সাম্রাজ্যবাদের শেষ দিনগুলি মূল: ডেভিড হারভে অনুবাদ: স ম আজাদ
সাম্রাজ্যবাদের শেষ দিনগুলো
মূল: ডেভিড হারভে অনুবাদ: স ম আজাদ
আমার পদ্ধতি হচ্ছে শক্তির দুটো উৎসের মধ্যে
উত্তেজনার ফলাফল হিসেবে সাম্রাজ্যবাদকে দেখা। একটি হচ্ছে ভূখন্ডগত উৎস, যা নিহিত
থাকে রাষ্ট্রীয় সংগঠনে। আর একটি শক্তির পুঁজিতান্ত্রিক যুক্তি (capitalist logic
of power) যা হচ্ছে অর্থ, সম্পদ এবং পুঁজির প্রবাহ ও সঞ্চালন।
আমি জোরালোভাবে বলি যে, আপনারা একটিকে আর একটিতে
রূপান্তরিত করতে পারেন না। দুটি সম্পূর্ণভাবে একে অপরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ- এই
বিশ্বাসটি করে কখনো কখনো ভুলসমূহের মধ্যে ভুল করা হয়।
বাস্তবে তারা একে অপরকে সহযোগিতা করে এবং কখনো একে
অপরের বিরুদ্ধে যায়- এবং সর্বদা তারা উত্তেজনার মধ্যে থাকে; যা সাম্রাজ্যবাদ তৈরী
করে সেই সাধারণ ধারণা যেটি আমাদের বাস্তবিকই প্রয়োগ করা দরকার প্রতিটি ঐতিহাসিক ও
ভৌগলিক মুহুর্তে বিশেষ অবস্থা বিশ্লেষেণের জন্য।
আপনারা লেনিন ও বুখারিনের লেখায় উত্তর খুঁজে পাবেন
না। তাঁদের সময় ও অবস্থা সম্পর্কে উনারা যা বলেছিলেন তা পড়তে চমৎকার। কিন্তু
আমাদের সমসাময়িক অবস্থা বিশ্লেষণের জন্য তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করতে হবে।
আমি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য
করতে চাই, যার রয়েছে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে থেকে ভিন্ন চরিত্র।
প্রায় ১৮ মাস পূর্বে একটি বক্তৃতাতে জর্জ বুশ
সবচেয়ে পরিষ্কার নির্দেশনাসমূহের একটি দিয়েছিলেন এর উপর। তিনি বলেছিলেন, তিনি
নিজেকে আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের একটি লম্বা সারির উপর দাঁড়ানো দেখেন- উইড্রো উইলসন
হয়ে ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট এবং রোনাল্ড রিগান।
আমেরিকান কর্মকান্ডের একটি গভীর ধারাবাহিকতা আছে
বাদবাকী বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আমার বন্ধু Neil Smith সম্প্রতি যার
একটি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর ‘The End Game of Globalisation’ নতুন
বইতে। Neil দেখিয়েছেন যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কৌশল সবসময়ই বৈশ্বিক।
মার্কিনীদের কখনো কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলসমূহের ওপর
আগ্রহ ছিল না। তাদের সর্বদাই আগ্রহের বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক-শক্তি। আমাদের দেখতে হবে
সেইসব ঘটনাবলীর মধ্যে যা উম্মোচিত করে একটি বৈশ্বিক শাসন-ক্ষমতা গঠনের প্রচেষ্টা;
যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট কেন্দ্রে আসীন এবং ঘটনাবলী নিয়্ন্ত্রণে সক্ষম।
১৯২০-এর দশকে এটি কীভাবে কাজ করেছিল তা দেখতে একটি
বিশেষ দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়াতে মেরিন সেনা
পাঠিয়েছিল এবং এই দেশটি দখল করতে চেষ্টা করেছিল। তারা
এক প্রকারের গেরিলা যুদ্ধের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল। সুতরাং
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একটি কৌশল মেনে চলতে, যা খুবই পরিচিত
হয়েছিল। তারা স্থানীয় একটি strongman খুঁজে পেয়েছিল, এই ক্ষেত্রে লোকটি ছিল
সমোজা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে দরকারী আর্থিক ও সামরিক সাহায্য এবং
যত খুশী ধনী হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল; যতদিন পর্যন্ত দিন মার্কিন পুঁজির আদেশ মান্য এবং মার্কিনীদের সহায়তা
করেছিলেন তাদের কৌশলগত স্বার্থগুলোর ক্ষেত্রে, যাতে বিপ্লবী আন্দোলন ঠেকানো যায়।
স্নায়ু যুদ্ধ
এই ধরনের পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া, যা মৌলিক ধরনের তা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জারি রেখেছিল বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এটি ছিল
পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় বিশেষ বাহিনীসহ
নিচু মাত্রার গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত থাকতো।
স্নায়ু যুদ্ধের সময় একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না,
তা নিয়ন্ত্রণ করতো কমিউনিস্ট ব্লক। স্নায়ু যুদ্ধের পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য
কিছু আগ্রোহোদ্দীপক উভয় সংকট সৃষ্টি করেছিল। স্নায়ু যুদ্ধের অনুপস্থিতিতে এর কৌশল
কীভাবে কাজ করতে পারতো? মৌল শত্রুর অনুপস্থিতিতে এটি কীভাবে কাজ করতে পারতো যা বহু
ইউরোপীয় দেশকে এর দাবী ও প্রয়োজনীয়তার কাছে বেঁধে রাখতো? এটি মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদী চর্চাকে পুনর্মূল্যায়নের দিকে ধাবিত করে।
অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করতো যে উৎপাদন, অর্থ,
সামরিক শক্তি অথবা সংস্কৃতির মাধ্যমে আধিপত্য করে এক ধরনের হেজিমনি (প্রতিদ্বন্দ্বী
রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্য বা নেতৃত্ব) নির্মাণ করা যায়। যাহোক আমরা এমন একটি
অবস্থানে আছি যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে আধিপত্যবাদী, কিন্তু আর
হেজমনিক নয়।
আমি প্রস্তাব করতে চাই যে এটি খুবই বিপজ্জনক অবস্থা, কারণ এটি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক শক্তি ব্যবহারের দিকে প্রলুব্ধ করে যাতে করে এটি যে
আর হেজেমনিক নয় তা বোঝাতে চেষ্টা করে।
কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার হেজিমনি হারিয়েছে। বিশ্ব
উনৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি আর হেজেমনিক নয়। ১৯৪৫ সালে উৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রাধান্য ছিল। কিন্তু মধ্য ১৯৬০-এর দশক এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে এই
প্রাধান্য হারাতে শুরু করে। ১৯৮০-এর দশক নাগাদ বিশ্বের অধিকাংশ উৎপাদন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সমস্ত বড় বড় ইস্যুর
সম্মুখীন হয়েছে তাতে মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব আমরা খুব স্পষ্ট দেখতে
পাই, যেমন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায়।
চীনে মার্কিন করপোরেশনগুলো খুবই জড়িত। গত বছর জেনারেল মোটর
একমাত্র যে জায়গাতে মুনাফা করেছিল, তা হচ্ছে চীন। সুতরাং ওয়ালমার্ট ও ও জেনারেল
মোটরের মত মার্কিন করপোরেশনগুলোর চীনকে দরকার। একই সময়ে চীন অন্যান্য ক্ষেত্রে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে।
একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদনের ওপর আধিপত্য হারালে
ভেবেছিল যে তারা ফিনান্সের মাধ্যমে আধিপত্য করতে পারবে। মূলগতভাবে ১৯৮০ সালের পরে
সবকিছুর অর্থায়ন (financialisation) ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন কৌশল। এর উদ্দেশ্য
ছিল অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, মার্কিন ট্রেজারি, ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি
ফান্ড (IMF) বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আধিপত্য বিনির্মাণ।
এটি সেই অভিযোগের দিকে ধাবিত করে এবং তা খুবই সফলতার সাথে।
কিন্তু যেহেতু ক্ষেত্রটি চুড়ান্তভাবে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাই আমরা দেখলাম
১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব ফিনান্সের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে মার্কিন আধিপত্য হ্রাস। বিশ্বে
এখনো মার্কিন করপোরেশনগুলোর মত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ খুবই ক্ষমতাধর ও
তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ঋণ
বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে। এর বড় অংশ এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের নিয়ন্ত্রণে।
অনিবার্য পরিণতি
সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা (financial
power) সরে যেতে শুরু করেছে। আমরা খুবই কৌতুলোদ্দীপক সন্ধিক্ষণে পৌঁছাচ্ছি যেখানে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা মুনাফার পরিমাণ মোটামুটিভাবে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া
মুনাফার কাছাকাছি। অন্য কথায় ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে সবকিছুর অর্থায়ানের (financialisation)
সার্বিক লাভ ধীরে ধীরে একটা পর্যায় পর্যন্ত হ্রাস পায় যাতে কর শুষে নেয়ার পরিবর্তে
বাদবাকী বিশ্বকে পরিশোধ করতে হয়। কাজেই ফিনান্সের ক্ষেত্রে পূর্বের মত মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের আর আধিপত্য নেই। এর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (financial imperialism)
ক্ষয় পেতে শুরু করেছে। তাতে আর অবশিষ্ট থাকে সামরিক সাম্রাজ্যবাদ। তা সেই প্রশ্নের
মুখোমুখি করে- কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে সমরবাদী হলো এবং কেন এটি যেভাবে
ইরাকে গেল, সেভাবেইবা গেল কেন? এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা। আমরা জানি যে কতগুলো ক্ষেত্রে ক্ষমতা রক্ষা
করতে কিছু বহিঃশত্রুর ধারণার চারপাশে নিজের সংহতি নির্মাণ করা দরকার।
ওসামা বিন লাদেন এলেন এবং তাই দিলেন, যা মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধের ধারণার দিকে ধাবিত করে।
অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণভাবে ফাটল শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের
শেষের দিকে অর্থনৈতিক বুদ্বুদ বিদীর্ণ হওয়ার পর। ঐ সমস্ত বুদ্বুদ মিলিয়ে যাওয়ার পর
আপনি পেলেন এনরনের মত কেলেংকারিগুলো এবং অনেক অভ্যন্তরীণ ধ্বংসাত্মক বিষয়সমূহ চলতে
দেখলেন। নয়া-উদারনীতিবাদীগণ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন এবং এটা
করার অনেকগুলো পথ ছিল, এর মধ্যে একটি হল বহিঃশত্রু থাকা। ইরাক যুদ্ধের দ্বিতীয়
কারণ তেল। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিভোগকৃত তেল নয়, সঙ্গে সঙ্গে
প্রধান তেল উৎপাদনকারী এলাকাতে সামরিক অবস্থান নেয়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন