বিজ্ঞান দর্শন- একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সামির ওকাশা
বিজ্ঞান দর্শন- একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মূল:সামির ওকাশা অনুবাদ: স ম আজাদ
অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট নিহিত থাকে বিশেষ পদ্ধতিসমূহে যেগুলো দুনিয়া সংবিক্ষণে (to investigate the world) বিজ্ঞানীগণ ব্যবহার করেন। এই পরামর্শ বেশ প্রশংসনীয়। কারণ অনেক বিজ্ঞানী অনুসন্ধানের স্বতন্ত্র পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করেন যেগুলো বিজ্ঞান বহির্ভূত শাখায় (non-scientific disciplines) দেখা যায় না। সুস্পষ্ট উদহারণ হ’ল পরীক্ষাসমূহের ব্যবহার, যা ঐতিহাসিকভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশে একটি বাঁক চিহ্নিত করে। যদিও সকল বিজ্ঞান পরীক্ষামূলক (experimental) নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নিশ্চিতভাবে আকাশে (on the heavens) পরীক্ষা করতে পারেন না, বরং পরিবর্তে সাবধানী পর্যবেক্ষনে তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অনেক সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। বিজ্ঞানের অন্য আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল তত্ত্ব নির্মাণ। বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলাফল লগ বইয়ে রেকর্ড করেন না, তাঁরা সচরাচর ঐ ফলাফল ব্যাখ্যা করতে চান সাধারণ তত্ত্বের আলোকে। এটা করা সব সময় সহজ নয়, তারপরেও কিছু আকর্ষণীয় সাফল্য ছিল। বিজ্ঞান দর্শনে মূল সমস্যাগুলোর একটি হ’ল কীভাবে পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, ও তত্ত্ব-নির্মাণের মত টেকনিকগুলো বিজ্ঞানীদের সামর্থ্য জোগায় প্রকৃতির অনেক রহস্যের উম্মোচনে।
আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস
এখনকার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শেখানো হয় অনেকাংশে অ-ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে(in a largely ahistorical way)। পাঠ্যপুস্তকগুলো বৈজ্ঞানিক শাখার (scientific discipline) মূল ধারণাবলী উপস্থাপন করে যতটা সম্ভব উপযুক্ত আঙ্গিকে, তাদের আবিষ্কারে যে দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক (lengthy and torturous) ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বজায় থাকে তার সামান্যই উল্লেখ থাকে। পেডাগোজিক্যাল কৌশল হিসেবে, এটি বোধগম্য। বিজ্ঞান দার্শনিকদের যে ইস্যুগুলোতে আগ্রহ বিদ্যমান সেগুলো বুঝতে বৈজ্ঞানিক ধারণাবলীর ইতিহাসের কিছু উপলব্ধি সহায়ক হয়। বাস্তবিকই আমরা অধ্যায় পাঁচে দেখতে পাবো: এটা যুক্তি দেয়া হয়ে থাকে যে ভালো বিজ্ঞান দর্শন করতে বিজ্ঞান ইতিহাসে নিবিড় মনোযোগ অপরিহার্য।
১৫০০ ও ১৭৫০ সনের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে দ্রুত বৈজ্ঞানিক বিকাশের যুগে আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস নিহিত, যাকে এখন আমরা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করি। অবশ্যি প্রাচীন ও মধ্য যুগেও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল- কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সেখান থেকে আসেনি। ঐ যুগগুলোতে আধিপত্যশীল বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এরিস্টটলবাদ, প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নামানুসারে এই মতবাদের নামকরণ হয়। তিনি পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাবিশ্বতত্ত্বে (cosmology) বিস্তৃত তত্ত্ব প্রদান করেন (put forward)। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীদের নিকট এরিস্টটলের ধারণাবলী খুবই অদ্ভূত মনে হতে পারে, এমনকি তাঁর অনুসন্ধানের পদ্ধতিসমূহও। ঠিক একটি উদাহরণ নেয়া যাক, তিনি বিশ্বাস করতেন যে দুনিয়ার সকল বস্তু ঠিক চারটি মৌল দ্বারা গঠিত: মাটি, আগুন, বায়ু ও পানি। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিতভাবেই আধুনিক বিজ্ঞান যা বলে তার সাথে সাংঘর্ষিক।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল কোপার্নিকান বিপ্লব। ১৫৪২-এ পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭২ - ১৫৪৩) একটি বই প্রকাশ করেন, এ্ই বইয়ে বিশ্বের ভূ-কেন্দ্রিক মডেলকে আক্রমণ করা হয়, যে মডেলে বিশ্বের কেন্দ্রে স্থির পৃথিবীকে স্থাপন করা হয়, গ্রহসমূহ ও সূর্য এই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে কক্ষপথে পরিক্রমণ করে। প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমির নাম অনুসারে ভূ-কেন্দ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, টলেমিয় জ্যোতির্বিজ্ঞান নামে পরিচিত। এরিস্টটলীয় বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির একেবারে কেন্দ্রে ছিল এই ভূ-কেন্দ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, এবং ১,৮০০ বছরের জন্য অনেকটাই চ্যালেঞ্জ বিহীন ছিল। কিন্তু কোপার্নিকাস একটি বিকল্প সুপারিশ করেন। তাঁর মডেলে বিশ্বের স্থির কেন্দ্র ছিল সূর্য, এবং পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে কক্ষপথে পরিক্রমণ করছে। এই সূর্যকেন্দ্রিক মডেলে পৃথিবীকে গণ্য করা হয় ঠিক অন্য আর একটা গ্রহ হিসেবে। কাজেই এতিহ্য পৃথিবীর ওপর যে অনন্য মর্যদা আরোপ করেছিল তা এটি হারিয়ে ফেলে। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব প্রথমদিকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়, ক্যাথোলিক গির্জার থেকেও তা কোন অংশে কম নয়। ক্যাথোলিক গির্জা এটিকে ধর্মশাস্ত্রের লঙ্ঘন বলে গণ্য করে এবং ১৬১৬-এ পৃথিবীর গতি সমর্থনকারী বইটিকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ১০০ বছরের মধ্যে কোপার্নিকাসবাদ প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক অর্থোডক্সিতে পরিণত হয়।
কোপার্নিকাসের আবিষ্কার নিছক অধিকার ভালো জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত করেনি। পরোক্ষে, এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশের দিকে ধাবিত করে, জোহানেস কেপলার (১৫৭১ - ১৬৩০) ও গ্যালিলিও গ্যালিলির (১৫৬৪ - ১৬৪২) কাজের মাধ্যমে। কেপলার আবিষ্কার করেন যে কোপার্নিকাস যেমনটি ভেবেছিলেন সেভাবে সূর্যের চারদিকে বৃত্তাকার কক্ষপথে গ্রহগুলো পরিক্রমণ করে না, বরং উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিক্রমণ করে। এটি ছিল তাঁর গ্রহ সংক্রান্ত গতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রথম সূত্র’; তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্র সূর্যের কক্ষপথগুলোতে গ্রহসমূহের আবর্তনের দ্রুতিকে সুনির্দিষ্টায়িত করে।
একসাথে বিবেচনা করলে বলা যায়, কেপলারের সূত্রাবলী একটি অধিকর উন্নত গ্রহীয় তত্ত্ব প্রদান করে যা পূর্বের থেকে অনেক অগ্রসর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে সমস্যাগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে সেগুলোর সমাধান করে। গ্যালিলিও কোপার্নিকাসবাদের আজী্বন সমর্থক, এবং টেলিস্কোপের আদি পথিকৃতদের একজন।যখন তিনি তাঁর টেলিস্কোপকে আকাশের দিকে তাক করেন, তিনি বিস্ময়কর আবিষ্কারসমূহের সম্পদ তৈরী করেন, যেমন চাঁদের ওপর পর্বতমালা, তারকারাজির বিশাল সারি (vast of array of stars), সৌর কলঙ্কসমূহ (sun-spots), এবং জুপিটারের চাঁদসমূহ। এ্রর সবকিছুই এরিস্টটলীয় মহাবিশ্ব তত্ত্বের (cosmology) সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক, এবং বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে কোপার্নিকাসবাদে দীক্ষা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (pivotal role) পালন করে।
যাহোক, গ্যালিলিওর সবচেয়ে স্থায়ী অবদান জ্যোতির্বিজ্ঞানে নয়, বরং বলবিদ্যায় (in mechanics), যেখানে তিনি এরস্টিটলীয় তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। এরস্টিটলীয় তত্ত্বটি হ’ল এই যে হালকা বস্তু অপেক্ষা ভারী বস্তু অধিকতর দ্রুত পতিত হয়। এই তত্ত্বের পরিবর্তে, গ্যালিলিও পাল্টা-সজ্ঞামূলক সাজেশন (counter-intuitive suggestion) দেন এবং তাহ’ল এই যে মুক্তভাবে পড়ন্ত সকল বস্তু পৃথিবীতে পতিত হবে একই হারে, তাদের ভর নির্বিশেষে (চিত্র ২)। (অবশ্যি বাস্তবে, যদি আপনি একটি পালক ও একটি ক্যানন-বল একই উ্চ্চতা থেকে একই সময়ে পড়তে দেন, ক্যানন-বল প্রথমে ভূমিতে পতিত হবে, কিন্তু গ্যালিলিও যুক্তি দেন যে এটি সাদাসিদাভাবে বাতাসের বাধার জন্য। শুন্যে তারা একসাথে ভূমিতে পতিত হবে।) অধিকন্তু, তিনি আরও যুক্তি দেন যে মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুসমূহ সুষমভাবে ত্বরণকৃত হয়, অর্থাৎ সমান সময়ে সমান দ্রুতি বৃদ্ধি পায়। এ্টি গ্যালিলিওর মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর সূত্র হিসেবে পরিচিত। গ্যালিলিও এই সূত্রের জন্য প্রত্যয়মূলক প্রমাণ দেন, যদিও তা সম্পূর্ণ উপসংহারমূলক প্রমাণ ছিল না। তাঁর বলবিদ্যার সূত্রের কেন্দ্রস্থল গঠন করে এই নিয়মটি।
গ্যালিলিওকে সর্বজনীনভাবে প্রথম সত্যিকার অর্থে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনিই প্রথম দেখান যে গণিতের ভাষা ব্যবহার করা যায় বস্তুজগতের প্রকৃত বিষয়সমুহ যেমন পড়ন্ত বস্তু, প্রজেক্টাইল ইত্যাদির বেশিষ্ট্য বর্ণনাতে। এটি আমাদের নিকট খুবই স্বাভাবিক মনে হতে পারে, আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ নিয়মিতভাবে (routinely) গানিতিক ভাষায় সূত্রবদ্ধ করা হয়, এবং কেবলমাত্র তা ভৌতবিজ্ঞানেই নয়, জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতিতেও। কিন্তু গ্যালিলিওর যুগে, এটা অবশ্যাম্ভাবী ছিল না, খাঁটি বিমূর্ত সত্তাসমূহ নিয়ে গণিত কাজ করতো বলে ব্যাপকভাবে গণ্য করা হতো, এবং সুতরাং গণিত ভৌত বাস্তবতায় অব্যবহারযোগ্য। গ্যালিলিওর কাজের আর একটা উদ্ভাবনী দিক হ’ল হাইপোথিসিসসমূহকে পরীক্ষণগতভাবে টেস্ট করার ওপর গুরুত্ব আরোপন। আধুনিক বিজ্ঞানীর নিকট এটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু গ্যালিলিও যে যুগে কাজ করতেন, সে যুগে জ্ঞানার্জনের নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে সাধারণত পরীক্ষণকে গণ্য করা হত না। পরীক্ষণগত টেস্টিংয়ের ওপর গ্যালিলিওর গুরুত্বারোপন সূচিত করে প্রকৃতির গবেষণায় একটি ইমপিরিক্যাল দিকের আরম্ভ যা আজও বজায় আছে।
গ্যালিলিওর মৃত্যু পরবর্তী যুগ বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে দ্রুত তাড়না অর্জন (rapidly gain in momentum) দেখে। ফরাসি দার্শনিক, গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) একটা র্যাডিক্যাল নয়া ‘যান্ত্রিক দর্শন’ বিকশিত করেন। এই নয়া দর্শনানুসারে, সাদাসিদাভাবে নিষ্ক্রিয় কণাসমূহ দ্বারা ভৌত বিশ্ব বস্তু গঠিত। এই কণাগুলো একে অপরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে এবং সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। দেকার্তে বিশ্বাস করেন, এই কণাসমূহ বা ‘কর্পাসলসের গতি সূত্রগুলো মেনে চলে এবং এতেই বিদ্যমান রয়েছে কোপার্নিকান বিশ্ব-গঠন উপলব্ধির চাবিকাঠি। এই নিষ্ক্রিয়, অসংবেদনশীল কর্পাসলগুলোর আলোকে সকল পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করতে প্রতিশ্রুতি দেয় যান্ত্রিক দর্শন, এবং দ্রুতই সতেরো শতকের দ্বিতীয় অর্ধাংশের আধিপত্যশীল বৈজ্ঞানিক রূপকল্প (scientific vision) হয়ে উঠে; কিছুটা হলেও (to some extent) এটা এখন পর্যন্ত আমাদের সাথে। হিউগেনস, গেসেন্ডি, হুক, বয়েল এবং অন্যান্যরা যান্ত্রিক দর্শনের সংস্করণগুলো সমর্থন করেন; এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা সূচিত করে এরিস্টটলীয় বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির চুড়ান্ত নিপতন (final downfall of the Aristotelian world-view)।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব চুড়ান্ত পরিণতি পায় আইজাক নিউটনের (১৬৪৩-১৭২৭) কাজে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে যার অর্জনসমূহ অসমান্তরাল। নিউটনের মাস্টারপিস ছিল Mathematical Principles of Natural Philosophy, এটি ১৬৮৭-এ প্রকাশিত হয়্। যান্ত্রিক দার্শনিকদের সাথে নিউটন এই মর্মে একমত হন যে মহাবিশ্ব গঠিত সাদাসিদাভাবে গতিশীল কণাসমূহ দিযে, কিন্তু তিনি দেকার্তের গতির সূত্র এবং সংঘর্ষের নিয়মাবলী উন্নত করতে চেয়েছিলেন। এর ফলে নিউটনের গতির তিনটি সূত্র এবং তাঁর বিখ্যাত সার্বজনীন অভিকর্ষের মূলনীতির (principle) উপর ভিত্তি করে বিশাল ক্ষমতার একটি গতিশীল ও যান্ত্রিক তত্ত্ব (a dynamical and mechanical theory of great power) পাওয়া যায়। এই মূলনীতি অনুসারে, বিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরকে অভিকর্ষীয়ভাবে আকর্ষণ করে; দুইটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণের তীব্রতা (strength of attraction) নির্ভর করে তাদের ভরের গুণফলের ওপর, এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ওপর। গতির সূত্রাবলী তখন নির্দিষ্টায়িত করে (specify)কীভাবে এই অভিকর্ষীয় বল বস্তুসমূহের গতিকে প্রভাবিত করে। নিউটন তাঁর তত্ত্বকে বিস্তৃত করেন বিশাল গাণিতিক নির্ভুলতা ও যথাযথতা (great mathematical precision and rigour) দিয়ে, এবং তিনি একটি গাণিতিক টেকনিক আবিষ্কার করেন যাকে আমরা ক্যালকুলাস’ বলি। সুন্দরভাবে, নিউটন দেখান যে কেপলারের গ্রহীয় সূত্রাবলী এবং গ্যালিলিওর সূত্র (উভয়ই কিছু গৌণ সংশোধনসহ) হ’ল তাঁর গতি ও অভিকর্ষ সূত্রাবলীর যৌক্তিক পরিণতি (logical consequences)। অন্য কথায়, একই সূত্রাবলী পার্থিব ও মহাকাশীয় উভয় ডোমেইনে অবস্থিত বস্তুসমূহের গতি ব্যাখ্যা করতে পারে, এবং নিউটন কর্তৃক সূত্রায়িত হয় নির্ভুল পরিমাণগত রূপে (in a precise quantitative form)।
নিউটনিয় পদার্থবিজ্ঞান পরবর্তী ২০০ বছরের জন্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ফ্রেমওয়ার্ক জোগায়, দ্রুত কার্টেসিয় পদার্থবিজ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করে। এই যুগে বৈজ্ঞানিক প্রত্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রধানত নিউটনের তত্ত্বের সফলতার কারণে। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে নিউটনের তত্ত্ব প্রকৃতির সত্যিকার কর্মকান্ড (true workings) উম্মোচিত করে, এবং কমপক্ষে নীতিগতভাবে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। আরও বেশী বেশী ঘটনা ব্যাখ্যা করতে বিস্তারিত প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল ব্যাখ্যাকরণের নিউটনীয় ধরনের প্রতি হাত প্রসারিত করে। অষ্টাদশ ও উণবিংশ শতক উভয়ে প্রত্যক্ষ করে লক্ষণযোগ্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, বিশেষ করে রসায়ন, অপটিক্স, শক্তি, তাপগতিবিদ্যা, এবং তড়িৎ-চুম্বকত্বের গবেষনায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই বিকাশকে গণ্য করা হয় ব্যাপকভাবে বিশ্বের নিউটনিয় ধারণার মধ্যেই। বিজ্ঞানীরা নিউটনের ধারণা (conception) গ্রহণ করেন প্রয়োজনগতভাবে সঠিক গণ্য করে; যা করা বাকি ছিল তা পূর্ণ করা বিস্তৃতভাবে।
নিউটনিয় চিত্রপটে আস্থা ভেঙ্গে পড়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের বছরগুলোতে, পদার্থবিজ্ঞানে দু’টি বিপ্লবী নয়া বিকাশে: আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিকস। আইনস্টাইন কর্তৃক আবিষ্কৃত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দেখায় যে নিউটনিয় মেকানিকস সঠিক ফলাফল প্রদর্শন করে না যখন ভারী বস্তু বা উচ্চ দ্রুতিতে চলমান বস্তুর ওপর প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে, কোয়ান্টাম মেকানিকস দেখায় যে নিউটনিয় তত্ত্ব কাজ করে না যখন খুবই ক্ষুদ্র মাত্রার স্কেলে, সাবএটমিক কণাসমূহে প্রয়োগ করা হয়। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স উভয়ই, বিশেষ করে পরেরটি খুবই অদ্ভূত ও র্যাডিক্যাল তত্ত্ব, এই তত্ত্ব দু’টি বাস্তবতা সম্পর্কে যে দাবী করে,তা অনেক মানুষের গ্রহণ করা অথবা উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। তাদের আবির্ভাব পদার্থবিজ্ঞানে যথেষ্ট ধারণাগত উলম্ফনের কারণ ঘটায়, যা এখনও অব্যাহত আছে।
এ পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞান ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় প্রধানত পদার্থবিজ্ঞানের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এক অর্থে সকল বৈজ্ঞানিক ডিসিপ্লিনের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক। অন্যান্য বিজ্ঞান যে বস্তুসমূহের ওপর গবেষণা করে, খোদ সেগুলো ভৌত সত্তাসমূহ (physical entities) দ্বারা গঠিত। উদাহরণ হিসেবে উদ্ভিদবিজ্ঞানের কথা ধরা যাক। উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ উদ্ভিদসমূহের ওপর গবেষণা করে, যেগুলো চুড়ান্তভাবে ভৌত সত্তাসমূহ যেমন অণু-পরমাণু দিয়ে গঠিত। সুতরাং উদ্ভিদবিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে পদার্থবিজ্ঞান অপেক্ষা ঊন মৌলিক, কিন্তু এটা কোনভাবে বলা যায় না যে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা পয়েন্ট যাতে আমরা অধ্যায় তিনে ফিরে আসবো। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের উৎপত্তির একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি এটা অ-ভৌত বিজ্ঞানগুলোর (non-physical sciences) সমস্ত উল্লেখ বাদ দেয়।
জীববিজ্ঞানে, যে ঘটনাটি স্পষ্টতই স্বতন্ত্র তাহ’ল চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা বিবর্তন তত্ত্বের আবিস্কার, যা ১৮৫৯-এ The Origin of Species-এ প্রকাশিত হয়। তখন পর্যন্ত এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হত যে বিভিন্ন প্রজাতি আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে ঈশ্বর কর্তৃক, যেভাবে Book of Genesis শেখায়। কিন্তু ডারইউন যুক্তি দেন যে সমসাময়িক প্রজাতিগুলো প্রকৃতপক্ষে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে উদ্বর্তিত হয়েছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সংঘটিত হয় যখন কিছু প্রজাতি অন্যদের থেকে অধিক বংশধর রেখে যায়, তাদের ভৌত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। যদি এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের বংশধরগণ উত্তরাধিকার সূত্রে পায়, সময়ের সাথে সাথে এই জনসংখ্যা পরিবেশের সাথে আরও বেশী করে অভিযোজিত হয়। এই প্রক্রিয়া যদিও সরল মনে হয়, তবে বিপুল সংখ্যক প্রজন্ম ধরে এটি একটি প্রজাতির সম্পূর্ন নয়া একটি প্রজাতিতে বিবর্তনের কারন হতে পারে, ডারউইন যুক্তি দেন। কারণ ডারউইন তাঁর তত্ত্বের জন্য যে প্রমান উপস্থাপন করেন তা এতটাই প্রত্যয় উৎপাদনকারী ছিল যে বিশ শতকের প্রারম্ভেই এটি বৈজ্ঞানিক অর্থোডক্সি হিসেবে গৃহিত হয়, বিবেচনার যোগ্য ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধিতা সত্ত্বেও (চিত্র ৩)। পরবর্তী সময়ের গবেষণা ডারউইনের তত্ত্বের বিস্মায়ক প্রমাণ (confirmation) যোগায়, যা আধুনিক জীববিদ্যাগত বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রস্থল গঠন ।
বিংশ শতাব্দী প্রত্যক্ষ করে জীববিজ্ঞানে আর একটি বিপ্লব যা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি: আণবিক জীববিজ্ঞানের উত্থান, বিশেষ করে আণবিক জিনতত্ত্ব। ১৯৫৩-এ ওয়াটসন ও ক্রিক DNA-এর গঠন আবিষ্কার করেন। DNA হ’ল বংশগত উপাদান (hereditary material) যা জীবিত প্রাণী কোষে জিন গঠন করে (চিত্র ৪)। ওয়াটসন ও ক্রিকের আবিষ্কার ব্যাখ্যা করে কীভাবে জিনগত তথ্য এক কোষ থেকে কপিকৃত হয়ে অন্য কোষে যায়, এবং এইভাবে পিতামাতা থেকে সন্তানদের নিকট স্থানান্তরিত হয়, আরও ব্যাখ্যা করে কেন সন্তানদের তাদের পিতামাতার অনুরূপ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তাদের আবিষ্কারে জীববিজ্ঞান গবেষণার একটি নয়া উত্তেজনাপুর্ণ ক্ষেত্র খুলে যায়। ওয়াটসন ও ক্রিকের কাজ থেকে ৫০ বছরে আণবিক জীববিজ্ঞান দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, বংশগতি এবং জিনগুলো কীভাবে জীবন্ত সত্তা (living organism) তৈরী করে- এ সম্পর্কে উপলব্ধি রূপান্তরিত হয়েছে। মানব সত্তায় জিনগুলোর সম্পূর্ণ সেটের আণবিক পর্যায়ের বর্ণনা দেয়ার প্রচেষ্টা Human Genome Project (HGP) হিসেবে পরিচিত। আণবিক জীববিজ্ঞান কতদূর আসতে পারে, এই প্রকল্পটি একটি সূচনা (indication)। একুশ শতক এই ক্ষেত্রে আরও উত্তেজনাকর বিকাশসমূহ দেখবে।
পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে গত একশ বছরে অধিকতর সম্পদ নিয়োজিত করা হয়েছে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। একটি ফল হ’ল নয়া বৈজ্ঞানিক শাখাসমূহ যেমন কম্পিউটার বিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভাষাতত্ত্ব ও স্নায়ুবিজ্ঞানের ব্যাপক বৃদ্ধি (explosion)। সম্ভবত গত ত্রিশ বছরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হ’ল জ্ঞানীয় বিজ্ঞান অর্থাৎ cognitive science-এর উথান, যা গবেষণা করে মানব জ্ঞানের নানা দিক যেমন প্রত্যক্ষকরন (perception), স্মৃতি (memory), এবং যুক্তিবিচারের (reasoning) উপর, এবং ঐতিহ্যিক (traditional) মনোবিজ্ঞানকে রূপান্তরিত করেছে। কগনিটিভ বিজ্ঞানের সংবেগের (impetus) অনেকটাই আসে এই ধারণা থেকে যে মানব মন কিছু দিক দিয়ে কম্পিউটারের অনুরূপ, এবং এইভাবে মানব মানসিক প্রক্রিয়াবলী উপলব্ধি করা যেতে পারে কম্পিউটার কৃত অপারেশনসমূহের সাথে তুলনা করে। কগনিটিভ বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এর শৈশবে রয়েছে, কিন্তু মনের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অনেকটাই উদ্ঘাটনের প্রুতিশ্রুতি দেয়। সামাজিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বও বিশ শতকে উৎকর্ষ লাভ করে, যদিও কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে এগুলো এখন পর্যন্ত সুক্ষ্মতা ও যথাযথতার দিক দিয়ে (in terms of sophitation and rigour) পিছিয়ে আছে। এটি একটি ইস্যু, যেটাতে আমরা ফিরে আসবো অধ্যায় সাতে।
বিজ্ঞান দর্শন কী?
বিজ্ঞান দর্শনের মূখ্য কাজ হ’ল বিভিন্ন বিজ্ঞানে ব্যবহৃত (used in various sciences) অনুসন্ধানের পদ্ধতিসমূহ বিশ্লেষণ করা। আপনি হয়তো আশ্চর্য হতে পারেন কেন এই দায় (task) খোদ বিজ্ঞানীদের ওপর বর্তানোর চেয়ে দার্শনিকদের ওপর বর্তানো উচিত। এটি একটি ভালো প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তরের খানিকটা হ’ল এই যে দার্শনিক প্রেক্ষাপট থেকে বিজ্ঞানের দিকে প্রেক্ষণ (looking) আামাদের অনুমোদন দেয় আরও গভীর অনুসন্ধানের, যাতে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে অন্তর্নিহিত অনুমানগুলো (assumptions) উম্মোচিত হয়, কিন্তু যেগুলো বিজ্ঞানীরা বিশদে আলোচনা করে না। বিশদ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী একটি পরীক্ষা করলেন এবং একটি নির্দিষ্ট ফল পেলেন। তিনি পরীক্ষাটি কয়েকবার পুনাবৃত্তি করলেন এবং একই ফল পেলেন বার বার। তারপর সম্ভবত তিনি থামবেন, এই আত্মবিশ্বাসে যে তিনি যদি একই পরীক্ষা পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন, ঠিক একই অবস্থার অধীনে, তিনি একই ফলাফল পেতে থাকবেন। এই অনুমান অনিবার্য বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু দার্শনিক হিসেবে আমরা এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই। ‘কেন’- এই প্রশ্নটি ধারন করে যে পরীক্ষণের (experiment) ভবিষ্যত পুনরাবৃত্তি একই ফলাফল প্রদান করবে? আমরা কীভাবে জানবো এটি সত্য? এই কিছুটা কৌতূহলী প্রশ্নাবলীর ধাধার ওপর বিজ্ঞানী সময় ব্যয় করতে অনাগ্রহী। তাঁর সম্ভবত আরও ভালো কিছু করার আছে। এগুলো চুড়ান্তভাবে দার্শনিক প্রশ্ন (quintessentially philosophical questions)। এই দার্শনিক প্রশ্নে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে ফেরত আসবো।
সুতরাং বিজ্ঞান দর্শনের কাজের একটা অংশ হ’ল স্বতঃসিদ্ধগুলোকে (assumptions) প্রশ্নবিদ্ধ করা যা বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু এটা মনে করা ভুল হবে যে বিজ্ঞানীরা কখনও নিজেরা দার্শনিক সমস্যা (issue) নিয়ে আলোচনা করে না। প্রকৃতপক্ষে, ঐতিহাসিকভাবে, অনেক বিজ্ঞানী বিজ্ঞান দর্শনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিখ্যাত উদাহরণ যেমন দেকার্তে, নিউটন, এবং আইনস্টাইন। প্রত্যেকে দার্শনিক প্রশ্নাবলীতে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন: যেমন বিজ্ঞান কীভাবে অগ্রসর হবে, অনুসন্ধানের কী কী পদ্ধতি এর ব্যবহার করা উচিত, ঐ পদ্ধতিসমূহের ওপর আামাদের কতটুকু আস্থা রাখা উচিত, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সীমা আছে কিনা, ইত্যাদি। যেমন আমরা দেখবো, এই প্রশ্নাবলী এখনও সমসাময়িক বিজ্ঞান দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে নিহিত (lie at the heart of contemporary philosophy of science)। সুতরাং যে ইস্যুগুলো বিজ্ঞান দার্শনিকদের আগ্রহী করে তোলে, তা ‘নিছক দার্শনিক’ নয়; বিপরীতক্রমে, মহান বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে কিছু বিজ্ঞানী সেই ইস্যুগুলিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। এটা বলা যায় যে এটা অবশ্যি স্বীকার করতে হবে, অনেক বিজ্ঞানী খুব কম আগ্রহ দেখান বিজ্ঞান দর্শনে, এবং এটা সম্পর্কে কম জানে, এটা দুর্ভাগ্যজনক। তখন এটি এই ইঙ্গিত করে না যে দার্শনিক ইস্যুগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। বরং বলা যায় এটা হ’ল বিজ্ঞানের বর্ধিত মাত্রায় বিশেষায়িত বৈশিষ্ট্যের ফল, এবং বিজ্ঞান ও মানবিকীবিদ্যার মধ্যকার মেরুকরণের ফল যা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে বিজ্ঞান দর্শন ঠিক আসলে কী সম্পর্কে। এটা বলার জন্য এটি ‘বিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহ অধ্যয়ন করে”, যেমনটি আমরা উপরে করেছিলাম, কিন্তু আসলে খুব বেশী কিছু বলা যায় না। অধিকতর তথ্যবহুল সংজ্ঞা (informative definition) দেয়ার চেষ্টা থেকে বরং আমরা সরাসরি অগ্রসর হবো বিজ্ঞান দর্শনে টিপিক্যাল সমস্যা বিবেচনা করতে।
বিজ্ঞান ও ছদ্ম-বিজ্ঞান
যে প্রশ্ন দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম তা স্মরণ করা যাক: বিজ্ঞান কী? কার্ল পপার, বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী বিজ্ঞান দার্শনিক, তিনি ভাবতেন যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এই যে এটি মিথ্যা-বর্ণনযোগ্য (falsifiable) হওয়া উচিত। একটা তত্ত্বকে মিথ্যা-বর্ণনযোগ্য (falsifiable) বলা মানে এই নয় যে এটি মিথ্যা (false)। বরং এর অর্থ এই যে তত্ত্বটি কিছু সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী (predictions) তৈরী করে যা অভিজ্ঞতার বিপরীতে অভীক্ষণকৃত (tested) হতে সক্ষম। যদি এই ভবিষ্যদ্বাণী ভূল প্রতিপন্ন হয়, তখন তত্ত্বটি মিথ্যা হয়ে যায় অথবা খারিজ হয়ে যায় (disproved)। সুতরাং মিথ্যা-বর্ণনযোগ্য তত্ত্ব হ’ল সেই তত্ত্ব যা আমরা মিথ্যা বলে আবিষ্কার করতে পারি। এটি অভিজ্ঞতার প্রত্যেকটি সম্ভাব্য গতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পপার ভাবলেন যে কিছু কথিত (supposedly) বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ এই শর্ত পূরণ করে না এবং এইভাবে বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করার যোগ্য নয়; বরং তারা নিছক ছদ্ম-বিজ্ঞান।
ফ্রয়েডের মনো-বিশ্লেষণীয় তত্ত্ব হ’ল ছদ্ম-বিজ্ঞানের উদাহরণগুলোর একটি যেটি পপারের পছন্দের। পপারের মতে, ফ্রয়েডের তত্ত্ব যেকোন অভিজ্ঞতাগত ফলাফল তা যাই হোক না কেন তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। একজন রোগীর আচরণ যাই হোক না কেন, ফ্রয়েডিয়গণ এর একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পান তাঁদের তত্ত্বের আলোকে। তাঁরা কখনও স্বীকার করেন না যে তাঁদের তত্ত্ব ভুল। পপার তাঁর পয়েন্ট বিস্তৃত করেন পরবর্তী উদারহণ দিয়ে। কল্পনা করা যাক একজন মানুষ একটি শিশুকে নদীতে ঠেলে দিল হত্যার উদ্দেশ্যে, এবং অন্য আর একজন মানুষ শিশুকে বাঁচাতে তাঁর জীবন ত্যাগ করল। ফ্রয়েডিয়গণ উভয় মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে সমান স্বাচ্ছন্দে। প্রথমজন ছিল অবদমিত (repressed), এবং দ্বিতীয়জন পরমানন্দ (sublimation) অর্জন করেছেন। পপার যুক্তি দেন যে অবদমন, পরমানন্দ, এবং অচেতন ইচ্ছার (unconscious desires) মতন ধারণাবলী ব্যবহারের মাধ্যমে ফ্রয়েডের তত্ত্ব যেকোন ক্লিনিক্যাল ডাটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে; এইভাবে এটি ছিল অমিথ্যা-বর্ণনযোগ্য (unfalsifiable)।
পপার মনে করেন মার্কসের ইতিহাসের তত্ত্বের বেলায় একই কথা সত্য। মার্কস দাবী করেন যে দুনিয়া জুড়ে শিল্পায়িত সমাজে পুঁজিতন্ত্র সমাজতন্ত্রকে পথ ছেড়ে দেবে এবং চুড়ান্তভাবে কমিউনিজমকে। কিন্তু যখন এটি সংঘটিত হল না, তখন মার্কসের তত্ত্ব ভুল ছিল- এটি স্বীকার করার পরিবর্তে, মার্কসবাদীরা একটি এড হক ব্যাখ্যা হাজির করে- কেন যা সংঘটিত হয়েছে তা আদতে যথাযথভাবে তাঁদের তত্ত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা বলতে পারেন যে কমিউনিজমের দিকে অনিবার্য প্রগতি অস্থায়ীভাবে মন্থর হয়ে যায় কল্যান রাষ্ট্রের উত্থা্নে, যেটি প্রোলেতারিয়েতকে নমনীয় করে এবং তাঁদের বিপ্লবী উদ্দীপনা (revolutionary zeal) দুর্বল করে। এইভাবে, মার্কসের তত্ত্বকে যেকোন ঘটনার সম্ভাব্য গতির সাথে সুসংগত (compatible) করা যায়, ঠিক ফ্রয়েডের মত করে। সুতরাং পপারের মানদন্ড অনুসারে, কোন তত্ত্বই প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক হিসেবে যোগ্য হয় না।
পপারের নিকট ফ্রয়েডের ও মার্কসের তত্ত্বসমূহ আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের তুলনায় বিপরীত বলে প্রতীয়মান। আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতা নামেও পরিচিত। ফ্রয়েড ও মার্কসের তত্ত্বসমূহ থেকে আলাদাভাবে আইনস্টাইনের তত্ত্ব একটি খুবই সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে যে দূরবর্তী তারকারাজী থেকে আসা আলোক রশ্মির বিচ্যুতি সংঘটিত হয় সূর্যের অভিকর্ষীয় ফিল্ড দ্বারা। সাধারণত সূর্য গ্রহণের সময় ছাড়া এই প্রভাব পর্যবেক্ষণ অসম্ভব। ১৯১৯-এ ইংরেজ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার ইডিঙ্গটন দু’টি অভিযান (expedition) সংগঠিত করেন ঐ বছরের সূর্য গ্রহন পর্যবেক্ষণ করতে, একটি ব্রাজিলে এবং অপরটি আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল নিকটবর্তী প্রিন্সিপে দ্বীপে, আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষা করতে। পপার এতে মুগ্ধ হন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট, সূক্ষ্ম ভবিষ্যদ্বাণী করে, যা পর্যবেক্ষণ দ্বারা সমর্থিত। যদি দেখা যেত যে তারকা রশ্মি সূর্য দ্বারা বিচ্যুত হচ্ছে না, তা’হলে এটি প্রমাণিত হত যে আইনস্টাইন ভুল। সুতরাং আইনস্টাইনের তত্ত্ব falsibiality-এর মানদন্ডকে সন্তুষ্ট করে।
পপারের ছদ্ম-বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানের সীমা নির্দেশ করার প্রচেষ্টা সজ্ঞাগতভাবে (intuitively) সম্পূর্ণ প্রশংসনীয় (plausible)। একটা তত্ত্ব সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছুটা সন্দেহের উদ্রেক হয় যখন এটি যেকোন ইমপিরিক্যাল ডাটার সাথে খাপ খায়। কিছু দার্শনিক মনে করেন পপারের মানদন্ড অতিমাত্রায় সরল। পপার ফ্রয়েডিয় ও মার্কসবাদীদের সমালোচনা করেন বিভিন্ন ডাটা ব্যাখ্যা করার জন্য যেগুলো তাদের তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হওয়াতে তত্ত্বগুলো খন্ডিত হয়েছে বলে গ্রহণ না করাতে। এটি অবশ্যি একটি সন্দেহজনক প্রক্রিয়া বলে প্রতীয়মান। যাহোক, কিছু প্রমাণ (evidences) আছে যে ঠিক এই প্রক্রিয়াগুলো (procedures) নিয়মিতভাবে (routinely) সম্মানিত বিজ্ঞানীগণ ব্যবহার করেন, যাদের পপার ছদ্ম-বিজ্ঞানে নিয়োজিত বলে অভিযুক্ত করতে চান না। এই প্রক্রিয়াগুলোর ব্যবহার থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার পাওয়া গেছে।
আর একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক উদহারণ এটি ব্যাখ্যা করতে পারে। আমরা আগেই নিউটনের অভিকর্ষীয় সূত্রের সাক্ষাত পেয়েছি, এটি গ্রহসমূহের সূর্যকে পরিক্রমণে কোন পথ অনুসরণ করা উচিত সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পর্যবেক্ষণ থেকে এই ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের সমর্থন মেলে। যাহোক, ইউরেনাসের পর্যবেক্ষণকৃত কক্ষপথ ধারাবাহিকভাবে (consistently) নিউটনের তত্ত্ব অনুসারে ভবিষ্যদ্বাণীকৃত (predicted) পথ থেকে পৃথক। এই ধাঁধাঁ ১৮৪৬-এ সমাধান করেন দু’জন বিজ্ঞানী, ইংল্যান্ডের এ্যাডামস এবং ফ্রান্সের লেভেরিয়ের, স্বাধীনভাবে গবেষণা করে। তাঁরা সুপারিশ করেন যে অনাবিষ্কৃত আর একটি গ্রহ আছে, যেটি ইউরেনাসে বাড়তি (additional) অভিকর্ষীয় বল প্রয়োগ করছে। এ্যাডামস ও লেভেরিয়ের এই গ্রহের ভর ও অবস্থান কি হওয়া দরকার তা গণনা করতে সক্ষম হন, যদি এর অভিকর্ষীয় টান (gravitational pull) বাস্তবিকই ইউরেনাসের অদ্ভূত আচরণের জন্য দায়ী হয়ে থাকে। অল্প কিছুদিন পরে নেপচুন আবিষ্কৃত হয় প্রায় সেখানেই যেখানে এ্যাডামস ও লেভেরিয়ের অনুমান করেছিলেন।
এখন স্পষ্টভাবে আমাদের এ্র্যাডাম ও লেভেরিয়ারের আচরণ ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে সমালোচনা করা উচিত নয়- যেহেতু এটি একটি নয়া গ্রহ আবিষ্কারের দিকে ধাবিত করেছে। কিন্তু পপার যা করার জন্য মার্কসবাদীদের সমালোচনা করেছিলেন তাঁরা সুক্ষ্মভাবে ঠিক তাই করেছিলেন। তাঁরা শুরু করেছিলেন একটি তত্ত্ব দিয়ে- নিউটনের অভিকর্ষজ তত্ত্ব- যেটি ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে একটি বেঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। নিউটনের তত্ত্ব অবশ্যি বেঠিক- এই উপসংহারে আসার পরিবর্তে তাঁরা বরং এটিতে লেগে থাকে এবং একটি নয়া গ্রহ প্রস্তাবনার মাধ্যমে চেষ্টা করে সাংঘর্ষিক পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে । অনুরূপভাবে, যখন পুঁজিতন্ত্র কমিউনিজমের জন্য কোন পথ ছেড়ে দেয়ার লক্ষণ দেখায় না, তখন মার্কসবাদীরা উপসংহারে উপনীত হন না যে মার্কসের তত্ত্ব অবশ্যি বেঠিক। বরং এই তত্ত্ব নিয়ে তাঁরা লেগে থেকে চেষ্টা করেন সাংঘর্ষিক পর্যবেক্ষণসমূহ অন্য উপায়ে ব্যাখ্যা করতে। সুতরাং মার্কসবাদীগণ ছদ্ম-বিজ্ঞানে নিয়োজিত- এই অভিযোগ করা নিশ্চিতভাবে অশোভন যদি আমরা অনুমোদন দেই এ্যাডামস ও লেভেরিয়ের যা করেছিলেন তা বাস্তবিকই দৃষ্টান্তস্থানীয বিজ্ঞান।
এটি
সুপারিশ করে যে বিজ্ঞান থেকে ছদ্ম-বিজ্ঞানের সীমারেখা টানায় পপারের
প্রচেষ্টা সম্পুর্ণ সঠিক হতে পারে না, এর প্রাথমিক বিশ্বাসযোগ্যতা
(plausibility) সত্ত্বেও। এ্যাডাম/লেভিরিয়ারের উদাহরণ কোনভাবেই অস্বাভাবিক
(atypical) নয়। সাধারণভাবে, বিজ্ঞানীগণ নিছক তাঁদের তত্ত্ব পরিত্যাগ করেন
না যখন সেগুলো পর্যবেক্ষণিক ডাটার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। সাধারণত তাঁরা বিরোধ
(conflict) অপসারণের জন্য উপায় অন্বেষণ করে তাঁদের তত্ত্ব পরিত্যাগ না
করেই। এই পয়েন্টে আমরা ফেরত আসবো অধ্যায় ৫-এ। এটা মনে রাখা দরকার যে কার্যত
বিজ্ঞানে প্রত্যেক তত্ত্ব কিছু না কিছু পর্যবেক্ষণের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
এমন একটা তত্ত্ব অন্বেষণ খুবই কষ্টসাধ্য যেটি সব ডাটার সাথে নিখুঁতভাবে খাপ
খায়। স্পষ্টতই যদি একটি তত্ত্ব ধারাবহিকভাবে অধিক অধিক ডাটার সাথে
সাংঘর্ষিক হয়, এবং সাংঘর্ষিকতা দূর করতে ব্যাখ্যাকরনের বিশ্বাসযোগ্য উপায়
খুঁজে পাওয়া না যায়, তখন এটি অবশেষে প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু অগ্রগতি
সামান্যই হতো যদি বিজ্ঞানীগণ সাদাসিধাভাবে তাঁদের তত্ত্বসমূহ পরিত্যাগ
করতো বিপত্তির প্রথম লক্ষণেই (at the first sign of trouble)।
অধ্যায় ২
বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রক্রিয়া
বিজ্ঞানীবৃন্দ প্রায়ই দুনিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু বলেন যা আমরা অন্যথায় বিশ্বাস করতাম না। উদাহরণস্বরূপ, জীববিজ্ঞানীগণ আমাদের বলেন যে আমরা শিম্পাঞ্জীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ, ভূতত্ত্ববিদগণ আমাদের বলেন যে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা একসময় সংযুক্ত ছিল, এবং মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ আমাদের বলেন যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ কীভাবে এই অসম্ভাব্য-নিনাদিত উপসংহারে (unlikely-sounding conclusion) উপনীত হন? মোটের উপর, এ পর্যন্ত কেউ দেখেনি একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি থেকে উদ্বর্তিত হয়, অথবা একটি একক মহাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’টি হয়, অথবা মহাবিশ্ব বড় হচ্ছে। অবশ্যি উত্তরটি এই যে বিজ্ঞানীবৃন্দ এই প্রতীতিতে উপনীত হন যুক্তি প্রক্রিয়া অথবা অবধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে (by a process of reasoning or inference)। কিন্তু এই পদ্ধতি সম্পর্কে আরও বেশী জানলে এটা সুন্দর হতো। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য ঠিক কী? বিজ্ঞানীবৃন্দ কৃত অবধারণগুলোতে আমাদের কতটুকু আস্থা স্থাপন করা উচিত? এগুলোই এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।
|
অবরোহ ও আরোহ
যুক্তি প্রক্রিয়ার (reasoning) অবরোহ ও আরোহ ধরনদ্বয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন পার্থক্য তৈরী করেন যুক্তিবিদগণ (logicians)। অবরোহমূলক যুক্তি প্রক্রিয়া বা একটি অবরোহমূলক অবধারণের (inference) এক টুকরো উদাহরন নিম্নে দেয়া হ’ল:
সকল ফরাসি লাল মদ পছন্দ করে। পিয়েরে একজন ফরাসি। সুতরাং, পিয়েরে লাল মদ পছন্দ করে।
|
সকল অবধারণ অবরোহমূলক নয়। নিচের উদাহরণ বিবেচনা করা যাক:
বাক্সের প্রথম পাঁচটি ডিম পচা।
সব ডিমে একই বেস্ট-বিফোর ডেট ছাপ দেয়া আছে।
সুতরাং ষষ্ঠ ডিমটিও পচা হবে।
এটি দেখতে যুক্তি-প্রক্রিয়ার একটি পুরোপুরি বোধগম্য নমুনার মত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি অবরোহমূলক নয়, কারণ প্রতিজ্ঞাসমূহ থেকে উপসংহার ফলস্বরূপ পাওয়া যায় না। এমনকি যদিও প্রথম পাঁচটি ডিম বাস্তবিকই পচা, এবং এমনটি যদিও সবগুলো ডিমে একই বেস্ট-বিফোর ডেট ছাপ দেওয়া, এটি নিশ্চয়তা দেয় না যে ষষ্ঠ ডিমটিও পচা হবে। এটি পুরোপুরি অনুমেয় যে ষষ্ঠ ডিমটি পুরোপুরি ভাল। অন্য কথায়, এটা যুক্তিগতভাবে সম্ভব যে এই অবধারণের প্রতিজ্ঞাগুলো সত্য এবং যদিও উপসংহার মিথ্যা, সুতরাং অবধারণ অবরোহমূলক নয়। পরিবর্তে এটি একটি আরোহমূলক অবধারণ হিসেবে পরিচিত। আরোহমূলক অবধারণ, বা আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়াতে, আমরা আমাদের পরীক্ষাকৃত বিষয় সম্পর্কে প্রতিজ্ঞাগুলো থেকে পরীক্ষা করা হয়নি এমন বিষয় সম্পর্কে উপসংহারে উপনীত হই- এই উদাহরণের ডিমগুলো।
আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার থেকে অবরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া একটি অধিকতর নিরাপদ কর্মকান্ড (activity)। যখন আমরা যুক্তি দেই অবরোহমূলকভাবে, তখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি যদি আমরা সত্য প্রতিজ্ঞাসমূহ দিয়ে শুরু করি, আমরা একটা সত্য উপসংহারে উপনীত হবো। কিন্তু আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া এটি ধারণ করে না। বিপরীতক্রমে, আমাদেরকে সত্য প্রতিজ্ঞাসমূহ থেকে একটি মিথ্যা উপসংহারে নিয়ে যেতে আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া পুরোপুরি সক্ষম। এই ত্রুটি সত্ত্বেও, আমাদের মনে হয় আমরা আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার ওপর সারা জীবন ধরে নির্ভর করি, প্রায়ই এমনকি এটা সম্পর্কে চিন্তা না করেই। উদারহণস্বরূপ, যখন আপনি সকাল বেলায় আপনার কম্পিউটার চালু করলেন, তখন আপনি আত্মবিশ্বাসী যে এটি আপনার মুখের ওপর বিস্ফোরিত হবে না। কেন? কারণ আপনি প্রতিদিন আপনার কম্পিটার চালু করেন সকালে, এবং এটা কখনো আপনার মুখের ওপর এখন পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয়নি। কিন্তু ‘এখন পর্যন্ত আমার কম্পিউটার বিস্ফেরিত হয়নি যখন আমি এটাকে চালু করি’- এই অবধারণ থেকে ‘আমার কম্পিউটার বিস্ফোরিত হবে না যখন আমি এটা চালু করি এই সময়’- এই অবধারণ আরোহমূলক, অবরোহমূলক নয়। এই অবধারণের প্রতিজ্ঞা থেকে উপসংহার অনুসরিত হয়নি। এটা যুক্তিগতভাবে সম্ভব যে আপনার কম্পিউটার এই সময় বিস্ফোরিত হবে, যদিও পূর্বে এটা কখনো হয়নি।
দৈনন্দিন জীবনে আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার অন্যান্য উদাহরণ সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। যখন আপনি আপনার কারের স্টিয়ারিং হুইল ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরান, তখন আপনি ধরে নেন গাড়িটি বাম দিকে যাবে, ডান দিকে নয়। যখনই আপনি যাতায়াতে গাড়ি চালান, তখনিই আপনি কার্যকরভাবে আপনার জীবনকে এই পূর্ব-ধারণার (assumption) ওপর বাজি রাখেন। কিন্তু কী আপনাকে এতটা নিশ্চিত করে যে এটি সত্য? যদি আপনার প্রতীতির নায্যতা প্রতিপাদন সম্পর্কে একজন কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি তাহ’লে কী বলতেন? আপনি যদি মেকানিক না হন, তাহ’লে আপনি সম্ভবত উত্তর দিতেন: ‘অতীতে যখনই আমি স্টিয়ারিং হুইল ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরিয়েছি, তখনই গাড়ি বাম দিকে গিয়েছে। সুতরাং, একই ঘটনা ঘটবে যখন আমি স্টিয়ারিং হুইল এই সময়ে ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরাবো।’ আবার, এটি একটি আরোহমূলক অবধারণ, অবরোহমূলক নয়। মনে হয় আরোহমূলকভাবে যুক্তি-প্রক্রিয়াকরণ দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ ।
বিজ্ঞানীগণও কি আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া ব্যবহার করে? উত্তর মনে হয় হ্যাঁ সূচক। ডাউন’স সিন্ড্রোম (সংক্ষেপে DS) নামে পরিচিত জিনগত রোগ বিবেচনা করা যাক। জিনবিদগণ আমাদের বলেন যে DS আক্রান্ত রোগীদের অতিরিক্ত একটি ক্রোমোজম থাকে- তাদের স্বাভাবিক ৪৬টির পরিবর্তে ৪৭টি থাকে (চিত্র ৫)। তাঁরা এটি কীভাবে জানলেন? উত্তরটি অবশ্যি এই যে তাঁরা ব্যাপক সংখ্যক DS আক্রান্ত রোগী পরীক্ষা করেন এবং দেখতে পান যে প্রত্যেকের একটি করে অতিরিক্ত ক্রোমোজম আছে। তাঁরা তখন আরোহমূলকভাবে যুক্তি-প্রক্রিয়াতে এই উপসংহারে উপনীত হন যে তাঁরা যাদের পরীক্ষা করেননি সেই রোগীগুলোসহ সকল DS আক্রান্ত রোগীর প্রত্যেকের একটি করে অতিরিক্ত ক্রোমোজম রয়েছে। এটা সহজে দেখা যায় যে এই অবধারণ আরোহমূলক। ঘটনা এই যে নমুনা পরীক্ষাকৃত DS আক্রান্ত রোগীদের ৪৭টি ক্রোমোজম আছে, এটি প্রমাণ করে না যে সকল DS আক্রান্ত রোগীর তাই আছে। এটা সম্ভব যে নমুনা ছিল অপ্রতিনিধিত্বশীল, যদিও এটার সম্ভাবনা কম।
এই উদাহরণ একেবারেই বিচ্ছিন্ন (isolated) নয়। কার্যত, বিজ্ঞানীবৃন্দ আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন যখনই তারা সীমিত উপাত্ত থেকে একটি অধিকতর সাধারণ উপসংহারে উপনীত হন, যা তাঁরা সবসময় করেন। উদহারণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক নিউটনের সার্বজনীন অভিকর্ষজ নীতিমালা, যেটির আমরা মুখোমুখি হয়েছি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে, এটি বলে যে মহাবিশ্বের সকল বস্তু একে অপরকে অভিকর্ষজ বল দ্বারা আকর্ষণ করে। তখন স্পষ্টতই নিউটন এই নীতিমালায় উপনীত হন নি সমগ্র মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুকে পরীক্ষণ করে- তিনি তা পারেন নি। বরং, তিনি দেখেন যে গ্রহগুলো ও সূর্যের জন্য, এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের নিকটবর্তী পরিক্রমণরত নানা ধরণের বস্তুর জন্য নীতিমালাটি সত্য বলে গৃহিত। এই উপাত্ত থেকে, তিনি অবধারণ করেন যে নীতিমালাটি সকল বস্তুর জন্য সত্য বলে প্রযোজ্য। আবার, এই অবধারণটি নিশ্চিতভাবেই আরোহমূলক: ঘটনা এই যে নিউটনের নীতিমালা কিছু বস্তুর জন্য সত্য- এটা নিশ্চায়তা দেয় না যে এটি সকল বস্তুর জন্য সত্য হিসেবে গৃহিত হবে।
যেভাবে আমরা কথা বলি তাতে বিজ্ঞানে আরোহের কেন্দ্রীয় ভূমিকা কখনো কখনো ঝাপসা হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট পড়ে থাকতে পারেন। এই রিপোর্ট বলে যে বিজ্ঞানীরা ‘পরীক্ষণগত প্রমাণ’ (experimental proof) পেয়েছেন যে জীনগতভাবে পরিবর্তিত ভূট্টা মানুষের জন্য নিরাপদ। এর অর্থ এই যে বিজ্ঞানীবৃন্দ ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ওপর এই ভূট্টার পরীক্ষা চালিয়েছেন, এবং তাদের কেউই ক্ষতির সম্মুখীন হন নি। কিন্তু যথাযথভাবে বললে এটা প্রমাণ করে না যে ভূট্টা নিরাপদ, যে অর্থে গণিতবিদগণ পিথাগোরাসের সূত্র প্রমাণ করতে পারেন, বলা হয়ে থাকে। ‘যে সমস্ত মানুষের ওপর ভূট্টা পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের কাউকে ক্ষতি করে নি’- থেকে পাওয়া অবধারণ ‘ভূট্টো কাউকে ক্ষতি করবে না’ হ’ল আরোহমূলক, অবরোহণমূলক নয়। সংবাদপত্রের রিপোর্টে বাস্তবিকই বলা উচিত ছিল যে বিজ্ঞানীগণ নিরতিশয় ভালো নজির (extremely good evidence) দেখতে পেয়েছেন যে মানুষের জন্য ভূট্টা নিরাপদ। যখন আমরা অবরোহমূলক অবধারণসমূহ নিয়ে কায়কারবার করবো ঠিক তখনি কেবলমাত্র কঠোরভাবে ‘প্রমাণ’ শব্দটি আমাদের ব্যবহার করা উচিত। শব্দের এই কঠোর অর্থে, বৈজ্ঞানিক প্রকল্পসমূহ, কখনো কখনো কমই প্রমাণ করা যেতে পারে উপাত্ত দিয়ে।
অধিকাংশ দার্শনিক মনে করেন এটা অনিবার্য যে বিজ্ঞান ব্যাপকভাবে নির্ভর করে আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার ওপর, বাস্তবিকই এটা এতটাই অনিবার্য যে এটার জন্য কদাচিৎ তর্ক করা হয়। কিন্তু, উল্লেখযোগ্যভাবে, এটা পপার অস্বীকার করেন, যার সাথে আমাদের গত অধ্যায়ে দেখা হয়েছে। পপার দাবী করেন যে বিজ্ঞানীদের কেবলমাত্র অবরোহমূলক অবধারণ ব্যবহার করা দরকার। এটা চমৎকার হতো যদি এটা সত্য হতো, যেহেতু অবরোহমূলক অবধারণগুলো আরোহমূলকের থেকে অধিকতর নিরাপদ, যেমনটি আমরা দেখেছি।
পপারের মৌলিক বিতর্ক (argument) ছিল এই। যদিও এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে সীমিত উপাত্ত নমুনা থেকে পাওয়া একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সত্য হয়, তখন এটা প্রমাণ করা সম্ভব যে তত্ত্বটি মিথ্যা। ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী একটি তত্ত্ব বিবেচনা করছেন যাতে ধাতুর সকল খন্ড বিদ্যুৎ পরিবহন করে। এমনকি যদিও তাঁর পরীক্ষাকৃত ধাতুর প্রত্যেকটি খন্ড বিদ্যুৎ পরিবহন করে, তারপরেও এটা প্রমাণ করে না যে তত্ত্বটি সত্য, আমরা যেসব কারণ দেখেছি তার জন্য। তিনি যদি দেখতে পান ধাতুর একটি খন্ড বিদ্যুৎ পরিবহন করে না, তবে এটা প্রমাণ করে তত্ত্বটি মিথ্যা। যেহেতু ‘এই ধাতুর খন্ডটি বিদ্যুৎ পরিবহন করে না’ থেকে পাওয়া অবধারণ ‘এটা মিথ্যা যে ধাতুর সকল খন্ড বিদ্যুৎ পরিবহন করে’- একটা অবরোহমূলক অবধারণ, কারণ প্রতিজ্ঞার ফলস্বরূপ উপসংহার পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং যদি একজন বিজ্ঞানী কেবলমাত্র দেখাতে আগ্রহী হন যে একটি প্রদত্ত সূত্র মিথ্যা, তাহ’লে তিনি তাঁর লক্ষ্য হয়তো অর্জন করতে পারবেন আরোহমূলক অবধারণ ছাড়াই।
পপারের বিতর্কের দুর্বলতা অনিবার্য। যেহেতু বিজ্ঞানীবৃন্দ নিছক দেখাতে আগ্রহী নন যে কিছু তত্ত্ব মিথ্যা। যখন একজন বিজ্ঞানী পরীক্ষণকৃত উপাত্ত সংগ্রহ করেন, তখন তাঁর লক্ষ্য হতে পারে এটা দেখানো যে একটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব- তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর তত্ত্ব সম্ভবত মিথ্যা। অর্থাৎ অনেক বেশী সম্ভব যে তিনি মানুষজনকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে তাঁর নিজের তত্ত্ব সত্য। এবং তা করতে যেয়ে, তাঁকে এক ধরনের আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করতে হয়। সুতরাং পপারের প্রচেষ্টা দেখায় যে বিজ্ঞান আরোহ ছাড়া সফল হতে পারে না।
হিউমের সমস্যা
যদিও আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তিবিদ্যাগতভাবে তর্কের অবকাশ নেই তা কিন্তু নয়, তবুও এটিকে বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্বাস গঠনের একটি সম্পূর্ণ সংবেদনশীল উপায় (a perfectly sensible way) বলে মনে হয়। ঘটনা এই যে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্য্য উঠে- এটা প্রমাণ করে না যে এটা আগামীকাল উঠবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এটি আমাদের চিন্তা করার খুবই ভালো কারণ দেয় যে এটা ঘটবে? যদি আপনার এমন কারও সাথে দেখা হয় যিনি আগামীকাল সূর্য উঠবে কি উঠবে না- এ সম্পর্কে অজ্ঞেয়বাদী ধারণা পোষণ করেন, তাহ’লে আপনি তাকে বাস্তবিকই অদ্ভূত বলে গণ্য করবেন, যদিও তাকে যুক্তিহীন (irrational) বলে মনে করতে পারেন না।
কিন্তু আরোহতে স্থাপনকৃত এই বিশ্বাসকে নায্যতা দেয় কিসে? কেউ একজন যিনি আরোহমূলকভাবে যুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন যে তারা ভুল তাদের কীভাবে আমাদের প্ররোচিত করা উচিত? অষ্টাদশ শতাব্দীর স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১ - ১৭৭৬) এই প্রশ্নের সরল কিন্তু র্যাডিক্যাল উত্তর দেন। তিনি যুক্তি দেন যে আরোহের ব্যবহার আদৌ যৌক্তিকভাবে নায্যতা পেতে পারে না। হিউম স্বীকার করেন যে আমরা সবসময় আরোহ ব্যবহার করি, প্রাত্যহিক জীবনে এবং বিজ্ঞানে, কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন এটা ঠিক নিষ্ঠুর পশুর আচরণের বিষয়। আরোহ ব্যবহারের জন্য একটি ভালো যুক্তি (good reason) প্রদানকে চ্যালেঞ্জ করলে, আমরা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারি না, তিনি মনে করতেন।
কিন্তু কীভাবে আমরা জানবো যে প্রকৃতির সুষমতার(UN)পূর্ব-অনুমান আদতেই সত্য, হিউম জিজ্ঞেস করেন? সম্ভবত আমরা কী এর সত্যতা কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারবো (প্রমাণের কঠোর অর্থে)? না, হিউম বলেন, আমরা পারবো না। কারণ একটা বিশ্বের কল্পনা করা সহজ যেখানে প্রকৃতি সুষম (uniform) নয়, বরং দিন দিন এর গতিপথ এলোমেলোভাবে পরিবর্তন হয়। এরকম ধরনের বিশ্বে, কম্পিউটার কোনো কারণ ছাড়াই বিস্ফোরিত হতে পারে, কখনো পানি সর্তকীকরণ ছাড়াই আমাদের বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে, বিলিয়ার্ড বলগুলো কখনো সংঘর্ষকালে আচমকা থেমে যেতে পারে, এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি এ ধরনের ‘অসুষম’ (non-uniform) বিশ্ব অনুধাবনীয় হয়, তখন এটা বলা যায় যে আমরা সুষম প্রকৃতির সত্যতা কঠোরভাবে প্রমাণ করতে পারিনা। কারণ যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি যে সুষম প্রকৃতি সত্য, তখন অসুষম বিশ্ব একটি যৌক্তিক অসাম্ভব্যতা হয়ে দাঁড়ায়।
এটা আমরা কবুল করতে পারি যে আমরা প্রকৃতির সুষমতা (UN) প্রমাণ করতে পারি না, তবুও এর সত্যতার জন্য উত্তম অভিজ্ঞতামূলক নজির (empirical evidence) অন্বেষণের প্রত্যাশা করতে পারি। সর্বোপরি, যেহেতু এখন পর্যন্ত প্রকৃতির সুষমতা সর্বদাই সত্য বলে প্রতিভাত, নিশ্চিতভাবেই তা আমাদের ভালো যুক্তি দেয় এটাকে সত্য বলে চিন্তা করতে? যেহেতু এটা নিজেই (itself) একটি আরোহমূলক যুক্তি (inductive argument), এবং সুতরাং নিজেই নির্ভর করে প্রকৃতির সুষমতার পূর্ব-ধারণার ওপর। এই যুক্তি (argument) যেটি প্রারম্ভ থেকেই প্রকৃতির সুষমতা ধারণ করে, তা স্পষ্টতই UN যে সত্য তা দেখাতে ব্যবহার করা যায় না। বিষয়টাকে অন্যভাবে স্থাপন করা যেতে পারে, এটা নিশ্চিতভাবেই একটি প্রতিষ্ঠিত ঘটনা যে প্রকৃতি এ পর্যন্ত প্রধানত সুষম আচরণই করেছে। কিন্তু যুক্তি দিতে আমরা এই ঘটনার দোহাই দিতে পারি না যে প্রকৃতি সুষম হিসেবে বহাল থাকবে, কারণ এটি ধরে নেয় যে অতীতে যা সংঘটিত হয়েছে তাই হবে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তার নির্ভরযোগ্য পথ প্রদর্শক- যেটি হল প্রকৃতির সুষমতার পূর্ব-ধারণা। যদি আমরা অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তির ওপর যুক্তি দিতে চেষ্টা করি, তাহলে আমরা একটি চক্রে যুক্তি-প্রক্রিয়াকে নিঃশেষ করবো (end up)।
কারও আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস স্থাপন উচিত হলেও তিনি এই প্রক্রিয়াতে বিশ্বাস করতে নাও পারেন। কীভাবে আপনি তাঁর এই যুক্তি প্রক্রিয়াতে প্রত্যয় জন্মাবেন, সেটি থেকে কল্পনা করা যায় কেন আপনি হিউমের পয়েন্টের শক্তির জায়গাটার প্রশংসা করবেন। আপনি সম্ভবত বলবেন: দেখুন, আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত বেশ ভালো কাজ করেছে। আরোহ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীগণ পরমাণু বিযোজিত করেছেন, চাঁদের পৃষ্ঠে মানুষকে অবতরণ করিয়েছেন, কম্পিউটার আবিষ্কার করেছেন, এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে আরোহ ব্যবহার না করা মনুষ্যজন কদর্য মৃত্যুবরণ করার প্রবণতা প্রদর্শন করে। তাঁরা আরসেনিক ভক্ষণ করেন এই বিশ্বাসে যে এটি তাঁদের পুষ্টি যোগাবে, উচু ভবন থেকে লাফ দেয় এই বিশ্বাসে যে তাঁরা উড়তে পারবে, এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। এটি আপনাকে স্পষ্টভাবে যুক্তি প্রদান করবে আরোহমূলকভাবে। কিন্তু অবশ্যি এটি সন্দেহকারীকে উপলব্ধি করানো যাবে না। আরোহ নির্ভরযোগ্য এই যুক্তি দেয়া যায় এই জন্য যে এটা এখন পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করেছে আরোহমূলক উপায়ে যুক্তি দেওয়াতে। কিন্তু কেউ একজন যিনি ইতোমধ্যে আরোহকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না, এ ধরনের যুক্তি (argument) তার নিকট কোনো ওজন বহন করে না। সেটাই হল হিউমের মৌলিক পয়েন্ট।
সুতরাং অবস্থান এই। হিউম দেখান যে আমাদের আরোহমূলক অবধারণগুলো নির্ভর করে প্রকৃতির সুষমতার পূর্ব-অনুমানের ওপর (on UN assumption)। কিন্তু আমরা প্রমান করতে পারি না যে প্রকৃতির সুষমতা সত্য এবং প্রশ্নাতীতভাবে আমরা অভিজ্ঞতামূলক নজির উপস্থাপন করতে পারি না এর সত্যতার জন্য। সুতরাং আমাদের আরোহমূলক অবধারণসমূহ নির্ভর করে দুনিয়া সম্পর্কে পূর্ব-অনুমানের ওপর, যার জন্য আমাদের ভালো ভিত্তি নেই। হিউম এই মর্মে উপসংহারে উপনীত হন যে আরোহের ওপর আমাদের আস্থা নিছক অন্ধ বিশ্বাস- এটি মোটেই কোনো যৌক্তিক নায্যতা প্রতিপাদন করে না।
এই কৌতূহলী যুক্তি (argument) বিজ্ঞান দর্শনে (on the philosophy of science) একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে, এবং আজ তক তা করেছে চলেছে।(পপার বিশ্বাস করতেন যে হিউম আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার সামগ্রিক অযৌক্তিকতা দেখিয়েছেন।হিউমের এই অযৌক্তিকতা দিয়ে প্ররোচিত হয়ে পপার ব্যর্থভাবে দেখাতে চেষ্টা করেন যে বিজ্ঞানীদের কেবলমাত্র আরোহমূলক অবধারণসমূহ ব্যবহার করা দরকার।) হিউমের যুক্তির প্রভাব উপলব্ধি করা কঠিন নয়। যেহেতু স্বাভাবিকভাবে আমরা বিজ্ঞানকে চিন্তা করি যৌক্তিক অনুসন্ধানের যথার্থ দৃষ্টান্ত হিসেবে। দুনিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীবৃন্দ আমাদের যা বলেন তার উপর গভীর বিশ্বাস স্থাপন করি। প্রতিবার আমরা যখন বিমানে ভ্রমণ করি, তখন যে বিজ্ঞানীগণ বিমানের নকসা করেছিলেন তাঁদের হাতে আমাদের সমর্পণ করি। কিন্তু বিজ্ঞান ভরসা করে আরোহের উপর, এবং হিউমের যুক্তিতে প্রতীয়মান যে আরোহকে যৌক্তিকভাবে নায্যতা দেয়া যায় না। যদি হিউম সঠিক হন, তাহলে যে বুনিয়াদের উপর বিজ্ঞান নির্মিত, সেই বুনিয়াদকে আমরা যতটা প্রত্যাশা করি ঠিক ততটা দেখতে দৃঢ় নয়। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থা (puzzling state of affairs) হিউমের আরোহের সমস্যা হিসেবে পরিচিত।
দার্শনিকবৃন্দ হিউমের সমস্যার প্রতি সাড়া দিয়েছেন আক্ষরিক অর্থেই ডজন ডজন নানা পদ্ধতিতে; এটা এখন পর্যন্ত একটি সক্রিয় গবেষণার ক্ষেত্র। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন এর মূল নিহিত সম্ভাব্যতার ধারণায় (in the concept of probability)। এই সুপারিশ আপাত দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত (plausible)। এটা ভাবা খু্বই স্বাভাবিক যে একটি আরোহমূলক অবধারণের প্রতিজ্ঞাসমূহ (premisses of an inductive inference) উপসংহারের সত্যতার নিশ্চায়তা দেয় না, তবে তারা এটাকে সম্পূর্ণ সম্ভাবিত করে (make it quite probable)। সুতরাং এমনকি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিশ্চিত না হলেও, এটি উচ্চমাত্রায় সম্ভাবিত হতে পারে। কিন্তু হিউমের সমস্যার প্রতি এই সাড়া এর নিজেরই সমস্যাসমূহ (difficulties) তৈরী করে, এবং কোনভাবেই সার্বজনীনভাবে গৃহিত হয় না; যথাসময়ে আমরা এটাতে ফেরত আসবো।
আর একটি জনপ্রিয় সাড়া (response) হলো এটা কবুল করা যে আরোহকে যৌক্তিকভাবে ন্যায্যতা দেয়া যায় না, বরং যুক্তি দেয়া যায় যে এটা আদতে খুব একটা সমস্যাযুক্ত (problematic) নয়। একজন কীভাবে এই ধরণের অবস্থানকে সমর্থন করতে পারেন? কিছু দার্শনিক যুক্তি দিয়েছেন যে আরোহ খুবই মৌলিক, আমরা কীভাবে চিন্তা করি ও যুক্তি দেখাই যে এটা এমন ধরনের বিষয় না যেটির নায্যতা প্রতিপাদন করা যেতে পারে। পিটার স্ট্রসন (Peter Strawson), একজন প্রভাবশালী সমসাময়িক দার্শনিক। তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি (view) সমর্থন করেন একটি উপমা দিয়ে। যদি কেউ এই মর্মে উদ্বিগ্ন বোধ করেন যে একটি নির্দিষ্ট মকদ্দমা (action) আইন-সঙ্গত কিনা, তখন তিনি আইন গ্রন্থ পাঠ করে পরামর্শ করতে পারেন এবং আইন গ্রন্থ কী বলে তার সঙ্গে মকদ্দমাটিকে তুলনা করতে পারেন। কিন্তু ধরুন কেউ এই মর্মে উদ্বিগ্ন বোধ করে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে আইনটি নিজেই ন্যায়সঙ্গত কীনা। এটা বাস্তবিকই অদ্ভুত উদ্বেগ। কারণ আইন একটি মানদন্ড যার সাহায্যে অন্যান্য বিষয়ের বৈধতা (legality) বিচার করা হয়। এবং মানদন্ডটি নিজেই বৈধ কিনা- এটির অনুসন্ধান ঊন অর্থ তৈরী করে (makes little sense)। আরোহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, স্ট্রসন যুক্তি দেন। মানদন্ডগুলোর একটি হলো আরোহ, যেটি আমরা ব্যবহার করি এই সিদ্ধান্ত নিতে যে দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের দাবীগুলো ন্যায় সঙ্গত কিনা। উদাহরণস্বরূপ, একটি ঔষধ কোম্পানি দাবী করল যে তাদের নয়া ঔষধের বিস্ময়কর উপকারিতা আছে। আমরা আরোহ ব্যবহার করি কোম্পানির দাবীর যৌক্তিকতা বিচার করতে। সুতরাং এটা জিজ্ঞেস করা ঊন অর্থ বহন করে যে আরোহ নিজেই যৌক্তিক কিনা।
স্ট্রসন (Strawson) বাস্তবিকই হিউমের সমস্যাকে নিষ্ক্রিয় করতে সফল হন? কিছু দার্শনিক বলেন হ্যাঁ, অন্যেরা বলেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কবুল করেন এটা দেখা কষ্টকর যে কীভাবে আরোহের একটি সন্তোষজনক নায্যতা পাওয়া যেতে পারে। (ফ্রাংক র্যামজে, ১৯২০-এর দশকের একজন ক্যামব্রিজ দার্শনিক, তিনি বলেন যে আরোহের একটি নায্যতার জন্য জিজ্ঞেস করা মানে 'চাঁদের জন্য ক্রন্দন করা' ।) এটা এমন একটাকিছু যা আমাদের উদ্বিগ্ন করা উচিত কিনা, অথবা বিজ্ঞানে আমাদের বিশ্বাসকে ঝাকুনি দেয় কিনা, এটা একটা কঠিন প্রশ্ন যেটি আমাদের নিজেদের আলোড়িত করে।
সেরা ব্যাখ্যার জন্য অবধারণ (Inference to the best explanation)
আমরা এ পর্যন্ত যতদূর আরোহমূলক অবধারণসমূহ পরীক্ষা করেছি, আমরা দেখেছি সবগুলোরই মূলগত গঠন একই (all had essentially the same structure)। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, অবধারণের প্রতিজ্ঞা এই রূপ (form) ধারণ করে- এ পর্যন্ত পরীক্ষাকৃত সকল x হয়েছে y, এবং উপসংহারের রূপ (form) হয় এরকম- পরবর্তীতে যে x পরীক্ষা করা হবে তা হবে y, অথবা সকল x হবে y। অন্য কথায়, এই অবধারণগুলো আমাদের নিয়ে যায় পরীক্ষাকৃত থেকে একটি প্রদত্ত ধরনের অপরীক্ষাকৃত উদহারণগুলোতে।
এ ধরনের অবধারণগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় দৈনন্দিন জীবনে এবং বিজ্ঞানে, যেমনটি আমরা দেখেছি। যাহোক, অ-অবরোহমূলক অবধারণের খুবই প্রচলিত ধরনও আছে, যা এই সরল প্যাটার্নের সঙ্গে খাপ খায় না। নিচের উদারণ বিবেচনা কর যাক:
কয়েক টুকরো বাদে মিটসেফে রাখা পনির অদৃশ্য হয়ে গেল
গতরাতে মিটসেফ থেকে কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা গিয়েছিলো
সুতরাং, ইঁদুর পনির ভক্ষণ করেছিলো।
এটা স্পষ্ট যে এই অবধারণ অ-অবরোহমূলক: উপসংহার প্রতিজ্ঞার ফলস্বরূপ সংঘটিত হয় না (the premises do not entail the conclusion)। কারণ গৃহকর্মী (maid) পনির চুরি করতে যেয়ে সেসময় কয়েক টুকরো চালাকির সাথে রেখে যেতে পারেন যাতে মনে হয় এটা ইঁদুরের হাত সাফাইয়ের কাজ। কিচিরমিচির আওয়াজের কারণ হতে পারে যে কোন সংখ্যক উপায়ে।সম্ভবত এটির মূল কারণ হতে পারে বয়লারের অতিরিক্ত উত্তাপ। তাসত্ত্বেও, অবধারণ স্পষ্টতই যৌক্তিক । বিভিন্ন ধরনের বিকল্প ব্যাখ্যার থেকে ইঁদুরের পনির ভক্ষণ প্রকল্পটি (hypothesis) উপাত্তের অধিকতর একটা ভালো ব্যাখ্যা প্রদান করে বলে মনে হয়। সর্বোপরি গৃহকর্মী সাধারণত পনির চুরি করে না, আধুনিক বয়লার অতিরিক্ত উত্তপ্ত হওয়ার প্র্রবণতা প্রদর্শন করে না। অন্যদিকে ইঁদুর সুযোগ পেলেই সাধারণত পনির ভক্ষণ করে থাকে এবং কিচিরমিচির আওয়াজের প্রবণতা প্রদর্শন করে থাকে। সুতরাং যদিও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে ইঁদুর প্রকল্পটি যৌক্তিক (true)। ভারসাম্য হিসেবে এটি পর্যবেক্ষণে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত (plausible) মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্যের বর্ণনায় এটি সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।
এ ধরনের যুক্তি-প্রক্রিয়া
‘সেরা ব্যাখ্যার অবধারণ হিসেবে পরিচিত’, এর স্পষ্ট যুক্তিসমূহের জন্য (for obvious
reasons), সংক্ষেপে এটিকে আমরা বলি IBE। IBE ও আরোহের মধ্যকার সম্পর্ককে ঘিরে কিছু
পরিভাষাগত বিভ্রান্তি(terminological confusion)বিদ্যমান। কিছু দার্শনিক IBE-কে বর্ণনা
করেন আরোহমূলক অবধারণ হিসেবে; কার্যত, ‘যেকোনো অবধারণ যেটি অবরোহমূলক নয়’ বোঝাতে তাঁরা
‘আরোহমূলক অবধারণ’ ব্যবহার করেন। অন্যরা IBE-এর সাথে আরোহমূলক অবধারণের প্রতি-তুলনা
করেন, যেমনটি আমরা উপরে করেছি। বেকড কেক (pie) কাটার এই পদ্ধতির ওপর, একটি প্রদত্ত
প্রকরণের পরীক্ষাকৃত থেকে অপরীক্ষাকৃত উদাহরণসমূহের অবধারণের জন্য ‘আরোহমূলক অবধারণ’
সংরক্ষণ করা হয়, ইতোপূর্বে আমরা যে প্রকরণ পরীক্ষণ করেছি; এই অ-অবরোহমূলক অবধারণের
দু’টি স্বতন্ত্র ধরন হলো IBE ও আরোহমূলক অবধারণ। আমরা কোন পরিভাষা সমর্থন করি- তার
ওপর কোন কিছুই ঝুলে থাকে না।
বিজ্ঞানীরা প্রায়ই IBE ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ, জীবজগৎ সম্পর্কে নানা ঘটনার প্রতি মনোযোগ দিতে আহ্বান জানিয়ে ডারউইন তাঁর বিবর্তন তত্ত্বের জন্য যুক্তি দেন, যেগুলো ব্যাখ্যা করা কঠিন যদি আমরা ধরে নেই বর্তমান প্রজাতিসমূহ পৃথকভাবে তৈরী করা হয়েছে, কিন্তু তা পূর্ণ অর্থ তৈরী করে যদি বর্তমান প্রজাতিসমূহ একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্বর্তিত হয়ে থাকে, যা তার তত্ত্ব ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ঘোড়ার পায়ের সাথে জেব্রার পায়ের শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্য বিদ্যমান। কীভাবে আমরা এগুলো ব্যাখ্যা করবো, যদি ঈশ্বর ঘোড়া ও জেব্রা পৃথকভাবে তৈরী করে থাকেন? সম্ভবত তিনি তাদের পাগুলো তৈরী করতে পারতেন যত ইচ্ছা তত পৃথক করে। কিন্তু যদি ঘোড়া ও জেব্রা উভয়েই একটি সাম্প্রতিক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসে থাকে (have descended), তবে এটি তাদের শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্যের স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে। ডারউইন যুক্তি দেন যে এই ধরনের ঘটনাসমূহ এবং আরও অন্য প্রকারের ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার সামর্থ গঠন করে এর সত্যতার শক্তিশালী নজির।
IBE-এর আর একটি উদাহণ হলো ব্রাউনিয় গতির ওপর আইনস্টাইনের বিখ্যাত কাজ। এটি তরল বা গ্যাসে ভাসমান আণুবিক্ষণিক কণিকাসমূহের বিঙ্খৃল, আঁকাবাঁকা ব্রাউনিয় গতিকে নির্দেশ করে। স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন (১৭১৩-১৮৫৮) এই গতি আবিষ্কার করেন, যখন তিনি পানিতে ভাসমান পরাগরেণু নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। ঊনিশ শতকে ব্রাউনিয় গতির কিছু ব্যাখ্যা অগ্রসর করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটি তত্ত্ব গতির কারণ হিসেবে নির্দেশ করে কণিকাসমূহের মধ্যকার তড়িৎ আকর্ষণকে, আর একটি চারপাশের প্রতিবেশ থেকে আলোড়নকে (agitation from external surroundings), এবং আর একটি প্রবাহীতে বিদ্যমান পরিচালন স্রোতকে (convection currents) নির্দেশ করে। সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তি হলো বস্তুর গতীয় তত্ত্ব। এই তত্ত্ব যুক্তি দেয় যে গতিশীল অণু বা পরমাণু দিয়ে তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ গঠিত। ব্রাউন প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে চারপাশের অণুগুলোর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে অবলম্বী কণিকাগুলো (suspended particles) অস্থির ও এলোমেলো গতি প্রাপ্ত হয়। এই তত্ত্ব প্রথম প্রস্তাব করা হয় ঊনিশ শতকের শেষের দিকে, কিন্তু তখন ব্যাপকভাবে গৃহিত হয়নি, এর পেছনের কারণ অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন না যে পরমাণু ও অণুসমূহ প্রকৃত ভৌত সত্তা, এই অবিশ্বাসও কম দায়ী নয়। কিন্তু ১৯০৫-এ, আইনস্টাইন ব্রাউনিয় গতির একটি প্রতিভাদীপ্ত গাণিতিক বর্ণনা প্রদান করেন, কিছু নিখুঁত, পরিমাণগত ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যা পরবর্তীতে পরীক্ষণগতভাবে নিশ্চিত হয়। আইনস্টাইনের কাজের পরে, ব্রাউনিয় গতির একটি অধিকতর ভালো ব্যাখ্যা প্রদানে গতীয় তত্ত্ব দ্রুত সক্ষম হয় যেকোনো বিকল্প থেকে। আর পরমাণু ও অণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়বাদীতা (scepticism) দ্রুত মিলিয়ে যায়।
একটা আগ্রহোদ্দীপক প্রশ্ন
হল IBE অথবা সাধারণ আরোহ (ordinary induction) অবধারণের (inference)একটি অধিকতর মৌলিক
প্যাটার্ন কিনা। দার্শনিক গিলবার্ট হারমান যুক্তি দেন যে IBE হল অধিকতর মৌলিক। এই
দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, যখনি আমরা একটি সাধারণ আরোহমূলক অবধারণ তৈরী করি যেমন ‘এ পর্যন্ত
পরীক্ষাকৃত ধাতুর সকল টুকরো বিদ্যুৎ পরিবহন করে, সুতরাং ধাতুর সকল টুকরোই বিদ্যুৎ পরিবহন
করে’, তখনই আমরা পরোক্ষভাবে ব্যাখ্যামূলক বিবেচনাসমূহের প্রতি সানুনয় আবেদন করি। আমরা
মনে করি যে কেন আমাদের নমুনা ধাতুর টুকরাসমূহ বিদ্যুৎ পরিবহন করে- তার জন্য ব্যাখ্যা
এই যে একজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান সেগুলো নিয়ে ঝালাই করে, কিন্তু তা থেকে আমরা অবধারণ
করতে পারি না যে ধাতুর সকল টুকরোই বিদ্যুৎ পরিবহন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাবৃন্দ
বলেন না যে IBE ও সাধারণ আরোহের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই- স্পষ্টতই আছে। বরং, তাঁরা
চিন্তা করেন যে সাধারণ আরোহ চুড়ান্তভাবে IBE–এর উপর নির্ভরশীল।
যাহোক, অন্য দার্শনিকবৃন্দ
যুক্তি দেন যে এটি বিষয়সমূহকে পশ্চাতে ঠেলে দেয়: তাঁরা বলেন, IBE নিজেই সাধারণ আরোহের
ওপর পরাশ্রয়ী। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ভিত্তি দেখতে, উপরের মিটসেফের-ভেতর-পনিরের (the
cheese-in-the-larder) উদাহরণটি সম্পর্কে আবার ভাবুন। কেন গৃহকর্মী প্রকল্প থেকে (maid
hypothesis) ইদুর প্রকল্পকে (mouse hypothesis) এই ডাটার জন্য একটি অধিকতর ভালো ব্যাখ্যা
হিসেবে মনে করতে হবে? সম্ভবত, কারণ আমরা জানি যে গৃহকর্মী সাধারণত পনির চুরি করে না,
অন্যদিকে ইদুর করে। কিন্তু এটি সেই জ্ঞান যেটি আমরা অর্জন করেছি সাধারণ আরোহমূলক যুক্তি-প্রক্রিয়ার
(ordinary inductive reasoning) মাধ্যমে, পূর্বেকার ইদুর ও গৃহকর্মীর আচরণ পর্যবেক্ষণের
ভিত্তিতে। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গি (view) অনুসারে, যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি
প্রতিযোগী প্রকল্পসমূহের কোন গ্রুপটি আমাদের ডাটার সেরা ব্যাখ্যা প্রদান করে, তখন আমরা
অবিচ্ছিন্নভাবে (invariably) সাধারণ আরোহের মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞানের প্রতি আবেদন জানাবো।
এইভাবে IBE-কে অবধারণের একটি অধিকতর মৌলিক ধরন (mode) হিসেবে গণ্য করা বেঠিক।
এই বিরোধী মতামতগুলোর কোনটিকে আমরা সমর্থন করবো, স্পষ্টভাবে একটা ইস্যু দাবী করে অধিকতর মনোযোগ (more attention)। যদি আমরা IBE ব্যবহার করতে চাই, ডাটার সেরা ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে প্রতিযোগী প্রকল্পসমূহের কোনটি, তা সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু উপায় আমাদের দরকার। কিন্তু কোন মানদন্ড (criteria) এটি নির্ণয় করে? জনপ্রিয় উত্তর এই যে সেরা ব্যাখ্যা সরলতম অথবা সবচেয়ে অনাড়ম্বরের একটি (parsimonious one)। আবার বিবেচনা করা যাক মিটসেফে-পনির (cheese-in-the-larder) উদারণটি। এখানে দুটি ডাটা বিদ্যমান, যাদের ব্যাখ্যা দরকার: হারিয়ে যাওয়া পনির এবং কিচিরমিচির শব্দ। উভয় টুকরো ডাটা ব্যাখ্যা করতে ইদুর প্রকল্প স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয় মাত্র একটি কারণ: সেটি হল ইদুর। কিন্তু একই ডাটা ব্যাখ্যা করতে গৃহকর্মী প্রকল্প অবশ্যি স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয় দুটি কারণ: একজন অসৎ গৃহকর্মী এবং একটি অতিতপ্ত বয়লার (overheating boiler)। সুতরাং ইদুর প্রকল্প অধিকতর অনাড়ম্বর (parsimonious), তাই অধিকতর উত্তম। অনুরূপভাবে ডারউইনের উদাহরণও। কেবলমাত্র প্রজাতিসমূহের মধ্যকার নিছক শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্যই নয়, ডারউইনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে জীবজগৎ (living world) সম্পর্কে ঘটনাবলীর বৈচিত্রময় পরিসর। ডারউইন জানতেন ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটি অন্যান্য পদ্ধতিতেও ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব সবগুলো ঘটনা একযোগে ব্যাখ্যা করতে পারে-সেটিই এটিকে ডাটার সেরা ব্যাখ্যায় পরিণত করেছে।
সরলতা অথবা অনাড়ম্বতার(simplicity or parsimony) ধারণা হল একটি উত্তম ব্যাখ্যার চিহ্ন, এটি সম্পূর্ণ মর্মস্পর্শী, এবং IBE-ধারণা সম্প্রসারণে নিশ্চিতভাবেই সহায়তা করে। কিন্তু যদি বিজ্ঞানীবৃন্দ অবধারণের পথপ্রদর্শক (guide to inference) হিসেবে সরলতাকে ব্যবহার করেন, তখন এটি একটি সমস্যা উত্থাপন করে। কারণ, কীভাবে আমরা জানবো যে মহাবিশ্ব জটিল না হয়ে বরং সরল? যে তত্ত্বটি সবচেয়ে কমসংখ্যক কারণের প্রেক্ষাপটে ডাটা ব্যাখ্যা করে, সেই তত্ত্বটি পছন্দ করাটাই বুদ্ধিমান মনে হয়। কিন্তু কোনো বিষয়গত কারণ আছে কী যে জন্য চিন্তা করা যায় যে একটি অধিকতর কম সরল তত্ত্বের (less simple theroy) থেকে এ ধরনের তত্ত্ব সত্য হতে পারে? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞান দার্শনিকবৃন্দ একমত নন।
সম্ভাব্যতা ও আরোহ
সম্ভাব্যতার ধারণা দার্শনিকভাবে হতবুদ্ধিকর।ধাঁধার অংশ হল এই যে ‘সম্ভাব্যতা’ শব্দটির মনে হয় একাধিক অর্থ আছে। যদিআপনি পড়ে থাকেন যে ১০০ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে এমন ব্রিটিশ নারীর সংখ্যা প্রতি ১০ জনে ১ জন, আপনি তখন এই বলে বুঝে থাকবেন যে সকল ইংরেজ নারীর ১০ ভাগের ১ ভাগ ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন। অনুরূপভাবে, যদি আপনি পড়ে থাকেন যে পুরুষ ধূঁমপায়ীর ফুসফুসের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা প্রতি ৪ জনে ১ জন, এটি আপনি নেবেন এই অর্থে যে সকল পুরুষ ধূঁমপায়ীর এক-চতুর্থাংশ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এটি সম্ভাব্যতার সংঘটন হার ব্যাখ্যা (frequency interpretation) হিসেবে পরিচিত: এটি সম্ভাব্যতাকে অনুপাত অথবা সংঘটন হারের সাথে সমীকৃত করে (equate)। কিন্তু যদি আপনি পড়েন যে মঙ্গল গ্রহে জীবন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ১,০০০-এর মধ্যে ১টি, এর অর্থ কী? এর অর্থ কি এই যে আমাদের সৌরজগতে প্রতি ১০০০ গ্রহের মধ্যে ১টিতে জীবন থাকে? স্পষ্টতই এটি নয়। একটা কারণ আমাদের সৌরজগতে মাত্র ৯টি গ্রহ আছে। সুতরাং সম্ভাব্যতার একটি ভিন্ন ধারণা অবশ্যি এখানে কাজ করে।
‘মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা একহাজারের মধ্যে একটি’-এই বিবৃতির একটি ব্যাখ্যা এই যে বিবৃতি উচ্চারণকারী ব্যক্তি সাটামাটাভাবে তাদের নিজেদের সম্পর্কে একটি বিষয়ীগত ঘটনার (subjective fact) বার্তা দেন- তাঁরা আমাদের বলেন যে কীভাবে মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনার কথা তাঁরা চিন্তা করেন। এটি সম্ভাব্যতার বিষয়ীগত ব্যাখ্যা। এটি সম্ভাব্যতাকে আমাদের ব্যক্তিগত অভিমতসমূহের শক্তির মাত্রা (measure of the strength) হিসেবে গ্রহণ করে। স্পষ্টভাবে, আমরা কিছু অভিমত অন্যগুলোর থেকে অধিকতর জোরালোভাবে ধারণ করি। আমি খুব আত্মবিশ্বাসী যে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতবে, যীশু খ্রীস্টের অস্তিত্বেও যুক্তিসঙ্গতভাবে আত্মবিশ্বাসী, বরং কম আত্মবিশ্বাসী যে বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয় এড়ানো যাবে। এটি বলে প্রকাশ করা যায় যে ‘ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতবে’-এই বিবৃতির প্রতি আমি উচ্চ সম্ভাব্যতা আরোপ করি, ‘যিশু খ্রীস্টের অস্তিত্ব ছিল’-এটির প্রতি মোটামুটি সম্ভাবনা, এবং ‘বৈশ্বিক পরিবেশগত বিপর্যয় এড়ানো যাবে’- এটির সম্ভাবনা নিম্ন। অবশ্যি, এই বিবৃতিগুলোতে আমার প্রত্যয়ের দৃঢ়তার (strength) সঠিক মান আরোপন খুবই কঠিন, কিন্তু বিষয়ীগত ব্যাখ্যার প্রবক্তাগণ এটিকে গণ্য করেন নিছক একটি কেজো সীমাবদ্ধতা (practical limitation) হিসেবে। নীতিগতভাবে, বিবৃতিসমূহের প্রত্যেকটিতে একটা সুনির্দিষ্ট সংখ্যাগত সম্ভাব্যতা ধার্য করার সামর্থ আমাদের থাকা উচিত। এই বিবৃতিসমূহের ওপর আমাদের অভিমত আছে, যা প্রতিফলিত করে কতটা জোরালোভাবে আমরা সেগুলো বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস করি, তাঁরা বলেন।
সম্ভাব্যতার বিষয়ীগত ব্যাখ্যা প্রকারান্তরে বোঝায় যে মানুষ যা বিশ্বাস করে তার বাইরে স্বাধীনভাবে কোন বিষয়গত সত্য (objective fact) নাই। যদি আমি বলি যে মঙ্গল গ্রহে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা উচ্চ এবং আপনি বলেন যে এটির সম্ভাবনা খুব কম, আমাদের কেউই সঠিক বা বেঠিক নয়- আমরা উভয়েই সহজভাবে বলছি যে কত দৃঢ়ভাবে (how strongly) প্রশ্নটিতে বিদ্যমান বিবৃতিটি (the statement in question) বিশ্বাস করি। মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে অথবা নেই, সে সম্পর্কে অবশ্যি বিষয়গত সত্য আছে; বিষয়ীগত ব্যাখ্যা অনুসারে, মঙ্গলে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা কতটা- এ বিষয়ে শুধু কোনো বিষয়গত সত্য নাই। সম্ভাব্যতার যুক্তিবিদ্যাগত ব্যাখ্যা এই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করে। এটি ধারণ করে যে ‘মঙ্গলে প্রাণের সম্ভাবনা খু্বই বেশী’-এ ধরনের বিবৃতি, প্রমাণের সুনির্দিষ্টায়িত কাঠামোর সাপেক্ষে (relative to a specified body of evidence) বিষয়গতভাবে সত্য অথবা মিথ্যা। এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর (on this view), বিবৃতির সম্ভাব্যতা হলো এর সপক্ষে প্রমাণের শক্তির পরিমাপ। যুক্তিবিদ্যাগত ব্যাখ্যার সমর্থকবৃন্দ মনে করেন যে আমাদের ভাষায় যেকোনো দুটি বিবৃতির জন্য, আমরা নীতিগতভাবে একটির সম্ভাব্যতা আবিষ্কার করতে পারি, অন্যটিকে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বর্তমান হার বিবেচনায় এনে ১০,০০০ বছরের মধ্যে বরফ যুগ শুরু হবে, এই মর্মে আমরা সম্ভাব্যতা আবিষ্কার করতে চাইতে পারি। বিষয়গত ব্যাখ্যা বলে এই সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কোন বিষয়ীগত সত্য নাই। কিন্তু যুক্তিবিদ্যাগত ব্যাখ্যা দৃঢ়ভাবে জোর দেয় যে সম্ভাবনা আছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বর্তমান হার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাগত সম্ভাব্যতা আরোপ করে, তাহলো ১০,০০০ বছরের মধ্যে বরফ যুগ সংঘটিত হতে পারে, এই সংখ্যাগত সম্ভাব্যতা ধরা যাক ০.৯। সম্ভাব্যতা ০.৯-কে স্পষ্টভাবে উচ্চ সম্ভাবনা হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ সর্বোচ্চ সম্ভাবনা ১.০। সুতরাং ‘১০,০০০ বছরের মধ্যে বরফ যুগ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই উচ্চ’– বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে দেয়া প্রমাণ অনুসারে এই বিবৃতি তখন বিষয়গতভাবে সত্য হবে।
যদি আপনি সম্ভাব্যতা অথবা পরিসংখ্যান পড়ে থাকেন, তবে সম্ভাব্যতার বিভিন্ন ব্যাখ্যার এই আলাপ দিয়ে আপনি বিভ্রান্ত হতে পারেন। আপনি যা শিখেছেন তার সাথে এই ব্যাখ্যাগুলো কীভাবে সম্পর্কিত? এটির উত্তর এই যে সম্ভাব্যতার গাণিতিক অধ্যয়ন নিজ থেকে আমাদের বলে না যে সম্ভাব্যতার অর্থ কী, যা আমরা উপরে পরীক্ষা করেছি। অধিকাংশ পরিসংখ্যানবিদ প্রকৃতপক্ষে কম্পাঙ্ক ব্যাখ্যা (frequency interpretation) সমর্থন করেন, কিন্তু অধিকাংশ দার্শনিক সমস্যার মত, সম্ভাব্যতা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে- এই সমস্যাও গাণিতিকভাবে সমাধান করা যায় না। যে ব্যাখ্যাই আমরা অবলম্বন করিনা কেন, সম্ভাব্যতার সমাধানের জন্য গাণিতিক সূত্রাবলী একই থাকে।
দুটি প্রধান কারণের জন্য বিজ্ঞান দার্শনিকবৃন্দ সম্ভাব্যতার ওপর আগ্রহী। প্রথমটি হলো এই যে বিজ্ঞানের অনেক শাখাতে, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানে আমরা অনেক সূত্র ও তত্ত্ব দেখতে পাই যেগুলো সূত্রবদ্ধ হয়েছে সম্ভাব্যতার ধারণা ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করুন, মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স নামে পরিচিত তত্ত্বকে, যেটি কারবার করে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে জিনসমূহের স্থানান্তর নিয়ে যৌণ প্রজননক্ষম জনসংখ্যার মধ্যে। মেন্ডেলিয় জেনেটিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহের একটি হলো এই যে একটি জীবসত্তায় প্রত্যেকটি জিনের ৫০% সুযোগ রয়েছে জীবসত্তার জননকোষের (sperm or egg) যেকোন একটির মধ্যে এটির নিজেকে তৈরী করবার। সুতরাং আপনার মায়ের মধ্যে দেখতে পাওয়া যেকোন জিন আপনার মধ্যে থাকার ৫০% সুযোগ রয়েছে, এবং আপনার পিতার মধ্যকার জিনসমূহের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। এই তত্ত্ব এবং অন্যান্য তত্ত্ব ব্যবহার করে, জিনতত্ত্ববিদগণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেন এই বিষয়ে যে কেন একটা পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিশেষ বৈশিষ্টসমূহ (উদারহণস্বরূপ চোখের রঙ) যে পদ্ধতিতে তারা বিদ্যমান আছে সেভাবে বন্টিত হয়। এখন ‘‘সুযোগ” কেবলমাত্র সম্ভাব্যতার জন্য আর একটি শব্দ, সুতরাং এটা স্পষ্ট যে আমাদের মেন্ডিলিয়ান নীতি সম্ভাব্যতার ধারণার (concept of probability) কেজো ব্যবহার (essential use) অব্যাহত রাখে।বৈজ্ঞানিক সূত্র ও নীতিসমূহের আরও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যেগুলো সম্ভাব্যতার প্রেক্ষিত দিয়ে প্রকাশ করা যায়। সম্ভাব্যতার দার্শনিক অধ্যয়নের জন্য এই সূত্র ও নীতিসমূহ উপলদ্ধির প্রয়োজন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা।
কেন বিজ্ঞান দার্শনিকগণ সম্ভাব্যতার ধারণাতে আগ্রহী- এটির দ্বিতীয় কারণ হলো এই প্রত্যাশা যে এটি আরোহমূলক অবধারণে কিছু আলো ফেলতে পারে, বিশেষত হিউমের সমস্যার ওপর; এটিই আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া দরকার। হিউমের সমস্যার মূলে প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে একটি আরোহমূলক অবধারণের প্রতিজ্ঞা এর উপসংহারের সত্যতার প্রতিশ্রুতি দেয় না (do not gurantee)। কিন্তু এটি প্রস্তাব দিতে প্রলুব্ধ করে যে প্রতিনিধিত্বকারী (typical) আরোহমূলক অবধারণের প্রতিজ্ঞা উপসংহারকে উচ্চমাত্রায় সম্ভাব্য করে তোলে। যদিও সত্য এই যে এ পর্যন্ত পরীক্ষাকৃত সকল বস্তু নিউটনের অভিকর্ষ সূত্র মেনে চলে- এটি প্রমাণ করে না যে সকল বস্তু মেনে চলে, নিশ্চিতভাবে এটি খুবই সম্ভাব্য করে তোলে? সুতরাং নিশ্চিতভাবে সর্বোপরি হিউমের সমস্যার উত্তর খুব সহজে দেয়া যেতে পারে?
বিষয়গুলো
এতটা সহজ নয়। কারণ হিউমের অনুমানের এই প্রতিক্রিয়াতে আমাদের অবশ্যি জিজ্ঞেস করতে হবে
সম্ভাব্যতার ব্যাখ্যা কী হবে। মাত্রাগত ব্যাখ্যায় (on frequency interpretation), এটা
খুবই সম্ভব যে সকল বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে- বলা মানেই সকল বস্তুর অধিকাংশই সূ্ত্রটা
মেনে চলে। কিন্তু আমরা যদি আরোহ ব্যবহার না করি তবে আমাদের জানার কোনো উপায় থাকে ন!
কারণ মহাবিশ্বের সকল বস্তুর একটা ক্ষুদ্র অংশ
কেবলমাত্র আমরা পরীক্ষা করেছি। সুতরাং হিউমের সমস্যাটা থেকেই যায়। এই বিষয়টা পর্যবেক্ষণ
করতে আর একটা উপায় হলো এই। আমরা ‘সকল পরীক্ষণকৃত বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে’ থেকে ‘সকল বস্তু
নিউটনের সূত্র মেনে চলে’ অবধারণ দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই অবধারণের প্রতিজ্ঞা উপসংহারের
সত্যতার প্রতিশ্রুতি দেয় না- হিউমের এই উদ্বেগের প্রতি জবাবে আমরা সুপারিশ করেছিলাম
যে তবু এটি উপসংহারটিকে উচ্চ মাত্রায় সম্ভাব্য করে তুলতে পারে।কিন্তু ‘সকল পরীক্ষণকৃত
বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে’- এটি থেকে পাওয়া অবধারণ হলো ‘এটি খুবই সম্ভব যে সকল
বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে’, এটি এখনও একটি আরোহমূলক অবধারণ, যেহেতু দেয়া আছে যে
পরবর্তী অবধারণ এই অর্থ প্রকাশ করে ‘অধিকাংশ বস্তু (a very high proportion of all
objects) নিউটনের সূত্র মেনে চলে’, ফ্রিকুয়েন্সি ব্যাখ্যা অনুসারে। সুতরাং সম্ভাব্যতার
ধারণার প্রতি আকর্ষণ হিউমের যুক্তির বাইরে যায় না, যদি আমরা সম্ভাব্যতার ফ্রিকুয়েন্সি
ব্যাখ্যা পরিগ্রহণ করি। কারণ তখন সম্ভাব্যতাসমূহের জ্ঞান নিজেই আরোহের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে পড়ে। কিন্তু ‘সকল পরীক্ষণকৃত বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে’- এটি থেকে পাওয়া অবধারণ
হলো ‘এটি খুবই সম্ভব যে সকল বস্তু নিউটনের সূত্র মেনে চলে’, এটি এখনও একটি আরোহমূলক
অবধারণ, যেহেতু দেয়া আছে যে পরবর্তী অবধারণ এই অর্থ প্রকাশ করে ‘অধিকাংশ বস্তু (a
very high proportion of all objects) নিউটনের সূত্র মেনে চলে’, ফ্রিকুয়েন্সি ব্যাখ্যা
অনুসারে। সুতরাং সম্ভাব্যতার ধারণার প্রতি আকর্ষণ হিউমের যুক্তির বাইরে যায় না, যদি
আমরা সম্ভাব্যতার ফ্রিকুয়েন্সি ব্যাখ্যা পরিগ্রহণ করি। কারণ তখন সম্ভাব্যতাসমূহের জ্ঞান
নিজেই আরোহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
হিউমের সমস্যা সমাধানে
সম্ভাব্যতার বিষয়ীগত ব্যাখ্যাও ক্ষমতাহীন, যদিও একটি ভিন্ন কারণের জন্য। ধরুন, জন বিশ্বাস
করেন যে সূ্র্য আগামীকাল উদিত হবে এবং জ্যাক বিশ্বাস করেন এটা হবে না। তাঁরা উভয়েই
এই প্রমাণটা গ্রহণ করেন যে অতীতে প্রতিদিন সূ্র্য উদিত হয়েছে। স্বজ্ঞাতভাবে, আমরা বলতে
চাই যে জন যৌক্তিক (rational) এবং জ্যাক নন, কারণ সাক্ষ্যপ্রমাণ জনের বিশ্বাসকে অধিকতর
সম্ভাব্য করে তোলে। কিন্তু যদি সম্ভাব্যতা সাদাসিদাভাবে বিষয়ীগত অভিমত হতো, তাহলো আমরা
এটা বলতে পারতাম না। আমরা যা বলতে পারি তাহলো এই যে জন উচ্চ মাত্রায় গুরুত্বারোপ করেন
‘আগামীকাল সূর্য উদয়ের ওপর এবং কিন্তু জ্যাক তা করেন না। যদি সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কোনো
বিষয়গত সত্য (objective facts) না থাকে, তখন আমরা বলতে পারি না যে আরোহমূলক অবধারণসমূহের
উপসংহারগুলোও বিষয়গতভাবে সম্ভাবনীয়। সুতরাং আমাদের কাছে ব্যাখ্যা নেই কেন জ্যাকের মত
কেউ একজন অযৌক্তিক (irrational) হবেন, যিনি আরোহের ব্যবহার প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু
হিউমের সমস্যা হলো সুনির্দিষ্টভাবে এরকম একটি ব্যাখ্যার দাবী।
সম্ভাব্যতার যৌক্তিক ব্যাখ্যা
(logical interpretation) ধারণ করে হিউমের প্রতি একটি সন্তোষজনক সাড়ার জন্য অধিকতর
প্রতিশ্রুতি। ধরুন সম্ভাব্যতা সম্পর্কে একটি বিষয়গত সত্য এই যে আগামীকাল সূর্য উদিত
হবে, কারণ দেওয়া আছে যে অতীতে এটি প্রতিদিন উদিত হতো। মনে করুন এই সম্ভাব্যতা খুবই
উচ্চ। তখন কেন জন যৌক্তিক এবং জ্যাক নয়- এ সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা আছে। কারণ জন ও
জ্যাক উভয়েই এই নজির গ্রহণ করেন যে অতীতে প্রতিদিন সূর্য উদিত হয়েছে, কিন্তু জ্যাক
উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে এই নজির এটিকে খুবই সম্ভব করে তোলে যে আগামীকাল সূর্য উদিত
হবে, যখন জন এটি উপলব্ধি করে। বিবৃতিটির সম্ভাব্যতার ব্যাপারে এর অনুকুলে নজিরের (evidence)
পরিমাপক হিসেবে, যেহেতু যুক্তিবিদ্যাগত ব্যাখ্যা সুপারিশ করে, এবং সুন্দরভাবে সদৃশ
হয় (tallies neatly) আমাদের সজ্ঞাত অনুভূতির সাথে (with our intuitive feeling) যাতে
একটি আরোহমূলক অবধারণ উপসংহারকে উচ্চমাত্রায় সম্ভব করে তোলে, এমনকি যদি তারা এর সত্যতা
সম্পর্কে নিশ্চায়তা দিতে না পারলেও।
এর কারণ যেকোনো ডিটেইলে সম্ভাব্যতার যুক্তিবিদ্যাগত
ব্যাখ্যা সম্পন্ন করতে সকল প্রচেষ্টা গাণিতীয় ও দার্শনিক উভয় প্রকারের অনেক সমস্যার
বিরুদ্ধে ধাবিত হয়।ফলে, আজকের দিনে অনেক দার্শনিক যুক্তিবিদ্যাগত ব্যাখ্যার মূলগত অনুমান
(underlying assumption of the logical interpretation) সরাসরি প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা
প্রদর্শন করে- যাতে একটি বিবৃতির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিষয়গত তথ্য বিদ্যমান, অন্যটি
দেওয়া আছে। এই অনুমান প্রত্যাখ্যান স্বভাবতই ধাবিত হয় সম্ভাব্যতার বিষয়ীগত ব্যাখ্যার
দিকে (leads naturally to the subjective interpretation of probability), কিন্তু যেমনটি
আমরা দেখেছি, তা হিউমের প্রতি একটি সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার (response) ক্ষীণ আশা প্রদান
করে।
এমনকি যদি হিউমের সমস্যা চুড়ান্তভাবে অসমাধানীয় হয়, যেমনটি মনে হয়, সমস্যা সম্পর্কে চিন্তন এখন পর্যন্ত একটি দরকারী অনুশীলন। কারণ আরোহের সমস্যার উপর আলোকপাত আমাদের নিয়ে যায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-প্রক্রিয়ার সংগঠন, যৌক্তিকতার প্রকৃতি, আস্থার যথাযথ মাত্রা বিজ্ঞানে স্থাপন, সম্ভাব্যতার ব্যাখ্যা, এবং আরো অনেক কিছু সম্পর্কে আগ্রোহোদ্দীপক প্রশ্নাবলীর ভান্ডারে (thicket)। দার্শনিক প্রশ্নাবলীর মত, এই প্রশ্নাবলী সম্ভবত চুড়ান্ত উত্তরসমূহের অনুমোদন দেয় না, কিন্তু তাদের নিয়ে নাড়াচাড়া (in grappling)করে আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রকৃতি ও সীমা সম্পর্কে যথেষ্ট শিখতে পারি।
অধ্যায় ৩
বিজ্ঞানে
ব্যাখ্যা
বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
লক্ষ্যগুলোর একটি হলো চারপাশের দুনিয়াতে যা ঘটে তা ব্যাখ্যার চেষ্টা। কখনো আমরা ব্যাখ্যা
অন্বেষণ করি কেজো ফলাফলের জন্য (for practical ends)। উদারহণস্বরূপ, আমরা জানতে চাইতে পারি
কেন ওজোন স্তর দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে যাতে এটা সম্পর্কে আমরা কিছু একটা করতে চেষ্টা করি।
অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অন্বেষণ করি আমাদের বৃদ্ধিবৃত্তিক কৌতুহল
মেটাতে, আমরা আরও বেশী বুঝতে চাই কীভাবে দুনিয়া কাজ করে।
ঐতিহাসিকভাবে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লাভের চেষ্টা অনুপ্রাণিত হয় উভয় লক্ষ্য দিয়ে (by both goals)। প্রায়ই আধুনিক বিজ্ঞান ব্যাখ্যা প্রদানের লক্ষ্যে সফল। উদাহরণস্বরূপ, যখন সোডিয়ামকে প্রজ্জ্বলিত করা হয় তখন কেন এটা হলুদ হয়, তা রসায়নবিদগণ ব্যাখ্যা করতে পারেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন এবং কখন সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়। অর্থনীতিবিদগণ ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন ১৯৮০-এর দশকে ইয়েনের মূল্য হ্রাস পেয়েছিলো। জিনতত্ত্ববিদগণ ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন পুরুষদের টাক পরিবারে অব্যাহত থাকতে পারে। নিউরোলজিস্টগণ ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন অক্সিজেনের প্রচন্ড অভাব থেকে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। সফল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসমূহের অন্য আরো উদাহরণের কথা আপনি সম্ভবত চিন্তা করতে পারেন।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? একটি প্রপঞ্চ বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- এটা বলে ঠিক কী অর্থ প্রকাশ করা যায়? এটি একটি প্রশ্ন যা আরিস্ততলের সময়ে থেকে দার্শনিকবৃন্দ অনুশীলন করছেন, কিন্তু আমাদের প্রারম্ভ বিন্দু হবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার একটি বিখ্যাত বর্ণনা যা ১৯৫০-এর দশকে হাজির করেন মার্কিন দার্শনিক কার্ল হেম্পেল। হেম্পেলের বর্ণনা ব্যাখ্যার আচ্ছাদন নিয়ম মডেল (covering law model of explnation) নামে পরিচিত, যে কারণসমূহের জন্য এভাবে বলা তা পরবর্তীতে স্পষ্ট হবে।
হেম্পেলের ব্যাখ্যার আচ্ছাদন নিয়ম মডেল
আচ্ছাদনের নিয়ম মডেলের পেছনে বিদ্যমান মৌলিক ধারণা অকপট। হেম্পেল লক্ষ্য করেন যে তিনি যাকে ‘ব্যাখ্যা-অন্বেষণককেন প্রশ্ন’ বলে আখ্যায়িত করেন তার প্রত্যুত্তরে সাধারণত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এই প্রশ্নগুলো যেমন ‘কেন দুনিয়াটা পুরোপুরি গোলাকার নয়?’ ‘কেন নারীরা পুরুষের থেকে দীর্ঘজীবি?’ এই প্রশ্নগুলো এবং এ ধরনের আরও প্রশ্ন ব্যাখ্যা দাবী করে। একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে ব্যাখ্যা-অন্বেষক কেন প্রশ্নের একটি সন্তোষজনক উত্তর যোগাতে হয়। যদি আমরা দরকারী বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ণয় করতে পারি যাতে এ ধরনের একটি উত্তর অবশ্যি থাকবে, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আদতে কী?
হেম্পেল সুপারিশ করেন যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাবলীর টিপিক্যালগতভাবে একটি যুক্তির যৌক্তিক কাঠামো (logical structure of an argument) থাকে, অর্থাৎ অবধারণের একটি সেট যা থেকে একটি উপসংহারে উপনীত হওয়া যায়। উপসংহারটি বিবৃত করে যে একটি ঘটনা যার ব্যাখ্যায়নের দরকার আছে যা প্রকৃতপক্ষে সংঘটিত হয়, এবং অবধারণ আমাদের বলে কেন উপসংহারটি সত্য। এইভাবে ধরা যাক কেউ একজন জিজ্ঞেস করল কেন চিনি পানিতে দ্রবীভূত হয়।এটির জবাব দিতে হেম্পেল বলেন, আমরা অবশ্যি একটি যুক্তি নির্মাণ করবো যার উপসংহার হলো ‘চিনি পানিতে দ্রবীভূত হয়’ এবং যার অবধারণসমূহ আমাদের বলে কেন এই উপসংহার সত্য। তখন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বর্ণনা প্রদানের কাজ হয়ে যায় সম্যকভাবে সম্পর্কের বৈশিষ্টায়নের কাজ, যে সম্পর্কটি অবশ্যি ধারণ করবে অবধারণসমূহের সেট ও উপসংহার, যাতে পরবর্তীটির একটি ব্যাখ্যা হিসেবে পূর্ববর্তীটিকে বিবেচনা করা যায়। সেটি ছিল সমস্যা যা হেম্পেল নিজেই উত্থাপন করেন (set himself)।
সাধারণ নিয়মগুলোকে কখনো
কখনো ‘প্রকৃতির নিয়মাবলী’ বলা হয়ে থাকে। হেম্পেল অনুমোদন দেন যে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
আবেদন রাখতে পারে নির্দিষ্ট ঘটনাবলীতে এমনকি সাধারণ নিয়মাবলীতে, কিন্তু তিনি মনে করেন
যে কমপক্ষে একটি সাধারণ নিয়ম সবসময় দরকার। হেম্পেলের ধারণার ওপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা
করতে দেখাতে হয় যে এর সংঘটন (its occurance) অনুসরণ করে অবরোহীভাবে একটি সাধারণ নিয়ম
হতে, সম্ভবত পরিপূরিত হয় অন্যান্য নিয়ম এবং/অথবা নির্দিষ্ট ঘটনা (particualar
facts) দিয়ে, যার সবকিছু অবশ্যি সত্য হতে হবে।
যে প্রপঞ্চটিকে ব্যাখ্যা
করতে হবে তাকে বলে explanandum,
এবং সাধারণ নিয়মাবলী ও বিশেষ ঘটনাবলী যা ব্যাখ্যায়ন করে
তাদেরকে বলে explanans। স্বয়ং explanandum হতে পারে একটি বিশেষ ঘটনা অথবা একটি সাধারণ নিয়ম। উপরের উদাহরণে, এটি ছিল
বিশেষ ঘটনা- আমার উদ্ভিদের মৃত্যু। কিন্তু কখনো কখনো আমরা যে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে
চাই, সেগুলো সাধারণ। উদাহরণস্বরূপ, যেমন, আমাদের ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছে হতে পারে কেন
সূর্যের আলোক সম্পাতে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে। এটি একটি সাধারণ নিয়ম, একটি বিশেষ
ঘটনা নয়। এটা ব্যাখ্যা করতে আমাদের আরো অধিক মৌল নিয়মাবলী থেকে যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়া দরকার- সম্ভবত ত্বকীয় কোষের ওপর বিকিরণের প্রভাব সম্পর্কে নিয়মাবলী, সূর্যালোকে
বিকিরণের পরিমাণ সম্পর্কে বিশেষ ঘটনাবলী সহযোগে। সুতরাং একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার গঠন
মূলগতভাবে একই, সেটি explanandum হোক, অর্থাৎ যে বিষয়টি
আমরা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছি, সেটি বিশেষই হোক বা সাধারণই হোক।
এটা দেখা খুবই সহজ যে কেন হেম্পেলের মডেলকে ব্যাখ্যার প্রাবরণ নিয়ম মডেল (covering law model) বলে। কারণ এই মডেল অনুসারে, ব্যাখ্যার
সারসত্তা (the essence of explanation) দেখায় যে, যে প্রপঞ্চটি ব্যাখ্যা করতে হবে তা ‘প্রাবরিত’ (covered) হয় প্রকৃতির কিছু সাধারণ নিয়ম দিয়ে। নিশ্চিতভাবেই
এই ধারণায় কিছু মর্মস্পর্শী ব্যাপার আছে। যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে একটি প্রপঞ্চ হলো একটি
সাধারণ নিয়মের পরিণতি, এই অর্থে যে এর ভেতর থেকে এটি রহস্য উম্মোচনকৃত হয়- এটি এটিকে
অধিক প্রতিদান দেয়। এবং প্রকৃত পক্ষে, প্রায়ই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাবলী হেম্পেল কর্তৃক
বর্ণনাকৃত প্যাটার্ণের সঙ্গে অভিযোজিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, নিউটন ব্যাখ্যা করেন কেন গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তন করে, এই সিদ্ধান্তে তিনি উপনীত হন কিছু সামান্য অনুমানসহ তাঁর সার্বজনীন অভিকর্ষীয় নিয়ম থেকে। নিউটনের ব্যাখ্যা হেম্পেলের মডেলের সঙ্গে সঠিকভাবে অভিযোজিত হয়: একটি প্রপঞ্চ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এটি দেখিয়ে যে প্রকৃতির নিয়মাবলী ও অতিরিক্ত তথ্য অনুসারে এটিকে তাই হতে হবে। নিউটনের পরে, গ্রহীয় কক্ষপথসমূহ উপবৃত্তাকার, এ সম্পর্কে আর কোনো রহস্য নেই।
হেম্পেল অবগত ছিলেন যে সকল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
যথাযথভাবে তাঁর মডেলে অভিযোজিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন কেন
এথেন্স সবসময় ধোঁয়াশায় নিমজ্জিত থাকে, তারা সম্ভবত বলবে ‘গাড়ী থেকে নিষ্কাশিত দূষণের
কারণে’। এটি হলো একটি যথাযথ গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, যদিও এতে কোনো সূত্রাবলীর
উল্লেখ জড়িত নেই। কিন্তু হেম্পেল বলতেন যে যদি ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে বিশদ করা হয়,
সূত্রাবলী রঙ্গমমঞ্চে প্রবেশ করে। সম্ভবত একটি সূত্র (law) আছে যেটি এমনটি বলে, ‘যদি
কার্বন মনোক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যথেষ্ট মাত্রায় নির্গত হয়, ধোঁয়াশা মেঘ (smog
cloud) তৈরী হবে’। কেন এথেন্স ধোঁয়াশায় নিমজ্জিত হয়- এটির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা এই সূত্রটির
সঙ্গে ঘটনাটি নজির হিসেবে উল্লেখ করে যে গাড়ি নিষ্কাশনে কার্বন মনোক্সাইড থাকে এবং
এথেন্সে অনেক গাড়ী আছে। আমরা যদি নীতিবাগিশী না হই, তবে আমরা ব্যাখ্যাকে যথাযথভাবে
বিশদায়িত করতাম না। কিন্তু যদি আমাদের এটির বিশদ ব্যাখ্যা করতে হয়, তবে দেখা যাবে যে
এটি সম্পূর্ণরূপে প্রাবরিত সূত্র প্যাটার্নের (covering law pattern) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ
হবে।
ব্যাখ্যা ও পূর্বানুমান
(explanation and prediction)এর মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁর মডেল থেকে হেম্পেল
একটি আগ্রহোদ্দীপক দার্শনিক উপসংহার (philosophical consequence) টানেন । তিনি যুক্তি
দেন যে এই দুটি বিষয় একই মুদ্রার দুটি পিঠ। যখনি আমরা একটি প্রপঞ্চের প্রাবরিত সূত্র
ব্যাখ্যা প্রদান করি, তখনি আমরা যে সূত্রাবলী ও বিশেষ ঘটনাবলী (laws and particular facts ) উল্লেখ করি সেগুলো আমাদের সামর্থ্য যোগায় প্রপঞ্চটির
সংঘটনের পূর্বানুমানের, যদিও আমরা ইতোমধ্যে এটি সম্পর্কে জানতাম না। উদাহরণস্বরূপ,
আবার বিবেচনা করা যাক, নিউটনের গ্রহীয় কক্ষপথ কেন উপবৃত্তাকার তার ব্যাখ্যা।
যদিও প্রাবরিত সূত্র মডেল খুব ভালভাবে ধারণ করে অনেক প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সংগঠন (structure), এটি কিছু অনুপযোগী প্রতি-উদাহরণেরও (a number of awkward counter-examples) সম্মুখীন হয়। এই প্রতি-উদাহরণগুলো দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। একদিকে, কিছু যথার্থ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্র আছে, যেগুলো প্রাবরিত সূত্র মডেলে খাপ খায় না, এমনকি আন্দাজেও না। এই ক্ষেত্রগুলো ধারণা দেয় যে হেম্পেলের মডেল থুবই কঠোর (strick)- এটি কিছু বাস্তবসম্মত (bonafide) বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বাদ দেয়। অন্যদিকে, কিছু কিছু বিষয়ের ক্ষেত্র আছে যেগুলো প্রাবরিত সূত্র মডেলে খাপ খায়, কিন্তু সেগুলো সজ্ঞাতভাবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য করা যায় না। এই ক্ষেত্রগুলো সুপারিশ করে যে হেম্পেল মডেল খুবই উদার (liberal)- এটি কিছু বিষয়ের অনুমোদন দেয় যেগুলো বাদ দেয়া উচিত। আমরা দ্বিতীয় ধরণের প্রতি-উদাহরণগুলোর ওপর আলোকপাত করবো।
প্রতিসমতার
সমস্যা
ধরা যাক এক সূর্যোজ্জ্বল দিনে আপনি সৈকতে
শুয়ে আছেন, এবং আপনি লক্ষ্য করলেন যে একটি পতাকার খুঁটি বালির উপর ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের
ছায়া তৈরী করেছে। এটি একটি ব্যাখ্যা-অন্বেষক কেন প্রশ্ন। বিশ্বাসযোগ্য উত্তর এমন হতে
পারে: সূর্য থেকে আলোক রশ্মি পতাকার খুঁটিতে আঘাত করছে, যেটি ঠিক ১৫ মিটার উঁচু। সূর্যের
উন্নতি কোণ ৩৭°। যেহেতু আলোক রশ্মি সরল
রেখায় ভ্রমণ করে, কাজেই একটি সরল ত্রিকোণোমিতিয় হিসাব (tan37° = 15/20) দেখায় যে পতাকার খুঁটি
২০ মিটার দৈর্ঘ্যের ছায়া ফেলবে। এটি দেখতে একটি যথাযথ উত্তম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এবং
হেম্পেলের schema
অনুসারে
এটিকে পুনরায় লিখলে, আমরা দেখতে পাই যে এটি প্রাবরিত সূত্র মডেলে খাপ খায়:
সাধারণ সূত্রাবলী: আলো সরল রেখায় গমন করে
ত্রিকোণমিতির
সূত্রাবলী
বিশেষ ঘটনা: সূর্যের উন্নতি কোণ ৩৭°
পতাকার খুঁটির উচ্চতা ১৫ মিটার
Þ যে প্রপঞ্চ ব্যাখ্যা
করতে হবে: ছায়াটির দৈর্ঘ্য ২০ মিটার
ছায়ার দৈর্ঘ হিসেবে করা হয়েছে পতাকার খুঁটির
উচ্চতা ও সূর্যের উন্নতি কোণ থেকে, সাথে সাথে আলোকীয় সূত্র: আলোক সরলরেখায় গমন করে
এবং ত্রিকোণমিতিয় সূত্রসহ। যেহেতু এই সূত্রগুলো সত্য, এবং যেহেতু পতাকার খুঁটি বাস্তবিকই
১৫ মিটার উঁচু, কাজেই ব্যাখ্যাটি হেম্পেলের শর্তাবলীকে (requirements)যথাযথভাবে সন্তুষ্ট
করে। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যাটির উৎপত্তি হলো এভাবে: ধরা যাক আমরা ব্যাখ্যা
(explanandum) অদলবদল করি- ছায়ার দৈর্ঘ্য
২০ মিটার- বিশেষ সত্যসহ এবং তাহলো পতাকার খুঁটির উচ্চতা ১৫ মিটার। ফলাফল হলো:
সাধারণ সূত্র: আলো সরলরেখায় গমন করে
ত্রিকোণমিতির
সূত্রাবলী
বিশেষ সত্য: সূর্যের উন্নতি কোণ ৩৭°
ছায়া
দৈর্ঘ্য ২০ মিটার
Þ
যে প্রপঞ্চটি ব্যাখ্যা করতে হবে: খুঁটির উচ্চতা ১৫ মিটার
এই ‘ব্যাখ্যা স্পষ্টতই প্রাবরিত সূত্র মডেলের
সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পতাকার খুঁটির উচ্চতা হিসেব করা হয়েছে এটির ছায়ার দৈর্ঘ্য, সাথে
আলোকীয় সূত্র এবং ত্রিকোণমিতিয় সূত্রাবলী দিয়ে।আলোকীয় সূত্রটি হলো আলো সরলরেখায় চলে।
কিন্তু কেন পতাকার খুঁটির দৈর্ঘ্য ১৫ মিটার- এটাকে একটি ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য করতে অদ্ভুত মনে হয়। কেন পতাকার দৈর্ঘ্য ১৫ মিটার-
এটার প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্ভবত এই যে কাঠমিস্ত্রি এটাকে এইভাবে তৈরী করেছেন- এটি যে ছায়া
তৈরী করে তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং
হেম্পেলের মডেল খুবই উদার: এটি এমন একটা-কিছুকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য করে
যা আদতে নয়।
পতাকার খুঁটি উদাহরণের
সাধারণ নৈতিক উপদেশ (general
moral) এই
যে ব্যাখ্যার ধারণা (concept of explanation) একটি গুরুত্বপূর্ণ অপ্রতিসমতা (asymmetry) প্রদর্শন করে। পতাকার
খুঁটির উচ্চতা ব্যাখ্যা করে ছায়ার দৈর্ঘ্যে, প্রাসঙ্গিক সূত্রাবলী ও অতিরিক্ত ঘটনার
সাহায্যে, কিন্তু বিপরীত ক্রমে নয় (but not vice-versa)। সাধারণভাবে, যদি x
ব্যাখ্যা করে y প্রাসঙ্গিক সূত্রাবলী ও অতিরিক্ত ঘটনার সাহায্যে। তখন এটি সত্য হবে
না যে y ব্যাখ্যা করে x প্রাসঙ্গিক সূত্রাবলী ও অতিরিক্ত ঘটনার সাহায্যে। এটি কখনও
কখনও এই বলে প্রকাশ করে যে ব্যাখ্যা একটি অপ্রতিসম সম্পর্ক (asymmetric
relation)।
হেম্পেলের প্রাবরিত মডেল এই প্রতিসমতাকে কদর করে না। ঠিক যেমন আমরা ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ
করতে পারি পতাকার খুটির উচ্চতা থেকে, প্রদত্ত সূত্র ও অতিরিক্ত ঘটনাবলী থেকে, তেমনি
পতাকার খুঁটির উচ্চতা বের করতে পারি ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে। অন্য কথায়, প্রাবরিত সূত্র
মডেল পরোক্ষে বুঝায় যে ব্যাখ্যারও হওয়া উচিত একটি প্রতিসম সম্পর্ক, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে
এটি অপ্রতিসম। সুতরাং একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে কী হতে হবে- তা সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ
করতে হেম্পেলের মডেল ব্যর্থ।
ছায়া
ও পতাকা-খুঁটি দৃষ্টান্তটি (case) হেম্পেলের থিসিসের প্রতি একটি প্রতি-উদাহরণ প্রদান
করে, তা হলো ব্যাখ্যা ও পূর্বানুমান (explanation and prediction) হচ্ছে এই মুদ্রার দু’টি
পিঠ । কারণটি অনিবার্য। ধরা যাক আপনি জানতেন না যে পতাকা-খুঁটির উচ্ছ কত ছিল। যদি কেউ-একজন আপনাকে বলে
যে এটি ২০ মিটার ছায়া দেয় এবং সূর্য্যের উন্নতি কোণ ৩৭°,
আপনি পতাকা-খুঁটির উচ্চতা নির্ণয় করতে সমর্থ
হবেন (would be able to predict), যদি আপনি
প্রাসঙ্গিক আলোকীয় (optical) ও ত্রিকোণমিতিয় সূত্রাবলী
জানেন তবেই। কিন্তু আমরা এইমাত্র যেমনটি দেখেছি, এই তথ্য স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে না যে এই পতাকা-খুঁটির যে উচ্চতা
আছে, তা কেন। সুতরাং এই উদাহরণে পূর্বানুমান ও ব্যাখ্যা অংশ উপায় (part ways)। যে তথ্যটি একটি ঘটনাকে
অনুমান করতে সহায়তা করে আমরা এটা সম্পর্কে জানার পূর্বে, সেই তথ্যটি একই ঘটনাকে ব্যাখ্যা
করতে সহায়তা করে না এটাকে আমরা জানার পরে, যেটি হেম্পেলের থিসিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অপ্রাসঙ্গিকতার সমস্যা
ধরা যাক একটি অল্পবয়স্ক
শিশু হাসপাতালের একটি কক্ষে আছে, এই কক্ষটি গর্ভবতী মহিলাদের দিয়ে পূর্ণ। শিশুটি লক্ষ্য
করে যে কক্ষে জন নামীয় একজন ব্যক্তি গর্ভবতী নয়, এবং ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে কেন নয়।
ডাক্তার উত্তর দেন: ‘জন নিয়মিতভাবে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল নেন গত কয়েক বছর ধরে। যে মানুষেরা
নিয়মিতভাবে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল নেন তারা কখনও গর্ভবতী হয় না। এজন্য জন গর্ভবতী হন না’। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া
যাক যে ডাক্তার যা বলেন তা সত্য- জন মানসিকভাবে অসুস্থ এবং বাস্তবিকই জন্ম-নিয়ন্ত্রণ
নেন, যেটি তিনি বিশ্বাস করেন, সেটি তাকে সহায়তা করে। তারপরেও শিশুর প্রতি ডাক্তারের
উত্তর স্পষ্টভাবে খুব একটা সহায়ক নয়। জন গর্ভবতী নন, নিশ্চিতভাবেই তা এই জন্য যে তিনি
পুরুষ এবং পুরুষ গর্ভবতী হতে পারেন না।
যাহোক, শিশুকে ডাক্তার
কৃর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা প্রাবরিত সূত্র মডেলে নিখুতভাবে খাপ খায়। জন গর্ভবতী নয়-
এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করতে ডাক্তার যুক্তি দেন সাধারণ সূত্র ও বিশেষ ঘটনা থেকে। সাধারণ সূত্রটি হলো এই যে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ
পিল গ্রহণকারী মানুষ গর্ভবতী হয় না এবং বিশেষ ঘটনাটি হলো জন জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ
করতেন। যেহেতু সাধারণ সূত্র এবং বিশেষ ঘটনাটি সত্য, এবং তাদের বাস্তবিকই ব্যাখ্যা
(explanandum) থেকে অনিবার্য ফলস্বরূপ
পাওয়া যায়, প্রাবরিত সূত্র মডেল অনুসারে ডাক্তার একটি যথাযথ পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন
কেন জন গর্ভবতী নয়। কিন্তু অবশ্যি তিনি যথাযথ ব্যাখ্যা দেননি। সুতরাং প্রাবরিত সূত্র
মডেল খুবই উদার (permissive): এটি অনেক বিষয়কে গণ্য
করে বৈজ্ঞানিক যুক্তি হিসেবে যা সজ্ঞাগতভাবে (intuitively) নয়।
সাধারণ নৈতিক উপদেশ (general moral) এই যে একটি প্রপঞ্চের উত্তম ব্যাখ্যায় সেই তথ্য থাকা দরকার যেটি প্রপঞ্চের সংঘটনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। এই জায়গাটিতেই শিশুর প্রতি ডাক্তারের উত্তর ভুল। যদিও শিশুটিকে ডাক্তার যা বললেন তা যর্থার্থই সত্য, কিন্তু জন জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল নিচ্ছেন- এই প্রপঞ্চটি (fact) তাঁর গর্ভবতী না হওয়ার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তিনি এমনকি যদি পিল নাও নিতেন, তবু তিনি গর্ভবতী হতেন না। এই কারণে শিশুটির প্রশ্নের ক্ষেত্রে ডাক্তারের জবাব একটি ভালো উত্তর গঠন করে না। আমাদের ব্যাখ্যার ধারণায় হেম্পেলের মডেল এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টকে (crucial feature) মান্য করে না।
ব্যাখ্যা ও কার্যকারণ
যেহেতু প্রাবরিত সূত্র মডেল অনেক বেশী সমস্যা মুকাবেলা করে, কাজেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপলব্ধির বিকল্প পদ্ধতি অন্বেষণ খুবই স্বাভাবিক। কিছু দার্শনিকবৃন্দ বিশ্বাস করেন যে কার্যকারণের ধারণাতেই সমাধান (key) নিহিত। এটি খুবই আকর্ষণীয় সুপারিশ। যেহেতু বহু ক্ষেত্রে একটি প্রপঞ্চকে বাস্তবিকই ব্যাখ্যা করতে বলতে হয় এটি কী কারণে সংঘটিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি দুর্ঘটনা তদন্তকারী একটি বিমান দুর্ঘটনা (aeroplane crash) ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন, তিনি স্পষ্টতই দুর্ঘটনার কারণ অন্বেষণ করবেন। বাস্তবিকই, ‘কেন বিমান দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো’ এবং বিমান দুর্ঘটনার কারণ কী ছিল’- এই দুটি প্রশ্ন কার্যত সমার্থক। একইভাবে, যদি একজন বাস্তুসংস্থানবিদ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন গ্রীস্ম-মন্ডলীয় রেইনফরেস্টে যতটুকু জীববৈচিত্র থাকা দরকার ছিল তার চেয়ে কম কেন, তিনি স্পষ্টভাবে জীববৈচিত্র হ্রাসের কারণ অন্বেষণ করবেন। ব্যাখ্যা ও কার্যকারণের ধারণাবলীর মধ্যকার সংযোগ সম্পূর্ণ সুবিদিত।
এই সংযোগে অভিভূত হয়ে,
কার্যকারণ-ভিত্তিক বর্ণনার পক্ষে কিছু দার্শনিক ব্যাখ্যার প্রাবরণ সূত্র বর্ণনা পরিত্যাগ
করে । খুঁটিনাটি (the
details)
পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু এই বর্ণনাগুলোর পেছনের মূল ধারণা (basic idea) এই যে প্রপঞ্চকে
ব্যাখ্যা করতে সোজাসুজি বলতে হয় যে কী কারণে এটি সংঘটিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে, প্রাবরণ
সূত্র ও কার্যকারণ বর্ণনার পার্থক্য প্রকৃতপক্ষে খুব বেশী নয়, উদাহরণস্বরূপ, কেন গ্রহীয়
কক্ষপথ উপবৃত্তাকার-এ সম্পর্কে নিউটনের ব্যাখ্যা স্মরণ করা যাক। আমরা দেখি যে এই উদাহরণটি
প্রাবরণ সূত্র মডেলে খাপ খায়, কারণ নিউটন গ্রহীয় কক্ষপথের আকৃতি নির্ণয় করেন তাঁর অভিকর্ষজ
সূত্রসহ কিছু অতিরিক্ত প্রপঞ্চ থেকে। কিন্তু নিউটনের ব্যাখ্যাও ছিল একটি কার্যকারণগত
ব্যাখ্যা, কারণ গ্রহমন্ডলীর অধিবৃত্তাকার কক্ষপথগুলোর কারণ হলো গ্রহসমূহ ও সূর্যের
মধ্যকার অভিকর্ষজ আকর্ষণ।
যাহোক, প্রাবরণ সূত্র ও কার্যকারণগত বর্ণনা সম্পূর্ণ সমতুল্য নয়, কিছু ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন(diverge)। বাস্তবিকই, অনেক দার্শনিক যথাযথভাবে ব্যাখ্যার কার্যকারণগত বর্ণনা সমর্থন করেন কারণ তারা মনে করেন যে প্রাবরণ সূত্র মডেল যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয় এটি সেগুলো পরিহার করতে পারে। স্মরণ করা যাক পতাকা-খুঁটির কথা। কেন আমাদের সজ্ঞা (intuition) আমাদের বলে যে পতাকা-খুঁটির উচ্চতা ছায়ার দৈর্ঘ্যকে ব্যাখ্যা করে প্রদত্ত সূত্রাবলী থেকে, বিপরীতক্রমে (vice-versa) নয়? সম্ভাবনীয়ভাবে, কারণ পতাকা-খুঁটির উচ্চতা হলো ছায়ার দৈর্ঘ্য যে ২০ মিটার তার কারণ, কিন্তু ছায়ার দৈর্ঘ্য যে ২০ মিটার তা পতাকা-খুঁটির ১৫ মিটার উচ্চতার কারণ নয়। সুতরাং প্রাবরণ সূত্র মডেলের থেকে কার্যকারণ বর্ণনা ভিন্ন। কার্যকারণ বর্ণনা পতাকা-খুঁটির ক্ষেত্রে ‘সঠিক’ উত্তর প্রদান করে। এটি আমাদের সজ্ঞাকে মান্য করে, আর তাহলো এটি যে ছায়া দেয় সেটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমরা পতাকা-খুঁটির উচ্চতা ব্যাখ্যা করতে পারি না।
পতাকা-খুঁটি সমস্যার সাধারণ নৈতিক উপদেশ এই যে প্রাবরণ সূত্র মডেল ধারণ করতে পারে না যে ঘটনাটি তাহলো ব্যাখ্যা একটি অপ্রতিসম সম্পর্ক। এখন কার্যকারণ সম্পর্ক (causality) স্পষ্টত একটি অপ্রতিসম সম্পর্কও: যদি x হয় y-এর কারণ, তখন x-এর কারণ y নয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আগুনের কারণ সর্ট-সার্কিট হয়, তখন স্পষ্টভাবে সর্ট-সার্কিটের কারণ আগুন নয়। সুতরাং এটা সুপারিশ করা খুবই সম্ভব যে ব্যাখ্যার অপ্রতিসমতা উদ্ভূত হয় কার্যকারণ সম্পর্ক (causality) থেকে। যদি একটি প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করতে এটা বলতে হয় যে এটি কী কারণে ঘটে, তখন যেহেতু কার্যকারণ সম্পর্ক অপ্রতিসম, তাই আমাদের প্রত্যাশা করা উচিত যে ব্যাখ্যাও হতে হবে অপ্রতিসম- এটি যেমন। প্রাবরণ সূত্র মডেল সঠিকভাবেই পতাকা-খুঁটি সমস্যার বিপরীতে যায়, কারণ কার্যকারণ সম্পর্কের উল্লেখ ছাড়াই এটি চেষ্টা করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ধারণা বিশ্লেষণ করতে।
একই কথা জন্ম-নিয়ন্ত্রণ
পিলের ক্ষেত্রেও সত্য। জন জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল নেন- এটি ব্যাখ্যা করে না যে কেন তিনি
গর্ভবতী নন, কারণ জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পিল তার গর্ভবতী না হওয়ার কারণ নয়। বরং, জনের লিঙ্গই
(gender) তার গর্ভবতী না হওয়ার
কারণ। এ কারণে আমরা মনে করি যে ‘কেন জন গর্ভবতী নয়?’-ডাক্তারের উত্তরের পরিবর্তে এই
প্রশ্নের সঠিক উত্তর বরং এই যে ‘কারণ তিনি একজন পুরুষ, এবং পুরুষ গর্ভবতী হতে পারেন
না। ডাক্তারের উত্তর প্রাবরণ সূত্র মডেলকে সন্তুষ্ট করে, কিন্তু আমরা যে প্রপঞ্চটির
কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই, এটি সঠিকভাবে ঐ প্রপঞ্চটির কারণ চিহ্নিত করে না, এটি একটি
যথার্থ ব্যাখ্যা গঠন করে না। ব্যাখ্যাকে
অবশ্যি explanandum-এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ তথ্য ধারণ করতে হবে। কার্যত, এটা অন্যভাবে বলা যে ব্যাখ্যাকে
আমাদের বলা উচিত explanandum-এর কারণ। কার্যকারণ সম্পর্ক ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার
বর্ণনা অপ্রাসঙ্গিকতার সমস্যার সম্মুখীন হয় না।
কার্যকারণ সম্পর্ক ও ব্যাখ্যার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সংযোগকে মান্য করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য হেম্পেলের সমালোচনা করা খুব সহজ। কিন্তু কিছু উপায়ে সমালোচনা একটু অশোভন। হেম্পেল অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism) নামে পরিচিত দার্শনিক মতবাদের সমর্থক, এবং অভিজ্ঞতাবাদীরা ঐতিহ্যগভাবে কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণার প্রতি খুবই সংশয়প্রবণ (suspicious)। অভিজ্ঞতাবাদীরা বলে যে আমাদের সকল জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। ডেভিড হিউমের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে গত অধ্যায়ে, তিনি একজন নেতৃস্থানীয় অভিজ্ঞতাবাদী, এবং তিনি যুক্তি দেন যে কার্যকারণগত সম্পর্কাবলী সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ অসম্ভব। সুতরাং তিনি উপসংহার টানেন যে তারা অস্তিত্বমান নয়- কার্যকারণ সম্পর্ক আমাদের কল্পনার উদ্ভাবন। এই উপসংহার গ্রহণ করা খুব কঠিন। নিশ্চিতভা্বেই এটি একটি বিষয়গত সত্য যে কাচের পাত্র ফেলে দেওয়ার কারণে তা ভেঙ্গে যায়। হিউম এটি অস্বীকার করেন। তিনি সুপারিশ করেন যে এটা একটা বিষয়গত সত্য যে অধিকাংশ কাচের পাত্র ফেলে দিলে প্রকৃতপক্ষে ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু আমাদের কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণা এর থেকে বেশীকিছু অন্তুভূক্ত করে। এটি পতন ও ভাঙ্গনের (dropping and the breaking) মধ্যকার কার্যকারণগত সংযোগের ধারণা অন্তর্ভুক্ত করে, অর্থাৎ পূর্ববর্তী ঘটনা পরবর্তী ঘটনাটি সংঘটিত করে (the former brings about the latter)। হিউমের মতে এ ধরণের সংযোগ দুনিয়াতে দেখা যায় না। যা আমরা দেখি তাহলো পাত্র ফেলে দেয়া হলো, এবং তখন মুহুর্ত পরে এটি ভেঙ্গে গেল। আমরা প্রথম ঘটনা ও দ্বিতীয়টির মধ্যে কোনো কার্যকারণগত সংযোগের অভিজ্ঞতা লাভ করি না। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্ক একটি কল্পনা (fiction)।
অধিকাংশ অভিজ্ঞতাবাদীগণ সরাসরি এই বিস্ময়কর উপসংহার গ্রহণ করেননি। কিন্তু হিউমের কাজের ফলে, তাঁরা কার্যকারণ সম্পর্ককে বিবেচনা করার প্রবণতা প্রদর্শন করেন এমন একটি ধারণা হিসেবে, যাকে আলোচনা করতে হবে খুব সতর্কতা সহকারে। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্কের প্রত্যয়ের ভিত্তিতে ব্যাখ্যার প্রত্যয় (concept) বিশ্লেষণের ধারণা অভিজ্ঞতাবাদীদের মনে হয় যুক্তির বিপরীতে (perverse)। যদি একজনের লক্ষ্য হয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রত্যয়কে (concept) বিশদ করা, যেমন হেম্পেল করেছিলেন, তাহলে প্রতীতিসমূহ ব্যবহারে (in using notions) সামান্য যুক্তি (little point) আছে যেগুলোর সমানভাবে নিজেদের (themselves) স্পষ্ট করার প্রয়োজন আছে (need of clarification themselves)। এবং অভিজ্ঞতাবাদীদের জন্য, কার্যকারণ সম্পর্ককে নিশ্চিতভাবেই দার্শনিকভাবে স্পষ্ট করার প্রয়োজন আছে। সুতরাং সত্য এই যে প্রাবরণ সূত্র মডেল যে কার্যকারণ সম্পর্কের উল্লেখ করেনি তা নিছক হেম্পেলের দিক থেকে অনবধানতা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, জনপ্রিয়তায় অভিজ্ঞতাবাদের কিছুটা অবনমন ঘটেছে। অধিকন্তু, অনেক দার্শনিক উপসংহারে এসেছেন যে কার্যকারণ সম্পর্কের প্রতীতি (concept of causality) দার্শনিকভাবে সমস্যাসংকুল (philosophically problematic) হলেও, দুনিয়াকে আমরা কীভাবে উপলব্ধি করবো তা বুঝতে অপরিহার্য। সুতরাং হেম্পেলের সময় যেমনটা ছিল তার থেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কার্যকারণ ভিত্তিক বর্ণনার ধারণা মনে হয় অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
ব্যাখ্যার কার্যকারণ সম্পর্ক-ভিত্তিক
বর্ণনা নিশ্চিতভাবেই ধারণ করে অনেক প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাবলী খুব ভালোভাবে, কিন্তু
সেগুলোই কি পুরো আখ্যান (but
are they the whole story)?
অনেক দার্শনিক বলেন তা নয়, এই ভিত্তিতে যে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিদ্যমান তা কার্যকারণগত
বলে মনে হয় না। বিজ্ঞানে যাকে ‘তাত্ত্বিক সনাক্তকরণ’ বলে সেখান থেকে এক ধরনের উদাহরণের
উৎপত্তি হয়। তাত্ত্বিক সনাক্তকরণে জড়িত থাকে একটি প্রতীতির সাথে আর একটির সনাক্ত করা,
সাধারণত তা করা হয় বিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন শাখা থেকে। ‘পানি হলো H2O’
একটি উদাহরণ, যেমন ‘তাপমাত্রা হলো গড় আণবিক গতিশক্তি’। এই উভয় ক্ষেত্রেই, প্রতিদিনকার
একটি সুপরিচিত প্রতীতিকে সমীকৃত অথবা সনাক্ত করা হয় একটি অধিকতর দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক
প্রতীতির সঙ্গে (a
more esoteric scientific concept)। প্রায়ই, যেগুলোকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে মনে
হয়, তাত্ত্বিক সনাক্তকরণ আমাদের তাই যোগান দেয়। যখন রসায়নবিদগণ আবিষ্কার করেন যে পানি
হলো H2O, এর ফলে তাঁরা ব্যাখ্যা করে ফেলেন যে পানি কী। অনুরূপভাবে, যখন
পদার্থবিদগণ আবিষ্কার করেন যে একটি বস্তুর তাপমাত্রা হলো এর অণুসমূহের গড় গতিশক্তি,
এইভাবে তাঁরা তাপমাত্রা কী তা ব্যাখ্যা করে ফেলেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাগুলোর কোনটিই
কার্যকারণগত নয়। H2O দিয়ে গঠিত বলেই একটা বস্তুর পানি হওয়ার কারণ ঘটে না- এটি নিছক পানিই (it just is being
water)।
একটি নির্দিষ্ট গড় আণবিক গতিশক্তি থাকা কারণ
ঘটায় না একটি তরলের যে তাপমাত্রা আছে তার। এর মানে এর সেই তাপমাত্রা আছে। যদি এই উদাহরণগুলো
গ্রহণ করা হয় বৈধ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে, তখন তারা সুপারিশ করে যে ব্যাখ্যার কার্যকারণভিত্তিক
বর্ণনা পুরো আখ্যান (the
whole story) হতে পারে না।
বিজ্ঞান কী সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে?
আমরা যে দুনিয়াতে বাস করি তার অনেকটাই আধুনিক বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু আরো অসংখ্য প্রপঞ্চ আছে যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত হয়নি, অথবা কমপক্ষে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যাকৃত হয়নি। এরকম একটি উদাহরণ হলো জীবনে উৎপত্তি। আমরা জানি যে প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে, নিজেদের কপি করার সামর্থ্য আছে এরকম অণুগুলোর উৎপত্তি হয় আদিম স্যুপে, এবং সেখানেই জীবনের উদ্বোধন সংঘটিত হয়। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না যে কীভাবে এই স্ব-প্রতিলিপিকৃত অনুগুলো (self-replicating molecules) সেখানে প্রথম অবস্থায় (in the first place) পাওয়া গেল। আরো একটি উদাহরণ হলো এই প্রপঞ্চ যে অটিজম আক্রান্ত শিশুর খুব ভালো স্মৃতি শক্তি থাকার প্রবণতা আছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের ওপর চালানো অনেক গবেষণা এই প্রপঞ্চটি নিশ্চিত করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এটির ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে উপসংহারে বিজ্ঞান এই ধরনের প্রপঞ্চকসমূহের ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হবে। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি (plausible view)। অণু-জীববিজ্ঞানীগণ কঠোর পরিশ্রম করছেন জীবনের উৎসের সমস্যা সম্পর্কে, এবং কেবল একজন হতাশাবাদী বলতে পারেন তারা কখনো এটি সমাধান করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে, সমস্যাটা সহজ (easy) নয়, কিন্তু এই কারণে নয় যে এটি জানা খুবই কঠিন পৃথিবীর কী অবস্থা ছিল ৪ বিলিয়ন বছর আগে। কিন্তু তাসত্ত্বেও, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে জীবনের উৎপত্তিকে কখনো ব্যাখ্যা করা যাবে না। একই কথা বলা যায় অটিজম আক্রান্ত শিশুদের ব্যতিক্রমী স্মৃতিশক্তি সম্পর্কেও। স্মৃতিবিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এর শৈশবে, এবং অটিজমের নিউরোলজিয় ভিত্তি সম্পর্কে আবিষ্কারের অনেক কিছুই বাকী। স্পষ্টতই আমরা নিশ্চয়তা (guarantee) দিতে পারি না যে শেষতক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রদত্ত ব্যাখ্যামূলক সফলতার সংখ্যা যা আধুনিক বিজ্ঞান ইতোমধ্যে অর্জন করেছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে স্মার্ট মানি বলতে এখানে সকল মনোযোগ বোঝায় যা আজকের অনেক অব্যাখ্যাত প্রপঞ্চের ওপর প্রদান করতে হবে যাতে এগুলোও অবশেষে ব্যাখ্যা করা যায়।
কিন্তু এর অর্থ কি এই যে বিজ্ঞান নীতিগতভাবে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পার? অথবা কিছু প্রপঞ্চ বিদ্যমান আছে কী যা চিরদিনের জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নাগালের বাইরে থাকে? এটি উত্তর দেয়ার জন্য সহজ প্রশ্ন নয়। একদিকে, এটি দাবী করা খুবই ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে বিজ্ঞান সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে। অন্যদিকে, এটা দাবী করা (assert) অদূরদর্শী যে যেকোনো নির্দিষ্ট প্রপঞ্চ কখনো বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। যেহেতু বিজ্ঞান পরিবর্তিত এবং বিকশিত হয় খুবই দ্রুত, এবং একটি প্রপঞ্চ যা আজকের বিজ্ঞানের সুবিধাজনক অবস্থান থেকেও্র সম্পূর্ণ অব্যাখ্যাত বলে মনে হয় তা খুব সহজেই আগামীদিনে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে।
কিছু দার্শনিকের মতানুসারে, বিশুদ্ধ য়ৌক্তিক কারণ আছে যে কেন বিজ্ঞান সবকিছু কখনো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হবে না। কোনোকিছু ব্যাখ্যা করতে, তা যাকিছুই হোক না কেন, আমাদের অন্যকিছুর যাচ্ঞা করা দরকার। কিন্তু কি দিয়ে ব্যাখ্যা করে দ্বিতীয় বিষয়টি? দৃষ্টান্ত দিতে স্মরণ করা যাক নিউটনকে, তিনি প্রপঞ্চসমূহের একটি বিস্তৃত পরিসরের ব্যাখ্যা দেন তাঁর অভিকর্ষজ তত্ত্ব ব্যবহার করে। কিন্তু স্বয়ং অভিকর্ষজ তত্ত্বকে কি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? যদি কিছু মানুষ জিজ্ঞেস করে কেন সকল বস্তু একে অপরের উপর অভিকর্ষজ শক্তি প্রয়োগ করে, তাহলে তাঁদের প্রতি আমাদের কী বলা্ উচিত? এই প্রশ্নের জবাব নিউটনের কাছে নেই। নিউটনীয় বিজ্ঞানে অভিকর্ষজ তত্ত্ব একটি মৌলিক নীতি: এটি অন্যান্য বিষয় ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এটি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। নৈতিকতা সাধারণীকরণযোগ্য। যাহোক ভবিষ্যতের বিজ্ঞান যতই ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারুক, যে ব্যাখ্যা এটি প্রদান করে তার জন্য বিজ্ঞানকে কিছু মৌলিক সূত্রাবলী ও নীতিসমূহ ব্যবহার করতে হয়। যেহেতু কোনোকিছুই স্বয়ং এগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, তাই বলা যায় যে কমপক্ষে কিছু সূত্রাবলী ও নীতিসমূহ নিজ থেকেই অব্যাখ্যাত থেকে যাবে।
একজন যে যুক্তিই তৈরী
করুন, তা অনস্বীকার্যভাবে খুবই বিমূর্ত। এটি এই ভাবার্থ প্রদর্শন করে যে কিছু বিষয়
কখনও ব্যাখ্যা করা যাবে না, কিন্তু আমাদের বলে না যে সেগুলো কী। যাহোক, ঘটনাবলী সম্পর্কে
কিছু দার্শনিক এই মর্মে মূর্ত সুপারিশ করেন যে তারা মনে করেন বিজ্ঞান কখনও সেগুলো ব্যাখ্যা
করতে পারবে না। যেমন একটি উদাহরণ হলো চেতনা (consciousness)-আমাদের নিজেদের ও অন্য
উচ্চস্তরের প্রাণীদের চিন্তন, সংবেদনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। মস্তিষ্ক বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী
ও অন্যান্যরা চেতনার প্রকৃতির ওপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন ও করছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক
সময়ের দার্শনিকবৃন্দ দাবী করেন যে এই গবেষণা যাই প্রকাশ করুক, এটি কখনও সম্পূর্ণরূপে
চেতনার প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। চেতনার প্রপঞ্চ সম্পর্কে অন্তর্নিহিতভাবে
কিছু একটা রহস্যময়তা বিদ্যমান, সেটি বজায় থাকে যাতে বৈজ্ঞানিক তদন্তের কোনও পরিমাণ
তা দূর করতে পারে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি কী? বুনিয়াদি যুক্তি
এই যে সচেতন অভিজ্ঞতাবলী মৌলিকভাবে দুনিয়ার যেকোনো কিছু থেকে আলাদা, সেই অর্থে তাদের
একটি ‘বিষয়ীগত দিক’ আছে। উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক একটি ভয়ংকর হরর মুভি দেখার
অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে সংলগ্ন একটি স্বতন্ত্র ‘অনুভূতি’-সহ অভিজ্ঞতা। বর্তমান পরিভাষায়,
অভিজ্ঞতা আছে ‘এটা এমন একটা-কিছুর মত’। একদিন হয়তো নিউরোবিজ্ঞানীবৃন্দ মস্তিষ্কে সংঘটিত
জটিল আচরণ যা আমাদের আতঙ্কের অনুভূতি তৈরী করে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিতে
সক্ষম হবেন। কিন্তু এটা কি ব্যাখ্যা করতে পারবে কেন একটি হরর মুভি দর্শনে যে অনুভূতি
তৈরী হয়, তা বরং অন্য কোনো উপায়ে হয় না? অনেক মানুষ মনে করেন যে এটা হবে না। এই দৃষ্টিতে,
মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক গবেষণা বড় জোর আমাদের বলতে পারে কোন সচেতন অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের
কোন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এটি নিশ্চিতভাবেই আগ্রহোদ্দীপক ও মূল্যবান।
যাহোক, এটা আমাদের বলে না কেন স্বতন্ত্র বিষয়ীগত ‘অনুভূতি’-র অভিজ্ঞতাসমূহের ফলাফল
আসা উচিত সম্পূর্ণরূপে (purely) মস্তিষ্কে সংঘটিত শারীরবৃত্তিক
আচরণ (physical
goings-on)
থেকে। তাই চেতনা (consciousness,, অথবা কমপক্ষে এর একটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক, বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যাতীত
(inexplicable)।
যদিও সম্পূর্ণ মনোমুগ্ধকর (compelling), তবু এই যুক্তি (argument) বিতর্কিত এবং সকল দার্শনিক কর্তৃক সমর্থিত হয়নি, এমনকি সকল নিউরোবিজ্ঞানী কর্তৃকও। বাস্তবিকই ১৯৯১-এ একটি সুপরিচিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এটি লেখেন দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট (Daniel Dennett), স্পর্ধাভরে তিনি এই গ্রন্থটির নামকরণ করেন Consciousness Explained। চেতনা বৈজ্ঞানিকভাবে অব্যাখ্যেয়-এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকদের কল্পনার ঘাটতি আছে বলে কখনও কখনও দায়ী করা হয়। এমনকি এটি যদি সত্য হয় যে মস্তিষ্ক বিজ্ঞান (brain science) বর্তমানে যেভাবে অনুশীলনকৃত হয় তা যদি সচেতন অভিজ্ঞতার বিষয়ীগত দিক ব্যাখ্যা করতে না পারে , তখন আমরা কী মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের একটি র্যাডিক্যালগতভাবে ভিন্ন প্রকরণের উত্থান কল্পনা করতে পারি না, র্যাডিক্যালগতভাবে ভিন্ন ব্যাখ্যামূলক কৌশলসহ (with explanatory techniques), যা ব্যাখ্যা করে কেন আমাদের অভিজ্ঞতাবলী অনুভব করে সেই উপায়ে যেভাবে তারা করে। দার্শনিকদের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে কী সম্ভব ও সম্ভব নয় তা বিজ্ঞানীদের নিকট বলতে চেষ্টা করা, এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক বিকাশাবলী প্রায়ই দার্শনিকদের ভ্রান্তি প্রমাণ করে।কেবলমাত্র সময়ই বলে দেবে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে কিনা তাদের জন্য যারা যুক্তি দেয় যে সচেতনতা অবশ্যি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরিহার করে।
ব্যাখ্যা এবং অবরোহ
বিভিন্ন প্রকারের ঘটনা ব্যাখ্যার্থে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ডিসিপ্লিন
পরিকল্পিত। কেন রাবার বিদ্যুৎ পরিবহন করে না, সেটি ব্যাখ্যার কাজ পদার্থবিজ্ঞানের।
কচ্ছপের আয়ু এত দীর্ঘ কেন তা ব্যাখ্যার কাজ জীববিজ্ঞানের। উচ্চতর সুদের হার কেন মুদ্রাস্ফীতি
হ্রাস করে, তা ব্যাখ্যার কাজ অর্থনীতির, এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। সংক্ষেপে বলা যায় বিজ্ঞানের
বিভিন্ন শাখার মধ্যে শ্রমবিভাগ বিদ্যমান: প্রত্যেকটি শাখা এর নিজস্ব ঘটনাবলীর বিশেষ
সেট ব্যাখায়নে পারদর্শী। এটি ব্যাখ্যা করে কেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সচরাচর একে অপরের
সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না- উদাহরণস্বরূপ, জীববিজ্ঞানীবৃন্দ এই মর্মে উদ্বিগ্ন
নন যে পদার্থবিজ্ঞানীবৃন্দ ও অর্থনীতিবিদগণ তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে পারেন।
তবু, এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সবগুলো এক সমান নয়: কিছু অন্যান্য শাখার তুলনায় অধিকতর মৌলিক। সবগুলোর মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানকে সাধারণত গণ্য করা হয় সর্বাধিক মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে। কিন্তু কেন? কারণ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গবেষণাকৃত বস্তুসমূহ (objects) চুড়ান্তভাবে ভৌত কণিকাসমূহ দিয়ে গঠিত। উদাহরণ হিসেবে জীবিত প্রাণীসমূহ বিবেচনা করা যাক। জীবিত প্রাণী কোষ দিয়ে গঠিত, এই কোষ আবার পানি, নিউক্লিক এসিড (যেমন ডিএনএ), প্রোটিন, চিনি, ও লিপিড (চর্বি) দিয়ে গঠিত, এদের সবকিছুই গঠিত আবার অণু বা অণুসমূহের জোড়া লাগানো দীর্ঘ শিকল দিয়ে। কিন্তু অণুসমূহ পরমাণু দিয়ে গঠিত, যেগুলো ভৌত কণিকা। সুতরাং জীববিজ্ঞানী কর্তৃক গবেষণাকৃত বস্তুসমূহ চুড়ান্তভাবে খুবই জটিল ভৌত সত্তা। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, এমনকি সামাজিক বিজ্ঞানেও। উদাহরণ হিসেবে অর্থনীতি নেয়া যাক। অর্থনীতি গবেষণা করে কর্পোরেশন এবং বাজারে ভোক্তাদের আচরণ, এবং এই আচরণের পরিণতি নিয়ে। কিন্তু ভোক্তাগণ মানব সত্তা এবং কর্পোরেশন মানব সত্তা দিয়ে গঠিত; এবং মানব সত্তা হল জীবিত প্রাণী, সুতরাং ভৌত সত্তা।
এটার অর্থ এই কী যে, নীতিগতভাবে, পদার্থবিজ্ঞান সকল উচ্চস্তরর
বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত (subsume) করতে পারে? যেহেতু
সবকিছুই ভৌত কণিকা দিয়ে গঠিত, তাই নিশ্চিতভাবেই যদি আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ পদার্থবিজ্ঞান
(a complete physics) থাকতো, যা আমাদের অনুমোদন দিতো মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি ভৌত কণিকার
আচরণ সম্পর্কে পুরোপুরি ভবিষ্যদ্বাণী করতে, তখন অন্য সকল বিজ্ঞান কী অপ্রয়োজনীয় হয়ে
যেতো? অধিকাংশ দার্শনিক এই লাইনের চিন্তা বিরোধিতা করেন। সর্বোপরি, এটি সুপারিশ করা
বাতিকগ্রস্ত মনে হয় যে জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতি যে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারে তা পদার্থবিজ্ঞান
একদিন ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হবে। সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলী থেকে জীববিজ্ঞান
ও অর্থনীতির সূত্রাবলীতে যুক্তির সাহায্যে উপনীত হওয়া খুবই দূরবর্তী প্রত্যাশা বলে
প্রতীয়মান হয়। ভবিষ্যতের পদার্থবিজ্ঞান দেখতে যাই হোক না কেন, এটি অর্থনৈতিক মন্দা
সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে খুবই অনুপযোগী। জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতির মত বিজ্ঞানের শাখা
পদার্থবিজ্ঞানে রূপান্তর থেকে অনেক দূরে, বরং এই দু’টি শাখা মূলত পদার্থবিজ্ঞান থেকে
স্বাধীন (autonomous)।
এটি দার্শনিক ধাঁধার দিকে ধাবিত করে। চুড়ান্তভাবে ভৌত সত্তা নিয়ে
গবেষণায় নিয়োজিত বিজ্ঞান কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানে রূপান্তরিত হতে পারবে না? এটা স্বীকৃত
যে উচ্চতরের বিজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে পদার্থবিজ্ঞান থেকে স্বাধীন (autonomous), কিন্তু
কীভাবে এটি সম্ভব? কিছু দার্শনিকের মতে, উত্তর এই সত্যে নিহিত যে উচ্চস্তরের বিজ্ঞান
কর্তৃক গবেষণাকৃত বস্তুসমূহ (objects) ভৌত পর্যায়ে ‘বর্ধিতভাবে প্রতীত’ (multiply realized
at the physical level)। বর্ধিতভাবে প্রতীতির ধারণা (idea of multiple realization)
বিশদ করতে, অ্যাশট্রের (ashtrays) সংগ্রহ কল্পনা করা যাক। মহাবিশ্বের সবকিছুর মত প্রত্যেকটি
স্বতন্ত্র অ্যাশট্রে স্পষ্টতই একটি ভৌত সত্তা। কিন্তু অ্যাশট্রেগুলোর ভৌত সংগঠন (physical
composition) বিভিন্ন হতে পারে, যেমন কিছু কা্চের তৈরী হতে পারে, অন্যগুলো প্লাস্টিকের,
এবং ইত্যাদি। এবং সেগুলো সম্ভবত আকার, আকৃতি ও ওজনে পৃথক হবে। একটি অ্যাশট্রে কতগুলো
বিভিন্ন ভৌত বৈশিষ্ট্যের পরিসর ধারণ করতে পারে, সে সম্পর্কে কার্যত কোনো পরিসীমা নেই।
সুতরাং ’অ্যাশট্রে’-কে সম্পূর্ণরূপে ভৌত শর্তাবলী (purely physical terms) দিয়ে সংজ্ঞায়িত
করা অসম্ভব। ‘x একটি অ্যাশট্রে যদি এবং কেবলমাত্র যদি x হয় . . - এই আঙ্গিকের একটি সত্যি বিবৃতি আমরা অন্বেষণ করতে
পারিনা, যেখানে ফাঁকা স্থান (blank) পূর্ণ করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা থেকে নেয়া অভিব্যক্তি
(expression) দিয়ে। এর অর্থ এই যে অ্যাশট্রেসমূহ ভৌত পর্যায়ে বর্ধিতভাবে প্রতীত (multiply
realized at the physical level)।
কেন মনোবিজ্ঞানকে পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নে অবরোহিত করা যায় না
(cannot be reduced)-এটা ব্যাখ্যা করতে দার্শনিকরা বহুবিধ প্রতীতির (multiple
realization multiple realization) সহায়তা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু নীতিগতভাবে
ব্যাখ্যাটি যেকোনো উচ্চতর পর্যায়ের বিজ্ঞানের জন্য কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি জীববৈজ্ঞানিক
সত্য (biological fact) বিবেচনা করা যাক, তাহলো এই যে স্নায়ুকোষ ত্বককোষ অপেক্ষা দীর্ঘায়ু।
কোষ ভৌত সত্তা, সুতরাং একজন চিন্তা করতে পারে যে এই সত্যটি একদিন পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে
ব্যাখ্যা করা যাবে। যাহোক, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভৌত পর্যায়ে (at the microphysical
level) কোষগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবেই বহুবিধভাবে প্রতীত (multiply realized)। কোষগুলো
চুড়ান্তভাবে পরমাণু দিয়ে গঠিত, কিন্ত বিভিন্ন কোষে পরমাণুসমূহের সুনির্দিষ্ট বিন্যাস
অবশ্যি পৃথক হবে। “কোষের ধারণাকে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সংজ্ঞায়িত
করা যায় না। ‘x একটি কোষ যদি এবং কেবল যদি x . .
’ –এই আঙ্গিকটির কোনো সত্য বিবৃতি থাকে না, যদি ফাঁকা স্থান পূর্ণ করা হয় মাইক্রোপদার্থবিজ্ঞান
থেকে একটি অভিব্যক্তি (expression) দিয়ে। এটা যদি সঠিক হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় এই
যে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান কখনো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হবে না- কেন স্নায়ু কোষের আয়ু ত্বক
কোষের থেকে অধিক, অথবা প্রকৃতপক্ষে কোষ সম্পর্কে অন্য যেকোনো সত্য। দরকারী উপায়ে কোষজীবিজ্ঞানের
অভিধান ও পদার্থবিজ্ঞানের অভিধান একে অপরের ওপর খাপ খায় না (do not map onto each
other)। এইভাবে আমরা একটা ব্যাখ্যা পেয়ে যাই যে কেন কোষজীববিজ্ঞানকে পদার্থবিজ্ঞানে
অবরোহিত করা যায় না (cannot be reduced to physics), কোষ ভৌত সত্তা হওয়া সত্তেও। সকল
দার্শনিক বহুবিধ প্রতীতির মতবাদে খুশী নয়, কিন্ত এটি পদার্থবিজ্ঞান থেকে উচ্চতর-পর্যায়ের
বিজ্ঞান যে স্বতন্ত্র এবং পদার্থবিজ্ঞানও যে অন্যান্য শাখা থেকে স্বতন্ত্র- সেটির একটি পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যার যোগান দেয়।
অধ্যায় চার
বাস্তববাদ ও প্রতি-বাস্তববাদ
যদিও ঐতিহ্যিক বাস্তববাদ/ভাববাদের ইস্যু দর্শনের যে এলাকার অন্তর্ভুক্ত তাকে মেটাফিজিক্স বলা হয়, কিন্তু বিশেষ করে বিজ্ঞানের সাথে এটি করার কিছুই প্রকৃতপক্ষে পায়নি। এই অধ্যায়ে আমাদের সম্পৃক্তি একটি অধিকতর আধুনিক বিতর্কের বিষয়ে যেটি বিশেষত বিজ্ঞানের উপর, এবং কিছু উপায়ে ঐতিহ্যিক ইস্যুর অনুরূপ। বিতর্কটি হলো দুটি অবস্থানের মধ্যে, একটি অবস্থান বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ এবং অপরটি এর বিপরীত যা প্রতিবাস্তববাদ বা যান্ত্রিকতাবাদ (instrumentalism) নামে পরিচিত। এখন থেকে আমরা ‘বাস্তববাদ’ শব্দটি ব্যবহার করবো বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ বোঝাতে, এবং ‘বাস্তববাদী’ ব্যবহার করবো বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদী বোঝাতে।
অধিকাংশ দার্শনিক ‘ইজম’-এর মতই বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ ও বিপরীত-বাস্তববাদ। বৈজ্ঞানিক বাস্তবাদের অনেক ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ আছে, সুতরাং একটি সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট উপায়ে একে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কিন্তু মৌল ধারণা খুবই সোজা। বাস্তববাদীবৃন্দ মনে করেন যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো দুনিয়ার একটি সত্য বর্ণনার যোগান দেয়া। এটি মোটামুটি নির্দোষ মতবাদের মতই শোনায়। বিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো দুনিয়ার একটি মিথ্যা বর্ণনা তৈরী করা- এটা কেউ নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেনা। কিন্তু প্রতি-বাস্তববাদীরা তা মনে করে না। বরং প্রতি-বাস্তববাদীরা মনে করে যে দুনিয়ার একটি নির্দিষ্ট অংশ- ‘পর্যবেক্ষণযোগ্য অংশ’-এর একটি সত্য বর্ণনার যোগান দেয়াই হলো বিজ্ঞানের লক্ষ্য। প্রতি-বাস্তববাদীদের দুনিয়ার ‘অপর্যবেক্ষণযোগ্য’ অংশ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই, বিজ্ঞানীরা এটিকে সত্য বললেই কী আর না বললেই কী।
দুনিয়ার পর্যবেক্ষণযোগ্য অংশ দ্বারা ঠিক কী অর্থ বুঝাতে চান প্রতি-বাস্তববাদীরা? তাঁরা বুঝাতে চান টেবিল-চেয়ার, গাছপালা ও প্রাণী, টেস্ট-টিউব ও বুনসেন বার্নার, বজ্রপাত ও তুষার পাত ইত্যাদি ইত্যাদি। মানব সত্তা সরাসরি এই ধরনের বস্তুসমূহ উপলব্ধি করতে পারে- সেই জন্য এর অর্থ হলো এই যে তাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য বলা যায়। বিজ্ঞানের কিছু শাখা একচেটিয়াভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য বস্তুসমূহ নিয়ে কাজ করে (deal)। যেমন জীবাশ্মবিদ্যা, অর্থাৎ জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা। জীবাশ্মগুলো সহজেই পর্যবেক্ষণযোগ্য । স্বাভাবিকভাবে যাদের দৃষ্টিশক্তি কাজ করে তারা জীবাশ্ম দেখতে পায়। কিন্তু অন্যান্য বিজ্ঞান দাবী করে বাস্তবতার অপর্যবেক্ষণযোগ্য এলাকা। পদার্থবিজ্ঞান এর সুস্পষ্ট উদাহরণ। পরমাণু, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, লেপটন, এবং অন্যান্য অদ্ভুত কণিকাসমূহের উপর তত্ত্বাবলী অগ্রসর করতে পদার্থবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। এই ধরনের সত্তাসমূহ মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার (observational powers) বাইরে অবস্থান করে।
জীবাশ্মবিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রসমূহে বাস্তবতাবাদী ও প্রতি-বাস্তবতাবাদীরা দ্বিমত পোষণ করেন না। যেহেতু জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণযোগ্য, বাস্তবতাবাদীর থিসিস হলো এই (the realist thesis) যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য সত্যিকারভাবে দুনিয়াটাকে বর্ণনা করা এবং প্রতি-বাস্তবতাবাদীর থিসিস হলো এই যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য সত্যিকারভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য দুনিয়াটাকে বর্ণনা করা, এই দুটি থিসিস নিশ্চিতভাবেই অনুরূপ, যতদূর পর্যন্ত জীবাশ্ম গবেষণাকে সংশ্লিষ্ট করা হয়। কিন্তু যখন পদার্থবিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানের নিকট এটি আসে, তখন বাস্তবতাবাদীগণ ও প্রতি-বাস্তবতাবাদীগণ ভিন্নমত পোষণ করেন। বাস্তবতাবাদীগণ বলেন যে যখন পদার্থবিজ্ঞানীগণ ইলেকট্রন ও কোয়ার্ক সম্পর্কে তত্ত্বসমূহ হাজির করেন, তখন তাঁরা চেষ্টা করেন সাবএটমিক দুনিয়ার একটি সত্য বর্ণনা দিতে, ঠিক যেমন জীবাশ্মতত্ত্ববিদগণ চেষ্টা করেন জীবাশ্মসমূহের দুনিয়ার একটি সত্য বর্ণনা দিতে। প্রতি-বাস্তবতাবাদীগণ ভিন্নমত পোষণ করেন: তাঁরা সাবএটমিক পদার্থবিজ্ঞান ও জীবাশ্মবিজ্ঞানের তত্ত্বসমূহের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য দেখেন।
যখন পদার্থবিজ্ঞানীগণ অপর্যবেক্ষণযোগ্য
অর্থাৎ দেখা যায় না এমন সত্তাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেন, তখন প্রতি-বাস্তবতাবাদীবৃন্দ
কত দূর পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে থাকবেন? টিপিক্যালগতভাবে তাঁরা দাবী করেন যে
এই সত্তাসমূহ নিছক উপযুক্ত অলীক বস্তু (convenient fictions) যা সহায়তা করে পর্যবেক্ষণযোগ্য
প্রপঞ্চসমূহ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। উদাহরণস্বরূপ, গ্যাসের গতি তত্ত্ব বিবেচনা
করা যাক, যেটি বলে যে একটি গ্যাসের যেকোনো আয়তন ধারণ করে খুবই ক্ষুদ্র সত্তাসমূহ এবং
এগুলো গতিশীল। এই সত্তাগুলো অণু এবং অপর্যবেক্ষণযোগ্য। গতি তত্ত্ব থেকে গ্যাসের পর্যবেক্ষণযোগ্য
আচরণের নানাবিধ ফলাফল আমরা অনুমান করতে পারি। যেমন ধ্রুব চাপে একটি গ্যাসের নমুনা উত্তপ্ত
করলে এর আয়তন সম্প্রসারণ সংঘটিত হয়, যা পরীক্ষাণীয়ভাবে প্রমাণ করা যায়।
যেহেতু বাস্তবাদ/প্রতি-বাস্তববাদ বিতর্ক বিজ্ঞানের লক্ষ্য সম্পর্কে
উৎসাহী, কাজেই একজন মনে করতে পারে যে এটা সমাধান করা যেতে পারে সাদামাটাভাবে স্বয়ং
বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন করে। কেন বিজ্ঞানীদের একটি ক্ষীণ দল (straw poll of Scientist)
তাদের লক্ষ্যাবলী সম্পর্কে নিজেদের প্রশ্ন করে না? কিন্তু এই সুপারিশ (suggestion)
এই পয়েন্টটা ধরতে ব্যর্থ হয় আর তা হলো এটি ‘বিজ্ঞানের লক্ষ্য’ নামক অভিব্যক্তি খুবই
আক্ষরিক অর্থে নেয়। যখন আমরা জিজ্ঞেস করি বিজ্ঞানের লক্ষ্য কী, তখন আমরা স্বতন্ত্র
বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি না। বরং বৈজ্ঞানিক এন্টারপ্রাইজ ব্যাখ্যা
করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলেন এবং কী করেন- এ ব্যাপারে আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি কীভাবে
সেরা
অর্থ বহন করে আমাদের নিকট নিয়ে আসে।
বাস্তববাদীরা মনে করেন যে আমাদের সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবলী ব্যাখ্যা করা উচিত
বাস্তবতার প্রচেষ্টাকৃত বিবরণ হিসেবে। প্রতি-বাস্তববাদীরা মনে করেন যে পর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহ ও প্রক্রিয়াবলীর
জন্য যে
তত্ত্বসমূহ কথা বলে, সেই
তত্ত্বাসমূহের জন্যে এই ব্যাখ্যা অনুপযোগী। যখন বাস্তববাদ/প্রতি-বাস্তববাদ বিতর্কের
ওপর বিজ্ঞানীবৃন্দের নিজস্ব দৃষ্টিগুলোর আবিষ্কার নিঃসন্দেহের আগ্রহোদ্দীপক, তখন
ইস্যুটি চুড়ান্তভাবে দর্শন সংক্রান্ত।
প্রতি-বাস্তববাদের অনেক প্রেষণা উদ্ভূত হয এই বিশ্বাস থেকে
যে আমরা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতার অপর্যবেক্ষণযোগ্য অংশের জ্ঞান অর্জন করতে পারি না- এটা
মানব জ্ঞানের পরিসীমার বাইরে। এই দৃশ্যপটে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্থিরীকৃত
হয় আমাদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দিয়ে। সুতরাং বিজ্ঞান আমাদের জীবাশ্ম, উদ্ভিদ ও চিনির
স্ফটিকের জ্ঞান দিতে পারে, কিন্তু পরমাণু, ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের জ্ঞান দিতে পারে না-
যেহেতু পরবর্তীগুলো অপর্যবেক্ষণযোগ্য। সবমিলিয়ে এই মনোভঙ্গি (view) অবিশ্বাস্য (implausible)।
কারণ ফসিল ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ গুরুত্ব সহকারে সন্দেহ পোষণ করতে পারবে
না, কিন্তু পরমাণু ও ইলেকট্রনের জন্য এটা সত্য নয়। গত অধ্যায়ে আমরা যেমনটি দেখেছি,
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে অনেক নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী পরমাণুর অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করতেন।
যারা এধরনের মনোভঙ্গি (view) গ্রহণ করেন তারা অবশ্যি কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করেন- কেন বিজ্ঞানীবৃন্দ অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহ
সম্পর্কে তত্ত্বাবলী এগিয়ে নেন, যদি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যা পর্যবেক্ষণ করতে পারে তাতে
সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতি-বাস্তববাদীরা যে ব্যাখ্যা প্র্রদান করেন তা হলো এই যে সেগুলো
সুবিধাজনক ফিকশন (convenient fictions), যা পর্যবেক্ষণযোগ্য দুনিয়াতে বস্তুসমূহের আচরণ
সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীতে সহায়তা করতে পরিকল্পনাকৃত।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমাদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দিয়ে সীমাবদ্ধ, বাস্তববাদীরা
এতে একমত পোষণ করেন না। পক্ষান্তরে, তাঁরা বিশ্বাস করেন আমাদের ইতোমধ্যে
অপর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতার পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে। এজন্য বিশ্বাস করার সকল যুক্তি
(every reason) আছে যে আমাদের সেরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ সত্য, এবং আমাদের সেরা
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহ (unobservable entities)
সম্পর্কে বলে। উদাহরণ হিসেবে, বস্তুর আণবিক তত্ত্ব বিবেচনা করা যাক, যেটি বলে সকল
বস্তু পরমাণুসমূহ দিয়ে গঠিত। দুনিয়া সম্পর্কে ঘটনাবলীর একটি বড় পরিসরের
ব্যাখ্যায়নে পারমাণবিক তত্ত্ব সক্ষম। বাস্তববাদীদের মতে, পর্যাপ্ত প্রমাণ (good
evIdence) আছে যে তত্ত্ব সত্য, অর্থাৎ বস্তু প্রকৃতপক্ষেই পরমাণুসমূহ দিয়ে গঠিত
এবং তত্ত্ব যেভাবে বলে তা সেভাবেই আচরণ করে। অবশ্যি তত্ত্ব মিথ্যা হতে পারে, এর সমর্থনে আপাত প্রমাণ সত্তেও,
কিন্তু তা যেকোনো তত্ত্বের ক্ষেত্রেও হতে পারে। ঠিক যেহেতু পরমাণুগুলো
অপর্যবেক্ষণযোগ্য, তাই বাস্তবতার একটি চেষ্টাকৃত বর্ণনা ছাড়া তা কোনো কারণ নয়
পারমাণবিক তত্ত্ব ব্যাখ্যার। এবং একটি খুবই সফল তত্ত্ব, সকল সম্ভাবনায়।
আমাদের উচিত দুই ধরণের প্রতি-বাস্তবতা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা।
প্রথম ধরণ অনুযায়ী, আক্ষরিকভাবে মোটের উপর অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহের আলাপ (talk)
বোঝা যায় না। সুতরাং যখন একজন বিজ্ঞানী ইলেক্ট্রন সম্পর্কে একটি তত্ত্ব হাজির
করেন, উদাহরণস্বরূপ, যে সত্তাকে ‘ইলেক্ট্রন’ বলা হয়, তার অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁকে
জাহির করতে বাধ্য করা উচিত নয়। বরং, ইলেক্ট্রনগুলোর আলাপ রূপকময় (metaphorical)। প্রতি-বাস্তববাদের
এই রূপটি বিশ শতকের প্রথমার্ধে জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু এখন এটিকে অল্প মানুষই সমর্থন
করে (advocate)।ভাষা দর্শনের একটি মতবাদ (doctrine) দিয়ে এটি বহুল পরিমাণে
উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো, সেই মত অনুসারে মূলগতভাবে যে পদার্থসমূহ (things) পর্যবেক্ষণ
করা যায় না সেগুলো সম্পর্কে কোনো অর্থপূর্ণ ভাষ্য (assertions) তৈরী করা সম্ভব নয়,
এই মতবাদটি সাম্প্রতিক কালের স্বল্প সংখ্যক দার্শনিকগণ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ধরণের
প্রতি-বাস্তববাদ গ্রহণ করে অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহের সেই আলাপগুলো যেগুলোকে অভিহিত
মূল্যে (at face value) গ্রহণ করা উচিত: যদি একটি তত্ত্ব বলে যে ইলেকট্রনগুলো
ঋণাত্মক চার্জযুক্ত, এটি সত্য যদি ইলেক্ট্রনগুলো অস্তিত্বমান থাকে এবং তারা ঋণাত্মক
চার্জযুক্ত হয়, কিন্তু অন্যথায় মিথ্যা। কিন্তু আমরা কখনো জানবোনা কোনটি,
প্রতি-বাস্তববাদীরা বলেন। সুতরাং অপর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতা সম্পর্কে
বিজ্ঞানীবৃন্দ যে দাবীসমূহ করেন, সেগুলোর প্রতি সঠিক মনোভাব (correct attitude) হলো
আদত অজ্ঞেয়বাদের একটি (one of total agnosticism)। তারা হয় সত্য অথবা মিথ্যা,
কিন্তু কোনটি তা অন্বেষণে আমরা অসমর্থ। অধিকাংশ আধুনিক প্রতি-বাস্তববাদ এই দ্বিতীয়
প্রকারের।
‘ন-অলৌকিক’ যুক্তি (The `no miracles’
argument)
অনেক তত্ত্ব যা অপর্যবেক্ষণযোগ্য
সত্তাসমূহকে সিদ্ধ বলে ধরে নেয়, সেই তত্ত্বগুলো অভিজ্ঞতামূলকভাবে সফল- তারা পর্যবেক্ষণযোগ্য দুনিয়ার পদার্থসমূহের আচরণ
সম্পর্কে চমৎকার পূ্র্বাভাস (excellent predictions) দেয়। উপরোল্লেখিত গ্যাসের গতিতত্ত্ব
একটি উদাহরণ, এবং আরও অন্যান্য উদাহরণ আছে। অধিকন্তু, অনুরূপ তত্ত্বসমূহের প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ
প্রযুক্তিগত প্রয়োগ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যখন ইলেকট্রনসমূহ উচ্চতর শক্তিস্তরসমূহ থেকে
নিম্নতর শক্তিস্তরসমূহে আসে তখন যা ঘটে তার উপর ভিত্তি করে যে তত্ত্ব তার উপরই লেজার
প্রযুক্তির ভিত্তি নিহিত। এবং লেজারের কাজ যেমন তারা আমাদের দৃষ্টির ত্রুটি সংশোধন
করে, গাইডেড মিসাইলসমূহের সাহায্যে আমাদের শত্রুদের আক্রমণ করে, এবং এছাড়া আরও অনেক
কাজ করে। লেজার প্রযুক্তির ভিত্তি নির্মাণ করে যে তত্ত্ব তা সত্যিই অভিজ্ঞতামূলকভাবে
সফল।
তত্ত্বসমূহের অভিজ্ঞতামূলক সফলতা অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমুহকে
সিদ্ধ বলে ধরে নেয়। এই সফলতা হলো বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদের জন্য মজবুত যুক্তিগুলোর
একটির ভিত্তি, এটিকে বলা হয় ‘ন অলৌকিক যুক্তি। এই যুক্তি অনুসারে, এটি একটি
বিস্ময়কর যুগপৎ সংঘটন (an extraordinary coincidence) হতো যদি ইলেকট্রন ও পরমাণু
সম্পর্কে বলা একটি তত্ত্ব পর্যবেক্ষণযোগ্য দুনিয়া সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে
পারতো- যদি না ইলেকট্রন ও পরমাণু প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বমাণ থাকতো। যদি কোনো পরমাণু
ও ইলেকট্রন না থাকে, পর্যবেক্ষণযোগ্য ডাটার সাথে তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সাজুয্য কী
ব্যাখ্যা করে? অনুরূপভাবে, আমাদের তত্ত্বসমূহ যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দিকে ধাবিত
করে, তা আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবো যদি না আমরা ধরে নেই যে আলোচনাধীন তত্ত্বাবলী
সত্য? এই মনোভঙ্গিতে, প্রতি-বাস্তববাদী হওয়া মানেই অলৌকিকে বিশ্বাস করার সামিল।
যেহেতু অলৌকিকে বিশ্বাস না করা নিশ্চিতভাবেই অধিকতর ভালো যদি একটি ন-অলৌকিক বিকল্প
থাকে, তখন আমাদের প্রতি-বাস্তববাদী না হয়ে বাস্তববাদী হওয়া উচিত।
বাস্তববাদ সঠিক এবং প্রতি-বাস্তববাদ বেঠিক- এটি প্রমাণ করা এই যুক্তির উদ্দেশ্য নয়। বরং
এটি একটি যুক্তিসঙ্গত যুক্তি (plausibility argument)-সর্বোত্তম ব্যাখ্যার একটি
অনুসিদ্ধান্ত। যে ঘটনা (phenomenon) ব্যাখ্যা করতে হবে তাহলো এই ঘটনা (fact) যে
অনেক তত্ত্ব অপর্যবেক্ষণযোগ্য সত্তাসমূহকে স্বতসিদ্ধ বলে ধরে নেয়, সেই তত্ত্বগুলো
উচ্চমাত্রায় অভিজ্ঞতামূলক সাফল্য উপভোগ করে। এই ঘটনার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা, ধরে নেই
যে ‘ন-অলৌকিক যুক্তি সমর্থন করে। এই ঘটনা হলো এই যে তত্ত্বসমূহ সত্য (true)।
আলোচনাধীন সত্তাসমূহ (the entities in question) প্রকৃতই অস্তিত্বমান, এবং ঠিক
যেমনি তত্তসমূহ বলে, ঠিক সেইভাবেই সত্তাসমূহ আচরণ করে। এই ব্যাখ্যা যদি না আমরা
গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের তত্ত্বসমূহের অভিজ্ঞতামূলক সফলতা হয়ে যায় একট অব্যাখ্যাত
রহস্য।
প্রতি-বাস্তববাদীরা ‘ন অলৌকিক’ যুক্তির প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়
(respond) নানা উপায়ে। একটি প্রতিক্রিয়া (one response) বিজ্ঞান ইতিহাসের কিছু
ঘটনার প্রতি দোহাই দেয়া। ঐতিহাসিকভাবে, তত্ত্বসমূহের অনেক নজির আছে যেগুলোকে এখন
আমরা মিথ্যা বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু সেগুলো সেই সময়ে অভিজ্ঞতামূলকভাবে সম্পূর্ণ
সফল ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান দার্শনিক ল্যারি লাউডেন (Larry Laudan)
তাঁর বিখ্যাত একটি আর্টিকেলে ত্রিশটির অধিক এ ধরনের তত্ত্বের তালিকা দেন, বিভিন্ন
বৈজ্ঞানিক ডিসিপ্লিন ও যুগের পরিসর থেকে এই আর্টিকেলগুলো নেয়া হয়েছিলো। দহনের
ফ্লজিস্টন তত্ত্ব তেমনি একটি উদাহরণ। এই তত্ত্ব অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ পর্যন্ত
ব্যাপকভাবে গৃহিত হয়েছিলো। এই তত্ত্বে বলা হয় যে যখন কোনো বস্তু (object) দহন করা
হয় তখন এটি একটি পদার্থ (substance) নির্গত করে বায়ুমন্ডলে, একে ‘ফ্লজিস্টন’ নামে
অভিহিত করা হয়। আধুনিক রসায়ন আমাদের শেখায় যে এটি মিথ্যা। ফ্লজিস্টন নামে কোনো
পদার্থ নেই। বরং যখন বাতাসে কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তখনি দহন
সংঘটিত হয়। কিন্তু ফ্লজিস্টনের অনস্তিত্ব সত্ত্বেও, ফ্লজিস্টন তত্ত্ব
অভিজ্ঞতামূলকভাবে সম্পূর্ণ সফল ছিল: এটি এর সময়ে প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণযোগ্য ডাটার
সাথে যুক্তিসঙ্গতভাবে খাপ খেতো।
এই ধরনের উদাহরণসমূহ সুপারিশ করে যে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদের
জন্য ‘ন-অলৌকিক’ যুক্তি (no miracles’ argument) একটু দ্রুতই হয়ে যায়। ঐ যুক্তির
প্রবক্তাবৃন্দ এখনকার সময়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবলীর অভিজ্ঞতামূলক সফলতাকে গণ্য করেন
তাঁদের সত্যের নজির (evidence) হিসেবে। কিন্তু বিজ্ঞান দর্শন দেখায় যে অভিজ্ঞতামূলকভাবে
সফল তত্ত্বাবলী প্রায়ই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং আমরা কীভাবে জানবো যে একই
পরিণতি (same fate) ঘটবে না আজকের দিনের তত্ত্বসমূহের বেলায়? আমরা কীভাবে জানবো যে
উদাহরণস্বরূপ, বস্তুর পারমাণবিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও ফ্লজিস্টন তত্ত্বের ক্ষেত্রে
যা ঘটেছে তা ঘটবে না? যদি একবার আমরা বিজ্ঞান ইতিহাসের দিকে যথাযথ মনোযোগ দেই,
প্রতি-বাস্তববাদীরা যুক্তি দেন, আমরা দেখতে পাই যে অভিজ্ঞতামূলক সফলতা থেকে
তাত্ত্বিক সত্যের দিকে অনুসিদ্ধান্ত (inference) খুবই নড়বড়ে। এইভাবে পারমাণবিক
তত্ত্বের প্রতি যুক্তিসঙ্গত মনোভাব (rational attitude) একটি অজ্ঞেয়বাদের (agnosticism)
দৃষ্টান্ত হয়ে যায়- অর্থাৎ এটা সত্যও হতে পারে, অথবা নাও হতে পারে। আমরা নিছক জানি
না, প্রতি-বাস্তববাদীরা বলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন