যস্থান পূরণের জন্য সরকারী আদেশের কঠোর পদ্ধতির উদ্ভব হয় এই সরকারের সিদ্ধান্তাবলী ও কর্মকান্ড দিয়ে। অতএব, সোভিয়েত পরিকল্পিত অর্থনীতি সম্পর্কে বলার পরিবর্তে, একটি আমলাতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত অর্থনীতি সম্পর্কে বলা অধিকতর সঠিক।৬৭


অবশ্যি অন্য আরো লোকজন রুশ অর্থনীতির অদক্ষতার বর্ণনা প্রদান করেছিলেন। উপরের বর্ণনাকে যা বৈশিষ্ট্যায়িত করে তা হল এই যে অপচয় ও অদক্ষতা (ধিংঃব ধহফ রহবভভরপরবহপরবং) কে দেখা হয় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীর ব্যবস্থার ফসল হিসেবে। রুশ শিল্পে নৈরাজ্য ও অপচয়জনিত ক্ষতির (ধহধৎপযু ধহফ ধিংঃধমব) মৌলিক কারণসমূহ নিহিত রয়েছে একটি বিচ্ছিন্ন (রংড়ষধঃবফ) অর্থনীতিতে পুঁজিতান্ত্রিক সঞ্চয়নÑ উৎপাদনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ও নিম্ন সরবরাহ।      

জাঁতি (হঁঃপৎধশবৎ) এর দুইটি বাহুর মতন এগুলো ব্যবস্থাপকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তাদের প্রতারণায় উৎসাহ যোগায়, উৎপাদন সম্ভাবনাসমূহ গোপন করে, যন্ত্রপাতি ও সরবরাহের (বয়ঁরঢ়সবহঃং ধহফ ংঁঢ়ঢ়ষু) প্রয়োজনকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখায়, সম্পদসমূহ মজুদ করে নিরাপত্তার ভান দেখায়, এবং সাধারণভাবে রক্ষণশীলভাবে কাজ করে। এটি অপচয়ের দিকে ধাবিত করে, এবং সুতরাং সরবরাহের আরো ঘাটতি হয় এবং উপর থেকে ব্যবস্থাপকদের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়, যাদেরকে আরো অধিক প্রতারণা করতে হয়, এবং এভাবে একটি দুষ্টচক্র চলতে থাকে ।

উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ও নিম্ন সরবরাহ বর্ধিষ্ণু বিভাগতন্ত্রের (ফবঢ়ধৎঃসবহঃধষরংস) দিকে ধাবিত করে, সাধারণভাবে অর্থনীতির বিনিময়ে একজন নিজের সেকটরকে দেখভাল করেÑপুনরায় একটি দুষ্টচক্র। একই সমস্যা ব্যবস্থাপকদের অগ্রাধিকারকরণের দিকে ধাবিত করে। কিন্তু এই অগ্রাধিকার ব্যবস্থা (ংুংঃবস) ও ‘প্রচারাভিযান’ (পধসঢ়ধরমহ) পদ্ধতির একটি স্পষ্ট পরিমাণগত মানদন্ডের ঘাটতি থাকায়, এটি অপচয় ও বিকৃতির দিকে ধাবিত করে। এই বৈশিষ্ট্যাবলীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে বহুবিধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, যেগুলো নিজেরাই ছিল অপচয়কর এবং তাদের প্রণালীবদ্ধকরণ (ংুংঃবসধঃরুধঃরড়হ) ও সংগতির (যধৎসড়হু) ঘাটতি আরো অচপয়ের দিকে ধাবিত করে। সুতরাং আমলাদের কাগুজে পিরামিড ও আতিশয্যের জন্য আরো নিয়ন্ত্রণের দরকার পড়ে। আবারো একটি দুষ্টচক্র। অতি উচ্চমাত্রায় পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা এবং নিচু মাত্রার সরবরাহের মধ্যেকার দ্ব›দ্ব (পড়হভষরপঃ) থেকে দুষ্টচক্রের উদ্ভব, এটিকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিযোজনপূর্বক (সঁঃধঃরং সঁঃধহফরং) দুর্বল মূল্য কৌশল (ঢ়ড়ড়ৎ  ঢ়ৎরপব সবপযধহরংস) ফলাফলের ওপর আরোপ করা যায়। এটি আনুক্রমিকভাবে তারপরেও অধিকতর বিভাগতন্ত্র (ফবঢ়ধৎঃসবহঃধষরংস), অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রচারাভিযান ও নিয়ন্ত্রণসমূহের আতিশয্যকে উৎসাহিত করে।

এই সমস্ত সমস্যাবলীর পেছনে রয়েছে পুঁজিতান্ত্রিক প্রণোদনা Ñ ক্ষমতার জন্য বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এবং এটি থেকে উদ্বর্তনের জন্য প্রচন্ড সামরিক ব্যয়ভারের প্রয়োজনীয়তা।

            নিম্ন উৎপাদনশীলতা কেবলমাত্র উপর থেকে অব্যবস্থাপনার জন্য ঘটেনি, নিচ থেকে শ্রমিকদের প্রতিরোধসমূহের জন্যও ঘটেছে। এই নিচু উৎপাদনশীলতার মাত্রা উপরের অব্যবস্থাপনা ও ভ্রান্তি কিংবা শ্রমিকদের প্রতিরোধের ফল কিনা, এটা বিচার করা অসম্ভব ছিল । দু’টি অবয়বকে স্বভাবতই পৃথক করা যায় না। মানুষের প্রয়োজন মেটানের চেয়ে বরং ব্যয় হ্রাসকরণে এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে উৎকণ্ঠিত ছিল সাধারণভাবে পুঁজিবাদ, এবং বিশেষভাবে এর আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী প্রকরণ। এর যৌক্তিকতা ছিল মূলত অযৌক্তিক, যেহেতু এটি শ্রমিককে পরকীকৃত করে, একটি বিষয়ীতে (ংঁনলবপঃ) পরিণত করার পরিবর্তে একটি ‘বস্তু’তে (ঃযরহম), একটি সধহরঢ়ঁষধঃবফ ড়নলবপঃ এ রূপান্তরিত করে, কারণ একজন বিষয়ী শ্রমিক তার জীবনকে নিজের ইচ্ছানুসারে রূপ দান করতে পারে। সেই কারণে শ্রমিকেরা উৎপাদনে অন্তরায় তৈরী করে।৬৮

এই উপসংহারটি দিয়ে রাশিয়ার শ্রমিকদের ওপর অধ্যায়টি শেষ হয়:


বর্তমানে রুশ নেতৃবৃন্দের কেন্দ্রীয় উদ্বেগের বিষয় হলো কীভাবে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা উন্নতি করা যায়। শ্রমিকদের তাদের কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ কখনোই সমাজের প্রতি অধিকতর এরকমটি ছিলনা। শ্রমিকদের আমলাতন্ত্রের উৎপদানশীল মেশিনের নগণ্য অংশে পরিণতকরণের প্রচেষ্টা থেকে, শ্রমিকদের যেটি সবথেকে দরকার যে উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীল সামর্থ, সেগুলোকে তারা হত্যা করে। যৌক্তিকায়িত ও গুরুত্বারোপকৃত শোষণ শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

শ্রমিক শ্রেণী যত অধিক দক্ষ ও সুসংহত হয়, তখন তারা কেবলমাত্র পরকীকরণ (ধষরবহধঃরড়হ) ও শোষণই প্রতিরোধ না, সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের শোষক ও নির্যাতকদের জন্য বর্ধিতভাবে ঘৃণা প্রদর্শন করে। শ্রমিক শ্রেণী প্রাযুক্তিক প্রশাসক হিসেবে আমলাতন্ত্রের জন্য তাদের শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছে। গণরোষের সম্মুখে কোন শাসক শ্রেণীই তার শাসক দীর্ঘদিন বজায় রাখতে পারে না।৬৯


আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ গভীরতর ও গভীরতর সাধারণ সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছিল। মার্কস যেমনটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, যখন একটি সামাজিক ব্যবস্থা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে বাঁধা হয়ে দাড়ায়, তখন বিপ্লবের যুগ শুরু হয়।


স্তালিনিয় রেজিমের ময়নাতদন্ত


একজন মানুষ জীবিত থাকতে যে গভীর অসুস্থতা দিয়ে আক্রান্ত হয়, ময়নাতদন্ত তা প্রকাশ করে। এইভাবে একটি সামাজিক বিন্যাসের (ংড়পরধষ ড়ৎফবৎ) মৃত্যুর মুহুর্তটি হতে পারে তার সত্যের মুহুর্ত।  স্বয়ং ইউএসএসআর এ ‘সাম্যবাদ’ এর পতনের পর, যখন ১৯৮৯ এর শরৎ ও শীতে স্তালিনের সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিষ্ঠিত পূর্ব ইউরোপের রেজিমসমূহ ভেঙ্গে যেতে শুরু করে, তখন স্তালিনিয় রেজিমের প্রকৃতির ওপর সুস্পষ্ট বিচার সহজতর হয়।সমাজতান্ত্রিক হিসেবে, অথবা এমনকি ‘অধঃপতিত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র’ হিসেবে Ñ অর্থাৎ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার উত্তরণকালীন পর্যায় হিসেবে  স্তালিনপন্থী রেজিমের উপলদ্ধি Ñ এই অনুমান করে যে এটি পুঁজিবাদ থেকে অধিকতর প্রগতিশীল। একজন মার্কসবাদীর জন্য সবার ওপরে তাৎপর্যমন্ডিত যে এটি পুঁজিবাদের চেয়ে অধিকতর দক্ষভাবে উৎপাদিকা শক্তি বিকাশে সক্ষম। আমাদের একমাত্র ত্রৎস্কির কথাগুলো স্মরণে রাখা দরকার:

সমাজতন্ত্র বিজয়ের অধিকার প্রদর্শন করেছে, কেবলমাত্র উধং কধঢ়রঃধষ এর পাতায় নয়, বরং পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ জমিতে অবস্থিত শিল্প ক্ষেত্রেও Ñ কেবলমাত্র দ্ব›দ্ব তত্তে¡র ভাষায় নয়, ইস্পাত, সিমেন্ট ও বিদ্যুতের ভাষায়।৭০

বাস্তবিকই এটি ছিল শিল্প উন্নয়নের ভাষা যেটি পূর্ব ইউরোপ ও ইউএসএসআর এর ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা করে। কিন্তু যা ঘটেছিল তা বিজয় নয়, বরং ১৯৭০এর দশকের শেষভাগে এবং ১৯৮০এর দশকের প্রথম ভাগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হ্রাস, যেটি মন্দা এবং এই দেশগুলোর  সঙ্গে অগ্রসর পশ্চিমের পার্থক্য বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করেছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নে এঘচএর বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল নিম্নরূপ: প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (যদিও অতিরঞ্জিত দাবী), ১৯.২%; ১৯৫০-৫৯, ৫.৮%; ১৯৭০-৭৮, ৩.৭%; ১৯৮০-৮২ তে এটি ছিল ১.৫% এর নীচে; এর শেষ তিন-চার বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক।৭১

যদি পাশ্চাত্যের থেকে পূর্ব ইউরোপ ও ইউএসএসআর এর শ্রমের উৎপাদনশীলতা অধিকতর গতিশীল হতো, তবে কেন বুঝতে পারা যাবে না যে এই সমস্ত দেশের শাসকবর্গ  পরিণামে  বাজারের প্রেমম্গ্ধু হয়। তারপর জার্মানির পুনরেকত্রিকরণে দেখার কথা ছিল পশ্চিম জার্মানির তুলনায় পূর্ব জার্মানির শিল্পের সমৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে পুনরেকত্রীকরণের পর পূর্ব জার্মান অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৮৯এ পূর্ব জার্মানিতে কর্মে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দশ নিযুত, অন্যদিকে এখন কেবলমাত্র ছয় নিযুত। পাশ্চাত্যের লেভেলের তুলনায় পূর্ব জার্মানিতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ছিল মাত্র ২৯%।৭২ একইভাবে যদিও পূর্ব জার্মানির উৎপাদনশীলতার মাত্রা পূর্ব ইউরোপে সর্বোচ্চ ছিল, কিন্তু পশ্চিম জার্মানি ও অন্যান্য অগ্রসর অর্থনীতির তুলনায় তখন পর্যন্ত নিচু ছিল যাদের সঙ্গে এর প্রতিযোগিতা করতে হতো।

যদি ইউএসএসআর শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হতো, যতো বিকৃতভাবেই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত যে যদি পুঁজিবাদ এটিকে আক্রমণ করতো, তাহলে শ্রমিক শ্রেণী তাদের রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতো। ত্রৎস্কি সবসময় স্বতঃসিদ্ধভাবে বিবেচনা করতেন যে পুঁজিবাদ কর্তৃক আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণী এর সহায়তায় এগিয়ে আসবে, একে কর্তৃত্বকারী আমলাতন্ত্র যতই দুর্নীতিগ্রস্থ ও বিকৃত হোক না কেন। সোভিয়েত আমলাতন্ত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন আমলাতন্ত্রের মধ্যকার তুলনা ছিল ত্রৎস্কির পছন্দের। নানা ধরণের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে যেমন জঙ্গী, সংস্কারবাদী, বিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল, ক্যাথলিক Ñ কিন্তু সবই হল হধঃরড়হধষ পধশবএ শ্রমিক শ্রেণীর অংশের দরকযাকষির জন্য প্রতিরক্ষা সংগঠন। ত্রৎস্কি বলেন যে, ট্রেড ইউনিয়নে কর্তৃত্বকারী আমলাতন্ত্র যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক না কেন, শ্রমিক শ্রেণী সব সময়ই ‘তাদের প্রগতিশীল পদক্ষেপসমূহ সমর্থন করবে এবং . . . বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের রক্ষা করবে।’

কিন্তু ১৯৮৯ এ সংকটকাল উপস্থিত হলে দেখা গেল যে পূর্ব ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণী ‘তাদের’ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসল না। স্তালিনিয় রাষ্ট্রসমূহ শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র হলে এটা ব্যাখ্যা করা যায় না যে কেন তাদের একমাত্র প্রতিরক্ষক রুমানিয়াতে ঝবপঁৎরঃধঃব, পূর্ব জার্মানীতে ঝঃধংর, ইত্যাদি, অথবা সোভিয়েত শ্রমিক শ্রেণী কেন ইয়েলেৎসিনকে সমর্থন দেন, যিনি বাজারের একজন দৃঢ় প্রতিনিধি।

১৯৮৯এ পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটল, যদি পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের রেজিম উত্তর-পুঁজিবাদী হতো, তাহলে কীভাবে এই পুনঃপ্রতিষ্ঠা অর্জিত হল এরকম বিস্ময়কর সাচ্ছন্দে? ত্রৎস্কি বলেছিলেন যে একটি সামাজিক ব্যবস্থা (ংড়পরধষ ড়ৎফবৎ) থেকে অপর একটিতে রূপান্তরণে অবশ্যি একটি গৃহযুদ্ধ অনুসঙ্গী হবে। কিন্তু ঘটনাবলী ত্রৎস্কির দাবী অনুসারে সংঘটিত হয়নি। ত্রৎস্কি লেখেন:

এক শ্রেণীর হাত থেকে অন্য এক শ্রেনীর হাতে ক্ষমতার হস্তান্তরের ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত মার্কসবাদী তত্ত¡ কেবলমাত্র বিপ্লবী সময়েই প্রয়োগযোগ্য যখন ইতিহাস পাগলাটেভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হয় তা নয়, এটি প্রতি-বিপ্লবের সময়েও প্রয়োগযোগ্য, যখন সমাজ পেছনের দিকে ধাবিত হয়। যিনি দাবী করেন যে সোভিয়েত সরকার ধীরে ধীরে প্রলেতারিয় থেকে বুর্জোয়াজীতে রূপান্তরিত হয়েছে, বলতে গেলে তিনি সংস্কারবাদের ফিল্মকে পেছনের দিকে ধাবিত করেন।৭৩

১৯৮৯এর বিপ্লব ব্যাপক মাত্রার সামাজিক সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের অনুপস্থিতির জন্য উল্লেখ্য। রোমানিয়া ছাড়া আর কোথাও কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ ছিল না। বাস্তবত থ্যাচারের ব্রিটেনে পুলিশ ও ধর্মঘটী খনি শ্রমিকদের মধ্যে সংঘটিত ভয়াবহ সংঘর্ষের তুলনায় পূর্ব জার্মানি, চেকো¯øাভাকিয়া ও হাঙ্গেরিতে স্বল্প পরিমাণে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছিল।

একটি সামাজিক ব্যবস্থা (ংড়পরধষ ড়ৎফবৎ) থেকে অন্যটিতে ধাপান্তরে আবশ্যিকভাবে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র অন্য একটি রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। ১৯৮৯এ রাষ্ট্রযন্ত্র স্পর্শ করা হয়নি বললেই চলে। রাশিয়াতে সোভিয়েত সেনাবাহিনী, কেজিবি ও আমলাতন্ত্র তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত ছিল। পোল্যান্ডে সেনাবাহিনী পরিবর্তন সংবর্ধনে সহায়তা করেন। জেনারেল ইয়ারুজালস্কি ১৯৮১এর অভ্যুত্থানের স্থপতি ছিলেন। তিনি সলিডারিটির  সঙ্গে গোল টেবিল বৈঠকে চুক্তির জন্য আলোচনাতে এবং গধুড়রিবপযরং এর কোয়ালিশন সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

যদি একটি প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হতো, যদি পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটতো, তাহলে একটি শাসক শ্রেণী দিয়ে  অপরটির সামগ্রিক প্রতিস্থাপন হওয়া উচিত ছিল। পরিবর্তে আমরা লক্ষ্য করলাম সমাজের শীর্ষে একই ব্যক্তিবর্গের অবস্থানের ধারাবাহিকতা। নামঘন্ট তালিকার (ঘড়সবহশষধঃঁৎধ) সদস্যবৃন্দ যারা ‘সমাজতন্ত্র’ এর অধীনে অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন, তারাই একই কাজ করছেন ‘বাজার’ এর অধীনে। মাইক হাইনস এর খুবই ভাল একটি নিবন্ধ হল ‘শ্রেণী ও সংকট: পূর্ব ইউরোপে রূপান্তর’, এই নিবন্ধে তিনি লেখেন:

এটি (রাষ্ট্র) সফল হয়েছে অংশত এর ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে ‘রাষ্ট্রীয় পকেট’ থেকে ‘ব্যক্তিগত পকেট’ এ স্থানান্তর করে। এই প্রক্রিয়াতে শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরে কিছুটা উর্ধ্ব প্রবাহিতা এবং মাঝে মধ্যে নতুন আগন্তুক দেখা যায়। শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ দাবী করেন যে যেটি বিপদজনক তা হলো পুঁজিবাদী সমাজ দিয়ে উৎপাদনের সমাজতান্ত্রিক ধরণের প্রতিস্থাপন, এই দাবীর বিপরীতে এরকম কোনো প্রমাণ দেখা যায় না যে শাসক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। যেটি বিস্মায়ক তা হলো প্রকৃতপক্ষে কত নগণ্য পরিবর্তনই না ঘটেছে। এর ম্যানেজারদের নিকট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিক্রয় অথবা নিয়ন্ত্রণাধীন লোকজনের একই ধরণের গোষ্ঠীসহ এর পুনঃরাষ্ট্রীয়করণ- এর থেকে কদাচিৎ বেশি সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত করে একজন জেনারেলকে বহিস্কার এবং একজন কর্নেলকে পদোন্নতি দানে। বরং এটি এই পরামর্শ দেয় যে যেটি ঝুকির মধ্যে তা হলো উৎপাদনের ধরণের মধ্যে অভ্যন্তরিণ রূপান্তরণ, এই দৃষ্টান্তে তা হলো পুঁজিবাদের রূপের অবস্থান পরিবর্তন, অর্থাৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ থেকে অধিকতর মিশ্র রাষ্ট্রীয় ও বাজার রূপসমূহের মধ্যে।৭৪

ক্রিস হারমান সঠিকভাবে উন্নয়নকে পার্শ্বিক দিকে ধাবিত বলে বর্ণনা করেছিলেন, আর তা হলো আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ থেকে বাজার পুঁজিবাদের দিকে।

চুড়ান্তভাবে, যদি ইউএসএসআর ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে উত্তর-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিন্যাস (বপড়হড়সরপ ধহফ ংড়পরধষ ড়ৎফবৎ) থাকতো, তাহলে কীভাবে এটা সম্ভব হলো এর ভেতর একটি বাজার অর্থনীতিকে সংযোজন? একজন একটি লেবু গাছকে কমলা গাছে কলম দিকে পারে অথবা এর বিপরীতটিও সম্ভব, কারণ উভয়ই একই সাইট্রাস পরিবার (ভধসরষু) ভূক্ত; একজন আলু গাছকে কমলা গাছে কলম দিতে পারে না। মাইক হাইনস স্তালিনীয় অর্থনীতিতে বাজার অর্থনীতির সফল সংযোজন (মৎধভঃরহম) এর বর্ণনা দেন:

এটি যথাযথভাবে এই কারণে যে রপান্তরণ (ঃৎধহংরঃরড়হ) এর উভয় পার্শ্বই একই কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যাবলী প্রদর্শন করে, আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে এতে একটা মাত্রায় (ড়হ ঃযব ংপধষব) ব্যক্তিক সুবিধাবাদ (ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরংস) সম্ভব। আমরা কেবলমাত্র শ্রেণী-সমাজগুলোই দেখছিনে, বরং উৎপাদনের একটি সাধারণ ধরণে প্রোথিত শ্রেনী-সমাজগুলো দেখছি, যেখানে পরিবর্তনগুলো সংঘটিত হচ্ছে আধেয় (বংংবহপব)-তে নয়, আধার (ভড়ৎস) এ। যদি এটা বোঝা না যায়, তবে এটি বোঝা অসম্ভব যে কীভাবে উপরে অবস্থান পরিবর্তনের নীচে একই মানুষজন, একই পরিবারবর্গ, একই সামাজিক জালিকাগুলো (হবঃড়িৎশং) ১৯৯০এর দশকে তাদের সৌভাগ্যের পানীয় পান করছে, যেভাবে তারা ১৯৮০এর দশকে করেছিল। এটা সত্য যে যখন তারা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে গালগপ্প করতো, তখন তাদের অনুপস্থিত বন্ধুবর্গ সম্পর্কে হঠাৎ হঠাৎ ভাবনার উদ্রেক হতো, কিন্তু তারা অধিকতর সামগ্রিক দৃষ্টি হারাতো না, কারণ রূপান্তরণ সত্তে¡ও তারা তখন পর্যন্ত উপরে অবস্থান করছে। তাদের নীচে একই শ্রমিক শ্রেনী তখন পর্যন্ত তাদের সম্পদ, সুবিধাদি এবং অতীতে কৃত তাদের অদক্ষতার বোঝা বহন করছে।৭৫

পুরাতন বিন্যাসের সত্যিকার ভুক্তভোগী জনগণ এখন নতুন বিন্যাসেও ভুক্তভোগী।৭৬

                  যদি পূর্ব ইউরোপে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী রেজিমের স¤প্রসারণ অধঃপতিত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের তত্ত¡কে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাহলে স্তালিনীয় রেজিমের ধ্বংস এই প্রশ্নটির উত্তর দেয় যথাযথভাবে। উভয় ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্ত¡ নিজেকে প্রদর্শন করে টেকসই বিকল্প হিসেবে।

একটি পশ্চাৎপদ দেশে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের ওপর আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের চাপের ফল হলো রুশ বিপ্লবের অধঃপতন (ফবমবহবৎধঃরড়হ) এবং স্তালিনবাদের উত্থান, এই বিশ্লেষণে ত্রৎস্কির কাজ ছিল একটি অভিযাত্রিক প্রচেষ্টা। স্তালিনের ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’ এই মতবাদের বিরোধীতায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্তালিনবাদী রেজিমের প্রতি তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খানিক মার্কসবাদী, ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্তে¡র বিকাশে। তাঁর কিছু বক্তব্য পরিহার করে, ত্রৎস্কিবাদের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়কে সমর্থন করা দরকার।

ত্রৎস্কির অবস্থানের ওপর আমার সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল ধ্রæপদী মার্কসবাদে প্রত্যাবর্তন। বিশেষ করে ত্রৎস্কির প্রয়াণের পর ঐতিহাসিক বিকাশ প্রদর্শন করে যে ‘অধপতিত শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রে’র ধারণা ধ্রæপদী মার্কসবাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, যাতে সমাজতন্ত্রকে চি‎িহ্নত করা হয় শ্রমিক শ্রেণীর স্ব-মুক্তি হিসেবে। স্তালিনীয় রেজিমের ওপর ত্রৎস্কির লেখালেখির মূল নিহিতার্থ  সংরক্ষণে তাঁর রচনাবলীর  আক্ষরিক অর্থ বাদ দিতে হবে। ইউএসএসআর ও পূর্ব ইউরোপে মেকি সমাজতন্ত্রের পতন সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছে লেলিন ও ত্রৎস্কির সত্যিকার বিপ্লবী ধারণাবলী, অক্টোবর বিপ্লবের সত্যিকার উত্তরাধিকারের পুনরাবিষ্কার।  তথাকথিত ‘সাম্যবাদের পতন’ সত্তে¡ও, আমার রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এর উপসংহারিক বিবৃতি যখন লিখিত হয়েছিল তখনকার মতন তা এখনও সত্য:

স্ব-সমবেত (ংবষভ-সড়নরষরংবফ), সমাজতান্ত্রিক উদ্দেশ্যাবলী এবং সেগুলো অর্জনের পদ্ধতিসমূহের প্রতি সচেতন জনগণই কেবলমাত্র চুড়ান্ত অধ্যায়টি লিখতে পারে, বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টির নেতৃত্বে।

বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে এর সূত্রের মৌলিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করে স্তালিনীয় রেজিমের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী সংজ্ঞা ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡কে অনুসরণ করে:

. . . . রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মধ্যে দেখা হলে পুঁজিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলী বুঝতে পারা যায়: ‘শ্রমের সামাজিক বিভাগে নৈরাজ্য এবং কারখানাগুলোতে (ড়িৎশংযড়ঢ়)  স্বৈরতন্ত্র হ’ল পারস্পারিক নির্ভরশীল অবস্থা . . . .।’৭৭


সামরিক প্রতিযোগিতা দিয়ে কর্তৃত্বকারী আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হলো এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, যাতে স্তালিনীয় রেজিমকে স্থাপন করে এই তত্ত¡টি পুঁজিবাদী সঞ্চয়নের গতিতে (ফুহধসরপ) রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর অধীনস্থতার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম।



অধ্যায় তিন

স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি


পাশ্চাত্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাজার পুঁজিবাদের তেজীভাব দেখা যায়। এটা ঠিক মেন্ডেল ও গং কর্তৃক এখন পর্যন্ত বারংবার পুনরাবৃত ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীত ঘটনাই দেখা যায়। এই দ্ব›দ্ব (পড়হঃৎধফরপঃরড়হ) নিরসনের প্রচেষ্টা স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্তে¡র সূত্রবদ্ধকরণের দিকে ধাবিত করে।

এটি কীভাবে ঘটলো তা বুঝতে আমার আত্মজীবনীমূলক প্রকৃতির দিকে সংক্ষিপ্ত পদচারণা দরকারর। ঘটনা হলো এই যে আমি ফিলিস্তিনে স্বাধীনভাবে প্রায় ত্রিশ জনের মত সদস্য নিয়ে ছোট্ট একটি ত্রৎস্কিপন্থী গ্রæপ গড়েছিলাম ধ্বংসস্তুপ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলন যে বিশাল অসুবিধার সম্মুখীন হয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এটি ছিল প্রস্তুতি। হ্যান্স খ্রিস্টিয়ান এন্ডারসনের সম্রাটের নুতন কাপড় গল্পের ছোট্ট বালকটির মতন আমি ছিলাম। নাৎসিবাদ ও স্তালিনবাদের অধীনে বছরের পর বছর অন্তরণ ও নিদারুণ যন্ত্রণার পরে ত্রৎস্কিপন্থীরা আলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপনের মানসিক প্রয়োজনে ভুগছিল। বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হওয়া আরো বেদনাদায়ক ছিল। আমার রাজনৈতিক বিকাশ ব্রিটিশ ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলনের অংশ ছিল, যার ১৯৪৬এ প্রায় চারশো সদস্য ছিল, আমি সম্ভবত এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চাপের মধ্যে ছিলাম। মতান্ধবাদীতা (ফড়মসধঃরংস) থেকে মুক্তি পেতে এটি যথেষ্ট ছিল না যে আমি মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, ত্রৎস্কি ও লু´েমবার্গ পড়েছিলাম। মেন্ডেল ও পাবলো মার্কসবাদী সাহিত্যে আমার চেয়ে কোনভাবেই ঊণ জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন না। অতীতের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণে বুঝতে পারি ব্রিটেনে নিঃসঙ্গ ফিলিস্তিনি হিসেবে আমার একটি রাজনৈতিক সুবিধা ছিল।

৯৪৬এ ব্রিটেনে এসে ঔপনিবেশিক দেশের প্রেক্ষাপটে অবস্থাদি পর্যালোচনা করে, আমি নিম্নোক্ত ঘটনাবলী দিয়ে বিস্মিত হই:

. . . . শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান ছিল উচু। যখন আমি প্রথমে একজন শ্রমিকের বাড়ি পরিদর্শন করি, ঠিক একটি সাধারণ বাড়ি, আমি তাঁর কাজ কী জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে তিনি একজন প্রকৌশলী। আমার ইংরেজী ভাল ছিল না, সুতরাং আমি মনে করলাম যে তিনি একজন ডিগ্রীধারী প্রকৌশলী। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আধা-দক্ষ প্রকৌশল শ্রমিক। এটি ছিল একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। শিশুরা ১৯৩০এর দশকের চেয়ে ভাল ছিল। ইউরোপে কেবলমাত্র একবার জুতা ছাড়া শিশু দেখেছিলাম ডাবলিনে। আর কোনো শিশুদের রিকেট রোগ হতো না। এটি আমাকে বুঝতে সহায়তা করলো যে চুড়ান্ত সংকট ঠিক দোর গোড়ায় নয়।৭৮

দীর্ঘ তেজীভাব এবং ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যকার অসংগতির মোকাবেলায় ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলনের কিছু লোকজনের সামান্যই অসুবিধা হয়। আসন্ন পুঁজিবাদী বিপর্যয়ের কাল্পনিক জগতে গ্যারি হিলি (এবৎৎু ঐবধষু) বসবাস অব্যাহত রেখেই চলেছিলেন। মেন্ডেল সবসময় ঘটনার পেছনে পড়ে থাকেন এবং পুঁজিবাদের কেজো (ড়িৎশরহম) কৌশল সম্পর্কে অস্পষ্ট সূত্রাবলী ব্যবহার করেন। স্পষ্টকরণের পরিবর্তে তিনি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেন।৭৯ এই বিষয়ে মেন্ডেলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রথম বিতার্কিক প্রবন্ধ লিখি এবং তা প্রকাশিত হয় ১৯৪৭এ। যুদ্ধোত্তর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অস্তিত্বকে মেন্ডেল অস্বীকারকরণের চেষ্টা করেন, এটি ছিল তার বিরুদ্ধে সমালোচনা, কিন্তু তারপরেও এটি মার্কসীয় অর্থনীতির যান্ত্রিক ধারণা বাতিলের বাইরে যায়নি।৮০

সাধারণ ইস্যুর কার্যকর উপলব্ধিকে কেবলমাত্র ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যর্থতা দিয়ে উত্থাপিত সমস্যাবলী জাপটে ধরলেই চলে না। এটিকে শ্বাশত পুঁজিবাদী তেজীভাবের পয়গম্বরদের মোকাবেলাও করতে হয়, যারা যুক্তি দেন যে ব্যবস্থাটি উন্নতি করবে যতক্ষণ পর্যন্ত কেইনসিয় অর্থনৈতিক পলিসিসমূহ অনুসরণ করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পুরোপুরি কর্মসংস্থান হলো একটি সত্য ঘটনা, কিন্তু এটিকে কেইনসিয় পলিসিসমূহের ফল বলে মনে করা হলো মোরগের ডাকে সূর্যোদয় ঘটে বিশ্বাস করার মতন একটি ব্যাপার। ১৯২৮ থেকে পরবর্তী সময়ে জন মেনার্ড কেইনস যুক্তি দেন যে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো আর্থিক (ভরংপধষ) ও মুদ্রানীতি সংক্রান্ত (সড়হবঃধৎু) পলিসিগুলোকে ব্যবহার করা যাতে এটা নিশ্চিত হয় যে  অর্থনীতিতে যথেষ্ট কার্যকর চাহিদা থাকে সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান বজায় রাখতে। ১৯৩৬এ কেইনস তাঁর ধারণাবলীকে আরো বিকশিত করেন তাঁর কর্মসংস্থান, সুদ ও অর্থের সাধারণ তত্ত¡ (এবহবৎধষ ঞযবড়ৎু ড়ভ ঊসঢ়ষড়ুসবহঃ, ওহঃবৎবংঃ ধহফ গড়হবু)  গ্রন্থে। কিন্তু সেই সময়কার সরকারগুলো কোনো সময়েই তাঁর উপদেশাবলী বাস্তবে অনুসরণ করেনি। রক্ষণশীল, শ্রমিকদলের সরকারও নয়, এমনকি জাতীয় সরকারও কেইনসের যুক্তি গ্রহণ করেনি।       

যুদ্ধের আবির্ভাবে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। কেইনস যেমনটি সুপারিশ করেছিলেন, সেভাবে পুঁজিপতি শ্রেণী শান্তিকালীন সময়ে জন-কার্য (ঢ়ঁনষরপ ড়িৎশং)এ অর্থ ব্যয়ে অনুৎসাহী ছিলেন, তারাই এখন সামরিক খাতে টাকা ছিটানোর ব্যাপারে খুবই উদার। এইভাবে, উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিপতিগণ দুই বিলিয়নের উপর থেকে চার বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেট ঘাটতির ভার নেয়ার জন্য রুজভেল্টের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন (১৯৩৪, ৩.৬ বিলিয়ন ডলার; ১৯৩৫, ৩ বিলিয়ন ডলার; ১৯৩৬, ৪.৩ বিলিয়ন ডলার; ১৯৩৭, ২.৭ বিলিয়ন ডলার)। কিন্তু ১৯৪১-৪২এ ৫৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতিতে তারা কিছু মনে করেননি। এটি অসম্ভাবনীয় যে হিটলার কেইনসের সাধারণ তত্ত¡ পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জন করেছিলেন নিযুত নিযুত মানুষকে সেনাবাহিনী ও অস্ত্র শিল্পে সমবেত করে। কেমব্রিজের অর্থনীতিবিদ নয়, অস্ত্র প্রতিযোগিতাই পার্থক্যটি গড়ে দিয়েছিল।

যাহোক, দুই দশকে প্রথম বারের মতন সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান চুড়ান্তভাবে অর্জিত হলে এই ধারণাটা খুবই বিস্তৃিত লাভ করে যে এটিকে বজায় রাখা যাবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় চাহিদা ব্যবস্থাপনার (ংঃধঃব ফবসধহফ সধহধমবসবহঃ) মাধ্যমে। যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের নিকট কেইনস কর্তৃক উপস্থাপিত মতবাদটি সম্পূর্ণরূপে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।

এমনকি কতিপয় প্রাক্তন মার্কসবাদী নিজেদেরকে কেইনসের অনুসারী হিসেবে ঘোষণা দেন। এদের মধ্যে একজন জন স্ট্রেচি (ঔড়যহ ঝঃৎধপযবু)। ১৯৩২-৩৫এ স্ট্রেচি তিনটি বই লেখেন: ক্ষমতার জন্য আসন্ন সংগ্রাম (ঞযব ঈড়সরহম ঝঃৎঁমমষব ভড়ৎ চড়বিৎ), ফ্যাসিবাদের হুমকি (ঞযব গবহধপব ড়ভ ঋধপরংস) এবং পুঁজিবাদী সংকটের প্রকৃতি (ঞযব ঘধঃঁৎব ড়ভ ঃযব ঈধঢ়রঃধষরংঃ ঈৎরংরং), এই গ্রন্থত্রয়ে তিনি নিজেকে গোঁড়া মার্কসবাদী রূপে দাবী করেন (যদিও তিনি প্রকৃতপক্ষে স্তালিনবাদ দিয়ে অধিক প্রভাবিত ছিলেন)। ১৯৪০এ স্ট্রেচি একটি নতুন গ্রন্থ প্রকাশ করেন, প্রগতির জন্য কর্মসূচী (অ চৎড়মৎধসসব ভড়ৎ চৎড়মৎবংং)। এটি যুক্তি দেয় যে, দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাদের ভাঙ্গনের জন্য সমাজতন্ত্র হলো একমাত্র প্রতিকার, কিন্তু পুঁজিবাদের সংস্কারের জন্য স্বল্প মেয়াদে দরকার হ’ল একটি অন্তর্বর্তীকালীন কর্মসূচী, যেটি হবে রুজভেল্টের নয়া কর্মসূচীর (ঘবি উবধষ) অনুরূপ। তাঁর কর্মসূচীতে ছয়টি প্রধান দাবী অন্তর্ভুক্ত ছিল: পাবলিক এন্টারপ্রাইজের স¤প্রসারণ, ঋণ পুঁজিতে স্বল্প সুদের হার, বর্ধিত সামাজিক সেবা খাত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর্থিক ভাতাদি, এবং পুনর্বন্টিত করারোপণ (ৎবফরংঃৎরনঁঃরাব ঃধীধঃরড়হ)। তাছাড়া রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ব্যবস্থা এবং নধষধহপব ড়ভ ঢ়ধুসবহঃংএর কঠোর জন- নিয়ন্ত্রণ (ংঃৎরপঃ ঢ়ঁনষরপ পড়হঃৎড়ষ) থাকতে হবে।৮১ এই কর্মসূচী এতটাই ন্যূনতমবাদী (সরহরসধষরংঃ) ছিল যাতে করে ডানপন্থী এন্থনি ক্রসল্যান্ড বলতে পেরেছিলেন, ‘১৯৩৭এ লেবার পার্টি কর্তৃক প্রণীত কর্মসূচীর থেকেও এটি ছিল অতুলনীয়রূপে অধিকতর সাদামাটা’।৮২ জন স্ট্রেচি মার্কসের কিছু বিশ্লেষণকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সমাজকে অভিহিত করতেন ‘পুঁজিবাদী’ হিসেবে। কিন্তু এখন তিনি উপসংহার টানেন যে বেকারত্ব এবং সংকট হলো অতীতের বিষয়বস্তু। তিনি বলেন, গণতন্ত্র এবং কেইনস কর্তৃক আবি®কৃত সরকারের অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের টেকনিকগুলোর তাৎপর্য হলো এই যে এখন পুঁজিবাদ পরিকল্পিত।

ক্রসল্যান্ডও কেইনসিয় পদ্ধতিতে সংস্কারকৃত পুঁজিবাদ সম্পর্কে কাব্যিকভাবে খুবই উৎসাহী। তাঁর গ্রন্থ সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (ঞযব ঋঁঃঁৎব ড়ভ ঝড়পরধষরংস) ১৯৫৬তে প্রকাশিত হয়, এই গ্রন্থে তিনি যুক্তি দেন যে পুঁজিবাদের নৈরাজ্য অপসৃত হচ্ছে, এবং সুতরাং শ্রেণী সংঘর্ষসমূহও অপসৃত হচ্ছে। ব্যবস্থাটি আরো অধিকতরভাবে যৌক্তিক (ৎধঃরড়হধষ) ও গণতান্ত্রিক হচ্ছে। পুঁজিবাদ নিজেই শান্তিপূর্ণভাবে অপসৃত হবে। ক্রসল্যান্ডের অভিমত অনুসারে, মানবিক প্রয়োজন মেটানোর পরিবর্তে উৎপাদন বরং মুনাফা বানানোর জন্য উৎসর্গীকৃত, এই সমস্তই কেবলি পুরোদস্তুর আজেবাজে কথা। ‘ব্যক্তিগত শিল্প-কারখানা অবশেষে মানাবিকীকৃত হচ্ছে’।৮৩ একটি ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লব’ শুরু হয়েছে যাতে শ্রেণী সংঘর্ষ অচিন্তনীয়: ‘আজ কেউ ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সরকার ও নিয়োগকর্তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণাত্মক জোটের কথা চিন্তা করতে পরেনা,’ ক্রসল্যান্ড লেখেন।৮৪ ‘আমরা, ব্রিটেনে, গণ-প্রাচুর্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে’।৮৫

এখন কেইনসবাদ নিশ্চয়তা দিচ্ছে বাঁধাহীন প্রবৃদ্ধির, ক্রসল্যান্ড বলেন, রাষ্ট্র উচ্চ কর রাজস্বের দিকে নজর দিতে পারে যা সামাজিক সংস্কারসমূহ এবং সামাজিক কল্যাণ পরিকল্পনাতে অর্থ যোগাতে পারে। সমাজতন্ত্রীদের অর্থনৈতিক ইস্যুসমূহ থেকে তাঁদের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু কিসে?

. . . আমরা আমাদের মনোযোগ বর্ধিতভাবে নিবদ্ধ করবো অন্য কোনো কিছুতে এবং, শেষ পর্যন্ত, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে Ñ ব্যাক্তিক স্বাধীনতা, সুখ, এবং সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা, অবসর যাপন (পঁষঃরাধঃরড়হ ড়ভ ষবরংঁৎব), সৌন্দর্য, অনুগ্রহ (মৎধপব), প্রহর্ষ (মধরবঃু), আনন্দ (বীপরঃবসবহঃ). . . . .অধিকতর উম্মুক্ত  ক্যাফে, রাতে অধিকতর উজ্জল ও উচ্ছল রাজপথ, জন-ভবনসমূহের (ঢ়ঁনষরপ যড়ঁংবং) জন্য দেরীতে বন্ধের সময় (ষধঃবৎ পষড়ংরহম যড়ঁৎং), অধিক সংখ্যক স্থানীয় বৈচিত্রময় থিয়েটারসমূহ (ৎবঢ়বৎঃড়ৎু ঃযবধঃৎবং), অধিক সংখ্যক ভালো অতিথিবৎসল হোটেল মালিক ও রেস্টুরেন্ট মালিক. . . .জন-স্থানগুলোতে অধিক সংখ্যক ম্যুরাল ও চিত্র, আসবাবপত্র ও মৃৎশিল্প এবং মেয়েদের পোষাকের জন্য অধিকতর উৎকর্ষময় নকশা, নতুন আবাসন এস্টেটগুলোর কেন্দ্রে মূর্তিসমূহ, ভাল নকশাকৃত রাজপথের বাতিসমূহ এবং টেলিফোন কিওস্ক, এবং ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।৮৬

যদি যুদ্ধোত্তর তেজীভাবের তাৎক্ষণিক শর্তবালী দিয়ে মেন্ডেল ও হিলি ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হন, তবে কেইনসিয়পন্থীগণ ও পুঁজিবাদের অন্যান্য সাফাই গাইয়েবৃন্দ দীর্ঘ মেয়াদে ভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন হন বর্ধিত মাত্রায় গভীর ও অনিয়ন্ত্রিণীয় সংকটাবলী দিয়ে, যেগুলো ১৯৭০এর দশক থেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি উভয় অবস্থানসমূহের ফাঁদ পরিহার করে। এটি বেড়ে উঠে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্তে¡র বিকাশ থেকে। পশ্চিমা পুঁজিবাদে যুদ্ধোত্তর তেজীভাবের উপলব্ধির জট খুলতে রাশিয়াকে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কেনই বা এটা গুরুত্বপূর্ণ?

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের তত্ত¡ রাশিয়া ও পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যকার প্রতিযোগিতাকে চি‎িহ্নত করে প্রধান কৌশল হিসেবে, যেটি রাশিয়াতে পুঁজির সঞ্চয়নের গতি জোরদার করে। রাশিয়াতে অস্ত্র উৎপাদনও ব্যাখ্যা করে কেন এটা তেজীভাব ও মন্দার চক্র থেকে দুর্ভোগ পোহায় না। বিপরীতটাও সত্য Ñ লৌহ যবনিকার অপর পার্শ্বে এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়া সত্তে¡ও সামরিক ব্যয় উচু মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

১৯৪৮এর দলিল ‘স্তালিনিয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’এ একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম ‘ধ্বংসের উপায়ের উৎপাদন ও পরিভোগ’। অস্ত্র উৎপাদনের একটি অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য আছে। এটি নতুন উৎপাদন উপায়ের যোগান দেয় না (পুঁজিতে  মার্কসের পরিভাষা অনুসারে বিভাগ ১), অথবা শ্রমিকশ্রেণীর পরিভোগে কোনো অবদান রাখে না (বিভাগ ২ক)। সুতরাং, অস্ত্র শিল্প-কারখানার উৎপন্ন পণ্যাদি পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াতে পুনঃপ্রত্যাবর্তন (ভববফ নধপশ) করে না। এটি একটি অনুৎপাদনশীল ভোগের রূপ, যা পুঁজিপতি শ্রেণীর নিজেদের বিলাসদ্রব্যাদির ভোগের অনুরূপ (বিভাগ ২খ অথবা ৩)।৮৭

অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে ‘পুঁজিপতি শ্রেণীর যৌথ পরিভোগ’, এটি নিশ্চয়তা দেয় যে এই শ্রেণীটি সামরিক স¤প্রাসরণের মাধ্যমে ‘নতুন পুঁজি, সঞ্চয়নের নতুন সম্ভাবনাসমূহ পাবে’। সঞ্চয়নের নয়া সম্ভাবনাসমূহ অর্জনের সামর্থ পুঁজিপতি শ্রেনীর অন্যান্য পরিভোগ থেকে ‘ধ্বংসের উপায়ের উৎপাদন ও পরিভোগ’কে পৃথকায়িত করে।

‘স্তালিনীয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’ নিবন্ধে দেখানো হয়েছিল যে অস্ত্র উৎপাদনের স্থায়িত্বমূলক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে যে রুশ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে কেন বাজার অর্থনীতির তেজীভাব ও মন্দার ধ্রæপদী চক্রের অভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয় না।৮৮ উপরোক্ত বিশ্লেষণ হলো স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্তে¡র সঙ্গে সেতু-বন্ধন, যেটি বাজার পুঁজিবাদী দেশসমূহের অর্থনৈতিক স¤প্রসারণে সামরিক ব্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

মে, ১৯৫৭এ যুক্তিসমূহ আরো সুনির্দিষ্টায়িত হয় ‘স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতির জন্য সঠিক প্রেক্ষাপট’ শিরোনামের নিবন্ধে। এটিতে স্তালিনীয় রাশিয়ার অর্থনৈতিক গতিতে সামরিক ব্যয়ের ফলাফল এবং পাশ্চাত্য ও জাপানের পুঁজিবাদে সামরিক ব্যয়ের ফলাফলের ওপর নজর দেয়া হয়।৮৯ অস্ত্র ব্যয়ের প্রভাবকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয় না। সমাজের অর্থনৈতিক স্তর, এর উৎপাদিকা শক্তিসমূহ যে স্তরে পৌঁছেছে, তাই হলো সেনাবাহিনীর সংগঠনে সিদ্ধান্তিক নিয়ামক। মার্কস যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমাদের তত্ত¡ হলো এই যে শ্রমের সংগঠন শর্তায়িত হয় উৎপাদনের উপায় দিয়ে, এটি মনে হয় “মানবিক হত্যা শিল্প” এর মতন আর কোথাও চমৎকারভাবে প্রতিভাত হয়নি।’

পুঁজিবাদের প্রাথমিক সময়ে অর্থনীতির পশ্চাৎপদতাই অসম্ভব করে তুলেছিল বৃহদায়তন সেনাবাহিনীর পরিপালন ও সশস্ত্রকরণ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিয়োজিত সেনাবাহিনীসমূহের তুলনায় প্রথম দিকের উদীয়মান পুঁজিবাদের সেনাবাহিনীসমূহ ছিল ক্ষুদ্রায়তনের। এমনকি নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের সময়ে, ফ্রান্স, বাস্তবিকভাবে সমগ্র ইউরোপের শাসক শ্রেণীর কোনো সময়েই অর্ধ নিযুতের ওপর সৈন্য ছিল না। ঐ সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আয়তন ছিল ফরাসি সেনাবাহিনীর এক-দশমাংশ। ফ্রেডেরিক দি গ্রেট আঠারো শতকের যুদ্ধসমূহ সম্পর্কে ঘোষণা দেন, ‘শান্তিকামী নাগরিক যেন লক্ষ্য না করে যে দেশ যুদ্ধে নিরত’।৯০ এমনটি ঊনিশ শতকের যুদ্ধসমূহের সময়ে, নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহ, আফিম যুদ্ধসমূহ, ক্রিমিয় যুদ্ধ ইত্যাদিতে যুদ্ধরত জাতিসমূহের জীবন সামগ্রিকভাবে কদাচিৎ প্রভাবিত হয়েছিল।     



১৯১৪ Ñ ক্রান্তি সময়


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে এই সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন ফ্রান্সের জনসংখ্যা নেপোলিয়োনিয় সময়ের চেয়ে মাত্র দশ মিলিয়ন বেশী ছিল (ত্রিশ মিলিয়নের বিপরীতে চল্লিশ মিলিয়ন), কিন্তু দেশটি পাঁচ মিলিয়ন সৈন্য সমবেত করেছিল। অন্যান্য যুদ্ধরত দেশগুলোও একইভাবে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল। সেনাবাহিনীর প্রচন্ড আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে সামরিক প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব ব্যয় বৃদ্ধি দেখা যায়। এই বিষয়গুলো একত্রে একটি পরিবর্তন আনে সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতিতে সামরিক খাতের ভূমিকাতে।

যুদ্ধ-সেবায় জনসংখ্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ নিয়োজিত থাকাতে এবং অর্থনীতির একটি বৃহদাংশ বিনিয়োগকৃত থাকায়, কেবলমাত্র যুদ্ধে জড়িত সৈন্যগণই নয়, সঙ্গে সঙ্গে শিল্প শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক ও কৃষক-জনতা ইত্যাদির নিযুত নিযুত সংখ্যার ওপর, প্রকৃত পক্ষে, সমগ্র বেসামরিক জনগণের ওপর এটির প্রভাব অনুভূত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে, যদিও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ যুদ্ধের জন্য কিছুটা পর্যায় পর্যন্ত প্রস্তুত ছিল, কিন্তু অর্থনীতি কদাচিৎ অস্ত্র উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। নানা ধরণের যুদ্ধের পর এটা প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় যে বন্দুক অথবা মাখনÑ এই ধরণের বিপরীতমূখী অবস্থার সঙ্গে পেরে উঠতে শাসক শ্রেণী সিদ্ধান্ত নেয়।

সুতরাং, যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির দিকে যথেষ্ট নজর না দিয়েও, ১৯১৪ পর্যন্ত পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ সম্ভব ছিল, যেহেতু সেগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে গৌণ ভূমিকা পালন করতো। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ঠিক পরেই অর্থনীতির সামরিক খাতের গুরুত্ব আবার হ্রাস পায়। সেনাবাহিনীর আয়তন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস করা হয়, অস্ত্র উৎপাদন জোরালোভাবে কাঁট-ছাট করা হয়।

যাহোক, ১৯৩০এর দশকের মহামন্দা এবং হিটলারের ক্ষমতায় আরোহণের পেছনে পেছনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতন শান্তিপূর্ণ সময়ে ক্ষমতাশালী সামরিক খাত দৃশ্যমান হয়। ১৯৩৯ ও ১৯৪৪এর মধ্যে যুদ্ধোপকরণের উৎপাদন জার্মানিতে পাঁচ গুণ, জাপানে দশ গুণ, ব্রিটেনে পঁচিশ গুণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশ গুণ বৃদ্ধি পায়।৯১             

যুদ্ধ অর্থনীতি


  

জার্মানী

(বিলিয়ন মার্ক)
  

ব্রিটেন

(মিলিয়ন পাউন্ড)
  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

(মিলিয়ন ডলার)


  

১৯৩৯
  

১৯৪৩
  

১৯৩৮
  

১৯৪৩
  

১৯৩৯-১৯৪০
  

১৯৪৪-১৯৪৫

সরকারী ব্যয়**(এঊ)
  

৬০.০*
  

১০০.০*
  

১.০
  

৫.৮
  

১৬.০
  

৯৫.৩

জাতীয় আয় (ঘও)
  

৮৮.০*
  

১২৫.০*
  

৫.২
  

৯.৫
  

৮৮.৬*
  

১৮৬.৬*

এঊ/ঘও
  

৬৮%
  

৮০%
  

১৯.২%
  

৬১.১%
  

১৮%
  

৫১%

*অনুমানমূলক চিত্র

** প্রধানত অস্ত্র ব্যয়

অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রায় দেড় দশক ব্যাপী কোন অগ্রসর দেশে আপেক্ষিকভাবে কোনো বৃহদায়তনের যুদ্ধ খাত ছিল না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এরকম কোনো বিরতি ছিল না। এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই অস্ত্র প্রতিযোগিতা আবার শুরু হয়।


অস্ত্র, তেজীভাব ও মন্দা


পূর্বে, এক শতকেরও বেশী সময়ের জন্য, পুঁজিবাদকে উন্নতি এবং মন্দার ছান্দিক চক্রের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। মন্দা দেখা দিত মোটামুটি নিয়মিতভাবে প্রতি দশ বছরে। কিন্তু স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির অভ্যাগম থেকে চক্রটি কোনো না কোনোভাবে ভেঙ্গে  পড়ে। এটি কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল বুঝতে জাতীয় অর্থনীতির কম-বেশী শতকরা দশ ভাগ সামরিক খাত কীভাবে সার্বিক মন্দাকে প্রতিহত করতে পারে বুঝতে হলে, প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে  ধ্রæপদী পুঁজিবাদের অধীনে মন্দার কারণসমূহের সার-সংক্ষেপ করতে হবে।

অতিউৎপাদনের পুঁজিবাদী সংকটসমূহের মৌলিক কারণ হলো শিল্প-কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় জনগণের আপেক্ষিক নিম্ন ক্রয় ক্ষমতা। মার্কস যেমনটি বলেন:

উৎপাদিকা শক্তিসমূহের উন্নয়নে পুঁজিবাদী উৎপাদনের প্রণোদনার বিপরীতে, সবসময় প্রকৃত সংকটসমূহের জন্য চুড়ান্ত কারণ হলো দারিদ্য্র এবং জনগণের সীমিত পরিভোগ। যদিও কেবলমাত্র সমাজের চরম পরিভোগের ক্ষমতা তাদের সীমাবদ্ধতাসমূহ তৈরী করে।৯২

চুড়ান্ত বিশ্লেষণে, পুঁজিবাদী সংকটের কারণ হলো এই যে সমাজের আয়ের সিংহ ভাগ পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে জমা হয়, এবং এর সিংহ ভাগ পরিভোগের উপায় ক্রয়ের পরিবর্তে উৎপাদনের উপায় ক্রয়ে ব্যয় হয়, অর্থাৎ এটি পুঁজির সঞ্চয়নের দিকে ধাবিত, জাতীয় আয়ের অংশে আপেক্ষিক বৃদ্ধি পরিভোগের দিকে ধাবিত অংশের তুলনায়, অতি-উৎপাদনের দিকে পরিচালিত হয়, এটি এমন একটি অবস্থা যাতে তৈরীকৃত দ্রব্যাদি বিক্রয় হয়না, ভোক্তাদের সেগুলো ক্রয়ের জন্য কোন উপায় থাকে না।

এটি একটি ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া। সঞ্চয়ন বৃদ্ধির সহযোগী হল কল-কারখানার পুনর্গঠন এবং প্রাযুক্তিক আবিষ্কার, এর ফলে শোষণের বর্ধিত মাত্রা দেখা যায়। শোষণের মাত্রা যত গভীর হয়, শ্রমিক শ্রেণীর মজুরী এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর রাজস্বের তুলনায় সঞ্চয়নের তহবিলও গভীর হয়। সঞ্চয়ন সঞ্চয়নের জন্ম দেয়।


অস্ত্র বাজেটের প্রতিক্রিয়া


যুদ্ধের পরে বিশাল সামরিক ব্যয় সংকটের প্রবণতায় প্রভাব ফেলে। বর্তমানে অস্ত্র অর্থনীতির বিশাল প্রভাব বিদ্যমান জনগণের ক্রয় ক্ষমতার স্তরে, প্রকৃত পুঁজি সঞ্চয়নের স্তরে, এবং বাজার অন্বেষণে পণ্যদ্রব্যের পরিমাণে ।

যাক কোন এক দেশে চাকুরি অন্বেষণ করছে এক নিযুত মানুষ, এবং তাদের মধ্য থেকে শতকরা দশ জন অর্থাৎ ১০০,০০০ জন সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেল অস্ত্র-নির্মাণ কারখানাতে। তাদের ক্রয়-ক্ষমতা অন্য কোন জায়গায় আরো অধিক মানুষজনের কর্ম-সংস্থান করে। কেইনস প্রথম গ্রæপের আকার ও দ্বিতীয় গ্রæপের আকারের মধ্যেকার সাংখ্যিক সম্পর্ককে ‘সঁষঃরঢ়ষরবৎ’ বলে অভিহিত করেন। সংক্ষিপ্ততার জন্য এই পদটিকে সার্থকভাবে ধার করা যেতে পারে, এবং যদি সঁষঃরঢ়ষরবৎ দুই হয় তবে রাষ্ট্র কর্তৃক ১০০,০০০ জন শ্রমিকের কর্মস্থানে ২০০,০০০ জনের সাধারণ কর্ম-সংস্থান বৃদ্ধি পায়। যদি তিন হয়, তাহলে বৃদ্ধি হবে ৩০০,০০০ জন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে জাতীয় আয়ের শতকরা দশ ভাগ অস্ত্র বাজেটে বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান ফলাফল (পঁসঁষধঃরাব বভভবপঃ) জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এর পরিমাণের অনুপাতকেও সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

আবার, যখন জাতীয় আয়ের শতকরা দশ ভাগ অস্ত্রখাতে যায়, তখন শান্তিপূর্ণ সময়ের উৎপাদনে বিনিয়োগকৃত পুঁজির উৎসাবলী মারাত্মকভাবে কাটছাট করা হয়: আমাদের উদাহরণে, জাতীয় আয়ের শতকরা বিশ ভাগ থেকে শতকরা দশ ভাগ। অস্ত্র, সেনা পোষাক, ব্যারাক প্রভৃতির জন্য নয়া রাষ্ট্রীয় চাহিদাসহ, জনগণের বর্ধিষ্ণু ক্রয় ক্ষমতা বিক্রয়ের অধিকতর সুযোগ করে দেয় এবং অতি-উৎপাদনের সংকটাবলীকে ঠেকিয়ে রাখে।

অধিকন্তু, একটি যুদ্ধ অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই বেসামরিক ক্রেতাদের জন্য অসামরিক দ্রব্যাদির সরবরাহ বৃদ্ধির হারে একটি বিশাল প্রভাব ফেলে। পূর্ণ কর্মসংস্থান কেবলমাত্র মজুরি ভোগী মানুষের সার্বিক সংখ্যাই বৃদ্ধি করে না, এটি শ্রম বাজারে আঁটশাঁট (ঃরমযঃহবংং) অবস্থার কারণ ঘটায়, যা উচচতর মজুরি অর্জনে শ্রমিকদের সামর্থ্য যোগায়। আপাত স্ববিরোধী হলেও, এটি মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে না: অন্য অবস্থা থেকে পুঁজি অধিকতর পূর্ণভাবে কাজ করছে; অলস ক্ষমতা (রফষব পধঢ়ধপরঃু) অথবা ক্ষতিতে নিয়োজিত পুঁজির কমই বিদ্যমান আছে। এর লেনদেন বৃহত্তর। এইভাবে, উদহারণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৩৭-৪২ এর বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকারখানাগুলোতে সর্বমোট মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা ৭০ ভাগ, মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা ৪০০ ভাগ!

সমাজে বৃহদায়তনের উৎপাদিকা শক্তির উপস্থিতিতে, যুদ্ধোপকরণে ব্যয় বৃদ্ধি প্রয়োজনগতভাবে বেসামরিক পরিভোগের হ্রাস ঘটায় নি, বরং তার বিপরীতটাই ঘটেছিল। এটি সুস্পষ্টভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গিয়েছিল। ১৯৪৩এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে ৮৩.৭ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অংক ব্যয় করলেও, বেসামরিক পরিভোগ হ্রাস পায়নি, বরং যুদ্ধ পূর্বাবস্থার থেকে প্রকৃতপক্ষে বেশী ছিল। এটি ১৯৩৯এর ৬১.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৯৪৩এ দাড়ায় ৭০.৮ বিলিয়ন ডলার (১৯৩৯এর মূল্য সূচকে প্রকাশিত)। এই বৃদ্ধি ছিল শতকরা ১৪.৭।

স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্ত¡ দেখায় যে কেন ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এটি তার থেকেও বেশী করেছিল। এটি দেখিয়েছিল যে নিয়ক্লিয় বোমার মোচার শীর্ষে অর্থনৈতিক উন্নতি স্থায়ী ও নিরাপদ হতে পারে না। এমনকি যখন বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র সমৃদ্ধ ছিল, তখনও সামরিক ব্যয়ভারের ফলে, সকল দেশই একই ভাবে উচ্চ সামরিক বাজেটের বোঝা বহন করতে পারেনি। যারা সামান্য ব্যয় করেছিল, তারা লাভবান হয়েছিল এর সামরিক ব্যয়ের বিপরীত অনুপাতে। রাশিয়ার ওপর ১৯৪৮এর দলিলে যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে সাধারণভাবে পুঁজিতন্ত্র কেবলমাত্র অস্থায়ী স্থিতিশীলতার অভিজ্ঞতা লাভ করছিল। এটিতে বলা হয়েছিল:

. . . বিশ্ববাজারে শক্তিগুলো খুবই তীব্রভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে যাতে, প্রত্যেকে সামরিক ব্যয় কাটছাট করতে পারে তার অবস্থান শক্তিশালীকরণে। আমরা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করছি জার্মানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, এবং তার আন্তর্জাতিক ব্যালান্স অব পেমেন্টসের অবনতির জন্য, ব্রিটেন বাধ্য হচ্ছে  তার ‘প্রতিরক্ষা বাজেট’ কাটছাট করতে। এখন পর্যন্ত কোনো দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে সমর্থ হয়নি, তাকে বাধ্য করতে পারেনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা পরিত্যাগকরণে এবং প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারেনি ‘কে সামরিক বাজেট দ্রæততম গতিতে সংকুচিত করবে’। তার দুনিয়াতে বৃহত্তম সামরিক বাজেটের  এবং শিল্পে বৃহত্তম ও নিরুঙ্কুশ বিনিয়োগের সামর্থ রয়েছে।৯৩

যদিও দলিলটি অনুমান করে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার অসম বোঝা অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করবে, কিন্তু ভুলভাবে এটি দেখায় যে রাশিয়া হবে বিজয়ী:

. . . রুশ শিল্পের বিশাল অগ্রযাত্রায়, এটি সম্ভব যে আর দশ বা বিশ বছরে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পের চরম মাত্রায় না পৌঁছালেও, কমপক্ষে বিশ্ব বাজারে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত ভারী শিল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। তখন বিশ্ব বাজারে পরাজয় ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র . . . প্রতিরক্ষা বাজেট হ্রাস করতে পারে।৯৪

তারপরেও মৌলিক যুক্তি সঠিক ছিল:

অতি-উৎপাদনের উপশম, পুঁজিবাদী উন্নতির সুস্থিতিকারক হিসেবে যুদ্ধ অর্থনীতি খুব কমই সেবা করতে পারে। যখন যুদ্ধ অর্থনীতি ব্যয়বহুল হয়ে যায়, তখন পুঁজিবাদী তেজীভাবের মৃত্যুঘন্টা নিশ্চিতই বাজবে।৯৫

প্রকৃতপক্ষে এটি রাশিয়া নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এর সামরিক বাজেট হ্রাসে বাধ্য করেছিল, বরং প্রাথমিকভাবে পশ্চিম জার্মানি ও জাপানই বাধ্য করেছিল, এই দুটি দেশের বিশাল সেনাবাহিনী পরিপোষণ নিষেধ ছিল, কারণ তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিল। তা সত্তে¡ও, সামরিক ব্যয়ের মাধ্যমে বাজার পুঁজিবাদের অস্থায়ী সুস্থিতিকরণ খুবই অস্থায়ী, ‘স্তালিনিয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’ পুস্তকটির এই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল। বাস্তবিকই, উৎপাদনশীল বিনিয়োগ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য সরিয়ে দিয়ে এটি মন্দা প্রতিরোধে প্রবণতা দেখায় স্থবিরতার দিকে দীর্ঘ মেয়াদি প্রবণতার মূল্যে। সামরিক ব্যয়ের উচ্চ স্তরসহ ঐ অর্থনীতিসমূহ নিজেদের দেখতে পায় একটি প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় এবং বেসামরিক শিল্পকারখানায় বিনিয়োগের অংশ বৃদ্ধিকরণে বাধ্য হয়। এটি ধ্রæপদী ব্যবসায় চক্রের প্রবণতাসমূহের অনুমোদন দেয় তাদের পুনরায় আত্মবিশ্বাস প্রদর্শনে।৯৬

একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে জাপান ও পশ্চিম জার্মানি এর মধ্যকার ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈরিতা তীক্ষèতর হয় সামরিক ব্যয়ের অসম বন্টনে, এটি অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করে এবং বৈশ্বিক মন্দার প্রত্যাবর্তন ঘটায়। কয়েক বছর পরে বিশ্ব অর্থনীতি হ্রাস পাবে, এই ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্যে পরিণত হয়েছে: বিশ্বউৎপাদন যেটি বার্ষিক ৫.৪% হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৯৫০-৬৩এর বছরগুলোতে, এবং ১৯৬৩-৭৩ এর সময়ে ৬%, ২.৬%এ  হ্রাস পেয়েছিল ১৯৭৩-৯০ এর বছরগুলোতে, এবং ১৯৯০-৯৬ এর বছরগুলোতে ১.৪%।৯৭

জাপান অথবা পশ্চিম জার্মানি অপেক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র খাতে এর জাতীয় আয়ের একটি অধিকতর বৃহত্তর অংশ ব্যয় করে। জাপান কখনো এর জাতীয় আয়ের ১% এর বেশী প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেনি। ফলে জাপান অধিকতর পুঁজি সঞ্চয়নে সমর্থ হয় এবং এর ফ্যাক্টরিগুলোর পুনঃযন্ত্রায়নে শিল্প-কারখানায় অধিক বিনিয়োগ করে। ফলাফল হলো এই যে জাপানিয় গাড়ি শিল্প খুব দ্রæত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। জাপানিয় জাহাজনির্মান শিল্প ব্রিটিশ শিল্পকে প্রতিস্থাপিত করে দুনিয়াতে প্রথম স্থানটি দখল করে, এবং ইলেকট্রনিকস শিল্পে জাপান জার্মানিকেও অতিক্রম করেছিল, যেটি এ যাবত পর্যন্ত প্রথম স্থান ধরে রেখেছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ জার্মানি ও জাপানের সাপেক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পের পশ্চাৎপদতাকে আরো খারাপের দিকে ধাবিত করেছিল। ফলাফল ছিল এই যে ১৯৭৩ এ ডলারের দুর্বলতা নিজেকে প্রকাশ করে ডলারে অভিহিত তেলের মূল্য বিস্ফোরণে। দীর্ঘ স্থায়ী তেজীভাবের সমাপ্তি ঘটে।

স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্ত¡ বলে যে পুঁজিবাদের অযৌক্তিকতা সিস্টেমের বুড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায় না। পুঁজিবাদ, মার্কসের ভাষায় যা সমগ্র ইতিহাসে রক্ত ও কর্দমে আবৃত, বৃদ্ধ বয়সে কল্যাণমূলক হবে না। ফলে স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি সিস্টেমের পশুত্ব ও বর্বরতার সবচেয়ে চরম প্রকাশ।৯৮


অধ্যায় চার

বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লব


তৃতীয় বিশ্বের বিকাশাবলী সম্পর্কিত আর একটি ইস্যু যা যুদ্ধোত্তর ত্রৎস্কিপন্থীগণের বুঝতে অসুবিধা হয়। ত্রৎস্কি কর্তৃক বিকশিত স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡ সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলায়ন এবং তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। বুর্জোয়া বিপ্লবের কাজসমূহ সম্পূর্ণকরণে সংগ্রামরত শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক এটি পরিচালিত হতে হবে এবং একই সময়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের দিকে ধাবিত করতে হবে। ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡ পর্যাপ্তভাবে তৃতীয় বিশ্বের তাৎপর্যমন্ডিত বিকাশাবলীর ব্যাখ্যা দেয়, কিন্তু এটি মাওয়ের চীন এবং ক্যাস্ত্রোর কিউবা দিয়ে তীক্ষèভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এই তত্ত¡টি কী প্রয়োগ করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হতো একটি “হাঁ’-ও না অথবা একটি “না”-ও না। এই দেশগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলী এবং ত্রৎস্কির তত্তে¡র মধ্যে অনেক কিছুই সার্বজনীন (পড়সসড়হ), কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সেখানে র‌্যাডিক্যাল  বৈসাদৃশ্যও (ফরাবৎমবহপব) বিদ্যমান। সুতরাং একটি তত্ত¡ সৃজনের প্রয়োজন দেখা দেয় যাতে উভয় দিক অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এটি ছিল বিক্ষেপিত (ফবভষবপঃবফ) স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡। 


মাওয়ের ক্ষমতায় আরোহণ

এর ‘কমিউনিস্ট’ মোড়ক সত্তে¡ও, ১৯৪৯এ জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাংদের ওপর মাওয়ের চীনা কমিউনিস্টদের বিজয়ে শিল্প শ্রমিকশ্রেণী কোনো ভূমিকাই পালন করেনি। এমনকি স্বয়ং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সামাজিক বিন্যাস ছিল সম্পূর্ণরূপে অশ্রমিকশ্রেণীয়। মাওয়ের পার্টির পদে আরোহণ মিলে যায় একটি সময়ের সঙ্গে যখন এটি আর শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ছিল না। ১৯২৬এর শেষের দিকে অন্ততঃ ৬৬% সদস্য ছিল শ্রমিক, অন্য ২২% ছিল বুদ্ধিজীবি এবং মাত্র ৫% ছিল কৃষক।৯৯ ১৯২৮এর নভেম্বর নাগাদ শ্রমিকদের শতকরা হার পাঁচ ভাগের চার ভাগ কমে মাত্র ১০% হয়। একটি অফিসিয়াল রিপোর্টে স্বীকার করা হয় যে পার্টির ‘শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে একটি একক শক্তিশালী পার্টি নিউক্লিয়াস নেই’।১০০ এক বছর পরে সদস্যদের মাত্র ৩% শ্রমিক ছিল এবং ১৯৩০এর শেষ নাগাদ এটি প্রায় শূন্য হয়ে যায়।১০১ তখন থেকে এবং মাওয়ের চুড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত পার্টিতে কোনো শিল্প শ্রমিক ছিল না বললেই চলে।

বেশ কয়েক বছর পার্টি কেন্দ্রীয় চীনের প্রদেশগুলোতে গভীরভাবে বিদ্রোহী কৃষক আন্দোলনে নিয়োজিত ছিল, যেখানে এটি একটি চীনা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিল; পরে ১৯৩৪এ কেন্দ্রীয় প্রদেশগুলোতে সামরিক পরাজয়ের পর এটি উত্তর-পশ্চিমে উত্তর শেনশিতে চলে যায়। এই উভয় অঞ্চলেই বলতে গেলে কোন শিল্প শ্রমিক ছিল না। একটি কমিনটার্ন মুখপাত্র মোটেই অতিশয়োক্তি করেনি যখন এটি লিখেছিল, ‘সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে সীমান্ত অঞ্চল ছিল চীনের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর একটি’।১০২ চুতে পুনরুক্তি করেন, ‘কমিউনিস্টদের পরিচালনাধীন অঞ্চলগুলো সমগ্র দেশের মধ্যে অর্থনেতিকভাবে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ ছিল’।১০৩ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বেশ কয়েক বছর কোনো একটি প্রকৃত শহর কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

মাওয়ের ক্ষমতায় আরোহণের সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতিতে শ্রমিকেরা এতটাই গুরুত্বহীন ছিলেন যে ১৯২৯এ একটি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে ১৯ বছর পর্যন্ত পার্টি ট্রেড ইউনিয়নসমূহের একটি জাতীয় কংগ্রেস আহŸানের কোনো প্রয়োজনই মনে করেনি। এটি শ্রমিকদের সমর্থন অন্বেষণে উদ্বিগ্ন ছিল না, যেমনটি এর ঘোষণায় দেখা যায় যে ১৯৩৭-৪৫এর সংকটময় বছরগুলোতে কুয়োমিন্টাং নিয়ন্ত্রিত এলাকাসমূহে এটি কোনো পার্টি সংগঠন বজায় রাখতে আগ্রহী ছিল না।১০৪ ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে যখন জাপান বিরোধী যুদ্ধ এগিয়ে চলছিল, তখন ধর্মঘটী শ্রমিক অথবা ধর্মঘটের জন্য প্ররোচনা দানকারী শ্রমিকদের জন্য কুয়োমিন্টাং সরকার মৃত্যুদন্ডের  ডিক্রী জারি করে, এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির একজন মুখপাত্র একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে বলেন যে সরকারের যুদ্ধ পরিচালনায় পার্টি ‘সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট’।১০৫ এমনকি কুয়োমিনটাং ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও, কুয়োমিনটাং অঞ্চলগুলোতে কদাচিৎ কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল, যেখানে দেশের সমস্ত শিল্প কেন্দ্রগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল।

শহরগুলোতে মাওয়ের বিজয় শিল্প শ্রমিক শ্রেণী থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ছাড়া আর সবকিছুই দৃষ্টিগোচর করে। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শহরগুলোতে যে কোনো শ্রমিক অভ্যুত্থান নিবৃতকরণে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন সেগুলো তাদের দখলে নেয়ার প্রাক্কালে। উদাহরণস্বরূপ, তিয়েনস্তিন (ঞরবহঃংরহ) ও বেইজিং পতনের পূর্বে পিপলস লিবারেশন আর্মির কমান্ডার জেনারেল লিন পিয়াও জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণাপত্র বিলি করেন:

. . . . শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং তাদের বর্তমান পেশাসমূহ চালিয়ে যেতে। প্রাদেশিক, নগর, কাউন্টি অথবা সরকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য  স্তরসমূহের কুয়োমিন্টাং ইউয়ান কর্মকর্তাগণ অথবা পুলিশ কর্মকর্তাগণ এবং জেলা, শহর, গ্রাম, অথবা পাউ চিয়া ( কুয়োমিনটাং নিরাপত্তা) সদস্যগণকে তাদের পদসমূহে অবস্থান করতে আদেশ করা হল।১০৬

ইয়াংঝে নদী অতিক্রমকালে, কেন্দ্রীয় চীন এবং দক্ষিণ চীনের বিশাল বিশাল নগরীসমূহ (সাংহাই, হ্যানকোও, ক্যান্টন) তাদের নিকট পদানত হওয়ার পূর্বে, মাও এবং চু তে এই ধরণের ঘোষণাপত্র ইস্যু করেন:

. . . সকল ব্যবসায়ে শ্রমিক-কর্মচারীগণ কাজ অব্যাহত রাখবেন . . . . কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক, পৌর অথবা কাউন্টি সরকারসমূহের নানা স্তরসমূহের কুয়োমিন্টাং কর্মকর্তাগণ, অথবা ‘ন্যাশনাল এসেম্বলি’র ডেলিগেটবৃন্দ, লেজি¯েøটিভ এবং কন্ট্রোল ইউয়ান এর সদস্যবৃন্দ অথবা গণ রাজনৈতিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, পুলিশ কর্মকর্তাগণ এবং পাউ চিয়া সংস্থার প্রধানগণ . . . তাদের পদসমূহে অবস্থান করবেন।১০৭

শ্রমিক শ্রেণী বিনীত থাকবে এবং নিষ্ক্রিয় থাকবে। পিপলস লিবারেশন আর্মি কর্তৃক নানকিং দখলের ঠিক দু’দিন পূর্বে ১৯৪৯এর ২২ এপ্রিলে নানকিং থেকে একটি রিপোর্টে অবস্থাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়:

নানকিংয়ের জনগণ উত্তেজনার কোনো চিহ্নই প্রদর্শন করছে না। কৌতুহলী জনতা নদীর তীরে এই সকালে সমবেত হচ্ছে নদীর অপর তীরে বন্দুক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণে। ব্যবসায়ও যথারীতি চলছে। কিছু দোকান বন্ধ, কিন্তু এটি ব্যবসায়ের অভাবে . . . . প্রেক্ষাগৃহগুলো তাদের প্রদর্শনীসমূহ চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে।


এক মাস পর নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা সাংহাই থেকে লেখেন, ‘লাল বাহিনী চীনা ভাষায়  পোস্টারসমূহ সেঁটে দিচ্ছে  যাতে জনতাকে শান্ত থাকতে বলা হচ্ছে এবং তাদের নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে এই মর্মে যে তাদের ভয়ের কোনো কিছু নেই’।১০৮ ক্যান্টনে ‘তাদের প্রবেশের পরে কমিউনিস্টগণ পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করে এবং অফিসার ও মানুষদের নির্দেশ দেয় তাদের পদে অবস্থান করে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে’।১০৯

ত্রৎস্কির যুক্তি ছিল এই যে বুর্জোয়া বিপ্লবের কাজসমূহ যেমন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে মুক্তি কেবলমাত্র অর্জিত হতে পারে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারা। এই যুক্তি চীনে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে না।


ক্যাস্ত্রোর বিপ্লব

কিউবাতে সংঘটিত বিকাশ আর একটি উদাহরণ যা ত্রৎস্কির দৃশ্যকল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এখানে শ্রমিক শ্রেণী কিংবা কৃষক শ্রেণী কেউই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। কাস্ত্রোর ক্ষমতারোহণে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিবৃন্দ সংগ্রামের সমগ্র ক্ষেত্রই পরিপূর্ণ করে রাখেন। সি. রাইট মিলস এর বই খরংঃবহ ণধহশবব একটি নির্ভরযোগ্য মনোলোগ যাতে কিউবার নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এটি সবার আগে বিপ্লব কী নয়, সেটি নিয়ে বিবেচনা করে:

. . . বিপ্লব স্বয়ং মজুরি শ্রমিক শ্রেনী ও পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যকার সংগ্রাম ছিল না। আমাদের বিপ্লব নগরীতে অবস্থিত শ্রমিক ইউনিয়নসমূহ অথবা মজুরি শ্রমিকগণ কর্তৃক সংঘটিত, অথবা লেবার পার্টিসমূহ অথবা এ রকম ধরণের একটা কিছু দ্বারা সংঘটিত বিপ্লব নয়। . . .  নগরীস্থ মজুরি শ্রমিকগণ যে কোনো বিপ্লবী পথের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না; তাদের ইউনিয়নসমূহ আপনাদের উত্তর আমেরিকান ইউনিয়নসমূহের মতই: অর্থ ও অধিকতর ভাল অবস্থার জন্য সংগ্রামরত। তাই সবকিছু যা প্রকৃতপক্ষে তাদের পরিচালিত করে। এবং কিছু কিছু এমনকি আপনাদের কিছু থেকে অধিকতর দুর্নীতি পরায়ন।১১০

কিউবান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পরে ক্যাস্ত্রোর নির্বিচার সমর্থক পল ব্যারন লিখেন:

এটা প্রতীয়মান যে শিল্প শ্রমিক শ্রেণীর কর্মরত অংশ সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী সময় কালে নিষ্ক্রিয় ছিল। এই শ্রমিকেরা কিউবান প্রোলেতারিয়েতের ‘অভিজাত’ স্তর গঠন করে, এরা বিদেশী ও অভ্যন্তরীণ একচেটিয়া ব্যবসায়ের মুনাফার ভাগীদার হয়, লাতিন আমেরিকার মান অনুসারে এরা সচ্ছল, এবং কিউবান সাধারণ জনগণের চেয়ে উচ্চতর জীবনযাত্রার মান উপভোগ করে। শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সম্পূর্ণভাবে আধিপত্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টাইলে “ব্যবসায়  ইউনিয়নিজম”, এবং অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের ফন্দিফিকির (ৎধপশবঃববৎরহম) ও দস্যুতা (মধহমংঃবৎরংস) দিয়ে এটি ঠাসা।১১১

অভ্যুত্থান শুরুর মোটামুটি ষোল মাস পরে এবং কিউবান একনায়ক বাতিস্তার পতনের আট মাস পূর্বে ১৯৫৮এর ৯ এপ্রিল ক্যাস্ত্রো কর্তৃক আহŸানকৃত সাধারণ ধর্মঘট সম্পূর্ণ ব্যর্থতার কারণ ছিল শিল্প-প্রলেতারিতের অনীহা। শ্রমিকেরা ছিল উদাসীন; এবং কমিউনিস্টরা এটিতে অন্তরায় তৈরী করেছিল। এটা কেবলমাত্র কিছু দিন পরে যে তারা ক্যাস্ত্রোর ব্যান্ডওয়াগনে সামিল হয়েছিল।১১২

ক্যাস্ত্রোর উত্থানে কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীই অসম্পৃক্ত ছিল তাই নয়, কৃষক জনগণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ১৯৫৮এর এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাস্ত্রোর অধীনে সশস্ত্র যোদ্ধা ছিল মাত্র ১৮০ জন এবং বাতিস্তার পতনের সময়ে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৮০৩এ।১১৩ ক্যাস্ত্রো ব্যান্ডের ক্যাডারগণ ছিলেন বুদ্ধিজীবি। এবং যে ক্ষুদ্র সংখ্যক কৃষকেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা কৃষি মজুরি শ্রমিক ছিলেন না।  সিয়েরা মেইয়েস্ত্রাতে যে কৃষকেরা ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সম্পর্কে চে গুয়েভারা বলেন:

যে সৈনিকেরা আমাদের গ্রামীণ জনগণের প্রথম গেরিলা বাহিনী গঠন করেছিল তারা সেই সামাজিক শ্রেণী থেকে এসেছিল যারা তাদের ভালবাসা দেখিয়েছিল জমির অধিকারের প্রতি সবচেয়ে তীব্রভাবে, সেটি যে মানসিক দিকটিকে সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশ করেছিল তাকে পেটি বুর্জোয়া বলেই আখ্যায়িত করা যায়।১১৪

ক্যাস্ত্রোর আন্দোলন ছিল মধ্য শ্রেণীর। ১৯৫৬এর ডিসেম্বরে ক্যাস্ত্রোর অধীনে যে ৮২ জন মানুষ মেক্সিকো থেকে কিউবা আক্রমণ করেছিলেন এবং যে ১২ জন সিয়েরা মেইয়েস্ত্রার যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের সবাই এই শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। ‘প্রধাণত মধ্য শ্রেণীর নগর প্রতিরোধ আন্দোলন দিয়েই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, এটি রাজনৈতিক ও মানসিক এসিড তৈরী করেছিল যা বাতিস্তার যুদ্ধ শক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু করেছিল’।১১৫

বৈশিষ্ট্যগতভাবে কিউবান আন্দোলনের জন্য, চে গুয়েভারা জোর দেন যে সকল ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শিল্প শ্রমিক শ্রেণী অপ্রাসঙ্গিক হবে:

নিজেদের ধরণে তৈরী একটি সেনাবাহিনীসহ পধসঢ়বংরহড়ং সংগ্রাম করছে তাদের নিজেদের মহান লক্ষ্যাবলীর জন্য, প্রাথমিকভাবে জমির ন্যায়ানুগ বন্টনের জন্য, এরা গ্রাম থেকে শহর দখল করবে . . . . ক্ষমতা দখলের জন্য বিষয়ীগত (ংঁনলবপঃরাব) অবস্থা

যুদ্ধোত্তর সামাজিক রূপান্তরণে, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় শ্রমিক শ্রেণী কখনো সহযোগী ভূমিকার চেয়ে বেশী দায়িত্ব পালন করেনি, এবং এমনকি যেখানে এই শ্রেণী উপস্থিত ছিল, সেখানেও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের জন্য ধাবিত একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে কাজ করেনি, যেমনটি ১৯১৭এ রাশিয়াতে হয়েছিল। সুতরাং অভ্যন্তরীণ পশ্চাৎপদ সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কাবলীর অতিক্রমণ প্রক্রিয়াসমূহ এবং সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল থেকে জাতীয় মুক্তি অর্জন এই বিষয়গুলো পুরোভাগে নিয়ে এসেছিলেন  প্রধাণত বুদ্ধিজীবি স¤প্রদায় অথবা রাষ্ট্র থেকে আগত নানা ধরনের শক্তিসমূহ, ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্তে¡ এই দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি। আফ্রিকাতে, এশিয়াতে ও ল্যাটিন আমেরিকাতে ফলাফল বৈচিত্রায়িত হলেও কমবেশী স্থায়ী রাষ্ট্রিয় পুঁজিবাদ ছিল বিরাজিত ফলাফল।

ত্রৎস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্তে¡ কী ভ্রান্তি ছিল?

ত্রৎস্কির তত্তে¡র মৌল বিষয়গুলোকে ছয়টি দফায় সার-সংক্ষেপ করা যেতে পারে:

(১) পুঁজিতান্ত্রিক দৃশ্যপটে দেরীতে আসা বুর্জোয়াজী মৌলিকভাবে এর এক শতক বা দুই শতক পূর্বসূরী থেকে পৃথক। সামন্ততন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতনে সৃষ্ট সমস্যাবলীর সঙ্গতিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, বৈপ্লবিক সমাধানে এটি অক্ষম। এটি সামন্ততন্ত্রের সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধন, প্রকৃত জাতীয় স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্জনে অক্ষম। অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ দেশ নির্বিশেষে এটি বিপ্লবী হতে অক্ষম। এটি চরমভাবে একটি রক্ষণশীল শক্তি।

(২) সিদ্ধান্তিক বিপ্লবী ভূমিকা প্রোলেতারিয়েতের ওপর ন্যস্ত, যদিও এটি খুবই তরুণ এবং সংখ্যায় ছোট।

(৩) স্বাধীন কার্যক্রমে অক্ষম কৃষকশ্রেণী শহরকে অনুসরণ করবে, এবং প্রথম দু’টি দফা অনুসারে অবশ্যি শিল্প প্রোলেতারিয়েতের নেতৃত্বকে অনুসরণ করবে।

(৪) কৃষি প্রশ্ন এবং জাতীয় সমস্যার সঙ্গতিপূর্ণ সমাধান, দ্রæত অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধাদানকারী সামাজিক ও রাজতান্ত্রিক জোয়ালসমূহের ছিন্নকরণ প্রয়োজনীয় করে তুলবে বুর্জোয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমানা ছাড়িয়ে যেতে। ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব দ্রæতই বিকশিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে ধাবিত হবে, এবং এইভাবে স্থায়ী বিপ্লবে পরিণত হবে’।১১৭

(৫) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্পূর্ণকরণ ‘জাতীয় সীমানার ভেতরে অচিন্তনীয় . . .। এইভাবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব স্থায়ী বিপ্লবে পরিণত হয়, শব্দটির নয়া ও বিস্তৃত অর্থে; এটি সম্পূর্ণতা পায় কেবলমাত্র আমাদের সমগ্র গ্রহে নয়া সমাজের চুড়ান্ত বিজয়ে’।১১৮ ‘একদেশে সমাজতন্ত্র’এর চেষ্টা এবং অর্জন হচ্ছে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও সংকীর্ণ স্বপ্ন।

(৬) ফলে পশ্চাৎপদ দেশসমূহের বিপ্লব অগ্রসর দেশসমূহে তীব্র আলোড়ন তুলবে।

            যখন দেরীতে বিকাশমান (ফবাবষড়ঢ়রহম) বুর্জোয়াশ্রেণীর রক্ষণশীল, ভীতু স্বভাব (ত্রৎস্কির প্রথম দফা) একটি চরম সত্য, তখন তরুণ শ্রমিকশ্রেনীর বিপ্লবী চরিত্র (ত্রৎস্কির দ্বিতীয় দফা) চরম সত্য বা অনিবার্যও নয়। যদি শ্রমিকশ্রেণী প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী না হয়, সেই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফা থেকে পঞ্চম দফা বাস্তবায়িত হবে না।

ত্রৎস্কির তত্তে¡র কেন্দ্রীয় স্তম্ভ শ্রমিকশ্রেণীর অনমনীয় বিপ্লবী চরিত্রে আশংকা করলে সমগ্র কাঠামোই টুকরো টুকারো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর তৃতীয় দফা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ কৃষকশ্রেণী অবিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীকে অনুসরণ করতে পারে না, এবং অন্যান্য সব উপাদানসমূহ একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কোনো কিছু আদৌ ঘটে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতসমূহের সংগ্রন্থন উৎপাদিকা শক্তিসমূহকে সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের সঙ্গে সংঘর্ষে নিয়ে আসে। কৃষক বিদ্রোহসমূহের সূত্রপাত ঘটে পূর্বের থেকে গভীরতর ও প্রশস্থতর গতিতে। তাতে প্রোথিত থাকে উচ্চতর জীবনযাত্রার মানের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক অর্থনৈতিক ধ্বংসের বিরুদ্ধে জাতীয় বিদ্রোহ। ফলাফল হলো এক ধরণের রূপান্তর যাতে অন্তুর্ভুক্ত থাকে স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত¡, কিন্তু  র‌্যাডিক্যালভাবে এটি থেকে ভিন্নভাবে। এটিকে আমরা বলি বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লব (ফবভষবপঃবফ ঢ়বৎসধহবহঃ ৎবাড়ষঁঃরড়হ)। এই তত্ত¡টি ১৯৬৩তে প্রথম বিস্তৃত পরিসরে উপস্থাপন করা হয়।১১৯

আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের দু’টি প্রধান শ্রেণী হলো পুঁজিপতি শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণী, এরা যদি প্রধান ভুমিকা পালন না করে, তার কারণ হলো একটি রক্ষণশীল শক্তিতে পরিণত হয়েছে, অপরটি এর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত স্তালিনবাদ বা সংশোধনবাদ দিয়ে। কীভাবে এই প্রধান প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হ’ল? ভুস্বামীতন্ত্র (ষধহফষড়ৎফরংস) এবং সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল ভাঙ্গতে উৎপাদিকা শক্তিসমূহের প্রণোদনা এবং কৃষক শ্রেণীর বিদ্রোহী আচরণ যথেষ্ট নয়। অন্য চারটি নিয়ামক সহায়তা করে:

(১) দু’টি পরাশক্তির বøকদ্বয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্ব›েদ্ব বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রত্যেকে হাইড্রোজেন বোমার অস্তিত্বের জন্য অসহায় বোধ করে। একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির ভয়ে এটি আংশিকভাবে তৃতীয় বিশ্বে তাদের হস্তক্ষেপের সামর্থ্যকে সীমিত করে।

(২) পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে রাষ্ট্রের গুরুত্বের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি।  এটি ইতিহাসের পরিসহাসগুলোর একটি যে যখন সমাজ একটি ঐতিহাসিক কর্তব্যের (ঃধংশ) সম্মুখীন হয়, এবং ঐতিহাসিকভাবে নিষ্পন্নকারী শ্রেণীটি অনুপস্থিত থাকে, তখন প্রায়ই জনগণের অন্য কোনো গোষ্ঠী রাষ্ট্র-ক্ষমতা হিসেবে সংগঠিত হয় এবং এটি বাস্তবায়িত করে। এই ধরণের অবস্থাধীনে রাষ্ট্র-ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটি কেবলমাত্র, অথবা এমনকি প্রধানত জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিকেই প্রতিফলিত করে না, যাতে এটির উত্থান ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে এটি বিশ্ব-অর্থনীতির পরা-জাতীয় আশুকর্তব্যসমূহকে (ংঁঢ়ৎধ-হধঃরড়হধষ রসঢ়বৎধঃরাবং) প্রতিফলিত করে।

(৩) স্তালিনবাদ ও সংস্কারবাদের প্রভাব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে ভিন্ন খাতে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনসমূহকে বিচ্যুত করে। প্রায়ই শ্রমিকশ্রেণীর মাঝে প্রভাবশালী কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ, অথবা অনুরূপ আন্দোলনসমূহ তাদের প্রচেষ্টাসমূহ অব্যাহত রাখে অন্য শ্রেণী স্বার্থসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী স্থানীয় শক্তিসমূহের সঙ্গে সহযোগিতায় এবং উৎসাহদানে।

(৪) জাতির নেতা এবং ঐক্যবদ্ধকারী (ঁহরভরবৎ) এবং সর্বোপরি জনগণের পরিচালনাকারী (সধহরঢ়ঁষধঃড়ৎ) হিসেবে বুদ্ধিজীবিশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। এই শেষ দফাটির বিশেষ ব্যাখ্যা দরকার।

যে জনগণের মধ্য থেকে এদের উত্থান ঘটে, বিপ্লবী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর নেতৃস্থানীয় ভুমিকা সেই জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সাধারণ পশ্চাৎপদতার সঙ্গে সরাসরি সমানুপাতিক। এটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যে রুশ পপুলিস্ট আন্দোলন অন্য যে কারুর থেকে সমাজের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অংশ কৃষকশ্রেণীর বিপ্লবায়নের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করতো।

‘বিশ্লেষণাত্মক চিন্তন প্রক্রিয়া’র (পৎরঃরপধষ ঃযরহশরহম) নিয়ন্ত্রক বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ওপর সবচেয়ে গুরুত্বারোপকারী গ্রæপটি হল রুশ পপুলিস্ট আন্দোলন। জারতান্ত্রিক রাশিয়ার তুলনায় উত্থানশীল যুদ্ধোত্তর জাতিসমূহে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবি শ্রেণী নিজেদের একটি অধিকতর সংহতকারী শক্তি হিসেবে প্রমাণ করে। দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যক্তিক সম্পত্তি অবস্থার রূপান্তর দুর্বল হওয়ায়, এবং সাম্রাজ্যবাদের ভার অসহনীয় অনুভূত হওয়ায়, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকেই সমাধান বলে প্রতীয়মান হয়। সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলায়ন, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব, রাশিয়ার উদাহরণ, এবং কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ কাজকর্ম, এই বিষয়গুলো বুদ্ধিজীবি শ্রেণীকে একটি সংহতকর কর্মসূচী দেয়। সমাজের একমাত্র অবিশেষায়িত অংশ হিসেবে (কারণ উৎপাদন সম্পর্কের ভেতরে এটি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী ভুমিকাতে আবদ্ধ থাকে না।) বুদ্ধিজীবি শ্রেণী হলো ‘পেশাদার বিপ্লবী এলিট’এর উৎস এবং একই সাথে সংঘাতময় গোষ্ঠীগত (ংবপঃরড়হধষ) ও শ্রেণী স্বার্থসমূহের বিপরীতে ‘জাতি’ স্বার্থসমূহের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতীয়মান। অধিকন্তু, এটি হলো সমাজের সেই অংশ যারা জাতীয় সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত, যেটির জন্য কৃষকশ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর অবসর বা শিক্ষা কোনোটিই নেই।

বুদ্ধিজীবিশ্রেণী তাঁদের দেশসমূহের প্রাযুক্তিক ঘাটতিতেও সংবেদনশীল। বিশ শতকের বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক জগতে অংশগ্রহণে তাঁরা তাঁদের নিজেদের জাতির পশ্চাৎপদতায় কষ্টবোধ করে। এই অনুভূতি গুরুত্ব পায় এই দেশগুলোতে মহামারিরূপে দেখা দেয়া ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বেকারত্ব’ দ্বারা। সাধারণ অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতায়, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র ভরসা সরকারি চাকুরি, কিন্তু সবার ভাগে পড়তে পারে এমন সংখ্যা খুবই কম।১২০

বুদ্ধিজীবিদের আত্মিক জীবনও সংকটগ্রস্থ। ভেঙ্গে পড়া শৃঙ্খলায় যেখানে ঐতিহ্যিক প্যাটার্নটি ভেঙ্গে পড়ছে, সেখানে তাঁরা অনিরাপদ, ভিত্তিহীন, দৃঢ় মূল্যবোধের অভাব অনুভব করে। দ্রবীভূত সংস্কৃতিসমূহ নয়া সংহতিকরণের জন্য একটি শক্তিশালী প্রেষণা তৈরী করে, যাকে হতে হয় সামগ্রিক ও গতিময়, যদি এটিকে সামাজিক ও আত্মিক শূন্যতা পূরণ করতে হয়। বুদ্ধিজীবি শ্রেণী জাতীয়তাবাদকে আলিঙ্গন করে ধর্মীয় উত্তাপসহ।

তাঁদের দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভের পূর্বে, বুদ্ধিজীবি শ্রেণী নিজেদের দ্বৈত চাপে দেখতে পায় Ñ তাঁদের জনগণের অধিকাংশের চেয়ে তারা সুবিধা প্রাপ্ত, কিন্তু তারপরেও তাঁরা বিদেশী শাসকদের অধস্তন। এটি জাতীয় আন্দোলনে তাঁদের দ্বিধা ও দোদুল্যমান ভূমিকার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে। তাঁদের অগ্রসরতা, ‘অজ্ঞ’ জনগণের প্রতি অপরাধবোধ ও ‘ঋনী’বোধের ধারণার সৃষ্টি করে, এবং একই সঙ্গে তাঁদের থেকে বিচ্ছেদের ও  শ্রেয়বোধের অনুভূতি তৈরী হয়। দূরে ও উপরে থাকার অবস্থান থেকে বিরতি ছাড়াই, বুদ্ধিজীবি শ্রেণী আত্মীকৃত হওয়া ছাড়াই অঙ্গীভূত হওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন। তাঁরা গতিশীল আন্দোলনের অন্বেষণে থাকে যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, এর জন্য বিস্তৃত নয়া দৃশ্যপট খুলে দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে যেটি বুদ্ধিজীবিশ্রেণীর নিজেদেরকে ক্ষমতা দেয়।

সামাজিক প্রকৌশলে দক্ষতাসহ, তাঁরা দক্ষতায় বিশালভাবে বিশ্বাস করে। আত্ম-সচেতন এবং মুক্তভাবে সংগঠিত জনতার মুক্তি সংগ্রামের ফল হলো তাদের জন্য নয়া দুনিয়া, এইভাবে দেখার পরিবর্তে  তাঁরা বরং ওপর থেকে সংস্কার প্রত্যাশা করে এবং নয়া দুনিয়াকে কৃতজ্ঞ জনগণের নিকট হস্তান্তরিত করতে ভীষণ ভালবাসে। মন্দা থেকে তাদের জাতিকে বেরকরণের পদক্ষেপসমূহের জন্য তারা অত্যুৎসাহী হলেও গণতন্ত্রের জন্য তারা খুব কমই আগ্রহী। তাঁরা প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত করে শিল্পায়নের জন্য, পুঁজির সঞ্চয়নের জন্য, জাতীয় পুনরুজ্জীবনের জন্য। সরাসরি অন্যান্য শ্রেণীসমূহের দুর্বলতা, এবং তাদের রাজনৈতিক নির্বীজতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল তাঁদের ক্ষমতা।

এই সবগুলো বিষয় সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে (ঃড়ঃধষরঃধৎরধহ ংঃধঃব পধঢ়রঃধষরংস) আকর্ষণীয় লক্ষ্য হিসেবে তৈরী করে বুদ্ধিজীবিদের জন্য। এবং প্রকৃতপক্ষে, উদীয়মান জাতিসমূহে তাঁরাই হচ্ছে সাম্যবাদের প্রধান ঝান্ডাবাহী। একজন লাতিন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ লেখেন, ‘লাতিন আমেরিকাতে ছাত্র-ছাত্রী এবং মধ্যশ্রেণীর মাঝে সাম্যবাদের বিশাল গ্রহনযোগ্যতা দেখা গেছে’।১২১ মার্চ/এপ্রিল ১৯৫৮এ ভারতের অমৃতসরে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে,  ‘ডেলিগেটদের প্রায় শতকরা ৬৭ জন হল শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকশ্রেণীর বাইরে অন্যান্য শ্রেণী থেকে আগত (মধ্যশ্রেণী, জমি মালিক শ্রেণী এবং ‘ক্ষুদে ব্যবসায়ী’)। শতকরা ৭২ জনের রয়েছে কিছু কলেজ শিক্ষা’।১২২ ১৯৪৩এ দেখা গেছে যে সকল পার্টি সদস্যদের শতকরা ১৬ জন সার্বক্ষণিক কর্মী।১২৩


বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লব


তৃতীয় বিশ্বে ত্রৎস্কির তত্ত¡ সুপারিশ করে যে সামাজিক বিকাশের প্রণোদনামূলক শক্তিসমূহ স্থায়ী বিপ্লবের দিকে ধাবিত করে এবং শ্রমিকশ্রেণীকে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে চালিত করে। কিন্তু বিপ্লবী বিষয় (ংঁনলবপঃ), অর্থাৎ প্রলেতারিয় কর্মকান্ড ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে, ফলাফল ধাবিত হতে পারে একটি ভিন্ন নেতৃত্বের দিকে এবং একটি ভিন্ন লক্ষ্যের দিকেÑতা হলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। ত্রৎস্কির তত্তে¡র সার্বজনীন বৈধতার বিষয়টি (বুর্জোয়াশ্রেণীর রক্ষণশীল চরিত্র) এবং যেটি অনিশ্চিত (শ্রমিকশ্রেণীর বিষয়ীগত কর্মকান্ড) Ñ এগুলো ব্যবহার করে একটি বিকল্পে উপনীত হওয়া যেতে পারে, ভাল নামের অভাবে, যাকে অভিহিত করা যায় ‘বিক্ষেপিত, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী, স্থায়ী বিপ্লব’। যাহোক, ত্রৎস্কির তত্তে¡র কেন্দ্রীয় ধারণাটি পূর্বের মতই  বৈধ থাকে: সারা দুনিয়াতে বিজয় লাভ করা পর্যন্ত মেহনতি জনতাকে অবশ্যি এর বিপ্লবী সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। এই লক্ষ্য থেকে দূরে থাকলে এই শ্রেণী স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না।



অধ্যায় পাঁচ

উত্তরাধিকার


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ এবং ঘটনাবলীর প্রকৃত অবস্থা পাশাপাশি উপস্থাপন করে বর্তমান প্রবন্ধটি শুরু হয়েছিল। এরপর বর্ণনা করা হয়েছিল কীভাবে ত্রৎস্কিপন্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় বাস্তবতার দিকে তাঁদের চোখ বন্ধ রেখে ত্রৎস্কির বাণীসমূহের প্রতি ফসল হিসেবে মক্ষিকা তুলেছি’। কেন এটি ঘটেছিল? কেন মেন্ডেল, পাবলো ও অন্যান্যা নেতৃস্থানীয় ত্রৎস্কিপন্থীরা, যারা খুবই আন্তরিক কিন্তু নির্বোধ ছিলেন না, এমন আচরণ করেছিলেন যেন তাঁরা কল্পলোকে বাস করছেন এবং কাজ করছেন? কারণ ছিল এই যে নাৎসিবাদ ও স্তালিনবাদের অন্ধকার প্রতিক্রিয়ার বছরগুলোতে তারা নিজেদের খুবই বিচ্ছিন্ন দেখতে পায়  শ্রমিকশ্রেণীর মাঝে ক্ষীণ ভিত্তিসহ। এ রকম দীর্ঘ সময়ের জন্য মরুভূমিতে অবস্থানের জন্য, পানির জন্য তৃষ্ণার্ত থাকার জন্য, সবুজ গাছের মরিচিকা এবং পানির বিশ্ব দেখে তারা দৃষ্টিভ্রমে নিপতিত হন।

            মার্কস, লেনিন, লুক্সেমবার্গ ও ত্রৎস্কির শিক্ষার মূলবিষয়ের (বংংবহপব) প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টাতে, এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে বাস্তব অবস্থার সাথে অভিযোাজিত হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা (ঃযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝড়পরধষরংঃ ঃবহফবহপু) তিনটি তত্ত¡ বিকাশের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে: স্তালিনবাদী রাশিয়াকে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী হিসেবে সংজ্ঞায়ন যেটি এর দীর্ঘ স্থায়ীত্ব এবং পরিণামে বিলুপ্তির ব্যাখ্যা দেয়; পশ্চিমা ধণতন্ত্রের দীর্ঘ তেজীভাবের উৎস নিহিত স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতিতে কিন্তু এটি ধারণ করে ভবিষ্যতের সংকটাবলী; এবং বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লবের আলোকে মাও ও ক্যাস্ত্রোর বিজয়ের ব্যাখ্যা।

            বাস্তব দুনিয়াতে কোনো ব্যবহারিক সম্পর্ক আছে কিনা যার অর্থ হলো এই যে এই তিনটি তত্তে¡র মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল কিনা?

            প্রকৃতপক্ষে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। স্তালিনিয় রেজিমের উদ্বর্তন ও শক্তি অন্য দু’টি বিকাশের জট খুলতে সহায়তা করে।

            সবার উপরে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসমূহ (ঃবহংরড়হং) যেন প্রলেতারিয় বিপ্লবে রূপান্তরিত না হতে পারে তার প্রতিরোধে স্তালিনিয় প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা রাশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিতে বিপ্লবসমূহের স্ফুলিঙ্গ তৈরী করে এবং অন্য অনেক দেশে প্রায় বিপ্লবী অবস্থা তৈরী করে। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশে তখনকার সামাজিক অস্থিরতাসমূহ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা থেকেও অধিকতর তী²তর ও গভীরতর ছিল। যদি ১৯৪৫এ এরকম উম্মুক্ত বিপ্লব না হয়ে থাকে, তবে কারণ ছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলো। বিপ্লবের বর্ধিষ্ণু স্রোতকে প্রতিহতকরণে এবং পুঁজিবাদ রক্ষাকরণে তাদের র‌্যাডিক্যাল প্রতিমূর্তি (ধঁৎধ) ব্যবহার করে স্তালিনপন্থী নেতৃবৃন্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানির উদাহরণসমূহ যে সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরেছিল তা হারিয়ে গেল। আগস্ট ১৯৪৪এ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত প্রতিরোধে নাৎসিবাহিনীর দখল থেকে প্যারিস মুক্ত হলো, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এদের ওপর ন্যস্ত হল। কমিউনিস্টদের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর তুলনা করা যাক। গ্যাব্রিয়েল কোলকোর যুদ্ধের রাজনীতি গ্রন্থে ব্যাখ্যা করা হয় যে ‘গ্যলিয় ভাবধারার গ্রæপগুলো সবসময়ই ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিল। ফ্রান্সের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে তাদের কদাচিৎ অস্তিত্ব ছিল’।১২৪ জনসমর্থনে সমাজতন্ত্রী পার্টিরও সমানভাবেই ঘাটতি ছিল:


তৃতীয় রিপাবলিকে সমাজতন্ত্রীরা উৎকর্ষের দিক দিয়ে সেরা দল ছিল এবং এমনকি ভিখি (ঠরপযু)এর পরেও তাদের রাজনীতিতে বাধ্যতামূলক আনুগত্যের ফল হলো দালালী ও আপোষের জন্য এর জাতীয় পরিষদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের পার্টি কর্তৃক বহিস্কার। ১৯৪১এর পরে সমাজতন্ত্রীরা পার্টি হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই উৎখাত হয়ে যায়, এবং কেবলমাত্র ১৯৪৪এ ধীরে ধীরে তাদের কর্মীদের পুনঃসংগঠিত করতে শুরু করে।১২৫


এতে কমিউনিস্ট পার্টি ফাঁকা মাঠ পেয়ে যায়: ‘কমিউনিস্টরা প্রতিরোধ সংগঠনে প্রাধান্য বিস্তার করে, সবচেয়ে বৃহৎ ছিল ঋৎধহপং-ঞরৎবঁৎং বঃ চধৎঃরংধহং ...’।১২৬ আয়ান বায়ারচল (ওধহ ইরৎপযধষষ) ফ্রান্সের অবস্থা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেন:


১৯৪৪এ নাৎসি দখল থেকে ফ্রান্স মুক্ত হলে দেশটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত হয়। প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সামান্যই নিয়ন্ত্রণ ছিল এই অবস্থার ওপর। বিভিন্ন পৌর এলাকাতে মুক্তি কমিটিসমূহ (ষরনবৎধঃরড়হ পড়সসরঃঃববং) প্রতিষ্ঠা করা হয়; মার্সাইয়ের স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো প্যারিসের সাথে আলোচনা ছাড়াই আঞ্চলিক গণমালিকানার কর্মসূচী শুরু করে। গণ বিচারালয়সমূহ (চবড়ঢ়ষব’ং পড়ঁৎঃং) প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং প্রায় ১১,০০০ দালালকে গুলি করে হত্যা করা হয়।


মুক্তি কমিটিগুলোর অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করতো ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি এবং সরকার হস্তক্ষেপে অক্ষম ছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাদের প্রতি বৃথাই স্বায়তশাসিতভাবে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে আহŸান জানান। কেবলমাত্র ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মরিস থোরেজের হস্তক্ষেপ তাদের নিবৃত করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে:


যেভাবে প্রতিরোধের জাতীয় কাউন্সিল সরকারের বিপরীতে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেনি, তেমনিভাবে স্থানীয় মুক্তি কমিটিগুলো পৌর ও বিভাগীয় প্রশাসনগুলোর বিপরীতে নিজেদের অবশ্যি প্রতিস্থাপিত করবে না।১২৭

         

মরিস থোরেজই মস্কো থেকে ফ্রান্সে ফিরে এসে আহŸান জানান, ‘একটি পুলিশ। একটি সেনাবাহিনী। একটি রাষ্ট্র’। এবং সুতরাং প্রতিরোধকে নিরস্ত্রীকৃত করা হয়। কোলকো লেখেন:

         

আঁদ্রে মার্তি ও চার্লস তিলোঁর (ঈযধৎষবং ঞরষষড়হ) চারপাশের পুরাতন, মিলিট্যান্ট নেতৃবৃন্দকে থোরেজ শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। আঁদ্রে মার্তি ও চার্লস তিলোকে তিনি চুড়ান্তভাবে বহিস্কার করেন। তিনি ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেন এবং শ্রমিকদের নিকট থেকে অধিক শ্রম দাবী করেন. এবং প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর (জবংরংঃধহপব ড়ৎমধহরংধঃরড়হং) বিলুপ্তির অনুমোদন দেন। তিনি প্রত্যেকটি সামাজিক লক্ষ্যকে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যের অধীনস্থ করেন; ‘মুক্তি কমিটিসমূহের কাজ শাসন করা নয়’, জানুয়ারি ১৯৪৫এ পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটিতে বলেন, ‘বরং যারা শাসন করেন তাদের সহায়তা করা। সর্বোপরি, তারা অবশ্যি জনগণকে সমবেত করবে, প্রশিক্ষিত করবে, এবং সংগঠিত করবে যাতে তারা যুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি সমাবেশ করতে পারে এবং  প্রতিরোধ কর্তৃক প্রণীত কর্মসূচীর বাস্তবায়নে সাময়িক সরকারকে সমর্থন দিতে পারে।’ সংক্ষেপে, ফরাসি পুঁজিবাদের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে, বামপন্থীদের পার্টি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে অস্বীকার করে। ‘জাতির ঐক্য ছিলো একটি স্পষ্ট আশু কর্তব্য’, থোরেজ এই উক্তিকরণে কখনো ক্লান্ত ছিলেন না। . . .  পার্টি প্রতিরোধকে নিরস্ত্রীকরণে সহায়তা করে, মুমূর্ষু অর্থনীতির পুরুজ্জীবন ঘটায়, এবং পুরাতন শৃঙ্খলাকে (ড়ষফ ড়ৎফবৎ) গুরুত্বপূর্ণ দম নেওয়ার ফুরসত (নৎবধঃযরহম ংঢ়বষষ) দিতে যথেষ্ট স্থিতিশীলতা তৈরী করে Ñ এবং পরে এগুলো সম্পন্নকরণে পার্টি অধিক কৃতিত্ব নেয়।১২৮


ইতালিতে যে কোনোকিছু বিপ্লবের ঢেউকে আরো উঁচুতে নিয়ে যায়। পিয়েরে ব্রো (চরবৎৎব ইৎড়ঁল্ক) লেখেন, ‘ইতালিতে এটি ছিল শ্রমিকদের আন্দোলন Ñ এবং কেউ জেনে আশ্চর্য হবে না যে এটি শুরু হয়েছিল ফিয়াত কারখানায় Ñ যেটি চুড়ান্তভাবে ফ্যাসিবাদী রেজিমের ভিত্তিকে নাড়া দিয়েছিল, এবং বেনিতো মুসোলিনির কবর খনন করেছিল’।১২৯

            বৃহদায়তনের ফিয়াত কারখানায় ধর্মঘটটি সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হয়েছিল যেটি পরের দিন রেজিমের পতন ঘটিয়েছিল। এক বছর পর:


মার্চ ১৯৪৪এ . . . . একটি নতুন এবং এমনকি অধিকতর বিস্ময়কর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দখলীকৃত ইতালিতে। এই সময় ধর্মঘটীদের শ্লোগান ছিল অধিকতর রাজনৈতিক, তারা দাবী করেছিল আশু শান্তি এবং জার্মানির জন্য যুদ্ধোৎপাদনের সমাপ্তি। সবচেয়ে আশাবাদী পূর্বাভাসও অতিক্রম করে যায় এই সংখ্যাটি। মিলান প্রদেশে ৩০০,০০০ শ্রমিক বের হয়ে আসে। স্বয়ং এই নগরীতে ট্রাম শ্রমিকেরা ১ মার্চে ধর্মঘট করে এবং কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সন্ত্রাসী অভিযানের কারণে চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে তারা বাধ্য হয় কাজে যোগ দিতে। শিল্প ত্রয়ী (রহফঁংঃৎরধষ ঃৎরধহমষব) অতিক্রম করে ধর্মঘট ছাড়িয়ে পড়ে ভেনেতোএর বস্ত্রকলগুলোতে এবং ইতালিয় কেন্দ্রীয় নগরী বোলোগনা ও ফ্লোরেন্সে। আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন নারী ও নিম্ন আয়ের শ্রমিক জনসাধারণ। মার্চের প্রথম সপ্তাহের বিভিন্ন সময়ে হাজারে হাজারে শ্রমিক মেশিন বন্ধ করে দেয়।১৩০

         

ইতালিয় শ্রমিকশ্রেণীর শিল্প, রাজনৈতিক ও সশস্্র সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যাতে ১৯৪৫ নাগাদ তুরিনের শ্রমিকশ্রেণীর জেলাগুলো ফ্যাসিবাদীদের ও জার্মানদের জন্য কার্যত নিষিদ্ধ এলাকা ছিল।১৩১ পরিণামে:


১ মে নাগাদ সম্পূর্ণ উত্তর ইতালি মুক্ত হয়। অধিকাংশ জায়গায় (সড়ংঃ য়ঁধৎঃবৎং) মুক্তির গণমুখী (ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ) ও অভ্যুত্থানিক (রহংঁৎৎবপঃরড়হধৎু) চরিত্র অভ্যর্থিত হয়, এবং এটি অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতির ওপর অনপনেয় অভিঘাত (রসঢ়ৎবংংরড়হ) রেখে যায়। অন্যদের ভেতরে এটি তীব্র উদ্বেগের কারণ ঘটায়। যারা ফ্যাসিবাদীদের সহযোগিতা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবিরোধীরা প্রতিশোধ নিয়েছিল, কাজেই মুক্তির তাৎক্ষণিক ফলাফল হ’ল সম্ভবতঃ ১২,০০০-১৫,০০০ জনের হত্যাকান্ড। উত্তরের শিল্পপতিরা প্রত্যাশা করেছিল ফ্যাসিবাদীদের নিকট থেকে অ্যাংলো-আমেরিকান কর্তৃপক্ষের নিকট নিরুদ্রপ ক্ষমতার স্থানান্তর। তার পরিবর্তে তারা দেখতে পেল যে অভ্যুত্থান ও মৈত্রীজোটের আগমনের মধ্যবর্তী দশ দিনে তাদের ফ্যাক্টরিগুলো দখলীকৃত, এবং শ্রমিকেরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আপোষীগণও অপেক্ষা করতে সাহস না পেয়ে সুইটজারল্যান্ড পলায়ন করে। পরবর্তী কয়েকমাসে পুঁজিবাদী মহলে আসন্ন সামাজিক বিপ্লবের ভয় বজায় থাকে।১৩২


            কিন্তু এই বিপ্লব বাস্তবে রূপায়িত হয়নি সর্বোপরি ইতালিয় কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক অনুশীলনকৃত নিয়ন্ত্রণের কারণে। ব্রো লেখেন:


ইতালিয় কমিউনিস্ট পার্টি হল মস্কোর সরাসরি নিয়ন্ত্রাধীন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অংশ। এটি অভিজাতবর্গ, অধঃপতিত ফ্যাসিবাদী, মার্শালগণ এবং গীর্জার প্রিন্সগণের দ্বারস্থ হয়। এটি তাদের নিকট সরকারী মন্ত্রীত্বের বিনিময়ে রাজপথের চাপ থেকে তাদের সকলকে রক্ষাকরণের আপোষ প্রস্তাব দেয়, এবং মস্কোতে ইতালিয় এজেন্সির আইনিক স্বীকৃতির জন্যও।১৩৩


ফ্রান্সের থোরেজের মতন ইতালিয় কমিউনিস্ট নেতা তোগলিয়াত্তি মস্কো থেকে ফিরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। গিন্সবার্গ লেখেন:


সেলেরনোতে পৌঁছে, তোগালিয়াত্তি তাঁর কমরেডদের নিকট কিছুটা বিস্ময় এবং কিছুটা বিরোধীতার মাঝে একটি কৌশলের রূপরেখা তুলে ধরেন, তাঁর ইচ্ছা হলো পার্টি নিকট ভবিষ্যতে এটি অনুসরণ করবে। তিনি বলেন, কমিউনিস্টদেরকে রাজতন্ত্রের প্রতি তাদের প্রায়ই উল্লেখকৃত শত্রæতা স্থগিত রাখতে হবে। পরিবর্তে তাদের সকল ফ্যাসিবিরোধী শক্তিসমূহকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে রাজকীয় সরকারে যোগদানের জন্য, যেটি সালেরনোর দক্ষিণে ইতালির সমস্ত অংশ এখন নিয়ন্ত্রণ করে। তোগলিয়াত্তি যুক্তি দেন, এই সময়ের প্রধান লক্ষ্য নাৎসি ও ফ্যাসিবাদীদের মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য, তা বাস্তবায়নের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হচেছ সরকারে যোগদান। কমিউনিস্টদের প্রধান লক্ষ্য হলো ইতালির মুক্তি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়।

তোগলিয়াত্তি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে যুদ্ধের বছরগুলোর ঐক্য সম্ভব হলে পুনর্গঠনের সময়ে অব্যাহত রাখা উচিত। এই মহাজোটে কেবলমাত্র সমাজতন্ত্রীরাই থাকবে না তা নয়, খ্রীস্টান গণতন্ত্রীরাও থাকবে। ১৯৪৪এ রোমে এক বক্তৃতায় তিনি খ্রীস্টান গণতন্ত্রীদের এমন একটি পার্টি হিসেবে অভিহিত করলেন যার র‌্যাংকে ‘শ্রমিক জনতা, কৃষক, বুদ্ধিজীবি এবং তরুণেরা রয়েছে, যারা মূলগতভাবে আমাদের আকাঙ্খাগুলো শেয়ার করে, কারণ তারা একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ইতালি চায়’।১৩৪


এপ্রিল ১৯৪৪এ তোগলিয়াত্তি জাতীয় মুক্তি কমিটির অন্তর্ভুক্ত পার্টিগুলোকে রাজার প্রতি আনুগত্য এবং মার্শাল বাদোগলিয়োর সরকারে যোগদানের জন্য আহবান জানান। তিনি মুসোলিনির অধীনে কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন এবং ১৯৩৫এ আবিসিনিয়ায় আগ্রাসনকারী ইতালিয় সেনাদলের নেতা ছিলেন। তোগলিয়াত্তি এমনকি বাদোগলিয়োর মন্ত্রীদের মধ্যে একজন হন!১৩৫

         

জার্মানিতে বিপ্লবী সংগ্রাম ফ্রান্স ও ইতালি থেকে আরো অধিক কষ্টকর ছিল, যদিও এখানে বিপ্লবের জন্য অপূরণীয় সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। এটি সত্য যে তৃতীয় রাইখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে নাৎসি নির্যাতন খুবই কঠিন করে তুলেছিলো, কিন্তু এটি সমীকরণের একটি দিক। সংগ্রামে ফিরে আসার জন্য সম্ভাবনা পদ্ধতিগতভাবে নাৎসি-বিরোধী ক্যাম্পের অভ্যন্তর থেকেই দুর্বল করে দেয়া হয়েছিল। সংস্কারবাদী সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির (ঝচউ) ধ্বংসাত্মক নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি স্তালিনিয় নিয়ন্ত্রাধীন কমিউনিস্ট পার্টি (কচউ) জার্মান শ্রমিকশ্রেণীকে তিক্ততা ও বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, হিটলারকে তার বিরুদ্ধে কোনরকম অঙ্গুলি উত্তোলন ছাড়াই ক্ষমতাসীন হতে দিয়ে।

            ১৯৩৯এ হিটলার-স্তালিন চুক্তি স্বাক্ষর জার্মান কমিউনিস্টদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল যারা নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই চুক্তির ফলে গেস্টাপো কর্তৃক বাজেয়াপ্ত গোপন লিফলেটের সংখ্যা ১৯৩৯এ ১৫,৯২২ থেকে কমে এই সংখ্যাটি ১৯৪০এ দাড়ায় ১,২৭৭এ।

            এমনকি যখন যুদ্ধ সমাপ্তির দিকে তখনও জোটের হিসাবকৃত কৌশল মনে হয়েছিলো তৃতীয় রাইখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অনুৎসাহিতকরণে এবং তার পরিবর্তে অন্তঃকোপী আনুগত্য উপস্থাপনে। পূর্বে, স্তালিন ‘মহান দেশপ্রেমমূলক যুদ্ধ’-এ রত বলে দাবী করেন এবং তাঁর লক্ষ্য নাৎসি রেজিম থেকে সকল জার্মানদের প্রতি ধাবিত হয়। জার্মান-বিরোধী, বিশেষ করে রাশিয়ার কার্যত বর্ণবাদী প্রচারণা নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের বিকাশকে অবদমিত করে। রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যমে ইলিয়া ইহরেনবার্গ বার বার লিখে এই বাক্যটি পুনরাবৃত করেন, ‘একমাত্র ভালো জার্মান হল মৃত জার্মান।’ আমার তার লেখা একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের কথা মনে পড়ে যাতে তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে একজন রাশিয়ার সৈন্যের সম্মুখীন হয়ে একজন জার্মান সৈন্য তার হাত উর্ধ্বে উত্তোলন করে এবং বলে, ‘আমি একজন কামারের সন্তান’ Ñ শ্রমিকশ্রেণীর পরিচয়ণে কী চমৎকার সূত্রায়ণ! রুশ সৈন্যের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? ইহরেনবার্গ লেখেন, ‘রুশ সৈন্য বলেন, “তুমি একজন জার্মান এবং জার্মানদের অপরাধসমূহের জন্য তুমিও দায়ী,” এবং তারপর জার্মান সৈন্যের বুকে তিনি বেয়োনেট চালান।’  

            জার্মান সৈন্যরা কাইজারের বিরুদ্ধে বিপ্লব দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবস্থাবলীতে এ ধরণের কোনো বিদ্রোহের উত্থান ঘটেনি, যেজন্য একজন সৈন্য বলেন, ‘খোদা না করুন, আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই। যদি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেমে আসে, তাহলে আমাদের খারাপ সময় হতো।’

কিন্তু বিপ্লবের বীজ তখন পর্যন্ত সেখানে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নির্যাতনের ভারী ঢাকনা জার্মান শ্রমিকদের ওপর থেকে উঠে গেল এবং তারা নিজেদের প্রকাশ করার সত্যিকার সুযোগ পেল। যা প্রকাশ পেল তা বিস্ময়কর। নতুন নতুন এলাকা নাৎসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হলে ফ্যাসি-বিরোধী কমিটিগুলোর অর্থাৎ ‘এন্টিফ্যাস’ এর ব্যাপক আন্দোলন জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ শতাধিকের ওপর এই কমিটিগুলো বিস্মায়করূপে শ্রমিক শ্রেণী দিয়ে গঠিত। নাৎসি রেজিমের উৎখাত এবং দখলদার জোট বাহিনী (পূর্বে রাশিয়া, পশ্চিমে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কর্তৃক ‘শৃঙ্খলা’ পুনারোপের মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ত সময়ে শ্রমিকেরা ম্ক্তু ছিল দ্বিবিধ অর্থেই। কেবলমাত্র নাৎসি জুলুমই অপসৃত হল না, সঙ্গে সঙ্গে গেস্টাপো শাসনও, সংস্কারবাদী সোস্যাল ডেমোক্রাট নেতৃত্ব ও স্তালিনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি এই উভয়ের মৃত্যুকর প্রভাব সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়।

            এন্টিফ্যাস বিস্ফোরকরূপে বৃদ্ধি পায়। লাইপজিগে (পূর্ব জার্মানি) ৩৮টি স্থানীয় কমিটি ছিল। এদের ৪,৫০০ জন কর্মী এবং ১,৫০,০০০ জন অনুসারী ছিল বলে দাবী করা হয়। যুদ্ধে ধ্বংসের কারণে ব্যাহত হওয়া সত্তে¡ও প্রায় ১,০০,০০০ জন মানুষ তাদের মে দিবসের বিক্ষোভে সমবেত হয় (উদাহরণস্বরূপ, জনসংখ্যা ৭,০০,০০০ থেকে নেমে ৫,০০,০০০ হয়েছিল)। পশ্চিম জার্মানির নগর ব্রামেনে ৫৫% বাড়িঘর অবসবাসযোগ্য ছিল এবং অধিবাসীদের এক-তৃতীয়াংশ নগরী থেকে পালিয়েছিল, সেখানে ১৪টি স্থানীয় গোষ্ঠী ছিল, সেখানে সদস্যসংখ্যা ৪,২৬৫ জন দাবী করা হয়। পক্ষকাল পরে সংখ্যা দাঁড়ায় ৬,৪৯৫ জন। অনেক এন্টি-ফ্যাস সংগঠিত হয় কর্মক্ষেত্রগুলোতে। মুক্তির ঠিক পরেই কেন্দ্রীয় রার-এ কর্মক্ষেত্রগুলোর প্রতিনিধিদের একটি সমাবেশ হয়, যাতে ৫৬টি খনি এবং অন্যান্য অনেক এন্টারপ্রাইজ থেকে ৩৬০ জন ডেলিগেট অন্তর্ভুক্ত ছিল।

            এন্টিফ্যাসগুলো নাৎসিবাদকে উৎখাতে বদ্ধপরিকর ছিল। নাৎসি কর্মীদের অপসারণের দাবীতে ধর্মঘটসমূহ শুরু করা হয়। ব্রামেন ও অন্যান্য জায়গায় নাৎসি ইউনিয়ন, জার্মান শ্রমিক ফ্রন্টের ভবনসমূহ দখল করে নেয়া হয়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পসমূহ থেকে ফেরত আসা সাথীদের নাৎসি কর্মীদের বাড়তি কক্ষসমূহে জায়গা দেয়া হয় এবং সবচেয়ে কুখ্যাত নাৎসি কর্মীদের কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেয়া হয়। স্টুটগার্ট ছিল আরো এক ধাপ এগিয়ে এবং তারা তাদের নিজস্ব ‘বিপ্লবী ট্রাইবুনালসমূহ’ গঠন করেছিল।

      একটি সচেতনতা ছিল এই যে কেবলমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর নিজেদের কাজের মাধ্যমেই নাৎসিবাদকে প্রকৃতপক্ষে চিরতরে উৎখাত করা যেতে পারে। বকুম-এ অবস্থিত প্রিন্স রিজেন্ট খনিতে রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের জন্য আহŸান জানানো হয় এবং শ্লোগান দেয়া হয়, ‘লাল বাহিনী দীর্ঘজীবি হোক’, এই শ্লোগানটি সোভিয়েত বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়নি, তার পরিবর্তে ১৯১৮-২৩এর জার্মান বিপ্লবের অভ্যুত্থানকারী শক্তির উদ্দেশ্য এটি দেয়া হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি এগিয়ে নেয়া হয় যে ‘ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে পূর্বের মতন কোনো চাকুরিদাতা (বসঢ়ষড়ুবৎং) থাকবে না। আমরা এটাকে অবশ্যি এমনভাবে সাজাবো এবং কাজ করবো যেন প্রতিষ্ঠানটি আমাদের!’ কিছু জায়গায় শ্রমিকেরা তাদের ফ্যাক্টরির দখল নেয় এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পালিয়ে যায়। এন্টিফ্যাস তাদের নিজেদের ফ্যাক্টরি মিলিশিয়া গঠন করে এবং পুলিশ প্রধানগণ ও মেয়রদের প্রতিস্থাপিত করে নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিবর্গ দিয়ে। স্টুটগার্ট ও হ্যানোভারের অবস্থা বর্ণনা করা হয় একটি ‘দ্বৈত ক্ষমতা’ হিসেবে। এন্টিফ্যাস নিজেদের পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে, শক্তিশালী স্থানীয় পদসমূহের প্রচালনাগুলোর দখল নেয় এবং খাদ্য সরবরাহের মতন গুরুত্বপূর্ণ  সেবাসমূহ চালানো শুরু করে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টটি সবিস্তারে উল্লেখযোগ্য:


নাৎসি সরকারের পতনের ঠিক পরেই নাৎসি-বিরোধী ঐক্য ফ্রন্ট আন্দোলনগুলোর উত্থান ঘটে এবং ব্যাপক এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বিভিন্ন নামীয় কতগুলো সংগঠনের অধীনে এবং দৃশ্যতঃ  একে অপরের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ ছাড়াই। . . . . তাদের একের সঙ্গে অপরের কোনো যোগাযোগ না থাকা সত্তে¡ও, এই গ্রæপগুলো লক্ষণযোগ্যরূপে সাদৃশ্য প্রদর্শন করে তাদের গঠনে এবং কর্মসূচীতে। নাৎসি আমলে যে সমস্ত মানুষেরা সক্রিয় ছিলেন এবং কোনো না কোনোভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের নিকট থেকে ঐ ফ্রন্টগুলো গঠনের উদ্যোগ এসেছিল বলে দৃষ্টিগোচর হয়। . . . . নাৎসীদের অভিযুক্তকরণ, অবৈধ নাৎসি গুপ্ত আন্দোলন প্রতিহতকরণের প্রচেষ্টা, বেসামরিক কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তিগত শিল্পকারখানার বিনাৎসিকরণ, আবাসন এবং খাদ্য সরবরাহ সংস্থানের উন্নয়নÑএগুলোই ছিল কেন্দ্রীয় বিষয় যাতে নুতনভাবে গঠিত সংস্থাগুলোর মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল। . . . . সুতরাং, এই উপসংহার যুক্তিযুক্ত যে নাৎসিবিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর স্বতঃস্ফুর্ত একত্রীকরণের প্রতিনিধিত্ব করে এই কমিউনিটিগুলো, যতদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসী রেজিম ক্ষমতায় ছিল,  ততদিন এগুলো ক্ষমতাবিহীন ছিল।


রিপোর্টে প্রতিতুলনায় দেখা যায় যে বামপন্থীদের কর্মকান্ড গুরুত্বারোপ করে নতুন করে আরম্ভকরণের পূর্বশর্ত হিসেবে নাৎসিবাদের সকল আলামতের মূলোৎপাটন, এর বিপরীতে ডানপন্থীগণ ‘মনোযোগ নিবদ্ধ করে হিটলার রেজিমের ধ্বংসাবশেষের যে কোনো কিছুর সংরক্ষণে যা এখন পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য’।

কিন্তু হায়, প্রত্যেক অঞ্চলে এন্টিফ্যাস কেবলমাত্র স্বল্প কয়েক সপ্তাহের জন্য টিকে থাকতে পেরেছিল, কারণ তারা (রুশ সেনাবাহিনীসহ) দখলদার বাহিনীসমূহের এবং শ্রমিক আন্দোলনে স্তালিনবাদীদের বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। স্থানীয় অঞ্চলগুলোতে দখলদার বাহিনীসমূহের দৃঢ় কর্তৃত্ব লাভের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। এটি প্রয়োগ করা হয় যেমনিভাবে রুশ নিয়ন্ত্রিত পূর্ব সেক্টরে তেমনি পশ্চিম সেক্টরে। এন্টিফ্যাস বিলুপ্ত করে দেয়া হয় উভয় ওয়ার্কার্স পার্টির পরোক্ষ সম্মতিতে। ইয়াল্টা চুক্তির পরে স্তালিনিয় কচউ মেনে নেয় যে পশ্চিমা মিত্রবর্গের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে তাদের প্রভাবাধীন এলাকা নিয়ন্ত্রণের এবং পূর্বাঞ্চলেও তারা কোনো স্বাধীন কর্মকান্ড সহ্য করতো না। পঞ্চিমাঞ্চলে সংস্কারবাদী ঝচউএর কোনো আগ্রহ ছিল না বিপ্লব সংবর্ধনে। সুতরাং, আলোচনাধীন সময়সীমা সংক্ষিপ্ত ছিল। অর্থাৎ ১৯৪৫এর বসন্তকালে প্রতিটি এলাকাতে এটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ টিকে ছিল । তা সত্তে¡ও, তারা যে ক্ষমতা দেখিয়েছিল তা রুখে দেয়া হয়, প্রধানত উপর ও নীচ থেকে স্তালিনবাদ দিয়ে।১৩৬



অধ্যায় ছয়

উপসংহার


ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে স্তালিনিয় রেজিম যুদ্ধে বিজয়ী না হলে ফ্রান্স ও ইতালির স্তালিনিয় পার্টিগুলোর যথেষ্ট ক্ষমতা থাকতো না এই দেশগুলোতে পুঁজিবাদী অর্ডার সংরক্ষণে। একইভাবে হিটলারের পতনের পরে জার্মান শ্রমিক শ্রেণী অচল হয়ে পড়তো না।

 রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের উদ্বর্তন পশ্চিমা পুঁজিবাদের উদ্বর্তনের দিকে ধাবিত করে, কারণ বিপ্লব এড়ানোর জন্য উভয়ের স্বার্থেই এটি দরকার ছিল। কিন্তু এটি হলো শত্রæ ভাবাপন্ন দুই ভাইয়ের সিস্টেম এবং প্রাক্তন যুদ্ধকালীন মিত্রবর্গ শীঘ্রই ঠান্ডা যুদ্ধের মতন একটি ব্যাপক ব্যয়বহুল অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল পাশ্চাত্যে ক্রিয়াশীল স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির ভিত্তি।

রাশিয়াতে স্তালিনিয় রেজিমের অস্তিত্ব এবং চীন ও কিউবার বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লবের মধ্যকার যোগসূত্র অধিকতর প্রতীয়মান। এটি ছিল একটি শক্তিশালী রাশিয়ার অস্তিত্ব যা মাওবাদী সেনাবাহিনীকে উৎসাহ যুগিয়েছিল জাপান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং চিয়াং কাই-শেক এর কুয়োমিনতাং এর বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরে যুদ্ধ করতে। এটি ছিল স্তলিনের নেতৃত্বে পশ্চাৎপদ রাশিয়ার জোরপূর্বক এবং দ্রæত শিল্পায়নের উদাহরণ, যা স্তালিনিয় পার্টিসমূহ এবং তৃতীয় দুনিয়া জুড়ে উত্থানশীল সরকারসমূহকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং এটি ছিল তাদের জন্য অনুসরণযোগ্য মডেল। স্থানীয় পুঁজিতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সমর্থকদের সঙ্গে মৈত্রীর স্তালিনিয় পলিসির অর্থ হল শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের উৎখাত ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদ প্রায়ই উপনিবেশসমূহ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে সমর্থ হয় তার অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ পরিত্যাগ ছাড়াই। রুশ বøকের সঙ্গে জোট বেঁধে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী পলিসিসমূহ অনুসরণে কোথাও অগ্রগতি ঘটতে পারে, কিন্তু সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা তখনও পুঁজিবাদী শাসনাধীনে শোষিত ও অধস্থনের।

সুতরাং, একবার রাশিয়াতে স্তালিনিয় রেজিমের ভাগ্য সম্পর্কে ত্রৎস্কির ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হলে, অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশসমূহে এবং একই সঙ্গে পশ্চাৎপদ দেশসমূহের বিকাশ সম্পর্কে তাঁর বাদবাকী ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবায়িত হতে ব্যর্থ হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মানবিক পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুধাবনে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি এবং বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লব (ফবভষবপঃবফ ঢ়বৎসধহবহঃ ৎবাড়ষঁঃরড়হ) Ñ এই ত্রয়ী (ঃৎড়রশধ) একটি ঐক্য, একটি সামগ্রিকতা তৈরী করে। সাধারণভাবে এটি ত্রৎস্কিবাদের নিশ্চিত প্রমাণ, আবার অংশতঃ এর নাস্তি । জীবন্ত তত্ত¡ হিসেবে মার্কসবাদ যেমনটি আছে ঠিক সেভাবেই বজায় থাকবে, এবং একই সময়ে এর পরিবর্তনও ঘটবে। যাহোক, ত্রয়ীকে একক হিসেবে অনুধাবন করা হয়নি এবং এটি হঠাৎ করেই অস্তিত্বমান হয়নি। এটি ছিল রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, অগ্রসর শিল্পায়িত পুঁজিবাদী দেশসমূহ, এবং তৃতীয় দুনিয়া Ñ এই তিনটি অঞ্চলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশসমূহের ওপর কতিপয় দীর্ঘ অনুসন্ধানের ফসল। গবেষণার পদ্ধতিসমূহ ছিল একে অপরের সঙ্গে বারংবার সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু কেবলমাত্র প্রক্রিয়াটির শেষেই গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যকার সম্পর্কাবলী স্পষ্ট হয়। কেবলমাত্র পর্বতের শৃঙ্গ থেকেই একজন পর্বত চুড়ায় পৌছানোর জন্য পরিকল্পিত বিভিন্ন ফুটপাতের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ দেখতে পায় এবং এই অনুকুল অবস্থা থেকে বিশ্লেষণ সংশ্লেষণের দিকে ধাবিত হয়, মার্কসবাদী দ্বা›িদ্বকতার বিজয়ী হিসেবে উত্থান ঘটে।

ব্যাপকমাত্রায় অপ্রতিসমতাসমূহ দিয়ে এর বিদীর্ণকরণসহ, দুনিয়ার অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনৈতিক কাঠামোর প্রকৃত পরিবর্তনসমূহ অনুধাবন করে, এটিকে বাস্তব, প্রকৃত, মূর্ত সম্ভাবনাসমূহ দ্বারা বুঝতে সম্ভব করে তোলে বিপ্লবীদের জন্য, যাতে তারা নিজেদেরকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াতে স্থাপন করে।

বর্তমানে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে স্তালিনবাদী রেজিম আর নেই। স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি দিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদ সম্মুখে প্রচালিত হয় না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী পথ তৃতীয় দুনিয়াতে পরিত্যক্ত হয়েছে, কারণ অধিকতর ঘনিষ্ঠ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আত্মীকরণে স্থানীয় শাসক শ্রেণীসমূহ বা গ্রæপগুলোর সেই ভুমিকা পালনের উৎসাহের জন্য মহড়ার দেবার জায়গা খুবই সংকীর্ণ। পশ্চিম, পূর্ব, এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে - দুনিয়া জুড়ে নিযুত নিযুত শ্রমিক কর্মচ্যূত হয়েছেন; নিযুতপতি ও বহু-নিযুতপতিদের বর্ধিত সংখ্যার পাশাপাশি নিযুত নিযুত বেকার বসবাস করে।

রাষ্টীয় পুঁজিবাদী হিসেবে রাশিয়ার সংজ্ঞায়ন, স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতিকে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক তেজী ভাবের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ, এবং তৃতীয় দুনিয়াতে মাওবাদের সফলতার জন্য ব্যাখ্যা হিসেবে বিক্ষেপিত স্থায়ী বিপ্লবকে গ্রহণ Ñ এই ত্রয়ীকে আজকের দিনের মার্কসবাদীদের নিকট অপ্রাসঙ্গিক দেখাতে পারে। কিন্তু এটি তা নয়।

            যে বস্তুগত শর্তসমূহ ধারণবলীর প্রকাশ ঘটায়, সেই শর্তগুলো অপসৃত হওয়ার পরেও সর্বোপরি, ধারণাবলী টিকে থাকে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য। একটি পাথর দিয়ে ঢিল দেবার কারণে পানিতে উৎপন্ন ঢেউটি বহমান থাকে এমনকি পাথরটি থেমে যাবার পরও।

এইভাবে এখন পর্যন্ত স্তালিনিয় রেজিম সম্পর্কে সমর্থকদের মধ্যে ও বিরোধী বুর্জোয়াদের মাঝে ভ্রান্তি বিদ্যমান আছে। এমনকি শ্রমিক গণতন্ত্র ছাড়াই শিল্পের রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হচ্ছে সমাজতন্ত্র, এই ধারণাটি এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সংঘটিত হওয়ার পরে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান কেইনসবাদের প্রতি আকর্ষন বৃদ্ধি করে। সেই সময়কার অবস্থার ব্যাখ্যায় কেইনসবাদের বিপরীতে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মার্কসবাদী বিকল্প হতে পারে স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির তত্ত¡। কেইনসবাদ এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং আঘাত করছে এবং আজ মুক্ত বাজার অর্থনীতির অর্থনৈতিক বিকল্প হিসেবে এটিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

বিশেষ করে তৃতীয় দুনিয়ায় জনগণের নিকট মাওবাদের ধারণাবলী এখন পর্যন্ত আকর্ষণীয়। চে গুয়েভারার ভাবমূর্তি এখন পর্যন্ত লাতিন আমেরিকায় প্রচন্ড অনুরণিত হয়। বিপ্লবী মার্কসবাদীদের নেতৃত্বে কেবলমাত্র সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণী নিজেরা সংগঠিত হয়ে বিপ্লব অর্জন করতে পারে Ñ এই ধারণাটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ব্যাপকভাবে গৃহিত হয়নি।

কেন আমরা যে তিনটি তত্ত¡ বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছি তা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন, তার আর একটি কারণ আছে। এটি করতে হয় মার্কসবাদী ঐতিহ্যের প্রকৃতি ও ধারবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ত্রৎস্কি যেমনটি বলেন, বিপ্লবী পার্টি হল শ্রমিকশ্রেণীর স্মৃতির সংগ্রহশালা। ত্রৎস্কির প্রয়াণের পূর্বে এই স্মৃতির সংগ্রহশালাটি, অর্থাৎ আন্দোলনের সত্যিকার ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করতো কিছু ব্যক্তির গ্রæপ। এটি মূর্তভাবে দেখানো যেতে পারে।

প্রথম আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল আপেক্ষিকভাবে বৃহদায়তনের সংগঠনসমূহ দিয়ে,  প্রথম আন্তর্জাতিক এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠার মধ্যে প্রায় দুই দশকের ছেদ থাকা সত্তে¡ও প্রথম আন্তর্জাতিকের হাজার হাজার সদস্য দ্বিতীয় আান্তর্জাতিকে যোগদান করেছিলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ভেতরে বিশাল ভাঙ্গনের ফলে তৃতীয় আন্তর্জাতিক (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, বা কমিনটার্ন) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইতালিয় স্যোশালিস্ট পার্টি, সেপ্টেম্বর, ১৯১৯এ বোলগ্নাতে অনুষ্ঠিত এর সম্মেলনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে যোগদানের জন্য ভোট দেয়, এতে ৩০০,০০০ জন সদস্য যোগ হয়। জামার্নিতে ১৯১৭তে স্যোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ভেঙ্গে গঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্যোশালিস্ট পার্টিও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, এতে আরও ৩০০,০০০ জন সদস্য যোগ হয়। ১৯২০এ ফরাসি স্যোশালিস্ট পার্টি যোগ দেয়, এতে ১৪০,০০০ জন সদস্য যোগ হয়। জুন ১৯২০এ বুলগেরিয় স্যোশালিস্টরা অধিভুক্তির জন্য ভোট দেয়, এতে ৩৫,৪৭৮ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়। যুগোশ্লাভ স্যোশালিস্ট পার্টিও একটি গণসংগঠন, এটিও যোগ দেয়। ১৯২০এ চেকো¯েøাভাক স্যোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ভেঙ্গে যায়, বাম কমিউনিস্টদের সঙ্গে অর্ধেক সদস্য চলে আসে এবং ৩৫০,০০০ সদস্যের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে। জার্মান ভাষী সংখ্যালঘু স্যোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একটি পৃথক ভাঙ্গনে আরও শক্তি যোগ হয়, এবং তাদের একীভূতকরণের পরে পার্টি তাদের সদস্য ৪০০,০০০ জন বলে দাবী করে। ১৯১৯এর বসন্তে নরওয়েজীয় লেবার পার্টি কমিনটার্নে যোগদান করে। সুইডেনে ভাঙ্গনের পরে, সোস্যালিস্ট পার্টির অধিকাংশ কমিনটার্নে যোগদান করে, এতে আরও ১৭,০০০ জন সদস্য যোগ হয়।১৩৭

দুঃখজনকভাবে, ১৯২০এর দশকে প্রথমদিকে লেনিন ও ত্রৎস্কির কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং ১৯৩০এর দশকে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ত্রৎস্কিপন্থী আন্দোলনের মধ্যে ব্যক্তিক বিপ্লবীদের অবস্থাবলীর প্রেক্ষাপটে কদাচিৎ কোনো ধারাবাহিকতা বিদ্যমান ছিল। স্তালিনের ব্যাপক প্রভাব এবং হিটলারের ভয়ে পিষ্ট হয়ে গণ আন্দোলনের প্রান্তে ত্রৎস্কিপন্থী সংগঠনে সবর্দাই ক্ষুদ্র গ্রæপসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এইভাবে হিটলারের বিজয়ের প্রাক্কালে বার্লিনে ত্রৎস্কিপন্থীদের সংখ্যা ছিল ৫০ জন!১৩৮ ১৯৩৬এর স্পেনিয় বিপ্লব সত্তে¡ও, ১৯৩৮এর সেপ্টেম্বরে, চতুর্থ আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্মেলনের রির্পোট অনুসারে, স্পেনিয় সেকশনের সদস্য ছিল ১০ এবং ৩০ এর মধ্যে!১৩৯

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতির পর্যায়সমূহে। ত্রৎস্কিপন্থী সংগঠনগুলো জন্ম নেয় নাৎসিবাদ ও স্তালিনবাদের বিজয়কালীন সময়ে, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর ভয়াবহ কালপর্যায়ে। কেন ত্রৎস্কিবাদ বিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতাহীন হয়েছিল দু’টি প্রজন্মের জন্য এবং সেজন্য ত্রৎস্কিপন্থীদের পথ হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতায় পেয়ে বসেছিল, সেটি বোধগম্য না হলে, একজন অবশ্যি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ হতাশাপ্রবণ উপসংহারে উপনীত হবেন। অতীতের উপলব্ধি এটি স্পষ্টায়িত করে যে ত্রৎস্কিবাদ, মার্কসবাদের ধারাবাহিকতায় একটি সংযোগ, এটির নিজ থেকে উত্থান ঘটবেই।

এখন বিপ্লবী মার্কসবাদ ও ত্রৎস্কিবাদের অগ্রগতির প্রধান বাধা স্তালিনবাদ চলে গেছে। অগ্রসর দেশগুলোতে পুঁজিবাদ আর স¤প্রসারিত হচ্ছে না। ১৯৩৮এর মধ্যবর্তী কর্মসূচীতে থাকা কথাগুলো ছিল ‘পদ্ধতিগত সামাজিক সংস্কার এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানের বৃদ্ধি নিয়ে আর কোনো আলোচনা নয়’, সুতরাং এগুলো আবার বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হচ্ছে।১৪০ ত্রৎস্কি কর্তৃক উত্থাপিত স্থায়ী বিপ্লবের ধ্রæপদি তত্ত¡  এজেন্ডাতে প্রত্যাবর্তন করছে, যা ১৯৯৮ এর ইন্দোনেশিয় বিপ্লবে দেখা গেছে।

ত্রয়ী ব্যাখ্যা করে কেন একটা সময়, একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাÑপুঁজিবাদ টিকেছিল, যদিও এটি কতিপয় ছদ্মবেশে অভিযোজিত হয়। একই সময়ে এটি (ত্রয়ী) সর্বদা সেই প্রক্রিয়ার দিকে আলোকপাত করে যেটি এই স্থায়ীত্বকে ক্রমাগত দুর্বল করে: কখনো কিছু সময়ের জন্য এই প্রক্রিয়াগুলো আণবিক পর্যায়ে থাকে এবং বাইরে থেকে কদাচিৎ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু চুড়ান্তভাবে পরিমাণ গুণে রূপান্তরিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থাটিই সংকট ও অস্থিতিশীলতা দিয়ে আলোড়িত হয়। তখন, মার্কস যেমনটি বলেন, মানবিকতা ‘এর আসন থেকে উত্থিত হবে এবং সফলতার সঙ্গে চিৎকার করে বলবে, “যথেষ্ট তদন্তকৃত হয়েছে, হে বৃদ্ধ গুপ্তচর!”’১৪১







তথ্য নির্দেশ:

১।         কার্ল মার্কস, ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ (মস্কো, ১৯৭৭)।

২।        এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৪-১৯৩৫ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৪), পৃঃ ১৮১-১৮২।

৩।        এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৩-১৯৩৪ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৫), পৃঃ ৩১৬।

৪।        এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৫-১৯৩৬ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৭), পৃঃ ২৬০।

৫।        এল ত্রৎস্কি, মার্কসবাদের সমর্থনে (ওহ ফবভবহপব ড়ভ গধৎীরংস) (লন্ডন,১৯৭১), পৃঃ ১৬-১৭।

৬।        ডাবিøও রেইজনার (সম্পাঃ), চতুর্থ আন্তর্জাতিকের দলিলপত্রাদি (নিউইয়র্ক, ১৯৭৩), পৃঃ ১৮৩।

৭।        এম কিড্রন, যুদ্ধোত্তর পশ্চিমা পুঁজিবাদ, (লন্ডন, ১৯৭০), পৃঃ ১১

৮।        টনি ক্লিফ ও ডি গøাকস্টেইন, লেবার পার্টি: একটি মার্কসবাদী ইতিহাস (লন্ডন, ১৯৮৮), পৃঃ ২২৭

৯।        প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৩

১০।       এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৮-৩৯ (নিউইয়র্ক, ১৯৭৪), পৃঃ ৭৮

১১।       এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৭-৩৮ (নিউইয়র্ক, ১৯৭৪), পৃঃ ২৭

১২।       এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৮-৩৯ (নিউইয়র্ক, ১৯৭৪), ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৮৭

১৩।       দেখুন টনি  ক্লিফ, ত্রৎস্কি: রাত যত গভীর তারা তত উজ্জ্বল (লন্ডন, ১৯৯৩), পৃঃ ১৯৮

১৪।       প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮৩

১৫।       প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৯

১৬।       এই বিবৃতিটি নভেম্বর ১৯৪৫এ দেয়া হয়, দেখুন জে পি ক্যানন, ‘মার্কিন শতাবব্দি’তে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম (নিউইয়র্ক, ১৯৭৭), পৃঃ ২০০

১৭।       চতুর্থ আন্তর্জাতিক, জুন ১৯৪৬।

১৮।       প্রাগুক্ত

১৯।       চতুর্থ আন্তর্জাতিক, জুন ১৯৪৬

২০।      ই জারমেন (মেন্ডেল), যুদ্ধোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক, সেপ্টেম্বর ১৯৪৬

২১।       চতুর্থ আন্তর্জাতিক, জুন ১৯৪৮

২২।      চতুর্থ আন্তর্জাতিক, আগস্ট ১৯৪৮

২৩।      টনি ক্লিফের উদ্ধৃতি, ওয়াশিংটনও না মস্কোও না (লন্ডন, ১৯৮২), পৃঃ ৮৪-৮৫

২৪।      দেখুন ‘যুগোশ্লাভিয়ার শ্রেণী চরিত্র’, ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ইঁষষবঃরহ এর অক্টোবর ১৯৪৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।

২৫।      এলএলএসপি এর অভ্যন্তরীণ বুলেটিন, সিলোন, এপ্রিল ১৯৫৪, পৃঃ ৭

২৬।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫

২৭।      রবার্ট জে আলেকজান্ডার, আন্তর্জাতিক ত্রৎস্কিবাদ (ডারহাম ও লন্ডন, ১৯৯১), পৃঃ ৬৬৪

২৮।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩৪

২৯।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬৩-৬৬৪

৩০।      চতুর্থ আন্তর্জাতিক, জুন ১৯৪৬

৩১।       প্রাগুক্ত

৩২।      প্রাগুক্ত

৩৩।      প্রাগুক্ত

৩৪।      প্রাগুক্ত

৩৫।      ই জারমেইন (মেন্ডেল), ‘ইউরোপীয় বিপ্লবের প্রথম পর্যায়’, চতুর্থ আন্তর্জাতিক, আগস্ট ১৯৪৬

৩৬।      ই জারমেইন (মেন্ডেল), ‘ইউরোপীয় বিপ্লবের সমস্যাবলী’, চতুর্থ আন্তর্জাতিক, সেপ্টেম্বর ১৯৪৬

৩৭।      ই জারমেইন (মেন্ডেল), ‘ঋৎড়স ঃযব অইঈ ঃড় ঈঁৎৎবহঃ জবধফরহম: ইড়ড়স, জবারাধষ ড়ৎ ঈৎরংরং?’ অর্থনৈতিক পুরুদ্ধারের সাক্ষ্যপ্রমাণ অস্বীকারকরণে মেন্ডেলের প্রচেষ্টা- এটি টনি ক্লিফ প্রত্যাখান করেন তাঁর ‘অষষ ঃযধঃ মষরঃঃবৎং রং হড়ঃ মড়ষফ’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে যা মুদ্রিত হয় টনি ক্লিফ, ওয়াশিংটনও না মস্কোও না, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ২৪-৩৯

৩৮।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬১

৩৯।      কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট ইশতেহার, (বেইজিং, ১৯৯০), পৃঃ ৫৯

৪০।      ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, এন্টি ডুরিং, (মস্কো, ১৯৭৫), পৃঃ ৩৩৬

৪১।       রোজা লাক্সেমবুর্গ, এবংধসসবষঃব ডবৎশব, খন্ড ৩ (বার্লিন, এনডি), পৃঃ ৬৩-৬৪

৪২।      এই যুক্তির বিস্তারণের জন্য দেখুন, টনি ক্লিফ, ওয়াশিংটনও না মস্কোও না, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৬৫-৬৬

৪৩।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬-৬৭

৪৪।      এল ত্রৎস্কি, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকাশের সমস্যাবলী: রুশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বাম বিরোধীদের থিসিসসমূহের খসড়া (নিউ ইয়র্ক, ১৯৩১), পৃঃ ৩৬

৪৫।      নয়া আন্তর্জাতিক, এপ্রিল ১৯৪৩

৪৬।      প্রাগুক্ত

৪৭।      দেখুন, উদাহরণ হিসেবে, এল ত্রৎস্কি, দা রেভুল্যুশন বিট্রেইড (নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৪), পৃঃ ২৮৯

৪৮।      কার্ল মার্কস, দর্শনের দারিদ্র্য (লন্ডন, এনডি), পৃঃ ১২৯-১৩০

৪৯।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬১

৫০।      কার্ল মার্কস, আ কনট্রিবিউশন টু দা ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি (শিকাগো, ১৯১৮), পৃঃ ২৮৫-২৮৬

৫১।       টনি ক্লিফ, রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ (লন্ডন, ১৯৮৮), পৃঃ ২২১-২২২

৫২।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৫-১৬৬

৫৩।      এল ত্রৎস্কি, দা রেভুল্যুশন বিট্রেইড, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৬

৫৪।      ই মেন্ডেল, রহ ছঁধঃৎরবসব ওহঃবৎহধঃরড়হধষব, সংখ্যা ১৪, ১৯৫৬

৫৫।      টনি ক্লিফ, ‘স্তালিনিয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’ (লন্ডন, ১৯৪৮), পৃঃ ১৩৪-১৩৫

৫৬।      প্রাগুক্ত

৫৭।      টনি ক্লিফ, রাশিয়া: একটি মার্কসবাদী বিশ্লেষণ (লন্ডন, ১৯৬৪), পৃঃ ১৯৭-১৯৮

৫৮।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৮

৫৯।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪০

৬০।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৮

৬১।       প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৬

৬২।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৬

৬৩।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৪

৬৪।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭

৬৫।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৮-২৪৯

৬৬।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫০-২৫৪

৬৭।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৩-২৭৪

৬৮।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৩

৬৯।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৯-৩১০

৭০।      লিয়ন ত্রৎস্কি, দা রেভুল্যুশন বিট্রেইড, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৮

৭১।       কমেকন বøকের জাতীয় আয় নি¤েœাক্ত হারে বৃদ্ধি পায়: ১৯৫১-৫৫, ১০.৮%; ১৯৫৬-৬০, ৮.৫%; ১৯৬১-৬৫, ৬%; ১৯৬৬-৭০, ৭.৪%; ১৯৭১-৭৫, ৬.৪%; ১৯৭৬-৮০, ৪.১%; ১৯৮১-৮৫, ৩%; ১৯৮৬-৮৮, ৩%। ঝঃধঃরংঃরপলবংশরর বুযবমড়ফহরশ ংঃৎধহ- ঈযষবহড়া ংড়াবঃধ বশড়হড়সরপযবংশড়র াুধরসড়ঢ়ড়হড়ংযবপযর (মস্কো, ১৯৮৯) পৃঃ ১৮।

৭২।      ফিনানসিয়াল টাইমস, ১২ মে ১৯৯২।

৭৩।      এল ত্রৎস্কি, রচনাবলী ১৯৩৩-৩৪, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ১০২-১০৩।

৭৪।      এম হাইয়ানস, ‘শ্রেণী ও সংকট: পূর্ব ইউরোপের রূপান্তর’, ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিজম ৫৪, বসন্ত ১৯৯২, পৃঃ ৪৬-৪৭।

৭৫।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯০

৭৬।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯

৭৭।      টনি ক্লিফ, রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ২২১-২২২

৭৮।      টনি ক্লিফ, ‘ফিফটি ফাইভ ইয়ারস আ রেভুলুশ্যারি’, সোশ্যালিস্ট রিভিও ১০০, মে ১৯৮৭

৭৯।      দেখুন, উদাহরণ হিসেবে, ই মেন্ডেল, লেইট ক্যাপিটালিজম (লন্ডন, ১৯৭৫)

৮০।      টনি ক্লিফ, ‘চক চক করলেই সোনা হয় না’, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ২৪-৩৭

৮১।       জে স্ট্রেচি, প্রগতির জন্য কর্মসূচী (লন্ডন, ১৯৪০), পৃঃ ২১০-২১১

৮২।      এ ক্রসল্যান্ড, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (লন্ডন ১৯৫৬)

৮৩।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৭

৮৪।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২-৩৩

৮৫।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩

৮৬।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২০-৫২২

৮৭।      দেখুন টনি ক্লিফ, ‘স্তালিনিয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ১২১-১২২

৮৮।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২১-১২৫

৮৯।      টনি ক্লিফ, ‘স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতির জন্য প্রেক্ষাপট’, সোশ্যালিস্ট রিভিও, মার্চ ১৯৫৭, পুনর্মুদ্রিত, টনি ক্লিফ, ওয়াশিংটনও নয় মস্কোও নয়, ড়ঢ় পরঃ,পৃঃ ১০১-১০৭

৯০।      উদ্ধৃতিকৃত প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১

৯১।       এফ স্টার্নবার্গ, ক্যাপিটালিজম এন্ড সোশ্যালিজম অন ট্রায়াল (লন্ডন, ১৯৫১), পৃঃ ৪৩৮

৯২।      কার্ল মার্কস, পুঁজি, খন্ড তিন, অধ্যায় ৩০: ‘মানি ক্যাপিটাল এন্ড রিয়াল ক্যাপিটাল’ (মস্কো, ১৯৫৯), পৃঃ ৪৮৪

৯৩।      টনি ক্লিফ, ‘স্তালিনিয় রাশিয়ার শ্রেণী চরিত্র’, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ১২১-১২৫; টনি ক্লিফ, ওয়াশিংটনও নর মস্কোও নয়, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ১০৬-১০৭

৯৪।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭

৯৫।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭

৯৬।      প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭

৯৭।      ফিনানসিয়াল টাইমস, ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮

৯৮।      স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতির বিকাশে আরো বৃহদায়নের পদক্ষেপ নেন মাইক কিড্রন এবং ক্রিস হারম্যান। দেখুন এম কিড্রন, ওয়েস্টার্ন ক্যাপিটালিজম সিন্স দা ওয়ার (লন্ডন, ১৯৭০) এবং একটি স্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতি (লন্ডন, ১৯৮৯), এবং সি ক্রিসম্যান, সংকটের ব্যাখ্যায়ন (লন্ডন, ১৯৮৪)

৯৯।      আর সি নর্থ, কুয়োমিংটাং এন্ড চাইনিজ কমিউনিস্ট এলিটস (স্ট্যানর্ফোড, ১৯৬২), পৃঃ ৩২

১০০।     এইচ আর আইজ্যাকস, চীন বিপ্লবের ট্র্যাজেডি (লন্ডন, ১৯৩৮), পৃঃ ৩৩৩

১০১।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯৪

১০২।     ওয়ার্লড নিউজ এন্ড ভিউজ, ২২ এপ্রিল, ১৯৩৯

১০৩।     এস জেলডার, চীনা কমিউনিস্ট (লন্ডন, ১৯৪৬), পৃঃ ১২৬৭

১০৪।     দেখুন কমিউনিস্ট ইশতেহার, চুনকিংয়ে প্রকাশিত, ২৩ নভেম্বর ১৯৩৮, নিউ ইয়র্ক টাইমস এ রিপোর্টকৃত, ২৪ নভেম্বর ১৯৩৮

১০৫।     এইচ আর আইজ্যাকস, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৪৫৬

১০৬।     নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি, ১১ জানুয়ারি ১৯৪৯

১০৭।     প্রাগুক্ত, ৩ মে ১৯৪৯

১০৮।     নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৫ মে ১৯৪৯

১০৯।     সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯

১১০।     সি রাইট, লিসেন ইয়াংকি, (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬০), পৃঃ ৪৭

১১১।     পি এ ব্যারান, রিফ্লেক্সনস অন দা কিউবান রেভ্যুলিউশন (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬১), পৃঃ ১৭।

১১২।     দা কমিউনিস্ট পার্টি অব কিউবা, দা পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টির অনেক বিভ্রান্তি আছে। এটি ১৯৩৯ ও ১৯৪৬এর মধ্যকার বাতিস্তার শাসনকে সমর্থন দেয়। এটির বাতিস্তার প্রথম মন্ত্রিসভায় দুটি মন্ত্রীসহ অংশ নেয়। ১৯৪৪এ কমিউনিস্ট পত্রিকা ঐড়ু বাতিস্তাকে অভিহিত করে এভাবে: জনগণের আইডল, আমাদের জাতীয় পলিসিসমূহের মহান ব্যক্তিত্ব, একজন মানুষ যিনি নয়া কিউবার পবিত্র সংস্কার কর্মসূচীসমূহকে মূর্তিমান রূপ দেন’। কাস্ত্রোকে ঘোষণা করা হয় একজন পেটিবুর্জোয়া অভিযাত্রিক হিসেবে। যেমনটি উপরে উদ্ধৃত, কমিউনিস্টগণ এপ্রিল ১৯৫৮এর ধর্মঘটে সহায়তা করেনি। ২৮ জুন ১৯৫৮এর শেষ পর্যন্ত তারা বাতিস্তা থেকে মুক্তি পেতে দুর্বলভাবে ‘স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক নির্বাচন’এর পক্ষে উকালতি করে। দেখুন পি এ ব্যারান, ড়ঢ় পরঃ

১১৩।     ১৯৬১এর ১ ডিসেম্বরে ক্যাস্ত্রোর বক্তৃতা, ‘এল মুনদো লা হাবানা’, ২২ ডিসেম্বর ১৯৬১

১১৪।     চে গুয়েভারা, ‘কিউবা: এক্সসেপশনাল কেইস?’, মানস্থলি রিভিও (নিউ ইয়র্ক), জুলাই-আগস্ট ১৯৬১, পৃঃ ৫৯

১১৫।     টি ড্র্যাপার, ‘ক্যাস্ত্রো’স কিউবা। আ রেভুলুশ্যন বিট্রেইড?’, এনকাউন্টার (লন্ডন), মার্চ ১৯৬১

১১৬।     চে গুয়েভারা, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ৬৩

১১৭।     এল ত্রৎস্কি, স্থায়ী বিপ্লব (নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৮), পৃঃ ২৭৮

১১৮।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৯

১১৯।     টি ক্লিফ, ‘ডিফলেক্টেড পারমানেন্ট রেভুলুশন’, ইন্টারনাশন্যাশ সোশ্যালিজম ১২ (প্রথম সিরিজ) এ প্রথম প্রকাশিত, বসন্তকাল ১৯৬৩

১২০।     এইভাবে, উদাহরণস্বরূপ ভারতে একটি জরিপের কথা উল্লেখ করা যায় যাতে দেখা গেছে যে লাক্ষেèৗ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ এবং ১৯৫৩এর মধ্যে মানবিক, বিজ্ঞান, বানিজ্য ও আইনে মাস্টার্স ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শতকরা পঁচিশ জন বেকার ছিল ১৯৫৭-তেও। জরিপে আরো রিপোটকৃত হয় যে উদারনৈতিক মানবিকের শতকরা ৪৭ জন, বিজ্ঞানের শতকরা ৫১.৪ জন, বানিজ্যের শতকরা ৭ জন, এবং শিক্ষাবিজ্ঞানের শতকরা ৮৫.৭ জন ছাত্রছাত্রী বলে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে যায় সরকারি চাকুরির জন্য দরকারি যোগ্যতা করতে। ডিগ্রিধারীদের প্রায় শতকরা ৫১ জন উপসংহার টানে যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা হলো ‘সময়ের অপচয়’। এম ভেইনার, পার্টি পলিটিকস ইন ইনডিয়া (প্রিন্সটন, ১৯৫৭), পৃঃ ৮-১০

১২১।     ভি আলভা, ‘দা মিডল ক্লাস রেভুলুশন’, নিউ পলিটিকস (নিউ ইয়র্ক), উইন্টার ১৯৬২, পৃঃ ৭১

১২২।     জি ডি ওভার স্ট্রিট ও এম উইন্ডমাইলার, কমিউনিজম ইন ইন্ডিয়া (বার্কলি এন্ড লস এঞ্জেলেস, ১৯৫৯), পৃঃ ৫৪০

১২৩।     প্রাগুক্ত, পৃঃ৩৫৮

১২৪।     জি কোলকো, দা পলিটিকস (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৮) পৃঃ ৭৭

১২৫।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৭

১২৬।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৮

১২৭।     আই বায়ারচল, বেইলিং আউট দা সিস্টেম (লন্ডন, ১৯৮৬), পৃঃ ৩৯-৪০

১২৮।     জি কোলকো, ড়ঢ় পরঃ,পৃঃ ৯৫

১২৯।     পি ব্রোউও, ‘দা ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি, দা ওয়ার এন্ড দা রেভুলুশন’, রেভুলুশনারি হিস্টোরি, ¯িপ্রং ১৯৯৫, পৃঃ ১১১

১৩০।     পি গিন্সবার্গ, আ হিস্টোরি অব কন্টেম্পোরারি ইটালি (লন্ডন, ১৯৯০), পৃঃ ২২

১৩১।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৪

১৩২।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৮

১৩৩।     পি ব্রোউও, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ ১১২

১৩৪।     পি গিন্সবার্গ, ড়ঢ় পরঃ, পৃঃ৪২-৪৩

১৩৫।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২

১৩৬।     ডনি গøাকেস্টেইনের বারবারিজম: নাজি কাউন্টার রেভুল্যুশন, ক্যাপিটালিজম এন্ড দা ওয়ার্কিং ক্লাস (লন্ডন, ১৯৯৯), এই পুস্তকটির ওপর ভিত্তি করে এই অংশটি লিখিত

১৩৭।     টনি ক্লিফ, লেনিন: রেভুল্যুশন বিসিজড (লন্ডন, ১৯৮৭), পৃঃ ২১৬-২১৮

১৩৮।     টনি ক্লিফ, ত্রৎস্কি: দা ডার্কার দা নাইট দা ব্রাইটার দা স্টার, ড়ঢ় পরঃ, গৃঃ ১৫৫

১৩৯।     প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৬

১৪০।     এল ত্রৎস্কি, দা ডেথ এগোনি অব ক্যাপিটালিজম এন্ড দা টাস্কস অব দা ফোর্থ ইন্টারন্যাশনাল (লন্ডন, ১৯৮০)

১৪১।     কে মার্কস ও এফ এঙ্গেলস, সংগৃহিত রচনাবলী, খন্ড ১১ (মস্কো, ১৯৭৯), পৃঃ ১৮৫। উদ্ধৃতিটি সেক্সপিয়ারের হেমলেট, এক্ট ১, দৃশ্য ৫ থেকে।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি