কোনো রোগ কেন ভাইরাল হয়? মূল: লী হাম্বার অনুবাদ: স ম আজাদ

কোনো রোগ কেন ভাইরাল হয়?

মূল: লী হাম্বার

অনুবাদ: স ম আজাদ


[লী হাম্বার দেখান যে করোনা ভাইরাস মহামারীর সত্যিকার উৎস বিদ্যমান খাদ্য শিল্পের অভ্যন্তরে।]


ভাইরাস জনিত রোগ বিরল নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের মতানুসারে কয়েক বছরের মধ্যে এ বছরের ফ্লু মৌসুম সবচেয়ে খারাপ। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯ মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয়, হাসপাতালে যায় ১,৮০,০০ জন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১০,০০০ জন।

২০১৮-১৯ সনের শীতে ফেব্রুয়ারি নাগাদ যুক্তরাজ্যে ফ্লু ভাইরাসের স্ট্রেইনে ২০০ জনের বেশী মারা যায়। ২,০০০-এর বেশী ছিল ক্রিটিক্যাল কেস, যদিও আপেক্ষিকভাবে অল্প সংখ্যক মানুষ এটির সংস্পর্শে এসেছিল। এর অর্থ হলো ভাইরাস আরো ভয়াবহ ক্ষতিকর হয়েছে। যে মানুষেরা আগে সুস্থ এবং ভালো ছিল, তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

 ২০১৭-১৮-এর শীতে যুক্তরাজ্যে ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৬০ জনের বেশী মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আর বিপুল সংখ্যক মানুষকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা করা হয়।

বৈশ্বিকভাবে এর প্রথম বছরে H1N1 (২০০৯) ফ্লুর স্ট্রেইনে ২০০৯-১০-এ ৫,৭৯,০০০ জন মারা যায়, যদিও এটা পূর্বানুমানের থেকে কম ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় যা ধারণা করা হয়েছিল এটি তার থেকে পনেরো গুণের বেশী রোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে জটিলতা তৈরী করেছিলো। নয় দিনের কম সময়ে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল। একুশ শতকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ব্যাপী একটা স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হলো গুরুতর ফ্লু মহামারি। এটিই হল প্রেক্ষাপট যার ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বুঝতে হবে, যেটি চীনে শুরু হয়েছিলো। আমরা এমন একটা দুনিয়াতে বাস করি যাতে মারাত্মক ভাইরাস জনিত মহামারির ঝুঁকি বিদ্যমান।
 
করোনাভাইরাস (CoV)গুলো হলো ভাইরাসসমূহের একটি বড় পরিবার। এটি মামুলি ঠান্ডা থেকে মিডল ইস্ট রেসপিরাটরি সিন্ড্রোম (MERS) ও সিভায়ার অ্যাকিউট রেসপিরাটরি সিন্ড্রোম (SARS)-এর মত মারাত্মক রোগের কারণ ঘটায়। তারা জুনুটিক (zoonotic), অর্থাৎ তারা পশু থেকে প্রাণীতে যায়। SARS সঞ্চালিত হয়েছিল খট্টাশ (civet cat ) থেকে মানুষে এবং MERS কুঁজওয়ালা উট থেকে মানুষে। অজানা- এবং জানা-ভাইরাসগুলোর মিউটেশনে সম্ভবত অজানা সংখ্যক করোনাভাইরাস প্রাণীদেহে সঞ্চালিত হচ্ছে যেগুলো এখনও মানুষকে সংক্রামিত করেনি।

করোনা ভাইরাস ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণগুলোতে অন্তর্ভুক্ত আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের লক্ষণ, জ্বর, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের দুর্বলতা ও কষ্ট। আরো গুরুতর ক্ষেত্রগুলোতে, ইনফেকশন থেকে নিউমোনিয়া,SARS, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
 
এই নিবন্ধ লেখার সময় চীনে 2019-nCoV করোনাভাইরাসে ৭৭,০০০ জন সংক্রমিত হয় এবং ২,৬৬৩ জন মারা যান, এবং বৈশ্বিকভাবে ৮০,০০০ এর অধিক সংক্রমিত হয়।
 
করোনা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র উহান। নেতৃস্থানীয়  চীনা জীবাণুবিদ্যা (virology) বিশেষজ্ঞ গুয়ান উই (Guan Yi) এই উহান পরিদর্শনের পর বলেন: আমার রক্ষণশীল অনুমান এই যে SARS-এর ১০ গুণ মাত্রায় এই মহামারি শেষ হতে পারে।” ২০০২-০৩-এ সারা দুনিয়াতে SARS প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৮০০ জন মানুষ মারা যায়।
 
এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের কারণ কি? ওহানে অবস্থিত বন্যপ্রাণী খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ের একটি বাজারকে সবচেয়ে বেশী সম্পর্কিত করে একটা ধারাবাহিক অনুমান বিদ্যমান। কিছু লক্ষণ আছে, যেমনটি বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী  রব ওয়ালেছ (Rob Wallace)  দেখান, তিনি ধারণা করেন যে বন্যপ্রাণী বাজারে প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে, তবে তা অল্প। উহান বাজারে ৫৮৫ নমুনার মধ্যে  ৩৩টি নমুনা 2019-nCoV পজিটিভ দেখায়, এর মধ্যে ৩১টি নমুনা বাজারের শেষ প্রান্তে যেখানে বন্যপ্রাণী বানিজ্য কেন্দ্রীভূত। তখনো এই পজিটিভ নমুনাগুলোর মধ্যে মাত্র ৪১% মার্কেট স্ট্রিটে দেখা যায় যেখানে বন্যপ্রাণী রাখা হতো। শুরুতে যারা সংক্রামিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এক-চতুরাংশ কখনো উহান বাজারে যাননি। বাজার আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রথমদিককার কেসগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
 
ভাইরাসের এই সুনির্দিষ্ট স্ট্রেইনের (specific strain) কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তা ভাইরাসজনিত রোগের বৈশ্বিক ও দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া প্রকারভেদের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না, কেন তারা অধিকতর ক্ষতিকর (more virelent) অথবা কেন পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা আরো দ্রুত ছড়ায়। সে জন্য, আমাদের বোঝা দরকার কীভাবে পুঁজিতন্ত্র প্রেক্ষাপট তৈরী করে যাতে মারাত্মক ভাইরাস ধাওয়া করে।
 
চীন শুরু করার জন্য একটা ভাল জায়গা। গত ৫০ বছর ধরে এবং, বিশেষ করে একুশ শতকে, চীনে যে মাত্রায় শিল্পায়িত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তা পূর্বে দেখা যায়নি।
 
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৭ নাগাদ, যখন H5N1 ফ্লুর একটি নতুন স্ট্রেইনের (new strain) উত্থান ঘটে দক্ষিণ চীনের গুয়াঙ্গডঙ্গে, যেখানে ৭০০ মিলিয়ন মুরগীর আবাস ছিল। এগুলোর প্রজনন, বৃদ্ধি, জবাই ও প্রক্রিয়াকরণ সবই উলম্বভাবে সমন্বিত করে সম্পন্ন করা হয় শিল্প পরিবেশে, এটিকে সাপোর্ট করে ফিড মিলগুলো ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো। ১৯৯০-এর দশকব্যাপী পোল্ট্রি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রতি বছরে ৭% হারে। প্রক্রিয়াকৃত পোল্ট্রি রপ্তানিতে আছে পাতিহাঁস ও হাঁস। ১৯৯২ ও ১৯৯৬-এর মধ্যে এই রপ্তানি ৬ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৭৭৪ মিলিয়ন ডলার হয়।
 
জনাকীর্ণ জীবন-যাপন (Cheek-by-jowl)

জনাকীর্ণ জীবন-যাপনে এটি ঘটে, পার্ল রিভার ডেল্টাতে বিপুল ও উচ্চমাত্রার অস্থায়ী জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে।
এই অঞ্চলটি হংকংয়ের সাথে সংযুক্ত, এটি দুনিয়ার প্রধান আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রগুলোর একটি। পার্ল রিভার ডেল্টা থেকে দেশের অভ্যন্তরে এমনকি বিদেশেও এর রয়েছে ব্যাপক পরিবহন রুট। পোল্ট্রি সংখ্যা বৃদ্ধির তীব্রতার মাত্রার সাথে গোয়াঙ্গডঙ্গ জলাভূমিতে বর্ধিষ্ণ জনসংখ্যার চাপ ভাইরাস সংক্রমণের একটি সমাবেশ তৈরী করে যা  বছর ব্যাপী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাটিকে ওয়ালেছ বর্ণনা করেন একটি ভাইরাস ঘটিত “একমুখী চক্র” (virulence ratchet) হিসেবে।
 
তীব্র শিল্প খাদ্য উৎপাদন ভাইরাসগুলোকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয় মিউটেশনে এবং পোল্ট্রি হোস্টে ছড়িয়ে পড়তে, একই সময়ে স্থানীয় জনসংখ্যার নৈকট্য ও আকার  ভাইরাসগুলোকে মনুষ্য জনগণকে সংক্রামিত করতে একটি অতিক্রম সক্ষম প্রবেশদ্বার (cross-over gateway) প্রদান করে।
 
অধিকতর ঐতিহ্যবাহী কাঁচা বাজার ও বিচিত্র খাদ্য সামগ্রী (exotic food) বিক্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি ব্যাপক শিল্প উৎপাদন কারখানা অবস্থিত। বিবনায়নের মাধ্যমে বর্ধিষ্ণু কৃষি উৎপাদন বন্যপ্রাণী খাদ্যের অন্বেষণকে ঠেলে দেয় আদি ভূমিভাগের শেষপ্রান্তে, যা “খুড়ে আনে অজানা ও সম্ভাব্য প্রটো-মহামারী অণুজীব”, ওয়ালেছের অভিমত অনুযায়ী।
 
কৃষি ও পশু পালনের শিল্প মডেল ব্যাখ্যা দেয় কীভাবে আমরা একটি সংকট মুহুর্তে পৌঁছাই যখন প্রতিটি বছর নিয়ে আসে একটি নয়া  ও সম্ভাব্য মারাত্মক বৈশ্বিক ভাইরাসের বিপদ।

শিল্প কৃষি মানবজাতির স্বাস্থ্য ও কল্যাণে যে বহু ও বৈচিত্রময় বিপদ তৈরী করে কার্ল মার্কস তা চিহ্নিত করেন। এটি দেখা যায় তাঁর স্বল্প-খ্যাত নোটবুকগুলোর অনেককটির সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে। প্রকৃতপক্ষে, মার্কস মধ্য-ঊনিশ শতকে ব্রিটেনের শিল্প খাদ্য ব্যবস্থার একটি বিস্তারিত ও সুক্ষ্ম সমালোচনা বিকশিত করেন। এ সময়টাকে ইতিহাসবেত্তাগণ “দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লব” হিসেবে অভিহিত করেন।

মার্কস কেবলমাত্র খাদ্যের উৎপাদন, বন্টন ও ভোগেরই অধ্যয়ন করেননি, তিনি ছিলেন প্রথম এই বিষয়গুলোর উপলব্ধির ক্ষেত্রে, তিনি মনে করতেন এগুলো  খাদ্য “রেজিমের” পরিবর্তনের একটি সমস্যা গঠন করে- পুঁজিতান্ত্রিক খাদ্য সিস্টেমের আলোচনাতে যা তখন থেকেই হয়ে ওঠে একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। মার্কস তাঁর ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেন এই প্রতীতিতে যে “মানব অস্তিত্বের প্রথম প্রতিজ্ঞা” হলো জীবন-ধারণের উপায় উৎপাদন, যা শুরু হয় খাদ্য, আশ্রয়, বস্ত্র দিয়ে এবং সম্প্রসারিত হয় জীবনের অন্য সকল উপায় অবধি।
 
তিনি পুঁজি গ্রন্থে লেখেন, “সকল শ্রম আদিতে নিয়োজিত ছিল খাদ্য ভোগ ও উৎপাদনে”।  প্রধান গুরুত্বারোপ করা হতো পুস্টিকর, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চায়তাতে।
 
মধ্য-ঊনিশ শতকে প্রজননের নয়া পদ্ধতি দ্বারা প্রাণীর অপব্যবহার সম্পর্কে মার্কস উচ্চকিত ছিলেন। ভেড়া ও গবাদিপশু অধিকতর গোলাকার ও মোটা করে বিকশিত  করা হয়েছিলো যাতে হাড়ের তুলনায় মাংস ও চর্বির পরিমাণ অধিকতর ছিলো। এতে একটা পর্যায় পর্যন্ত পশুরা কদাচিৎ নিজেদের ভার বইতে পারে।

মাংস উৎপাদনের জন্য পশু প্রজননের বৃদ্ধির হার আরো দ্রুততর করা হয়েছে,পাঁচ বছরের পরিবর্তে বরং দুই বছর পরই ভেড়া ও গরু জবাই করা হয়। দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে বাছুরগুলোকে আগেই দুধ ছাড়ানো হয়। বলদগুলোকে বর্ধিতভাবে গোশালায় প্রতিপালন করা হয় এবং দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়। গবাদিপশুর বৃদ্ধি দ্রুততর করতে বিভিন্ন উপাদান সমৃদ্ধ মিশ্রণ খাওয়ানো হয়, যাতে আমদানীকৃত খইল থাকে, এতে গবাদিপশু থেকে উৎকৃষ্টতর সার পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা বলদকে প্রতিদিন ১০ পাউন্ড করে খইল খাওয়ানো হয় এবং যে মুহুর্তে তারা পরিপক্কতা অর্জন করে অমনি তাদের জবাই করা হয়।
 
মার্কস লেখেন: “এই বন্দিশালাতে (খামারে গরুর শেড) পশুরা জন্ম নেয় এবং তাদের জবাই করার পূর্ব পর্যন্ত তারা সেখানে থাকে। এই ব্যবস্থাটি এমন একটি প্রজনন ব্যবস্থার সাথে জড়িত যাতে পশুগুলো বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিক ভাবে হাড়গুলোকে অবিকশিত রেখে, এতে নিছক মাংস ও বিপুল পরিমাণে চর্বি জন্মায়, প্রশ্ন হলো এতে চুড়ান্তভাবে জীবনি শক্তির মারাত্মক অবনমন ঘটে কিনা। অন্যদিকে আগের সময়ের প্রাণীগুলো সক্রিয় থাকতো যতটা সম্ভব বেশী মুক্ত বাতাসে থেকে।”
 
এটি তুলনা করুন আধুনিক কালের শিল্প পোল্ট্রি উৎপাদনের সাথে। ১৯৪০-এ হেনরি ওয়ালেছ জুনিয়র বিকশিত করেন শিল্পে সংকরায়িত মুরগীর বাচ্চার প্রথম বংশ Hy-Line International--এ, এটি তাঁর পিতার একটি কৃষি-বিষয়ক কোম্পানি থেকে তৈরী হওয়া আলাদা একটি কোম্পানি। তাঁর পিতা হেনরি ওয়ালেছ সিনিয়র ছিলেন প্রাক্তন কৃষি সচিব ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এক দশকের মধ্যে পৃথিবী ব্যাপী প্রায় সকল পোল্ট্রি ব্রিডারগণ এই সংকরগুলো থেকে বংশ তৈরী করেন।
 
বর্তমানে দুনিয়ার পোল্ট্রি উৎপাদনের প্রায় ৭৫% মাত্র অল্প কয়েকটি কোম্পানির হাতে। ২০০৬ সন নাগাদ, চারটি প্রধান ব্রিডার ছিল যারা “ব্রয়লার” (মাংসের জন্য মুরগীর বাচ্চা) লাইন নিয়ন্ত্রণ করতো, যা ১৯৮৯-এর ১১টি থেকে কম। একই সময়ে ডিমের জন্য লেয়ার লাইন প্রস্তুতকারী ১০টি কোম্পানি কমে মাত্র ২টিতে নেমে আসে।
 
দুনিয়াতে EW (Erich Wesjohann) গ্রুপ একাই মোট সাদা ডিম উৎপাদনের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে। বাদামী ডিম উৎপাদনের ৮০% নিয়ন্ত্রণ করে Hendrix Genetics, এদের Nutreco-তে ৫০% স্টেইক আছে, এটি টার্কি, ব্রয়লার ও শুকরছানা প্রজনন করে। Grimaud Group এভিয়ান জেনেটিকসে দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি। Cobb-Vantress হলো বড় চারটি পোল্ট্রি উৎপাদনকারীর শেষ একটি, এটির মালিক হলো Tyson Foods, এটি দুনিয়ার বৃহত্তম মুরগীর মাংসের প্রক্রিয়াকারক ও বিপণনকারক।
 
উৎপাদনে যেকোনো অপরিকল্পিত বৈচিত্রময়তা দূর করতে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা হয় কঠোরভাবে ও নির্দয়ভাবে। ২০০৯-এ শিকাগো ভিত্তিক পশু অধিকার গ্রুপ, Mercy for Animals, Hy-Line hatchery-তে পুরুষ লেয়ার বাচ্চাগুলোর ওপর একটি ফুটেজ প্রকাশ করে। এই ফুটেজে দেখা যায় পুরুষ লেয়ার বাচ্চাগুলোকে মিট গ্রাইন্ডারে ভরা হচ্ছে টুকরো টুকরো করতে। পুরুষ লেয়ার বাচ্চাগুলো ডিম দিতে পারে না, তাই স্বাভাবিক শিল্প পদ্ধতি হলো এগুলোকে জীবন্ত টুকরোকরণ। 
 
Hy-Line-এর Jane Foulton ব্যাখ্যা করে দেন: “আমাদের খুব কঠোর অর্থনৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। দরকারী অর্থনৈতিক মাত্রায় কোন প্রোডাকশন লাইন কাজ করতে না পারলে উৎখাত হয়ে যাবে”। এই উৎখাতের পরিণাম হলো এই যে বৈশ্বিক পোল্ট্রি উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য হলো মনোকালচারের। নয়া ভাইরাসগুলোর প্রতি প্রতিরোধ থেকে প্রজনন দ্বারা মুরগীর বাচ্চাগুলো অসক্ষম থাকে। এগুলোতে জিনসমূহের একটি সীমিত পুল থাকে যেগুলো ভাইরাসগুলোর সাথে রোগ-প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়ার প্রকরণকে সীমিত করে যখন তারা মিউটেশনে লিপ্ত হয়। এভাবে পোল্ট্রি থেকে মানুষে স্থানান্তরের (cross-over) সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
 
পশুগুলোকে  বৃহদায়তনের “ফ্যাক্টরি ফার্মে” পালন করা হয় উদ্বেগজনক অবস্থায়। ব্রয়লারগুলোকে মোটাতাজা করা হয় দশ হাজারে মত পাখী থাকতে পারে এরকম চালাঘরে। মুরগীর বাচ্চাগুলোকে পালন করা হয় দ্রুত ওজন বৃদ্ধির জন্য, এর অর্থ হলো ব্যবসায় খাটানো টাকা যাতে  দ্রুত ফেরত আসে এবং উচ্চতর মুনাফা (quicker turnover and higher profits) নিশ্চিত হয়। এই মুরগীর বাচ্চাগুলোর অতিকায় বুক হলো সাদা মাংসের প্রতি পক্ষপাতের প্রতিফলন।
 
তাদের বেড়ে উঠার জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য খাওয়ানো হয়, এতে তারা নিষ্ক্রিয় থাকে এবং তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় মেঝেতে বসে থাকে। তাদের বেড়ে উঠার চক্রে বিষ্ঠাও জমা হতে থাকে।
 
কেবলমাত্র মুরগীর বাচ্চাগুলোকে চালান দেয়ার পর চালাঘরগুলো পরিষ্কার করা হয়, কিন্তু মুরগীর বাচ্চাগুলোর পরবর্তী গ্রুপের জন্য এই বিষ্ঠা থেকে যেতে পারে, তবে পুরাতন স্তরের উপরে কাঠের গুড়ো দিয়ে একটা পাতলা নতুন স্তর দেয়া হয়।
 
মুরগীর বাচ্চাগুলোকে মৃদু আলোয় লালন-পালন করা হয়  (কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক আলোতে অনীহা দেখিয়ে থাকতে পারে)। চালাঘরগুলোতে এগুলো ছয়-থেকে-আট সপ্তাহ থাকে। তাদেরকে এন্টিবাইওটিক্সের মত এডিটিভ মিশিয়ে খাবার খাওয়ানো হয় যাতে বৃদ্ধি দ্রুত হয়, কিন্তু ভীড়াক্রান্ত পরিবেশে অনেকগুলো মারা যায়। অধিকাংশ বানিজ্যিক গ্রেডের পোল্ট্রি ফিডে আর্সেনিক মেশানো থাকে যাতে চালান ও বিক্রয়ের সময় পাখীর মাংস হালকা লাল (pink) থাকে।

এটি হলো একটি আদর্শ পরিবেশ (ideal circumstances) যাতে নয়া ভাইরাসসমূহের ওয়ালেস কথিত একটি “যথার্থ চিড়িয়াখানা” পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারে, বিশেষ করে ফ্লু ভাইরাসসমূহের। ভাইরাসের বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হলো গ্রহণশীল হোস্টসমূহের সরবরাহ। সংক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত হোস্ট থাকলেই একটি ভাইরাসের উদ্বর্তন সংঘটিত হয়। সুতরাং শিল্প প্রাণি-সম্পদের (industrial livestock) আদর্শ জনসংখ্যা হলো ভাইরাসজনিত রোগজীবাণুর জন্য পোষক। 
 
প্রাণীসমূহ যতটুকু রোগ-প্রতিরোধী যার জন্য ধীর গতির সংক্রমণে জীবাণুসমূহ বাধ্য হয়, তা জেনেটিক মনোকালচারে দূর হয়ে যায়। জনসংখ্যার বৃহৎ আকার ও ঘনত্ব বড় মাত্রার সংক্রমণের হার সহজতর করে দেয়। ভীড়াক্রান্ত অবস্থা রোগ প্রতিরোধী সাড়াকে দমন করে। গবাদিপশুর দ্রুত টার্নওভার সহজ-গ্রাহী হোস্টের (susceptible hosts) একটি অবিরাম নবায়নকৃত সরবরাহের যোগান দেয়। 
 
মুরগী, হাঁস বা শুকর জবাইয়ের অনেক পূর্বেই, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইনফেকশন যে কোনো পশুতে তাদের সংক্রমণ সীমায় অবশ্যি দ্রুত পোঁছাতে হয়। কারণ যেইমাত্র শিল্প পশুসমূহ সঠিক আকার পায়, তখনি তাদের জবাই করা হয়। মুরগীগুলোকে যে বয়সে প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তার সময় ৬০ দিন থেকে কমিয়ে ৪০ দিনে নিয়ে আসা হয়, এ ধরনের উৎপাদন উদ্ভাবন ভাইরাসগুলোর ওপর চাপ বৃদ্ধি করে তাদের সংক্রমণ সীমায় দ্রুত পৌঁছাতে।
 
একবার ভাইরাস ইনফেকশন সংঘটিত হলে বাছাইকরণ (culling) কোনো সমাধান নয়। ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পশুপালের দ্রুত বাছাইকরণ ব্যর্থ হয় সঞ্চালনকারী স্ট্রেইন প্রতিরোধী হোস্ট নির্বাচন করতে, এছাড়া সম্ভাব্য প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশিষ্ট পশুদের সম্পূর্ণ হত্যা করাতে  বারবার আক্রমণ (repeated invasion) সংঘটিত হয়।
 
৫০ বছরে নয়াউদারনীতিবাদ দ্বারা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে সহজাত শিল্পায়িত উৎপাদন পদ্ধতিসমূহ (industrial practices) এখন বিশ্বায়িত এবং তীব্রায়িত। এই পদ্ধতি আরো অধিকতর মারাত্মক ক্ষতিকর রোগজীবাণু প্রজনন করে। মহামারীর এই প্যাটার্ন আকস্মিক নয়। আমরা যে খাদ্য খাই তা যে পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয় এটি তারই পরিণাম।
 
আমরা কী করতে পারি? আরো অধিক প্রতি-ভাইরাস ভ্যাক্সিন (anti-virus vaccine) কী এর উত্তর? এটি একটি আধিপত্যশালী প্যারাডাইম (paradigm), ওয়ালেছ (Wallace) যেটিকে বলেন ‘একটি আণবিক বয়ান’ (a molecular narrative)। এই বয়ান সুপারিশ করে রোগ ও ভগ্ন-স্বাস্থ্য হলো ভাইরাস ও প্রতিরোধীতার লড়াই সম্পর্কে, ভাইরাসের বিবর্তন ও ভাক্সিন উৎপাদনে মানবতার সক্ষমতা সম্পর্কে, প্রকৃতি বনাম বিজ্ঞান সম্পর্কে।
 
একটি বয়ান হলো এই যে বৃহদায়নের ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন যেমন বায়ার হলো পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড ও ইনসেক্টিসাইডের একটি নেতৃস্থানীয় উৎপাদক। মোনসান্টোর বিলিয়ন ডলার ক্রয়ে তারা খুশী, এখন তারা বিশ্বের বৃহত্তম বীজ কোম্পানি।
 
প্রথমে তারা আমাদের কাছে খাদ্য বিক্রয় করে যা আমাদের অসুস্থ্য করে। এই খাদ্য উৎপাদন একটি মারাত্মক ভাইরাস ঘটিত মহামারীর হুমকি তৈরী করে। তারপর তারা আমাদের নিকট ঔষধ বিক্রয় করে আমাদের ভালো করতে। এটি অবমাননাকর আজেবাজে কথা। গ্রহের দূষণ মোকাবেলায় যেমন ক্যাটালাইটিক কনভার্টার দরকার, তেমনি মানবতার সার্বিক স্বাস্থ্য- ও কল্যাণের প্রয়োজনে মনোযোগ দিতে ঔষধও কার্যকর।
 
আমরা উত্তরটা জানি। আমাদের দরকার ফ্যাক্টরি-ফার্মিং ও শিল্প-কৃষির অবসান ঘটানো। এগুলো বনভূমিকে নগ্ন করে এবং মাটির প্রাকৃতিক পুষ্টি-উপাদানকে উৎখাত করে। এই পদ্ধতিগুলোকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে পরিকল্পিত, যৌথ, নিরাপদ এবং মানবিক সার্বজনীন গবাদিপশু ও কৃষি পদ্ধতি দ্বারা, কারণ এগুলো টেকসই এবং আমাদের দরকারী পুষ্টি সরবরাহ করে।
 
আমাদের এটা করা থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে কোনো জ্ঞানের অথবা প্রয়োজনের অভাব থেকে নয়, বরং এটি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ধরন দিয়ে। এতে মালিকানা বজায় থাকে অশ্লীলভাবে ধনী পুঁজিতন্ত্রীদের হাতে। এই অস্বাস্থ্যকর ও মারাত্মক ক্ষতিকর খাদ্য-উৎপাদন পদ্ধতি বজায় রাখাতে তাদের ও তাদের শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ বিদ্যমান আছে। তাদের জন্য এই মালিকানা ত্যাগ করার মানে হলো তাদের নিজেদের ত্যাগ করা। মানবতার কল্যাণের জন্য, তাদের এই পদ্ধতিগুলো আমাদের ত্যাগ করা দরকার।


ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত Socilist Review March 2020 ইস্যু থেকে অনুবাদকৃত
 
 শওকত হোসেন সম্পাদিত হাল খাতা লিটল ম্যাগাজিনের করোনা সংখ্যায় প্রকাশিত

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিস্টাল ফিল্ড তত্ত্ব স ম আজাদ

পরকীকরণ: মার্কসের তত্ত্বের ভূমিকা

রসায়নের প্রকৃতি এরিক শেরি