জায়নবাদকে বিরোধীতার দশটি কারণ মূল: জন রোজ অনুবাদ: স ম আজাদ

 জায়নবাদকে বিরোধীতার দশটি কারণ

মূল: জন রোজ অনুবাদ: স ম আজাদ

[লেবাননে আগুন জ্বলছে। মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের দোসর ইজরাইল সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।  এই ইজরাইলী রাষ্ট্রের সরকারী ভাবাদর্শ হচ্ছে জায়নবাদ। এই ভাবাদর্শ  বরাবরই  ইহুদী ও আরব উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই ধ্বংসাত্মক।  মধ্য প্রাচ্যে একসময় আরব ও ইহুদী সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ইতিহাস ছিল। এই ইতিহাসকে জায়নবাদ অস্বীকার করে। জায়নবাদ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট। এটি বুঝতে জন রোজ লিখিত Ten Reasons to Oppose  Zionism নিবন্ধটি আমাদের কিছুটা সহায়তা করবে বলে আশা করি। এই নিবন্ধটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত  সাপ্তাহিক  Socialist Worker পত্রিকার  ২৯শে জুলাই, ২০০৬ তারিখে প্রকাশিত হয়। জন রোজ The Myths of Zionism গ্রন্থের লেখক। ]

১. জায়নবাদ দাবী করে যে একচেটিয়া ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদীদের অধিকার রয়েছে তাদের ভূমিতে ফেরার যেখানে তাদের ধর্ম জুদাইজমের শেকড় রয়েছে।
২. মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক তিনটি বৃহৎ একেশ্বরবাদী ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হচ্ছে ফিলিস্তিনি ভূমি। এই ধর্ম তিনটি হচ্ছে জুদাইজম, খ্রীস্টান ও ইসলাম। তাদের কেউই এই ভূমির একমাত্র দাবীদার হতে পারে না।
৩. জায়নবাদ দাবী করে যে সত্তর খ্রীস্টাব্দে  রোমান সাম্রাজ্য  ইহুদী মন্দির ধ্বংস করলে ইহুদীরা নির্বাসিত হয়। বাস্তবে ইতোমধ্যেই রোমান সাম্রাজ্যের যুগে অধিকাংশ ইহুদী ফিলিস্তিনের বাইরে বসবাস করছিল। সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে এবং তার বাইরেও ইহুদী বসতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মিশরের বৃহৎ বন্দর নগরী আলেকজান্দ্রিয়াতে একটি উন্নত ইহুদী ধর্মীয়, বানিজ্যিক ও হস্তশিল্প কেন্দ্র ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অনেক পূর্বেই।
রোমান সাম্রাজ্যের ৫০০ বছর পূর্বেই বেবিলনে ইহুদী ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল যা রোমান সাম্রাজ্যের পরেও একশ’ বছর টিকে ছিল। ইহুদী ইতিহাসের সত্যিকার ও গতিশীল ভিত্তি হচ্ছে অইহুদীদের সাথে ইহুদীদের বসবাস।
৪. জায়নবাদ দাবী  করে যে ইউরোপে ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা  এবং সেমিটিজম বিরোধীতার একমাত্র জবাব হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের অভিবাসন। এটি সেমিটিজম বিরোধীতা অনিবার্য হিসেবে দেখে।
৫.  খ্রীস্টিয় ইউরোপ ইহুদীদের নির্যাতন করে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক উভয়বিধ কারণে। বাইবেলীয় গল্পসমূহের খ্রীস্টান ভাষান্তরকে  জুদাইজম হুমকি দেয়।  কিন্তু মধ্য যুগে ইউরোপে ইহুদীদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তাদের ভূমি মালিক হওয়ার অনুমোদন ছিল না, কিন্তু তারা বদ্ধ সামন্ত অর্থনীতিগুলোকে বণিক ও সওদাগর হিসেবে সেবা করেছিল। ইউরোপের খ্রীস্টান শাসকগোষ্ঠী  তাদের ব্যবহার ও অপব্যবহার করতো। ইহুদীদের কখনো কখনো সুবিধা দেয়া হতো যা কৃষক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করতো। কিন্তু এর বাস্তবতা এই ছিল যে যখন শাসক গোষ্ঠীর নিজস্ব অত্যাচারে দাঙ্গা  ও ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটতো তখন ঐ ঘটনার বলির পাঠা হতো তারা।
৬.  Enlightenment এবং আঠারো শতকের মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবসমূহ সেমিটিজম বিরোধীতাকে পরাস্ত করার জন্য ভিত্তি যুগিয়েছে। এই বিপ্লবসমূহ ইহুদীদের জন্য আনুষ্ঠানিক সমাধিকার নিশ্চিত করেছিল। যদিও ইহুদীদের এই সমস্ত অধিকার বাস্তবায়নের জন্য  সংগ্রাম করতে হয়েছিল, তারপরেও তারা পশ্চিম ইউরোপে উন্নতি করতে শুরু করেছিল। মুক্ত জুদাইজম ও Enlightenment-এর মধ্যে  সৃজনশীল মিথষ্ক্রিয়া ঊনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথম দিকের ইউরোপ শ্রেষ্ঠতম মনিষীসমূহ তৈরী করেছিল। এরা ছিলেন কার্ল মার্কস, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও আলবার্ট আইনস্টাইন। ইউরোপীয় সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে  সমৃদ্ধ হয়েছিল এর ইহুদী অবদানসমূহ দিয়ে। 
৭. জায়নবাদের সত্যিকার ভিত্তি পূর্ব  ইউরোপ।  ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে রুশীয় জারদের ভঙ্গুর সাম্রাজ্যে বিশ্বের অর্ধেকের বেশী ইহুদী বসবাস করছিল। ইউরোপীয় আধুনিকায়ন এই সমস্ত সামন্ত শাসকবৃন্দকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। বিপ্লব তাদের উৎখাতের হুমকির সম্মুখীন করেছিল এবং ইহুদীরা বলির পাঠা হয়েছিল। ইহুদীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছিল জারগণ। ই্হুদীরা প্রধাণত পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকাতে অভিবাসিত হওয়া শুরু করেছিল।  কিন্তু একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশ জায়নবাদীদের ক্রমবর্ধমান আবেদনে সাড়া দিয়ে গিয়েছিল ফিলিস্তিনে। এই ইহুদীরা জায়নবাদী বসতি স্থাপনে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ  অংশ ছিল। জায়নবাদ ছিল  একটি ঔপনিবেশিক আন্দোলন যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কর্তৃক সমর্থিত ছিল।
৮. ঔপনিবেশিক সমাজবাদ বলতে কোন কিছু ছিল না। জায়নবাদী বসতি স্থাপনকারীরা  আরব কৃষকদের উৎথাত শুরু করেছিল, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমি চাষ করছিলেন। “Kibbutz communes" ছিল কেবলমাত্র ইহুদীদের জন্য। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য জায়নবাদও একটি প্রকল্প। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে  বিজয়ের ফলে  ব্রিটেন দখল করেছিল ফিলিস্তিন। এর শাসনকে নিষ্কন্টক করতে জায়নবাদী বসতি স্থাপন একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।
 
১৯২১ সনে  ঔপনিবেশিক সচিব হিসাবে উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘জায়নবাদ ইহুদীদের জন্য ভাল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্যও ভাল।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে ইসরাইলকে  সমর্থন দানকারী প্রধান শক্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮১ সনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট  রোনাল্ড রিগান ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সহ ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তি, এটি প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্য উপকারী। যদি ঐ শক্তিসহ ইসরাইল না থাকতো, তবে আমাদের নিজেদের থেকে এগুলো  সরবরাহ করতে হতো।’  বিশ শতকের শেষ নাগাদ ইসরাইলকে সহায়তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছিল ১০০ বিলিয়ন ডলার।
৯. ফিলিস্তিনে ইহুদীদের একচেটিয়া আবাসনের অধিকারের জন্য নাৎসি Holocaust কোন ভালো কারণ হতে পারে না।
১৯৪৮ সনে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা Holocaust-কে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। একই বছরে, ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিতে প্রায় ১ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়ী থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। অন্য কথায়, ইউরোপীয় গণহত্যার মূল্য দিতে বাধ্য করা হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের।
আদিবাসী আরব ফিলিস্তিনিদের এই উৎখাতের উপর নির্ভর করে ইহুদী রাষ্ট্র। এটিই চুড়ান্ত দুর্বলতা এবং ভুল পদক্ষেপ যা অবশ্যি মোকাবেলা করতে হবে যে কোন চিরস্থায়ী শান্তি চুক্তিতে। ফিলিস্তিনি ভূমিতে তাদের দস্যুতার যুক্তি হিসেবে জায়নবাদীরা Holocaust-কে ব্যবহার করে আদর্শিক নৈতিক ব্ল্যাকমেইলিং-এর জন্য। এটি হচ্ছে ইতিহাসে সংঘটিত নিকৃষ্টতম অপরাধগুলোর একটি স্মৃতির বিপদজনন্ডিতক অপব্যবহার। জায়নবাদ বাধা দেয় আরব ও ইহুদীদের মধ্যে একটি ন্যায় সঙ্গত চুক্তিতে। কিন্তু এরকম ধরণের একটি চুক্তি নিশ্চিতভাবেই সম্ভব।
১০. জায়নবাদী রাষ্ট্র সংগঠন একটি সত্যিকার শান্তিকে বাধা দেয়, কারণ এটি আরবদের বিনিময়ে ইহুদীদের সুবিধা দেয়। জায়নবাদী বসতি স্থাপনের পূর্বে আরব-ইহুদী সম্পর্ক অধিকতর উন্নত ছিল, এবং এই অতীত ইতিহাস থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। এমন কি দক্ষিণপন্থী এক পন্ডিত স্বীকার করেন যে ইসলামী সভ্যতার চুড়ান্ত পর্বে দুই সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে বিকাশমান সম্পর্ক ছিল এবং যৌথইসলামী-জুদায়ো’ সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল, যাকে তিনি ইসলামী আরব-ই্হুদী ‘symbiosis' অভিহিত করেন।
এবং আমরা এমনকি বিস্মৃত হয়েছি যে গত শতকে আরব ভূমিতে ইহুদী সংলগ্নতা কত গভীর ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইরাকে ব্রিটিশ পুতুল রাজতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণ-অভ্যুত্থান Al-wathbah (The Leap) সংঘটিত হয়েছিল।
অনেক তরুণ ইরাকি ইহুদী এতে অংশগ্রহণ করেছিল। এজন্য জায়নবাদীরা স্বীকার করেছিল যে এটি ছিল ভ্রাতৃত্বের যুগ যেখানে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের ধারণা খুবই দূরবর্তী’ মনে হয়েছিল।
হায়, আন্দোলন পরাজিত হয়েছিল। এবং তখন জায়নবাদীরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ ও ইরাকী সরকার ইরাকের প্রাচীন ইহুদী জনগণকে অভিবাসনে বাধ্য করতে সহায়তা করেছিল। এটি ছিল গত শতকের স্বল্পজানা ট্র্যাজেডিসমূহের একটি।
শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরাকের সেরা ১০০ জন সঙ্গীত শিল্পীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন ইহুদী। স্বল্পজ্ঞাত যৌথ আরবীয়-ইহুদীয় অতীত থেকেই আশার দ্যুতি বিদ্যমান। এই দ্যুতিই সাহায্য করতে পারে একটি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ভবিষ্যতের উপর আলো বিকিরণ করতে।

টাঙ্গাইল থেকে সাপ্তাহিক পূর্বাকাশ ২৭শে আগস্ট ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি