ইলিয়ানর মার্কস ছিলেন একজন সংগ্রামী, একজন সংগঠক এবং একজন লেখক। তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ এবং যৌণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে। তিনি সারা জীবন তাঁর চারপাশে একটিভিস্ট দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন, এবং তাঁর সময়কার একজন মহান একটিভিস্ট হন। তিনি মহান বিপ্লবী কার্ল মার্কসের কনিষ্ঠা কন্যার থেকেও বেশী কিছু ছিলেন।
আমাদের সবার মত, তিনিও গড়ে উঠেন যে সময়ে তিনি বাস করতেন এবং কাজ করতেন, সেই সময় দিয়ে। ১৮৭১-এ সংঘটিত প্যারিস কমিউন থেকে ১৮৮০-এর দশকের নয়া ইউনিয়নিজম আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শ্রমিকদের রুখে দাঁড়ানো পর্যন্ত, সময়ের জয়-পরাজয়গুলো প্রোথিত হয় (distilled ) ইলিয়ানরের রাজনৈতিক চিন্তায়, কর্মে এবং প্রতিশ্রুতিতে।
তিনি থিয়েটার ও অভিনয়ের অনুরাগী ছিলেন। এই অনুরাগ শ্রমিকদের শত শত সভাতে বক্তৃতা করতে সহায়ক হয়েছিলো। তিনি একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন এবং আনন্দ দিতে পারতেন । ব্রিটিশ দর্শকদের কাছে তিনি ইবসেন ও ফ্লবার নিয়ে আসতে সহায়তা করেছিলেন, পাশাপাশি লন্ডনের ইস্ট এন্ডে নির্মম বসদের জীবনে তিনি আতঙ্ক ছিলেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেকে শেকসপিয়ারসহ সবকিছুতেই তিনি মতামত ব্যক্ত করতেন।
বিপ্লবী সমাজতন্ত্র সবসময় তাঁর মনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল। ইলিয়ানর সম্পর্কে মার্কস বলেন যে যখন তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা জেনি তাঁর মতো, তখন “টুসিই (ইলিয়ানরের ডাকনাম) আমি। ইলিয়ানর সম্পর্কে মার্কসের এই উক্তি খুবই বিখ্যাত। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর পরিবারের, বিশেষ করে তাঁর পিতার অঙ্গীকারের ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁর জীবন ও রাজনীতির ওপর। তিনি তাঁর কিশোর বেলা ব্যয় করেন International Working Men's Association, IWMA-এর কংগ্রেসগুলোতে। IWMA ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিকদের সংগঠন, এবং পরিণত বয়সের (adult life) বেশীটা ব্যয় করেন কার্ল মার্কসের রচনাবলীর অনুবাদে ও গোছানোতে (organising)। কিন্তু তিনি তাঁর মনোজগতে মনোনিবেশ করলে (continued in her spirit) তাঁর নিজেকেও খুঁজে পান।
ইলিয়ানরের রাজনীতির মূলে ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদ। ঠিক ১৬ বছর বয়সে তিনি প্যারিস এবং এর কমিউনের দিকে নজর দিলেন, মেহনতি নারী ও পুরুষ ঠিক কী করতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করতে। এর ইতিহাস এবং এর শিক্ষা শেয়ার করতে তিনি নিজে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি সমাজের সবচেয়ে নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়ান। শিশু হিসেবে, তিনি আইরিশ রিপাবলিকানদের সংগ্রামের সাথে একাত্ম হন, এই উপলব্ধি যেটি পরবর্তীতে প্রতিদান হিসেবে তিনি ফিরে পান, যখন ইস্ট লন্ডনে রাজনীতিকৃত আইরিশ শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।
লেবার পার্টির আবির্ভাবের অনেক পূর্বেই তিনি ব্রিটেনে গোড়ার দিকের সমাজতান্ত্রিক সংগঠন তৈরী করেন। বাক স্বাধীনতা (free speech) এবং একটিভিস্টদের রাজপথে সংগঠিত হওয়ার অধিকারের জন্য তিনি প্রচার অভিযান চালান।
তিনি আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাদের কেন্দ্রগুলোতে সমাজতান্ত্রিক
ধারণাবলী নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। ১৮৯০-এ মে দিবসের বিক্ষোভে একটি
বক্তৃতাতে তিনি বুদ্ধিদীপ্তভাবে যেমনটি বলেন: “কিছু খ্রীস্টান আছেন যারা ছয় দিন
পাপ করেন এবং সপ্তম দিনে গির্জায় যান, আমরা অবশ্যি তাদের মত হবো না; কিন্তু আমরা
অবশ্যি কারণের জন্য (for the cause) দৈনিক কথা বলবো, আমাদের সাথে দেখা হওয়া পুরুষ
ও বিশেষ করে নারীদের কর্মীতে (rank) পরিণত করবো যাতে আমাদের তাঁরা সহায়তা করেন”(www.marxists.org/archive/eleanor/works/mayday.htm)।
নয়া ইউনিয়নবাদের
সংগ্রাম, ধর্মঘট ও শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে তিনি ক্লান্তহীনভাবে কাজ করেন। আট ঘন্টা
শ্রমদিবস, ভালো বেতন ও উন্নত পরিবেশের
জন্য সংগ্রামে এটি হ’ল “অসংগঠিতদের” (unorganisable) সংগঠন।
কাজের
পরিবর্তনশীল ধরন এবং শ্রমিক সংগঠনের জন্য এর তাৎপর্যাবলী (implications) সম্পর্কে সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে অনেক কিছু করা হয়েছে। শ্রমিকদের কিছু গোষ্ঠী সংগঠিত হতে পারে কিনা বা
রুখে দাঁড়াতে পারে কিনা- এই প্রশ্নগুলোকে স্পর্শ করে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক আছে।
আর
কিছু না হলেও, আজকের দিনের ফাস্ট ফুড শ্রমিক অথবা কল সেন্টার কর্মীদের মতই ১৮৮০-এর
দশকের ম্যাচ ফ্যাক্টরির নারী-শ্রমিক, গ্যাস-শ্রমিক ও ডক-শ্রমিকদের কাজের জীবন ছিল
প্রতি মুহুর্তে (every bit) অনিশ্চিত। তাঁদের সংগঠনের ইতিহাস ছিল সামান্যই অথবা
ছিলই না, তাঁরা বিদ্যমান ইউনিয়নগুলো থেকে বাদ ছিল এবং তাঁদের গাল দেয়া হতো এবং পিঠ
চাপড়ানো হতো সমান মাত্রায়। কিন্তু তাঁরা সংগ্রাম করেছিল এবং তাঁরা জিতেছিল।
দেশব্যাপী ইলিয়ানর এই শ্রমিকদের সংগঠিত করেন এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ গ্যাস ওয়ার্কার্স
এন্ড জেনারেল ল্যাবারারস-এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন, যেটি এখন
জিএমবি নামে পরিচিত।
তিনি ব্রিটেনের এবং মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের ওপর লিখতেন, এবং শ্রমিকদের ভয়াবহ কর্ম পরিবেশ
এবং তাঁরা যে দারিদ্র্য সহ্য করতেন,
সেগুলোর উপরও লিখতেন। তিনি নির্যাতিতদের একজন জননেতা ছিলেন। নারীদের
বিশেষ করে অভিবাসী শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করতেন এবং আন্দোলন করতেন। এতে অন্তর্ভুক্ত
ছিলেন সিলভারটাউনের (Silvertown) নারী শ্রমিক থেকে স্টেপনির (Stepney) ইহুদি
দর্জিগণ।
নারী
মুক্তির ইস্যুতে তিনি লিখতেন ও বক্তৃতা দিতেন। তাঁর জীবনকালে ব্রিটেনের নারী
আন্দোলনে প্রধানত মধ্যশ্রেণীর নারীগণ ও তাঁদের স্বার্থের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে
শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য ইলিয়ানর নারীদের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেন. ঠিক
যেভাবে তিনি শ্রমিক আন্দোলন এবং এর অগ্রগতিকে দেখেন নারী মুক্তির চাবিকাঠি হিসেবে।
নারী শিক্ষার মত জায়গাগুলোর অর্জনকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না, কিন্তু তিনি দ্রুত
উপলব্ধি করেছিলেন যে নারী অধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের তুলনায় শ্রমজীবি নারীদের
শ্রমজীবি পুরুষদের সাথে বেশী সাদৃশ্য আছে। তিনি যুক্তি দেন যে, নারীদের ভোট দিতে
দেয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভোট দিতে পারাই যথেষ্ঠ ছিল না।
তিনি
উপলব্ধি করেন যে নারী ও পুরুষকে সংগঠিত করতে হয় পাশাপাশি থেকে। ১৮৯২ সনে তিনি
লেখেন, “এবং এখন আমাদের নারীদের কী করতে হবে? কোনও সন্দেহ ছাড়াই একটা জিনিস করতে
হবে। আমরা সংগঠিত হবো – কিন্তু ‘নারী’ হিসেবে সংগঠিত হবো না, বরং প্রোলেতিারিয় হিসেবে;
আমাদের কর্মজীবি পুরুষদের নারী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয় বরং সংগ্রামগুলোতে তাঁদের
কমরেড হিসেবে”(www.marixists.org/archive/draper/1976/women/5-emarx.html)।
তিনি তাঁর
কীর্তি ও সাহসিকতা দিয়ে মুগ্ধ করেন। গ্যাস শ্রমিকেরা তাঁকে “Our Old Sticker”
হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর যুক্তিসমূহের (arguments) ওপর বক্তৃতা প্রদান এবং এগুলোর
শক্তিমত্তা- এই উভয়ই দ্বারাই তাঁরা এবং অন্যান্যরা অভিভূত হতেন।
ইলিয়ানরের জীবনের অনেকগুলো বর্ণনা ফোকাস করে তাঁর
বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিগত জীবন এবং তাঁর আত্মহত্যার ওপর। তা থেকেও তাঁর জীবন ও
উত্তরাধিকারে অনেক বেশী কিছু বিদ্যমান। ইলিয়ানর মার্কসকে স্থান দেয়া উচিত
ক্ষমতাশালী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রে যেখানে তিনি মানানসই। এই শ্রমিক আন্দোলন
ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়নিজমের বৈশিষ্ট্যকে এবং সমাজের সবচেয়ে শোষিত ও নিপীড়িতদের
অবস্থান পাল্টে দিয়েছিল।
২: জীবনের প্রথম দিকের সময় (THE EARLY YEARS)
জানুয়ারি ১৮৫৫-তে ইলিয়ানর মার্কস লন্ডনের কেন্দ্রে সোহোর ডিন স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন।রাজনৈতিক অভিবাসীদের জন্য সোহো ছিল জীবনের কেন্দ্র। তাঁর জীবনের প্রথম দিকে পরিবারটি ধারাবাহিকভাবে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের চাপে পড়ে।নিয়মিতভাবে পাওনাদাররা তাঁদের দরজায় কড়া নাড়তো।
ইলিয়ানরের জন্মের তিন বছর পুর্বে মার্কস দম্পতির কন্যা ফ্র্যানজিস্কার মৃত্যুবরণ করে। মোটা অঙ্কের ঋণ না করে তার জন্য তাঁরা কফিন কিনতে সমর্থ হয় না। এই চাপ অনিবার্যভাবে তাঁদের ক্ষতি করে। কার্ল মার্কস লিখেন, ‘প্রতিদিন আমার স্ত্রী আমাকে বলে সে এবং ছেলেমেয়েরা মারা যাবে এবং তাদের কবর দেয়া হবে। এবং প্রকৃতপক্ষে আমি তাঁর সাথে বিতর্ক করতে পারি না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন