প্রাসঙ্গিকতা: এঙ্গেলসের ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র মূল: জ্যাক ফারমার অনুবাদ: স ম আজাদ
প্রাসঙ্গিকতা: এঙ্গেলসের ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
মূল: জ্যাক ফারমার অনুবাদ: স ম আজাদ
পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেন তাঁদের প্রত্যেকে অনুপ্রাণিত হন একটি অধিকতর ভাল, অধিকতর ন্যায়ানুগ সমাজের রূপকল্প দিয়ে। মার্টিন লুথার কিঙ্গের “স্বপ্ন”-এর পথে অকুপাই আন্দোলনের সমাবেশসমূহ পরিকল্পনা করে সংগঠিত করতে অধিকতর গণতান্ত্রিক রূপসমূহ প্রদর্শনের, বিপ্লবী মিশরে কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়াই কর্মক্ষেত্র পরিচালনে, ছাত্রদের ঘেরাওয়ের কার্যক্রমে যেখানে জনগণ কেবলমাত্র হতাশ নন- তাঁরা দুনিয়াকে ভিন্নভাবে সংগঠিত করার পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করেন।
পুঁজিতন্ত্রের বর্বরতা প্রত্যাখ্যানকারী জনগণের একটি দীর্ঘ এবং গৌরবময় ইতিহাসের অংশ হল এই ধরনের ধারণাসমূহ। ফেড্রেরিখ এঙ্গেলসের পুস্তিকা সমাজতন্ত্র: ইউটোপিয় এবং বৈজ্ঞানিক, এটিতে তিনি সারসংক্ষেপিত করেন এবং সমালোচনা করেন সবচেয়ে পরিশীলিত চিন্তাবিদদের কয়েকজনকে, যারা শিল্প বিপ্লবের নিষ্ঠুরতাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সমাজকে সংগঠিত করতে ভিন্ন পন্থার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কোঁতে দি সেন্ট-সাইমন, চার্লস ফুরিয়ের এবং রবার্ট ওয়েন প্রভৃতি চিন্তকদের এঙ্গেলস “ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রী” হিসেবে অভিহিত করেন। ১৭৮৯-এ শুরুকৃত ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা এই তিনজন বিপুলভাবে প্রভাবিত হন। ফরাসি বিপ্লব বুর্জোয়া অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক শ্রেণীকে পুরাতন অভিজাত শ্রেণীর বিপরীতে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। কিন্তু এটি সংঘটিত হয় জনসমর্থন সংগঠিত করে এবং মুক্তি ও সমতাবাদের র্যাডিক্যাল ধারণাবলীকে অবারিত করে।
এঙ্গেলস লেখেন: “ব্প্লিব ছিল সুবিধাভোগী অলস শ্রেণীসমূহ, অভিজাতবৃন্দ ও পুরোহিতদের বিরুদ্ধে তৃতীয় এস্টেটের বিজয়, অর্থাৎ জাতির বিপুল জনগণের, যারা উৎপাদন ও ব্যবসায়ে কাজ করে। কিন্তু তৃতীয় এস্টেটের বিজয় শীঘ্রই এটিকে সম্পূর্ণরূপে এই “এস্টেট”-এর একটি ক্ষুদ্রতর অংশের বিজয় বলে প্রতিভাত হয়, অর্থাৎ এর সামাজিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ অর্থাৎ সম্পত্তিবান বুর্জোয়া শ্রেণীর বিজয় হিসেবে।”
সেইন্ট-সাইমনের যুক্তিসমূহ বিকশিত হয় “নিষ্কর্মাদের” অর্থাৎ অলস উচ্চতর শ্রেণীসমূহের ওপর আক্রমণ হিসেবে। তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন “শ্রমিকদের” ফ্যাক্টরি মালিক মালিকদের এবং এমনকি তাঁদের কর্মচারীদের। তাসত্ত্বেও, তাঁর প্রধান সহানুভূতি বিদ্যমান ছিল দরিদ্রদের প্রতি।
চার্লস ফুরিয়ের প্রথম দিককার পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের অবস্থাবলীর প্রতি অধিকতর আইনিক (forensic) মনোভঙ্গি নিয়েছিলেন। তিনি আলোকায়নের আদর্শসমূহ (enlightenment ideals) ও মার্জিত আচরণের (civilised behaviour) অভিভাবকত্বের ভানকারী বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্চমনা বুলিবাগিশীকে নির্দয়রূপে তুলনা করেন সেই জীবনের সঙ্গে যেটি আদতে ছিল অধিকাংশ জনগণের । তিনি ইতিহাসকে দেখেন বিভিন্ন পর্যায়সমূহ- আদিম সমাজ থেকে বর্বরতা, গোষ্ঠীতন্ত্র (The patriarchate), এবং সভ্যতা অর্থাৎ পুঁজিতন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহমানরূপে। দার্শনিক হেগেলের মত তিনি যুক্তি দেন যে ইতিহাস দ্বন্দ্বসমূহ (contradictions) দ্বারা অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। পুঁজিতন্ত্র যুগপৎ ঝলমলে সম্পদ এবং নিষ্পেষিত দারিদ্র্য তৈরী করে এমন একটা মাত্রায় যে ফুরিয়ের যুক্তি দেন যে “সভ্যতার অধীনে স্বয়ং অতি-প্রাচুর্য থেকে দারিদ্র্য জন্ম নেয়।”
রবর্ট ওয়েন ছিলেন একজন ফ্যাক্টরি মালিক। তাই শোষণ প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে তাতে তিনি দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করেন যে ফ্যাক্টরি শ্রমিকেরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সম্পদ উৎপাদন করা সত্ত্বেও তাঁরা দুর্দশাগ্রস্থ জীবন যাপন করেন, কারণ পুঁজিপতি শ্রেণী উদ্বৃত্ত শোষণ করে নেয়।
ওয়েন যুক্তি দেন যে এটি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণী যারা পুঁজিতন্ত্রের অধীনে ঐ সম্পদ তৈরী করেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি, কারণ এর অর্থ হল যে শ্রমিকেরা কেবলমাত্র দুর্ব্যবহারের নিষ্ক্রিয় গ্রহিতাই নয়, আদতে একটি শক্তি যা ধারাবাহিকভাবে পুঁজিতন্ত্রের পুনরুৎপাদন করে তাঁদের শ্রমের মাধ্যমে। যদি তাঁরা তা করতে পারে, তবে পুঁজিতন্ত্রকে সশব্দে থামিয়ে দেবার শক্তিও তাঁদের আছে।
দরিদ্র ও শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষ নেবার কারণে সেইন্ট-সাইমন, ফুরিয়ের ও ওয়েন একটি বিকল্প সামাজিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চাইছিলেন। সুতরাং ওয়েন চমৎকারভাবে নিউ ল্যানার্কে একটি কটন মিল স্থাপন করেন, যেখানে শ্রমিকেরা ভাল বেতন পেত, এবং ছেলেমেয়েদের জন্য মান সম্মত শিক্ষায় এবং সামাজিক আবাসনে প্রবেশাধিকার ছিল। সমস্যা হলো এই যে এ ধরনের প্রকল্পসমূহ শেষ হয় সমস্যাবলীর (evils) পুনরুৎপাদনে যেগুলো তাঁরা প্রতিরোধে সচেষ্ট ছিলেন। ওয়েনকে তখন পর্যন্ত মুনাফা করতে হতো এবং তিনি শীঘ্রই বুঝতে সক্ষম হলেন যে তাঁর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও , “মানুষজন হলো আমার দয়ার ক্রীতদাস”।
ব্যবস্থা (system) সম্পর্কে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীদের সমালোচনাকে এঙ্গেলস স্বাগত জানান, কিন্তু তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তাঁদের বিশ্লেষণকে আরো এগিয়ে নিয়ে এটা দেখাতে যে কীভাবে শ্রমিকশ্রেণী শ্রেণীসমাজ ভাঙ্গতে কাজ করতে পারে। এটা দেখানো যথেষ্ট নয় যে ব্যবস্থাটি অযৌক্তিক এবং অন্যায় (irrational and unfair) এটি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, তা দেখাতে সমাজতন্ত্রীদের সামর্থ্য থাকতে হবে। শ্রমিকদের ক্ষমতা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের কেন্দ্রে নিহিত, অন্য কোথাও একটি আদর্শ বিকল্প তৈরীর প্রচেষ্টাতে নয়।
যখন তিনি নিজেকে প্রথম দিককার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং চার্টিস্ট অভ্যুত্থানে নিয়োজিত রাখেন, তখন ওয়েন আবিষ্কার করেন যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সংগঠিত করতে র্যাডিক্যাল গণতান্ত্রিক রূপের জন্য শ্রমিকশ্রেণী যৌথ কেন্দ্রিকতার বীজ বপন করে। শ্রমিকশ্রেণীর স্বয়ং-কার্যক্রমে, মার্কস ও এঙ্গেলস প্রত্যক্ষ করেন পুঁজিতন্ত্রের বস্তুগত অবস্থাবলী এবং একটি সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আদর্শের মধ্যকার সেতুবন্ধন।
গণতন্ত্র ও মুক্তির আদর্শাবলী রক্ষা করার অর্থে মার্কসবাদীরা ভাববাদী, যা পুঁজিতন্ত্র পদ্ধতিগতভাবে তুলে ধরতে অক্ষম, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমরা বস্তুবাদী এই অর্থে যে আমরা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোর গভীরে সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা দেখি।
এই কারণে এঙ্গেলস ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীদের মুক্তিকামী রূপকল্পকে প্রশংসা করেন, একই সঙ্গে কীভাবে পুঁজিতন্ত্রকে পরাভূত করা যাবে এ সম্পর্কে তাঁদের বিমূর্ত ধারণাসমূহকে তীক্ষ্মভাবে সমালোচনা করেন।
সৌন্দর্যময় দীবা স্বপ্নের ক্ষমতা দিয়ে সমাজকে রূপান্তর করা যায় না, কিন্তু সফলতাও আশা করা যায় না তা বাদ দিয়ে।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত মাসিক সোস্যালিস্ট রিভিউয়ের এপ্রিল ২০১৩ থেকে অনুদিত।
টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পূর্বাকাশ ২২শে ডিসেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন