দ্বান্দ্বিকতা, প্রকৃতি এবং প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা মূল: ক্যামিলা রয়োল অনুবাদ: স ম আজাদ
দ্বান্দ্বিকতা, প্রকৃতি এবং প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা
মূল: ক্যামিলা রয়োল অনুবাদ: স ম আজাদ
অনুবাদকের উৎসর্গ: প্রিয় ছাত্র এবং প্রিয় বন্ধু খন্দকার তুষার আহমেদ জাভেদ ও সুবল সূত্রধরকে
১৮৭৩এ কার্ল মার্কসের সহযোগী ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা শিরোনামে একটি উচ্চাভিলাষী গ্রন্থের ওপর কাজ আরম্ভ করেন। তিনি মার্কসকে একটি চিঠিতে অভিহিত করেন কীভাবে, একদিন বিছানায় শায়িত অবস্থায় তিনি উপসংহারে উপনীত হন যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ হলো প্রকৃতপক্ষে সবকিছুই গতিময় বস্তু (matter in motion) সম্পর্কে। তিনি তাঁর বন্ধুকে ধারণাটি সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতেও বলেন যেন কোনো বাজে ইংরেজ ব্যক্তি এটি চুরি করতে না পারে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তাঁর নিজের ব্যাপক গবেষণায় মার্কসিয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে এঙ্গেলস সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেন। তাঁর ধারণাবলী লেখার প্রকল্পটি তিনি পরবর্তী দশক পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন, কিন্তু সম্পূর্ণকরণের সুযোগ শেষ পর্যন্ত তিনি কখনো পাননি।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাটি অদ্যবধি বিতর্কিত থেকে গিয়েছে। সমাজ অধ্যয়নে প্রয়োগকৃত হিসেবে, দ্বান্দ্বিকতা আপত্তিকৃত, দ্বান্দ্বিকতা কী - এর বহুবিধ ব্যাখ্যা এবং কীসের জন্য এটি প্রয়োগকৃত হওয়ার জন্য প্রত্যাশিত- এগুলো সহকারে। কিন্তু বহু তত্ত্ববিদ যারা দ্বান্দ্বিকভাবে মানব সমাজের উপলব্ধির পক্ষে, তাঁরা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে এটি প্রকৃতিতেও প্রয়োগযোগ্য। মার্কসবাদ কী ধরনের দর্শন এবং এটি আমাদের বাসকৃত দুনিয়ার অধিক মৌলিক দিকসমূহ উপলব্ধিতে সহায়তা করতে পারে কিনা- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো অধিক প্রশ্নমালা উত্থাপিত হয় প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কিত বিতর্কগুলোতে। এটি আরো নির্ভর করে প্রকৃতি দ্বারা আমরা কী অর্থ করি -এ বিষয়টি ঠিক দ্বান্দ্বিকতার মতই বিতর্কিত।
এঙ্গেলস ও ঊনিশ শতকের বিজ্ঞান
এঙ্গেলস নিশ্চিতভাবে তাঁর (বা যে কোনো) যুগের সবথেকে স্ব-শিক্ষিত মনিষীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি নিজেকে কেবলমাত্র সামাজিক বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে শিক্ষিত করেননি সঙ্গে সঙ্গে নৃবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও শিল্পকলা সম্পর্কেও শিক্ষিত করেছিলেন। তিনি এমন একটা যুগে বসবাস করছিলেন যখন এইসব ক্ষেত্রের সবগুলোতে বিপ্লবী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখ্য ১৮৫৯এ চার্লস ডারইউনের On the Origin of Speciesএর প্রকাশনা, এতে তিনি দেখান যে প্রাণিজ সত্ত্বাসমূহের প্রজাতিগুলো (organisms of species) অনড় ও পৃথকায়িত অস্তিত্ব নয়, বরং এগুলো নয়া ও র্যাড্যিালগতভাবে পৃথক রূপসমূহে বিকশিত হতে সমর্থ। মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনেই ডারইউনের লেখাটি পড়েন এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির ধারণার প্রমাণ হিসেবে এটিকে দেখেন- কমপক্ষে মানব সমাজসমূহের ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের ধারণার (conception) অনুরূপ হিসেবে তো বটেই।
কিন্তু এটা কেবলমাত্র জীববিজ্ঞানই নয় যেটি ঊনিশ শতকে বিপ্লবায়িত হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে জেমস প্রেসকট জুল দেখান যে তাপকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে এবং এর বিপরীত প্রক্রিয়াটিও সংঘটিত করা যায়। ভূূতত্ত্ব বিদ্যায় চার্লস লয়েল পৃথিবীর কঠিন আবরণের (earth crust) ভেতরে স্তরসমূহের ধারাবাহিক সৃজন ও ধ্বংস প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। এ্যালেক্স ক্যালিনিকোস যুক্তি দেন যে এঙ্গেলসের অন্তর্দৃষ্টি অবশ্যি দেখতে হবে যখন তিনি লিখছিলেন সেই সময়ে ভৌত বিজ্ঞানে সংঘটিত আদত বিকাশাবলীর প্রেক্ষাপটে। নিউটনের সূত্রাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত মডেলের ওপর ভিত্তি করে আগে বিজ্ঞানকে দেখা হতো-যেখানে যান্ত্রিক প্রক্রিয়াবলী সময়ের প্রেক্ষাপটে উভমুখী। ঊনিশ শতকে বিজ্ঞান বিবর্তনের মতন একমুখী প্রক্রিয়াসমূহের ওপর মনোযোগ দেয়া শুরু করে যেখানে প্রকৃতি কেবলমাত্র পরিবর্তিত হয় না সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়।
বিজ্ঞানীদের এবং সমাজে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের আরো উপলব্ধিতে মার্কসবাদ সহায়তা করেছে। এঙ্গেলস কেবলমাত্র বিজ্ঞানের সামাজিক অবস্থানেই আগ্রহী ছিলেন না- তিনি বিজ্ঞানের অভ্যন্তরস্থিত বিতর্কসমূহ বিশ্লেষণও করেন। এই বিষয়ের ওপর তাঁর লেখালেখি এটি স্পষ্টায়িত করে যে ঐ বিতর্কসমূহে অংশগ্রহণে তিনি নিজে যথেষ্ট তথ্যাভিজ্ঞ ছিলেন। তখন থেকে এঙ্গেলসের কিছু অন্তর্দৃষ্টি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। The Part Played by Labour in the Transition from Ape to Man শিরোনামের নিবন্ধে এঙ্গেলস যুক্তি দেন যে আদি মানবের খাড়া অঙ্গসংস্থিতি তাদের হাতসমূহকে মুক্তি দেয় এবং তাদের হাতিয়ার ব্যবহারকরণের বিকাশে সামর্থ্যবান করে তোলে, এ বিষয়গুলো সংঘটিত হয় বৃহত্তর মস্তিষ্ক বিকাশের পাশাপাশি। বর্তমানে যেটিকে জিন-সংস্কৃতি সহ-বিবর্তন (gene-culture coevolution) ) অভিহিত করা হয়, তার আদি উদাহরণ হিসেবে স্টেফান যে গৌল্ডের (Stephen Jay Gould) মতন বিজ্ঞানীবৃন্দ এই ধারণাটির প্রশংসা করেছেন।
যাহোক, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাটি বিতর্কিত থেকে যায়। এটি এই ঘটনা দিয়ে সহায়তাকৃত হয়নি যে এঙ্গেলস যথেষ্ট আয়ুষ্কাল পাননি বই লেখাটি শেষকরণে অথবা তাঁর প্রকল্পটির সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তি বা প্রমাণ উত্থাপনে। ১৮৮৩এর মার্চে কার্ল মার্কস মৃত্যুবরণ করেন। এঙ্গেলস তাঁর নিজের কাজগুলোকে একপাশে রেখে পুঁজির খন্ড ২ ও ৩ প্রকাশকরণের প্রস্তুতির জন্য দুঃসাধ্য কাজটি হাতে নেন। কিন্তু প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার পান্ডুলিপিটি টিকে যায় এবং ১৯২৫এ রুশ ভাষায় ও ১৯৩৯এ ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হয়। ইংরেজী ভার্সনের দায়িত্ব পালন করেন জে বি এস হ্যালডেন। তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। কীভাবে বিবর্তন জেনেটিক্সের সাথে সম্পর্কিত, এই বিষয়টি উপলব্ধির অগ্রগতিতে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন অঙ্গীকারাবদ্ধ (committed) মার্কসবাদী এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর উত্তরোত্তরভাবে অধিকতর প্রত্যয় দীপ্ত হন তাঁর সারা জীবনে। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ভূমিকা বইটিতে তিনি তাঁর মুখবন্ধে যুক্তি দেন যে এটি যদি পূর্বে প্রকাশিত হতো তাহলে এই বইটি তাঁকে অনেক বিশৃঙ্খল চিন্তা থেকে রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু এঙ্গেলসের কাজটি প্রকাশকরণ কোনো সহজ কর্ম (task) ছিল না। এটি ছিল মূলত এক সারি নোটের সমাহার। এঙ্গেলসের হয়তো অভিপ্রায় ছিলো এই কাজটির কোনো কোনো অংশের সম্পাদনাকরণ অথবা ত্যাগকরণ।
প্রকৃতিকে দ্বান্দ্বিক হিসেবে অভিহিতকরণ কী কেজো?
এঙ্গেলসের ধারণাবলীর কোনো উৎকর্ষতা আছে কিনা তা আলোচনা করতে হলে, দ্বান্দ্বিকতা কী এবং কিসে এটি ব্যবহারের জন্য প্রত্যাশিত- এগুলো সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদি এটি কেবল বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য হয়, তবে দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কিত শিক্ষা সামান্যই মনোযোগ দাবী করতে পারে, যদি আমরা এটি সম্পর্কে পুস্তকে ও সম্মেলনে শিখি কিন্তু তার পর মুহুর্তে এটি ভুলে যাই কারণ দৈনন্দিন অনুশীলনের সাথে এটির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। মার্কস পুঁজির afterword-এ একমত হন যে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা মূলত দুনিয়া পরিবর্তন প্রত্যাশি মানুষদের জন্য একটি দর্শন। এটি সারবস্তুর দিক থেকে সমালোচনামূলক ও বিপ্লবী (critical and revolutionary। জার্মান ভাববাদী দার্শনিক গিয়র্গ হেগেলের ধারণাবলীকে মার্কস তাঁর ধারণাবলীর অনেকটারই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী আন্দোলনসমূহের জন্য হেগেল তাঁর সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেন, বিশেষত তাঁর জীবনের শেষের দিকে। যাহোক, আমি যুক্তি দিতে চাই যে দ্বান্দ্বিকতার বস্তুবাদী ও মার্কসবাদী ভার্সনকে যখন বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রকল্পের কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয় কেবলমাত্র তখনই এটি অর্থবহ হয়।
অনেক তাত্ত্বিকদের জন্য দ্বান্দ্বিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবর্তন ও দ্বন্দ্ব (change and contradiction)। নিয়ত পরিবর্তনশীল দুনিয়ার প্রকৃতিকে অনুধাবনে এটি অনুমোদন দেয়, জন মোলিনিয়াক্স (John Molyneux) এই বৈশিষ্ট্যসূচক উপাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে মার্কসবাদ দর্শনের সাম্প্রতিক পাঠে এটিকে বিষয়বস্তু হিসেবে নেন। দ্বান্দ্বিকতাকে একটি সমালোচনামূলক দর্শন (critical philosophy) বলা যেতে পারে, কারণ আমাদের দুনিয়াটা একই রকম রয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অপরিবর্তিত থেকে যাবে- এই ধারণাটিকে এই দর্শন প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু এটি আরো যুক্তি দেয় যে পরিবর্তন সবসময় ক্রমিক (gradual) নয়, বিষয়াবলীর উন্নতি ঘটতে পারে লাফিয়ে লাফিয়ে, যাকে আমরা অভিহিত করি বিপ্লবী পরিবর্তন হিসেবে। Dance of the Dialectic গ্রন্থটিতে বারটেল ওলমান (Bertell Ollman) দুনিয়াটাকে বুঝতে পছন্দ করেন চলন্ত গাড়িতে লাফ দেবার প্রচেষ্টা হিসেবে। যদি আপনার চোখ বাঁধা থাকে এবং আপনি যদি না জানেন গাড়িটি কোনদিকে এবং কত দ্রুত যাচ্ছে, তবে কী আপনি চলন্ত গাড়িতে লাফ দিতে চেষ্টা করবেন। ওলমান যুক্তি দেন যে আমাদের চারপাশে দুনিয়াটায় পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে এবং আমাদের সেই তত্ত্বের দরকার যেটি এই পরিবর্তন বুঝতে পারে। অধিকাংশ সূত্রাবলী শুরু থেকে এটা অবধারিত মনে করে যে আমরা দুনিয়াটা দেখা শুরু করতে পারি যেন এটা স্থির (static) এবং তারপর আমাদের দেখা যেকোন পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করতে পারি। দ্বান্দ্বিক চিন্তকদের জন্য এর বিপরীতটাই সত্য। পরিবর্তন হচ্ছে ব্রহ্মান্ডের default অবস্থা। এটি স্থিতি (stasis) যেটি অস্বাভাবিক এবং যার ব্যাখ্যা দরকার।
মার্কসবাদী ভূগোলবিদ ডেভিড হারভে কয়েক বছর ধরেই যুক্তি দেন যে একজন সামাজিক তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি তাঁর গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন তাহলো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। হারভের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্ভবত সবচেয়ে সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এটি কী নয় তা পর্যবেক্ষণে। তিনি কার্টেসিয় reductionism-এর বিরোধীতা করেন, যার ভিত্তি হলো এটাকে সত্য বলে ধরে নেয়া যে আমরা দুনিয়াটা অধ্যয়ন করতে পারি এটিকে পৃথক বস্তুসমূহে বিভক্ত করে। কার্টেসিয়ানগণ যুক্তি দেন যে অংশসমূহের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে, যা সমগ্র (whole) থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান। আমরা প্রত্যেকটি অংশকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি এবং তারপর পর্যবেক্ষণ করি তারা কীভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং কার্টেসিয় ভিত্তিতে নগরসমূহের উপলব্ধিতে একজন ভূগোলবিদ লন্ডনের দিকে তাকাতে পারে (সম্ভবত M25 সড়ক পথের নাগালে মধ্যকার সবকিছু সংজ্ঞায়িত হিসেবে)। তাঁরা জিজ্ঞেস করতে পারে লন্ডনে কারা বসবাস করে, তারা কী ধরণের বাড়িতে বসবাস করে, নগরীর বিভিন্ন অংশে কী ধরণের শিল্পকারখানা বিদ্যমান এবং অন্য অনেক প্রশ্নাদি। অন্য আর এক নগরীর ক্ষেত্রে তারা একই কাজ করতে পারে, হতে পারে তা নিউইয়র্ক নগরী। একবার কেবলমাত্র তারা প্রত্যেকটি নগরীর বৈশিষ্ট্যাবলী পৃথক সত্ত্বা হিসেবে বুঝলে তখন তারা দুটি নগরীর তুলনার প্রচেষ্টা নিতে পারে।
একজন দ্বান্দ্বিক চিন্তক তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রক্রিয়াসমূহের ওপর যেগুলো ঐ নগরীসমূহকে গঠন করে, যেমন নগরীসমূহের দিকে বা থেকে অভিবাসন, অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন এই উভয় দেশে নয়া উদারনীতিবাদের বৃদ্ধির মতন প্রক্রিয়াগুলোতে। তখন নগরগুলোকে বিযুক্ত সত্ত্বা (discrete things) হিসেবে গণ্য না করে প্রক্রিয়াসমূহের জটিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর প্রেক্ষাপট হিসেবের মধ্যে না নিয়ে কোনো নগরকে আমরা বিবেচনা করতে পারি কিনা- হারভের চিন্তাধারার পদ্ধতি এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নগরগুলোর অভ্যন্তরস্থিত অভিবাসীদের পর্যবেক্ষণ করতে হলে আমাদের বোঝা দরকার যে নগরের বাইরে যে জায়গাগুলো থেকে অভিবাসীগণ আসছে সেখানে কী সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু এটি নগরগুলোর মধ্যকার সাদৃশ্যাবলীর দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং লন্ডন ও নিউইয়র্ক এই উভয় নগরে অভিবাসন উভয়কে একই পদ্ধতিতে প্রভাবিত করে থাকতে পারে।
হারভের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (dialectical approach) আমাদের চিন্তনের সাধারণ কান্ডজ্ঞান পদ্ধতিকে মাথার ওপর স্থাপন করে। তিনি কার্যকরভাবে বলেন যে বস্তু (thing) হিসেবে এমন কোনো বস্তু নেই। কঠিন বস্তু হিসেবে আমরা যেগুলোকে মনে করি তা প্রকৃতপক্ষে প্রক্রিয়াসমূহের তৈরী। বিভিন্ন প্রক্রিয়াসমূহ সাময়িকভাবে একত্রিত হয়ে বস্তুসমূহ উৎপন্ন করতে পারে, কিন্তু এগুলো সবসময় ক্ষণস্থায়ী। বস্তুসমূহ সবসময় সৃষ্টি বা ধ্বংস প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান থাকে। যা কিছু কঠিন তা বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বস্তু হতে পারে একটি ভাব বা ধারণা (idea or concept) বা একটাকিছু যা মূর্তভাবে অস্তিত্বমান থাকে একটি নগরের মতন। এঙ্গেলসও তাঁর Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosphy প্রবন্ধে অনুরূপ কিছু একটা যুক্তি দেন: দুনিয়াটাকে তৈরী (ready-made) বস্তুসমূহের জটিল হিসেবে উপলব্ধি না করে বরং প্রক্রিয়াসমূহের জটিল হিসেবে গণ্য করতে হবে, যাতে বস্তুসমূহ অস্তিত্বমান হওয়া এবং বিলয় হওয়ার একটি বাধাহীন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।
মার্কসের জন্য, এবং তাঁর অনুসারীদের অনেকের জন্য, দ্বান্দ্বিকতা হলো একই সাথে দ্বন্দ্ব (contradiction) এবং পরিবর্তন (change)। এই দুটি সম্পর্কিত, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বনিচয় পরিবর্তনকে সম্মুখবর্তী করে এবং গতিময়তার (dynamism) দিকে ধাবিত করে, যেটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে সবকিছু মনে হয় দ্বন্দ্বাত্মক (contradictory)। যাহোক, হারভে যুক্তি দেন যে দ্বন্দ্বসমূহের আলোকে চিন্তন (thinking) তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যদি বস্তুনিচয় প্রক্রিয়াসমূহের ধাপান্তরিত জটিলসমূহ (shifting complexes of processes) দিয়ে তৈরী হয়, তবে এটি কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় যে ঐ প্রক্রিয়াসমূহের কতগুলো পরস্পর বিরোধী হবে। ব্রিটেনের লেবার পার্টি উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। এটি একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল, কিন্তু প্রধাণত শ্রমিক শ্রেণীর সদস্যতা বজায় রাখে। এটিকে বুর্জোয়া শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণীর দল বলা হলো একটি দ্বন্দ্বাত্মক বিষয় বলার মতন শোনায়। এর কারণ হলো এটি একটি দ্বন্দ্বকে নির্দেশ করে। প্রধান কাজ হলো বহুমাত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের দিকে নজর দেয়া যেটি লেবার পার্টির অস্তিত্বমান হওয়ার কারণ। একটা সময় পুঁজির একটি অংশের নিকট কল্যাণ রাষ্ট্র বর্ধিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো, একই সময়ে শ্রমিক জনগণ সংস্কারতান্ত্রিক ধারণাবলী ও সংস্কারতান্ত্রিক পার্টিসমূহের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর প্রয়োজনসমূহ এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রয়োজনসমূহ একে অপরের থেকে বিপরীত, কিন্তু ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এগুলো একীভূত হতে সমর্থ হয়েছিল-এই ক্ষেত্রে একটি খুবই সাংঘর্ষিক সংগঠন গড়তে। দ্বন্দ্বের প্রশ্নে এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বন্দ্বাবলীর বাস্তব উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু মূর্ত কৌশলসমূহের অন্বেষণ করে যার সাহায্যে সেগুলো বিকশিত হয়, এবং প্রক্রিয়াসমূহের অন্বেষণ করে যার সাহায্যে বস্তুসমূহ অস্তিত্বমান ও অনস্তিত্বমান হয়। সবকিছুই সাংঘর্ষিক, কিন্তু কেন- এটিা জিজ্ঞাসা না করে সরলভাবে বিবৃতকরণ যথেষ্ট নয়।
দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীগণ
যদি দ্বান্দ্বিকতা মার্কসবাদীদের মানব সমাজ সম্পর্কে কোনোকিছু উপলব্ধিকরণে সাহায্য করে, তবে কী প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জন্য এটি উপযোগী হতে পারে- যে মানুষজন দুনিয়ার একেবারে নানা দিকসমূহ বুঝতে চেষ্টা করেন। খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞানী সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তি দিয়েছেন যে তাঁরা দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান অনুশীলন করছেন, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে। ১৯৮৫এ রিচার্ড লেভিন্স ও রিচার্ড লিয়োন্টিন (Richard Levins and Richard Lewontin) প্রবন্ধসমূহের একটি সংকলন প্রকাশ করেন, এর শিরোনাম ছিল The Dialectical Biologist। উভয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন (এবং এখনও আছেন)। বইটির শিরোনাম থেকে মনে হয়, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন এটা বলা পরিহার করতে চান যে তাঁরা জীববিজ্ঞানে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। এটি জীববিজ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা নয় যেহেতু তাঁরা সেই দার্শনিক নন যারা বাইরে থেকে জীববিজ্ঞানের দিকে অভিগমন করছেন। পরিবর্তে তাঁরা যুক্তি দেন যে তাঁরা একটি পদ্ধতি হিসেবে এটি অভিযোজিত করেছেন এবং জীববিজ্ঞানী হিসেবে এটিকে তাঁদের অনুশীলনে আত্মীকৃত করেছেন। বইটি এঙ্গেলসকে উৎসর্গ করা হয়, যিনি এটিকে অনেক সময় ভুল হিসেবে পেয়েছিলেন কিন্তু যেখানে এটি গুরুত্বাধিকারী সেখানে তিনি এটিকে সঠিকভাবে পেয়েছিলেন। লেভিন্স ও লিয়োন্টিনের সাথে পরিচিত পাঠকবৃন্দ অবগত আছেন যে তাঁদের মধ্যে তাঁদের আগ্রহসমূহের একটি বিস্তৃত পরিসর বিদ্যমান। তাঁরা জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত কিছু পরিসংখ্যানগত পদ্ধতিসমূহের সমালোচনা করেন, যেমন জীববিজ্ঞানীয় নির্ণয়তাবাদ (biological determinism) (এই ধারণা অনুযায়ী মানব আচরণ পুরোপুরি জেনেটিক্সের সাহায্যে ব্যাখ্যাকরণ যোগ্য)। তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ল্যাতিন আমেরিকান অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারসমূহ সমর্থন করেন।
যাহোক, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন কর্তৃক বিকশিত সবথেকে উদ্ভাবনামূলক যুক্তি হলো এই যে বিবর্তনের বিষয়ী ও বিষয় (subject and object) হিসেবে জীবন্ত সত্ত্বার (organism) উল্লেখকরণ। বিশেষভাবে লিয়োন্টিন উল্লেখ করেন যে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের ভেতরে ধ্রুপদী দৃষ্টিভঙ্গি জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখেছে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে শক্তিসমূহের নিষ্ক্রিয় বিষয় (passive objects of forces) হিসেবে। এই শক্তিসমূহ জীবন্ত সত্ত্বার অভ্যন্তরে হতে পারে অথবা বাইরের হতে পারে। ডারউইন জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখেন তাদের পরিবেশের পরিবর্তনসমূহে সাড়া প্রদানকারী হিসেবে। একটি পপুলেশনের মধ্যকার স্বাতন্ত্রিক সদস্যগণের উদ্বর্তনে ও পুনরুৎপাদনে তাদের সামর্থ্য ভিন্ন হতে পারে, কিন্ত এটি পরিবেশ থেকে বহিঃস্থ চাপসমূহ নেয় ঐ রূপভেদের ওপর ক্রিয়াকরণে এবং কোন স্বাতন্ত্রিক সদস্য সবচেয়ে বেশী সফল তা নির্ণয়করণে। ঐ স্বাতন্ত্রিক সদস্যগণ তাদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত করে। যখন বিবর্তনকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তখন সমস্যাসমূহের একটি বিশেষ সেটসহ একটি প্রজাতিকে উপস্থাপনকরণে পরিবেশকে দেখা হয়, যাতে এটি অবশ্যি একটি সমাধান অন্বেষণ করতে পারে ভুল সংশোধন পর্যন্ত একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার (a process of trial and error) মাধ্যমে। উদাহরণ স্বরূপ, কুঁজো তিমির পরিবেশ শীতল এবং পুষ্টিকর ক্রিল ও ছোট মাছ দিয়ে পূর্ণ। এই পরিবেশে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়, এটি এই সমস্যাটি সমাধান করে, হিমশীতল পানিতে বেঁচে থাকতে এর চর্বি, একটি বিশাল মুখ এবং এর খাদ্য গ্রহণরে জন্য চিত্তাকর্ষী টেকনিকসমূহের বিকাশ ঘটে। বিশাল, শীতল পানিতে সন্তরণরত ক্রিল ভক্ষকের কাজকে বাস্তুসংস্থানবিদগণ উপযোগী বলে নির্দেশ করেন।
যেখানে বাইরে থেকে তাদের ওপর ক্রিয়ারত শক্তিসমূহে সাড়া দিতে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখে ডারউইনবাদীগণ, সেই ক্ষেত্রে জিনগত নির্ণায়কবাদীগণ অন্য দিক থেকে দেখে। তাঁরা যুক্তি দেন যে উদ্ভিদ ও প্রাণিগণ তাদের জিন থেকে উৎসারিত অভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহে সাড়া দেয়। রিচার্ড ডাউকিনস জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে বারংবার তুলনা করেন রোবটের সাথে: আমরা উদ্বর্তন মেশিন - রোবট যান, জিন নামে পরিচিত স্বার্থপর অণুসমূহের সংরক্ষণে অন্ধভাবে প্রোগামকৃত। জীববিজ্ঞানের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানুষ সহ জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ বিকশিত হয় একটি পূর্বনির্ধারিত পথ ধরে, যেটি ঠিক হয় আমাদের জিনসমূহে কোডকৃত তথ্য দিয়ে।
এটি বলা যায় না যে উভয় দৃষ্টিভঙ্গি ভুল, অথবা তারা একে অপরের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। ডাউকিনস সঙ্গতিপূর্ণভাবে সৃষ্টিবাদীদের বিপক্ষে বিবর্তনকে সমর্থন করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উভয় দৃষ্টিভঙ্গির, একটি বাইরের নিয়ামকসমূহের ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং অপরটি অভ্যন্তীরণ নিয়ামকসমূহে গুরুত্বারোপ করে, এর অর্থ ছবির কেবলমাত্র অংশবিশেষের ওপর দৃষ্টি আরোপকরণ। লেভিন্স ও লিয়োন্টিন যুক্তি দেন যে জীবন্ত সত্ত্বা স্বয়ং এর বিবর্তনে যে ভুমিকাটি পালন করে, তা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ অগ্রাহ্য করে। জীবন্ত সত্ত্বাকে দেখা হয় একটি নিষ্ক্রিয় অবস্থা হিসেবে যাতে জিনসমূহ এবং পরিবেশ পরস্পরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে। দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে একটি জীবন্ত সত্ত্বাও, এক অর্থে, কেবলমাত্র বিষয় (object) নয়, সাথে সাথে এর নিজের বিবর্তনের বিষয়ীও (subject) বটে। তাদের সন্নিহিত প্রতিবেশের কোন দিকগুলো সবথেকে প্রাসঙ্গিক তা নির্ণয় করে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তার নিজের চারপাশে একটি উপযোগী অবস্থা নির্দিষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, কাঠঠোকরা একটি গাছের বাকলকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে আবিষ্কার করে, গাছের তলায় অবস্থিত পাথরসমূহকে নয়। অন্য পাখিসমূহ যারা ঐ পাথরসমূহ ব্যবহার করে শামুকের খোলস চূর্ণকরণে, তারা গাছের তলাকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে দেখে এবং তাদেরকে তাদের পরিবেশের অংশ হিসেবে গণ্য করে। জীবন্ত সত্ত্বার অনুপস্থিতিতে একটি উপযোগী অবস্থাই বা কি যাতে এটি বসবাস করে তা আমরা জানতে পারিনে। কোনো কিছুর জন্য কখনো কাজের শূন্যতা (job vacancy) ছিল না, যেটি শীতল পানিতে বসবাস করে কেবলমাত্র তার জায়গা পূরণে কুঁজো তিমির উদ্বর্তনের জন্য। ঐ উপযোগী অবস্থা বিকশিত হয় তিমির বিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে।
লেভিন্স ও লিয়োন্টিন অসংখ্য পদ্ধতির উদাহরণসমূহের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যেগুলোতে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তাদের পরিবেশের ওপর ক্রিয়া করে এবং এমনকি এর প্রতি যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিবরসমূহ তাদের নিজেদের জন্য তাদের সন্নিহিত প্রতিবেশ অধিকতর বসবাসযোগ্য করতে বাঁধ তৈরী করে। উদ্ভিদের শেকড়সমূহ চারপাশের মাটির সংযুক্তি পরিবর্তন করে যাতে তারা পুষ্টি উপাদানসমূহ অধিকতর সহজে সংগ্রহ (extract) করতে পারে। জীবন্ত বস্তুসমূহ দৃষ্টিআকর্ষক স্কেলে গ্রহের পরিবর্তন সংঘটিত করেছে, এমনকি অক্সিজেন যোগ করে বায়ুমন্ডলকে একমুখীভাবে (irreversibly) পরিবর্তন করছে। আমরা স্রেফ এমন বিষয় (object) নই যে কবলমাত্র বাহ্যিক শক্তিসমূহ দ্বারা সক্রিয়কৃত হবো। যে সমস্ত উপায়ে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্কিত, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন সেগুলো গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ব্যতিরেকে জীবন্ত সত্ত্বা অথবা পরিবেশকে উপলব্ধি করা যায় না। এটি সরাসরি কার্টেসিয় দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত, যেটি জীবন্ত সত্ত্বাকে বিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করে। অধিকন্তু, জীবন্ত সত্ত্বার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ক বিকশিত হয় সময়ের মাধমে। পশু ও উদ্ভিদের ইতিহাস বিদ্যমান।
যে প্রক্রিয়াসমূহ মসৃণ ও ক্রমান্বয়িক পদ্ধতির পরিবর্তে বরং অসাংলগ্নিকভাবে (disjointed) বিকশিত হয়, সেগুলোতে স্টেফান জে গৌল্ড ও নাইলস ইলড্রেজ (Stephen Jay Gould and Niles Eldredge) প্রক্রিয়াসমূহের দ্বান্দ্বিক উপলব্ধি প্রয়োগ করেন। তাঁদের সবিরাম সাম্যাবস্থার (punctuated equilibrium) তত্ত্বে বিবর্তনকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয় স্থিতির (stasis) দীর্ঘকালিন যুগ হিসেবে, যেটি বৈচিত্রায়িত হয় দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা, যাতে নয়া প্রজাতিসমূহের দ্রুত উদ্ভব ঘটে। গৌল্ড স্বীকার করেন যে মার্কসিয় দর্শন দ্বারা তত্ত্বটি প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং তিনি যুক্তি দেন যে অধিকতর গুরুত্বের সাথে পাশ্চাত্যের পন্ডিতবৃন্দ কর্তৃক দ্বান্দ্বিক চিন্তন গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু ক্রমিকতা ও উল্লম্ফন সম্পর্কে (gradualness and leaps) সবিরাম সাম্যাবস্থা ও দ্বান্দ্বিক অন্তর্দৃষ্টিসমূহের মধ্যেকার সাদৃশ্য সত্ত্বেও এটি একটি তত্ত্ব হিসেবে উল্লেখনীয়রূপে টিকে আছে। স্টেভেন রোজ একজন নিউরোবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞান দর্শনের ওপর একজন জনপ্রিয় লেখক, তিনি তাঁর উপর প্রভাবদায়ী তত্ত্বসমূহের মধ্যে দ্বান্দ্বিক ঐতিহ্যকে উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তি দেন যে ব্যাবস্থাটির প্রত্যেকটি অংশকে বিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণে জটিল ব্যবস্থাসমূহে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যাবলী ব্যাখ্যা করা যায় না । হার্ভের মতন দ্বান্দ্বিক চিন্তকগণের কিছু অন্তর্দৃষ্টির সাথে তাঁর যুক্তির সাযুজ্য বিদ্যমান।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার বিপক্ষে যুক্তিসমূহ
যাহোক, সকল মার্কসবাদীগণ এই ধারণাটি গ্রহণ করেননি যে জীববিজ্ঞানীগণ যেভাবে ব্যাখ্যা করেন সেভাবে প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াসমূহ বিদ্যমান। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রথম প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে বিষয়টির ওপর এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ বিতর্ক আকর্ষণ করেছে। শত্রুবৃন্দ ও বন্ধুত্বের ভানকারী অনেকেই বিকৃতি সাধন করেন তাঁর ধারণাবলীর। সম্ভবতঃ সংশয়ের আংশিক কারণ হলো এঙ্গেলস কর্তৃক দ্বান্দ্বিকতার তিনটি নিয়মের সূত্রায়ন। এই নিয়মগুলো মূলত জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের নিকট থেকে এঙ্গেলস ধার করেছিলেন সম্ভবত সামাজিক দুনিয়া ও প্রাকৃতিক জগতের প্রক্রিয়াসমূহ বর্ণনাকরণে। নিয়মগুলো হলো: বিপরীতসমূহের আন্তরঅনুপ্রবেশ (the interpenetration of opposites), পরিমাণগত পরিবর্তনের গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর (transformation of quantity to quality) এবং নেতির নেতিকরণ (the negation of the negation)। আমরা প্রায়ই বিজ্ঞান ও প্রকৃতি থেকে দৃষ্টান্তসমূহ ব্যবহার করি এই নিয়মত্রয় ব্যাখ্যাকরণে। পরিমাণগত পরিবর্তনের গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর- এই নিয়মটির জন্য মানুষজন যে দৃষ্টান্তটি প্রায়ই উল্লেখ করেন তাহলো এই যে পানির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্র্রী সেলসিয়াসে উন্নীত হলে এটির বাষ্পে রূপান্তর। তাপমাত্রার পরিমাণগত পরিবর্তন এক ভৌত অবস্থা থেকে অপর ভৌত অবস্থার পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। আর একটি দৃষ্টান্ত হলো মুরগী ও ডিম প্রসঙ্গে। যখন একটি মুরগীর বাচ্চা ডিম থেকে ফুটে বের হয়, তখন এটি ঐ ডিমকে ধ্বংস করে, অর্থাৎ এটির নেতিকরণ সংঘটিত করে। কিন্তু বড় হয়ে মুরগীতে পরিণত হয়ে মুরগীর বাচ্চার নেতিকরণ সংঘটিত হয়, এটি হলো নেতির নেতিকরণ।
এই সুনির্দিষ্ট উদাহরণসমূহ আমরা নির্বাচন করি এটি অবধারিত মনে করতে যে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াসমূহ প্রকৃতিতে অস্তিÍত্বমান। কিন্তু অনেক মার্কসবাদী ভাষ্যকার এই অনুমানকে প্রত্যাখ্যান করেন। এর কিছু উদাহরণসমূহের গতানুগতিকতা
মূল: ক্যামিলা রয়োল অনুবাদ: স ম আজাদ
অনুবাদকের উৎসর্গ: প্রিয় ছাত্র এবং প্রিয় বন্ধু খন্দকার তুষার আহমেদ জাভেদ ও সুবল সূত্রধরকে
১৮৭৩এ কার্ল মার্কসের সহযোগী ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা শিরোনামে একটি উচ্চাভিলাষী গ্রন্থের ওপর কাজ আরম্ভ করেন। তিনি মার্কসকে একটি চিঠিতে অভিহিত করেন কীভাবে, একদিন বিছানায় শায়িত অবস্থায় তিনি উপসংহারে উপনীত হন যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ হলো প্রকৃতপক্ষে সবকিছুই গতিময় বস্তু (matter in motion) সম্পর্কে। তিনি তাঁর বন্ধুকে ধারণাটি সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতেও বলেন যেন কোনো বাজে ইংরেজ ব্যক্তি এটি চুরি করতে না পারে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তাঁর নিজের ব্যাপক গবেষণায় মার্কসিয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে এঙ্গেলস সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেন। তাঁর ধারণাবলী লেখার প্রকল্পটি তিনি পরবর্তী দশক পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন, কিন্তু সম্পূর্ণকরণের সুযোগ শেষ পর্যন্ত তিনি কখনো পাননি।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাটি অদ্যবধি বিতর্কিত থেকে গিয়েছে। সমাজ অধ্যয়নে প্রয়োগকৃত হিসেবে, দ্বান্দ্বিকতা আপত্তিকৃত, দ্বান্দ্বিকতা কী - এর বহুবিধ ব্যাখ্যা এবং কীসের জন্য এটি প্রয়োগকৃত হওয়ার জন্য প্রত্যাশিত- এগুলো সহকারে। কিন্তু বহু তত্ত্ববিদ যারা দ্বান্দ্বিকভাবে মানব সমাজের উপলব্ধির পক্ষে, তাঁরা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে এটি প্রকৃতিতেও প্রয়োগযোগ্য। মার্কসবাদ কী ধরনের দর্শন এবং এটি আমাদের বাসকৃত দুনিয়ার অধিক মৌলিক দিকসমূহ উপলব্ধিতে সহায়তা করতে পারে কিনা- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো অধিক প্রশ্নমালা উত্থাপিত হয় প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কিত বিতর্কগুলোতে। এটি আরো নির্ভর করে প্রকৃতি দ্বারা আমরা কী অর্থ করি -এ বিষয়টি ঠিক দ্বান্দ্বিকতার মতই বিতর্কিত।
এঙ্গেলস ও ঊনিশ শতকের বিজ্ঞান
এঙ্গেলস নিশ্চিতভাবে তাঁর (বা যে কোনো) যুগের সবথেকে স্ব-শিক্ষিত মনিষীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি নিজেকে কেবলমাত্র সামাজিক বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে শিক্ষিত করেননি সঙ্গে সঙ্গে নৃবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও শিল্পকলা সম্পর্কেও শিক্ষিত করেছিলেন। তিনি এমন একটা যুগে বসবাস করছিলেন যখন এইসব ক্ষেত্রের সবগুলোতে বিপ্লবী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখ্য ১৮৫৯এ চার্লস ডারইউনের On the Origin of Speciesএর প্রকাশনা, এতে তিনি দেখান যে প্রাণিজ সত্ত্বাসমূহের প্রজাতিগুলো (organisms of species) অনড় ও পৃথকায়িত অস্তিত্ব নয়, বরং এগুলো নয়া ও র্যাড্যিালগতভাবে পৃথক রূপসমূহে বিকশিত হতে সমর্থ। মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনেই ডারইউনের লেখাটি পড়েন এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির ধারণার প্রমাণ হিসেবে এটিকে দেখেন- কমপক্ষে মানব সমাজসমূহের ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের ধারণার (conception) অনুরূপ হিসেবে তো বটেই।
কিন্তু এটা কেবলমাত্র জীববিজ্ঞানই নয় যেটি ঊনিশ শতকে বিপ্লবায়িত হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে জেমস প্রেসকট জুল দেখান যে তাপকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে এবং এর বিপরীত প্রক্রিয়াটিও সংঘটিত করা যায়। ভূূতত্ত্ব বিদ্যায় চার্লস লয়েল পৃথিবীর কঠিন আবরণের (earth crust) ভেতরে স্তরসমূহের ধারাবাহিক সৃজন ও ধ্বংস প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। এ্যালেক্স ক্যালিনিকোস যুক্তি দেন যে এঙ্গেলসের অন্তর্দৃষ্টি অবশ্যি দেখতে হবে যখন তিনি লিখছিলেন সেই সময়ে ভৌত বিজ্ঞানে সংঘটিত আদত বিকাশাবলীর প্রেক্ষাপটে। নিউটনের সূত্রাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত মডেলের ওপর ভিত্তি করে আগে বিজ্ঞানকে দেখা হতো-যেখানে যান্ত্রিক প্রক্রিয়াবলী সময়ের প্রেক্ষাপটে উভমুখী। ঊনিশ শতকে বিজ্ঞান বিবর্তনের মতন একমুখী প্রক্রিয়াসমূহের ওপর মনোযোগ দেয়া শুরু করে যেখানে প্রকৃতি কেবলমাত্র পরিবর্তিত হয় না সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়।
বিজ্ঞানীদের এবং সমাজে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের আরো উপলব্ধিতে মার্কসবাদ সহায়তা করেছে। এঙ্গেলস কেবলমাত্র বিজ্ঞানের সামাজিক অবস্থানেই আগ্রহী ছিলেন না- তিনি বিজ্ঞানের অভ্যন্তরস্থিত বিতর্কসমূহ বিশ্লেষণও করেন। এই বিষয়ের ওপর তাঁর লেখালেখি এটি স্পষ্টায়িত করে যে ঐ বিতর্কসমূহে অংশগ্রহণে তিনি নিজে যথেষ্ট তথ্যাভিজ্ঞ ছিলেন। তখন থেকে এঙ্গেলসের কিছু অন্তর্দৃষ্টি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। The Part Played by Labour in the Transition from Ape to Man শিরোনামের নিবন্ধে এঙ্গেলস যুক্তি দেন যে আদি মানবের খাড়া অঙ্গসংস্থিতি তাদের হাতসমূহকে মুক্তি দেয় এবং তাদের হাতিয়ার ব্যবহারকরণের বিকাশে সামর্থ্যবান করে তোলে, এ বিষয়গুলো সংঘটিত হয় বৃহত্তর মস্তিষ্ক বিকাশের পাশাপাশি। বর্তমানে যেটিকে জিন-সংস্কৃতি সহ-বিবর্তন (gene-culture coevolution) ) অভিহিত করা হয়, তার আদি উদাহরণ হিসেবে স্টেফান যে গৌল্ডের (Stephen Jay Gould) মতন বিজ্ঞানীবৃন্দ এই ধারণাটির প্রশংসা করেছেন।
যাহোক, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাটি বিতর্কিত থেকে যায়। এটি এই ঘটনা দিয়ে সহায়তাকৃত হয়নি যে এঙ্গেলস যথেষ্ট আয়ুষ্কাল পাননি বই লেখাটি শেষকরণে অথবা তাঁর প্রকল্পটির সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তি বা প্রমাণ উত্থাপনে। ১৮৮৩এর মার্চে কার্ল মার্কস মৃত্যুবরণ করেন। এঙ্গেলস তাঁর নিজের কাজগুলোকে একপাশে রেখে পুঁজির খন্ড ২ ও ৩ প্রকাশকরণের প্রস্তুতির জন্য দুঃসাধ্য কাজটি হাতে নেন। কিন্তু প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার পান্ডুলিপিটি টিকে যায় এবং ১৯২৫এ রুশ ভাষায় ও ১৯৩৯এ ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হয়। ইংরেজী ভার্সনের দায়িত্ব পালন করেন জে বি এস হ্যালডেন। তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। কীভাবে বিবর্তন জেনেটিক্সের সাথে সম্পর্কিত, এই বিষয়টি উপলব্ধির অগ্রগতিতে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন অঙ্গীকারাবদ্ধ (committed) মার্কসবাদী এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর উত্তরোত্তরভাবে অধিকতর প্রত্যয় দীপ্ত হন তাঁর সারা জীবনে। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ভূমিকা বইটিতে তিনি তাঁর মুখবন্ধে যুক্তি দেন যে এটি যদি পূর্বে প্রকাশিত হতো তাহলে এই বইটি তাঁকে অনেক বিশৃঙ্খল চিন্তা থেকে রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু এঙ্গেলসের কাজটি প্রকাশকরণ কোনো সহজ কর্ম (task) ছিল না। এটি ছিল মূলত এক সারি নোটের সমাহার। এঙ্গেলসের হয়তো অভিপ্রায় ছিলো এই কাজটির কোনো কোনো অংশের সম্পাদনাকরণ অথবা ত্যাগকরণ।
প্রকৃতিকে দ্বান্দ্বিক হিসেবে অভিহিতকরণ কী কেজো?
এঙ্গেলসের ধারণাবলীর কোনো উৎকর্ষতা আছে কিনা তা আলোচনা করতে হলে, দ্বান্দ্বিকতা কী এবং কিসে এটি ব্যবহারের জন্য প্রত্যাশিত- এগুলো সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদি এটি কেবল বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য হয়, তবে দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কিত শিক্ষা সামান্যই মনোযোগ দাবী করতে পারে, যদি আমরা এটি সম্পর্কে পুস্তকে ও সম্মেলনে শিখি কিন্তু তার পর মুহুর্তে এটি ভুলে যাই কারণ দৈনন্দিন অনুশীলনের সাথে এটির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। মার্কস পুঁজির afterword-এ একমত হন যে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা মূলত দুনিয়া পরিবর্তন প্রত্যাশি মানুষদের জন্য একটি দর্শন। এটি সারবস্তুর দিক থেকে সমালোচনামূলক ও বিপ্লবী (critical and revolutionary। জার্মান ভাববাদী দার্শনিক গিয়র্গ হেগেলের ধারণাবলীকে মার্কস তাঁর ধারণাবলীর অনেকটারই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী আন্দোলনসমূহের জন্য হেগেল তাঁর সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেন, বিশেষত তাঁর জীবনের শেষের দিকে। যাহোক, আমি যুক্তি দিতে চাই যে দ্বান্দ্বিকতার বস্তুবাদী ও মার্কসবাদী ভার্সনকে যখন বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রকল্পের কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয় কেবলমাত্র তখনই এটি অর্থবহ হয়।
অনেক তাত্ত্বিকদের জন্য দ্বান্দ্বিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবর্তন ও দ্বন্দ্ব (change and contradiction)। নিয়ত পরিবর্তনশীল দুনিয়ার প্রকৃতিকে অনুধাবনে এটি অনুমোদন দেয়, জন মোলিনিয়াক্স (John Molyneux) এই বৈশিষ্ট্যসূচক উপাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে মার্কসবাদ দর্শনের সাম্প্রতিক পাঠে এটিকে বিষয়বস্তু হিসেবে নেন। দ্বান্দ্বিকতাকে একটি সমালোচনামূলক দর্শন (critical philosophy) বলা যেতে পারে, কারণ আমাদের দুনিয়াটা একই রকম রয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অপরিবর্তিত থেকে যাবে- এই ধারণাটিকে এই দর্শন প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু এটি আরো যুক্তি দেয় যে পরিবর্তন সবসময় ক্রমিক (gradual) নয়, বিষয়াবলীর উন্নতি ঘটতে পারে লাফিয়ে লাফিয়ে, যাকে আমরা অভিহিত করি বিপ্লবী পরিবর্তন হিসেবে। Dance of the Dialectic গ্রন্থটিতে বারটেল ওলমান (Bertell Ollman) দুনিয়াটাকে বুঝতে পছন্দ করেন চলন্ত গাড়িতে লাফ দেবার প্রচেষ্টা হিসেবে। যদি আপনার চোখ বাঁধা থাকে এবং আপনি যদি না জানেন গাড়িটি কোনদিকে এবং কত দ্রুত যাচ্ছে, তবে কী আপনি চলন্ত গাড়িতে লাফ দিতে চেষ্টা করবেন। ওলমান যুক্তি দেন যে আমাদের চারপাশে দুনিয়াটায় পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে এবং আমাদের সেই তত্ত্বের দরকার যেটি এই পরিবর্তন বুঝতে পারে। অধিকাংশ সূত্রাবলী শুরু থেকে এটা অবধারিত মনে করে যে আমরা দুনিয়াটা দেখা শুরু করতে পারি যেন এটা স্থির (static) এবং তারপর আমাদের দেখা যেকোন পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করতে পারি। দ্বান্দ্বিক চিন্তকদের জন্য এর বিপরীতটাই সত্য। পরিবর্তন হচ্ছে ব্রহ্মান্ডের default অবস্থা। এটি স্থিতি (stasis) যেটি অস্বাভাবিক এবং যার ব্যাখ্যা দরকার।
মার্কসবাদী ভূগোলবিদ ডেভিড হারভে কয়েক বছর ধরেই যুক্তি দেন যে একজন সামাজিক তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি তাঁর গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন তাহলো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। হারভের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্ভবত সবচেয়ে সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এটি কী নয় তা পর্যবেক্ষণে। তিনি কার্টেসিয় reductionism-এর বিরোধীতা করেন, যার ভিত্তি হলো এটাকে সত্য বলে ধরে নেয়া যে আমরা দুনিয়াটা অধ্যয়ন করতে পারি এটিকে পৃথক বস্তুসমূহে বিভক্ত করে। কার্টেসিয়ানগণ যুক্তি দেন যে অংশসমূহের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে, যা সমগ্র (whole) থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান। আমরা প্রত্যেকটি অংশকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি এবং তারপর পর্যবেক্ষণ করি তারা কীভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং কার্টেসিয় ভিত্তিতে নগরসমূহের উপলব্ধিতে একজন ভূগোলবিদ লন্ডনের দিকে তাকাতে পারে (সম্ভবত M25 সড়ক পথের নাগালে মধ্যকার সবকিছু সংজ্ঞায়িত হিসেবে)। তাঁরা জিজ্ঞেস করতে পারে লন্ডনে কারা বসবাস করে, তারা কী ধরণের বাড়িতে বসবাস করে, নগরীর বিভিন্ন অংশে কী ধরণের শিল্পকারখানা বিদ্যমান এবং অন্য অনেক প্রশ্নাদি। অন্য আর এক নগরীর ক্ষেত্রে তারা একই কাজ করতে পারে, হতে পারে তা নিউইয়র্ক নগরী। একবার কেবলমাত্র তারা প্রত্যেকটি নগরীর বৈশিষ্ট্যাবলী পৃথক সত্ত্বা হিসেবে বুঝলে তখন তারা দুটি নগরীর তুলনার প্রচেষ্টা নিতে পারে।
একজন দ্বান্দ্বিক চিন্তক তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রক্রিয়াসমূহের ওপর যেগুলো ঐ নগরীসমূহকে গঠন করে, যেমন নগরীসমূহের দিকে বা থেকে অভিবাসন, অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন এই উভয় দেশে নয়া উদারনীতিবাদের বৃদ্ধির মতন প্রক্রিয়াগুলোতে। তখন নগরগুলোকে বিযুক্ত সত্ত্বা (discrete things) হিসেবে গণ্য না করে প্রক্রিয়াসমূহের জটিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর প্রেক্ষাপট হিসেবের মধ্যে না নিয়ে কোনো নগরকে আমরা বিবেচনা করতে পারি কিনা- হারভের চিন্তাধারার পদ্ধতি এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নগরগুলোর অভ্যন্তরস্থিত অভিবাসীদের পর্যবেক্ষণ করতে হলে আমাদের বোঝা দরকার যে নগরের বাইরে যে জায়গাগুলো থেকে অভিবাসীগণ আসছে সেখানে কী সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু এটি নগরগুলোর মধ্যকার সাদৃশ্যাবলীর দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং লন্ডন ও নিউইয়র্ক এই উভয় নগরে অভিবাসন উভয়কে একই পদ্ধতিতে প্রভাবিত করে থাকতে পারে।
হারভের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (dialectical approach) আমাদের চিন্তনের সাধারণ কান্ডজ্ঞান পদ্ধতিকে মাথার ওপর স্থাপন করে। তিনি কার্যকরভাবে বলেন যে বস্তু (thing) হিসেবে এমন কোনো বস্তু নেই। কঠিন বস্তু হিসেবে আমরা যেগুলোকে মনে করি তা প্রকৃতপক্ষে প্রক্রিয়াসমূহের তৈরী। বিভিন্ন প্রক্রিয়াসমূহ সাময়িকভাবে একত্রিত হয়ে বস্তুসমূহ উৎপন্ন করতে পারে, কিন্তু এগুলো সবসময় ক্ষণস্থায়ী। বস্তুসমূহ সবসময় সৃষ্টি বা ধ্বংস প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান থাকে। যা কিছু কঠিন তা বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বস্তু হতে পারে একটি ভাব বা ধারণা (idea or concept) বা একটাকিছু যা মূর্তভাবে অস্তিত্বমান থাকে একটি নগরের মতন। এঙ্গেলসও তাঁর Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosphy প্রবন্ধে অনুরূপ কিছু একটা যুক্তি দেন: দুনিয়াটাকে তৈরী (ready-made) বস্তুসমূহের জটিল হিসেবে উপলব্ধি না করে বরং প্রক্রিয়াসমূহের জটিল হিসেবে গণ্য করতে হবে, যাতে বস্তুসমূহ অস্তিত্বমান হওয়া এবং বিলয় হওয়ার একটি বাধাহীন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।
মার্কসের জন্য, এবং তাঁর অনুসারীদের অনেকের জন্য, দ্বান্দ্বিকতা হলো একই সাথে দ্বন্দ্ব (contradiction) এবং পরিবর্তন (change)। এই দুটি সম্পর্কিত, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বনিচয় পরিবর্তনকে সম্মুখবর্তী করে এবং গতিময়তার (dynamism) দিকে ধাবিত করে, যেটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে সবকিছু মনে হয় দ্বন্দ্বাত্মক (contradictory)। যাহোক, হারভে যুক্তি দেন যে দ্বন্দ্বসমূহের আলোকে চিন্তন (thinking) তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যদি বস্তুনিচয় প্রক্রিয়াসমূহের ধাপান্তরিত জটিলসমূহ (shifting complexes of processes) দিয়ে তৈরী হয়, তবে এটি কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় যে ঐ প্রক্রিয়াসমূহের কতগুলো পরস্পর বিরোধী হবে। ব্রিটেনের লেবার পার্টি উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। এটি একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল, কিন্তু প্রধাণত শ্রমিক শ্রেণীর সদস্যতা বজায় রাখে। এটিকে বুর্জোয়া শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণীর দল বলা হলো একটি দ্বন্দ্বাত্মক বিষয় বলার মতন শোনায়। এর কারণ হলো এটি একটি দ্বন্দ্বকে নির্দেশ করে। প্রধান কাজ হলো বহুমাত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের দিকে নজর দেয়া যেটি লেবার পার্টির অস্তিত্বমান হওয়ার কারণ। একটা সময় পুঁজির একটি অংশের নিকট কল্যাণ রাষ্ট্র বর্ধিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো, একই সময়ে শ্রমিক জনগণ সংস্কারতান্ত্রিক ধারণাবলী ও সংস্কারতান্ত্রিক পার্টিসমূহের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর প্রয়োজনসমূহ এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রয়োজনসমূহ একে অপরের থেকে বিপরীত, কিন্তু ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এগুলো একীভূত হতে সমর্থ হয়েছিল-এই ক্ষেত্রে একটি খুবই সাংঘর্ষিক সংগঠন গড়তে। দ্বন্দ্বের প্রশ্নে এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বন্দ্বাবলীর বাস্তব উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু মূর্ত কৌশলসমূহের অন্বেষণ করে যার সাহায্যে সেগুলো বিকশিত হয়, এবং প্রক্রিয়াসমূহের অন্বেষণ করে যার সাহায্যে বস্তুসমূহ অস্তিত্বমান ও অনস্তিত্বমান হয়। সবকিছুই সাংঘর্ষিক, কিন্তু কেন- এটিা জিজ্ঞাসা না করে সরলভাবে বিবৃতকরণ যথেষ্ট নয়।
দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীগণ
যদি দ্বান্দ্বিকতা মার্কসবাদীদের মানব সমাজ সম্পর্কে কোনোকিছু উপলব্ধিকরণে সাহায্য করে, তবে কী প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জন্য এটি উপযোগী হতে পারে- যে মানুষজন দুনিয়ার একেবারে নানা দিকসমূহ বুঝতে চেষ্টা করেন। খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞানী সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তি দিয়েছেন যে তাঁরা দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান অনুশীলন করছেন, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে। ১৯৮৫এ রিচার্ড লেভিন্স ও রিচার্ড লিয়োন্টিন (Richard Levins and Richard Lewontin) প্রবন্ধসমূহের একটি সংকলন প্রকাশ করেন, এর শিরোনাম ছিল The Dialectical Biologist। উভয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন (এবং এখনও আছেন)। বইটির শিরোনাম থেকে মনে হয়, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন এটা বলা পরিহার করতে চান যে তাঁরা জীববিজ্ঞানে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। এটি জীববিজ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা নয় যেহেতু তাঁরা সেই দার্শনিক নন যারা বাইরে থেকে জীববিজ্ঞানের দিকে অভিগমন করছেন। পরিবর্তে তাঁরা যুক্তি দেন যে তাঁরা একটি পদ্ধতি হিসেবে এটি অভিযোজিত করেছেন এবং জীববিজ্ঞানী হিসেবে এটিকে তাঁদের অনুশীলনে আত্মীকৃত করেছেন। বইটি এঙ্গেলসকে উৎসর্গ করা হয়, যিনি এটিকে অনেক সময় ভুল হিসেবে পেয়েছিলেন কিন্তু যেখানে এটি গুরুত্বাধিকারী সেখানে তিনি এটিকে সঠিকভাবে পেয়েছিলেন। লেভিন্স ও লিয়োন্টিনের সাথে পরিচিত পাঠকবৃন্দ অবগত আছেন যে তাঁদের মধ্যে তাঁদের আগ্রহসমূহের একটি বিস্তৃত পরিসর বিদ্যমান। তাঁরা জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত কিছু পরিসংখ্যানগত পদ্ধতিসমূহের সমালোচনা করেন, যেমন জীববিজ্ঞানীয় নির্ণয়তাবাদ (biological determinism) (এই ধারণা অনুযায়ী মানব আচরণ পুরোপুরি জেনেটিক্সের সাহায্যে ব্যাখ্যাকরণ যোগ্য)। তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ল্যাতিন আমেরিকান অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারসমূহ সমর্থন করেন।
যাহোক, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন কর্তৃক বিকশিত সবথেকে উদ্ভাবনামূলক যুক্তি হলো এই যে বিবর্তনের বিষয়ী ও বিষয় (subject and object) হিসেবে জীবন্ত সত্ত্বার (organism) উল্লেখকরণ। বিশেষভাবে লিয়োন্টিন উল্লেখ করেন যে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের ভেতরে ধ্রুপদী দৃষ্টিভঙ্গি জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখেছে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে শক্তিসমূহের নিষ্ক্রিয় বিষয় (passive objects of forces) হিসেবে। এই শক্তিসমূহ জীবন্ত সত্ত্বার অভ্যন্তরে হতে পারে অথবা বাইরের হতে পারে। ডারউইন জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখেন তাদের পরিবেশের পরিবর্তনসমূহে সাড়া প্রদানকারী হিসেবে। একটি পপুলেশনের মধ্যকার স্বাতন্ত্রিক সদস্যগণের উদ্বর্তনে ও পুনরুৎপাদনে তাদের সামর্থ্য ভিন্ন হতে পারে, কিন্ত এটি পরিবেশ থেকে বহিঃস্থ চাপসমূহ নেয় ঐ রূপভেদের ওপর ক্রিয়াকরণে এবং কোন স্বাতন্ত্রিক সদস্য সবচেয়ে বেশী সফল তা নির্ণয়করণে। ঐ স্বাতন্ত্রিক সদস্যগণ তাদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত করে। যখন বিবর্তনকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তখন সমস্যাসমূহের একটি বিশেষ সেটসহ একটি প্রজাতিকে উপস্থাপনকরণে পরিবেশকে দেখা হয়, যাতে এটি অবশ্যি একটি সমাধান অন্বেষণ করতে পারে ভুল সংশোধন পর্যন্ত একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার (a process of trial and error) মাধ্যমে। উদাহরণ স্বরূপ, কুঁজো তিমির পরিবেশ শীতল এবং পুষ্টিকর ক্রিল ও ছোট মাছ দিয়ে পূর্ণ। এই পরিবেশে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়, এটি এই সমস্যাটি সমাধান করে, হিমশীতল পানিতে বেঁচে থাকতে এর চর্বি, একটি বিশাল মুখ এবং এর খাদ্য গ্রহণরে জন্য চিত্তাকর্ষী টেকনিকসমূহের বিকাশ ঘটে। বিশাল, শীতল পানিতে সন্তরণরত ক্রিল ভক্ষকের কাজকে বাস্তুসংস্থানবিদগণ উপযোগী বলে নির্দেশ করেন।
যেখানে বাইরে থেকে তাদের ওপর ক্রিয়ারত শক্তিসমূহে সাড়া দিতে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে দেখে ডারউইনবাদীগণ, সেই ক্ষেত্রে জিনগত নির্ণায়কবাদীগণ অন্য দিক থেকে দেখে। তাঁরা যুক্তি দেন যে উদ্ভিদ ও প্রাণিগণ তাদের জিন থেকে উৎসারিত অভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহে সাড়া দেয়। রিচার্ড ডাউকিনস জীবন্ত সত্ত্বাসমূহকে বারংবার তুলনা করেন রোবটের সাথে: আমরা উদ্বর্তন মেশিন - রোবট যান, জিন নামে পরিচিত স্বার্থপর অণুসমূহের সংরক্ষণে অন্ধভাবে প্রোগামকৃত। জীববিজ্ঞানের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানুষ সহ জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ বিকশিত হয় একটি পূর্বনির্ধারিত পথ ধরে, যেটি ঠিক হয় আমাদের জিনসমূহে কোডকৃত তথ্য দিয়ে।
এটি বলা যায় না যে উভয় দৃষ্টিভঙ্গি ভুল, অথবা তারা একে অপরের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। ডাউকিনস সঙ্গতিপূর্ণভাবে সৃষ্টিবাদীদের বিপক্ষে বিবর্তনকে সমর্থন করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উভয় দৃষ্টিভঙ্গির, একটি বাইরের নিয়ামকসমূহের ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং অপরটি অভ্যন্তীরণ নিয়ামকসমূহে গুরুত্বারোপ করে, এর অর্থ ছবির কেবলমাত্র অংশবিশেষের ওপর দৃষ্টি আরোপকরণ। লেভিন্স ও লিয়োন্টিন যুক্তি দেন যে জীবন্ত সত্ত্বা স্বয়ং এর বিবর্তনে যে ভুমিকাটি পালন করে, তা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ অগ্রাহ্য করে। জীবন্ত সত্ত্বাকে দেখা হয় একটি নিষ্ক্রিয় অবস্থা হিসেবে যাতে জিনসমূহ এবং পরিবেশ পরস্পরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে। দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে একটি জীবন্ত সত্ত্বাও, এক অর্থে, কেবলমাত্র বিষয় (object) নয়, সাথে সাথে এর নিজের বিবর্তনের বিষয়ীও (subject) বটে। তাদের সন্নিহিত প্রতিবেশের কোন দিকগুলো সবথেকে প্রাসঙ্গিক তা নির্ণয় করে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তার নিজের চারপাশে একটি উপযোগী অবস্থা নির্দিষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, কাঠঠোকরা একটি গাছের বাকলকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে আবিষ্কার করে, গাছের তলায় অবস্থিত পাথরসমূহকে নয়। অন্য পাখিসমূহ যারা ঐ পাথরসমূহ ব্যবহার করে শামুকের খোলস চূর্ণকরণে, তারা গাছের তলাকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে দেখে এবং তাদেরকে তাদের পরিবেশের অংশ হিসেবে গণ্য করে। জীবন্ত সত্ত্বার অনুপস্থিতিতে একটি উপযোগী অবস্থাই বা কি যাতে এটি বসবাস করে তা আমরা জানতে পারিনে। কোনো কিছুর জন্য কখনো কাজের শূন্যতা (job vacancy) ছিল না, যেটি শীতল পানিতে বসবাস করে কেবলমাত্র তার জায়গা পূরণে কুঁজো তিমির উদ্বর্তনের জন্য। ঐ উপযোগী অবস্থা বিকশিত হয় তিমির বিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে।
লেভিন্স ও লিয়োন্টিন অসংখ্য পদ্ধতির উদাহরণসমূহের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যেগুলোতে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তাদের পরিবেশের ওপর ক্রিয়া করে এবং এমনকি এর প্রতি যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিবরসমূহ তাদের নিজেদের জন্য তাদের সন্নিহিত প্রতিবেশ অধিকতর বসবাসযোগ্য করতে বাঁধ তৈরী করে। উদ্ভিদের শেকড়সমূহ চারপাশের মাটির সংযুক্তি পরিবর্তন করে যাতে তারা পুষ্টি উপাদানসমূহ অধিকতর সহজে সংগ্রহ (extract) করতে পারে। জীবন্ত বস্তুসমূহ দৃষ্টিআকর্ষক স্কেলে গ্রহের পরিবর্তন সংঘটিত করেছে, এমনকি অক্সিজেন যোগ করে বায়ুমন্ডলকে একমুখীভাবে (irreversibly) পরিবর্তন করছে। আমরা স্রেফ এমন বিষয় (object) নই যে কবলমাত্র বাহ্যিক শক্তিসমূহ দ্বারা সক্রিয়কৃত হবো। যে সমস্ত উপায়ে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ তাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্কিত, লেভিন্স ও লিয়োন্টিন সেগুলো গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ব্যতিরেকে জীবন্ত সত্ত্বা অথবা পরিবেশকে উপলব্ধি করা যায় না। এটি সরাসরি কার্টেসিয় দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত, যেটি জীবন্ত সত্ত্বাকে বিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করে। অধিকন্তু, জীবন্ত সত্ত্বার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ক বিকশিত হয় সময়ের মাধমে। পশু ও উদ্ভিদের ইতিহাস বিদ্যমান।
যে প্রক্রিয়াসমূহ মসৃণ ও ক্রমান্বয়িক পদ্ধতির পরিবর্তে বরং অসাংলগ্নিকভাবে (disjointed) বিকশিত হয়, সেগুলোতে স্টেফান জে গৌল্ড ও নাইলস ইলড্রেজ (Stephen Jay Gould and Niles Eldredge) প্রক্রিয়াসমূহের দ্বান্দ্বিক উপলব্ধি প্রয়োগ করেন। তাঁদের সবিরাম সাম্যাবস্থার (punctuated equilibrium) তত্ত্বে বিবর্তনকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয় স্থিতির (stasis) দীর্ঘকালিন যুগ হিসেবে, যেটি বৈচিত্রায়িত হয় দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা, যাতে নয়া প্রজাতিসমূহের দ্রুত উদ্ভব ঘটে। গৌল্ড স্বীকার করেন যে মার্কসিয় দর্শন দ্বারা তত্ত্বটি প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং তিনি যুক্তি দেন যে অধিকতর গুরুত্বের সাথে পাশ্চাত্যের পন্ডিতবৃন্দ কর্তৃক দ্বান্দ্বিক চিন্তন গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু ক্রমিকতা ও উল্লম্ফন সম্পর্কে (gradualness and leaps) সবিরাম সাম্যাবস্থা ও দ্বান্দ্বিক অন্তর্দৃষ্টিসমূহের মধ্যেকার সাদৃশ্য সত্ত্বেও এটি একটি তত্ত্ব হিসেবে উল্লেখনীয়রূপে টিকে আছে। স্টেভেন রোজ একজন নিউরোবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞান দর্শনের ওপর একজন জনপ্রিয় লেখক, তিনি তাঁর উপর প্রভাবদায়ী তত্ত্বসমূহের মধ্যে দ্বান্দ্বিক ঐতিহ্যকে উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তি দেন যে ব্যাবস্থাটির প্রত্যেকটি অংশকে বিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণে জটিল ব্যবস্থাসমূহে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যাবলী ব্যাখ্যা করা যায় না । হার্ভের মতন দ্বান্দ্বিক চিন্তকগণের কিছু অন্তর্দৃষ্টির সাথে তাঁর যুক্তির সাযুজ্য বিদ্যমান।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার বিপক্ষে যুক্তিসমূহ
যাহোক, সকল মার্কসবাদীগণ এই ধারণাটি গ্রহণ করেননি যে জীববিজ্ঞানীগণ যেভাবে ব্যাখ্যা করেন সেভাবে প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াসমূহ বিদ্যমান। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রথম প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে বিষয়টির ওপর এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ বিতর্ক আকর্ষণ করেছে। শত্রুবৃন্দ ও বন্ধুত্বের ভানকারী অনেকেই বিকৃতি সাধন করেন তাঁর ধারণাবলীর। সম্ভবতঃ সংশয়ের আংশিক কারণ হলো এঙ্গেলস কর্তৃক দ্বান্দ্বিকতার তিনটি নিয়মের সূত্রায়ন। এই নিয়মগুলো মূলত জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের নিকট থেকে এঙ্গেলস ধার করেছিলেন সম্ভবত সামাজিক দুনিয়া ও প্রাকৃতিক জগতের প্রক্রিয়াসমূহ বর্ণনাকরণে। নিয়মগুলো হলো: বিপরীতসমূহের আন্তরঅনুপ্রবেশ (the interpenetration of opposites), পরিমাণগত পরিবর্তনের গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর (transformation of quantity to quality) এবং নেতির নেতিকরণ (the negation of the negation)। আমরা প্রায়ই বিজ্ঞান ও প্রকৃতি থেকে দৃষ্টান্তসমূহ ব্যবহার করি এই নিয়মত্রয় ব্যাখ্যাকরণে। পরিমাণগত পরিবর্তনের গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর- এই নিয়মটির জন্য মানুষজন যে দৃষ্টান্তটি প্রায়ই উল্লেখ করেন তাহলো এই যে পানির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্র্রী সেলসিয়াসে উন্নীত হলে এটির বাষ্পে রূপান্তর। তাপমাত্রার পরিমাণগত পরিবর্তন এক ভৌত অবস্থা থেকে অপর ভৌত অবস্থার পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। আর একটি দৃষ্টান্ত হলো মুরগী ও ডিম প্রসঙ্গে। যখন একটি মুরগীর বাচ্চা ডিম থেকে ফুটে বের হয়, তখন এটি ঐ ডিমকে ধ্বংস করে, অর্থাৎ এটির নেতিকরণ সংঘটিত করে। কিন্তু বড় হয়ে মুরগীতে পরিণত হয়ে মুরগীর বাচ্চার নেতিকরণ সংঘটিত হয়, এটি হলো নেতির নেতিকরণ।
এই সুনির্দিষ্ট উদাহরণসমূহ আমরা নির্বাচন করি এটি অবধারিত মনে করতে যে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াসমূহ প্রকৃতিতে অস্তিÍত্বমান। কিন্তু অনেক মার্কসবাদী ভাষ্যকার এই অনুমানকে প্রত্যাখ্যান করেন। এর কিছু উদাহরণসমূহের গতানুগতিকতা
(triviality) হলো একটি কারণ যাতে কিছু মানুষজন প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। আয়ান বার্চাল সঠিকভাবেই বলেন যে এক কাপ চা তৈরীকরণ অথবা মুরগীর বাচ্চা ফুটানো থেকে বিপ্লব সংঘটিতকরণ বরং অনেক জটিল। কমবেশী স্বপ্রণোদিত এক সেট নিয়মের জন্য সুবিধাজনক প্রমাণ অন্বেষণের প্রচেষ্টা হিসেবে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে সমালোচনা করা হয়। নেতির নেতিকরণের মতন নিয়মের জন্য প্রাকৃতিক জগতে প্রমাণ অন্বেষণ সম্ভব , যদি আপনি যথেষ্ট শ্রম সহকারে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোন উদাহরণটি আপনি পছন্দ করবেন সে ব্যাপারে যদি নৈর্বাচনিক হন। এটি জাঁ-পল সার্তেকে মন্তব্যকরণে ধাবিত করে যে একজন কেবলমাত্র একটিই দ্বান্দ্বিকতা প্রকৃতিতে দেখতে পাবে যেটি সে সেখানে আরোপ করে।
কিছু মানুষজন যুক্তি দেন যে এঙ্গেলস এটি প্রস্তাব করে মৌলিকভাবে ভুল করেন। তাঁরা বলেন যে তিনি মার্কসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি উপলব্ধি করতে পারেননি অথবা এটিকে বিকৃত করেন সামাজিক বা ঐতিহাসিক প্রশ্নাবলীর বাইরে প্রসারিত করে। ১৯৬০এর দশকে জর্জি লিখথেইম (George Lichtheim) লিখেছিলেন, যখন অনেক একাডেমিয় মার্কসবাদী স্তালিনবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা থেকে মার্কসবাদকে উদ্ধারকরণের উপায় অন্বেষণ করছিলেন, তিনি যুক্তি দেন যে এঙ্গেলসই সমস্যা। লিখথেইম এবং অন্যান্য বামপন্থীদের ধারণা এই যে প্রকৃতিতে কতগুলো নিয়ম”বিদ্যমান যা নিচ থেকে সমাজতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই নিয়মগুলো ইঙ্গিত দেয় যে প্রকৃতি এবং পরিণামে মানব সমাজ একটি পূর্বনির্ধারিত গতিপথ অনুসরণ করে। এবং যদি ইতিহাস পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে এতে শ্রমিক শ্রেণীর সচেতন ক্রিয়ার কোন ভূমিকা নেই। যদি আমরা দ্বান্দ্বিকতাকে তিনটি নিয়মের একটি সেট হিসেবে পুঞ্জিভূত করি, তবে আমরা মূর্ত বাস্তবতা থেকে এর বিচ্ছেদের বিপদ টেনে আনি, যেটি থেকে এটি উদ্ভূত বলে গণ্য করা হয়। প্রকৃতিতে নিয়মাবলীর প্রয়োগ ধারণাবলী ও বাস্তবতার মধ্যেকার একটি দ্বৈততান্ত্রিক পার্থক্য সুপারিশ করে, যেখানে একটি আর একটিকে নির্ধারিত করে। কীভাবে এটিকে মার্কসবাদের একটি কনসেপশনের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়, যাতে তত্ত্ব ও অনুশীলনের ঐক্যের জন্য যুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০এর দশকসমূহে নানা প্রবণতার বামপন্থী একাডেমিশিয়ানগণ এটি মেনে নেন যে সমাজতন্ত্রের স্তালিনিয় ব্যাখ্যার মূলে ছিলো এঙ্গেলসের ধারণাবলী, অর্থাৎ এমন একটা কিছু যা সমাজের উপর থেকে এলিটগণ কর্র্তৃক শ্রমিক জনতার নিকট হস্তান্তর করা যায়। মার্কসবাদী ঐতিহ্যে এঙ্গেলসের অবদানকে সামগ্রিকভাবে বাতিল করতে কিছু লোকজন এমনকি তাঁর মন্তব্যসমূহ উদ্ধৃত করেন। উদারহণস্বরূপ, অধিকতর সাম্প্রতিক সময়ে লিঙ্গ বিষয়ের লেখকগণ একইভাবে দেখতে পান যে মার্কসের দ্যোতনাপূর্ণ অবস্থান (nuancedposition) সহজে গ্রহণ করা যায়, যেখানে এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যত বিজ্ঞানকৃত ও নির্ণয়বাদী (scientistic and deterministic)।
যাহোক, এটা মনে হয় না যে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের জীবনকালে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির প্রশ্নাবলীতে মৌলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করতেন। পরবর্তী জীবনে তাঁরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের শ্রম বিভাগ তৈরী করেন, যাতে এঙ্গেলস বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন, অন্যদিকে মার্কস পুঁজি গ্রন্থ লিখনে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁরা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে দেখা করতেন, বিশেষ করে এঙ্গেলস ১৮৭০এ লন্ডনে চলে আসেন, এবং তাঁরা তাঁদের কাজ নিয়ে বিস্তারিতভাবে নিয়মিত আলোচনা করতেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে এমন কোনো লিখিত পত্রাবলী নেই যা দিয়ে এটা বাতলানো যায় যে তাঁরা ভিন্নমত পোষণ করতেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসলে এটা বলা যায় না যে মার্কস বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পুঁজি গ্রন্থের কোনো বিষয় ব্যাখ্যাকরণে তিনি প্রায়ই রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান থেকে উদাহরণসমূহ নির্বাচন করতেন। দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যাকরণে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের উপবৃত্তাকার গতি ব্যবহার করেন এবং জৈব রসায়নের উল্লেখ করতেন। মার্কস ব্যাখ্যা করেন যে একটি যৌগের রাসায়নিক সংগঠনে কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন বিভিন্ন মাত্রায় যোগ করে মাত্রিক পরিবর্তন সংঘটিত করলে গুণগতভাবে বিভিন্ন ধর্মাবলী বিশিষ্ট নতুন বস্তুসমূহের উদ্ভব ঘটে।
এটা যদিও সত্য যে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৫এ এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রকাশিত হওয়ার পর তা সেখানে প্রভাবদায়ী ছিল। স্তালিনপন্থীগণ দ্বান্দ্বিকতার যে সংস্করণটি ব্যবহার করেন তা এঙ্গেলসের তিনটি নিয়মের অনমনীয় প্রয়োগের সাথে বাধাঁ ছিল। স্তালিন কর্তৃক নিয়মগুলো বারবার পুনরাবৃত্ত হয় এবং এটা মনে হয় যে তাঁর অনুসারীগণ সম্পূর্ণ অসমালোচনীয়ভাবে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণা গ্রহণ করেন। যে সমস্ত অধ্যাপকবৃন্দ পূর্বে ইন্সটিটিউশনসমূহের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা তাঁদেরকে কনিষ্ঠ সহযোগীবৃন্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত দেখতে পেলেন। এই কনিষ্ঠ সহযোগীবৃন্দ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বা এর স্তালিনিয় ব্যাখ্যার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন। পূর্বতন অনেক শ্রদ্ধাভাজন বিজ্ঞানীবৃন্দ নিজেদের বন্দীকৃত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং এমনকি অনেককে হত্যা করা হয়। ত্রোফিম লাইসেনকো ইন্সটিটিউট অব জেনেটিকসের প্রধান নিযুক্ত হন, তিনি জেনেটিকসকে একটি বুর্জোয়া বিচ্যুতি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। বিজ্ঞানের ওপর এই আক্রমণগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে বলশেভিকিকরণের ব্যাপক প্রণোদনার অংশ। একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে বহাল রাখার তবিয়তে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষায়িত প্রয়োজনাবলীর সহগামী হতে বিজ্ঞানকে বাধ্যকরণে এটা ছিল অংশত একটি প্রচেষ্টা। খাঁটি বিজ্ঞানের জন্য আর কোনো সময় ছিলো না। বিজ্ঞানীবৃন্দকে তাঁদের কাজের নায্যতা প্রতিপাদন করতে হতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য স্তালিনের পাঁচশালা পরিকল্পনাসমূহের সাথে এর সঙ্গতিপূর্ণতা প্রদর্শন দ্বারা। কিন্তু এর নিজের নাগরিকদের নিকট এবং পশ্চিমে এর সম্ভাবনীয় সহানুভূতিশীলদের নিকট প্রোলেতারিয়েতের স্বার্থে সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত সমাজ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের নায্যতা প্রতিপাদনে এটা ছিল একটি ভাবাদর্শিক প্রচেষ্টার অংশ।
সুতরাং বিজ্ঞানকে অধিকতর দ্বান্দ্বিক হতে বাধ্যকরণের এই মর্মান্তিক প্রচেষ্টায় এঙ্গেলস অনভিপ্রায়িকভাবে একটি ভূমিকা পালন করে থাকতে পারেন। কিন্তু দ্বান্দ্বিকতার প্রতি একটি মতান্ধিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন ছিল এঙ্গেলসের অভিপ্রায়িত শেষ বিষয়। এবং, অবশ্যি, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা ছিল একটি অসমাপ্ত কাজ, এক সারি নোটের সমাহার যেগুলো তিনি বিবেচনাকররূপে সংশোধন করতে পারতেন, যদি তিনি নিজে এটিকে প্রকাশ করতে পারতেন। মার্কসবাদ ও বিজ্ঞানের দর্শন-এ হেলেনা শিহান যুক্তি দেন যে বিষয়টির ওপর তাঁর কাজকে বরং চুড়ান্ত অর্থ না ধরে এই ক্ষেত্রে এটিকে একটি সূচক হিসেবেই অধিকতররূপে দেখা উচিত। বিজ্ঞানের ওপর এঙ্গেলসের নিজের মন্তব্যও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে, সেটি লুদভিগ ফয়েরবাখ-এ। এখানে তিনি হেগেলের দর্শনের সম্ভাবনীয় কেজো অবদান আলোচনা করেন, যা থেকে তিনি তিনটি নিয়ম আহরণ করেন, এবং হেগেলের কিছু রক্ষণশীল ব্যাখ্যাবলী প্রত্যাখ্যান করেন। এঙ্গেলস বিবৃত করেন: তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে, হেগেলিয় ব্যবস্থার সমগ্র মতান্ধিক আঁধারকে চরম সত্য বলে ঘোষণা করা হয়, যা সকল মতান্ধতন্ত্রকে দ্রবীভূত করে। এইভাবে তাঁর বিপ্লবী দিক চাপা পড়ে যায় রক্ষণশীল দিকের অতিবৃদ্ধির নীচে।
এখানে এটি প্রতীয়মান, তিনি বলছেন যে হেগেলের নিয়মগুলো উম্মুক্ত থাকা উচিত মূল্যায়ন এবং পুনঃব্যাখ্যায়নের জন্য। তারা নিয়মগুলোর একটি অনড় সেট নয়। যাহোক, এটি বলা যায় না যে তিনি দ্বান্দ্বিকতাকে পুরোপুরি একটি পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করতেন। এটিও স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, কমপক্ষে এঙ্গেলসের দিক থেক গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে দুনিয়া সম্পর্কে চিন্তনের প্রক্রিয়াসমূহকে আমরা যে দুনিয়াকে অধ্যয়ন প্রয়াসী তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করতে পারিনে।
লুকাস এবং সমাজের দ্বান্দ্বিকতা
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার বিরুদ্ধে হাঙ্গেরিয় মার্কসবাদী গিয়র্গ লুকাসের কাজ ছিল বিশেষভাবে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। মার্কসিয় দর্শনের ব্যাবহারিক প্রয়োগের ব্যাপারে লুকাস উৎসাহী ছিলেন, যেখানে দ্বান্দ্বিকতা ছিল বিপ্লবের জন্য একটি বাহন। লুকাসের ধারণাবলী চমৎকারভাবে পরিবর্তন হয়েছে তাঁর সারাজীবন ব্যাপী এবং তাঁর চিন্তনকে বিস্তারিতভাবে এখানে উপস্থাপন অসম্ভব। যাহোক, দ্বান্দ্বিক দর্শনের প্রতি তাঁর প্রথম দিককার দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে স্পষ্টায়িতভাবে এসেছে তাঁর ধ্রুপদী কাজ ইতিহাস এবং শ্রেণী সচেতনতা-তে। ভিয়েনাতে নির্বাসনরত অবস্থায় ১৯২৩এ এটি প্রকাশিত হয়। লুকাস বেলা কুনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন, যদিও বামদের ওপর আধিপত্য ছিল অধিকতর বৃহত্তর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। অ্যাডমিরাল হোরথি দেশটির দখল নিলে, তিনি হাঙ্গেরি থেকে পালাতে বাধ্য হলেন। হোরথি কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ করেন এবং হত্যা করেন এবং তাঁদের হাজার হাজার সমর্থকদের বন্দী করেন।
লুকাস যুক্তি দেন যে আমরা আমাদের চারপাশের দুনিয়ার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনে। আমরা একটি বুর্জোয়া সমাজে বাস করি এবং চিন্তা করি যেটি আমাদের ধারণাবলীকে বিকৃত করে। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে আমাদের নিকট সবচেয়ে দরকারী অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী পণ্যের রূপ ধারণ করে যা টাকার মাধ্যমে বিনিময়যোগ্য। সুতরাং, পণ্যসামগ্রীর বস্তুগত বৈশিষ্ট্যাবলী, এবং সেগুলোর সামাজিক উৎসাবলী আড়ালকৃত হয় এবং কেবলমাত্র একটি বৈশিষ্ট্য প্রাসঙ্গিক হয়, আর তাহলো বাজারে সেগুলোর দাম। মার্কস যুক্তি দেন যে পণ্যসামগ্রীর পুঁজিতান্ত্রিক বিনিময় এর নিজস্ব যুক্তি (logic) অনুসরণ করে- এবং অনিবার্যতার একটি বোধ (a sense of inevitability) দিতে পারে। লুকাস যেমনটি ইতিহাস ও শ্রেণী সচেতনতা গ্রন্থে বলেন:
বিষয়গতভাবে বিষয়সমূহের দুনিয়া (world of objects) এবং বস্তুসামগ্রীর মধ্যেকার সম্পর্কাবলী হঠাৎ অস্তিত্বমান হয় (পণ্যসামগ্রীর দুনিয়া এবং বাজারে তাদের সঞ্চালন)। এই বিষয়সমূহের নিয়ন্ত্রণাধিকারী নিয়মাবলী প্রকৃতপক্ষে মানুষ কর্তৃক ক্রমাগতভাবে আবিষ্কৃত, কিন্তু তারপরেও তারা তার সাথে মুখোমুখি হয় অদৃশ্য শক্তিনিচয় হিসেবে, যা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা উৎপন্ন করে।
সুতরাং আমরা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চিন্তা করি এক সারি বিষয়সমূহ দ্বারা তৈরীকৃত ব্যবস্থা হিসেবে। এই বিষয়সমূহ একে অপরের সাথে সম্পর্কায়িত, কিন্তু এটি অধিকতর জটিল বাস্তবতাকে আড়াল করে। লুকাস যুক্তি দেন যে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এমন চমৎকারভাবে উপলব্ধিকরণে সক্ষম যে তা বুর্জোয়া শ্রেণী পারে না। এর কারণ হলো পুঁজিতন্ত্রকে প্রবহমান রাখতে আমরা নিজেরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের শ্রম ক্ষমতা দামের জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর নিকট বিক্রয় করি, সুতরাং শ্রম সম্পাদনে আমাদের সক্ষমতা, তা একভাবে বিষয়কৃত হয় এবং পণ্যে রূপান্তরিত হয়। কীভাবে পুঁজিতন্ত্র কাজ করে, প্রোলেতারিয়েত ঠিক তা বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করে না, বরং পুঁজিতন্ত্রের ভেতরে ক্রিয়া করে। শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে এবং অনুশীলন থেকে অবিচ্ছেদ্যভাবে তত্ত্বকে অবলোকনে লুকাস মার্কসকে অনুসরণ করেন: বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা হলো একটি বিপ্লবী দ্বান্দ্বিকতা, আমাদের বাসকৃত সমাজে কার্যকর প্রক্রিয়াসমূহ অনুধাবনে তা একটি উপায় কেবলমাত্র নয়, সঙ্গে সঙ্গে ঐ সমাজকে পরির্তনের জন্য একটি হাতিয়ারও বটে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা উদ্ঘাটনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকার ওপর লুকাস মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। সমাজে দ্বান্দ্বিকতার ওপর প্রায় একচেটিয়া গুরুত্ব আরোপনে তাঁর প্রকৃতির বিষয়ে সামান্যই বলার ছিল। লুকাসের মতানুসারে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণী ইতিহাসের বিষয়ী ও বিষয় ((subject and object of history) উভয় হিসেবে যে চমৎকার ভূমিকা পালন করে, সেটি প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন অভিমুখ যেমন প্রাণি জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, প্রস্তুরসমূহ, ইত্যাদি সেই একই ভূমিকা পালন করতে পারে না। তারা শ্রেণী সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে না।
এটা প্রায়ই অনুমানকৃত হয় যে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে লুকাস সামগ্রিকভাবে বাতিল করে দেন একটি অনুমানের ওপর। এই অনুমানটির জন্য অনেকখানি দায়ী ইতিহাস ও শ্রেণী চেতনা গ্রন্থের অনুগামী প্যাসেজটি: এঙ্গেলস কর্তৃক দ্বান্দ্বিকতার উপস্থাপন থেকে ভুল উপলব্ধি মূলগতভাবে এই ঘটনায় নিহিত যে এঙ্গেলস হেগেলের ভ্রান্ত উদাহরণ অনুসরণে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে প্রকৃতির জ্ঞান অবধি সম্প্রসারণ করেন। যাহোক, লুকাস সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে জন রিজ প্রশ্ন তোলেন। আমাদের সমাজ অধ্যয়ন পদ্ধতিসমূহের সাথে আমাদের প্রকৃতি অধ্যয়ন পদ্ধতিসমূহের সমীকৃতকরণের জন্য লুকাস এঙ্গেলসের সমালোচনা করেন। লুকাসের ক্ষেত্রে, একজন দূরবর্তী, বিষয়গত পর্যবেক্ষক হিসেবে সমাজ অধ্যয়নের দিকে আমরা অভিগমন করতে পারি না, যেমনটি আমরা (অনুমানসিদ্ধরূপে) প্রকৃতির দিকে পারি। আমরা সমাজের অংশ, সুতরাং আমরা এটাকে ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ করি। এটা প্রয়োজনগতভাবে অনুমান করবার দরকার নেই যে প্রকৃতির কোনো দ্বান্দ্বিকতা নেই। যাহোক, মনুষ্যজনের সচেতন হস্থক্ষেপ ছাড়া প্রকৃতিতে উদ্ভূত যেকোনো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিসমূহ সমাজ পর্যবেক্ষণে পদ্ধতিসমূহ থেকে পৃথক হবে। এটাও যথার্থভাবে স্মরণীয় যে ১৯২৩এ লুকাস প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অধ্যয়ন নাও করে থাকতে পারেন এবং বিশেষ করে ঐ টেক্সটে একারণে সাড়া নাও দিয়ে থাকতে পারেন, যেটি তখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
প্রকৃতি দ্বারা আমরা কি বুঝি?
পরবর্তীতে সমালোচকবৃন্দ প্রশ্ন করেন যে প্রাকৃতিক জগৎ থেকে ঘেরাওকৃত ও পৃথক করে মানব সমাজকে অধ্যয়ন করা যায় কিনা, যেমনটি লুকাস করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। আন্তোনিও গ্রামশি লুকাস সম্পর্কে বলেন যে যদি তাঁর অধিকার-খ্যাপন (assertion) প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি দ্বৈততা পূর্বানুমান করে, তবে তিনি ভ্রান্ত। যদি প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাতে কোনো কিছু আছে বলে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে এটা মনে হয় যে আমাদের প্রকৃতি এর কিছু ধারণা প্রকৃতপক্ষে কি অর্থ প্রকাশ করে সে সম্পর্কে কমপক্ষে একমত হওয়া প্রয়োজন। এই প্রশ্নটি প্রায়ই এধরনের যুক্তিসমূহ থেকে বের করে আনা হয় (left out of such arguments)। দ্বান্দ্বিকতা কি, এই ধারণার ওপর বিতর্ক সাধারণত কেন্দ্রীভূত থাকে এবং এটি বিতর্কিত থেকে যায়।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে প্রকৃতির ধারণা কঠিনই থেকে যায়। উইলিয়াম রেমন্ড এটিকে ভাষাতে সম্ভবতঃ সবথেকে জটিল শব্দ হিসেবে নির্দেশিত করেন। সুতরাং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার দেখা পাওয়া এই প্রবন্ধের পরিসীমার বাইরে। কিন্তু প্রকৃতি শব্দটি কি নির্দেশ করে সে সম্পর্কে অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল অনুমানসমূহের কতকগুলি সম্পর্কে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি।
আমার নিজের বিষয় ভূগোলে প্রকৃতি সম্পর্কে সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টি সঞ্জাত ধারণাবলীর কিছুটা বিকশিত হয়েছে। এটি সম্ভবত বিষয়টির ইতিহাস ঘটিত কারণে। ঐতিহ্যিক কারণে ভূগোলবিদগণ সেই সমস্ত মানুষ যারা দুনিয়া পরিভ্রমণ করেন, নানা মানব সমাজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরামর্শ দেন জনগণ যে পরিবেশে বাস করেন, সেটি কীভাবে এই সমাজগুলোকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আগের ভূগোলবিদগণ এই বর্ণতান্ত্রিক মিথটি প্রচার করেন যে উষ্ণ জলবায়ুতে বসবাসরত জনগণের দরিদ্র হবার ঝোঁক বিদ্যমান, কারণ জলবায়ু সংক্রান্ত অবস্থাবলী অলসতায় উৎসাহ যোগায়। আজকের দিনে (অধিকাংশ) ভূগোলবিদগণ অভিমতটির সমালোচনায় অধিকতর সোচ্চার, যেটি বলে যে সরল ও অনির্দিষ্টভাবে পরিবেশ সমাজকে প্রভাবিত করে । কিন্তু সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সম্পর্কে আগ্রহ এখনো বিদ্যমান। ভূগোল প্রায়ই বর্ণনাকৃত হয় একটি সেতুকৃত ডিসিপ্লিন হিসেবে, অংশত সামাজিক বিজ্ঞান, অংশত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।
এই প্রশ্নাবলীতে সুনির্দিষ্টভাবে একটি মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেয়া সবচেয়ে বিখ্যাত ভূগোলবিদদের এক ছিলেন প্রয়াত নেইল স্মিথ (যার ডক্টোরাল থিসিসটি একটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল: Uneven Development। স্মিথ যুক্তি দেন যে প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাবলীর অনেকগুলোকে শ্রেণী সমাজের ভাবাদর্শের সাথে এবং শ্রেণী সমাজের সুনির্দিষ্ট রূপ হিসেবে পুঁজিতন্ত্রের ভাবাদর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। মার্কস প্রকৃতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে আংশিক অন্তর্দৃষ্টিসমূহ রেখে গেছেন, তাতে সারবস্তু যোগ করাই তাঁর কাজের লক্ষ্য। আমরা প্রকৃতিকে দেখার প্রবণতা প্রদর্শন করি মানবতা থেকে বাহ্যিক কোনোকিছু হিসেবে। প্রাকৃতিক জগৎ হলো আমাদের নগরগুলোর প্রান্তসীমাসমূহের বাইরে অবস্থিত তেপান্তর, মানব হস্তক্ষেপ মুক্ত অদূষিত একটি স্বর্গ। প্রকৃতির এই প্রতিবিম্বগুলো অনেক গভীর সবুজ পরিবেশতান্ত্রিক চিন্তাবিদবৃন্দের ভাবাদর্শের কেন্দ্রে অবস্থিত। অবশ্যি, অনেক মানুষজন যারা নিজেদের বিবেচনা করেন পরিবেশতান্ত্রিক হিসেবে, তাঁরা মনুষ্যজনের কল্যাণের জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যাহোক, একটি বাহ্যিক প্রকৃতি সংরক্ষণের ভাবাদর্শ রাজনৈতিকভাবে অসহায়ক হতে পারে। এটি এই বিশ্বাসকে লালন করে যে মানুষের প্রয়োজনসমূহ প্রাকৃতিক দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহের বিপরীত, যেটি দেখা যেতে পারে লাগাতার এই যুক্তিটিতে যে প্রকৃতি রক্ষাকরণে আমাদের মানব জনসংখ্যা বৃদ্ধি সীমিত করা প্রয়োজন। ডেভিড এটেনবোরোর সাম্প্রতিক সময়ের মন্তব্যসমূহে এটি প্রদর্শিত হয় যে মানুষ হলো দুনিয়াতে প্লেগ। প্রকৃতিকে সংরক্ষণের অধিকতর ঊন আগ্রহী মানুজনই মানব সমাজ থেকে পৃথকীকৃত প্রকৃতির আদর্শ সমর্থন করে । টেকনোক্র্যাটিক চিন্তকগণ যুক্তি দেন যে আমরা প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারি। তাঁরা পরামর্শ দেন যে আরো সুক্ষ্মতর প্রযুক্তি উদ্ভাবন দ্বারা আমরা আমাদের সকল পারিবেশিক সমস্যাবলী সমাধান করতে পারি। পূর্বের মতন একই অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের সমাজসমূহ পরিচালনা করতে পারি এবং কেবলমাত্র বাহ্যিকভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে গণ্য করি। শোষণের জন্য প্রকৃতি আমাদের নিকট একটি স্বর্গ বা একটি উৎস যাই হোক না কেন, এটিকে এখনো সমাজ থেকে বাহ্যিক অস্তিত্বরূপে নির্দিষ্টায়িত (defined) করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ সবই প্রকৃতি-সমাজ দ্বৈততন্ত্রে অপরিহার্য (predicated)।
দ্বৈততন্ত্র একটি অপরিবর্তনীয় বা সার্বজনীন (unchanging or universal) প্রকৃতির ধারণাকেও লালন করে। বুর্জোয়া চিন্তকগণ যুক্তি দেন যে যেহেতু প্রকৃতি সমাজ থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান, তাই যা প্রাকৃতিক তা অবশ্যি পরিবর্তিত হবে না। সমাজ সম্পর্কে সবচেয়ে রক্ষণশীল ধারণাবলীর কিছুকে নায্যতা প্রদানকরণে প্রকৃতির কর্তৃপক্ষের (authority of nature) নিকট আবেদনকে ব্যবহার করা যেতে পারে। মানব স্বভাব কখনো পরিবর্তিত হয় না। প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন বিবাহকে সার্বিকভাবে একটি হেটারোসেক্সুয়াল প্রচেষ্টা হিসেবে, বিষয়সমূহের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলারও একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়। পুঁজিতন্ত্র সারা দুনিয়া চষে বেড়ায় প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ (natural resources) ধ্বংসকরণে নয়া পদ্ধতিসমূহ অন্বেষণের জন্য। কিন্তু এর আত্মপক্ষ সমর্থকগণ (ধঢ়ড়ষড়মরংঃং) জোর দেন যে তাঁদের জীবন যাত্রার পদ্ধতিটি অবশ্যি সংরক্ষণ করতে হবে চিরকালীনতার জন্য (for eternity)।
যদি বুর্জোয়াদের চিন্তাভাবনা প্রকৃতিকে একটি অস্পর্শনীয় বিরান ভূমি হিসেবে দেখে, তবে এটি কেবলমাত্র প্রকৃত অবস্থাকে অস্পষ্টকরণেই সহায়তা করে। মানব সত্ত্বা কেবলমাত্র দুনিয়াতে বসবাসই করে না, বরং দুনিয়ার ওপর প্রভাবও ফেলে।। নানা ধরনের সমাজ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে (treat) নানা পদ্ধতিতে। পুঁজিতন্ত্র প্রকৃতির প্রত্যেক দিককে ব্যবহারকরণের প্রবণতা দেখায় একটাকিছু হিসেবে যা সম্ভাবনীয়রূপে বাজারে বিনিময়ের জন্য পণ্যে পরিণত হয়। এর প্রভাব বলয়ের বাইরে কোনো প্রাকৃতিক জগৎ নেই। এমনকি প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা করে, আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি তার প্রয়োজনসমূহের ওপর ভিত্তি করে আমরা এটা সম্পর্কে চিন্তাকরণে বাধ্য হই একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। কিন্তু সাধারণত আমরা ঠিক প্রকৃতিকে গভীরভাবে চিন্তাই করিনে, বরং এটিকে মুনাফার একটি উৎস বা আমাদের বর্জের স্তুপ ফেলার একটি জায়গাতে রূপান্তরিত করি। স্মিথ যুক্তি দেন যে প্রাইস টাগরূপে , প্রত্যেকটি ব্যবহার-মূল্য একটি দাওয়াত পৌঁছে দেয় শ্রম প্রক্রিয়াতে, এবং পুঁজি-এর স্বভাবগত কারণে অতি দরকারী বিশিষ্ট সত্ত্বা (quintessential socialite) এবং প্রত্যেকটি দাওয়াত পণ্য তৈরীতে প্রণোদিত হয়। কার্বন বাজারের উত্থানে এটি বিস্মায়করূপে স্পষ্ট, আমরা যে বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেই, তাতে এটি একটি আর্থিক মূল্য কার্যকররূপে আরোপ করে। স্মিথ ও অন্যদের জন্য প্রকৃতির উৎপাদনের তত্ত্ব দ্বৈততান্ত্রিক ধারণাবলীর প্রতি একটি প্রতিষেধক। যদি যুক্তি দেওয়া হয় যে প্রকৃতি উৎপাদন করা হয়, তার অর্থ এই নয় যে আমরা মানবেরা আক্ষরিক অর্থে এর প্রত্যেকটি দিক সৃজন করি; আমরা পর্বতমালা তৈরি করিনে। যাহোক, আমরা আক্ষরিক অর্থে নয়া জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ (জিনগত পরিবর্তন দিয়ে) এবং নয়া বাস্তুসংস্থানসমূহ যেমন বিবনায়নের মাধ্যমে তৈরীকৃত জঙ্গলাৎ জমিসমূহ তৈরী করি। এটি বলা যেতে পারে যে আমাদের কর্মসমূহ পুরাতনটির মধ্যে একটি নয়া প্রকৃতি তৈরী করে। মার্কস যুক্তি দেন যে এমনকি তার কালে খুব কম তেপান্তর অবশিষ্ট ছিল। স্মিথকে উদ্ধৃত করে বলা যায়: প্রকৃতি ধারণার আধিপত্য শুরু হয় প্রকৃতি ও সমাজকে দুুটি পৃথক এলাকা হিসেবে গণ্য করে এবং তাদেরকে একীভূতকরণের প্রচেষ্টাসমূহ থেকে। মার্কসে আমরা বিপরীত প্রক্রিয়া দেখি। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিনতাই বিদ্যমান থাকুক না কেন, তিনি প্রকৃতির সাথে [সমাজের, অনু:] সম্পর্ক শুরু করেন একটি ঐক্য হিসেবে এবং যুগপৎ ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক ফলাফল (historical and logical result) হিসেবে আহরণ করেন।
প্রকৃতির প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকেই দ্বান্দ্বিক হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। পুঁজি-তে মার্কস কর্তৃক বিকশিত ও প্রয়োগকৃত (developed and employed) যে পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেন, ওলম্যান (Ollman) তাকে সাধারণীকরণের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ বলে অভিহিত করেন। সমগ্র বিশ্ব ব্রম্মান্ড জটিল এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল। সবকিছুই সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে একবারে চিন্তাকরণের চেষ্টা অসম্ভব। সুতরাং মার্কস দ্বান্দ্বিকতা ব্যবহার করেন একটি পদ্ধতি হিসেবে দুনিয়ার বিভিন্ন দিকের ওপর তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধকরণে। কখনো তিনি শরণ নেন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের পর্যায়ের প্রক্রিয়াসমূহে, কখনো অধিকতর সাধারণভাবে শ্রেণী সমাজের। কখনো তিনি তাঁর যুক্তিসমূহের ব্যাপ্তিকে অধিকতর বিশদায়িত করেন এই সুপারিশ করে যে তিনি যে বিষয়ের শরণ নেন তা প্রাকৃতিক দুনিয়ার সমগ্রের সাথে সম্পর্কিত। একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট তৈরীকরণে, উদাহরণস্বরূপ, পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যেকার সম্পর্ক ব্যাখ্যাকরণে যদি মনুষ্যজনের মাঝে কী ঘটে , ঠিক তার শরণ নেয়া হয়, তাহলে এটি প্রায়ই অর্থ বহন করে। কখনো পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী কী পদ্ধতিতে সম্পর্কিত, তা উল্লেখকরণে এটি অর্থ বহন করে, কিন্তু এই সম্পর্ক একটি ব্যাপৃত প্রেক্ষাপট, যাতে এটি অস্তিত্বশীল তা থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান নয়। ওলম্যানের জন্য, এটি এই যুক্তি সমর্থন করে যে এঙ্গেলসের মতন মার্কসের অভিপ্রায় ছিল যে দ্বান্দ্বিকতা কেবল সমাজে নয়, সমাজ ও প্রকৃতি উভয়টিতে প্রয়োগযোগ্য। কেউ একজন মানব সমাজ সম্পর্কে একটি বিশেষ যুক্তি তৈরীকরণে ব্যবহার করে থাকতে পারে, তার থেকে বরং মানব সমাজ যে সমগ্র প্রাকৃতিক জগতের অংশ, এটি পর্যবেক্ষণ হলো সাধারণীকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়সমূহকে দেখা।
সমাজ ও প্রকৃতি একে অপরের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত, সে সম্পর্কে খুব বেশী প্রশ্ন তখন মার্কস ও মার্কসবাদীদের সামনে ছিল না। পরিবর্তে আমাদের প্রশ্ন করা উচিত কীভাবে সমগ্রের এই দুটি দিক আদৌ পৃথকীকৃত হয়ে গেল প্রথম পর্যায়ে। জন বেলামি ফোস্টার এই পয়েন্টটি নেন, যিনি মার্কসের মেটাবোলিক ফাটলের ধারণা (concept of a metabolic rift) পুনরুদ্ধার করেন। মার্কস যুক্তি দেন যে আমাদের চারপাশের দুনিয়ার সাথে মানব সত্ত্বাসমূহ মেটাবোলিক উপায়ে মিথষ্ক্রিয়া করে। আমাদের কাজকরণের এবং আমাদের শ্রম শক্তি ব্যবহারকরণের সামর্থ্য এই মিথষ্ক্রিয়াকে সহজতর করে। পুজিঁতন্ত্র শ্রম শক্তিকে পণ্যায়িত করে এবং এটিকে মুনাফার উৎসে রূপান্তরিত করে। এটি যুগপৎ মানবতা ও প্রকৃতির মধ্যে একটি মেটাবোলিক ফাটল সৃজন করে। সুতরাং, এটি যুক্তি দেয়া হয় যে ফাটল ঐতিহাসিক আকস্মিক একটা কিছু, যেটি বিকশিত হয় পুঁজিতন্ত্রের বিকাশের সাথে। পুঁজি খন্ড তিন-এর একটি প্যাসেজে মার্কস বর্ণনা করেন কীভাবে পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্ট শর্তাবলী প্ররোচিত করে সামাজিক মেটাবোলিজমের স্বাধীন প্রক্রিয়াতে একটি অমেরামতযোগ্য ফাটল তৈরীকরণে, যে মেটাবোলিজমটি নির্দিষ্টায়িত হয় স্বয়ং জীবনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী দিয়ে”। এই প্যাসেজে মার্কস ঘোষণা করেন যে প্রকৃতি হিসেবে একটি বিষয় বিদ্যমান ( এবং প্রস্তাবকরণে এতদূর যান যে সেখানে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী বিদ্যমান)। তিনি প্রকৃতিকে দেখেননি চরম অর্থে সম্পূর্ণত সামাজিকভাবে গঠনকৃত হিসেবে, যেভাবে পদটি কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়। যেন সমাজ থেকে পৃথক এভাবে প্রকৃতি/জীববিজ্ঞান এর ওপর সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ নিবদ্ধকরণ হলো মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু যদি এ দুটি অপৃথকায়িত হয় তবে একজনের সমীকরণের সামাজিক পক্ষের ওপর সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ এবং প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে সমাজ কৃর্তক নির্ণীত হিসেবে পর্যবেক্ষণ, এভাবে ফোকাসকরণ সমস্যাকীর্ণ।
যদি আমরা প্রকৃতি তৈরী করি তবে আধিপত্য বা ব্যবস্থাপনার (domination or management) চেয়ে এর সাথে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর জটিল। যাহোক, এটি এই অর্থও করে যে আমরা যে উপায়ে প্রকৃতি সৃজন করি তা পরিবর্তন করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রজাতি নিশ্চিহ্নকরণের মতন প্রক্রিয়া নিচয় প্রতিরোধকরণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত, কিন্তু কল্পনা করা উচিত নয় যে যা আমরা করছি তা মানব অস্তিত্বের পূর্বেকার কিছু একটা কল্পিত প্রাকৃতিক অবস্থায় পরিবেশকে পুনরুদ্ধারকরণ নয়। পরিবর্তে আমাদের প্রকৃতি সৃজনের পদ্ধতির ওপর মনোযাগ নিবদ্ধ করা উচিত , কী উদ্দেশ্যাবলী এবং কাদের আগ্রহে- এগুলোর দিকে। নেইল স্মিথ এই হতাশতান্ত্রিক যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন যে মানবতা সবসময় পরিবেশ শোষণ করবে। সাধারণ জনগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণকৃত প্রকৃতি উৎপাদন ভিত্তিক সমাজতন্ত্রের জন্য তিনি যুক্তি দেন। যদি আমরা দ্বান্দ্বিকতাকে দেখি কেবলমাত্র সমাজে অস্তিত্বমান হিসেবে, তাহলে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে জোরদারকরণের ঝুঁকি নেই যে প্রকৃতি একটি সামগ্রিকভাবে পৃথক ক্ষেত্র, এটি এক ধরণের দ্বৈততন্ত্র যা বিরুদ্ধে নেইল স্মিথ, জন বেলামি ফস্টার এবং অন্যান্যরা যুক্তি দেন। কেন গ্রামশির মতন মানুষজন লুকাসের প্রকৃতি ও সমাজ পৃথককরণের প্রচেষ্টার প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তার কারণ সম্ভবত এই দ্বৈততন্ত্র। যাহোক, যদি এই প্রকৃতি সম্পর্কে লুকাস ভ্রান্ত হন, তাহলেও এটি বলা যায় না যে তাঁর ধারণাবলী প্রগতিশীল পরিবেশতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অকেজো। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে প্রশ্নাবলী উত্থাপনে লুকাস, গ্রামশি এবং ফরাসি মার্কসবাদী দার্শনিক হেনরি লেফেবব্রে (Henri Lefebvre) এর মতন মার্কসবাদী চিন্তকদের ধারণাবলী প্রয়োগ করেন সাম্প্রতিক কালের চিন্তকেরা, বিশেষত ভূগোলবিদগণ।
মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যেকার সম্পর্ক অথবা এমনকি প্রকৃতির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের চেয়ে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ওপর বিতর্কাবলীর একটি ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে মার্কসবাদী তত্ত্বের জন্য। মার্কসবাদ কী ধরণের দর্শন এবং ঐ দর্শন কিসের জন্য ব্যবহার করা হয় বলে ধরে নেয়া যায়- এ সম্পর্কে প্রশ্নাবলীর মূলে এটি নিয়ে যায়। দুনিয়াটা কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিষয় উপলব্ধিকরণে এঙ্গেলস চেষ্টারত ছিলেন বলে মনে হয়। বাস্তবিক বস্তুগত প্রক্রিয়াবলীর বয়ান হিসেবে তিনি দ্বান্দ্বিকতাকে দেখেন। যখন তিনি বলেন পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়, তখন এটি ঠিক এই অর্থ প্রকাশ করে না যে দুনিয়াটাকে বিবেচনাকরণে যেন এটি সংঘটিত হয় অথবা দুনিয়াটাকে এইভাবে চিন্তাকরণে এটি একটি কেজো পদ্ধতি। তিনি মনে করেন যে এটি প্রকৃত পক্ষে এইভাবে ক্রিয়া করে। সব দার্শনিক একমত হন না যে চিন্তনরত ব্যক্তির মনের বাইরে দুনিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান। এবং ঐ দুনিয়াটা কীভাবে কাজ করে এ সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধিকরণের প্রচেষ্টাটির ক্ষেত্রে দর্শনের জন্য একটি সার্বজনীন গৃহিত ভূমিকা নেই। অনেক চিন্তকদের জন্য এই যুক্তি দেয়ার প্রচেষ্টাটি এতদূর উচ্চাভিলাষী যে বাস্তবতা পরিচালনাকারী নিয়মাবলী অথবা প্রক্রিয়াবলী বিদ্যমান আছে এবং আমরা এই নিয়মাবলী উপলব্ধিতে সক্ষম।
যাহোক, দর্শনের প্রতি এই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক প্রশ্নাবলীতে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কস তাঁর ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিসে একমত পোষণ করেন যে “ অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তনের বাস্তবতা বা না-বাস্তবতা (reality or non-reality of thinking)এর ওপর বিতর্ক (dispute) হলো একটি পুরোপুরি পন্ডিতীয় প্রশ্ন (a purely scholastic question)। যদি আমরা দুনিয়া পরিবর্তনে লক্ষ্য স্থির করি, তবে এই যুক্তির ওপর দাঁড়াতে হবে যে আমাদের দুনিয়াটা অস্তিত্বমান, এ বিষয়ে একমত হওয়া উচিত। এবং ঐ দুনিয়াটা উপলব্ধিকরণের প্রচেষ্টার প্রকল্পটি আমাদের ঐকান্তিকভাবে নিতে হবে। অবশ্যি, মার্কসবাদ হলো দুনিয়াটিতে হস্থক্ষেপকরণ, কেবলমাত্র এটি ব্যাখ্যাকরণ নয়। কিন্তু মার্কসের জন্য, এ দুটি অবিচ্ছিন্ন। আমরা এতে হস্থক্ষেপের মাধ্যমে দুনিয়াটা ব্যাখ্যা করি এবং আমাদের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে হস্থক্ষেপ করি।
কেন অধিক দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞানী নেই?
কিন্তু যদি প্রাকৃতিক জগতে প্রকৃত দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াবলী কাজ করে, তবে এটি এই প্রশ্ন উত্থাপন করে যে কেন কেবলমাত্র প্রকৃতি অধ্যয়নরত স্বল্প সংখ্যক বিজ্ঞানী এটিকে স্বীকার করেন। কেন অধিক সংখ্যক দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞানী নেই। প্রতি-জবাব দেয়া যায় যে অনেক যুক্তিনিচয় বিদ্যমান, কেবল বিজ্ঞানে নয়, যেখানে মার্কসবাদীগণ অনুভব করেন যে তাদের ধারণাবলী সঠিক, কিন্তু সেখানে অধিকাংশ জনগণ ভিন্নমত পোষণ করেন। কেন অধিক সংখ্যক অর্থনীতিবিদ নেই যারা মুনাফা হার হ্রাসের প্রবণতা গ্রহন করেননি।
আমরা প্রায়ই ধরে নেই যে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ। অন্য কথায়, আমরা চিন্তাকরণের প্রবণতা দেখাই যে যখন বিজ্ঞানীবৃন্দ প্রাকৃতিক জগৎ পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের অন্বেষণের পদ্ধতিসমূহ তাঁদের সুযোগ করে দেয় দুনিয়ার একটি বিষয়গত উপলব্ধি অর্জনে, যেটি আমরা অবশিষ্টাংশরা পারি নে। যাহোক, বিজ্ঞানীবৃন্দ সমাজের বাইরে বসবাস করেন না। গবেষণায় মনোযোগের দাবীদার তাঁদের তত্ত্বনিচয়, এমনকি প্রশ্নাবলীর ধরনসমূহ, প্রতিফলিত করে তাঁরা যে সমাজে বাস করে এবং কাজ করে, সেই সমাজের প্রকরণ। সুতরাং বলা যায় যে বিজ্ঞানীবৃন্দ বাস্তবিক জগৎ (real world) পর্যবেক্ষণ করেন একটি সামাজিক প্রিজমের মাধ্যমে, যেটি তাঁদের দৃষ্টিকে বিকৃত করে। লুকাস শনাক্ত করেন যে পুঁজিতন্ত্র প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন অংশকে বাজারে বিনিময়ের জন্য পণ্যে রূপান্তরিত করে। উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধিকরণ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীবৃন্দ উদ্ভিদের পাতার রুবিস্কো নামক একটি এনজাইমের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন ঐ এনজাইম যাতে অধিকতর দক্ষভাবে কাজ করে, এতে চুড়ান্তভাবে তাঁরা একটি উদ্ভিদ ইঞ্জিনিয়ার করতে পারে। বর্তমান ভ্যারাইটির তুলনায় এই উদ্ভিদটি অধিকতর শস্য উৎপাদন করবে কৃষকদের জন্য। এটি দেখা সম্ভব হয় কীভাবে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা বিজ্ঞানকে উৎসাহিত করে থাকতে পারে একটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির পরিবর্তে রিডাকশনিস্ট পদ্ধতিতে দুনিয়া পর্যবেক্ষণে। ফিল জেসপার যুক্তি দেন যে পুঁজিতান্ত্রিক বিজ্ঞানে রিডাকশনিজমের প্রতি প্রবণতা প্রতিফলিত করে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ (individualism) এর আধিপত্য। প্রক্রিয়াবলীর জটিল হিসেবে এই এনজাইমটির উৎকর্ষায়নের প্রচেষ্টাকরণ অথবা এর পরিবেশের সাথে ঐতিহাসিকভাবে বিকাশমান সম্পর্কের সত্ত্বা হিসেবে এটিকে দেখা- এই বিজ্ঞানীদের জন্য এটি বিশেষভাবে সহায়ক নয়। ঐ একটি এনজাইমের ওপর কাজকরণে তাঁরা অধিকতর সামর্থ্যবান যদি তাঁরা এটিকে উপজীব্য করেন এমনভাবে যেন এটি উদ্ভিদের বাদবাকী অংশ থেকে পৃথক।
জন প্যারিঙ্গটন একই ধরনের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যুক্তি দেন যে রিডাকশনিজমে, একটি ব্যবস্থাকে তার উপাদানসমূহে ব্যবচ্ছেদকরণ এবং সেগুলোর স্বাতন্ত্রিক অধ্যয়ন দিয়ে এই ব্যবস্থাটিকে সবচেয়ে ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়-এই বিশ্বাসটি মনুষ্য উর্বরতার আণবিক জীববিজ্ঞানে তাঁর নিজের গবেষণায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার প্রদান করে। যাহোক, রিডাকশনিজম এর উপযোগীতার সীমায় পৌঁছে যখন এটি চেষ্টা করে কীভাবে এর অন্তর্দৃষ্টিসমূহ একটি বিস্তৃত চিত্রের সাথে উপযোগী হয়ে অর্থপূর্ণ হয়। এটি বিশেষত সমস্যাকীর্ণ হয় যখন জীববিজ্ঞানীয় গবেষণার সামাজিক তাৎপর্য্যনিচয় (ংড়পরধষ রসঢ়ষরপধঃরড়হং) ব্যাখ্যাকরণ প্রচেষ্টায় ব্যবহারকৃত হয়- যখন এটি একটি পদ্ধতি থেকে একটি ভাবাদর্শে রূপ লাভ করে।
লেভিন্স ও লিয়োন্টিন এবং স্টেভান রোজের মতন স্বল্প কয়েকজন দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীবৃন্দ, এদের সবার প্রতি দ্বান্দ্বিকতার একটি নমনীয় সংস্করণ অনুসরণের অভিযোগ রয়েেেছ। ক্রিস হারমান যুক্তি দেন যে যদি আমরা প্রকৃতিতে এই হেগেলিয় নিয়মাবলী প্রমাণের প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন না করি, বিশেষত নেতির নেতিকরণে, আমরা একটাকিছু কেন্দ্রীয় মিস করি। হারমান যুক্তি দেন যে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ কেবলমাত্র তাদের পরিবেশসমূহের সাথেই সম্পর্কিত নয়, তারা ঐ পরিবেশসমূহ দিয়ে নেতিকৃত। যে পদ্ধতিতে তারা ফিরতি প্রতিক্রিয়া করে ঐ পরিবেশসমূহে, সেটিকে বিবেচনা করা উচিত নেতির নেতিকরণের একটি উদাহরণ হিসেবে। হারমানের জন্য, পরিবেশের ওপর ক্রিয়াকরণের সামর্থ্য অনেক প্রকারের জীবন্ত সত্ত্বাসমূহের মাঝে খুবই সাধারণ। কিন্তু লেভিন্স ও লেয়োন্টিন থেকে পৃথকভাবে তিনি যুক্তি দেন যে কেবলমাত্র যাদের মধ্যে সচেতনতা (consciousness) বিকশিত, যেমন মনুষ্যজন, তাদেরকে গণ্য করা যেতে পারে অস্তিত্বায়িত বিষয় থেকে অস্তিত্বায়িত বিষয়ীতে (being objects to being subjects)। অন্ধ প্রত্যুত্তর সহ আমাদের পরিবেশে কেবলমাত্র প্রতিক্রিয়া সংঘটনের থেকে বরং আমাদের চারপাশের দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে মানুষের সামর্থ্য বিদ্যমান।
ক্রিস্টোফ নেইয়ারস (Christof Niehrs) একজন জার্মান ভ্রুণতত্ত্ববিদ, একটি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে জীববিজ্ঞানের প্রক্রিয়া এবং হেগেলের নিয়মাবলীর মধ্যেকার আনুষ্ঠানিক সাদৃশ্য তিনি বিশদভাবে লক্ষ্য করেন। খুবই প্রাথমিক সময়ে পশু ভ্রুণসমূহ কীভাবে বিকশিত হয়, তা তিনি পর্যবেক্ষণ করেন, কোষসমূহের একটি বলের অস্তিত্বায়ন থেকে একটি প্রত্যাভিজ্ঞেয় ভ্রুণে রূপান্তরণের অনেক পূর্বেই। কোষসমূহ কর্তৃক মোরফোজেনস নামক রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিঃসরিত হয় ভ্রুণের এক পার্শ্বে। মেরুদন্ডী প্রাণিসমূহে এই পার্শ্বের বিকাশায়ন শুরু হয় যাতে এই পার্শ্বটি হয়ে ওঠে স্পাইনাল কর্ড থাকা পার্শ্ব (ডোর্সাল সাইড)। এগুলো তখন বিপরীত পার্শ্বের দিকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিঃসরণের সূত্রপাত করে যা মোরফাজেনসমূহের প্রথম গ্রুপের উৎপাদনের বিপরীতে কাজ করে (এটিকে নেতিকৃত করে)। এগুলো পালাক্রমে পৃষ্ঠীয় দিকে (at the dorsal side) নেতিকৃত হয়। প্রাণি বিকাশে এটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি। এটি একটি প্রক্রিয়া উম্মুক্ত করে যেটি পরিণামে একটি প্রাণির গঠনের দিকে ধাবিত হয়, যেটিতে কোষসমূহের একটি সমসত্ত্ব সমাহারের পরিবর্তে বরং একটি হেড এন্ড ও একটি টেইল এন্ড বিদ্যমান থাকে। এবং এটি কদাচিৎ নেতির নেতিকরণের সাথে অধিকতর সদৃশ হতে পারে।
যাহোক, প্রকৃতিতে হেগেলের আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণসমূহ লক্ষ্য করে যথেষ্ট যোগসূত্র পাওয়া যায় না, যাতে কীভাবে বিজ্ঞানীবৃন্দ এই নিয়মাবলী আদৌ ব্যবহার করতে পারে। যদি বিজ্ঞানীবৃন্দ এই ধারণা থেকে শুরুকরণে প্রত্যাশা করেন যে তাঁরা বাইরে যাবেন এবং তাঁদের কাজে নিয়মাবলীর উদাহরণসমূহ অন্বেষণ করবেন (যেটি ক্রিস হারমান অনুমোদন দেননি), তাহলে এটি দ্বান্দ্বিকতাকে একটি বৃদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। উল্লেখিত সকল বিজ্ঞানীবৃন্দ বিবৃত করেন যে যখন তাঁরা ল্যাবে যান তখন অন্যরা যা করেন সেইভাবেই একই পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে একই বিজ্ঞান তাঁরা করেন। ঐ পরীক্ষণসমূহ না করার কৈফিয়তের পরিবর্তে বরং তাঁদের পরীক্ষণসমূহের ফলাফল ব্যাখ্যাকরণে দ্বান্দ্বিকতা তাঁদের জন্য এক উপায়। সুনির্দিষ্ট বস্তুগত প্রপঞ্চগুচ্ছের (material phenomena) জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য দ্বান্দ্বিকতার নিয়মাবলী জানার কোনো বিকল্প নেই।
উপসংহার
বিজ্ঞান ও প্রকৃতি থেকে উদাহরণ ব্যবহার করে আমরা প্রায়ই দ্বান্দ্বিকতা ব্যাখ্যা করি। কিন্তু একটি অভিমত প্রচলিত আছে যে এই সমস্ত ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতা প্রাসঙ্গিক, এটি সার্বিকভাবে গৃহিত হয়নি। অনেক মার্কসবাদী প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি ঐতিহ্য বিদ্যমান আছে যেটি পুঁজিতান্ত্রিক ভাবাদর্শের অংশ হিসেবে সমাজ থেকে প্রকৃতির পৃথককরণ দেখে। আমরা যদি সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যকার বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করি এবং একমত পোষণ করি যে দ্বান্দ্বিকতা সমাজ সম্পর্কে কিছু একটা দেখায়, তখন কী আমরা সাঙ্গতিকভাবে য্ুিক্ত প্রদর্শন করতে পারি যে প্রকৃতি সম্পর্কে এর বলার কিছু নেই?
মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিকতা একটি বস্তুবাদী দর্শন। এটি দুনিয়াকে এমনভাবে বিবেচনা করে যেন এটি পরিবর্তনশীল, কারণ এটির পরিবর্তন সংঘটিত হয়, এবং পরস্পর-বিরোধাত্মক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এটি পরস্পরবিরোধী। প্রাকৃতিক জগৎ প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৯৫৮এ পরিমাপ আরম্ভ হওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম বারের মতন বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনমাত্রা ৪০০ পিপিএম অতিক্রম করেছে। বায়ুমন্ডলে গ্যাসের লেভেলসমূহ উঠা-নামা করে, কিন্তুু এটি সম্ভব যে তারা শীঘ্র একটা পর্যায়ে পৌঁছবে যেখানে তারা একমূখী পরিবর্তনের কারণ সংঘটিত করবে। যদি সাইবেরিয় পারমাফ্রস্টের গলন শুরু হয়, বিজ্ঞানীবৃন্দ অনুমান করেন যে এটি ফ্রস্টের অভ্যন্তরস্থ আটকে পড়া মিথেনের নিঃসরণের দিকে ধাবিত করতে পারে। মিথেনও একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের থেকেও অধিকতর শক্তিশালী, সুতরাং এটি অধিকতর উষ্ণায়নের দিকে ধাবিত করতে পারে এবং সম্ভবত এতে আরো অবদান রাখে এবং ফ্রস্টের গলন সংঘটিত করে। এমনটি নয় যে দুনিয়া আর কখনো পূর্বে এই রকম উষ্ণ হয়নি, এটি অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু এই ফলাফলসহ বাসকৃত জনগণের জন্য এটি ধ্বংসাত্মক পরিণাম বয়ে আনবে। মনুষ্যজন এই পরিবর্তনসমূহ সংঘটিত করছে এবং আমাদের সমাজসমূহের সাথে সম্পর্কস্থাপন ব্যতিরেকে সেগুলো সংবেদ্যতার সঙ্গে উপলব্ধি করা যাবে না।
আমাদের বাসকৃত দুনিয়ার বাস্তবতা উপলব্ধিকরণকে পৃথক পৃথক উপাদানসমূহে বিভক্ত করা যেতে পারে এবং যেন এতে বিদ্যমান সবকিছু একই রকম থাকে, এতে আমরা আমাদের উপলব্ধি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে পড়ে যাই। কিন্তু আমরা মার্কসবাদীগণ কেবলমাত্র দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যা করি নে; আমরা ঐ বাস্তবতাকে পরিবর্তন করি। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির সাথে আমাদের চলতি সন্দেহযুক্ত চিড়কে (problematic rift with nature) দেখে শ্রেণী সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সবকিছুর মতন একটা কিছু যা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
৯ জানুয়ারি ২০১৪এ পোস্টকৃত, ইন্টারন্যাশনাল সোস্যালিজম অনলাইন, সংখ্যা ১৪১
কিছু মানুষজন যুক্তি দেন যে এঙ্গেলস এটি প্রস্তাব করে মৌলিকভাবে ভুল করেন। তাঁরা বলেন যে তিনি মার্কসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি উপলব্ধি করতে পারেননি অথবা এটিকে বিকৃত করেন সামাজিক বা ঐতিহাসিক প্রশ্নাবলীর বাইরে প্রসারিত করে। ১৯৬০এর দশকে জর্জি লিখথেইম (George Lichtheim) লিখেছিলেন, যখন অনেক একাডেমিয় মার্কসবাদী স্তালিনবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা থেকে মার্কসবাদকে উদ্ধারকরণের উপায় অন্বেষণ করছিলেন, তিনি যুক্তি দেন যে এঙ্গেলসই সমস্যা। লিখথেইম এবং অন্যান্য বামপন্থীদের ধারণা এই যে প্রকৃতিতে কতগুলো নিয়ম”বিদ্যমান যা নিচ থেকে সমাজতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই নিয়মগুলো ইঙ্গিত দেয় যে প্রকৃতি এবং পরিণামে মানব সমাজ একটি পূর্বনির্ধারিত গতিপথ অনুসরণ করে। এবং যদি ইতিহাস পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে এতে শ্রমিক শ্রেণীর সচেতন ক্রিয়ার কোন ভূমিকা নেই। যদি আমরা দ্বান্দ্বিকতাকে তিনটি নিয়মের একটি সেট হিসেবে পুঞ্জিভূত করি, তবে আমরা মূর্ত বাস্তবতা থেকে এর বিচ্ছেদের বিপদ টেনে আনি, যেটি থেকে এটি উদ্ভূত বলে গণ্য করা হয়। প্রকৃতিতে নিয়মাবলীর প্রয়োগ ধারণাবলী ও বাস্তবতার মধ্যেকার একটি দ্বৈততান্ত্রিক পার্থক্য সুপারিশ করে, যেখানে একটি আর একটিকে নির্ধারিত করে। কীভাবে এটিকে মার্কসবাদের একটি কনসেপশনের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়, যাতে তত্ত্ব ও অনুশীলনের ঐক্যের জন্য যুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০এর দশকসমূহে নানা প্রবণতার বামপন্থী একাডেমিশিয়ানগণ এটি মেনে নেন যে সমাজতন্ত্রের স্তালিনিয় ব্যাখ্যার মূলে ছিলো এঙ্গেলসের ধারণাবলী, অর্থাৎ এমন একটা কিছু যা সমাজের উপর থেকে এলিটগণ কর্র্তৃক শ্রমিক জনতার নিকট হস্তান্তর করা যায়। মার্কসবাদী ঐতিহ্যে এঙ্গেলসের অবদানকে সামগ্রিকভাবে বাতিল করতে কিছু লোকজন এমনকি তাঁর মন্তব্যসমূহ উদ্ধৃত করেন। উদারহণস্বরূপ, অধিকতর সাম্প্রতিক সময়ে লিঙ্গ বিষয়ের লেখকগণ একইভাবে দেখতে পান যে মার্কসের দ্যোতনাপূর্ণ অবস্থান (nuancedposition) সহজে গ্রহণ করা যায়, যেখানে এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যত বিজ্ঞানকৃত ও নির্ণয়বাদী (scientistic and deterministic)।
যাহোক, এটা মনে হয় না যে মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের জীবনকালে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির প্রশ্নাবলীতে মৌলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করতেন। পরবর্তী জীবনে তাঁরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের শ্রম বিভাগ তৈরী করেন, যাতে এঙ্গেলস বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন, অন্যদিকে মার্কস পুঁজি গ্রন্থ লিখনে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁরা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে দেখা করতেন, বিশেষ করে এঙ্গেলস ১৮৭০এ লন্ডনে চলে আসেন, এবং তাঁরা তাঁদের কাজ নিয়ে বিস্তারিতভাবে নিয়মিত আলোচনা করতেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে এমন কোনো লিখিত পত্রাবলী নেই যা দিয়ে এটা বাতলানো যায় যে তাঁরা ভিন্নমত পোষণ করতেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসলে এটা বলা যায় না যে মার্কস বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পুঁজি গ্রন্থের কোনো বিষয় ব্যাখ্যাকরণে তিনি প্রায়ই রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান থেকে উদাহরণসমূহ নির্বাচন করতেন। দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যাকরণে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের উপবৃত্তাকার গতি ব্যবহার করেন এবং জৈব রসায়নের উল্লেখ করতেন। মার্কস ব্যাখ্যা করেন যে একটি যৌগের রাসায়নিক সংগঠনে কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন বিভিন্ন মাত্রায় যোগ করে মাত্রিক পরিবর্তন সংঘটিত করলে গুণগতভাবে বিভিন্ন ধর্মাবলী বিশিষ্ট নতুন বস্তুসমূহের উদ্ভব ঘটে।
এটা যদিও সত্য যে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৫এ এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রকাশিত হওয়ার পর তা সেখানে প্রভাবদায়ী ছিল। স্তালিনপন্থীগণ দ্বান্দ্বিকতার যে সংস্করণটি ব্যবহার করেন তা এঙ্গেলসের তিনটি নিয়মের অনমনীয় প্রয়োগের সাথে বাধাঁ ছিল। স্তালিন কর্তৃক নিয়মগুলো বারবার পুনরাবৃত্ত হয় এবং এটা মনে হয় যে তাঁর অনুসারীগণ সম্পূর্ণ অসমালোচনীয়ভাবে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণা গ্রহণ করেন। যে সমস্ত অধ্যাপকবৃন্দ পূর্বে ইন্সটিটিউশনসমূহের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা তাঁদেরকে কনিষ্ঠ সহযোগীবৃন্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত দেখতে পেলেন। এই কনিষ্ঠ সহযোগীবৃন্দ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বা এর স্তালিনিয় ব্যাখ্যার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করেন। পূর্বতন অনেক শ্রদ্ধাভাজন বিজ্ঞানীবৃন্দ নিজেদের বন্দীকৃত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং এমনকি অনেককে হত্যা করা হয়। ত্রোফিম লাইসেনকো ইন্সটিটিউট অব জেনেটিকসের প্রধান নিযুক্ত হন, তিনি জেনেটিকসকে একটি বুর্জোয়া বিচ্যুতি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। বিজ্ঞানের ওপর এই আক্রমণগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে বলশেভিকিকরণের ব্যাপক প্রণোদনার অংশ। একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে বহাল রাখার তবিয়তে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষায়িত প্রয়োজনাবলীর সহগামী হতে বিজ্ঞানকে বাধ্যকরণে এটা ছিল অংশত একটি প্রচেষ্টা। খাঁটি বিজ্ঞানের জন্য আর কোনো সময় ছিলো না। বিজ্ঞানীবৃন্দকে তাঁদের কাজের নায্যতা প্রতিপাদন করতে হতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য স্তালিনের পাঁচশালা পরিকল্পনাসমূহের সাথে এর সঙ্গতিপূর্ণতা প্রদর্শন দ্বারা। কিন্তু এর নিজের নাগরিকদের নিকট এবং পশ্চিমে এর সম্ভাবনীয় সহানুভূতিশীলদের নিকট প্রোলেতারিয়েতের স্বার্থে সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত সমাজ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের নায্যতা প্রতিপাদনে এটা ছিল একটি ভাবাদর্শিক প্রচেষ্টার অংশ।
সুতরাং বিজ্ঞানকে অধিকতর দ্বান্দ্বিক হতে বাধ্যকরণের এই মর্মান্তিক প্রচেষ্টায় এঙ্গেলস অনভিপ্রায়িকভাবে একটি ভূমিকা পালন করে থাকতে পারেন। কিন্তু দ্বান্দ্বিকতার প্রতি একটি মতান্ধিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন ছিল এঙ্গেলসের অভিপ্রায়িত শেষ বিষয়। এবং, অবশ্যি, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা ছিল একটি অসমাপ্ত কাজ, এক সারি নোটের সমাহার যেগুলো তিনি বিবেচনাকররূপে সংশোধন করতে পারতেন, যদি তিনি নিজে এটিকে প্রকাশ করতে পারতেন। মার্কসবাদ ও বিজ্ঞানের দর্শন-এ হেলেনা শিহান যুক্তি দেন যে বিষয়টির ওপর তাঁর কাজকে বরং চুড়ান্ত অর্থ না ধরে এই ক্ষেত্রে এটিকে একটি সূচক হিসেবেই অধিকতররূপে দেখা উচিত। বিজ্ঞানের ওপর এঙ্গেলসের নিজের মন্তব্যও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে, সেটি লুদভিগ ফয়েরবাখ-এ। এখানে তিনি হেগেলের দর্শনের সম্ভাবনীয় কেজো অবদান আলোচনা করেন, যা থেকে তিনি তিনটি নিয়ম আহরণ করেন, এবং হেগেলের কিছু রক্ষণশীল ব্যাখ্যাবলী প্রত্যাখ্যান করেন। এঙ্গেলস বিবৃত করেন: তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে, হেগেলিয় ব্যবস্থার সমগ্র মতান্ধিক আঁধারকে চরম সত্য বলে ঘোষণা করা হয়, যা সকল মতান্ধতন্ত্রকে দ্রবীভূত করে। এইভাবে তাঁর বিপ্লবী দিক চাপা পড়ে যায় রক্ষণশীল দিকের অতিবৃদ্ধির নীচে।
এখানে এটি প্রতীয়মান, তিনি বলছেন যে হেগেলের নিয়মগুলো উম্মুক্ত থাকা উচিত মূল্যায়ন এবং পুনঃব্যাখ্যায়নের জন্য। তারা নিয়মগুলোর একটি অনড় সেট নয়। যাহোক, এটি বলা যায় না যে তিনি দ্বান্দ্বিকতাকে পুরোপুরি একটি পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করতেন। এটিও স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, কমপক্ষে এঙ্গেলসের দিক থেক গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে দুনিয়া সম্পর্কে চিন্তনের প্রক্রিয়াসমূহকে আমরা যে দুনিয়াকে অধ্যয়ন প্রয়াসী তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করতে পারিনে।
লুকাস এবং সমাজের দ্বান্দ্বিকতা
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার বিরুদ্ধে হাঙ্গেরিয় মার্কসবাদী গিয়র্গ লুকাসের কাজ ছিল বিশেষভাবে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। মার্কসিয় দর্শনের ব্যাবহারিক প্রয়োগের ব্যাপারে লুকাস উৎসাহী ছিলেন, যেখানে দ্বান্দ্বিকতা ছিল বিপ্লবের জন্য একটি বাহন। লুকাসের ধারণাবলী চমৎকারভাবে পরিবর্তন হয়েছে তাঁর সারাজীবন ব্যাপী এবং তাঁর চিন্তনকে বিস্তারিতভাবে এখানে উপস্থাপন অসম্ভব। যাহোক, দ্বান্দ্বিক দর্শনের প্রতি তাঁর প্রথম দিককার দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে স্পষ্টায়িতভাবে এসেছে তাঁর ধ্রুপদী কাজ ইতিহাস এবং শ্রেণী সচেতনতা-তে। ভিয়েনাতে নির্বাসনরত অবস্থায় ১৯২৩এ এটি প্রকাশিত হয়। লুকাস বেলা কুনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন, যদিও বামদের ওপর আধিপত্য ছিল অধিকতর বৃহত্তর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। অ্যাডমিরাল হোরথি দেশটির দখল নিলে, তিনি হাঙ্গেরি থেকে পালাতে বাধ্য হলেন। হোরথি কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ করেন এবং হত্যা করেন এবং তাঁদের হাজার হাজার সমর্থকদের বন্দী করেন।
লুকাস যুক্তি দেন যে আমরা আমাদের চারপাশের দুনিয়ার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনে। আমরা একটি বুর্জোয়া সমাজে বাস করি এবং চিন্তা করি যেটি আমাদের ধারণাবলীকে বিকৃত করে। পুঁজিতন্ত্রের অধীনে আমাদের নিকট সবচেয়ে দরকারী অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রী পণ্যের রূপ ধারণ করে যা টাকার মাধ্যমে বিনিময়যোগ্য। সুতরাং, পণ্যসামগ্রীর বস্তুগত বৈশিষ্ট্যাবলী, এবং সেগুলোর সামাজিক উৎসাবলী আড়ালকৃত হয় এবং কেবলমাত্র একটি বৈশিষ্ট্য প্রাসঙ্গিক হয়, আর তাহলো বাজারে সেগুলোর দাম। মার্কস যুক্তি দেন যে পণ্যসামগ্রীর পুঁজিতান্ত্রিক বিনিময় এর নিজস্ব যুক্তি (logic) অনুসরণ করে- এবং অনিবার্যতার একটি বোধ (a sense of inevitability) দিতে পারে। লুকাস যেমনটি ইতিহাস ও শ্রেণী সচেতনতা গ্রন্থে বলেন:
বিষয়গতভাবে বিষয়সমূহের দুনিয়া (world of objects) এবং বস্তুসামগ্রীর মধ্যেকার সম্পর্কাবলী হঠাৎ অস্তিত্বমান হয় (পণ্যসামগ্রীর দুনিয়া এবং বাজারে তাদের সঞ্চালন)। এই বিষয়সমূহের নিয়ন্ত্রণাধিকারী নিয়মাবলী প্রকৃতপক্ষে মানুষ কর্তৃক ক্রমাগতভাবে আবিষ্কৃত, কিন্তু তারপরেও তারা তার সাথে মুখোমুখি হয় অদৃশ্য শক্তিনিচয় হিসেবে, যা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা উৎপন্ন করে।
সুতরাং আমরা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চিন্তা করি এক সারি বিষয়সমূহ দ্বারা তৈরীকৃত ব্যবস্থা হিসেবে। এই বিষয়সমূহ একে অপরের সাথে সম্পর্কায়িত, কিন্তু এটি অধিকতর জটিল বাস্তবতাকে আড়াল করে। লুকাস যুক্তি দেন যে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এমন চমৎকারভাবে উপলব্ধিকরণে সক্ষম যে তা বুর্জোয়া শ্রেণী পারে না। এর কারণ হলো পুঁজিতন্ত্রকে প্রবহমান রাখতে আমরা নিজেরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের শ্রম ক্ষমতা দামের জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর নিকট বিক্রয় করি, সুতরাং শ্রম সম্পাদনে আমাদের সক্ষমতা, তা একভাবে বিষয়কৃত হয় এবং পণ্যে রূপান্তরিত হয়। কীভাবে পুঁজিতন্ত্র কাজ করে, প্রোলেতারিয়েত ঠিক তা বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করে না, বরং পুঁজিতন্ত্রের ভেতরে ক্রিয়া করে। শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে এবং অনুশীলন থেকে অবিচ্ছেদ্যভাবে তত্ত্বকে অবলোকনে লুকাস মার্কসকে অনুসরণ করেন: বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা হলো একটি বিপ্লবী দ্বান্দ্বিকতা, আমাদের বাসকৃত সমাজে কার্যকর প্রক্রিয়াসমূহ অনুধাবনে তা একটি উপায় কেবলমাত্র নয়, সঙ্গে সঙ্গে ঐ সমাজকে পরির্তনের জন্য একটি হাতিয়ারও বটে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা উদ্ঘাটনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকার ওপর লুকাস মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। সমাজে দ্বান্দ্বিকতার ওপর প্রায় একচেটিয়া গুরুত্ব আরোপনে তাঁর প্রকৃতির বিষয়ে সামান্যই বলার ছিল। লুকাসের মতানুসারে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণী ইতিহাসের বিষয়ী ও বিষয় ((subject and object of history) উভয় হিসেবে যে চমৎকার ভূমিকা পালন করে, সেটি প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন অভিমুখ যেমন প্রাণি জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, প্রস্তুরসমূহ, ইত্যাদি সেই একই ভূমিকা পালন করতে পারে না। তারা শ্রেণী সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে না।
এটা প্রায়ই অনুমানকৃত হয় যে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে লুকাস সামগ্রিকভাবে বাতিল করে দেন একটি অনুমানের ওপর। এই অনুমানটির জন্য অনেকখানি দায়ী ইতিহাস ও শ্রেণী চেতনা গ্রন্থের অনুগামী প্যাসেজটি: এঙ্গেলস কর্তৃক দ্বান্দ্বিকতার উপস্থাপন থেকে ভুল উপলব্ধি মূলগতভাবে এই ঘটনায় নিহিত যে এঙ্গেলস হেগেলের ভ্রান্ত উদাহরণ অনুসরণে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে প্রকৃতির জ্ঞান অবধি সম্প্রসারণ করেন। যাহোক, লুকাস সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে জন রিজ প্রশ্ন তোলেন। আমাদের সমাজ অধ্যয়ন পদ্ধতিসমূহের সাথে আমাদের প্রকৃতি অধ্যয়ন পদ্ধতিসমূহের সমীকৃতকরণের জন্য লুকাস এঙ্গেলসের সমালোচনা করেন। লুকাসের ক্ষেত্রে, একজন দূরবর্তী, বিষয়গত পর্যবেক্ষক হিসেবে সমাজ অধ্যয়নের দিকে আমরা অভিগমন করতে পারি না, যেমনটি আমরা (অনুমানসিদ্ধরূপে) প্রকৃতির দিকে পারি। আমরা সমাজের অংশ, সুতরাং আমরা এটাকে ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ করি। এটা প্রয়োজনগতভাবে অনুমান করবার দরকার নেই যে প্রকৃতির কোনো দ্বান্দ্বিকতা নেই। যাহোক, মনুষ্যজনের সচেতন হস্থক্ষেপ ছাড়া প্রকৃতিতে উদ্ভূত যেকোনো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিসমূহ সমাজ পর্যবেক্ষণে পদ্ধতিসমূহ থেকে পৃথক হবে। এটাও যথার্থভাবে স্মরণীয় যে ১৯২৩এ লুকাস প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অধ্যয়ন নাও করে থাকতে পারেন এবং বিশেষ করে ঐ টেক্সটে একারণে সাড়া নাও দিয়ে থাকতে পারেন, যেটি তখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
প্রকৃতি দ্বারা আমরা কি বুঝি?
পরবর্তীতে সমালোচকবৃন্দ প্রশ্ন করেন যে প্রাকৃতিক জগৎ থেকে ঘেরাওকৃত ও পৃথক করে মানব সমাজকে অধ্যয়ন করা যায় কিনা, যেমনটি লুকাস করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। আন্তোনিও গ্রামশি লুকাস সম্পর্কে বলেন যে যদি তাঁর অধিকার-খ্যাপন (assertion) প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি দ্বৈততা পূর্বানুমান করে, তবে তিনি ভ্রান্ত। যদি প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাতে কোনো কিছু আছে বলে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে এটা মনে হয় যে আমাদের প্রকৃতি এর কিছু ধারণা প্রকৃতপক্ষে কি অর্থ প্রকাশ করে সে সম্পর্কে কমপক্ষে একমত হওয়া প্রয়োজন। এই প্রশ্নটি প্রায়ই এধরনের যুক্তিসমূহ থেকে বের করে আনা হয় (left out of such arguments)। দ্বান্দ্বিকতা কি, এই ধারণার ওপর বিতর্ক সাধারণত কেন্দ্রীভূত থাকে এবং এটি বিতর্কিত থেকে যায়।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে প্রকৃতির ধারণা কঠিনই থেকে যায়। উইলিয়াম রেমন্ড এটিকে ভাষাতে সম্ভবতঃ সবথেকে জটিল শব্দ হিসেবে নির্দেশিত করেন। সুতরাং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার দেখা পাওয়া এই প্রবন্ধের পরিসীমার বাইরে। কিন্তু প্রকৃতি শব্দটি কি নির্দেশ করে সে সম্পর্কে অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল অনুমানসমূহের কতকগুলি সম্পর্কে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি।
আমার নিজের বিষয় ভূগোলে প্রকৃতি সম্পর্কে সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টি সঞ্জাত ধারণাবলীর কিছুটা বিকশিত হয়েছে। এটি সম্ভবত বিষয়টির ইতিহাস ঘটিত কারণে। ঐতিহ্যিক কারণে ভূগোলবিদগণ সেই সমস্ত মানুষ যারা দুনিয়া পরিভ্রমণ করেন, নানা মানব সমাজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরামর্শ দেন জনগণ যে পরিবেশে বাস করেন, সেটি কীভাবে এই সমাজগুলোকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আগের ভূগোলবিদগণ এই বর্ণতান্ত্রিক মিথটি প্রচার করেন যে উষ্ণ জলবায়ুতে বসবাসরত জনগণের দরিদ্র হবার ঝোঁক বিদ্যমান, কারণ জলবায়ু সংক্রান্ত অবস্থাবলী অলসতায় উৎসাহ যোগায়। আজকের দিনে (অধিকাংশ) ভূগোলবিদগণ অভিমতটির সমালোচনায় অধিকতর সোচ্চার, যেটি বলে যে সরল ও অনির্দিষ্টভাবে পরিবেশ সমাজকে প্রভাবিত করে । কিন্তু সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সম্পর্কে আগ্রহ এখনো বিদ্যমান। ভূগোল প্রায়ই বর্ণনাকৃত হয় একটি সেতুকৃত ডিসিপ্লিন হিসেবে, অংশত সামাজিক বিজ্ঞান, অংশত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।
এই প্রশ্নাবলীতে সুনির্দিষ্টভাবে একটি মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেয়া সবচেয়ে বিখ্যাত ভূগোলবিদদের এক ছিলেন প্রয়াত নেইল স্মিথ (যার ডক্টোরাল থিসিসটি একটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল: Uneven Development। স্মিথ যুক্তি দেন যে প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাবলীর অনেকগুলোকে শ্রেণী সমাজের ভাবাদর্শের সাথে এবং শ্রেণী সমাজের সুনির্দিষ্ট রূপ হিসেবে পুঁজিতন্ত্রের ভাবাদর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। মার্কস প্রকৃতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে আংশিক অন্তর্দৃষ্টিসমূহ রেখে গেছেন, তাতে সারবস্তু যোগ করাই তাঁর কাজের লক্ষ্য। আমরা প্রকৃতিকে দেখার প্রবণতা প্রদর্শন করি মানবতা থেকে বাহ্যিক কোনোকিছু হিসেবে। প্রাকৃতিক জগৎ হলো আমাদের নগরগুলোর প্রান্তসীমাসমূহের বাইরে অবস্থিত তেপান্তর, মানব হস্তক্ষেপ মুক্ত অদূষিত একটি স্বর্গ। প্রকৃতির এই প্রতিবিম্বগুলো অনেক গভীর সবুজ পরিবেশতান্ত্রিক চিন্তাবিদবৃন্দের ভাবাদর্শের কেন্দ্রে অবস্থিত। অবশ্যি, অনেক মানুষজন যারা নিজেদের বিবেচনা করেন পরিবেশতান্ত্রিক হিসেবে, তাঁরা মনুষ্যজনের কল্যাণের জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যাহোক, একটি বাহ্যিক প্রকৃতি সংরক্ষণের ভাবাদর্শ রাজনৈতিকভাবে অসহায়ক হতে পারে। এটি এই বিশ্বাসকে লালন করে যে মানুষের প্রয়োজনসমূহ প্রাকৃতিক দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহের বিপরীত, যেটি দেখা যেতে পারে লাগাতার এই যুক্তিটিতে যে প্রকৃতি রক্ষাকরণে আমাদের মানব জনসংখ্যা বৃদ্ধি সীমিত করা প্রয়োজন। ডেভিড এটেনবোরোর সাম্প্রতিক সময়ের মন্তব্যসমূহে এটি প্রদর্শিত হয় যে মানুষ হলো দুনিয়াতে প্লেগ। প্রকৃতিকে সংরক্ষণের অধিকতর ঊন আগ্রহী মানুজনই মানব সমাজ থেকে পৃথকীকৃত প্রকৃতির আদর্শ সমর্থন করে । টেকনোক্র্যাটিক চিন্তকগণ যুক্তি দেন যে আমরা প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারি। তাঁরা পরামর্শ দেন যে আরো সুক্ষ্মতর প্রযুক্তি উদ্ভাবন দ্বারা আমরা আমাদের সকল পারিবেশিক সমস্যাবলী সমাধান করতে পারি। পূর্বের মতন একই অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের সমাজসমূহ পরিচালনা করতে পারি এবং কেবলমাত্র বাহ্যিকভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে গণ্য করি। শোষণের জন্য প্রকৃতি আমাদের নিকট একটি স্বর্গ বা একটি উৎস যাই হোক না কেন, এটিকে এখনো সমাজ থেকে বাহ্যিক অস্তিত্বরূপে নির্দিষ্টায়িত (defined) করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ সবই প্রকৃতি-সমাজ দ্বৈততন্ত্রে অপরিহার্য (predicated)।
দ্বৈততন্ত্র একটি অপরিবর্তনীয় বা সার্বজনীন (unchanging or universal) প্রকৃতির ধারণাকেও লালন করে। বুর্জোয়া চিন্তকগণ যুক্তি দেন যে যেহেতু প্রকৃতি সমাজ থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান, তাই যা প্রাকৃতিক তা অবশ্যি পরিবর্তিত হবে না। সমাজ সম্পর্কে সবচেয়ে রক্ষণশীল ধারণাবলীর কিছুকে নায্যতা প্রদানকরণে প্রকৃতির কর্তৃপক্ষের (authority of nature) নিকট আবেদনকে ব্যবহার করা যেতে পারে। মানব স্বভাব কখনো পরিবর্তিত হয় না। প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন বিবাহকে সার্বিকভাবে একটি হেটারোসেক্সুয়াল প্রচেষ্টা হিসেবে, বিষয়সমূহের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলারও একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়। পুঁজিতন্ত্র সারা দুনিয়া চষে বেড়ায় প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ (natural resources) ধ্বংসকরণে নয়া পদ্ধতিসমূহ অন্বেষণের জন্য। কিন্তু এর আত্মপক্ষ সমর্থকগণ (ধঢ়ড়ষড়মরংঃং) জোর দেন যে তাঁদের জীবন যাত্রার পদ্ধতিটি অবশ্যি সংরক্ষণ করতে হবে চিরকালীনতার জন্য (for eternity)।
যদি বুর্জোয়াদের চিন্তাভাবনা প্রকৃতিকে একটি অস্পর্শনীয় বিরান ভূমি হিসেবে দেখে, তবে এটি কেবলমাত্র প্রকৃত অবস্থাকে অস্পষ্টকরণেই সহায়তা করে। মানব সত্ত্বা কেবলমাত্র দুনিয়াতে বসবাসই করে না, বরং দুনিয়ার ওপর প্রভাবও ফেলে।। নানা ধরনের সমাজ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে (treat) নানা পদ্ধতিতে। পুঁজিতন্ত্র প্রকৃতির প্রত্যেক দিককে ব্যবহারকরণের প্রবণতা দেখায় একটাকিছু হিসেবে যা সম্ভাবনীয়রূপে বাজারে বিনিময়ের জন্য পণ্যে পরিণত হয়। এর প্রভাব বলয়ের বাইরে কোনো প্রাকৃতিক জগৎ নেই। এমনকি প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা করে, আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি তার প্রয়োজনসমূহের ওপর ভিত্তি করে আমরা এটা সম্পর্কে চিন্তাকরণে বাধ্য হই একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। কিন্তু সাধারণত আমরা ঠিক প্রকৃতিকে গভীরভাবে চিন্তাই করিনে, বরং এটিকে মুনাফার একটি উৎস বা আমাদের বর্জের স্তুপ ফেলার একটি জায়গাতে রূপান্তরিত করি। স্মিথ যুক্তি দেন যে প্রাইস টাগরূপে , প্রত্যেকটি ব্যবহার-মূল্য একটি দাওয়াত পৌঁছে দেয় শ্রম প্রক্রিয়াতে, এবং পুঁজি-এর স্বভাবগত কারণে অতি দরকারী বিশিষ্ট সত্ত্বা (quintessential socialite) এবং প্রত্যেকটি দাওয়াত পণ্য তৈরীতে প্রণোদিত হয়। কার্বন বাজারের উত্থানে এটি বিস্মায়করূপে স্পষ্ট, আমরা যে বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেই, তাতে এটি একটি আর্থিক মূল্য কার্যকররূপে আরোপ করে। স্মিথ ও অন্যদের জন্য প্রকৃতির উৎপাদনের তত্ত্ব দ্বৈততান্ত্রিক ধারণাবলীর প্রতি একটি প্রতিষেধক। যদি যুক্তি দেওয়া হয় যে প্রকৃতি উৎপাদন করা হয়, তার অর্থ এই নয় যে আমরা মানবেরা আক্ষরিক অর্থে এর প্রত্যেকটি দিক সৃজন করি; আমরা পর্বতমালা তৈরি করিনে। যাহোক, আমরা আক্ষরিক অর্থে নয়া জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ (জিনগত পরিবর্তন দিয়ে) এবং নয়া বাস্তুসংস্থানসমূহ যেমন বিবনায়নের মাধ্যমে তৈরীকৃত জঙ্গলাৎ জমিসমূহ তৈরী করি। এটি বলা যেতে পারে যে আমাদের কর্মসমূহ পুরাতনটির মধ্যে একটি নয়া প্রকৃতি তৈরী করে। মার্কস যুক্তি দেন যে এমনকি তার কালে খুব কম তেপান্তর অবশিষ্ট ছিল। স্মিথকে উদ্ধৃত করে বলা যায়: প্রকৃতি ধারণার আধিপত্য শুরু হয় প্রকৃতি ও সমাজকে দুুটি পৃথক এলাকা হিসেবে গণ্য করে এবং তাদেরকে একীভূতকরণের প্রচেষ্টাসমূহ থেকে। মার্কসে আমরা বিপরীত প্রক্রিয়া দেখি। তাদের মধ্যে যে বিচ্ছিনতাই বিদ্যমান থাকুক না কেন, তিনি প্রকৃতির সাথে [সমাজের, অনু:] সম্পর্ক শুরু করেন একটি ঐক্য হিসেবে এবং যুগপৎ ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক ফলাফল (historical and logical result) হিসেবে আহরণ করেন।
প্রকৃতির প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকেই দ্বান্দ্বিক হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। পুঁজি-তে মার্কস কর্তৃক বিকশিত ও প্রয়োগকৃত (developed and employed) যে পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেন, ওলম্যান (Ollman) তাকে সাধারণীকরণের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ বলে অভিহিত করেন। সমগ্র বিশ্ব ব্রম্মান্ড জটিল এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল। সবকিছুই সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে একবারে চিন্তাকরণের চেষ্টা অসম্ভব। সুতরাং মার্কস দ্বান্দ্বিকতা ব্যবহার করেন একটি পদ্ধতি হিসেবে দুনিয়ার বিভিন্ন দিকের ওপর তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধকরণে। কখনো তিনি শরণ নেন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের পর্যায়ের প্রক্রিয়াসমূহে, কখনো অধিকতর সাধারণভাবে শ্রেণী সমাজের। কখনো তিনি তাঁর যুক্তিসমূহের ব্যাপ্তিকে অধিকতর বিশদায়িত করেন এই সুপারিশ করে যে তিনি যে বিষয়ের শরণ নেন তা প্রাকৃতিক দুনিয়ার সমগ্রের সাথে সম্পর্কিত। একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট তৈরীকরণে, উদাহরণস্বরূপ, পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যেকার সম্পর্ক ব্যাখ্যাকরণে যদি মনুষ্যজনের মাঝে কী ঘটে , ঠিক তার শরণ নেয়া হয়, তাহলে এটি প্রায়ই অর্থ বহন করে। কখনো পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী কী পদ্ধতিতে সম্পর্কিত, তা উল্লেখকরণে এটি অর্থ বহন করে, কিন্তু এই সম্পর্ক একটি ব্যাপৃত প্রেক্ষাপট, যাতে এটি অস্তিত্বশীল তা থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান নয়। ওলম্যানের জন্য, এটি এই যুক্তি সমর্থন করে যে এঙ্গেলসের মতন মার্কসের অভিপ্রায় ছিল যে দ্বান্দ্বিকতা কেবল সমাজে নয়, সমাজ ও প্রকৃতি উভয়টিতে প্রয়োগযোগ্য। কেউ একজন মানব সমাজ সম্পর্কে একটি বিশেষ যুক্তি তৈরীকরণে ব্যবহার করে থাকতে পারে, তার থেকে বরং মানব সমাজ যে সমগ্র প্রাকৃতিক জগতের অংশ, এটি পর্যবেক্ষণ হলো সাধারণীকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়সমূহকে দেখা।
সমাজ ও প্রকৃতি একে অপরের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত, সে সম্পর্কে খুব বেশী প্রশ্ন তখন মার্কস ও মার্কসবাদীদের সামনে ছিল না। পরিবর্তে আমাদের প্রশ্ন করা উচিত কীভাবে সমগ্রের এই দুটি দিক আদৌ পৃথকীকৃত হয়ে গেল প্রথম পর্যায়ে। জন বেলামি ফোস্টার এই পয়েন্টটি নেন, যিনি মার্কসের মেটাবোলিক ফাটলের ধারণা (concept of a metabolic rift) পুনরুদ্ধার করেন। মার্কস যুক্তি দেন যে আমাদের চারপাশের দুনিয়ার সাথে মানব সত্ত্বাসমূহ মেটাবোলিক উপায়ে মিথষ্ক্রিয়া করে। আমাদের কাজকরণের এবং আমাদের শ্রম শক্তি ব্যবহারকরণের সামর্থ্য এই মিথষ্ক্রিয়াকে সহজতর করে। পুজিঁতন্ত্র শ্রম শক্তিকে পণ্যায়িত করে এবং এটিকে মুনাফার উৎসে রূপান্তরিত করে। এটি যুগপৎ মানবতা ও প্রকৃতির মধ্যে একটি মেটাবোলিক ফাটল সৃজন করে। সুতরাং, এটি যুক্তি দেয়া হয় যে ফাটল ঐতিহাসিক আকস্মিক একটা কিছু, যেটি বিকশিত হয় পুঁজিতন্ত্রের বিকাশের সাথে। পুঁজি খন্ড তিন-এর একটি প্যাসেজে মার্কস বর্ণনা করেন কীভাবে পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্ট শর্তাবলী প্ররোচিত করে সামাজিক মেটাবোলিজমের স্বাধীন প্রক্রিয়াতে একটি অমেরামতযোগ্য ফাটল তৈরীকরণে, যে মেটাবোলিজমটি নির্দিষ্টায়িত হয় স্বয়ং জীবনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী দিয়ে”। এই প্যাসেজে মার্কস ঘোষণা করেন যে প্রকৃতি হিসেবে একটি বিষয় বিদ্যমান ( এবং প্রস্তাবকরণে এতদূর যান যে সেখানে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী বিদ্যমান)। তিনি প্রকৃতিকে দেখেননি চরম অর্থে সম্পূর্ণত সামাজিকভাবে গঠনকৃত হিসেবে, যেভাবে পদটি কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়। যেন সমাজ থেকে পৃথক এভাবে প্রকৃতি/জীববিজ্ঞান এর ওপর সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ নিবদ্ধকরণ হলো মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু যদি এ দুটি অপৃথকায়িত হয় তবে একজনের সমীকরণের সামাজিক পক্ষের ওপর সম্পূর্ণরূপে মনোযোগ এবং প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে সমাজ কৃর্তক নির্ণীত হিসেবে পর্যবেক্ষণ, এভাবে ফোকাসকরণ সমস্যাকীর্ণ।
যদি আমরা প্রকৃতি তৈরী করি তবে আধিপত্য বা ব্যবস্থাপনার (domination or management) চেয়ে এর সাথে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর জটিল। যাহোক, এটি এই অর্থও করে যে আমরা যে উপায়ে প্রকৃতি সৃজন করি তা পরিবর্তন করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রজাতি নিশ্চিহ্নকরণের মতন প্রক্রিয়া নিচয় প্রতিরোধকরণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত, কিন্তু কল্পনা করা উচিত নয় যে যা আমরা করছি তা মানব অস্তিত্বের পূর্বেকার কিছু একটা কল্পিত প্রাকৃতিক অবস্থায় পরিবেশকে পুনরুদ্ধারকরণ নয়। পরিবর্তে আমাদের প্রকৃতি সৃজনের পদ্ধতির ওপর মনোযাগ নিবদ্ধ করা উচিত , কী উদ্দেশ্যাবলী এবং কাদের আগ্রহে- এগুলোর দিকে। নেইল স্মিথ এই হতাশতান্ত্রিক যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন যে মানবতা সবসময় পরিবেশ শোষণ করবে। সাধারণ জনগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণকৃত প্রকৃতি উৎপাদন ভিত্তিক সমাজতন্ত্রের জন্য তিনি যুক্তি দেন। যদি আমরা দ্বান্দ্বিকতাকে দেখি কেবলমাত্র সমাজে অস্তিত্বমান হিসেবে, তাহলে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে জোরদারকরণের ঝুঁকি নেই যে প্রকৃতি একটি সামগ্রিকভাবে পৃথক ক্ষেত্র, এটি এক ধরণের দ্বৈততন্ত্র যা বিরুদ্ধে নেইল স্মিথ, জন বেলামি ফস্টার এবং অন্যান্যরা যুক্তি দেন। কেন গ্রামশির মতন মানুষজন লুকাসের প্রকৃতি ও সমাজ পৃথককরণের প্রচেষ্টার প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তার কারণ সম্ভবত এই দ্বৈততন্ত্র। যাহোক, যদি এই প্রকৃতি সম্পর্কে লুকাস ভ্রান্ত হন, তাহলেও এটি বলা যায় না যে তাঁর ধারণাবলী প্রগতিশীল পরিবেশতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অকেজো। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে প্রশ্নাবলী উত্থাপনে লুকাস, গ্রামশি এবং ফরাসি মার্কসবাদী দার্শনিক হেনরি লেফেবব্রে (Henri Lefebvre) এর মতন মার্কসবাদী চিন্তকদের ধারণাবলী প্রয়োগ করেন সাম্প্রতিক কালের চিন্তকেরা, বিশেষত ভূগোলবিদগণ।
মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যেকার সম্পর্ক অথবা এমনকি প্রকৃতির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের চেয়ে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ওপর বিতর্কাবলীর একটি ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে মার্কসবাদী তত্ত্বের জন্য। মার্কসবাদ কী ধরণের দর্শন এবং ঐ দর্শন কিসের জন্য ব্যবহার করা হয় বলে ধরে নেয়া যায়- এ সম্পর্কে প্রশ্নাবলীর মূলে এটি নিয়ে যায়। দুনিয়াটা কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিষয় উপলব্ধিকরণে এঙ্গেলস চেষ্টারত ছিলেন বলে মনে হয়। বাস্তবিক বস্তুগত প্রক্রিয়াবলীর বয়ান হিসেবে তিনি দ্বান্দ্বিকতাকে দেখেন। যখন তিনি বলেন পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়, তখন এটি ঠিক এই অর্থ প্রকাশ করে না যে দুনিয়াটাকে বিবেচনাকরণে যেন এটি সংঘটিত হয় অথবা দুনিয়াটাকে এইভাবে চিন্তাকরণে এটি একটি কেজো পদ্ধতি। তিনি মনে করেন যে এটি প্রকৃত পক্ষে এইভাবে ক্রিয়া করে। সব দার্শনিক একমত হন না যে চিন্তনরত ব্যক্তির মনের বাইরে দুনিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান। এবং ঐ দুনিয়াটা কীভাবে কাজ করে এ সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধিকরণের প্রচেষ্টাটির ক্ষেত্রে দর্শনের জন্য একটি সার্বজনীন গৃহিত ভূমিকা নেই। অনেক চিন্তকদের জন্য এই যুক্তি দেয়ার প্রচেষ্টাটি এতদূর উচ্চাভিলাষী যে বাস্তবতা পরিচালনাকারী নিয়মাবলী অথবা প্রক্রিয়াবলী বিদ্যমান আছে এবং আমরা এই নিয়মাবলী উপলব্ধিতে সক্ষম।
যাহোক, দর্শনের প্রতি এই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক প্রশ্নাবলীতে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কস তাঁর ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিসে একমত পোষণ করেন যে “ অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তনের বাস্তবতা বা না-বাস্তবতা (reality or non-reality of thinking)এর ওপর বিতর্ক (dispute) হলো একটি পুরোপুরি পন্ডিতীয় প্রশ্ন (a purely scholastic question)। যদি আমরা দুনিয়া পরিবর্তনে লক্ষ্য স্থির করি, তবে এই যুক্তির ওপর দাঁড়াতে হবে যে আমাদের দুনিয়াটা অস্তিত্বমান, এ বিষয়ে একমত হওয়া উচিত। এবং ঐ দুনিয়াটা উপলব্ধিকরণের প্রচেষ্টার প্রকল্পটি আমাদের ঐকান্তিকভাবে নিতে হবে। অবশ্যি, মার্কসবাদ হলো দুনিয়াটিতে হস্থক্ষেপকরণ, কেবলমাত্র এটি ব্যাখ্যাকরণ নয়। কিন্তু মার্কসের জন্য, এ দুটি অবিচ্ছিন্ন। আমরা এতে হস্থক্ষেপের মাধ্যমে দুনিয়াটা ব্যাখ্যা করি এবং আমাদের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে হস্থক্ষেপ করি।
কেন অধিক দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞানী নেই?
কিন্তু যদি প্রাকৃতিক জগতে প্রকৃত দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াবলী কাজ করে, তবে এটি এই প্রশ্ন উত্থাপন করে যে কেন কেবলমাত্র প্রকৃতি অধ্যয়নরত স্বল্প সংখ্যক বিজ্ঞানী এটিকে স্বীকার করেন। কেন অধিক সংখ্যক দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞানী নেই। প্রতি-জবাব দেয়া যায় যে অনেক যুক্তিনিচয় বিদ্যমান, কেবল বিজ্ঞানে নয়, যেখানে মার্কসবাদীগণ অনুভব করেন যে তাদের ধারণাবলী সঠিক, কিন্তু সেখানে অধিকাংশ জনগণ ভিন্নমত পোষণ করেন। কেন অধিক সংখ্যক অর্থনীতিবিদ নেই যারা মুনাফা হার হ্রাসের প্রবণতা গ্রহন করেননি।
আমরা প্রায়ই ধরে নেই যে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ। অন্য কথায়, আমরা চিন্তাকরণের প্রবণতা দেখাই যে যখন বিজ্ঞানীবৃন্দ প্রাকৃতিক জগৎ পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের অন্বেষণের পদ্ধতিসমূহ তাঁদের সুযোগ করে দেয় দুনিয়ার একটি বিষয়গত উপলব্ধি অর্জনে, যেটি আমরা অবশিষ্টাংশরা পারি নে। যাহোক, বিজ্ঞানীবৃন্দ সমাজের বাইরে বসবাস করেন না। গবেষণায় মনোযোগের দাবীদার তাঁদের তত্ত্বনিচয়, এমনকি প্রশ্নাবলীর ধরনসমূহ, প্রতিফলিত করে তাঁরা যে সমাজে বাস করে এবং কাজ করে, সেই সমাজের প্রকরণ। সুতরাং বলা যায় যে বিজ্ঞানীবৃন্দ বাস্তবিক জগৎ (real world) পর্যবেক্ষণ করেন একটি সামাজিক প্রিজমের মাধ্যমে, যেটি তাঁদের দৃষ্টিকে বিকৃত করে। লুকাস শনাক্ত করেন যে পুঁজিতন্ত্র প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন অংশকে বাজারে বিনিময়ের জন্য পণ্যে রূপান্তরিত করে। উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধিকরণ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীবৃন্দ উদ্ভিদের পাতার রুবিস্কো নামক একটি এনজাইমের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন ঐ এনজাইম যাতে অধিকতর দক্ষভাবে কাজ করে, এতে চুড়ান্তভাবে তাঁরা একটি উদ্ভিদ ইঞ্জিনিয়ার করতে পারে। বর্তমান ভ্যারাইটির তুলনায় এই উদ্ভিদটি অধিকতর শস্য উৎপাদন করবে কৃষকদের জন্য। এটি দেখা সম্ভব হয় কীভাবে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা বিজ্ঞানকে উৎসাহিত করে থাকতে পারে একটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির পরিবর্তে রিডাকশনিস্ট পদ্ধতিতে দুনিয়া পর্যবেক্ষণে। ফিল জেসপার যুক্তি দেন যে পুঁজিতান্ত্রিক বিজ্ঞানে রিডাকশনিজমের প্রতি প্রবণতা প্রতিফলিত করে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ (individualism) এর আধিপত্য। প্রক্রিয়াবলীর জটিল হিসেবে এই এনজাইমটির উৎকর্ষায়নের প্রচেষ্টাকরণ অথবা এর পরিবেশের সাথে ঐতিহাসিকভাবে বিকাশমান সম্পর্কের সত্ত্বা হিসেবে এটিকে দেখা- এই বিজ্ঞানীদের জন্য এটি বিশেষভাবে সহায়ক নয়। ঐ একটি এনজাইমের ওপর কাজকরণে তাঁরা অধিকতর সামর্থ্যবান যদি তাঁরা এটিকে উপজীব্য করেন এমনভাবে যেন এটি উদ্ভিদের বাদবাকী অংশ থেকে পৃথক।
জন প্যারিঙ্গটন একই ধরনের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যুক্তি দেন যে রিডাকশনিজমে, একটি ব্যবস্থাকে তার উপাদানসমূহে ব্যবচ্ছেদকরণ এবং সেগুলোর স্বাতন্ত্রিক অধ্যয়ন দিয়ে এই ব্যবস্থাটিকে সবচেয়ে ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়-এই বিশ্বাসটি মনুষ্য উর্বরতার আণবিক জীববিজ্ঞানে তাঁর নিজের গবেষণায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার প্রদান করে। যাহোক, রিডাকশনিজম এর উপযোগীতার সীমায় পৌঁছে যখন এটি চেষ্টা করে কীভাবে এর অন্তর্দৃষ্টিসমূহ একটি বিস্তৃত চিত্রের সাথে উপযোগী হয়ে অর্থপূর্ণ হয়। এটি বিশেষত সমস্যাকীর্ণ হয় যখন জীববিজ্ঞানীয় গবেষণার সামাজিক তাৎপর্য্যনিচয় (ংড়পরধষ রসঢ়ষরপধঃরড়হং) ব্যাখ্যাকরণ প্রচেষ্টায় ব্যবহারকৃত হয়- যখন এটি একটি পদ্ধতি থেকে একটি ভাবাদর্শে রূপ লাভ করে।
লেভিন্স ও লিয়োন্টিন এবং স্টেভান রোজের মতন স্বল্প কয়েকজন দ্বান্দ্বিক জীববিজ্ঞানীবৃন্দ, এদের সবার প্রতি দ্বান্দ্বিকতার একটি নমনীয় সংস্করণ অনুসরণের অভিযোগ রয়েেেছ। ক্রিস হারমান যুক্তি দেন যে যদি আমরা প্রকৃতিতে এই হেগেলিয় নিয়মাবলী প্রমাণের প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন না করি, বিশেষত নেতির নেতিকরণে, আমরা একটাকিছু কেন্দ্রীয় মিস করি। হারমান যুক্তি দেন যে জীবন্ত সত্ত্বাসমূহ কেবলমাত্র তাদের পরিবেশসমূহের সাথেই সম্পর্কিত নয়, তারা ঐ পরিবেশসমূহ দিয়ে নেতিকৃত। যে পদ্ধতিতে তারা ফিরতি প্রতিক্রিয়া করে ঐ পরিবেশসমূহে, সেটিকে বিবেচনা করা উচিত নেতির নেতিকরণের একটি উদাহরণ হিসেবে। হারমানের জন্য, পরিবেশের ওপর ক্রিয়াকরণের সামর্থ্য অনেক প্রকারের জীবন্ত সত্ত্বাসমূহের মাঝে খুবই সাধারণ। কিন্তু লেভিন্স ও লেয়োন্টিন থেকে পৃথকভাবে তিনি যুক্তি দেন যে কেবলমাত্র যাদের মধ্যে সচেতনতা (consciousness) বিকশিত, যেমন মনুষ্যজন, তাদেরকে গণ্য করা যেতে পারে অস্তিত্বায়িত বিষয় থেকে অস্তিত্বায়িত বিষয়ীতে (being objects to being subjects)। অন্ধ প্রত্যুত্তর সহ আমাদের পরিবেশে কেবলমাত্র প্রতিক্রিয়া সংঘটনের থেকে বরং আমাদের চারপাশের দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে মানুষের সামর্থ্য বিদ্যমান।
ক্রিস্টোফ নেইয়ারস (Christof Niehrs) একজন জার্মান ভ্রুণতত্ত্ববিদ, একটি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে জীববিজ্ঞানের প্রক্রিয়া এবং হেগেলের নিয়মাবলীর মধ্যেকার আনুষ্ঠানিক সাদৃশ্য তিনি বিশদভাবে লক্ষ্য করেন। খুবই প্রাথমিক সময়ে পশু ভ্রুণসমূহ কীভাবে বিকশিত হয়, তা তিনি পর্যবেক্ষণ করেন, কোষসমূহের একটি বলের অস্তিত্বায়ন থেকে একটি প্রত্যাভিজ্ঞেয় ভ্রুণে রূপান্তরণের অনেক পূর্বেই। কোষসমূহ কর্তৃক মোরফোজেনস নামক রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিঃসরিত হয় ভ্রুণের এক পার্শ্বে। মেরুদন্ডী প্রাণিসমূহে এই পার্শ্বের বিকাশায়ন শুরু হয় যাতে এই পার্শ্বটি হয়ে ওঠে স্পাইনাল কর্ড থাকা পার্শ্ব (ডোর্সাল সাইড)। এগুলো তখন বিপরীত পার্শ্বের দিকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিঃসরণের সূত্রপাত করে যা মোরফাজেনসমূহের প্রথম গ্রুপের উৎপাদনের বিপরীতে কাজ করে (এটিকে নেতিকৃত করে)। এগুলো পালাক্রমে পৃষ্ঠীয় দিকে (at the dorsal side) নেতিকৃত হয়। প্রাণি বিকাশে এটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি। এটি একটি প্রক্রিয়া উম্মুক্ত করে যেটি পরিণামে একটি প্রাণির গঠনের দিকে ধাবিত হয়, যেটিতে কোষসমূহের একটি সমসত্ত্ব সমাহারের পরিবর্তে বরং একটি হেড এন্ড ও একটি টেইল এন্ড বিদ্যমান থাকে। এবং এটি কদাচিৎ নেতির নেতিকরণের সাথে অধিকতর সদৃশ হতে পারে।
যাহোক, প্রকৃতিতে হেগেলের আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণসমূহ লক্ষ্য করে যথেষ্ট যোগসূত্র পাওয়া যায় না, যাতে কীভাবে বিজ্ঞানীবৃন্দ এই নিয়মাবলী আদৌ ব্যবহার করতে পারে। যদি বিজ্ঞানীবৃন্দ এই ধারণা থেকে শুরুকরণে প্রত্যাশা করেন যে তাঁরা বাইরে যাবেন এবং তাঁদের কাজে নিয়মাবলীর উদাহরণসমূহ অন্বেষণ করবেন (যেটি ক্রিস হারমান অনুমোদন দেননি), তাহলে এটি দ্বান্দ্বিকতাকে একটি বৃদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। উল্লেখিত সকল বিজ্ঞানীবৃন্দ বিবৃত করেন যে যখন তাঁরা ল্যাবে যান তখন অন্যরা যা করেন সেইভাবেই একই পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে একই বিজ্ঞান তাঁরা করেন। ঐ পরীক্ষণসমূহ না করার কৈফিয়তের পরিবর্তে বরং তাঁদের পরীক্ষণসমূহের ফলাফল ব্যাখ্যাকরণে দ্বান্দ্বিকতা তাঁদের জন্য এক উপায়। সুনির্দিষ্ট বস্তুগত প্রপঞ্চগুচ্ছের (material phenomena) জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য দ্বান্দ্বিকতার নিয়মাবলী জানার কোনো বিকল্প নেই।
উপসংহার
বিজ্ঞান ও প্রকৃতি থেকে উদাহরণ ব্যবহার করে আমরা প্রায়ই দ্বান্দ্বিকতা ব্যাখ্যা করি। কিন্তু একটি অভিমত প্রচলিত আছে যে এই সমস্ত ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতা প্রাসঙ্গিক, এটি সার্বিকভাবে গৃহিত হয়নি। অনেক মার্কসবাদী প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি ঐতিহ্য বিদ্যমান আছে যেটি পুঁজিতান্ত্রিক ভাবাদর্শের অংশ হিসেবে সমাজ থেকে প্রকৃতির পৃথককরণ দেখে। আমরা যদি সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যকার বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করি এবং একমত পোষণ করি যে দ্বান্দ্বিকতা সমাজ সম্পর্কে কিছু একটা দেখায়, তখন কী আমরা সাঙ্গতিকভাবে য্ুিক্ত প্রদর্শন করতে পারি যে প্রকৃতি সম্পর্কে এর বলার কিছু নেই?
মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিকতা একটি বস্তুবাদী দর্শন। এটি দুনিয়াকে এমনভাবে বিবেচনা করে যেন এটি পরিবর্তনশীল, কারণ এটির পরিবর্তন সংঘটিত হয়, এবং পরস্পর-বিরোধাত্মক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এটি পরস্পরবিরোধী। প্রাকৃতিক জগৎ প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৯৫৮এ পরিমাপ আরম্ভ হওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম বারের মতন বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনমাত্রা ৪০০ পিপিএম অতিক্রম করেছে। বায়ুমন্ডলে গ্যাসের লেভেলসমূহ উঠা-নামা করে, কিন্তুু এটি সম্ভব যে তারা শীঘ্র একটা পর্যায়ে পৌঁছবে যেখানে তারা একমূখী পরিবর্তনের কারণ সংঘটিত করবে। যদি সাইবেরিয় পারমাফ্রস্টের গলন শুরু হয়, বিজ্ঞানীবৃন্দ অনুমান করেন যে এটি ফ্রস্টের অভ্যন্তরস্থ আটকে পড়া মিথেনের নিঃসরণের দিকে ধাবিত করতে পারে। মিথেনও একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের থেকেও অধিকতর শক্তিশালী, সুতরাং এটি অধিকতর উষ্ণায়নের দিকে ধাবিত করতে পারে এবং সম্ভবত এতে আরো অবদান রাখে এবং ফ্রস্টের গলন সংঘটিত করে। এমনটি নয় যে দুনিয়া আর কখনো পূর্বে এই রকম উষ্ণ হয়নি, এটি অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু এই ফলাফলসহ বাসকৃত জনগণের জন্য এটি ধ্বংসাত্মক পরিণাম বয়ে আনবে। মনুষ্যজন এই পরিবর্তনসমূহ সংঘটিত করছে এবং আমাদের সমাজসমূহের সাথে সম্পর্কস্থাপন ব্যতিরেকে সেগুলো সংবেদ্যতার সঙ্গে উপলব্ধি করা যাবে না।
আমাদের বাসকৃত দুনিয়ার বাস্তবতা উপলব্ধিকরণকে পৃথক পৃথক উপাদানসমূহে বিভক্ত করা যেতে পারে এবং যেন এতে বিদ্যমান সবকিছু একই রকম থাকে, এতে আমরা আমাদের উপলব্ধি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে পড়ে যাই। কিন্তু আমরা মার্কসবাদীগণ কেবলমাত্র দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যা করি নে; আমরা ঐ বাস্তবতাকে পরিবর্তন করি। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির সাথে আমাদের চলতি সন্দেহযুক্ত চিড়কে (problematic rift with nature) দেখে শ্রেণী সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সবকিছুর মতন একটা কিছু যা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
৯ জানুয়ারি ২০১৪এ পোস্টকৃত, ইন্টারন্যাশনাল সোস্যালিজম অনলাইন, সংখ্যা ১৪১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন